সমাজসংগঠন ও সমাজসংস্কার করিবার অন্যতম প্ৰধান অস্ত্ৰ সাহিত্য ও শিল্পকলা। সাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্য দিয়া যে শক্তি প্ৰয়োগ করা যায়, রাষ্ট্রের আইন বা সংস্কারপন্থীদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রচারকাৰ্য্যের চেয়ে তাহা কোন অংশেই কম নহে, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশী। সাহিত্য ও শিল্পকলার মধ্য দিয়া প্ৰচারিত ভাব ও আদর্শ জাতির মনোরাজ্যে বিপ্লব আনয়ন করে, মানুষের জীবনধারার আমূল পরিবর্ত্তন সাধন করিতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলন বা জাতীয় আন্দোলনে সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রভাব ইতিহাস পাঠকেরা কেহই অস্বীকার করিতে পারেন না। ফরাসীবিপ্লবের, এমনকি আধুনিক রাশিয়ার রাষ্ট্রবিপ্লবের মূলে সাহিত্য যে কত বড় শক্তি যোগাইয়াছিল, তাহা আমরা সকলেই জানি। অথচ সমাজ সংস্কার বা সমাজের পুনর্গঠন ব্যাপারেও সাহিত্যকে সেইরূপ মৰ্য্যাদা দিতে আমরা অনেক সময় ভুলিয়া যাই। কিন্তু একথা কে অস্বীকার করিতে পারে যে, সাহিত্যের মধ্য দিয়া প্ৰচারিত যে ভাব ও আদর্শ রাষ্ট্রকে ভাঙ্গিতে গড়িতে পারে, জাতীয় আন্দোলনের ধারাকে প্রভাবিত করিতে পারে, সমাজসংস্কার ও সংগঠনের ব্যাপারেও সেই শক্তি অশেষ কাৰ্য্য করিতে পারে।
জাতীয় আন্দোলন এবং সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর সাহিত্যের প্রভাব যে কত বেশী বাঙলাদেশেই তাহার বড় দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের উপর রহিয়াছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলা সাহিত্য বাঙালীর জাতীয় আন্দোলনের উপর যেমন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের উপরও তেমনি গভীর রেখাপাত করিয়াছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যে সমাজসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়, তাহা প্ৰধানত বাঙলা সাহিত্যকে অবলম্বন করিয়াই অগ্রসর হইয়াছিল। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ—রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর, ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্ৰ সেন, আচাৰ্য্য শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু প্ৰভৃতি প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই সংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতারা যে সমাজসংস্কার আন্দোলনে অগ্ৰণী হইয়াছিলেন, একথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করিতে হইবে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগে সামাজিক জড়তা ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁহারা অক্লান্তভাবে সংগ্ৰাম করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয় নাই। হিন্দুসমাজ উহাতে বহুল পরিমাণে প্ৰভাবিত হইয়াছে। তৎসত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের শক্তি ও তেজ যে ক্রমে মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছে, উহা আশানুরূপ প্রসারলাভ করিতে পারে নাই, তাহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, ব্ৰাহ্মসমাজ একটা বিষয়ে মারাত্মক ভুল করিয়াছিল। তাহারা হিন্দুসমাজ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া বাহির হইতে সংস্কার আন্দোলন চালাইতে চেষ্টা করিয়াছিল। ইহার ফলেই হিন্দুসমাজের সহানুভূতিলাভে তাহারা বহুল পরিমাণে বঞ্চিত হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই সত্য বহুদিন পূর্ব্বেই ধরিতে পারিয়াছিলেন। “ব্ৰাহ্ম ধৰ্ম্মের প্রচার” নামক তাঁহার বিখ্যাত বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছিলেন, ব্ৰাহ্মসমাজের কাজ শেষ হইয়াছে, উহার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের আর প্রয়োজন নাই। বৃহত্তর হিন্দুসমাজের অন্তর্ভূক্ত হওয়াই উহার পক্ষে বাঁচিবার একমাত্র পথ। জানি না, ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ এ সত্য এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন কিনা। পাঞ্জাবের আর্য্যসমাজ এই ভুল করে নাই, তাই তাহাদের শক্তি ক্রমেই বাড়িতেছে।
বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজের ভিতর হইতেই যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে প্ৰাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের নাম সৰ্ব্বাগ্রগণ্য। বলিতে গেলে হিন্দুসমাজের নবযুগের স্মৃতিকাররূপে তিনি আবির্ভূত হইয়াছিলেন। প্রাচীন স্মৃতিকারদের চেয়ে তাঁহার গৌরব কোন অংশেই কম নহে। তাঁহার দুই প্ৰধান সংস্কার প্রচেষ্টা-বিধবাবিবাহ প্ৰচলন এবং বহুবিবাহ নিবারণ বহুল পরিমাণে সাফল্যলাভ করিয়াছে। আর বিদ্যাসাগর মহাশয় প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই সংস্কার প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক যে সব সাহিত্যিক কাৰ্য্যক্ষেত্রে নামিয়াছিলেন, সমাজ সংস্কারের দিক দিয়া তাহাদের প্রভাব ও সামান্য নহে। পণ্ডিত রামনারায়ণের “কুলীনকুলসর্বস্ব” নাটক এবং দীনবন্ধু মিত্রের সামাজিক নাটক ও প্ৰহসন এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’1 ও কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সাও’2 বাঙলার সামাজিক আন্দোলনে স্থান পাইবার যোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্ৰ ও তাঁহার সমসাময়িক সাহিত্যিকবৃন্দ সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন অসাধারণ শক্তিধর পুরুষ।
সাহিত্যের মধ্য দিয়া তিনি বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন—তথা সমাজজীবনকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছিলেন, তাহার তুলনা নাই। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্ঘর্ষে আমরা কতকটা বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলাম, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের তীব্র আলোকে আমাদের চোখ ঝলসিয়া গিয়াছিল। ফলে যাহা কিছু পাশ্চাত্য তাঁহাই আমরা নকল করিয়া নিজেদের সত্ত্বা হারাইয়া ফেলিবার উপক্ৰম করিয়াছিলাম। এই বিমূঢ় অবস্থা হইতে জাতিকে যাহারা সচেতন করিয়া তোলেন—বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাদের মধ্যে সৰ্বাগ্রগণ্য। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি যেমন পাণ্ডিত্যলাভ করিয়াছিলেন, অগাধ হিন্দুশাস্ত্ৰ, দৰ্শন ও সাহিত্যেও তেমনি ছিল তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা। তাই প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তিনি স্বজাতি ও সমাজকে আত্মস্থ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। জাতির শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যে দৃষ্টি বহির্ম্মুখী হইয়াছিল, তাহাকে তিনি অন্তর্ম্মুখী করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। আর তাঁহার অসামান্য প্রতিভা সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই দুঃসাধ্য ব্ৰত পালন করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ তাঁহার শিষ্য ও সহকৰ্ম্মীরাও এই মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন।
তারপর আসিল শ্ৰীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যুগ। বঙ্কিমচন্দ্ৰ যে আদর্শ স্থাপন করিয়াছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ তাহাকে করিয়াছিলেন আরও মহীয়ান, গৌরবোজ্জল। বাঙ্গলার তথা সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজকে তিনিই নূতন করিয়া দিয়াছিলেন—কৰ্ম্মযোগ ও সেবাধৰ্ম্মের শিক্ষা। স্বামী বিবেকানন্দ প্ৰচলিত ভাষায় ‘সাহিত্যিক’ ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার বিরাট মনীষার স্পর্শে এক বিশাল নূতন সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। স্বামীজীর বক্তৃতা ও প্ৰবন্ধাবলী বাঙ্গলা ভাষার মধ্য দিয়া হিন্দুসমাজদেহে বিদ্যুৎসঞ্চার করিয়াছে।
এই যুগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন করিয়াছেন, তাঁহারা প্ৰধানত সাহিত্যকেই অবলম্বন করিয়াছেন। গিরিশচন্দ্ৰ ঘোষের সামাজিক নাটক এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসাবলীর নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “অপরাজেয় কথাশিল্পী” শরৎচন্দ্ৰ প্ৰকাশ্যে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য লইয়াই উপন্যাস লিখেন নাই বটে, কিন্তু যে সব ভাব ও আদর্শ তিনি তাঁহার সৃষ্ট কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়া প্রচার করিয়াছেন, তাহা বাঙালী হিন্দুর সমাজজীবনের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চও হিন্দুর সমাজজীবনের উপর কম প্রভাব বিস্তার করে নাই। বাঙ্গলার নাট্যশালার ইতিহাস খুব বেশী দিনের নহে, এখনও একশত বৎসর হয় নাই ।3 কিন্তু নানা বিচিত্র অবস্থাবিপৰ্য্যয়ের মধ্য দিয়া বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চ আমাদের সামাজিক পরিবর্ত্তনে বিপুল শক্তিসঞ্চার করিয়াছে। এক্ষেত্রে বাঙ্গলার সংবাদ পত্রের দানও সামান্য নয়। উনবিংশ শতাব্দীর যত কিছু সমাজসংস্কার আন্দোলন, তাহার অধিকাংশেরই বাহন ছিল বাঙ্গলার সংবাদপত্র। বাঙ্গলার রাজনৈতিক আন্দোলন, তাহার জাতীয়জীবন যেমন সংবাদ পত্রের নিকট ঋণী, হিন্দুর সমাজসংস্কার আন্দোলনও তেমনি সংবাদ পত্রের নিকট কম ঋণী নহে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেও মহাত্মা গান্ধীর অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন আন্দোলন প্ৰধানতঃ সংবাদ পত্রের মধ্য দিয়াই পরিচালিত হইয়াছে। সংবাদ পত্ৰ “সাহিত্যের” অন্তর্ভুক্ত কিনা সেই ‘চুলচেরা’ তর্ক আমরা তুলিব না, তবে বাঙ্গলা সংবাদপত্র যে বাঙ্গলা সাহিত্যের অন্যতম প্ৰধান সহযোগী একথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না । বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উৎকৃষ্ট রচনা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের মধ্য দিয়াই প্রথমে প্রকাশিত হইয়াছে ।
• ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে ’মাসিক পত্রিকা’য় ধারাবাহিক এবং ১৮৮৫-তে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় ।↩
• ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে প্রথম খণ্ড এবং ১৮৬৪-তে দুই খণ্ড একত্রে প্রকাশিত ।↩
• ১৭৯৫ সনে লেবেডেফ বাংলা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন । প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চের যুগ শুরু হয় ১৮৭২ সনের ডিসেম্বর মাস থেকে ।↩
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
জাতীয় আন্দোলন এবং সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর সাহিত্যের প্রভাব যে কত বেশী বাঙলাদেশেই তাহার বড় দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের উপর রহিয়াছে। উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙলা সাহিত্য বাঙালীর জাতীয় আন্দোলনের উপর যেমন প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের উপরও তেমনি গভীর রেখাপাত করিয়াছিল। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যে সমাজসংস্কার আন্দোলন আরম্ভ হয়, তাহা প্ৰধানত বাঙলা সাহিত্যকে অবলম্বন করিয়াই অগ্রসর হইয়াছিল। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ—রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর, ব্ৰহ্মানন্দ কেশবচন্দ্ৰ সেন, আচাৰ্য্য শিবনাথ শাস্ত্রী, রাজনারায়ণ বসু প্ৰভৃতি প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই সংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন। ব্ৰাহ্মসমাজের নেতারা যে সমাজসংস্কার আন্দোলনে অগ্ৰণী হইয়াছিলেন, একথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করিতে হইবে। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগে সামাজিক জড়তা ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে তাঁহারা অক্লান্তভাবে সংগ্ৰাম করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয় নাই। হিন্দুসমাজ উহাতে বহুল পরিমাণে প্ৰভাবিত হইয়াছে। তৎসত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের শক্তি ও তেজ যে ক্রমে মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছে, উহা আশানুরূপ প্রসারলাভ করিতে পারে নাই, তাহার কারণ কি ? আমাদের মনে হয়, ব্ৰাহ্মসমাজ একটা বিষয়ে মারাত্মক ভুল করিয়াছিল। তাহারা হিন্দুসমাজ হইতে স্বতন্ত্র হইয়া বাহির হইতে সংস্কার আন্দোলন চালাইতে চেষ্টা করিয়াছিল। ইহার ফলেই হিন্দুসমাজের সহানুভূতিলাভে তাহারা বহুল পরিমাণে বঞ্চিত হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ এই সত্য বহুদিন পূর্ব্বেই ধরিতে পারিয়াছিলেন। “ব্ৰাহ্ম ধৰ্ম্মের প্রচার” নামক তাঁহার বিখ্যাত বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছিলেন, ব্ৰাহ্মসমাজের কাজ শেষ হইয়াছে, উহার স্বতন্ত্র অস্তিত্বের আর প্রয়োজন নাই। বৃহত্তর হিন্দুসমাজের অন্তর্ভূক্ত হওয়াই উহার পক্ষে বাঁচিবার একমাত্র পথ। জানি না, ব্ৰাহ্মসমাজের নেতাগণ এ সত্য এখনও হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছেন কিনা। পাঞ্জাবের আর্য্যসমাজ এই ভুল করে নাই, তাই তাহাদের শক্তি ক্রমেই বাড়িতেছে।
বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজের ভিতর হইতেই যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন চালাইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে প্ৰাতঃস্মরণীয় পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের নাম সৰ্ব্বাগ্রগণ্য। বলিতে গেলে হিন্দুসমাজের নবযুগের স্মৃতিকাররূপে তিনি আবির্ভূত হইয়াছিলেন। প্রাচীন স্মৃতিকারদের চেয়ে তাঁহার গৌরব কোন অংশেই কম নহে। তাঁহার দুই প্ৰধান সংস্কার প্রচেষ্টা-বিধবাবিবাহ প্ৰচলন এবং বহুবিবাহ নিবারণ বহুল পরিমাণে সাফল্যলাভ করিয়াছে। আর বিদ্যাসাগর মহাশয় প্ৰধানত সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই সংস্কার প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক যে সব সাহিত্যিক কাৰ্য্যক্ষেত্রে নামিয়াছিলেন, সমাজ সংস্কারের দিক দিয়া তাহাদের প্রভাব ও সামান্য নহে। পণ্ডিত রামনারায়ণের “কুলীনকুলসর্বস্ব” নাটক এবং দীনবন্ধু মিত্রের সামাজিক নাটক ও প্ৰহসন এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’1 ও কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সাও’2 বাঙলার সামাজিক আন্দোলনে স্থান পাইবার যোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্ৰ ও তাঁহার সমসাময়িক সাহিত্যিকবৃন্দ সমাজসংস্কার আন্দোলনের উপর অশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন অসাধারণ শক্তিধর পুরুষ।
সাহিত্যের মধ্য দিয়া তিনি বাঙ্গালীর জাতীয় জীবন—তথা সমাজজীবনকে যে ভাবে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছিলেন, তাহার তুলনা নাই। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্ঘর্ষে আমরা কতকটা বিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলাম, পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের তীব্র আলোকে আমাদের চোখ ঝলসিয়া গিয়াছিল। ফলে যাহা কিছু পাশ্চাত্য তাঁহাই আমরা নকল করিয়া নিজেদের সত্ত্বা হারাইয়া ফেলিবার উপক্ৰম করিয়াছিলাম। এই বিমূঢ় অবস্থা হইতে জাতিকে যাহারা সচেতন করিয়া তোলেন—বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাদের মধ্যে সৰ্বাগ্রগণ্য। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানে তিনি যেমন পাণ্ডিত্যলাভ করিয়াছিলেন, অগাধ হিন্দুশাস্ত্ৰ, দৰ্শন ও সাহিত্যেও তেমনি ছিল তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা। তাই প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় বিদ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া তিনি স্বজাতি ও সমাজকে আত্মস্থ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। জাতির শিক্ষিত সম্প্রদায়ের যে দৃষ্টি বহির্ম্মুখী হইয়াছিল, তাহাকে তিনি অন্তর্ম্মুখী করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। আর তাঁহার অসামান্য প্রতিভা সাহিত্যের মধ্য দিয়াই এই দুঃসাধ্য ব্ৰত পালন করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক সাহিত্যিকগণ তাঁহার শিষ্য ও সহকৰ্ম্মীরাও এই মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন।
