২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৩)


ভগ্নদূত গিয়ে দশাননকে সংবাদ দিলো যে কুম্ভ ও নিকুম্ভ বীরগতি প্রাপ্ত করেছে। রাবণ মাথায় হাত দিয়ে বসলো । লঙ্কার বীরদের নিথর দেহ ঘীরে তাদের স্ত্রী, পুত্র, কন্যারা রোদন করতে লাগলো । ক্রন্দনে লঙ্কার আকাশ বাতাস ভরে গেলো । সাদা শাড়ি পড়ে বিধবারা শাঁখা পলা বিসর্জন দিয়ে, সিঁথির সিঁদুর মুছে মাটিটে পড়ে রোদন করতে লাগলেন । লঙ্কার সাগর পারে লক্ষ কোটি চিতা জ্বলে উঠলো । লঙ্কার বাতাসে কান পাতলেই কেবল রাক্ষসদের পরিবারের হাহাকার আর রোদন ছাড়া কিছুই শোনা গেলো না। মন্দোদরী সেই বিধবাদের পাশে নিজেকেও সাদা থান পড়ে দেখতে পেলো ভোরে স্বপ্নে। অত্যন্ত আশাঙ্কিত হল। আরোও দেখলো পুত্রবধূ প্রমীলা, মেঘনাদের ছিন্নমুণ্ড ক্রোড়ে নিয়ে চিতায় উঠে সতী হয়েছেন । এসব দেখে মন্দোদরী অনেক ভয় পেলো। কিন্তু দশানন তার স্ত্রীর কথা এক কর্ণ দিয়ে শুনে অপর কর্ণ দিয়ে বহিষ্কার করলো । কুম্ভকর্ণের ঘৃহে শূন্য হল। প্রভাত হল । হঠাত রাবণের মনে পড়লো, তার ভ্রাতা খড় শ্রীরামের বাণে হত হয়েছে পঞ্চবটিটে। খড়ের পুত্র মকরাক্ষ ত আছে। সে পিতার ন্যায় বুদ্ধিমান । অত্যন্ত ধুরন্ধর সে। অনেক বুদ্ধি রাখে। তাহাকেই যুদ্ধে প্রেরণ করা হোক। তখুনি সেনারা গিয়ে মকরাক্ষকে ডেকে আনলো । মকরাক্ষ বীর দর্পে খুড়া দশাননের সাথে সাক্ষাৎ করতে এলো। রাবণ বলল- “পুত্র ! তুমি এই বিপদে ভরসা । লঙ্কার প্রচুর বীর হত হয়েছে। আমার রাজসভায় যে বীরেরা অলঙ্কৃত করতো, যাহাদের দেখে ত্রিভুবন ভয় পেতো তারা সকলে বানরদের হস্তে হত হয়েছে। তুমি বিহিত করো। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সব নাশ করে দাও। রাম, লক্ষ্মণের কাটা মুণ্ড এনে আমাকে দেখাও।” মকরাক্ষ বলল- “আমি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম খুঁড়ামহাশয়! সেদিন পঞ্চবটিটে যদি আমি থাকতাম , তবে সেইদিনই রাম, লক্ষ্মণের বধ করে সীতাকে এনে আপনার হস্তে দিতাম। কিন্তু রামের ভাগ্য ভালো যে সেদিন আমি ছিলাম না। কিন্তু সেদিন যা করিনি , আজ তা করবো।”

মন্দোদরী বলল- “না পুত্র! তুমি সেই যুদ্ধে যেয়ো না। তুমি বরং লঙ্কা ছেড়ে পলায়ন করো। যে এই লঙ্কাতে থাকবে সেই হত হবে। ওনার দম্ভ আর দর্প সকলকে মৃত্যুর মুখে প্রেরণ করবে।” রাবণ বকাঝকা করে বলল- “মন্দোদরী! তুমি ময় দানবের কন্যা। জাতিতে দানবী হয়েও কেন মনুষ্য, বনের পশুকে ভয় করো? কেন যুদ্ধে গমনরত বীরকে মৃত্যুভয় প্রদর্শন করছ ? তোমার কর্তব্য মকরাক্ষকে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে প্রেরণ করা। কিসের তোমার এত ভয়?” মকরাক্ষ তখন বলল- “আপনি চিন্তা করবেন না খুঁড়িমা। আমি যুদ্ধে গেলে দেখবেন ঐ দুই নর আর বনের পশুরা পলায়ন করবার পথ পাবে না। পিষে পিষে তাদের মৃত্যু প্রদান করবো। আমার শক্তি তারা দেখেনি।” রাবণ তিন অক্ষৌহিণী সেনা দিয়ে মকরাক্ষকে যুদ্ধে পাঠাবে স্থির করলো। মকরাক্ষ বলল- “খুঁড়ামহাশয়! আমি এক বুদ্ধি রচেছি। যাহাতে অল্প সময়ে সমস্ত বানর আর দুই নরকে বধ করা যাবে। তাহারা দুজন আর্য । তাহারা গো হত্যা করে না। আজ যুদ্ধে কোন হস্তীবাহিনী বা অশ্বারোহী যুদ্ধে যাবে না। আপনি গোশালা থেকে বৃষদের প্রদান করুন। আজ সমস্ত রথে অশ্বের বদলে বৃষভ থাকবে। অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনীর পরিবর্তে রাক্ষসেরা আজ বৃষভবাহিনী হয়ে যুদ্ধ করবে। পাছে বৃষের অঙ্গে আঘাত লেগে গোহত্যা হয় এই ভয়ে তারা আজ যুদ্ধ করবে না। আমরা অনায়েসে অস্ত্র দিয়ে তাহাদিগের প্রাণহরণ করবো।”

কিন্তু এক সুমন্ত্রণা আছয়ে ইহার ।
শুনিয়াছি রঘুনাথ বিষ্ণু অবতার ।।
বড়ই ধার্মিক রাম, ধর্মেতে তৎপর ।
অস্ত্রাঘাত না করেন গরুর উপর ।।
এতেক ভাবিয়া মকরাক্ষ নিশাচর ।
যুক্তি ক’রে ধেনু বৎস আনায় বিস্তর ।।
নব নব বৎস সব রথে লয়ে তোলে ।
রথের চৌদিকে ধেনু বান্ধে পালে পালে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

এতেক ভাবে মকরাক্ষ লঙ্কার দ্বার খুলে যুদ্ধে বের হল। বানরেরা প্রস্তর বৃক্ষ নিক্ষেপ করতে উদ্যত হলে আশ্চর্য হল। একটাও অশ্ব বা হস্তী নেই। সব ধেনু, বৃষভ, বাছুর । এখন কিভাবে অস্ত্র নিক্ষেপ করা যাবে। হনুমান বলল- “কেহ অস্ত্র নিক্ষেপ করবে না। গোহত্যা হলে প্রভু শ্রীরাম কিন্তু আর হয়তো যুদ্ধ করবেন না।” এই সুযোগে রাক্ষসেরা লক্ষ লক্ষ কপি নিধন করতে থাকলো। কপিরা কোন অস্ত্রের আঘাত করতে পেলো না।

মকরাক্ষ রাক্ষসদের আদেশ দিলো- “তোমরা আমার সম্মুখে থেকে বানরদের হত্যা করবে । আজ মহারাজ রাবণের আদেশে আমি রাম, লক্ষ্মণ আর সুগ্রীবকে বধ করবো।” কামরূপী, পিঙ্গলনেত্র , অতি ক্রুড় রাক্ষসেরা গোরথ ও গোপৃষ্ঠে চেপে অনবরত শর আর বর্শা নিক্ষেপ করে বানরদের বধ আরম্ভ করলো। যুদ্ধে বানরদের দেহের পর্বত তৈরী হল। মকরাক্ষ হাস্য করতে করতে নানা দিব্যাস্ত্রে বানরদের রক্তে যেনো নদী তৈরী করলো। বানরেরা দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করতে লাগলো। হনুমান কিছু রাক্ষসকে গোপৃষ্ঠ থেকে সাবধানে তুলে ভূমিতে আছার মেরে বধ করলো। কিন্তু এভাবে তিন অক্ষৌহিণী সেনাকে রোধ করা সম্ভব হল না । নল, নীল, গবাক্ষ, কুমুদ বানরেরা মকরাক্ষের শরে আহত হয়ে পলায়ন করে প্রভু শ্রীরামের কাছে গেলো। শ্রীরাম তখন বললেন- “এই রাক্ষসেরা অতি কাপুরুষ। যেমন তাহাদিগের রাজা। যে কিনা সাধুবেশে পরস্ত্রী হরণ করে। আমাকেই যুদ্ধে যেতে হবে ।” এই বলে ভগবান শ্রীরাম যুদ্ধে এসে দেখলেন যে সত্যই রাক্ষসেরা গোপৃষ্ঠে আরোহন করে বানর নিধন করছে। ভগবান শ্রীরাম তখন শার্ঙ্গ ধনুক থেকে পবন বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের প্রভাবে সমস্ত বৃষভ, ধেনু, বাছুর উড়ে গিয়ে লঙ্কার গোশালায় ঢুকে গেলো। বিন্দুমাত্র আহত হল না তারা। যুদ্ধে আর কোন পশু দেখা গেলো না। গোবিহীন রথ গুলি ভূপতিত হল। তখন বানরেরা পালটা আঘাত করলো। প্রস্তর, বৃক্ষ দিয়ে রাক্ষসদের বধ করে করে সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে দিলো। মকরাক্ষ, শ্রীরামের সাথে যুদ্ধ করতে করতে পরাজিত হল। তখন ভগবান শ্রীরাম , মকরাক্ষের দিকে অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন। অগ্নিবাণ গিয়ে মকরাক্ষের হৃদয় বিদীর্ণ করলো। সেই বাণের প্রভাবে মকরাক্ষের গোটা শরীর টাই ঝলসে গেলো। তার চেহারা অবধি চেনা যাচ্ছিল্ল না। দেহের অস্থিমাংস গলে গলে বেরিয়ে এসেছিলো। মকরাক্ষ নিহত হতেই সেদিনের যুদ্ধ থামল ।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।