পাহার পর্বতে ঘেরা এই জনহীন প্রান্তরে ‘রাম’ নাম শুনে হনুমান আশ্চর্য হলেন । একবার ভাবলেন তিনি কি সত্যই শুনছেন । পরে দেখলেন না ঠিকই , কেহ রামনাম উচ্চারন করছে । এইস্থানে প্রভুর ভক্ত দেখে হনুমান খুবুই খুশী হলেন । বিশেষত রামনাম শুনলে তিনি তন্ময় হয়ে যান । সেই দিব্য নাম শুনে হনুমান মুগ্ধ হয়ে করতালি দিয়ে প্রথমে প্রভুর নামে মগ্ন হলেন । এমনকি প্রভুর নির্দেশ বিস্মৃত হলেন । পরে কালনেমি রামনাম সমাপ্ত করলে হনুমানের সকল কিছু মনে পড়লো । হনুমান সেই ছদ্দবেশী কালনেমিকে ধরতে পারেনি । মারুতি তখন সেই সাধুকে নিজ পরিচয় দিয়ে প্রনাম জানিয়ে বলল- “গোঁসাই! এই নির্জন প্রান্তরে আপনার ন্যয় সাধক দেখে আশ্চর্য হয়েছি। এইস্থানে কেহই নাই। চতুর্দিকে কেবল তুষার। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল শ্বেতধবল পর্বত। সাধারণের পক্ষে এখানে বসবাস করা অত্যন্ত কঠিন। আপনি নিশ্চয়ই কোন মহাত্মা যিনি ইন্দ্রিয়বিজয় করে শীতলতাকে জয় করেছেন। অথবা এ নিশ্চয়ই প্রভুর কৃপা হবে। তাহার ফলে আপনি শীতকে জয় করেছেন। হে মহাত্মা আমিও আপনার ন্যয় প্রভুর সামান্য ভক্ত । এখন লঙ্কারাজ রাবণের সাথে প্রভুর যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে রাবণপুত্র মেঘনাদের অস্ত্রে প্রভুর ভ্রাতা লক্ষ্মণ ঠাকুর প্রাণ হারাতে বসেছেন। আমাকে সূর্য উদয়ের আগে গন্ধমাদন পর্বত থেকে ভেষজ ঔষধি নিয়ে যেতে হবে। কৃপা করে বলবেন কোথায় সেই পর্বত?” কালনেমি মনে মনে হাস্য করলো । ভাবল এই কপিকে মূর্খ বানানো হয়েছে। এই কপিরা সাধারণত মূর্খ হয়। সামান্য কদলীর জন্য বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে লোকের মনোরঞ্জন করে। মাদারী ডুগডুগি বাজিয়ে নাচায়। এই কপিরা বরাবরই অকাট মূর্খ। কালনেমি বলল- “আমি প্রভু শ্রীরামের সামান্য ভক্ত। অবশ্যই আপনাকে গন্ধমাদন পর্বত দেখিয়ে দেবো। কিন্তু আপনি এত দূর হতে ঝড়ের বেগে এসেছেন। কিঞ্চিৎ জলপান করে বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” কালনেমি মুখে রামের জয়ধ্বনি করলেও অন্তরে কেবল রাবণের জয়ধ্বনি করছিলো। আর ভাবছিলো কিভাবে হনুমানকে জালে আটকানো যায়। হনুমান বলল- “আরে গোঁসাই! আমি এখন প্রভুর সেবায় নিয়োজিত। এই অবস্থায় বিশ্রাম নেওয়া আমার কাছে পাপ। আপনি কেবল জল প্রদান করুন।” কালনেমি এই সুযোগটাই খুঁজছিলো । তাড়াতাড়ি গরল মেশানো বৃহৎ এক কলসি দিয়ে জলপান করতে বলল। হনুমান হেসে বলল- “গোঁসাই! এই সামান্য জলে আমার উদরের এক কোনাও তৃপ্ত হবে না।” কালনেমি দেখলো চালাকী ব্যর্থ ।
সেই রাক্ষস বলল -“তাহলে আপনি এই আশ্রমের পাশে বৃহৎ দিঘিতে জলপান করুন। সেখানে প্রচুর জল আছে। আর সেই গভীর দিঘির জল অত্যন্ত মিষ্ট ও শীতল। যা পান করা মাত্রই আপনার সকল ক্লান্তি দূর হবে। তারপর আপনাকে গন্ধমাদন পর্বতের খোঁজ দেবো।” হনুমান সেই পুকুরের দিকে গেলো । কালনেমি মনে মনে আনন্দ পেতে লাগলো। কারণ হনুমানকে এবার সেই বৃহৎ কুমীর ছিঁড়ে খাবে । হনুমান সেই টলটলে দিঘির জল দেখে নামলো । হাতে মুখে জল দিয়ে অঞ্জলি ভরে ভরে জল পান করতে থাকলো । শাপিত হয়ে অপ্সরা গন্ধকালি সেখানে বৃহৎ কুমীর হয়ে ছিলো । সে দেখলো এক কপি জলপান করছে। কপির মাংস আহারের লোভে তাকে টেনে আনলো। আসতে আসতে গভীর জল দিয়ে এসে হনুমানের সামনে উপস্থিত হল। তারপর লম্ফ দিয়ে হনুমানকে আঘাত করলো। এত বৃহৎ কুমীর দেখে হনুমান অবাক হল। কুমীর নখ, দন্ত দিয়ে হনুমানকে আঘাত করতে লাগলো । হনুমানের দেহ সকলে আঘাত লাগলো। হনুমান পালটা তখন কুমীরের ওপর মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলো । সমানে মুষ্ট্যাঘাতে কুমীরের দম আটকে যেতে লাগলো । দুজনের যুদ্ধে দিঘির জলে যেনো ঝড় উপস্থিত হল। ঝাপ্টাঝাপ্টিতে দিঘির জল উথলে পার ভেঙ্গে যেতে লাগলো । দুপাশে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো । দিঘির পদ্ম সকল হনুমানের উপর এসে পড়েছিলো। মনে হচ্ছিল্ল জলদেবতা , রুদ্রাবতার হনুমানকে পদ্ম ও জলজ নানা ফুলে শৃঙ্গার করেছেন । একসময় হনুমান , কুমীরের মুখ দুটি দুদিকে টেনে টেনে ছিন্নভিন্ন করলেন। চোখ ঠিকরে বের হয়ে কুমীর মারা গেলো। সেখান থেকে শাপমুক্ত হয়ে সুন্দরী অপ্সরা গন্ধকালি বের হয়ে হনুমানের স্তবস্তুতি করে বলল- “হে পবনপুত্র! আমি স্বর্গের অপ্সরা গন্ধকালি। শাপিত হয়ে কুমীর রূপে এখানে ছিলাম। আপনার হস্তে নিধন হয়ে মুক্তিলাভ করেছি । হে রুদ্রাবতার। আপনি যাকে রামভক্ত ভেবেছেন , সে আসলে ছদ্দবেশী রাক্ষস কালনেমি। রাবণের আদেশে সে এখানে আপনাকে হত্যা করতে এসেছে । প্রথমে সে বিষ মেশানো কলসির জল আপনাকে পান করতে দিয়েছিলো। তারপর আপনাকে এখানে প্রেরণ করেছে। এখানে যে পর্বত আছে, যাহার থেকে দিব্য জ্যোতি উৎপন্ন হচ্ছে সেটিই গন্ধমাদন পর্বত।” এই বলে অপ্সরা গন্ধকালি নানা স্তবস্তুতি করে স্বর্গে প্রস্থান করলো। হনুমান এসে কালনেমিকে আক্রমণ করলো।
কালনেমি দেখলো হনুমান বেঁচে ফিরেছে । সে অতি আশ্চর্য হল। তারপর হনুমানের আঘাত খেয়ে সাধু রূপ ছেড়ে মূল বিকট রূপ রাক্ষস রূপে আসলো । দুজনে প্রবল যুদ্ধ আরম্ভ হল। একে অপরকে কিল- চড়- মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলো । হনুমানের আঘাত খেয়ে কালনেমি একেবারে দুর্বল হয়ে পড়লো। হনুমান সেই রাক্ষসকে ভূমিতে ফেলে তাকে চরণ দিয়ে চেপে ধরলেন । কালনেমির জিহ্বা, চোখ যেনো বের হয়ে আসলো। মুহূর্তে কালনেমি মারা গেলো। মৃত্যুর আগে সে একবার ‘রাম’ শব্দ উচ্চারন করেছিলো । হনুমান তখন বলল- “মৃত্যুর আগে প্রভুর নাম নিয়েছিলি। যা ব্যাটা তোর সদ্গতি হল।” এরপর হনুমান গন্ধমাদন পর্বতের কাছে গেলো । সেখানে দেখলো নারদাদি মুনি সেবিত দিব্য পর্বতকে । সেই স্থান হতেই ত্রিপুর বিনাশকালে ভগবান শিব অস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলেন । সেখানে ধর্মরাজকে অনুচর সহিত দেখতে পেলেন। পবিত্র মন্দির দেখলেন । সেখানে অগ্নি , কুবের ও চৌদ্দ ব্রম্মাণ্ডের সূর্য, পিণাক ধনুক, মহাদেবের বাহন বৃষ দেখলেন । আর সেখানে অনেক ঔষধি দেখলেন । হনুমান বুঝতেই পারছিলেন না যে কোনটা আসলে সেই ঔষধি। কারণ এখানে বহু ভেষজ ঔষধি ছিলো। আর তা থেকে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ ও দিব্য জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল। হনুমান ভাবল গোটা পর্বত টাই তুলে নিয়ে যাবে। তাহলে বৈদ্য সুষেণ নিজেই চিনে নিয়ে ঔষধি প্রয়োগ করবে। ভুল বশত অন্য ঔষধি নেওয়ার থেকে এটাই ভালো। হনুমান সেই গন্ধমাদন কে স্তবস্তুতি করলেন চলার জন্য। গন্ধমাদন পর্বত মানলো না। সে পালটা হামলা করলো হনুমানের ওপর। হনুমানের গদার আঘাতে গন্ধমাদনের জায়গা জায়গাতে পাথর সকল পতিত হল। ধস নামলো। কিছু জায়গায় ফাটল ধরল । ভারতবর্ষে উত্তরাখণ্ডে এই পর্বত এখনও আছে। এখানকার লোকেরা হনুমানের পূজা করে না। কারন তাদের ধারনা হনুমান জোর করে এই পর্বত নিয়ে গিয়েছিলো। এখানে হনুমানের কোন মন্দিরও নেই। কেউ পূজাও করে না। যাই হোক। হনুমান তখন বিশাল বড় হলেন। তারপর হস্তে তুললেন গন্ধমাদন পর্বত ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন