১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙলার হিন্দু সমাজের লোকক্ষয়ー২

বস্তুতঃ ১৯১০ সালে লে. কর্নেল মুখোপাধ্যায় বাঙলার হিন্দুসমাজের যে ক্ষয় ব্যাধি ধরিয়াছিলেন, তাহা প্রশমিত হওয়া দূরে থাকুক, উত্তরোত্তর প্রবলাকার ধারণ করিতেছে । তাহার পর ১৯১১, ১৯২১, ১৯৩১ সালে তিনটি আদমসুমারী হইয়াছে। প্ৰত্যেক আদম-সুমারীতেই হিন্দুসমাজের অবস্থা ক্রমশ অধিকতর শোচনীয় হইয়াছে , লক্ষ্য করিতেছি । ১৯৪১ সালের আদমসুমারীতেও উপজাতীয় হিন্দুদের (Tribal Hindus) বাদ দিলে বাঙালী হিন্দুদের অবস্থা পূর্ববৎ শোচনীয় ।

নিম্নে আমরা কতকগুলি তথ্য দিলাম । তথ্যগুলি বিশদভাবে বুঝাইবার জন্য আমরা যে চিত্রটি দিলাম (১নং চিত্র) তাহা হইতে বিষয়টি সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যাইবে । তথ্যগুলি এই:
বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা ও শতকরা অনুপাতー
বৎসর
হিন্দু (সংখ্যা হাজারে)
মুসলমান
শতকরা হি.
শতকরা মু.
১৮৭২
১৭২.৫৮
১৬৬.৮২
৫০.২
৪৮.৫
১৮৮১
১৮০.৭১
১৮৩.৯৪
৪৮.৮
৪৯.৭
১৮৯১
১৮৯.৭৮
২০১.৭৫
৪৭.৭
৫০.৭
১৯০১
২০১.৫৬
২১৯.৫৫
৪৭.০
৫১.২
১৯১১
২০৯.৪৮
২৪২.৩৭
৪৫.২
৫২.৩
১৯২১
২০৮.১৩
২৫৪.৮৬
৪৩.৭
৫৩.৫
১৯৩১
২২২.১২
২৭৮.১০
৪৩.৫
৫৪.৪
১৯৪১
২৫৮.০২
৩৩৩.৭২
৪২.০
৫৪.৩
১৯৪১
২৭২.০৭1

৪৪.৩2

নিম্নে আমরা যে চিত্রটি ( ১নং চিত্র ) দিলাম, তাহা হইতে বিষয়টি সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যাইবে :ー



 চিত্র নং ১ - বাংলা
নীচের চিত্রে দেখা যাইবে যে, ইং ১৮৮১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্ৰায় সমান ছিল,ーসমগ্ৰ লোকসংখ্যার শতকরা ৪৯ ভাগ হিসাবে। কিন্তু তারপর হইতেই মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়া চলিয়াছে এবং ১৯৩১ সালে তাহাদের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে লোকসংখ্যার শতকরা প্রায় ৫৪.৫ ভাগে। আর ঐ ১৮৮১ সাল হইতেই বাঙলায় হিন্দুদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস হইতেছে এবং ১৯৩১ সালে তাঁহাদের সংখ্যা আসিয়া নামিয়াছে শতকরা ৪৩ ভাগে। অর্থাৎ অৰ্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে বাঙলার হিন্দুদের সংখ্যা শতকরা ৬ ভাগ হ্রাস হইয়াছে, আর মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ৬ ভাগ বাড়িয়াছে। এই অবস্থা বিপৰ্য্যয়ের কারণ কি, তাহা চিন্তাশীল বাঙালী হিন্দু মাত্রেই গভীরভাবে ভাবিয়া দেখা অত্যাবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। যদি এইভাবে ক্রমাগত বাঙালী হিন্দুর সংখ্যা হ্রাস হইতে থাকে, তবে আগামী অৰ্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে তাহারা বাঙলাদেশে নগণ্য সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হইবে ;— এক শতাব্দীর মধ্যে জাতি হিসাবে লুপ্তপ্রায় হইবে, ইহাও অমূলক আশঙ্কা নহে।
১৮৮১-১৯৩১ এই পাঁচ দশকে ( অর্থাৎ ৫০ বৎসরে ) পাঞ্জাবের হিন্দু ও মুসলমানের লোকসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধির তুলনা করিলে বাঙলার সঙ্গে আশ্চৰ্য্য রকমের সাদৃশ্য দেখা যায়। সম্প্রতি পাঞ্জাবের অধ্যাপক রুচিরাম সাহানা বিষয়টির তুলনামূলক আলোচনা করিয়া বাঙলা ও পাঞ্জাবের হিন্দুদের শোচনীয় অবস্থার প্রতি সমগ্ৰ হিন্দু ভারতের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছেন ।
২নং চিত্রে দেখা যাইবে, পাঞ্জাবের মুসলমানেরা ১৮৮১ সালে পাঞ্জাবের সমগ্ৰ লোকসংখ্যার শতকরা ৪৭.৫ ভাগ ছিল,-আর ১৯৩১ সালে তাহাদের সংখ্যা উঠিয়াছে লোকসংখ্যার শতকরা ৫২.৫ ভাগে। এই ৫০ বৎসরের মধ্যে প্রথম দশ বৎসরে মুসলমানদের সংখ্যা ঈষৎ হ্রাস হইয়াছিল বটে, কিন্তু তারপর ৪০ বৎসরে তাহদের সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়াছে । পক্ষান্তরে হিন্দু ও শিখদের সংখ্যা ঐ ৫০ বৎসরে দ্রুত হ্রাস হইয়াছে ৷



