বাঙলাদেশে হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের সংখ্যাবৃদ্ধির আর একটি প্রধান কারণ, বহু হিন্দুর মুসলমানধৰ্ম্ম গ্ৰহণ। পাঠান যুগ হইতেই এই ব্যাপার চলিয়া আসিতেছে এবং এখনও চলিতেছে। প্ৰধানত দুইটি কারণে হিন্দুর এই ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণ সম্ভবপর হইয়াছে। প্রথমত হিন্দুসমাজের জাতিভেদ প্রথা, তাহার অনুদারতা ও সঙ্কীর্ণতা। পূৰ্ব্বে কয়েকটি প্রবন্ধে আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করিয়াছি। বহু বৌদ্ধ এবং প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধও যে হিন্দুসমাজের অত্যাচারে মুসলমানধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছে, ইহাও আমরা বলিয়াছি। দ্বিতীয়ত, মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রচারকদের প্রচারকাৰ্য্য। প্ৰধানত নিম্নজাতীয় হিন্দুরাই এই প্রচারকার্য্যের ফলে মুসলমান হইয়াছে এবং এখনও হইতেছে। রিজলী সাহেব ১৯০১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে বলিয়াছেন, পূর্ববঙ্গের ১ কোটি ৫০ লক্ষ মুসলমান হিন্দু সমাজের পোদ ও নমঃশূদ্র হইতে হইয়াছে। রিজলী সাহেবের এই মন্তব্যে সন্দেহ করিবার কোন কারণ নাই। যাহাদিগকে আমরা “অস্পৃশ্য ও অনাচরণীয়” করিয়া রাখিয়াছি, তাহারা যে প্ৰথম সুযোগেই মুসলমান ধৰ্ম্মের সাম্যবাদের আশ্রয় গ্ৰহণ করিবে, ইহা খুবই স্বাভাবিক। এই সম্পর্কে শ্ৰীযুত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত কৃত ‘বিক্রমপুরের ইতিহাসে’ (২য় সংস্করণ) কতকগুলি মূল্যবান তথ্য প্রদত্ত হইয়াছে।
একদিকে উপনিবেশ স্থাপন, অন্যদিকে ধৰ্ম্মপরায়ণ মুসলমান সাধুগণের উদার মত ও ধৰ্ম্মপ্রচারও মুসলমানাধিক্যের অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। শ্ৰীহট্টের মহাপুরুষ শাহ জালাল ৩৬০ জন আউলিয়া লইয়া আঁসিয়া শ্ৰীহট্টের নানাস্থানে ধৰ্ম্মপ্রচার করিতে আরম্ভ করেন । কেবল শ্ৰীহট্ট জেলার মধ্যেই যে ইঁহাদের প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল, তাহা নহে, সমগ্র পূর্ববঙ্গে ক্রমশ ইঁহাদের দ্বারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। বৰ্ত্তমান সময়ে পূর্ববঙ্গে যে সমস্ত সম্রাস্ত মুসলমান পরিবার আছেন, তন্মধ্যে এই আউলিয়াগণের বংশীয়দের কোন না কোনভাবে সম্পর্ক নাই, এমন অতি অল্পই দেখা যায়। বিজয়ী মুসলমানদের ধৰ্ম্মে তখন বহু লোক দীক্ষিত হইতে লাগিল। হিন্দু জাতি অতিশয় ধৰ্ম্মপরায়ণ হইলেও, তৎকালে অর্থাৎ সেই রাষ্ট্র বিপ্লবের যুগে, ধৰ্ম্মবন্ধন যে শিথিল হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।…..এই অবস্থায় সমাজের মধ্যে যাহাদের অবস্থা হীন ছিল, তাহারাই দলে দলে নবধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়া বাদশাহী জাতির মধ্যে পরিগণিত হইতে লাগিল।……শ্রীহট্টের শাহ জালালের ন্যায় বিক্রমপুরের বায়া আদম বা বাবা আদম প্রভৃতি মহাপুরুষগণের প্রভাবে সহজেই পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্ম বিস্তৃতিলাভ করে। নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলাম ধৰ্ম্মে নানাপ্রকার সাম্যভাব দেখিয়াও এই ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল।”
শ্ৰীযুত সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ কৃত “যশোহর ও খুলনার ইতিহাসে”ও লিখিত হইয়াছে যে, পাঠান আমলে বহু পীর, আউলিয়া প্ৰভৃতি গিয়া যশোহর ও খুলনার নানাস্থানে “আস্তানা” করেন। হঁহাদের দ্বারা যে মুসলমান ধৰ্ম্মপ্রচারে খুবই সহায়তা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। যশোহর জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যের ইহা অন্যতম কারণ। বাঙ্গলার অন্যান্য অঞ্চলেও সে সময়ে বহু পীর ও আউলিয়াদের আস্তান হইয়াছিল এবং তাহারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন। হিন্দুরা স্বভাবতই ধৰ্ম্মপ্ৰাণ জাতি। সেই কারণে যাহারা পীর ও আউলিয়াদের নিকট ইসলাম ধৰ্ম্মে দীক্ষা লইত না, তাহারাও ঐ সব মুসলমান সাধুদিগকে শ্রদ্ধা করিত। মুসলমান সাধু ও পীরদের এইরূপে বহু হিন্দু শিষ্যও জুটিয়া যাইত। ঐরূপ দৃষ্টান্ত এ যুগেও বিরল নহে। ধৰ্ম্মবিষয়ে হিন্দুদের এই অত্যধিক উদারতা, আদর্শের দিক দিয়া যতই উচ্চ হোক, কাৰ্য্যক্ষেত্রে হিন্দুদের বহু ক্ষতি করিয়াছে, কিঞ্চিৎ অনুদার শুনাইলেও একথা আমাদিগকে বলিতে হইতেছে। বৰ্ত্তমানকালে সঙ্ঘবদ্ধভাবে মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রচারের ব্যবস্থা হইয়াছে এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম প্ৰভৃতি এজন্য বহু অর্থব্যয় করিয়া থাকেন। এই সজঘবদ্ধ প্রচারকার্য্যের ফলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এখনও বহু হিন্দু মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতেছে। বাঙলার গ্রামেও ঐ ব্যাপার চলিতেছে।
উত্তরবঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্মপ্রচারের পশ্চাতে বহু সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ নিহিত আছে। “রংপুরে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য সম্বন্ধে বুকানন সাহেব ( ১৮০৭ ) লিখিয়াছেন যে, এখানকার মুসলমানেরা আরব, আফগান বা মুসলমান আগন্তুকদের বংশধর নহে, অধিকাংশই স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীদের বংশধর, রাজা ও ভূস্বামীদের গোঁড়ামি ও অত্যাচারের ফলে ধৰ্ম্ম পরিবর্ত্তন করিয়াছে। রাজা রামমোহনের সময়েও এই ধৰ্ম্মপরিবর্ত্তন প্রবলভাবে চলিয়াছিল। রংপুর অপেক্ষা বগুড়া জেলায় আফগান জায়গীরদারদের ধৰ্ম্মপ্রচার অধিকতর ফলপ্ৰদ হইয়াছিল । ত্ৰয়োদশ শতকে অনেক আফগান করতোয়ার পশ্চিম তীরে দিনাজপুর হইতে ঘোড়াঘাট এমন কি নাটোরের নিকট পৰ্য্যন্ত নিষ্কর জমি লাভ করিয়াছিল। তাহদের কৰ্ত্তব্য ছিল করতোয়ার পূর্বপারের কুচজাতির অভিযান ও আক্রমণ হইতে শান্তিস্থাপন এবং দেশরক্ষা করা । একদিকে যেমন তাহারা প্ৰজাদিগকে জোর করিয়া ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল, অপরদিকে তাহারা পূর্ব অঞ্চলে সৈন্য অভিযান করিয়া আদিম জাতিদের সম্মুখে একহস্তে তরবার অন্য হস্তে কোরান লইয়া উপস্থিত হইল। এইরূপ ব্যাপার প্রায় দুইশত বৎসর চলিতে থাকে। তুঘ্রিল খাঁর আক্রমণ ( ১২৫৭ ) ও হুসেন সাহের কামতাপুর ধ্বংসবিধান (১৪৯০) ইহার সাক্ষ্য দেয়। অপরদিকে কুচবিহারের রাজা বিষ্ণু সিংহ ( ১৬শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ) যখন হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া “রাজবংশী” নাম গ্ৰহণ করিলেন, তখন ঐ অঞ্চলের অনেক উচ্চশ্রেণীই তঁহার অনুকরণে হিন্দু হইল । অবশিষ্ট কুচ, মোচ, বোন্দো, ধীমলি প্ৰভৃতি নিম্নজাতির লোকেরা হিন্দুসমাজের বাহিরে উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত থাকিয়া গেল। তখন তাহাদের ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।……বগুড়া যে বাংলার সব জেলা অপেক্ষা মুসলমানবহুল, তাহার প্রধান কারণ বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইতিহাসের এক করুণ বিস্মৃত অধ্যায়ে নিহিত রহিয়াছে।1
চট্টগ্রাম অঞ্চলে সহস্ৰ সহস্ৰ হিন্দু প্ৰাচীনকাল হইতে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকের কাজ করিয়া জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিত। কিন্তু মধ্যযুগে হিন্দুশাস্ত্ৰে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ হওয়াতে উহারা দলে দলে মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেই জন্যই মুসলমানের সংখ্যা বেশী এবং জাহাজের লস্কর, সারেং প্রভৃতির কাজ যাহারা করে, তাহারা সকলেই মুসলমান। মালাবারেও ঠিক এইরূপ ব্যাপার ঘটে। [^10]
মুসলমান ধৰ্ম্মের ন্যায় খ্রীস্টান ধৰ্ম্মও হিন্দুদের মধ্যে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়াছে, এখনও চালাইতেছে। খ্রীস্টান মিশনারীরা দক্ষিণ ভারতেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক খ্রীস্টান করিতে সমর্থ হইয়াছেন বটে, কিন্তু বাঙলাদেশেও তাহারা নানাভাবে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়া কতকটা সফলতা লাভ করিয়াছেন। প্রথমত, বিবিধ শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া তাঁহারা খ্রীস্টানধৰ্ম্মের মূলতত্ত্ব ও আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করিয়াছেন। এই উপায়ে পূর্ব্বে তাঁহারা বহু হিন্দু যুবককে খ্রীস্টান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরে গ্রাম অঞ্চলে নানা সেবা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াও খ্রীস্টানধৰ্ম্ম প্রচারের কার্য মিশনারীরা চালাইয়া থাকেন। যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় খ্রীস্টান মিশনারীদের এইরূপ প্রচারমুখী সেবা প্রতিষ্ঠান আছে। খ্রীস্টান মিশনগুলির অর্থবল ও জনবল উভয়ই প্রচুর পরিমাণে আছে।
একদিকে খ্রীস্টান ধৰ্ম্ম ও অন্যদিকে মুসলমান ধৰ্ম্ম,—এই দুই প্রচারশীল ধৰ্ম্মের সম্মুখীন হইয়া হিন্দুসমাজকে যে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইয়াছে, তাহাতে সন্দেত নাই। পক্ষান্তরে হিন্দুধৰ্ম্ম মোটেই প্রচারশীল ধৰ্ম্ম নহে। অন্য ধৰ্ম্মাবলম্বীকে দীক্ষা দিয়া সে হিন্দু করিয়া লইতে সন্মত নহে। সে কেবল লোককে সামান্য ভুলত্রুটির জন্য বহিস্কৃত করিয়া দিতেই জানে, বাহির হইতে কাহাকেও গ্রহণ করিতে জানে না ।
ইহার ফলে হিন্দুসমাজ আজ কবির ভাষায় সত্যই “অচলায়তন” হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহাপ্ৰভু শ্ৰীগৌরাঙ্গের প্রচারিত বৈষ্ণব ধৰ্ম্মই প্ৰথমে অ-হিন্দুদিগকেও দীক্ষা দিয়া হিন্দুসমাজে গ্রহণ করিতে আরম্ভ করে। বহু পাহাড়িয়া জাতি৷ এই সময়ে হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল। মণিপুরী পৰ্যন্ত এই ধৰ্ম্মের প্রচার হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে ব্ৰাহ্মণ গোস্বামীরা আসিয়া এই উদারতার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। নতুবা এতদিনে বাঙলার প্রান্তভাগের বহু পাহাড়িয়া ও অহিন্দু জাতি হিন্দু হইয়া যাইত। বৰ্ত্তমান যুগে আৰ্য্যসমাজীরা2 শুদ্ধি আন্দোলন3 প্ৰবৰ্ত্তন করিয়া ‘অচলায়তন’ হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজের সম্মুখে একটা নূতন সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়াছেন। যদি হিন্দুসমাজ এই শুদ্ধি আন্দোলনকে মনে প্ৰাণে গ্ৰহণ করিতে পারে, তবে উহার দ্বারা হিন্দুসমাজের বহু সমস্যার সমাধান হইবে।