তারপর আসিল শ্ৰীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের যুগ। বঙ্কিমচন্দ্ৰ যে আদর্শ স্থাপন করিয়াছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ তাহাকে করিয়াছিলেন আরও মহীয়ান, গৌরবোজ্জল। বাঙ্গলার তথা সমগ্ৰ ভারতের হিন্দুসমাজকে তিনিই নূতন করিয়া দিয়াছিলেন—কৰ্ম্মযোগ ও সেবাধৰ্ম্মের শিক্ষা। স্বামী বিবেকানন্দ প্ৰচলিত ভাষায় ‘সাহিত্যিক’ ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার বিরাট মনীষার স্পর্শে এক বিশাল নূতন সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। স্বামীজীর বক্তৃতা ও প্ৰবন্ধাবলী বাঙ্গলা ভাষার মধ্য দিয়া হিন্দুসমাজদেহে বিদ্যুৎসঞ্চার করিয়াছে।
এই যুগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথমপাদে যাঁহারা সমাজসংস্কার আন্দোলন করিয়াছেন, তাঁহারা প্ৰধানত সাহিত্যকেই অবলম্বন করিয়াছেন। গিরিশচন্দ্ৰ ঘোষের সামাজিক নাটক এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসাবলীর নাম এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “অপরাজেয় কথাশিল্পী” শরৎচন্দ্ৰ প্ৰকাশ্যে সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্য লইয়াই উপন্যাস লিখেন নাই বটে, কিন্তু যে সব ভাব ও আদর্শ তিনি তাঁহার সৃষ্ট কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়া প্রচার করিয়াছেন, তাহা বাঙালী হিন্দুর সমাজজীবনের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চও হিন্দুর সমাজজীবনের উপর কম প্রভাব বিস্তার করে নাই। বাঙ্গলার নাট্যশালার ইতিহাস খুব বেশী দিনের নহে, এখনও একশত বৎসর হয় নাই ।3 কিন্তু নানা বিচিত্র অবস্থাবিপৰ্য্যয়ের মধ্য দিয়া বাঙ্গলার রঙ্গমঞ্চ আমাদের সামাজিক পরিবর্ত্তনে বিপুল শক্তিসঞ্চার করিয়াছে। এক্ষেত্রে বাঙ্গলার সংবাদ পত্রের দানও সামান্য নয়। উনবিংশ শতাব্দীর যত কিছু সমাজসংস্কার আন্দোলন, তাহার অধিকাংশেরই বাহন ছিল বাঙ্গলার সংবাদপত্র। বাঙ্গলার রাজনৈতিক আন্দোলন, তাহার জাতীয়জীবন যেমন সংবাদ পত্রের নিকট ঋণী, হিন্দুর সমাজসংস্কার আন্দোলনও তেমনি সংবাদ পত্রের নিকট কম ঋণী নহে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেও মহাত্মা গান্ধীর অস্পৃশ্যতা বর্জ্জন আন্দোলন প্ৰধানতঃ সংবাদ পত্রের মধ্য দিয়াই পরিচালিত হইয়াছে। সংবাদ পত্ৰ “সাহিত্যের” অন্তর্ভুক্ত কিনা সেই ‘চুলচেরা’ তর্ক আমরা তুলিব না, তবে বাঙ্গলা সংবাদপত্র যে বাঙ্গলা সাহিত্যের অন্যতম প্ৰধান সহযোগী একথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না । বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ উৎকৃষ্ট রচনা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রের মধ্য দিয়াই প্রথমে প্রকাশিত হইয়াছে ।
• ১৮৫৪ খ্রীস্টাব্দে ’মাসিক পত্রিকা’য় ধারাবাহিক এবং ১৮৮৫-তে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয় ।↩
• ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দে প্রথম খণ্ড এবং ১৮৬৪-তে দুই খণ্ড একত্রে প্রকাশিত ।↩
• ১৭৯৫ সনে লেবেডেফ বাংলা নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন । প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চের যুগ শুরু হয় ১৮৭২ সনের ডিসেম্বর মাস থেকে ।↩
চলবে ...
গ্রন্থঃ ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু
লেখকঃ প্রফুল্লকুমার সরকার
সংগৃহীতঃ হিন্দুত্ববুক্স হতে ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন