২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ৮ )


লঙ্কায় একে একে নিহত বীর রাক্ষস দের শব প্রবেশ করলো । হাহাকার আর কান্না উঠলো । দেবতাদের জয় করেছে যে সব রাক্ষস, তারা সব একে একে নিহত হচ্ছে । রাক্ষসেরা ক্রন্দন করে রাবণকে প্রতিশোধ নেবার জন্য উৎসাহিত করলো। দেবী মন্দোদরী পুনঃ বলল- “হে নাথ! আপনি এখনও কেন এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করছেন না? শ্রীরাম , সীতাকে নিয়ে যাবনেই । অতএব আর যুদ্ধ না করে সীতাকে এবার ফিরিয়ে দিয়ে যুদ্ধ রোধ করুন । আপনাকে বহুবার বুঝিয়েছি শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করা লঙ্কার পক্ষে উচিৎ নয়। দেখতেই তো পাচ্ছেন আপনার অনুগত বীরেরা সব মারা যাচ্ছে।” রাবণ ক্রোধে বলল- “মন্দোদরী! রামের ভাগ্য সঙ্গ দিচ্ছে এখন তাই সে জয়ী হচ্ছে। কিন্তু আমি ভাগ্যনিয়ন্ত্রা নবগ্রহদের পরাজিত করি। কাল আমি যুদ্ধে গমন করবো। দেখি গ্রহেরা কিভাবে রামের সঙ্গ দেয়?” এভাবে রাবণ আস্ফালন করে রাত্রি কাটিয়ে প্রভাতে লক্ষ সেনা, হস্তী, অশ্বারোহী, গজ, রথী নিয়ে বের হল। লঙ্কারাজ যুদ্ধে যাচ্ছেন। সেই মতো ধ্বজা তে ঢাকল সেনাদল । রথের ওপরে রাক্ষস জাতির পতাকা উড়ছিলো । লঙ্কারাজ রাবণ শিবের পূজো করে রথে চাপলেন। কিন্তু ভগবান শিব তাঁর কৃপা তুলে নিয়েছিলেন রাবণের ওপর থেকে । ধনুক, তরবারি, বিবিধ, দিব্যাস্ত্র, বর্শা আদি অস্ত্রাদি নিয়ে রথে উঠলেন। রাবণের রথে বিবিধ মণি, মুক্তা, প্রবাল ইত্যাদি দিনের আলোকেই উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় দ্যুতি প্রকাশ করছিলো । হৈ হৈ করে লঙ্কার মেদিনী কাঁপিয়ে গজবাহিনী, অশ্বারোহী, পদাতিক, রথী সব বের হল। লঙ্কার দ্বার খুলতেই আবার যুদ্ধ শুরু হল। রাবণের রথের আগে কুড়ি সহস্র ধনুর্ধারী অশ্বারোহী রাক্ষস সমানে বানরদের দলের দিকে শর সন্ধান আরম্ভ করলো । শয়ে শয়ে লাঙুর, ভল্লুক, মর্কট, কপি হতাহত হলে বানরেরা বৃহৎ প্রস্তর, বৃক্ষ, বল্লম, শর নিক্ষেপ আরম্ভ করলো। রাবণের সেই সুরক্ষা বাহিনী ছত্রভঙ্গ হলে রাবণ ক্রোধে হস্তীগুলিকে এগিয়ে দিলেন। মদমত্ত হস্তীগুলি ধেয়ে আসলে বানরেরা বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করতে লাগলো।

হস্তীগুলির উপরে থাকা রাক্ষসেরা প্রস্তরের আঘাতে উপর থেকেই নীচে পড়লো। তখন বিশাল পাথর তাদের উপর পড়তেই পিষ্ট হয়ে মাটিটে ডেবে গেলো। হস্তীগুলি ভয় পেয়ে এদিক সেদিক দৌড়ঝাঁপ আরম্ভ করলে রাক্ষস ও রথ গুলি ধ্বংস হল। আবার কিছু হস্তীর তলায় বানরেরা পিষ্ট হল। ভল্লুকেরা অশ্বারোহী দের অশ্ব শুদ্ধো তুলে ভূমিতে আছার মেরে অশ্ব সহ রাক্ষস গুলিকে নিহত করলো। রাবণ তখন বানরের পাল লক্ষ্য করে অগ্নিবান, বায়ুবান, পর্বত বাণ নিক্ষেপ করে সহস্র সহস্র বানর নিধন করতে লাগলেন । গবাক্ষ, মৈন্দ, কুমুদ বানরেরা রাবণের সাথে যুদ্ধ করতে এসে বাণ ফুটে জর্জরিত হল । বিভীষণ তখন ভগবান শ্রীরামকে বলিলেন – “প্রভু! ঐ শ্বেত ছত্র দেখা যাইতেছে, যিনি সেই রথে আসীন- তিনি দেবতাদিগের অজেয় । যার বদনে দোদুল্যমান কুণ্ডল দেখা যাচ্ছে , সেই বীর স্বয়ং রাক্ষস রাজ তথা আমার অগ্রজ দশানন রাবণ।” শ্রীরাম তখন বললেন- “অহঃ ! এই রাক্ষস রাজ রাবণ অনেক তেজস্বী। ইহার দেহের তেজ ভাস্করের ন্যয় বিকশিত হয়েছে। সেই তেজে ইহার দিকে তাকানো যায় না। ইহার দেহ দেবতা ও বড় দানবীরের ন্যয় মনে হচ্ছে। রাবণ কে আজ যমের ন্যয় বোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ভূতগণ এনাকে পরিবেষ্টিত করে আছে । সৌভাগ্যক্রমে এই পাপাত্মা আজ আমার দৃষ্টিতে এসেছে । আমার মনে সীতাহরণজনিত যে ক্রোধ উৎপন্ন হচ্ছে, তার ফলেই আমি এর ওপর অস্ত্র নিক্ষেপ করবো।” এইদিকে হনুমানের সাথে রাবণের প্রবল রণ আরম্ভ হল । হনুমান বৃহৎ শিলা , বৃক্ষ রাবণের দিকে নিক্ষেপ করতেই রাবণ শর সন্ধান করে তা চূর্ণ করলো। তারপর বলল- “লঙ্কায় অগ্নিকাণ্ডের শাস্তি আজ অবশ্যই পাইবি।” এই বলে রাবণ তীক্ষ্ণ দশটি শর হনুমানের দিকে নিক্ষেপ করলো। বাণ ফুটে হনুমান জর্জরিত হলে সুগ্রীব ও অঙ্গদ এগিয়ে আসলো। রাবণ প্রলয়ের বেগে শর সন্ধান আরম্ভ করলে সুগ্রীব ও অঙ্গদ পরাজিত হল। এরপর রাবণ আস্ফালন করলে , তখন শ্রীরাম যুদ্ধে আসলেন। রাবণ শ্রীরামের দিব্য তনু দর্শন করে বলল- “হে ভিখারী বনবাসী! তুমি অত্যন্ত বীর- এতে সন্দেহ নেই। কারণ হরধনু ভঙ্গ করা সাধারণ ব্যাপার নয়। তাড়কা, সুবাহু, মারীচ খড়, দূষণ, বিরাধ, ত্রিশিরা বধ করাও সাধারণ ব্যাপার নয়। তুমি বীর। কিন্তু তোমার থেকেও অধিক বীর আমি । অতএব সীতর চিন্তা ত্যাগ করে এখুনি যুদ্ধ বন্ধ করে প্রস্থান করো। কারণ লঙ্কা জয় তুমি করতে পারবে না। প্রাণ যদি বাঁচাতে চাও তো আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে পলায়ন করো।” এইভাবে কথা বলে রাবণ অতি দর্প প্রকাশ করতে লাগলো ।

ভগবান শ্রীরাম তখন বললেন- “রাবণ! তুমি শিব উপাসক! শাস্ত্রজ্ঞানী। মহান পুলস্ত্য ঋষির বংশজ । কেন নিজের বংশে কালিমা লেপন করছ ? নারী হরণ করে তোমার অপযশ হয়েছে। সীতাকে ফিরিয়ে তোমার ওপর যে কলঙ্ক রয়েছে, তা নিবারণ করো। যুদ্ধ বন্ধ করে সীতাকে ফিরিয়ে দাও।” এরপর ভগবান শ্রীরাম বললেন- “রাবণ! যদি আমি শত যোজন সমুদ্র পার করে আসতে পারি, তবে তোকে বধ করে সীতা উদ্ধার করতেও পারি ।” রাবণ ক্রোধে নানা দিব্যাস্ত্র , শ্রীরামের প্রতি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। শ্রীরাম দিব্যাস্ত্র প্রয়োগে সেগুলো ধ্বংস করলেন । রাবণ ক্রোধে অগ্নিবাণ, পর্বত বাণ, যক্ষ বাণ, গন্ধর্ব বাণ নিক্ষেপ করলেন। ভগবান রাম ইন্দ্রাস্ত্র, বজ্রাস্ত্র , সূর্য বাণ, চক্রবাণ নিক্ষেপ করলেন । দুজনের অস্ত্র যখন মুখোমুখি সংঘর্ষ হল তখন মেদিনী কেঁপে উঠলো। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে রাবণের অস্ত্রগুলি ধ্বংস হল। এবং আগুনের ফুলকি চতুর্দিকে বৃষ্টিধারার ন্যায় পতিত হল। ভগবান রাম শিলাবাণ নিক্ষেপ করলেন। আকাশ থেকে বৃহৎ শিলা মেদিনী কাঁপিয়ে রাবণের রথ, গজ, রথ, অশ্বারোহী গুলিকে পিষ্ট করলো। রাক্ষসদের মধ্যে হাহাকার উঠলো। সকলে পালাতে লাগলো। রাবণ তখণ রেগে বানর সেনাদের ধ্বংস করতে জ্বালা বাণ নিক্ষেপ করলে ভগবান শ্রীরাম বরুণ বাণে, রাবণের বাণ একেবারে অকেজো করে দিলেন । এরপর ভগবান শ্রীরাম ঝড়ের বেগে রাবণের দিকে বাণ চালনা করতে লাগলেন । বাণে রাবণের রথের অশ্ব গুলি, সারথি নিহত হল। ভগবান রাম হাসতে হাসতে দুটি শর নিক্ষেপ করে রাবণের রথের দুটি চক্র কাটলেন। তারপর রাবণের কিরীট বাণ দ্বারা ভূমিতে ফেলে দিলেন। আর এক বাণে রাবণের রথের ছত্র কেটে দিলেন। আর এক বাণে রাবণের ধনুক ও অস্ত্র সকল ভঙ্গ করলেন। তারপর আর এক বাণে রাবণের রথ চূর্ণ চূর্ণ করলেন। প্রচণ্ড শব্দে রাবণের রথ যখন ধ্বংস হল, রাবণ লম্ফ দিয়ে ভূমিতে নামলেন । রাবণ নিঃসহায়, অস্ত্রহীন। ভগবান রাম বললেন- “রাবণ! তুমি ক্লান্ত, সেনাহীন, রথহীন, অস্ত্রহীন। নিরস্ত্র ব্যক্তির ওপর আমি প্রহার করি না। তোমাকে আমি জীবন দান করলাম । যাও লঙ্কায় ফিরে যাও। যদি সুমতির উদয় হয় তবে সীতাকে ফিরিয়ে এই যুদ্ধ বন্ধ করো। অন্যত্থায় কাল আবার যুদ্ধে এসো।” হেরে গিয়ে রাবণ মাথা নীচু করে রইলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।