কিন্তু এদিকেও সেই সনাতনী জাতিভেদের মনোবৃত্তি প্ৰবল বাধা হইয়া আছে। অ-হিন্দুরা যদি হিন্দু ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে, তবে হিন্দুসমাজে তাহদের স্থান কোথায় হইবে ? কোন্ জাতির অন্তর্ভুক্ত তাহারা হইবে ? তাহদের জন্য কি নূতন নূতন জাতির সৃষ্টি হইবে ? আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, হিন্দু সমাজের সনাতনী অনুদারতার ফলে অ-হিন্দুরা বৈষ্ণবধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া সমাজে সম্মানের আসন পায় নাই, বরং তাহদের জন্য একটা পৃথক “জাতবৈষ্ণবের” সৃষ্টি হইয়াছিল। শুদ্ধি আন্দোলনের ফলে যাহারা হিন্দু হইতেছে, তাঙ্গাদের দশাও ঐরূপ হইতেছে, একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই ।
এ স্থলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আৰ্য্যসমাজের শুদ্ধি আন্দোলনের বহুপূর্ব্বে বাঙলা দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতের মনে এই শুদ্ধিসমস্যার কথা উদিত হইয়াছিল। ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণের ফলে হিন্দুর সংখ্যা যে হ্রাস হইতেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হ্রাস হওয়ার আশঙ্কা আছে, ইহা তাহারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং সেই বিপত্তি নিবারণের জন্য শুদ্ধির ব্যবস্থা দিয়াছিলেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গলার এক শত জন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত কলিকাতার “পতিতোদ্ধার সভার অনুমত্যনুসারে” “পতিতোদ্ধার বিষয়ক ভূমিকা ও ব্যবস্থা পত্রিকা” প্রচার করেন। উহাতে সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, শুদ্ধিব্যবস্থা শাস্ত্রসম্মত এবং যাহারা হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া ধৰ্ম্মান্তর গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহারা পুনরায় হিন্দু হইতে ইচ্ছা করিলে, তাহাদিগকে শুদ্ধির দ্বারা গ্ৰহণ করা যাইতে পারে। উক্ত পুস্তিকার শেষে ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা আবেগপূর্ণ ভাষায় হিন্দুসমাজের নিকট নিবেদন করিয়াছিলেন,—“সুবিজ্ঞবর মহাশয়েরা উদিত বিষয় অতি মনোযোগপূর্বক বিশেষ বিবেচনা করিয়া, বৰ্ত্তমান সময়কে শেষ সাবকাশ জানিয়া, হিন্দুজাতির চিহ্ন থাকিতে এমত বিহিত উপায় ত্বরায় করিতে আদেশ হয়, যদ্বারা পৃথিবী এককালে হিন্দুশূন্যভূতা ও বেদবিহিত সনাতনধৰ্ম্ম নিতান্ত লোপ না হয় ; অর্থাৎ ভ্রান্ত ম্লেচ্ছ ধৰ্ম্মাবলম্বনে পতিত হিন্দুদিগকে তাঁহাদিগের প্রার্থনা মতে আমাদিগের উক্ত ধৰ্ম্মশাস্ত্ৰ ব্যবস্থানুযায়ী সংস্কার দ্বারা উদ্ধার ও স্বজাতির সহিত ব্যবহার করণ সর্বসাধারণ পক্ষে আজ্ঞা করেন। 4
কিন্তু হায় ৮৬ বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গলার উদার দূরদর্শী ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা হিন্দুসমাজকে আত্মরক্ষার জন্য যে আহবান করিয়াছিলেন, বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ এখনও তাঁহাতে সাড়া দিতে পারিল না !
• ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় । ‘বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী’↩
• স্বামী দয়ানন্দের (১৮২৪-৮৩) উদ্যোগে ১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দে স্থাপিত হয় । বহু যুগসঞ্চিত কুসংস্কার ও লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে ক্লিষ্ট হিন্দু ধর্মকে বৈদিক যুগের বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নেওয়াই ছিল সমাজের প্রধান লক্ষ্য ।↩
• স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (১৮৫৫ー১৯২৬) শুদ্ধি প্রথার প্রবর্তন করেন । ইহার দ্বারা পরধর্মাবলম্বী কিছু আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ‘শুদ্ধ’ হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন । বিশেষ করে জোর করে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের এর ফলে স্ব-ধর্মে ফিরে আসার সুবিধা হয় ।↩
• অধ্যাপক বিমানবিহারী মজুমদারের “হিন্দুর সংখ্যা সংরক্ষণের চেষ্টা” আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৪৬। পরিশিষ্টে বিস্তৃত ব্যবস্থাপত্র দ্রষ্টব্য ।↩
একদিকে উপনিবেশ স্থাপন, অন্যদিকে ধৰ্ম্মপরায়ণ মুসলমান সাধুগণের উদার মত ও ধৰ্ম্মপ্রচারও মুসলমানাধিক্যের অন্যতম কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। শ্ৰীহট্টের মহাপুরুষ শাহ জালাল ৩৬০ জন আউলিয়া লইয়া আঁসিয়া শ্ৰীহট্টের নানাস্থানে ধৰ্ম্মপ্রচার করিতে আরম্ভ করেন । কেবল শ্ৰীহট্ট জেলার মধ্যেই যে ইঁহাদের প্রভাব সীমাবদ্ধ ছিল, তাহা নহে, সমগ্র পূর্ববঙ্গে ক্রমশ ইঁহাদের দ্বারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচারিত হইয়াছিল। বৰ্ত্তমান সময়ে পূর্ববঙ্গে যে সমস্ত সম্রাস্ত মুসলমান পরিবার আছেন, তন্মধ্যে এই আউলিয়াগণের বংশীয়দের কোন না কোনভাবে সম্পর্ক নাই, এমন অতি অল্পই দেখা যায়। বিজয়ী মুসলমানদের ধৰ্ম্মে তখন বহু লোক দীক্ষিত হইতে লাগিল। হিন্দু জাতি অতিশয় ধৰ্ম্মপরায়ণ হইলেও, তৎকালে অর্থাৎ সেই রাষ্ট্র বিপ্লবের যুগে, ধৰ্ম্মবন্ধন যে শিথিল হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।…..এই অবস্থায় সমাজের মধ্যে যাহাদের অবস্থা হীন ছিল, তাহারাই দলে দলে নবধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়া বাদশাহী জাতির মধ্যে পরিগণিত হইতে লাগিল।……শ্রীহট্টের শাহ জালালের ন্যায় বিক্রমপুরের বায়া আদম বা বাবা আদম প্রভৃতি মহাপুরুষগণের প্রভাবে সহজেই পূর্ববঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্ম বিস্তৃতিলাভ করে। নিম্নবর্ণের লোকেরা ইসলাম ধৰ্ম্মে নানাপ্রকার সাম্যভাব দেখিয়াও এই ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল।”
শ্ৰীযুত সতীশচন্দ্ৰ মিত্ৰ কৃত “যশোহর ও খুলনার ইতিহাসে”ও লিখিত হইয়াছে যে, পাঠান আমলে বহু পীর, আউলিয়া প্ৰভৃতি গিয়া যশোহর ও খুলনার নানাস্থানে “আস্তানা” করেন। হঁহাদের দ্বারা যে মুসলমান ধৰ্ম্মপ্রচারে খুবই সহায়তা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। যশোহর জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যের ইহা অন্যতম কারণ। বাঙ্গলার অন্যান্য অঞ্চলেও সে সময়ে বহু পীর ও আউলিয়াদের আস্তান হইয়াছিল এবং তাহারা ইসলাম ধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন। হিন্দুরা স্বভাবতই ধৰ্ম্মপ্ৰাণ জাতি। সেই কারণে যাহারা পীর ও আউলিয়াদের নিকট