মেঘনাদ যজ্ঞে বসলো । বিভীষণ ও হনুমান, জাম্বুবান, নল- নীল আদি বানর দলেরা বিভীষণের পিছু পিছু চলল। বিভীষণ সকলকে আগে আগে পথ প্রদর্শন করে নিয়ে গেলো। নিকুম্ভিলা মন্দির থেকে ধূম উঠতে দেখা গেলো। বিভীষণ বলল- “সর্বনাশ। বোধ হয় মেঘনাদ যজ্ঞ আরম্ভ করে দিয়েছে। একবার যজ্ঞ সমাপন হলে আর তাহাকে কেহ পরাজিত করতে পারবে না।” মেঘনাদের যজ্ঞ গৃহের দ্বারে প্রহরায় ছিলো রাবণের অনুগত শ্যাম বর্ণের মায়াবী রাক্ষসেরা। বিভীষণ বললেন- “ওহে বানরগণ! তোমরা সত্বর ঐ রাক্ষসদের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করো। তাহা হইলেই এদের সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে থাকা যজ্ঞরত মেঘনাদকে দেখা যাবে।” এরপর বিভীষণ লক্ষ্মণকে বললেন- “আপনি দিব্যাস্ত্র সমূহ চালনা করে এই রাক্ষস কটক বিনষ্ট করুন । তাহার পর সেই ক্রূরকর্মা , পাপাত্মা মেঘনাদকে বধ করবেন।” এই শুনে লক্ষ্মণ তখন বাণ রাক্ষসদের দিকে ছুড়তে থাকলেন । রাক্ষসেরা সেই বানর সেনা দেখা মাত্রই তোমর, সুতীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলো। বানরেরা বৃক্ষ, প্রস্তর, গদা নিয়ে রাক্ষসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুই দলে রণ আরম্ভ হল। লক্ষ্মণ দেখলো মেঘনাদ যজ্ঞে বসেছে।
জাই কপিনহ সো দেখা বৈসা ।
আহুতি দেত রুধির অরু ভৈসা ।।
কীনহ কপিনহ সব জগ্য বিধংসা ।
জব ন উঠই তব করহিঁ প্রসংসা ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )
এর অর্থ- “ মর্কটগণ গিয়ে দেখল যে মেঘনাদ বসে বসে রক্ত ও মহিষ আহুতি দিচ্ছে। তারা সব যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে দিল । তবুও যখন মেঘনাদ যজ্ঞ থেকে নিবৃত্ত হল না তখন তারা মেঘনাদের প্রশংসা করলো।” কিন্তু মেঘনাদ যজ্ঞ থেকে ওঠে না। লক্ষ্মণের নিক্ষেপিত শরে তাঁর অঙ্গ থেকে রুধির ধারা বের হল। কিন্তু সে যজ্ঞ করতেই থাকলো। তখন হনুমান গেলো বানর দল সহিত।
হনুমান বীর যেন সিংহের প্রতাপ ।
যজ্ঞকুণ্ড ভরি তায় করিল প্রস্রাব ।।
যজ্ঞকুণ্ড উপরেতে হনুমান মূতে ।
ফলমূল যজ্ঞের ভাসিয়া যায় স্রোতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
এই ভাবে আর তাহার সহিত যজ্ঞে প্রস্তর ফেলে যজ্ঞের অগ্নি নির্বাপিত করা হল । হনুমান তখন বলল- “রে দুর্মতি রাবনতনয় ! তুই যদি বীর হোস , তবে কিছুক্ষণ যুদ্ধ করতে পারবি । কিন্তু আমার হস্তে পড়লে প্রাণ ফিরিয়া পাইবি না। আয় আমার সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধ কর। দেখি তবে বুঝিবো তুই সত্যই বীর ।” মেঘনাদ বললেন- “তবে তাই হোক। লঙ্কায় এসেছিস জীবিত দেহে, ফিরবি শবদেহ হয়ে।” এই বলে মেঘনাদ ধনুর্বাণ নিয়ে রথে উঠলো। তারপর হনুমানকে অনবরত শর নিক্ষেপ করে আহত করলো। বিভীষণ এই দেখে লক্ষ্মণকে বললেন- “হে সৌমিত্র! ঐ দেখুন সুরবিজয়ী মেঘনাদ কিভাবে হনুমানকে বধ করবার চেষ্টা করছে । আপনি ভীষণ শর নিক্ষেপ করে ইন্দ্রজিতের প্রাণ হরণ করুন।” এই শুনে লক্ষ্মণ বললেন- “হে মেঘনাদ! আমি তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছি। এসো! আমার সহিত যুদ্ধ করো।” মেঘনাদ বলল- “তাত বিভীষণ! তুমি সম্পর্কে আমার পিতার ভ্রাতা। আমার পূজ্য। কিন্তু তুমি নিজের ভ্রাতার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করেছো । তুমি মন্দবুদ্ধি । তাই মিত্রপক্ষকে ত্যাগ করে শত্রুর দলে যোগদান করেছো। তুমি আত্মীয় স্বজন ছেড়ে শত্রুর সঙ্গে নিবাস করছ। তুমি নিজ পুত্রের শত্রু। কারণ তরণীসেনকে তুমি রক্ষা করো নি। ধন্য আমার ভ্রাতা তরণীসেন । সে শত্রু পক্ষে যোগ দেয়নি। বরং স্বদেশের মান রক্ষার্থে বীরগতি প্রাপ্ত করেছে । যদি স্বজন নির্গুণ ও শত্রু স্বগুণ হয় তথাপি স্বজনের সাথেই নিবাস করা উচিৎ। তোমার ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতা নাই। তুমি নির্দয়ী । তুমি আজ শত্রুকে আমার যজ্ঞস্থানের পথ দেখিয়ে দিয়েছো। তুমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছো । তুমি পিতৃব্য হলেও আজ তোমার সহিত আমি শত্রু ভাব পোষণ করবো।”
বিভীষণ বলল- “মেঘনাদ! আমি তোমার স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞাত । তুমি আমার পুত্রতুল্য। কিন্তু আমার অগ্রজ তথা তোমার পিতা দশানন ধর্মের মার্গ ত্যাগ করে অধর্মকে আশ্রয় করেছে । যদি আমি পাপাচারী হতাম তবে অগ্রজ রাবণকে আশ্রয় করে থাকতাম । আমি রাক্ষস কূলে জন্মিয়াছি- কিন্তু ধর্ম ছাড়িনি । আমি যদি পাপচারে লিপ্ত হতাম তবে আমার অগ্রজ ভ্রাতা আমাকে চোখের মণি করে রাখতেন। কিন্তু আমি সর্বদা ওনার অন্যায় কর্মের বিরোধিতা করেছি, তাই আমি তাঁহার চোখের শূল। মেঘনাদ! আমি তোমার পিতা তথা আমার অগ্রজকে বহুবার সংযত হতে বলেছি। কিন্তু সে কোন কথাই মানে নি। একের পর এক দুষ্কর্ম করে গেছে। কত মুনি- ঋষি- ধর্মাত্মাকে বধ করেছে, দেবকণ্যাদের অপহরণ করে এনে লঙ্কার দাসী বানিয়েছে। না জানি কত নারীর সতীত্ব নাশ করেছে , দেবী লক্ষ্মীর অবতার মাতা বেদবতীকে যজ্ঞকুণ্ডে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করেছে। অগ্রজ ভ্রাতা কুবেরের পুত্রবধূ রম্ভাকে ধর্ষণ করেছে। এমনকি মাতা সীতার মতো সতী নারীর দিকে কুদৃষ্টি দিয়েছে। এই পাপে আজ তাঁহার এই অবস্থা হয়েছে। আমি ধর্মের পথে এসে কোন পাপ করিনি । জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হল ধর্মপথে থেকে জীবন ধারণ করা। পুত্র মেঘনাদ! তুমি নির্দোষ। তুমি বলশালী। অতএব তুমিও ভগবান শ্রীরামের শরণে এসে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো।” মেঘনাদ গর্জে জানালো সে এইহেন প্রস্তাবে রাজী নয়। লম্ফ দিয়ে রথে উঠলো। মেঘনাদ বলল- “এবার আমার বীক্রম দেখো।” এই বলে রথ থেকে নানা ঘাতক অস্ত্র দ্বারা বানর সেনাদের বধ করতে লাগলো ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন