এরপর ভগবান শ্রীরাম বললেন- “প্রমীলা ! তুমি মহাসতী নারী। তোমার স্বামীর প্রাণ হরণ করতে যমদেবতা সাহস করেন না। পাছে তোমার শাপে তিনিই না ভস্ম হন। তুমি বীরপ্রতাপী মেঘনাদের অন্তিম সংস্কারের আয়োজন করো।” প্রমীলা স্বামীর শির আঁচলের তলায় আচ্ছাদন করে লঙ্কায় প্রবেশ করলেন। অশোক বনে গেলেন। যেখানে বন্দিনী সীতাদেবী ছিলেন। তিঁনিও ত্রিজটার কাছে মেঘনাদের নিধন সংবাদ পেয়েছিলেন । কিন্তু তিনি জানতেন প্রমীলা সতী নারী। যখন প্রমীলা তাঁর নিকটে গেলেন, তখন সীতাদেবীর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে পড়ছিলো। জানকী দেবী বললেন- “প্রমীলা! তোমাকে সান্ত্বনা প্রদান করবার ভাষা আমার কাছে নেই। সেই ধৃষ্টতা নেই। কারণ আমার দেবর তোমার স্বামীর প্রাণ হরণ করেছে। তুমি চাইলে আমার সাথে শত্রুসম আচরণ করতে পারো।” প্রমীলা তখন রোদন করে প্রথমে এসে সীতাদেবীর চরণে প্রণাম করলেন। বললেন- “মহা সতীর চরণে প্রণাম জানিয়ে সেই পরম সৌভাগ্য আমি লাভ করলাম। আমার কি সাধ্য সতী নারীর ক্ষতি করবার। সতী নারীর তেজে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর অবধি শিশু হন। মাতঃ আপনি সতী শিরোমণি। একজন লোভীর নিকট ধনসম্পত্তি যতটা প্রিয়- একজন সতী নারীর কাছে তাঁর স্বামী ততটাই প্রিয়। তাই আমি আমার স্বামীর চিতায় প্রবেশ করতে চাই। ভগবান শ্রীরাম আদেশ দিয়েছেন, আপনিই অনুমতি দিলে এই সৌভাগ্য সম্ভব। কৃপা পূর্বক এই অভাগিনী নারীকে দয়া করুন।” মাতা সীতাদেবী বললেন- “আমার স্বামী জানেন নারী ধর্মের আদর্শ আমার দ্বারাই জগতে বিস্তৃত হবে। কিন্তু আমি তোমাকে সতী হতে সমর্থন করতে পারি না। যদি মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামের স্ত্রী সতী প্রথার সমর্থন করেন, তবে এই প্রথা সর্বস্তরে প্রচলণ হবে। এতে নারীদের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে।”
প্রমীলা অনেক বুঝিয়ে বললেন- “দেবী! আমার স্বামী বচন বদ্ধ হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও আমি আর উনি কদাপি সঙ্গছাড়া হবো না। অতএব আপনি এই আদেশ প্রদান করুন। আমি চাই না, আমাকে অনুসরণ করে সকল পতিব্রতা নারী সতী হোক। কিন্তু এই নিয়ম কেবল আমারই জন্য। পতি হীনা হয়ে আমি কিরূপে থাকবো? না আমার পতির আত্মা শান্তি পাবেন, না আমি পাবো।” প্রমীলার অনেক কাকুতি মিনতি সীতাদেবী কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলেন না । শেষে বললেন- “মন না চাইলেও কেবল তোমাকে সতী হতে আদেশ করলাম। সতী প্রথা অধর্ম, আর অধর্মই থাকবে।” এই বলে সীতাদেবী প্রমীলার সিঁথি সিদুরে রাঙিয়ে বললেন- “তুমি সতী নারী রূপে আজ থেকে জগতে খ্যাত হবে। মাতা অনুসূয়া, সাবিত্রী, মাতা নর্মদার সাথে তোমার নাম শ্রদ্ধা পূর্বক স্মরণ করা হবে।” প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে ফিরে গেলো। মন্দোদরী অনেক বুঝালেন কিন্তু প্রমীলা নারাজ। সে সতী হবেই। মেঘনাদের দেহ নানা প্রকার সুগন্ধি পুস্প ও সুগন্ধি দিয়ে সাজানো হল। নিথর দেহ শত চামর, পাখা ব্যঞ্জন করতে করতে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হল। পেছন পেছন প্রস্তরবৎ হয়ে প্রমীলা চলল। তাঁহাকে নববধূর ন্যায় সজ্জা, কপালে সিঁদুর দেওয়া হয়েছিলো। মেঘনাদের চিতায় উঠে স্বামীর মুণ্ড ক্রোড়ে নিলো। চন্দন কাষ্ঠের চিতায় ঘৃত ঢেলে অগ্নি সংযোগ করা হল। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলে উঠলো। পর্বত প্রমান আগুনের শিখা উঠলো। দেখা গেলো তার মধ্যেই সতী প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে নির্বিকার ভাবে বসে আছেন । এই সতী নারীর ওপর দেবতাবৃন্দ পুস্পাদি বর্ষণ করলেন। সকলে দেখলো গগন থেকে পুস্প সেই চিতায় ঝরে পড়ছে। আগুনের শিখা একসময় প্রমীলাকেও ঢেকে দিলো। তাহার পর ধূম ভিন্ন আর কিছুই দেখা গেলো না। শরত এর নির্মল আকাশে সেই ধূম বহু দূর দূর অবধি ছড়িয়ে গেলো । চিতা নির্বাপিত হলে মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ের অস্থি শাস্ত্র মতে সমুদ্রে বিসর্জন করা হল ।
ভগবান শ্রীরাম সকল কিছুই দেখছিলেন। তাঁর কমলসম নয়ন হতে অশ্রু বিন্দু নির্গত হল। সীতাদেবীও এই সতীর আত্মত্যাগে অশ্রু মোচন করছিলেন। সীতাদেবী দেখলেন তাঁহাদের বিদেহী আত্মাকে। তাঁহারা সীতাদেবীকে নমস্কার ও স্তুতি করলেন । এছাড়া ভগবান শ্রীরাম দেখলেন মেঘনাদ আর তাঁর স্ত্রী প্রমীলার আত্মা তাঁহার সম্মুখে। তাঁহারা করজোড়ে ভগবান শ্রীরামকে নানা স্তবস্তুতি করছেন । ভগবান শ্রীরামই কেবল দেখতে পেলেন এই দৃশ্য। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম তখন আশীর্বাদ করে বললেন- “তোমাদের আর কেউ সঙ্গছাড়া করতে পারবে না। আমার শাশ্বত ধাম বৈকুণ্ঠে তোমরা চির অবস্থিতি লাভ করে সুখ আনন্দ প্রাপ্তি করবে।” মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ে ভগবানের ধাম প্রাপ্ত করেছিলেন । রাবণ বিমর্ষ হয়ে বসেছিলো রাজসভাতে। শূন্য আসন গুলি দেখে অন্ধকারে বসেছিলেন । এক সময় এই রাজসভা কত রাক্ষস বীরেরা অলঙ্কৃত করে থাকতো। আজ একটিও নেই। হঠাত তার সামনে আবির্ভূত হল রম্ভা। সেই অপ্সরা অট্টহাস্য করে বলল- “রাবণ!তুই না বীর! তো তোর এই অবস্থা কেন? কোথায় গেলো তোর সেই প্রতাপ? সেই বল? তোর এই অবস্থা দেখে দেবতাগণ খুবুই প্রীত হয়েছেন। তোর বংশ নাশ হতে দেখে আমিও আনন্দিত হয়েছি । রাবণ মনে পড়ে আমার ওপর কিভাবে অত্যাচার করেছিলি ? নারীর চোখের জল বজ্র তুল্য। তা কেবল বিনাশ আনে। তুইও এবার মরবি ।” এই বলে রম্ভা অদৃশ্য হল। রাবণের মনে হল শত শত সাধু তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে আনন্দে হাস্য করছেন। মনে পড়লো বেদবতীর কথা। নন্দীর কথা মনে পড়লো। মনে হয় এই সেই নর আর বানর। মন্দোদরী এসে বললেন- “এখন আপনি চিন্তা করছেন? এত কিছু হওয়ার পর? যদি আমার পরামর্শ শুনে আপনি সীতা হরণ না করতেন বা সীতাকে অনেক আগেই ফিরিয়ে দিতেন- তবে আজ এমন শোক আমরা পেতাম না। শ্রীরামের শক্তি দেখেছেন? কোথায় গেলো আপনার সেই রাক্ষস কূল? কোথায় সেই বলশালী রাক্ষসেরা? কোথায় আমার বীর পুত্র। সব আপনার দম্ভের কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলছি এখনও সময় আছে, সীতাকে ফিরিয়ে দিন।” রাবণ বলল- “এই সীতার জন্যই এত কিছু। তার জন্যই রাম লঙ্কা আক্রমণ করেছে। আজ এই সীতাকেই আমি পৃথিবী থেকে দূর করবো।” এই বলে রাবণ ধারালো খড়্গ নিয়ে অশোক বনে সীতাকে হত্যা করতে গেলো।
( ক্রমশঃ )
প্রমীলা অনেক বুঝিয়ে বললেন- “দেবী! আমার স্বামী বচন বদ্ধ হয়েছিলেন যে মৃত্যুর পরেও আমি আর উনি কদাপি সঙ্গছাড়া হবো না। অতএব আপনি এই আদেশ প্রদান করুন। আমি চাই না, আমাকে অনুসরণ করে সকল পতিব্রতা নারী সতী হোক। কিন্তু এই নিয়ম কেবল আমারই জন্য। পতি হীনা হয়ে আমি কিরূপে থাকবো? না আমার পতির আত্মা শান্তি পাবেন, না আমি পাবো।” প্রমীলার অনেক কাকুতি মিনতি সীতাদেবী কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারলেন না । শেষে বললেন- “মন না চাইলেও কেবল তোমাকে সতী হতে আদেশ করলাম। সতী প্রথা অধর্ম, আর অধর্মই থাকবে।” এই বলে সীতাদেবী প্রমীলার সিঁথি সিদুরে রাঙিয়ে বললেন- “তুমি সতী নারী রূপে আজ থেকে জগতে খ্যাত হবে। মাতা অনুসূয়া, সাবিত্রী, মাতা নর্মদার সাথে তোমার নাম শ্রদ্ধা পূর্বক স্মরণ করা হবে।” প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে ফিরে গেলো। মন্দোদরী অনেক বুঝালেন কিন্তু প্রমীলা নারাজ। সে সতী হবেই। মেঘনাদের দেহ নানা প্রকার সুগন্ধি পুস্প ও সুগন্ধি দিয়ে সাজানো হল। নিথর দেহ শত চামর, পাখা ব্যঞ্জন করতে করতে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হল। পেছন পেছন প্রস্তরবৎ হয়ে প্রমীলা চলল। তাঁহাকে নববধূর ন্যায় সজ্জা, কপালে সিঁদুর দেওয়া হয়েছিলো। মেঘনাদের চিতায় উঠে স্বামীর মুণ্ড ক্রোড়ে নিলো। চন্দন কাষ্ঠের চিতায় ঘৃত ঢেলে অগ্নি সংযোগ করা হল। দাউ দাউ করে চিতা জ্বলে উঠলো। পর্বত প্রমান আগুনের শিখা উঠলো। দেখা গেলো তার মধ্যেই সতী প্রমীলা স্বামীর শির নিয়ে নির্বিকার ভাবে বসে আছেন । এই সতী নারীর ওপর দেবতাবৃন্দ পুস্পাদি বর্ষণ করলেন। সকলে দেখলো গগন থেকে পুস্প সেই চিতায় ঝরে পড়ছে। আগুনের শিখা একসময় প্রমীলাকেও ঢেকে দিলো। তাহার পর ধূম ভিন্ন আর কিছুই দেখা গেলো না। শরত এর নির্মল আকাশে সেই ধূম বহু দূর দূর অবধি ছড়িয়ে গেলো । চিতা নির্বাপিত হলে মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ের অস্থি শাস্ত্র মতে সমুদ্রে বিসর্জন করা হল ।
ভগবান শ্রীরাম সকল কিছুই দেখছিলেন। তাঁর কমলসম নয়ন হতে অশ্রু বিন্দু নির্গত হল। সীতাদেবীও এই সতীর আত্মত্যাগে অশ্রু মোচন করছিলেন। সীতাদেবী দেখলেন তাঁহাদের বিদেহী আত্মাকে। তাঁহারা সীতাদেবীকে নমস্কার ও স্তুতি করলেন । এছাড়া ভগবান শ্রীরাম দেখলেন মেঘনাদ আর তাঁর স্ত্রী প্রমীলার আত্মা তাঁহার সম্মুখে। তাঁহারা করজোড়ে ভগবান শ্রীরামকে নানা স্তবস্তুতি করছেন । ভগবান শ্রীরামই কেবল দেখতে পেলেন এই দৃশ্য। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম তখন আশীর্বাদ করে বললেন- “তোমাদের আর কেউ সঙ্গছাড়া করতে পারবে না। আমার শাশ্বত ধাম বৈকুণ্ঠে তোমরা চির অবস্থিতি লাভ করে সুখ আনন্দ প্রাপ্তি করবে।” মেঘনাদ ও প্রমীলা উভয়ে ভগবানের ধাম প্রাপ্ত করেছিলেন । রাবণ বিমর্ষ হয়ে বসেছিলো রাজসভাতে। শূন্য আসন গুলি দেখে অন্ধকারে বসেছিলেন । এক সময় এই রাজসভা কত রাক্ষস বীরেরা অলঙ্কৃত করে থাকতো। আজ একটিও নেই। হঠাত তার সামনে আবির্ভূত হল রম্ভা। সেই অপ্সরা অট্টহাস্য করে বলল- “রাবণ!তুই না বীর! তো তোর এই অবস্থা কেন? কোথায় গেলো তোর সেই প্রতাপ? সেই বল? তোর এই অবস্থা দেখে দেবতাগণ খুবুই প্রীত হয়েছেন। তোর বংশ নাশ হতে দেখে আমিও আনন্দিত হয়েছি । রাবণ মনে পড়ে আমার ওপর কিভাবে অত্যাচার করেছিলি ? নারীর চোখের জল বজ্র তুল্য। তা কেবল বিনাশ আনে। তুইও এবার মরবি ।” এই বলে রম্ভা অদৃশ্য হল। রাবণের মনে হল শত শত সাধু তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে আনন্দে হাস্য করছেন। মনে পড়লো বেদবতীর কথা। নন্দীর কথা মনে পড়লো। মনে হয় এই সেই নর আর বানর। মন্দোদরী এসে বললেন- “এখন আপনি চিন্তা করছেন? এত কিছু হওয়ার পর? যদি আমার পরামর্শ শুনে আপনি সীতা হরণ না করতেন বা সীতাকে অনেক আগেই ফিরিয়ে দিতেন- তবে আজ এমন শোক আমরা পেতাম না। শ্রীরামের শক্তি দেখেছেন? কোথায় গেলো আপনার সেই রাক্ষস কূল? কোথায় সেই বলশালী রাক্ষসেরা? কোথায় আমার বীর পুত্র। সব আপনার দম্ভের কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলছি এখনও সময় আছে, সীতাকে ফিরিয়ে দিন।” রাবণ বলল- “এই সীতার জন্যই এত কিছু। তার জন্যই রাম লঙ্কা আক্রমণ করেছে। আজ এই সীতাকেই আমি পৃথিবী থেকে দূর করবো।” এই বলে রাবণ ধারালো খড়্গ নিয়ে অশোক বনে সীতাকে হত্যা করতে গেলো।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন