১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সমাজ ও সাহিত্য—২

এইবার অতি-আধুনিক বাঙ্গলা সাহিত্য সম্বন্ধে আমরা দুই একটা কথা বলিব। তরুণেরা এই সাহিত্যের নানা বিচিত্ৰ মনোহর নাম দিয়া থাকেন। যথা—অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য, রবীন্দ্রোত্তর বাঙলা সাহিত্য, যুদ্ধোত্তর বাঙলা সাহিত্য, সাম্প্রতিক সাহিত্য হত্যাদি। কিন্তু নামগুলি যতই গালভরা বা শ্রুতিমধুর হউক না কেন, জিনিষটা আসলে কি ? এই সাহিত্য কি জাতিকে কোন মৌলিক বলিষ্ঠ চিন্তার সন্ধান দিতে পারিয়াছে, অথবা সমাজকে কোন উন্নততর আদর্শ দেখাইতে পারিয়াছে ? প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মনের সঙ্ঘর্ষে উনবিংশ শতাব্দীতে যে নূতন বাঙলা সাহিত্যের জন্ম হইয়াছিল, তাহার মধ্যে শক্তি ছিল, তেজ ছিল, চিন্তার মৌলিকতা ও সজীবতা ছিল, একটা বলিষ্ঠ পৌরুষের ভাব তাহার মধ্যে আমরা দেখিতে পাই। কিন্তু অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য কেবল চিন্তার মৌলিকতা বা সজীবতার দিক হইতেই নিকৃষ্ট নহে,—একটা অবসাদগ্ৰস্ত, অতৃপ্ত ভোগবিলাসকামী, পৌরুষহীন, নিস্তেজ মনের শোচনীয় বিকাশ ইহার মধ্যে দেখিয়া জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমরা হতাশ হইয়া উঠি।


এই অতি-আধুনিক সাহিত্যিকেরা নিজেদের বাস্তববাদী বলিয়া গৰ্ব্ব করিয়া থাকেন এবং রবীন্দ্রনাথকে পৰ্য্যন্ত অত্যধিক আদর্শবাদী ভাববিলাসী বলিয়া অভিহিত করিতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু দেশ ও জাতির রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, এমন কি পারিবারিক জীবনের সঙ্গে এই নূতন সাহিত্যের কোন সম্বন্ধ আছে বলিয়া মনে হয় না। আলোকলতার যেমন মূল নাই, শূন্যে ঝুলিয়া থাকে, এই অতি-আধুনিক সাহিত্যও তেমনি সমসাময়িক জীবন হইতে যেন কোন রসধারা সংগ্ৰহ করিতে পারে না। পরাধীনতার জ্বালা, স্বাধীনতার তীব্ৰ আকাঙ্ক্ষা, অগণিত নরনারীর দারিদ্র্যপূর্ণ দুর্ব্বহ জীবনভার, প্রাণহীন সমাজের অশেষ গ্লানি ও নৈরাশ্য—অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে এই সমস্তের কোন প্ৰতিধ্বনি আমরা শুনিতে পাই কি ? এই সাহিত্যে যে সমস্ত নরনারীর চিত্র অঙ্কিত হয় তাহারা এ দেশের বা সমাজের নয়,—তাহাদের চিন্তা, ভাবনা, চরিত্রের সঙ্গে আমাদের চারদিককার পরিচিত নরনারীর কোন মিল নাই। ইহাদের পরিকল্পিত “বালিগঞ্জ সমাজ” বৈষ্ণবদের “মানস বৃন্দাবনের” মত কল্পনা ও ভাববিলাসের রাজ্যেই বৰ্ত্তমান। একথা কেহ অস্বীকার করে না যে, উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী হিন্দু সমাজ যেখানে ছিল, এখন আর সেখানে নাই, কালচক্রের আবৰ্ত্তনে আমরা বহু দূর চলিয়া আসিয়াছি। আমাদের সম্মুখে আজ জীবনসংগ্রাম কঠোরতর মূৰ্ত্তিতে দেখা দিয়াছে, নূতন নূতন সমস্যা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইতেছে, পৃথিবীর চারিদিক হইতে নানা বিচিত্ৰ চিন্তা ও ভাবের তরঙ্গ আসিয়া আমাদিগকে আঘাত করিতেছে। যদি অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে এই সমস্ত সমস্যার ছায়াপাত দেখিতাম, ঐ গুলির সম্মুখীন হইবার একটা প্ৰচেষ্টা এইসব নবীন লেখকদের রচনার মধ্যে ফুটিয়া উঠিত, তাহা হইলে আমরা আনন্দিত হইতাম। কিন্তু তাহার কোন লক্ষণ আমরা এই সাহিত্যে দেখিতে পাই না।


প্রশ্ন হইতে পারে, তাহা হইলে এইসব অতি-আধুনিক লেখকদের উদ্ভট ও অস্বাভাবিক কল্পনার মূল উৎস কোথায়, এই সব কৃত্রিম ও অবাস্তব নরনারীর চিত্ৰ কোথায় ইহারা পাইল ? ইহার সন্ধান করিতে হইলে গত মহাযুদ্ধের পরবর্ত্তী ইউরোপীয় সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে হইবে। মহাযুদ্ধের পর ইউরোপের অধিকাংশ দেশে সমাজ ও সভ্যতার একটা বিপৰ্য্যয় ঘটিয়াছিল, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল। পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যে সত্য ও নীতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, কঠোর নিৰ্ম্মম আঘাতে তাহার ভিত্তি ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। ইহার ফলে মানুষের জীবপ্রকৃতির আবরণ খুলিয়া গিয়া উহা একেবারে নগ্ন হইয়া পড়িল।

 নরনারীর সম্বন্ধের মধ্যে যে আদিম যৌনপ্রবৃত্তি এতকাল কতকটা সুপ্ত ও সংঘাত ছিল, নীতির বন্ধন হইত বিচ্ছিন্ন হইয়া উহা উচ্ছৃঙ্খল বীভৎস মূৰ্ত্তিতে দেখা দিল। ইউরোপীয় যুদ্ধোত্তর সাহিত্য এই উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল, বিপৰ্য্যস্ত সমাজেরই চিত্র অঙ্কনের কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়াছিল। ঐ রূপ সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে সমস্ত সমস্যা প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, এই নূতন সাহিত্যে তাহারই ছায়াপাত হইয়াছিল। যে সব নরনারী এই নূতন সামাজিক পরিবেশের মধ্যে আবির্ভূত হইয়াছিল, যুদ্ধোত্তর সাহিত্যে তাহারাই প্রধান অভিনেতা। আমাদের দেশের অতি-আধুনিক সাহিত্যিকেরা ইউরোপের এই যুদ্ধোত্তর সাহিত্যেরই নকল করিয়া বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে যুগান্তর সৃষ্টি করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আসলে ও নকলে যে প্ৰভেদ হয়, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে। যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্য যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সমাজের বাস্তব চিত্ৰই আঁকিয়াছিল,—ঐ সাহিত্যের উদাম উচ্ছৃঙ্খল নরনারীরা নিছক কল্পনা রাজ্যের প্রাণী নহে, সত্যকার জীবন ও চরিত্রেরই প্ৰতিচ্ছবি। কিন্তু এ দেশের সাহিত্যে যখন ঐ সব নরনারীর চিন্তা, চরিত্র ও জীবন সমস্যার আমদানী করা হইল, তখন উচ্চা উদ্ভট অম্বাভাবিক কাল্পনিক চিত্ৰ মাত্ৰ হইয়া দাঁড়াইল।

ঐ সব নরনারীও আমাদের সমাজে নাই, তাহাদের সমস্যাও আমাদের নহে। তাই যে উচ্ছৃঙ্খল উদ্দাম নগ্ন পশু প্ৰবৃত্তির চিত্র আমরা অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে দেখি, তাহাতে ঘৃণায় শিহরিয়া উঠি, নিজের অন্তরেই লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া পড়ি। যদি মিথ্যা ও অবাস্তব বলিয়া একেবারে ফুৎকারে হাওয়ায় উড়াইয়া দিতে পারিতাম, তাহা হইলে আর এই সাহিত্য লইয়া এমন উদ্বেগের কারণ ঘটিত না। কিন্তু মিথ্যা ও অবাস্তবেরও একটা মোহিনী শক্তি আছে, মানুষের আদিম পশু প্ৰকৃতিকে উহা প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। ফলে সমাজ ও পরিবারের উপর উহার অনিষ্টকর প্রভাব ক্রমে বিস্তৃত হইয়া পড়ে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচির বিকৃতি ঘটে। অতি-আধুনিক বাঙলা সাহিত্য তাই আমাদের নিকট আশঙ্কার স্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এ সাহিত্য সমাজকে উন্নততর আদর্শ প্রদর্শন করা দূরে থাকুক, উহাকে নীচের দিকে টানিয়া লইবারই চেষ্টা করিতেছে। বাঙলার হিন্দুসমাজের পক্ষে ইহা নিশ্চয়ই আশার কথা নহে।

চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।