 চিত্র নং ২ - পাঞ্জাব
১৮৮১ সালে তাহাদের সংখ্যা ছিল লোকসংখ্যার শতকরা ৫২.৫ ভাগ, আর ১৯৩১ সালে তাহাদের সংখ্যা নামিয়াছে শতকরা ৪৬ ভাগে। অর্থাৎ ৫০ বৎসরের মধ্যে তাহারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হইতে সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ে পরিণত হইয়াছে।



 চিত্র নং ৩ - পাঞ্জাব
২নং চিত্রে হিন্দু ও শিখদের লোকসংখ্যা একত্র করিয়া দেখানো হইয়াছে। শিখদের সংখ্যা যদি পৃথকভাবে হিসাব করা যায়, তবে পাঞ্জাবে হিন্দুদের অবস্থা আরও শোচনীয় প্রতীয়মান হইবে। ৩নং চিত্রে শিখদের সংখ্যা পৃথকভাবে দেখানো হইল।
৩নং চিত্রে দেখা যাইবে যে, ১৮৮১ সালে শিখেরা পাঞ্জাবের সমগ্ৰ লোকসংখ্যার শতকরা ৮ ভাগ ছিল, আর ১৯৩১ সালে তাহদের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে শতকরা ১৪ ভাগে। অর্থাৎ ৫০ বৎসরে তাহাদের সংখ্যা প্ৰায় দ্বিগুণ হইয়াছে। সুতরাং পাঞ্জাবে শিখসম্প্রদায়কে বাদ দিলে, কেবলমাত্র হিন্দুদের সংখ্যা যে শোচনীয়রূপে হ্রাস হইয়াছে, তাহা সহজেই বুঝা যাইতে পারে।
গত ৫০ বৎসরে পাঞ্জাব ও বাঙলায়, হিন্দু ও মুসলমানের লোকসংখ্যার এই হ্রাসবৃদ্ধি তুলনা করিয়া অধ্যাপক রুচিরাম সাহানী প্রশ্ন করিয়াছেন, এই পার্থক্যের কারণ কি ? উভয় সম্প্রদায়ই একই দেশে, একই জলবায়ুতে পাশাপাশি বাস করিতেছে, রাজনৈতিক অবস্থাও উভয়েরই সমান। তৎসত্ত্বেও এরূপ বিপরীত অবস্থা হয় কেন ? স্বভাবতঃই অনুমান করিতে হয়, হিন্দুদের সমাজব্যবস্থা এবং জীবনযাপন প্ৰণালীর মধ্যে এমন কিছু আছে, যাহার ফলে তাহদের লোকসংখ্যার ক্ষয় হইতেছে। পাঞ্জাব বাঙলার মত ম্যালেরিয়াগ্ৰস্ত নহে। সুতরাং পাঞ্জাবের হিন্দুদের দুর্দশ ম্যালেরিয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না । কিন্তু পাঞ্জাব ও বাঙলায় উভয়ত্ৰই হিন্দুদের সামাজিক অবস্থা, আচার, প্ৰথা, সংস্কার ইত্যাদি প্রায়ই একরূপ। অতএব এই সমস্তের মধ্যেই হিন্দুসমাজের ক্ষয়ব্যাধির কারণ অনুসন্ধান করিতে হইবে।
অধ্যাপক রুচিরাম সাহানীর মতে হিন্দুসমাজের ক্ষয়ব্যাধির কারণগুলি এই :-(১) জাতিভেদ প্ৰথা এবং তজ্জনিত ভেদবুদ্ধি ও সঙ্কীর্ণতা । (২) বাল্যবিবাহ। (৩) হিন্দু সমাজে বিধবাবিবাহের প্রচলন, পক্ষান্তরে মুসলমান সমাজে বিধবা বিবাহে ও বহুবিবাহ প্রথার অপ্রচলন। (৪) হিন্দুরা সহজেই অন্য ধৰ্ম্ম গ্ৰহণ করিতে পারে এবং সেই সব ধৰ্ম্ম সম্প্রদায়ে যথাযোগ্য সম্মান পায়, পক্ষান্তরে অন্যধৰ্ম্মাবলম্বীর পক্ষে হিন্দুধর্মে প্ৰবেশ করা পূর্ব্বে একেবারেই অসম্ভব ছিল, বৰ্তমানে অসম্ভব না হইলেও দুঃসাধ্য। (৫) হিন্দুরা বেশীর ভাগ সহরে বাস করে, আর মুসলমানেরা বেশীর ভাগ গ্রামে মুক্ত বায়ুতে কৃষক জীবন যাপন করে। (৬) হিন্দুৱা প্ৰধানতঃ নিরামিষাশী, আর মুসলমানেরা প্ৰধানতঃ মাংসাশী।
অধ্যাপক রুচিরাম সাহানী মনে করেন যে, এই সমস্ত কারণ সমবায়েই হিন্দুসমাজের লোকসংখ্যার হার ক্রমশঃ হ্রাস হইতেছে। অধ্যাপক সাহানীর কথাগুলি বিশেষভাবে চিন্তা ও আলোচনার যোগ্য । বাঙলাদেশের হিন্দুসমাজের মধ্যেও ঐ সব কারণ বর্ত্তমান আছে এবং তাহাদের সমাজজীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতেছে। বাঙলাদেশের বিশেষ অবস্থার মধ্যে আরও কতকগুলি আর্থিক ও সামাজিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত হইয়া উহার সমস্যাকে অধিকতর জটিল করিয়া তুলিয়াছে!

• শেষের অঙ্ক ও অনুপাত উপজাতীয় হিন্দুদের ধরিয়া↩

• শেষের অঙ্ক ও অনুপাত উপজাতীয় হিন্দুদের ধরিয়া↩


চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
বিঃদ্রঃ আরো পোষ্ট পেতে লাইক ও শেয়ার করুন
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।