ইসলাম ধৰ্ম্মে দীক্ষা লইত না, তাহারাও ঐ সব মুসলমান সাধুদিগকে শ্রদ্ধা করিত। মুসলমান সাধু ও পীরদের এইরূপে বহু হিন্দু শিষ্যও জুটিয়া যাইত। ঐরূপ দৃষ্টান্ত এ যুগেও বিরল নহে। ধৰ্ম্মবিষয়ে হিন্দুদের এই অত্যধিক উদারতা, আদর্শের দিক দিয়া যতই উচ্চ হোক, কাৰ্য্যক্ষেত্রে হিন্দুদের বহু ক্ষতি করিয়াছে, কিঞ্চিৎ অনুদার শুনাইলেও একথা আমাদিগকে বলিতে হইতেছে। বৰ্ত্তমানকালে সঙ্ঘবদ্ধভাবে মুসলমান ধৰ্ম্ম প্রচারের ব্যবস্থা হইয়াছে এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম প্ৰভৃতি এজন্য বহু অর্থব্যয় করিয়া থাকেন। এই সজঘবদ্ধ প্রচারকার্য্যের ফলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এখনও বহু হিন্দু মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতেছে। বাঙলার গ্রামেও ঐ ব্যাপার চলিতেছে।
উত্তরবঙ্গে ইসলাম ধৰ্ম্মপ্রচারের পশ্চাতে বহু সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ নিহিত আছে। “রংপুরে মুসলমানের সংখ্যাধিক্য সম্বন্ধে বুকানন সাহেব ( ১৮০৭ ) লিখিয়াছেন যে, এখানকার মুসলমানেরা আরব, আফগান বা মুসলমান আগন্তুকদের বংশধর নহে, অধিকাংশই স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীদের বংশধর, রাজা ও ভূস্বামীদের গোঁড়ামি ও অত্যাচারের ফলে ধৰ্ম্ম পরিবর্ত্তন করিয়াছে। রাজা রামমোহনের সময়েও এই ধৰ্ম্মপরিবর্ত্তন প্রবলভাবে চলিয়াছিল। রংপুর অপেক্ষা বগুড়া জেলায় আফগান জায়গীরদারদের ধৰ্ম্মপ্রচার অধিকতর ফলপ্ৰদ হইয়াছিল । ত্ৰয়োদশ শতকে অনেক আফগান করতোয়ার পশ্চিম তীরে দিনাজপুর হইতে ঘোড়াঘাট এমন কি নাটোরের নিকট পৰ্য্যন্ত নিষ্কর জমি লাভ করিয়াছিল। তাহদের কৰ্ত্তব্য ছিল করতোয়ার পূর্বপারের কুচজাতির অভিযান ও আক্রমণ হইতে শান্তিস্থাপন এবং দেশরক্ষা করা । একদিকে যেমন তাহারা প্ৰজাদিগকে জোর করিয়া ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল, অপরদিকে তাহারা পূর্ব অঞ্চলে সৈন্য অভিযান করিয়া আদিম জাতিদের সম্মুখে একহস্তে তরবার অন্য হস্তে কোরান লইয়া উপস্থিত হইল। এইরূপ ব্যাপার প্রায় দুইশত বৎসর চলিতে থাকে। তুঘ্রিল খাঁর আক্রমণ ( ১২৫৭ ) ও হুসেন সাহের কামতাপুর ধ্বংসবিধান (১৪৯০) ইহার সাক্ষ্য দেয়। অপরদিকে কুচবিহারের রাজা বিষ্ণু সিংহ ( ১৬শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ) যখন হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া “রাজবংশী” নাম গ্ৰহণ করিলেন, তখন ঐ অঞ্চলের অনেক উচ্চশ্রেণীই তঁহার অনুকরণে হিন্দু হইল । অবশিষ্ট কুচ, মোচ, বোন্দো, ধীমলি প্ৰভৃতি নিম্নজাতির লোকেরা হিন্দুসমাজের বাহিরে উপেক্ষিত ও অবজ্ঞাত থাকিয়া গেল। তখন তাহাদের ইসলাম ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।……বগুড়া যে বাংলার সব জেলা অপেক্ষা মুসলমানবহুল, তাহার প্রধান কারণ বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ইতিহাসের এক করুণ বিস্মৃত অধ্যায়ে নিহিত রহিয়াছে।1
চট্টগ্রাম অঞ্চলে সহস্ৰ সহস্ৰ হিন্দু প্ৰাচীনকাল হইতে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিকের কাজ করিয়া জীবিকা নিৰ্ব্বাহ করিত। কিন্তু মধ্যযুগে হিন্দুশাস্ত্ৰে সমুদ্র যাত্রা নিষিদ্ধ হওয়াতে উহারা দলে দলে মুসলমান ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে সেই জন্যই মুসলমানের সংখ্যা বেশী এবং জাহাজের লস্কর, সারেং প্রভৃতির কাজ যাহারা করে, তাহারা সকলেই মুসলমান। মালাবারেও ঠিক এইরূপ ব্যাপার ঘটে। [^10]
মুসলমান ধৰ্ম্মের ন্যায় খ্রীস্টান ধৰ্ম্মও হিন্দুদের মধ্যে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়াছে, এখনও চালাইতেছে। খ্রীস্টান মিশনারীরা দক্ষিণ ভারতেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক খ্রীস্টান করিতে সমর্থ হইয়াছেন বটে, কিন্তু বাঙলাদেশেও তাহারা নানাভাবে প্রচারকাৰ্য্য চালাইয়া কতকটা সফলতা লাভ করিয়াছেন। প্রথমত, বিবিধ শিক্ষা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়া তাঁহারা খ্রীস্টানধৰ্ম্মের মূলতত্ত্ব ও আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করিয়াছেন। এই উপায়ে পূর্ব্বে তাঁহারা বহু হিন্দু যুবককে খ্রীস্টান করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত, দেশের অভ্যন্তরে গ্রাম অঞ্চলে নানা সেবা প্ৰতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াও খ্রীস্টানধৰ্ম্ম প্রচারের কার্য মিশনারীরা চালাইয়া থাকেন। যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলায় খ্রীস্টান মিশনারীদের এইরূপ প্রচারমুখী সেবা প্রতিষ্ঠান আছে। খ্রীস্টান মিশনগুলির অর্থবল ও জনবল উভয়ই প্রচুর পরিমাণে আছে।
একদিকে খ্রীস্টান ধৰ্ম্ম ও অন্যদিকে মুসলমান ধৰ্ম্ম,—এই দুই প্রচারশীল ধৰ্ম্মের সম্মুখীন হইয়া হিন্দুসমাজকে যে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হইয়াছে, তাহাতে সন্দেত নাই। পক্ষান্তরে হিন্দুধৰ্ম্ম মোটেই প্রচারশীল ধৰ্ম্ম নহে। অন্য ধৰ্ম্মাবলম্বীকে দীক্ষা দিয়া সে হিন্দু করিয়া লইতে সন্মত নহে। সে কেবল লোককে সামান্য ভুলত্রুটির জন্য বহিস্কৃত করিয়া দিতেই জানে, বাহির হইতে কাহাকেও গ্রহণ করিতে জানে না ।
ইহার ফলে হিন্দুসমাজ আজ কবির ভাষায় সত্যই “অচলায়তন” হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মহাপ্ৰভু শ্ৰীগৌরাঙ্গের প্রচারিত বৈষ্ণব ধৰ্ম্মই প্ৰথমে অ-হিন্দুদিগকেও দীক্ষা দিয়া হিন্দুসমাজে গ্রহণ করিতে আরম্ভ করে। বহু পাহাড়িয়া জাতি৷ এই সময়ে হিন্দুধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়াছিল। মণিপুরী পৰ্যন্ত এই ধৰ্ম্মের প্রচার হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে ব্ৰাহ্মণ গোস্বামীরা আসিয়া এই উদারতার দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। নতুবা এতদিনে বাঙলার প্রান্তভাগের বহু পাহাড়িয়া ও অহিন্দু জাতি হিন্দু হইয়া যাইত। বৰ্ত্তমান যুগে আৰ্য্যসমাজীরা2 শুদ্ধি আন্দোলন3 প্ৰবৰ্ত্তন করিয়া ‘অচলায়তন’ হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজের সম্মুখে একটা নূতন সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়াছেন। যদি হিন্দুসমাজ এই শুদ্ধি আন্দোলনকে মনে প্ৰাণে গ্ৰহণ করিতে পারে, তবে উহার দ্বারা হিন্দুসমাজের বহু সমস্যার সমাধান হইবে।কিন্তু এদিকেও সেই সনাতনী জাতিভেদের মনোবৃত্তি প্ৰবল বাধা হইয়া আছে। অ-হিন্দুরা যদি হিন্দু ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করে, তবে হিন্দুসমাজে তাহদের স্থান কোথায় হইবে ? কোন্ জাতির অন্তর্ভুক্ত তাহারা হইবে ? তাহদের জন্য কি নূতন নূতন জাতির সৃষ্টি হইবে ? আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, হিন্দু সমাজের সনাতনী অনুদারতার ফলে অ-হিন্দুরা বৈষ্ণবধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া সমাজে সম্মানের আসন পায় নাই, বরং তাহদের জন্য একটা পৃথক “জাতবৈষ্ণবের” সৃষ্টি হইয়াছিল। শুদ্ধি আন্দোলনের ফলে যাহারা হিন্দু হইতেছে, তাঙ্গাদের দশাও ঐরূপ হইতেছে, একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই ।
