১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

হিন্দু ভদ্রলোক

বাঙলার হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় এখনও হিন্দুসমাজের মস্তিষ্কস্বরূপ, একথা বোধ হয় কেহই অস্বীকার করিবেন না। সুতরাং ইহাদের মঙ্গলামঙ্গলের উপর বাঙলার হিন্দুসমাজের শুভাশুভ অনেকখানি নির্ভর করে। বৃটিশ শাসনের আরম্ভে এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ই সৰ্ব্বপ্রথমে ইংরাজী শিক্ষালাভ করে এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। সমুদ্রমন্থনে যেমন অমৃত ও হলাহল দুই-ই উঠিয়াছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্ঘর্ষে আসিয়া হিন্দুসমাজের পক্ষেও সেই অবস্থা ঘটিয়াছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতার সংস্পর্শে যে নবজাগরণের ভাব হিন্দুসমাজ এবং তাহার মধ্য দিয়া সমগ্র দেশে আসিয়াছে, তাহাত আমরা চোখের উপরেই দেখিতেছি। গত এক শতাব্দী ধরিয়া জ্ঞানে বিজ্ঞানে, সামাজিক সংস্কারে, রাজনৈতিক আন্দোলনে দেশে একটা সাড়া পড়িয়া গিয়াছে এবং প্ৰধানত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রসম্প্রদায়ই এ বিষয়ে নেতৃত্ব করিয়াছে। কবি, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাসংস্কারক; সমাজসংস্কারক, জাতীয় আন্দোলনের প্রবৰ্ত্তক, রাজনৈতিক নেতা ইহাদের মধ্য হইতেই হইয়াছে। নবযুগের বাঙালী জাতি যাহা কিছু শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির গর্ব্ব করে তাহা এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়েরই দান, একথা অস্বীকার করিলে অকৃতজ্ঞতা হইবে। আজ যে বিশাল বাঙলা সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে এবং বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করিয়াছে, তাহাও প্ৰধানত এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি। সুতরাং এই দিক দিয়া হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় কেবল স্ব-সমাজের নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির, এমন কি সমগ্ৰ ভারতীয় মহাজাতির কল্যাণ সাধন করিয়াছে ।


কিন্তু সমুদ্রমন্থনে যে হলাহল উঠিয়াছে, তাহাও আজ প্ৰধানত এই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়কেই পান করিতে হইতেছে। পাশ্চাত্যশিক্ষা লাভ করিয়া হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় দেশ ও জাতির একদিক দিয়া মহৎ কল্যাণ সাধন করিয়াছে বটে, কিন্তু নিজেরা আজ বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কট তথা ধ্বংসের মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে যে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্ৰবৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, তাহার মূলে বিশেষ কোন মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁহাদের উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশের শাসনকাৰ্য্যে সহায়তা করিতে পারে এমন একদল লোককে তৈরী করা। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাপ্রণালী প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছিল, তাহার মূলে ছিল ঐ সহকারীর দল তৈরী করার অভিপ্ৰায়। তাই গত এক শতাব্দী ধরিয়া সরকারী এবং তাহারই আদর্শে পরিচালিত বে-সরকারী শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠানসমূহ হইতে প্ৰধানত ডেপুটি, মুন্সেফ, ইস্কুল মাস্টার, উকীল, মোক্তার, কেরাণী, গোমস্তার দল বাহির হইয়াছে। যে ২|৪ জন অন্য ধরণের মানুষ তৈরী হইয়াছে, তাহা এই শিক্ষা প্ৰণালীকে অতিক্রম করিয়াই হইয়াছে বলিলে অত্যুক্তি হয় না।


সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীর লোভে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় গত এক শতাব্দী ধরিয়া প্ৰাণপণে ইংরাজীশিক্ষা লাভ করিয়াছে। প্ৰথম প্রথম ইংরাজী শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা অল্প ছিল, সুতরাং সরকারী চাকুরী পাওয়াও সহজ ছিল। উকীল, মোক্তার প্রভৃতি হইয়াও বেশ দুপয়সা উপাৰ্জন করা যাইত। সুতরাং হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় অন্য সমস্ত ত্যাগ করিয়া, এমন কি গ্রামভিটা জমিজমা ছাড়িয়া ইংরাজী শিক্ষণ এবং সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীর পিছনে ছুটিয়াছে। আজ এক শতাব্দী পরে দেখিতেছি, মরীচিকার পশ্চাতে ছুটিয়া আমরা মরুভূমিতে প্ৰাণ হারাইতে বসিয়াছি। পাশ্চাত্য শিক্ষার কারখানা হইতে দলে দলে যে সব যুবক বাহির হইয়া আসিতেছে, তাহারা কোন সরকারী বা আধাসরকারী চাকুরী পাইতেছে না,—ওকালতী, মোক্তারী প্ৰভৃতি করিয়াও জীবিকানিৰ্বাহ করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে; পক্ষান্তরে যে শিক্ষা তাহারা লাভ করিতেছে, তাহাতে জীবনসংগ্রামে অন্য কোন ক্ষেত্রেও তাহারা আত্মরক্ষার যোগ্যতা অর্জন করিতেছে না। ইতিমধ্যে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের ঔদাসীন্য ও আত্মবিস্মৃতির সুযোগ লইয়া বিদেশী ও ভিন্ন প্ৰদেশবাসীরা আসিয়া বাঙলার ব্যবসাবাণিজ্য হস্তগত করিয়া ফেলিয়াছে। সুতরাং অবস্থা সব দিক দিয়াই ঘোরাল হইয়া উঠিয়াছে, হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিয়াছে। এই সঙ্কটের সমাধানের উপায় যদি এখন হইতেই করা না যায়, তবে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় ভবিষ্যতে লুপ্ত হইয়া যাইবে, এমন আশঙ্কার কারণও আছে।


এই সঙ্কট সমাধানের উপায় কি ? প্ৰবীণ ও বিশেষজ্ঞেরা বলিতেছেন যে, বৰ্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালীরই আমূল পরিবর্ত্তন করিতে হইবে। এখন যে ‘কেতাবী শিক্ষা’ দেওয়া হইতেছে, তাহাতে বৰ্ত্তমানের কঠোর জীবন সংগ্রামে শিক্ষিত যুবকদের অন্নসমস্যার সমাধান হইতে পারে না। এমন শিক্ষা প্ৰণালীর প্ৰবৰ্ত্তন করিতে হইবে, যাহাতে ব্যবহারিক বিজ্ঞান, বৈজ্ঞানিক কৃষি ও শিল্পশিক্ষাই হইবে প্ৰধান অঙ্গ। বৰ্ত্তমান যুগে অন্যান্য সভ্যদেশেও এইরূপ শিক্ষা প্ৰণালী প্ৰবৰ্ত্তিত হইয়াছে। যদি আমাদের দেশে এইরূপ শিক্ষাপ্রণালী প্ৰবৰ্ত্তিত করা যায়, তবে যুবকেরা সরকারী চাকুরী, কেরাণীগিরি প্রভৃতির মোহ ত্যাগ করিয়া শিল্পবাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করিবার সুযোগ পাইবে। আমাদের মতেও বাঙলার হিন্দু ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষে পুরাতন কেতাবী শিক্ষা ও সরকারী চাকুরীর পথ পরিত্যাগ করিয়া কৃষি, শিল্পবাণিজ্য, ব্যবসা প্ৰভৃতি অবলম্বন করা অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে। অন্যান্য দেশের ন্যায় এ দেশেও সরকারী ও আধা সরকারী চাকুরীতে সামান্য সংখ্যক লোকেরই প্রয়োজন হয়। একটা সম্প্রদায় বা শ্রেণী কেবল উহারই উপর নির্ভর করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে পারে না। তাহার উপর এ দেশে সম্প্রতি রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে হিন্দু ভদ্রলোকদের পক্ষে সরকারী চাকুরী পাওয়া খুবই কঠিন হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ভবিষ্যতে আরও হইবে। সুতরাং হিন্দু ভদ্রলোকেরা যদি সময় থাকিতে জীবনের গতি পরিবর্ত্তন না করে, তবে তাহাদের ভবিষ্যৎ নিতান্তই অন্ধকারময় হইবে সন্দেহ নাই।


কিন্তু নূতন পন্থা অবলম্বনের পথে কতকগুলি প্ৰবল বাধা আছে। প্রথমত শিক্ষাপ্রণালীর আমূল পরিবর্ত্তন করিতে হইলে,-ব্যবহারিক বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, কৰ্ম্মশালা প্ৰভৃতি স্থাপন করিতে প্রচুর অর্থ ও উদ্যোগ আয়োজনের প্রয়োজন। কেবলমাত্র দেশের গবর্ণমেণ্টই এই কাৰ্য্য করিতে সক্ষম, যদিও দেশবাসীর সহানুভূতি ও সহযোগিতা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বৰ্ত্তমানে গবৰ্ণমেণ্টের দ্বারা এই কাৰ্য্য হওয়ার সম্ভাবনা অতি কম। দ্বিতীয়ত, কতকগুলি যুবককে কেবলমাত্র ব্যবহারিক বিজ্ঞান, কৃষি-শিল্প ইত্যাদি শিক্ষা দিলেই সমস্যার সমাধান হইবে না। ঐ শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকেরা উপযুক্ত কৰ্ম্ম সংগ্ৰহ করিতে পারিবে কিনা, তাহাও চিন্তা করিতে হইবে। দেশের বর্তমান অবস্থায় এই শ্রেণীর শিক্ষিত যুবকদের কৰ্ম্মক্ষেত্ৰ বড় বেশী নাই। সেজন্য দেশে নূতন নূতন শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়িতে হইবে, বৈজ্ঞানিক কৃষি প্ৰভৃতির প্ৰবৰ্ত্তন করিতে হইবে। গ্রামে গ্রামে কুটীর শিল্প যতদূর সম্ভব পুনরুজ্জীবিত করিয়া তোলাও একটা উপায়। কিন্তু এই সমস্ত উপায়ও বহুল পরিমাণে গবৰ্ণমেণ্টের সাহায্য ও সহযোগিতার উপর নির্ভর করে। দেশে যে সব হিন্দু ধনী ও ব্যবসায়ী ব্যক্তি আছেন, তাহারা যদি নূতন নূতন শিল্প-বাণিজ্য গঠনে অধিকতর অর্থ নিয়োগ করেন, তাহা হইলে অবস্থার অনেক পরিবর্ত্তন হইতে পারে বটে।



বলা বাহুল্য, এ সমস্ত ২|৪ দিন বা ২|৪ মাসের কাজ নয়, কতকগুলি লোক খেয়ালমাফিক একটা কিছু করিলেও চলিবে না। একটা অর্থনৈতিক “পরিকল্পনা” করিয়া সঙ্ঘবদ্ধ প্ৰণালীতে এই কাজ করিতে হইবে। জাতির মনে যদি শুভবুদ্ধি জাগে এবং শক্তিশালী, প্রতিভাবান, দূরদর্শী লোকেরা এইসব কাৰ্য্যের নেতৃত্ব গ্ৰহণ করেন, তবেই ইহা সম্ভবপর হইতে পারে। যতদিন তাহা না হইতেছে ততদিন হিন্দু ভদ্রসম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ আশাপ্ৰদ বলিয়া মনে করিতে পারি না। অদূরে ভবিষ্যতেই বিষম অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে তাহাদের সংগ্ৰাম করিতে হইবে। জয়পরাজয় অনিশ্চিত।
এস্থলে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, বাঙালী হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসনের প্রথম হইতেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছড়াইয়া পড়িয়া সরকারী ও আধা-সরকারী চাকুরীর প্রধান অংশ দখল করিয়াছিল। কিন্তু বৰ্ত্তমানে অন্যান্য প্রদেশের লোকেও ইংরাজী শিক্ষা লাভ করিয়া বাঙালীর সঙ্গে প্ৰতিযোগিতা করিতেছে। সুতরাং বাঙালীর পক্ষে অন্যান্য প্রদেশেও কাজ পাওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়াইতেছে। অন্যান্য প্রদেশে যে “বাঙালী বিদ্বেষ” দেখিতে পাই, তাহার মূলে প্ৰধানত এই অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান।


এই সঙ্গে আরও একটী চিন্তার বিষয় আছে। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে হইতেই হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ জমিদার ও ভূস্বামীরূপে গ্রামে বাস করিতেন। ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সেই পুরাতন জমিদারদের মধ্যে অনেককে স্থায়িত্বদান করে এবং নূতন নূতন জমিদার জোতদার, পত্তনীদার, তালুকদার প্রভৃতি নানা মধ্যস্বত্বভোগীর সৃষ্টি করে। গত দুই শত বৎসর ধরিয়া এই সব হিন্দু জমিদার, তালুকদার ও জোতদার প্রভৃতি বাঙ্গলার হিন্দুসমাজের উপর নানাদিক দিয়া প্রভাব বিস্তার করিয়াছে।1



সেকালে বাঙলার গ্রামে হিন্দু জমিদারেরাই ছিলেন অনেক স্থলে সমাজের শীর্ষস্থানীয়। জমিদারদের দোষ ক্ৰটী অনেক ছিল বটে, প্রজাদের উপর তাঁহারা অনেক সময় উৎপীড়ন করিতেন, একথাও সত্য। কিন্তু জমিদারদের গুণও যে কিছু ছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। লোকের উপকারের জন্য তাঁহারা বহু সৎকাৰ্য্য করিতেন, আপদে বিপদে প্রজাদের সাহায্য করিতেন, প্ৰজারাও তাঁহাদিগকে “মা বাপ” বলিয়াই জানিত। জমিদারদের বাড়ীতে দোল দুর্গোৎসব পূজা অনুষ্ঠানে, বিবাহ শ্রাদ্ধ ইত্যাদিতে গ্রামের দরিদ্র প্রজারা নিঃসঙ্কোচে যোগ দিত। উহার ফলে তাহারা আর্থিক দিক দিয়াও উপকৃত হইত। শিক্ষাবিস্তারেও জমিদারের কম সাহায্য করিতেন না। সেকালের পাঠশালা, টোল প্ৰভৃতি তাঁহাদের সাহায্যেই চলিত। একালেও বহু ইংরাজী, বিদ্যালয় তাঁহাদের অর্থসাহায্যেই প্ৰতিষ্ঠিত হইয়াছে। এক কথায় জমিদারেরা ছিলেন প্রাচীন হিন্দু সমাজের ধুরন্ধর ।2 কিন্তু ব্রিটিশ আমলে কলিকাতা প্রভৃতি বড় বড় শহর যখন গড়িয়া উঠিল, তখন জমিদারেরা গ্রাম ত্যাগ করিয়া শহরে বাস করিতে আরম্ভ করিলেন।


 গ্রামে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবও জমিদারদের গ্ৰামত্যাগের অন্যতম প্ৰধান কারণ। শহরে আসিয়া পাশ্চাত্য সভ্যতা ও বিলাসের মোহে তাহারা অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন এবং বিলাসময় ব্যয়বহুল জীবন যাপন করিতে লাগিলেন। ইহার ফলে অনেকেই ঋণগ্ৰস্ত হইয়া পড়িলেন। বহু জমিদারের সম্পত্তি ঋণের দায়ে বিকাইয়া গেল, অনেকের সম্পত্তি ২|৪ বিঘা লাখেরাজ জমিতে মাত্ৰ পর্য্যবসিত হইল। তাঁহাদের প্রাচীন গ্ৰাম্যজীবনের ধারা লুপ্ত হইয়া গেল, গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁহাদের সম্পর্কও ক্রমে ক্রমে ছিন্ন হইল। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাঙলার হিন্দু জমিদারদের এই “সহরাভিযান” আরম্ভ হইয়াছে এবং এখনও উহার জের পুরাদমে চলিতেছে। ইহার ফলে একদিকে জমিদারেরা লোপ পাইতে বসিয়াছে, অন্যদিকে গ্ৰাম্য হিন্দুসমাজও সাধারণভাবে যে ক্ষতিগ্ৰস্ত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই ।3 জমিদারদের যেটুকু প্রভাবপ্রতিপত্তি ছিল, বাঙ্গলার বর্ত্তমান শাসকগণের নূতন নীতির ফলে তাহাও নিঃশেষ হইবে, আশঙ্কা হয়। ইহার উপর যদি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উঠিয়া যায়, তবে হিন্দু জমিদারসম্প্রদায় একেবারে উৎখাত হইয়া যাইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য লোক কৰ্ম্মহীন হইয়া পড়িবে। ইহার ফলে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের যে গুরুতর ক্ষতি হইবে, তাহা বলা বাহুল্য মাত্ৰ।
পক্ষান্তরে জমিদারী প্রথার যে অনেক দোষ আছে, বৰ্ত্তমান যুগে উহা নানা কারণে টিকিতে পারেনা, ইহা আমরা জানি। এই জমিদারী প্রথার জন্য বাঙলার বহু লক্ষ টাকার মূলধন নিষ্ফলভাবে জমিতে আটক হইয়া আছে, ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত হইয়া জাতির সম্পদ বৃদ্ধি করিতে পারিতেছে না। তার পর এই প্রথার ফলে কতকগুলি অলস, বিলাসী, চরিত্রহীন, অকৰ্ম্মণ্য লোকের সৃষ্টি হইয়াছে এবং বর্ত্তমানে অধিকাংশ প্রাচীন বনিয়াদী হিন্দু জমিদার বংশের নৈতিক অধঃপতন ঘটিয়াছে। কিন্তু এই প্রথা উঠিয়া গেলে বাঙ্গলার মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনে যে একটা ওলটপালট হইবে, তাহাতেও সন্দেহ নাই, কেননা ইহার উপর ভিত্তি করিয়াই গত কয়েক শতাব্দীতে বাঙ্গলার গ্ৰাম্যজীবন গড়িয়া উঠিয়াছে। সুতরাং কি উপায়ে সেই প্ৰতিক্রিয়া রোধ করা যাইতে পারে, অন্য কোন নূতন ভিত্তির উপর সমাজজীবনকে গড়া যাইতে পারে কিনা, এখন হইতেই তাহা চিন্তা করিতে হইবে।4 আমাদের মনে হয়, দেশে নূতন নূতন শিল্পবাণিজ্য প্ৰবৰ্ত্তন ও গঠনের দিকে হিন্দু ভদ্রলোক ও জমিদারদের এখন হইতেই আত্মনিয়োগ করিতে হইবে, জমিদারী ও মধ্যস্বত্ব ভোগের মোহ তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে। সময় থাকিতে প্ৰস্তুত না হইলে তাহাদের পক্ষে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। আরও আশঙ্কার কথা, বর্ত্তমান শাসকগণ যে সাম্প্রদায়িক নীতি অবলম্বন করিয়াছেন এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে যেসব আইন কানুন প্রণয়ন করিতেছেন,5 তাহাও হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের বিলোপে সহায়তা করিবে। বর্তমান মন্ত্রীমণ্ডলের কর্ণধারদের এইরূপ কোন গূঢ় অভিপ্ৰায় আছে কিনা জানিনা, কিন্তু যেভাবে তাঁহারা অগ্রসর হইতেছেন, তাহাতে হিন্দু ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ আশঙ্কাপূৰ্ণ বলিয়াই মনে হইতেছে।

• Report of the Land Revenue Commission of Bengal 1940.↩

• মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর দানের পরিমাণ ৩ কোটি টাকা । কেবলমাত্র শিক্ষা বিস্তারে বর্ধমানরাজের দান ২৫ লক্ষ, মৈমনসিংহ গৌরীপুরের জমিদারের দান ১২ লক্ষ, দিঘাপাতিয়ারাজের ৫ লক্ষ, চকদিঘী ৫ লক্ষ, লালগোলা ৪ লক্ষ, পুঁটিয়া ২ লক্ষ, উত্তরপাড়া ৬ লক্ষ ৫০ হাজার, মহারাজা মৈমনসিংহ ৯ লক্ষ, সন্তোষ ২ লক্ষ ইত্যাদি (Land Revenue Commission, vol.III দ্রষ্টব্য) ।ーলেখক↩

• আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ’আত্মজীবনী’তে জমিদারের এই শহরাভিযান সম্বন্ধে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য ও সুচিন্তিত মন্তব্য আছে ।ーলেখক↩

• Land Revenue Commision তাঁহাদের রিপোর্টে পরামর্শ দিতেছেনー১) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা উঠাইয়া দিতে হইবে । ২)গবর্নমেন্টের পক্ষ হইতে ক্ষতিপূরণ দিয়া জমিদারীগুলি ক্রয় করিয়া প্রজাদের সঙ্গে সরাসরি বন্দোবস্ত করিতা হইবে । এই Report পরীক্ষা করিয়া বাংলা গবর্নমেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত গার্নার সাহব তাহাদের নিকট যে প্রস্তাব দাখিল করিয়াছেন, তাহাতে জমিদারী প্রথা উঠাইয়া দিবার পক্ষে যে সব প্রবল বাধা আছে, তাহা প্রদর্শন করা হইয়াছে । গবর্নমন্টের পক্ষ হইতে দশ গুণ কি ১৫ গুণ মূল্য ক্ষতিপূরণ দিয়া যধি সমস্ত জমিদারী ক্রয় করিতে হয়, তবে সে অর্থ কোথা হইতে আসিবে, তাহাও গার্নার সাহেবের মতে বিবেচ্য ।ーলেখক↩

• যেমন কাপড় রেশনিংয়ের সময় হিন্দু ও মুসলমানদের সমান সমান দোকান হইতেছে, যদিও দোকানীদের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের অনুপাত ১২ : ১ । ফলে হিন্দু দোকান উঠিয়া যাইতেছে, মুসলমানদের দোকান হইতেছে ।ーলেখক↩

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।