রাবণের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে দেখে রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লো । মন্দোদরী আদি সুহিত জনেরা রাবণকে আবার সীতা ফিরিয়ে দেবার অনুরোধ জানালো । কিন্তু রাবণের মনে ক্রোধের আগুন জ্বলছে । মনে মনে ভাবছে কিভাবে রাম লক্ষ্মণকে খতম করা যায় । এইভাবে ভাবনা ভাবছিলেন । সেই সময় মেঘনাদ এসে যুদ্ধযাত্রা করতে চাইলো । মেঘনাদ বলল- “পিতা! আপনার ভয়ে চন্দ্র সূর্য অবধি ভয়ে ভয়ে থাকে। ঐ তুচ্ছ মানব আর বনের পশুর নিকট আপনার পরাজয় কোনভাবেই হতে দেবো না। হতে পারে রাম লক্ষ্মণ বড় যোদ্ধা বা মায়াবী বীর- কিংবা সেই বৈকুণ্ঠের নারায়ণ । আপনি আমাকে আদেশ করুন পিতা।” রাবণ আদেশ দিলো । কারণ মেঘনাদের বীক্রম রাবণ সহ গোটা লঙ্কা জানতো । মেঘনাদ বড় বীর । তাঁর মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করবার ক্ষমতা আছে । ইন্দ্রকে পরাজিত করেই ত ইন্দ্রজিৎ নামে আখ্যায়িত হয়েছে । মেঘনাদ যুদ্ধ করতে গমন করলো । মেঘনাদের স্ত্রী প্রমীলা ছিলেন মহাসতী । তিনি নাগকুলের কন্যা ছিলেন । প্রমীলা নাগদেবীর আরাধনা করে নাগদেবীকে সন্তুষ্ট করে নাগপাশ অস্ত্র লাভ করেছিলেন । সেই অস্ত্র স্বামীর হাতে দিয়ে কপালে তিলক চর্চিত করলেন । পুস্পাদি দ্বারা আরতি করে যুদ্ধ যাত্রার অনুমতি দিলেন । নিকুম্ভিলা পূজা সেড়ে মেঘনাদ যুদ্ধের জন্য তৈরী হলেন । মেঘনাদ সেনা নিতে চাইলো না। রাবণ বহু অশ্বারোহী, রথ, হস্তী, পদাতিক ইত্যাদি দিয়ে আশীহাজার রাক্ষস সাথে দিলেন। ঘাতক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাক্ষসেরা হৈ হৈ করতে করতে বের হল। লঙ্কার দ্বার খুলতেই রাক্ষসেরা ঝাঁপিয়ে পড়লো, অপরদিকে বানরেরা প্রস্তুত ছিলো । দু দলে প্রচণ্ড যুদ্ধ আরম্ভ হল। দু দলের সৈনিক একে অপরকে হত্যা করতে লাগলো । ভল্লুক, কপি, মর্কটেরা বড় বড় পাথর, বর্শা, গাছের বৃক্ষ ফেলে রথ, হস্তী, অশ্ব, রাক্ষস গুলিকে বধ করতে লাগলো । অপরদিকে রাক্ষসদের হস্তী গুলির পদপিষ্ট হয়ে, ঘাতক অস্ত্রে, নানা শরে কপি, ভল্লুক, মর্কটেরা হতাহত হতে থাকলো । সমুদ্রের বালি উড়ে চতুর্দিকে ধোঁয়ার ন্যায় হল। চারিদিকে কেবল মৃত্যু চিৎকার , অস্ত্রের সংঘর্ষের শব্দ, ঘোড়া হস্তীর চিৎকার, বিজয় উল্লাস ভিন্ন কিছুই শোনা গেলো না। যতদূর দৃশ্য দেখা যায় কেবল এই রকম পরিবেশ দেখা গেলো । যুদ্ধে যখন রাক্ষস সেনাদের বধ করে বানরেরা আনন্দ করছিলো, তখন ঘটলো অতি অপ্রিয় ঘটনা ।
আকাশে মেঘের আড়াল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শর এলো। শরে বানর, ভল্লুক, মর্কট, লাঙুর দের শিরোচ্ছেদ হল। কারোর আবার শরীর শত টুকরো হল। কারোর হাত পা বিছিন্ন হয়ে গেলো। কারোর মুণ্ড গুলো সাড়ি সাড়ি ভাবে কেটে সমুদ্রে পড়লো । ছিন্ন কবন্ধ হয়ে বানরেরা হত হতে লাগলো । মেঘের আড়াল থেকে কে এইভাবে যুদ্ধ করছে তা জানার জন্য রামচন্দ্র, বিভীষণকে জিজ্ঞেস করলেন। বিভীষণ বলল- “প্রভু! এই মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ, ভ্রাতা দশাননের পুত্র মেঘনাদ করতে পারে। সে ইন্দ্র সহ দেবতাদের পরাজিত করে ‘ইন্দ্রজিৎ’ নাম প্রাপ্তি করেছে ।” মেঘনাদের রথ দেখা যায় না । কেবল মেঘের আড়াল হতে তার গর্জন ও আস্ফালন শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টির ন্যায় চতুর্দিকে আগুনের গোলা পড়ে যেন কপিদের নিহত করছে । মেঘনাদ বলছে – “কোথায় রাম লক্ষ্মণ? সাহস থাকলে এসে যুদ্ধ করুক।” অঙ্গদ বলল- “ওরে মূঢ় ! বেশী আস্ফালন করিস না। তোর পিতা একটা তস্কর । তস্কর পুত্রের এত আস্ফালন মানায় না।” এই বলে অঙ্গদ একটি প্রকাণ্ড শাল গাছ ঘুড়িয়ে মেঘনাদের দিকে ছুড়ে দিলো । মেঘনাদ এক শরে সেই শাল গাছকে চূর্ণ চূর্ণ করে দিলো। তারপর আর এক শরে অঙ্গদের জ্ঞান হরণ করলো । এরপর শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ এসে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । সূচীমুখ, শিলামুখ অস্ত্র সকল বর্ষণ করে রাক্ষস সেনাদের বধ করলেন । তারপর মেঘনাদের সাথে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন । দিব্যাস্ত্র সকল ঝঙ্কারে যেনো প্রলয় উপস্থিত হল । মেঘনাদ কত বাণ মারেন। ভীষণ অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে বাণ গুলি আসতে আসতেই ভগবান রাম ও শ্রীলক্ষ্মণ সেইগুলি ধ্বংস করেন । এইভাবে মেঘনাদ “কালদণ্ড” বাণ নিক্ষেপ করলেন । প্রচণ্ড কালো ধোঁয়াতে সেই অস্ত্র ছুটে আসতে লাগলো । ভগবান রাম তখন সূর্যবাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের জ্যোতি মেঘনাদের বাণকে একেবারে অকেজো করে দিলো । মেঘনাদ রেগে শত বাণ নিক্ষেপ করলেন । ভগবান শ্রীরাম এমন এক বাণ নিক্ষেপ করলেন যা একটি ঢালের আকার হয়ে শত বাণকে প্রতিরোধ করলো। সেই ঢালে শত বাণ স্পর্শ করতেন চূর্ণ হল বাণ গুলো ।
এইভাবে মেঘনাদ আকাশের চারিপাশে মায়া দ্বারা ভ্রমণ করতে করতে বাণ চালনা করতে লাগলেন । বৃষ্টির শরের ন্যায় বাণ আকাশ থেকে উল্কা পিণ্ডের ন্যায় ছুটে আসতে লাগলো । কোন মেঘের আড়ালে মেঘনাদ লুকিয়ে আছে , তা বোঝা গেলো না। কেবল তার অট্টহাসের আওয়াজ শুনে সেইদিকেই বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন রাম ও লক্ষ্মণ । কিন্তু সেখানে থেকে মেঘনাদ অদৃশ্য হয়ে অন্যদিকে গিয়ে বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন । বানর দের মৃতদেহের যেনো পর্বত জমল । এমনই ছিলো মেঘনাদের বাণের তেজ। মেঘনাদ বলল- “কাকা বিভীষণ ! তুমি গিয়ে শত্রুর দলে ভিড়েছো ? তোমাকেও নিস্তার দেবো না।” এই বলে মেঘনাদ বিভীষণের পাণে বাণ বর্ষণ করতে থাকলে বিভীষণের সমস্ত অঙ্গ দিয়ে রক্তপাত হতে থাকে। বিভীষণ গিয়ে গুপ্ত স্থানে আশ্রয় নিলেন । এরপর মেঘনাদ হনুমান, সুগ্রীবের প্রতি বাণ বর্ষণ করতে লাগলেন । হনুমান গদা দিয়ে বাণ গুলি সড়িয়ে সুগ্রীবকে প্রাণে বাঁচালেন । মেঘনাদের বীক্রমে ছত্রভঙ্গ হতে লাগলো বানরেরা । রাবণ সব দেখে অট্টহাস্য করতে লাগলেন । এরপর মেঘনাদ বললেন- “ওহে বনবাসী কুমার। লঙ্কারাজ রাবণের সাথে যুদ্ধ করার পরিণতি হয় মৃত্যু। তোমাদের আমি সেই শাস্তি প্রদান করছি।” এই বলে মেঘনাদ নাগপাশ অস্ত্র মন্ত্র বলে নিক্ষেপ করলেন। নাগপাশ অস্ত্র শত নাগে রূপান্তরিত হয়ে রাম লক্ষ্মণের পানে আসতে থাকলো । শত নাগ এসে রাম লক্ষ্মণ কে খুব জোরে পেঁচিয়ে ধরল । নাগেদের বিষের প্রভাবে রাম লক্ষ্মণের চেতনা লোপ পেলো। ধনুক খসে পড়লো। দুজনেই ভূমিতে পতিত হয়ে অজ্ঞান হলেন । মেঘনাদ অট্টহাস্য করে লঙ্কায় ফিরে গেলো।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন