২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( সুন্দরাকাণ্ড পর্ব- ১৮ )

বানরেরা সত্যই একশো যোজন সেঁতু তৈরি করেছিল । যা দেখে অত্যন্ত প্রীত হলেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ।
অপরদিকে রাবণ এই ভেবে হাস্য করছিলেন যে বনের পশুগুলো ঐ দুই ভিক্ষুক, পিঁপড়ের কথায় আস্ফালন করে লঙ্কায় মরতে আসছে । পিষে পিষে সব কটাকে মারবো । এই ভেবে লঙ্কার রাক্ষস বীরেরা আস্ফালন করে বেড়াছিল্ল। যুদ্ধের তাদের প্রস্তুতিই নেই। এক ফুঁ দিলেই ঐ সেনাদল ছিটকে পড়বে- এমন ভাবনা নিয়ে তারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াছিল্ল । কিন্তু মন্দোদরী ও রাবণের শত রানী নানা অশুভ লক্ষণ দেখতে পেলো। হাতের শাঁখা পলা নানা কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছিল্ল, সিঁদুরের কৌটা হারিয়ে যাচ্ছিল্ল, স্বপ্নে তারা দেখলো বিধবার থান পড়ে রোদন করছে। এসব অমঙ্গল দেখে তাঁরা ভয়ে ছিলো। ভগবান রাম বললেন- “আমরা এবার লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। হে সেনাবৃন্দ! আপনারা যে শ্রম দ্বারা আমার উপকার করছেন এর জন্য আমি আপনাদের কাছে চিরঋণী থাকবো।” হনুমান বলল- “প্রভু! আপনি ও লক্ষ্মণ ঠাকুর আমার দুস্কন্ধে চাপুন। আমি আপনাদের সেই স্থানে নিয়ে যাচ্ছি।” এই বলে হনুমান দুস্কন্ধে শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ কে উঠিয়ে নিলো, তারপর রওনা হল। পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে অসংখ্য বানর চলল। কিছু বানরকে রেখে যাওয়া হল। তারা যুদ্ধের সময় আহার, ঔষধি রসদ নিয়ে পারাপার করবে। হৈ হৈ করতে “জয় শ্রী রাম” বলতে বলতে অসংখ্য কোটি কোটি কপি, মর্কট, ভল্লুক, লেঙুর, শিম্পাঞ্জী চলল। সারা ধরিত্রীর বানরেরা সেখানে ছিলো। সাদা, কালো উভয় প্রকার বানরেরা চলল। গদা, তরোয়াল , মুগুর, প্রকাণ্ড প্রস্তর, প্রকাণ্ড কাঠের গুঁড়ি নিয়ে চলল। সূর্য চিহ্ন পতাকায় ছেয়ে গেলো। আর্য ও অনার্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীরাম । এইভাবে তারা চলল। দেবতাবৃন্দ এই দৃশ্য দেখে খুবুই প্রীত হলেন। এখন কেবল যুদ্ধ হওয়া বাকী। রাবণের সব বীরদের মৃত্যু এখন মাত্র কিছু সময়ের অপেক্ষা। তারপর এই রাক্ষসেরা সমূলে নষ্ট হবে । পিলপিল করে কাতারে কাতারে সেনা চলল।

সমুদ্রের উপরে এই সেঁতু একে বেঁকে সোজা লঙ্কায় গেছে । তাঁর ওপর দিয়ে চলতে লাগলেন বানর দল। লঙ্কায় অশোকবণে বসে সীতাদেবী নানা শুভলক্ষণ দেখতে পেলেন । তিনি নয়নের জল মুছলেন । তাঁর দুঃখের নিবৃত্তির সময় আসছে । প্রহরা রত রাক্ষসীরা প্রমাদ গুনলো । লঙ্কায় নানা অশুভ চিহ্ন আরোও গভীর ভাবে দেখা দিলো । শ্রীরাম যত ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিল্লেন, ততই যেনী রাবণের দুর্ভাগ্য , রাবণের নিকটে আসতে থাকলো । সমুদ্রের হিংস্র প্রানী সকল হিংসা ভুলে সেঁতুর দুপাশে সাঁতার দিয়ে ভ্রমণ করছিলো। প্রভু শ্রীরামের দর্শনের জন্য তাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেছিলো । তারাও শ্রীরামের সাথে সাঁতার দিয়ে দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো । হাঙর, তিমি, মকর ও অনান্য নানা জলজ প্রানী এভাবেই ভ্রমণ করছিলো। সমুদ্রদেব মাঝে মাঝে স্রোত নিয়ে এসে যাত্রাপথের ছোট পাঁথর যেগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়েছিলো, সেগুলো ধুয়ে নিয়ে গেলো, যাতে প্রভুর সেনাদের কোন কষ্ট না হয় । সমুদ্র দেবতা সাথে সাথেই চলছিল। স্রোত এসে এসে মাঝে মাঝে সেঁতুর ওপর দিয়ে বয়ে গেলো- কিন্তু সেঁতু ভঙ্গ হল না । সমুদ্র দেবতা ভাবছিলো, আহা যদি প্রভুর শ্রীচরণ একবার স্পর্শ করতে পারতাম । মনে মনে তিনি প্রার্থনা করলেন – “হে প্রভু! এই অধম কে আপনার চরণ স্পর্শ করতে দিন। হে দীন দয়াল! কৃপা করে আপনার শ্রীচরণ স্পর্শের সুযোগ দিন।” তখন ভগবান রাম বললেন- “অবশ্যই! সমুদ্র তটে তুমি আমার নিত্য দিব্য স্বরূপের দর্শন পাবে। আমার চরণ স্পর্শ তুমি পাবে।” এই বলে প্রভু শ্রীরাম সমুদ্র দেবকে আশ্বস্ত করলেন । এইভাবে বানর সেনা সমেত প্রভু শ্রীরাম চলতে লাগলেন। সুগ্রীব, নল, নীল, অঙ্গদ, জাম্বুবান , গবাক্ষ , শ্রীমৈন্দ আদি বানরেরা চলতে লাগলো । দূর থেকে রাক্ষস রাজ রাবণ দেখে খুশীতে ডগমগ হচ্ছিল্লেন। তিনি অট্টহাস্য সহকারে বারংবার দর্পে মত্ত হলেন। আর রাক্ষসেরা রাবণকে আরোও উৎসাহ দিচ্ছিল্ল । খানিক যেতে লঙ্কার স্বর্ণ মহল দেখা গেলো। বিশ্বকর্মা , রাতারাতি আবার পুনঃ নির্মাণ করেছিলেন । সেই স্বর্ণ দ্যুতি যেনো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল্ল। মনে হচ্ছিল্ল লক্ষ সূর্য লঙ্কা থেকে দ্যুতি নির্গমন করছেন ।

লঙ্কার যত নিকটে পৌছালেন- এই দ্যুতি আরোও তীব্র হচ্ছিল্ল। কিন্তু ভগবান শ্রীরামের গাত্র থেকে যে পবিত্র জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল তাঁর কাছে ঐ দ্যুতি তো সামান্য। একটি দর্পের প্রকাশ, অপরটি ভগবৎ সত্তার প্রকাশ । একটি জাগতিক দ্যুতি অপরটি ঐশ্বরিক দ্যুতি । স্বর্ণমহলে থেকে যারা ঈশ্বর বিমুখ তাহাদের ধিক, তাঁদের অন্তরচক্ষু ঐ ঐশ্বর্য রুদ্ধ করে দেয়। গাছতলায় থেকে ঈশ্বর পরায়ণ , সেইই ধন্য। কারণ ঈশ্বর পরায়ণ ব্যক্তি যেখানে থাকেন, সেটাই দেবপুরী হয়ে যায় । সুতরাং লঙ্কার সেই স্বর্ণ দ্যুতি মূল্যহীন । এইভাবে যত নিকটে আসা গেলো , ততই সেই ভ্রমাত্মক জ্যোতির প্রকাশ দেখা গেলো । রাক্ষসেরা এত ঐশ্বর্যে থাকতে থাকতে ভগবানকে ভুলে গিয়েছিলো। বিভীষণ ও হনুমানের মতো ধর্মাত্মারা তাদের সত্যের মার্গ দেখালেও তারা সেই পথে যায় নি। এইভাবে লঙ্কার নিকটে পৌছালো। বিভীষণ বলল- “প্রভু! এই হল লঙ্কা। যেখান থেকে ভ্রাতা দশগ্রীব সদুপদেশ না মেনে আমাকে বিতারিত করেছে। এই নগরী তেই রাক্ষসেরা নিবাস করে।” এই বলে বিভীষণ বাক্য সমাপ্ত করলো। লঙ্কা নগরী বিশাল। সামনে বিশাল তোড়ন । রাক্ষসের মুখ, রাক্ষসদের মহিষ চিহ্ন পতাকা শোভা পাচ্ছে। হনুমান বলল- “প্রভু! এই স্থানে মাতা চামুণ্ডার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তিনি এখন বিদায় নিয়েছেন। সাথে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন, এই যুদ্ধে লঙ্কার পরাজয় হবে।” সুগ্রীব আদেশ দিলো, এখানে তাবু ফেলো । অসংখ্য তাবু রচনা হল। বানরেরা সব প্রহরা দিতে লাগলো। কাছেই ছিলো সুবেল পর্বত । ভগবানের চরণ স্পর্শ পেয়ে বালুকারাশি যেনো ধন্য হল। রাবণের পাপ পুরীতে থাকতে থাকতে তারাও অধর্মের ভাগী হয়েছিলো। আজ সকল অধর্ম নাশ হল, ভগবান শ্রীরামের চরণ স্পর্শে । ভগবান রাম একটি কথা ভাবছিলেন।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (3) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (82) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।