এ স্থলে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আৰ্য্যসমাজের শুদ্ধি আন্দোলনের বহুপূর্ব্বে বাঙলা দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতের মনে এই শুদ্ধিসমস্যার কথা উদিত হইয়াছিল। ধৰ্ম্মান্তর গ্রহণের ফলে হিন্দুর সংখ্যা যে হ্রাস হইতেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হ্রাস হওয়ার আশঙ্কা আছে, ইহা তাহারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন এবং সেই বিপত্তি নিবারণের জন্য শুদ্ধির ব্যবস্থা দিয়াছিলেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে বাঙ্গলার এক শত জন বিশিষ্ট ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত কলিকাতার “পতিতোদ্ধার সভার অনুমত্যনুসারে” “পতিতোদ্ধার বিষয়ক ভূমিকা ও ব্যবস্থা পত্রিকা” প্রচার করেন। উহাতে সুস্পষ্টরূপে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, শুদ্ধিব্যবস্থা শাস্ত্রসম্মত এবং যাহারা হিন্দুধৰ্ম্ম ত্যাগ করিয়া ধৰ্ম্মান্তর গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহারা পুনরায় হিন্দু হইতে ইচ্ছা করিলে, তাহাদিগকে শুদ্ধির দ্বারা গ্ৰহণ করা যাইতে পারে। উক্ত পুস্তিকার শেষে ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা আবেগপূর্ণ ভাষায় হিন্দুসমাজের নিকট নিবেদন করিয়াছিলেন,—“সুবিজ্ঞবর মহাশয়েরা উদিত বিষয় অতি মনোযোগপূর্বক বিশেষ বিবেচনা করিয়া, বৰ্ত্তমান সময়কে শেষ সাবকাশ জানিয়া, হিন্দুজাতির চিহ্ন থাকিতে এমত বিহিত উপায় ত্বরায় করিতে আদেশ হয়, যদ্বারা পৃথিবী এককালে হিন্দুশূন্যভূতা ও বেদবিহিত সনাতনধৰ্ম্ম নিতান্ত লোপ না হয় ; অর্থাৎ ভ্রান্ত ম্লেচ্ছ ধৰ্ম্মাবলম্বনে পতিত হিন্দুদিগকে তাঁহাদিগের প্রার্থনা মতে আমাদিগের উক্ত ধৰ্ম্মশাস্ত্ৰ ব্যবস্থানুযায়ী সংস্কার দ্বারা উদ্ধার ও স্বজাতির সহিত ব্যবহার করণ সর্বসাধারণ পক্ষে আজ্ঞা করেন। 4
কিন্তু হায় ৮৬ বৎসর পূর্ব্বে বাঙ্গলার উদার দূরদর্শী ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিতেরা হিন্দুসমাজকে আত্মরক্ষার জন্য যে আহবান করিয়াছিলেন, বাঙ্গলার হিন্দুসমাজ এখনও তাঁহাতে সাড়া দিতে পারিল না !
• ডা. রাধাকমল মুখোপাধ্যায় । ‘বাঙ্গলা ও বাঙ্গালী’↩
• স্বামী দয়ানন্দের (১৮২৪-৮৩) উদ্যোগে ১৮৭৭ খ্রীস্টাব্দে স্থাপিত হয় । বহু যুগসঞ্চিত কুসংস্কার ও লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে ক্লিষ্ট হিন্দু ধর্মকে বৈদিক যুগের বিশুদ্ধ হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নেওয়াই ছিল সমাজের প্রধান লক্ষ্য ।↩
• স্বামী শ্রদ্ধানন্দ (১৮৫৫ー১৯২৬) শুদ্ধি প্রথার প্রবর্তন করেন । ইহার দ্বারা পরধর্মাবলম্বী কিছু আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ‘শুদ্ধ’ হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন । বিশেষ করে জোর করে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের এর ফলে স্ব-ধর্মে ফিরে আসার সুবিধা হয় ।↩
• অধ্যাপক বিমানবিহারী মজুমদারের “হিন্দুর সংখ্যা সংরক্ষণের চেষ্টা” আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৪৬। পরিশিষ্টে বিস্তৃত ব্যবস্থাপত্র দ্রষ্টব্য ।↩
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন