২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-১৫)


লক্ষ্মণ ও রাবণনন্দন অতিকায়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ চলতে লাগলো । দিব্যাস্ত্র সকল টক্করে ভয়ানক বজ্রপাত , প্রলয় সমান হাওয়া বইলো । যেনো সমুদ্রে শত ঝঞ্জা উৎপন্ন হল । বানর ও রাক্ষসেরা ভয়ানক ভাবে লড়ছিলো । অন্তরীক্ষে দেবতাবৃন্দ এই যুদ্ধ দেখছিলেন । দেবতাসকল দিব্যদৃষ্টিতে দেখছিলেন যুদ্ধভূমিতে নিহত কোন রাক্ষস যমালয়ে যাচ্ছে না। সে দেবত্ব প্রাপ্তি করছে । মুক্তিলাভ করছে । ইন্দ্রাদি দেবতাবৃন্দ তখন দেবর্ষি নারদকে প্রশ্ন করলেন- “হে মহামুনে! আমরা এই ঘটনায় বিস্মৃত হয়েছি। রাবণের অনুচর রাক্ষসেরা শাস্ত্র নিয়ম উলঙ্ঘন করে চিরকাল পাপকাজ করে এসেছে। সৃষ্টির নিয়ম অনুযায়ী এই পাপীদিগের মৃত্যুর পর নরকে গমন করা উচিৎ। কিন্তু এরা কেনই বা দেবত্ব প্রাপ্তি হচ্ছে ?” নারদ মুনি হাস্য করে বললেন- “মহেন্দ্র! এই রাক্ষসেরা ‘রামকে মারো’, ‘রামের সেনাদের মারো’ বলে যুদ্ধে এসেছে। মৃত্যুর আগে তারা শত্রু ভাবে হলেও তারকব্রহ্ম ‘রাম’ নাম উচ্চারন করেছে। শত্রুভাবে হলেও মনে ভগবান শ্রীরামের মূর্তি ধ্যান করেছে। সেই তারকব্রহ্ম প্রভুর নাম শরণ মাত্রেই তাহাদিগের সকল পাপ নাশ হয়েছে। তাই তারা দেবত্ব প্রাপ্ত হয়েছে। হে দেবগণ ! বহু পূর্বে আমি একবার যমের আলয়ে গিয়ে যমের নিষেধ সর্তেও কৌতূহল বশত দক্ষিণ দিকে গমন করি। সেখানে গিয়ে দেখি মর্তের লোকেরা কর্ম অনুসারে নানা কুণ্ডে পতিত হয়ে যাতনা পাচ্ছে। সেই দেখে শিহরিত হয়ে আমি ‘নারায়ণ’ বলে প্রভুর নাম উচ্চারণ করি। আমার মুখ হতে প্রভুর নাম শুনে সকল পাপী উদ্ধার হয়েছিলো- আর যমালয় হল পাপীশূণ্য। হে সুরবৃন্দ! প্রভুর নাম হেলা ভরে নিলেও, শত্রুতা ভাবে নিলেও তা মঙ্গল ফল প্রদান করে।” এই শুনে দেবতারা বুঝলেন যে ‘রাম’ নাম নেওয়ার জন্যই এইসব মহাপাপীরা মুক্তি পাচ্ছে । ওদিকে অতিকায় তীব্র যুদ্ধ আরম্ভ করলো। চোখের নিমিষে বাণে বাণে আছন্ন করলো। লক্ষণের দিকে একবারে তিন, পাঁচ এমনকি সাতটি তীক্ষ্ণ শর নিক্ষেপ করলেন । লক্ষ্মণ সেই বাণ গুলি ধ্বংস করে দিলেন । এরপর লক্ষ্মণ অগ্নিবাণ আনয়ন করলেন । মনে হল যেনো লক্ষ্মণের ধনুক সহ বাণ থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে । আগুনের হুল্কা যেনো ভূভাগ আজ ভস্ম করবে এমন ছিলো তেজ ।

মন্ত্র বলে লক্ষ্মণ সেই বাণ অতিকায়ের পাণে নিক্ষেপ করলেন। অতিকায় সূর্যাস্ত্র প্রকট করলেন। সেই অস্ত্র দিয়ে প্রবল জ্যোতি দেখা গেলো যে রাক্ষস ও বানরেরা চোখ মুদ্রিত করলেন । অতিকায় সূর্যাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। অগ্নিবাণ আর সূর্যাস্ত্র মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে যেনো চতুর্দিক কেঁপে উঠে দুটি অস্ত্রই ধ্বংস হল। গর্জন করে অতিকায় তখন ঐষিকবাণ নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ ঐন্দ্রাস্ত্র নিক্ষেপ করে সেটিকে ধ্বংস করলো। তারপর অতিকায় যমাস্ত্র নিক্ষেপ করলে লক্ষ্মণ বায়ব্য অস্ত্রে প্রতিরোধ রলেন । এরপর অতিকায় ও লক্ষ্মণ একে অপরের দিকে প্রচুর মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। একটি অস্ত্রের আঘাতে লক্ষ্মণ পড়ে গেলো। অতিকায় হাস্য করে বলল- “যারে বালক! তোর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে যুদ্ধে আনয়ন কর। তুই কিছুই যুদ্ধ শিখিস নি।” এই কথা শুনে লক্ষ্মণের ক্রোধে মুখমণ্ডল আরক্তিম হল। উঠে দাঁড়িয়ে ধনুকে ব্রহ্মাস্ত্রের আহ্বান করলেন । ব্রহ্মাস্ত্র যখন ধনুকে প্রকট হল- চতুর্দিকে প্রলয় সমান হাওয়া প্রবাহিত হল, মেদিনী কাঁপতে লাগলো। ব্রহ্মাস্ত্রের থেকে ঘন ঘন বিকট আগুনের হুল্কা নির্গত হল । আগুনের ফুলকি উৎপন্ন হয়ে চতুর্দিকে ঝড়ে পড়তে লাগলো। মন্ত্র বলে লক্ষ্মণ সেই অস্ত্র অতিকায়ের দিকে নিক্ষেপ করলো। অতিকায় সেই অস্ত্র নিবারণের নিমিত্ত নানা অস্ত্র নিক্ষেপ করলো বটে- কিন্তু ব্রহ্মাস্ত্র নিস্ফল হল না। তীব্রবেগে সেই অস্ত্র আসতে দেখে অতিকায় বর্শা, বাণ, গদা, কুঠার, শূল, মুগুর নিক্ষেপ করলো কিন্তু সেই ব্রহ্মাস্ত্র নিবৃত্ত হল না। দেখতে দেখতে ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতে অতিকায়ের কিরীট দ্বারা সুসজ্জিত মস্তক ধড় থেকে কেটে ভূমিতে পড়লো। অতিকায়ের অন্ত হলে রাক্ষসেরা পলায়ন করলো। লঙ্কায় কান্নার রোল উঠলো। রাক্ষসদের বিধবা পত্নী সকল সাদা বস্ত্র পড়ে অলঙ্কারাদি বিসর্জন করে ক্রন্দন করতে লাগলো। ঘরে ঘরে কান্না ব্যতীত অপর কিছুই শোনা গেলো না । ত্রিশিরা, দেবান্তক, নরান্তক, অতিকায়ের মাতারা ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলো। চারদিকে কেবল কান্না আর কান্না । লঙ্কায় যেনো আলো জ্বলল না। সীতাদেবী এমনই অভিশাপ দিয়েছিলেন যে রাবণের অনুগত সেই রাক্ষসেরা সব নিহত হবে। ঘরে ঘরে উঠবে কান্নার রোল। লঙ্কা শ্মশান হবে। মন্দোদরী বুঝলো এই সকল সতী নারী সীতার অভিশাপের ফল। সে যতদিন লঙ্কায় থাকবে রোজ এমন সর্বনাশ হবে। তবুও রাবণ বোঝে না । রাবণ নিহত পুত্রদের শবের পাশে কপালে হাত দিয়ে ক্রন্দন করতে লাগলো। অক্ষয় কুমার থেকে আরম্ভ হয়ে একে একে পুত্রদের নাশ চলছে । এই শত্রু অতটাও শক্তিহীন নয়- যতটা জ্ঞান করা হয়েছিলো। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ অবধি নিহত হয়েছে । রাবণ আদেশ দিলো- “এর প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বো।”

রাক্ষসদের আদেশ দিলো দশানন- “সেই রাম কি কোন অলৌকিক শক্তি ধরে ? তোমরা সতর্ক ভাবে অশোকবণ ও লঙ্কাপুরী পাহারা দিবে । যে কেউ প্রবেশ করবে তাহাকে সতর্ক দৃষ্টিতে রাখবে। কি প্রদোষ, কি অর্ধরাত্রি , কি প্রভাত – সর্বদা সতর্ক হয়ে প্রহরা দিবে। শত্রুপক্ষের সেনারা লঙ্কায় প্রবেশ করে কিনা সেই বিষয়ে দৃষ্টি রাখবে।” কান্নার মাধ্যমে বীরেদের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন হল । ইন্দ্রজিৎ তখন বললেন- “পিতা! আপনি এবার আমাকে আদেশ দিন। আমি অযুথ শক্তি ধরি । নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করে যুদ্ধে গমন করতে আদেশ দিন। দেখবেন আমার শরে বানরেরা সব ভূমিতে পতিত হয়ে যমালয়ে যাত্রা করেছে। আরোও দেখবেন আমার শরে সুগ্রীব, অঙ্গদ, রাম, লক্ষ্মণ, হনুমান , জাম্বুবান সকলে মারা গেছে। পিতা এবার আমি ভয়ানক ভাবে যুদ্ধ করে বানরের রক্তে লঙ্কার বালুকারাশি লাল বর্ণে পরিণত করবো। ভ্রাতাদের নিথর শব দেখে আমি স্থির থাকতে পারছি না।” রাবণ বলল- “যাও পুত্র! বিজয়ী হয়ে আসো। শত্রুসেনাকে ধ্বংস করো। বিভীষণকে দেখে আত্মীয় জ্ঞান না করে তার সাথেও শত্রুসম আচরণ করবে। তেইশ অক্ষৌহিণী অতি বীর রাক্ষস সেনা তোমার আদেশ মেনে কাল যুদ্ধ করবে।” অপরদিকে শত্রু সেনাদের বধ করে বানরেরা খুশী হয়েছিলো। বিভীষণ বললেন- “গুপ্তচর মারফৎ সংবাদ পেয়েছি কাল মেঘনাদ, নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সমাপন করে যুদ্ধে আসবে। সে বড়ই বীর। নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সমাপনের পর সে অজেয় হবে।” মেঘনাদের নাম শুনে কপিদের মুখ শুকিয়ে গেলো। কারণ মেঘনাদের শক্তির কথা সে শুনেছে। মেঘনাদ সমস্ত রাত্রি ধরে দেবী নিকুম্ভিলার পূজা করলো। শত ছাগ, মহিষ বলি দিলো। যজ্ঞ করলো পূজাবিধি মেনে । যজ্ঞ থেকে বিবিধ অস্ত্রাদি উঠে এলো । একে একে মেঘনাদের তূনে জমা হল। মেঘনাদের আহুতি প্রদান করতেই এমন বহু মারনাস্ত্র উঠে এলো। দিব্য ধনুক, খড়্গ, ঢাল, বর্ম , তরবারি , শেল, শূল উঠে এলো। দিব্য রথ প্রকট হল। এইভাবে মেঘনাদ সেনা সমেত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। প্রভাতে তার স্ত্রী প্রমীলার কাছে বিদায় নিয়ে পিতামাতাকে প্রনাম করে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।