মায়া সীতার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে । রাক্ষস বিদ্যুৎজিহ্ব হত হয়েছে। রাবণের অনান্য সকল পুত্র ও নাতিপুতি, জ্ঞাতিগুষ্টি সকলেই নিহত হয়েছে । এ কেমন শত্রু, ভাবতে লাগলো রাবণ। লঙ্কায় প্রবেশ করে আক্রমণ হানছে । এসব ভেবে রাবণ চিন্তিত হল। মন্দোদরী আবার সীতাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার কথা বলতে রাবণ ধমকে স্ত্রীকে নিবৃত্ত করলেন । মেঘনাদ এলো। বলল- “পিতা! এবার আমি আবার যুদ্ধে গমন করবো। পিতা আমি যতবার যুদ্ধে গিয়েছি ঐ রাম লক্ষ্মণকে আহত করে দিয়েছি। কিন্তু ওদের ভাগ্য ভালো যে বেঁচে যায়। এবার আর বাঁচবে না। দেবী নিকুম্ভিলার আরাধনা করে আমি আবার যুদ্ধে যাবো। দেবীর সামনে বিজয়ের জন্য যজ্ঞ করবো। দেবীর কৃপায় সেই যজ্ঞ থেকে দিব্য রথ, কবচ, অস্ত্রাদি উঠে আসবে।” মন্দোদরী বললেন- “পুত্র! কেন জানি না আমার হৃদয় বড় শঙ্কিত হচ্ছে। এর পূর্বে এমন হয় নি। শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ বড়ই শক্তিমান। অতএব তাঁহাদিগের সাথে যুদ্ধ কদাপি করো না। তুমি বরং প্রমীলাকে নিয়ে লঙ্কা থেকে কোথাও চলে যাও । তুমি দূরে থাকলেও বেঁচে থাকবে। আমি শান্তি পাবো। কিন্তু এখানে থাকলে তোমার পিতার দর্পের হাওয়ায় তোমারো জীবনদীপ নির্বাপিত হবে। মাতা হয়ে পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ শ্রবণ করবার শক্তি বিধাতা আমাকে প্রদান করেন নি। তোমার ভ্রাতাদিগের অবস্থা কি হয়েছে দেখেছোই ত?” এত বলে মন্দোদরী রোদন করে মেঘনাদকে বোঝাতে লাগলেন। রাবণ বলল- “মন্দোদরী! তোমার কি নিজ পুত্রের শক্তির ওপর বিশ্বাস নেই ? মেঘনাদ সেই ইন্দ্রকে পরাজিত করে আবদ্ধ করেছে- এই মানুষ ত অতি তুচ্ছ। বৃথা কেন শঙ্কা করছ ? বরং মেঘনাদকে আশীর্বাদ করে যুদ্ধে প্রেরণ করো।” মন্দোদরী বলল- “ মাতা হয়ে পুত্রকে মৃত্যুমুখে যাওয়ার আশীর্বাদ দেবো ? আপনার কি সম্পূর্ণ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে? শ্রীরাম অনেক শক্তি রাখেন। তাঁহাকে পরাজিত করা যায় না। এই যুদ্ধে এত রাক্ষসের মৃত্যু দেখেও কি আপনি এই সরল সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না?”
মেঘনাদ বলল- “মাতা! আমিও কিছু কম শক্তি রাখি না। কিন্তু বীর কখনো নিজমুখে নিজের শক্তির কথা বলে না। আমি যুদ্ধ করে প্রমান করবো যা আমি কত শক্তি রাখি। কৃপা করে আমাকে যুদ্ধ গমনের আদেশ করুন। পিতার বাক্য পালণ করা পুত্রের ধর্ম । সেই শ্রীরাম পিতার বচন পালন করতেই রাজ্য ছেড়ে বনে এসেছেন। এখন আমি আমার পিতার কথা মেনে যুদ্ধে গিয়ে প্রমান করবো- পিতার কথা মান্যতা করাই পুত্রের কর্তব্য।” এত বলে মেঘনাদ তখন স্ত্রীর কাছে বিদায় নিতে গেলেন । প্রমীলা অনেক কান্নাকাটি করে স্বামীকে যুদ্ধে যেতে বাধা দিলো। বলিল- “প্রভু! কোনদিন আপনাকে বাধা প্রদান করিনি। আমি জানি সীতাদেবীকে অপহরণ করে আনয়ন করা অন্যায়। তবুও সেই ঘটনা নিয়ে আমি কোনপ্রকার অভিযোগ করিনি। আমি আপনার জন্য নাগদেবীর উপাসনা করে নাগপাশ অস্ত্র প্রদান করেছিলাম আপনাকে। কিন্তু নাগদেবী আর সহায়তা করবেন না বলে জানিয়েছেন। কৃপা করে আপনি আপনার মাতার কথা মেনে নিন। চলুন আমি আপনি অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।” মেঘনাদ বলল- “ছিঃ! প্রমীলা তোমার বুদ্ধিকে ধিক । এই সঙ্কটের সময় আমি পিতাকে ছেড়ে , নিজের স্বদেশ ছেড়ে পলায়ন করবো ? দেবী সীতাকে অপহরণ করা আমি সমর্থন করি না । কিন্তু তার জন্য আমি নিজে ধর্ম পালন থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। পিতার সঙ্কটে পিতার সাথে থাকাই পুত্রের ধর্ম । এই অবস্থায় আমি যুদ্ধে না গমন করলে কিংবা লঙ্কা ছেড়ে পলায়ন করলে আমার অধর্ম হবে।” মেঘনাদ এরপর স্ত্রী প্রমীলাকে আলিঙ্গন করে বললেন- “প্রমীলা! এই যুদ্ধের পর আমি জীবিত থাকি আর হত হই- তুমি আর আমি কদাপি সঙ্গছাড়া হবো না। যতদিন বেঁচেছি একসাথে বেঁচেছি- যমের সাধ্যি নেই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটানোর। ” এই বলে মেঘনাদ প্রস্থান করলো। প্রমীলা নানা অশুভ চিহ্ন দেখতে পেলো। সে ভূমিতে পড়ে ক্রন্দন করতে লাগলো ।
মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞের আয়োজন করছেন। সেখানে কড়া সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরী করেছেন রাবণ। একটা মাছি গলে যাবার উপায় নেই। এতই সেনা প্রহরায় সেখানে । মেঘনাদ রাত্রিকালে নিকুম্ভিলা পূজার আয়োজন করলেন। নিকুম্ভিলা দেবী সম্বন্ধে বলা যাক। ‘রামায়ণ’ ভিন্ন এই দেবীর নাম অন্য কোথাও নেই। এই দেবীকে আসুরিক দেবী বলেন অনেকে- যেটা সম্পূর্ণ ভুল। বস্তুত লঙ্কায় একটি শক্তিপীঠ আছে । পীঠনির্ণয়তন্ত্র গ্রন্থে লিখিত আছে –“লঙ্কায়াং নূপুরশ্চৈব ভৈরবো রাক্ষসেশ্বরঃ । / ইন্দ্রাক্ষী দেবতা তত্র ইন্দ্রোণোপাসিতা পুরা ।।” ভগবান হরির চক্রে খণ্ডিত হয়ে সতী দেবীর চরণের নূপুর এখানে পতিত হয়। দেবীর নাম ইন্দ্রাক্ষী ভৈরবের নাম রাক্ষসেশ্বর । পণ্ডিতেরা এই নিকুম্ভিলা দেবীকে সেই শক্তিপীঠের দেবী মানেন । কিন্তু শাস্ত্রে লঙ্কার শক্তিপীঠের দেবীকে নিকুম্ভিলা নয়- ‘ইন্দ্রাক্ষী’ বলে সম্বোধন করা আছে। বহু পূর্বে বৃত্রাসুরের হাতে রাজ্য হারিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র দেবতাদিগের সহিত এখানে এসে দেবী ভগবতীর তপস্যা করেছিলেন । তাই এই নাম দেবীর। লঙ্কায় এই দেবীর মন্দির এখনও আছে। তবে এটি শক্তিপীঠ রূপে স্বীকৃতি পায় নি । মেঘনাদের এই যজ্ঞের কথা বিভীষণ শুনেছিলো।
বিভীষণ বলে শুন রাজীব- লোচন ।
সামান্যেতে ইন্দ্রজিৎ না হবে পতন ।।
নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করে দুষ্ট নিশাচর ।
করিয়াছে যজ্ঞকুণ্ড লঙ্কার ভিতর ।।
যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিয়া যদি যায় রণে ।
স্বর্গ মর্ত্য পাতালেতে কার সাধ্য জিনে ।।
ব্রহ্মা দিয়াছেন শাপ শুন নারায়ণ ।
ইন্দ্রজিৎ- যজ্ঞ ভঙ্গ করিবে যে জন ।।
ইন্দ্রজিৎ সংগ্রামে মরিবে তার হাতে ।
লক্ষ্মণ পাঠায়ে দেহ আমার সঙ্গেতে ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
বিভীষণ বললেন- “হে শ্রীরাম! নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সমাপন হলে এই যুদ্ধে লঙ্কার জয় নিশ্চিত। ব্রহ্মা বলেছেন ইন্দ্রিজিতের যজ্ঞ ভঙ্গ করে তাহাকে নিধন সম্ভব। নাহলে সম্ভব না। অতএব সেনা সমেত লক্ষ্মণ ঠাকুরকে আমার সহিত প্রেরণ করুন।” লক্ষ্মণ বললেন- “নিরস্ত্র অবস্থায়, যজ্ঞে রত মেঘনাদকে যজ্ঞে বাধা দিয়ে যুদ্ধ করা ত ছল চাতুরী, অধর্ম।” ভগবান শ্রীরাম বললেন- “হে লক্ষ্মণ। প্রিয় ভ্রাতা! আমি জানি তুমি ন্যায় নীতি পালন করো। কিন্তু এই রাক্ষসেরা কপট দ্বারা যুদ্ধ করে। পূর্বেই দেখেছো এরা কখনো সীতার নকল মূর্তি দেখিয়ে আমাদের দুর্বল করতে চেষ্টা করছে, কখনো বৃষবাহিনী হয়ে যুদ্ধে এসেছে, যাতে গো হত্যার ভয়ে আমরা অস্ত্র নিক্ষেপ না করি। এই রাক্ষসেরা ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়েছে। মেঘনাদ যতদিন বেঁচে থাকবে সে দুর্মতি রাবণের শক্তিবৃদ্ধি করে অধর্ম বিস্তার করবে। আমি শপথ নিয়েছি এই রাক্ষসদের বিনাশ করবার। ধর্ম, ন্যায়, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য যদি ছল অবলম্বন করা যায়- তবে তাহা পাপ বলে গণ্য হয় না। বালীকে বধ করবার সময় আমি নিজেও এইরূপ পথ অবলম্বন করেছি। চতুরতা দ্বারা যদি মহৎ কাজ সম্পন্ন হয়- তবে তাহা পাপ নয়।” এইভাবে লক্ষ্মণকে বুঝালেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন