২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব- ১১ )



কুম্ভকর্ণ কক্ষ ছেড়ে বের হল। তারপর লঙ্কার প্রাসাদে গেলেন । মাতা কেকসী, অগ্রজ রাবণ, রাণী মন্দোদরীকে প্রনাম জানালেন । রাবণ নিজের ভ্রাতাকে আশীর্বাদ দিলেন। তারপর অনেক স্নেহ প্রদান করলেন। এরপর বললেন- “ভ্রাতা! বিরূপাক্ষ তোমাকে সকল কিছুই বর্ণনা করেছে নিশ্চয়ই । সেই মর্কট আর দুই বনবাসীকে কিছুতেই আমি পরাজিত করতে পারছি না। না জানি ওদের মধ্যে কি এমন শক্তি
আছে। তাই তোমাকে অকালে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুললাম আমার প্রিয় ভ্রাতা। এখন তুমিই আমার একমাত্র ভ্রাতা। বিভীষণ বেঁচে থেকেও সে আমার কাছে মৃত। কারন সে ঐ শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়েছে। সেই দুষ্টদের তুমি বিনাশ করো ভ্রাতা।” কুম্ভকর্ণ বললেন- “দুষ্ট ওরা নয় ভ্রাতা! দুষ্ট আপনি! এই যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে একমাত্র আপনার দর্পের কারণে। আর আপনার দর্পের কারণেই লঙ্কার বীরেরা এবং আপনার পুত্র অক্ষয় নিহত হয়েছে। ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে কলঙ্ক নিয়ে আসলেন, সাথে লঙ্কার সর্বনাশকে বহন করে এনেছেন। এসব তারই পরিণতি । আপনি নিজেই নিজের দুর্ভাগ্য আহ্বান করেছেন। শ্রীরামের শান্তি প্রস্তাব মেনে কেন সীতাদেবীকে ফিরিয়ে দিলেন না? যদি আপনি এত বড় বীর হতেন তবে রাম- লক্ষ্মণ কে বধ করে সীতাকে নিয়ে আসতেন। আপনি চৌর্য বৃত্তি অবলম্বন করে নিজেকে ভীরু বলে প্রমানিত করেছেন। আমাকে বলতেন , আমি ভগিনীর অপমানের প্রতিশোধ নিতাম। আর সীতাদেবী স্বয়ং মাতা লক্ষ্মী। দেবর্ষি নারদ মুনি আমাকে সেই কথাই জানিয়েছেন। ভ্রাতা বিভীষণ সঠিক কাজ করেছে, সে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করেছে। আর আপনি আমাদের ধার্মিক, সু পরামর্শদাতা ভ্রাতাকেই লঙ্কা থেকে নিষ্কাশন করলেন?” কুম্ভকর্ণের মুখে এমন কথা আশা করেন নি রাবণ। ক্রোধে ফেটে পড়লেন। শেষে কি এই ভ্রাতাও গিয়ে ঐ শত্রু পক্ষের সাথে যোগ দেবে ? এই সু পরামর্শ দশাননের মোটেও ভালো লাগলো না। তিনি বললেন- “তুমি কি আমাকে ধর্ম কথা শেখাচ্ছো?”

কুম্ভকর্ণ বলল- “দাদা আপনি কোন ধর্ম পালন করেছেন সঠিক ভাবে ? পিতা বিশ্বশ্রবা ও মাতা কেকসীর কথা পালন না করে পুত্রধর্ম পালন করেন নি। বৌঠান মন্দোদরী দেবীর কথা অগ্রাহ্য করে স্বামীর ধর্ম টাও পালন করছেন না। ভ্রাতা বিভীষণের কথা না মেনে সীতাকে না ফিরিয়ে নিজের পুত্র অক্ষয় কে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে পিতৃ ধর্ম টাও পালন করেন নি। ভ্রাতা বিভীষণকে পদাঘাত করে বহিষ্কার করে ভাতৃ ধর্ম টাও উলঙ্ঘন করলেন। শাস্ত্রে আছে প্রাতে ধর্মসেবন, দ্বিপ্রহরে অর্থসেবন ও নিশিতে কামসেবন করার বিধান। এর মধ্যে অধম কামসেবন, মধ্যম অর্থসেবন, উত্তম ধর্মসেবন । আপনি কি তা পালন করেছেন? আমি নিজেও আপনাকে অনুরোধ জানাবো যে সীতাদেবীকে , রঘুনাথের হস্তে ফিরিয়ে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করুন।” রাবণ ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলল- “ওরে মূর্খ ! তুই শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ রাবণকে উপদেশ প্রদান করিস? ওরে শাস্ত্রে এও বলা আছে বড় ভ্রাতা গুরু তুল্য। তাঁর নির্দেশেই গুরু নির্দেশ। বড় ভ্রাতার সেবা করাই কনিষ্ঠ ভ্রাতার কর্তব্য। তুই যার প্রশংসা করছিস, সেই রামের ভ্রাতা লক্ষ্মণ নিজেও এই শাস্ত্র নির্দেশ পালন করে বনবাসে এসেছে। লঙ্কার এই সমূহ বিপদে , দাদার বিপদে যে ভ্রাতা দাদার পাশে না থাকে সে অধম। সে নরকে যায়। শাস্ত্রে ইহাও বলে। যা, তুইও গিয়ে বিভীষণের মতো রামের চরণে পড়ে থাক- নয়তো গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আমি বুঝবো আমার দুই ভ্রাতাই নিহত হয়েছে।” কুম্ভকর্ণ বলল- “দাদা! আমি এত পুণ্য করিনি যে এই হস্তে প্রভু শ্রীরামের সেবা করতে পারবো। কিন্তু আপনার কাছে বচন দিচ্ছি, যুদ্ধে গিয়ে লঙ্কার মান রাখবো। দেশে আক্রমণ হলে সমগ্র দেশবাসীর কর্তব্য শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আমি তাই করে শাস্ত্র নিয়ম রক্ষা করবো। জানি আমার অন্তিম পরিণতি কি হবে! সেই বিষয়ে দেবর্ষি নারদ মুনি আমাকে বলেই দিয়েছেন। প্রভু শ্রীরামের সেবা না করতে পারলাম, কিন্তু তাঁর শরে এই দেহ ত্যাগ করলে মুক্তি পাবো। আমি ইহাও জানি ভ্রাতা, আমার জীবনের শেষ অধ্যায় উপস্থিত হয়েছে। আমার অন্তিম প্রণাম স্বীকার করুন।” রাবণ সেনা দিতে চাইলে কুম্ভকর্ণ নিলো না। কিন্তু রাবণ সাথে ত্রিশ সহস্র রাক্ষস সেনা প্রেরণ করলো। বিশাল মুগুর নিয়ে লঙ্কার পাঁচিল পার করে যুদ্ধভূমিতে এসে দাড়ালো ।

কুম্ভকর্ণের বিশাল দেহ দেখে বানরেরা অবাক হল। তার মস্তক দেখতে হলে আকাশের দিকে তাকাতে হয়। বিশাল বট বৃক্ষের সামনে ক্ষুদ্র পক্ষীর ন্যায় বানরেরা দেখতে লাগলো । তার বিশাল দেহ যেনো সূর্যকে ঢেকে দিয়েছে। আর তার ছায়া বহুদূর অবধি গিয়েছে। মনে হচ্ছে বিশাল মেঘে ঢাকা পড়েছে আকাশের সূর্য । বিশাল দেহ থেকে বানরেরা ভয় পেলো। ভাবল এর সাথে যুদ্ধ। বিভীষণ এগিয়ে এলো। ভ্রাতা কুম্ভকর্ণকে প্রনাম করলো। কুম্ভকর্ণ বিভীষণকে ভূমি থেকে হাতের করতলে তুলে তাহাকে অনেক আদর করলো। দুই ভ্রাতা রোদন করতে লাগলো। বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা ! আমি অগ্রজ দশাননকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু তিনি মানেন নি। আমার এছাড়া আর উপায় ছিলো না।” কুম্ভকর্ণ আদর করে বলল- “ভ্রাতা! এত ক্রন্দন কেন করছ ? শ্রীরামের সেবা করলে মন থেকে ত সমস্ত শোক নিবারিত হয়। আমি জানি ভ্রাতা দশাননের সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। তাই সে তোমার মতোন সুবুদ্ধিদাতাকে বিতারিত করেছে।” বিভীষণ বলল- “ভ্রাতা! তুমিও প্রভু শ্রীরামের শরণে এসো। তিনি শরণাগতকে আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করেন।” কুম্ভকর্ণ বলল- “ভ্রাতা ! আমার এমন সৌভাগ্য কোথায় যে প্রভু শ্রীরামের সেবা করবো ? সারা জীবন না জপ করলাম না তপ করলাম। ঘুমিয়েই কাটালাম। আমার এই সৌভাগ্য কোনদিন হবে না। তবে ওঁনার হস্তে নিধন হয়ে মুক্তি অবশ্যই পাবো। আজ আমার অন্তিম দিন। তোমার ন্যায় ধার্মিক ভ্রাতা পেয়ে আমি ধন্য। এখন আমি কর্তব্য করতে করতে বীরগতি প্রাপ্ত করতে ইচ্ছুক।” এই বলে কুম্ভকর্ণ বিভীষণকে নামিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। প্রচণ্ড গর্জন করে কুম্ভকর্ণ তেঁরে আসলো। বানরদের পালে পালে তুলে মুখে পুড়তে লাগলো। চিবিয়ে খেতে লাগলো। কাউকে আবার পায়ের তলায় পিষ্ট করলো। কাউকে আবার হাতে ধরে অনেক উচু থেকে নীচে ফেলে দিলো । বানরদলে হাহাকার আরম্ভ হল। কুম্ভকর্ণ যখন মুগুর দিয়ে বানরের পালে আঘাত হানলো- তখন মেদিনী কেঁপে উঠলো । কাতারে কাতারে বানর নিহত হল। কুম্ভকর্ণ ফুঁ দিয়েই কত বানরকে দূরে ফেলে দিলো। বানরেরা কুম্ভকর্ণের শরীর ধরে ঝুলে পড়লো। যেনো বট বৃক্ষে ক্ষুদ্র পক্ষী অবস্থান করছে এমন দেখা গেলো।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।