ভগবদগীতার শুরুতেই আমরা দেখতে পাই যে বর্তমান জটিল জীবন ধারাই আমাদের হতাশার কারন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে একটি হতাশাজনক অবস্থায় নিক্ষেপ করার পর গীতার জ্ঞান প্রদান করেছিলেন । অর্জুন সম্পর্কের বিবাদে পড়ে মানসিক দুর্দশাগ্রস্থ হয়েছিলেন । এই সম্পর্কের বিবাদই হল পৃথিবীতে সমস্ত সমস্যার উৎস । অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে তার সবচেয়ে কাছের মানুষদেরকে দেখলেন, যাদের তিনি হত্যা করতে যাচ্ছেন । তিনি তাদেরকে হত্যা করার বিপক্ষে যুক্তি খুজতে লাগলেন । কেউ নিজের জীবনে দুঃখ চায় না তবুও দুঃখ এসে ভর করে এবং জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে । প্রকৃত সাফল্য মানে জীবনের জটিলতা বা দুঃখগুলো এড়িয়ে চলা নয়, বরং কিভাবে তার মোকাবেলা করা যায় তার শক্তি সঞ্চয়কেই বোঝায় । যদিও কান্না করা ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রে বেমানান, অর্জুনের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছিল । কারণ তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন । বিষাদগ্রস্থ মনের ফলে তার তীর-ধনুক খসে পড়েছিল, তার মুখ ফ্যাকাসে এবং শুকিয়ে গিয়েছিল, বাক রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ।
সম্পূর্ণ অসহায় ও আশাহত অবস্থায় অর্জুন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়েছিলেন এবং তাকে গুরু হিসেবে বরণ করেছিলেন ।
“কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি । এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর তা আমাকে বল । এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত । দয়া করে আমাকে নির্দেশ দাও ।” (গীতা ২/৭)
শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু । কিন্তু তাকে হতাশাগ্রস্থ দেখার পরও তিনি হাসছিলেন । কারণ শ্রীকৃষ্ণ জানেন যে, যতক্ষন না পর্যন্ত কেউ উপলব্ধি করতে পারে যে, সে কিছুই জানে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে জ্ঞান লাভের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত করতে পারে না । তাই পারমার্থিক জ্ঞানের শুরু হয় বিনম্রতা ও সরলতা মধ্য দিয়ে । ঠিক যেমন, কোন জমিতে কোন কিছু বপন ও উৎপাদন করার আগে আগাছা পরিষ্কার করতে হয় । তেমনি, পারমার্থিক জ্ঞান লাভ করতে হলে হৃদয় হতে সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা (Misconception) ও কলুষতা দূর করতে হয় ।
হতাশাঃ----
নিজেকে জানাঃ - পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের শোকগ্রস্থ ও হতাশাচ্ছন্ন অবস্থা দেখে প্রথমেই বললেন
আশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভায়ষে
গতাসূনগতাসূংশ্চ-নানুশোচন্তি পন্ডিতাঃ ।। (গীতা ২/১১)
অনুবাদ – “পরমেশ্বর ভগবান বললেন-তুমি প্রাজ্ঞের মত কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয়, সেই বিষয়ে শোক করছ । যারা যথার্থই পন্ডিত তারা কখনও জীবিত বা মৃত কারও জন্যই শোক করেনা না ।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করলেনঃ---
দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ।
তথা দেহান্তর প্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ।। (গীতা ২/১৩)
অনুবাদ – “দেহীর (আত্মা) দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোনও দেহে দেহান্তরিত হয় । স্থিতপ্রজ্ঞ পন্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না ।”
আধুনিক বিজ্ঞানের মতে, প্রতি ৭ বছরে মানুষের শরীরের কোষ সমূহ একবার পরিবর্তিত হয় । আমাদের এই শরীরটি একটা পোষাকের মত এবং আত্মা বিহীন দেহকে একটি চালক বিহীন গাড়ির সাথে তুলনা করা হয় ।
একবার প্রভুপাদ (ইসকন প্রতিষ্ঠাতা আচার্য) যখন তার বয়স ছিল ৮০ বছর তখন একবার শ্রীজগন্নাথ পুরীর সমুদ্রের তীরে বসেছিলেন । সমুদ্রের ধারাবাহিক ঢেউগুলোকে দেখে তিনি বলতে লাগলেন, “আমার এই ঢেউয়ে ঝাপ দিয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু আমার শরীরটি তার অনুমোদন দিচ্ছে না ।” তিনি তার বাল্যকালে সেখানে ঢেউয়ে খেলাধূলার কথা স্মরণ করতে থাকেন । তিনি ব্যাখ্যা করলেন যে, তার সেই শরীরটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে যদিও তিনি (আত্মা) একই রয়ে গেছেন ।”
তাই “আমি এই দেহ নই, একটি চিন্ময় আত্মা”- এই উপলব্ধির মাধ্যমেই প্রকৃত জ্ঞানের সূচনা হয় ।
আত্মা প্রকৃতপক্ষে কি চায় ? -----
আত্মা ভগবানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সৎ (নিত্য), চিৎ (জ্ঞানময়) ও আনন্দময় । আত্মাকে সন্তুষ্ট না করে দেহকে সন্তুষ্ট করাটা অনেকটা খাচার অভ্যন্তরস্থ পাখিকে খাবার ন দিয়ে শুধু খাঁচাটি পরিষ্কার করার মতই । আধুনিক সভ্যতা কেবল আমাদের এই দেহটির চাহিদা মিটাতে দক্ষ । কিন্তু “আত্মা কি?” এবং “আত্মা প্রকৃতপক্ষে কি চায়?” তা জানে না । আত্মা প্রকৃত পক্ষে ভালবাসতে ও ভালবাসা প্রাপ্ত হতে চায় ।
উদাহরণ ১ঃ যারা কখনও ভালবাসা প্রাপ্ত হয়নি এবং জানে না কিভাবে ভালবাসতে হয়, তারা খুবই নিষ্ঠুর ও নির্দয় হয় । কখনও কখনও ভয়ানক খুনি ও সন্ত্রাসীতে পরিণত হয় ।
উদাহরণ ২ঃ নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর অধিকাংশই “ভালবাসা-কেন্দ্রিক” । তার কারন হল, চলচ্চিত্রগুলো যদি ভালবাসা-কেন্দ্রিক দৃশ্যে পরিপূর্ণ না হয় তাহলে মানুষ সেগুলো কখনই দেখবে না ।
কলুষিত হৃদয়-মূল কারণঃ ---
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে সকল ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান এবং বৈরাগ্য পূর্ণরূপে বিরাজমান বলেই তিনি সর্বাকর্ষক ।
তিনিই প্রতিটি জীবের প্রকৃত ভালবাসার বস্তু । তবুও তাকে ভালবাসার এই প্রবনতা কেন আমরা বিস্মৃত হই ? ভগবান কম্পিউটারজাত সভ্যতা (যার ভালবাসার কোন ক্ষমতা নেই) সৃষ্টি করেননি । বরং, তিনি মুক্ত, স্বাধীন জীবদের সৃষ্টি করেছেন । এই প্রকার জীব সমূহ যখন তাদের এই স্বাধীনতার মাধ্যমে সেবা করার চেয়ে শোষণের প্রতি ধাবিত হয়, তখন তারা জড়াপ্রকৃতির আটটি উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে – যেমন ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ (এগুলো স্থুল উপাদান) এবং মন, বুদ্ধি, অহংকার (এগুলো সূক্ষ্ম উপাদান), রোগ নিরাময় করতে হলে যেমন তার মূল কারন উদঘাটন আব্শ্যক, তেমনি কলুষিত হৃদয়ের সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে মূল কারণটি (যা হল সবচেয়ে সূক্ষ্মতম উপাদান ‘অহংকার’) খুজে বের করতে হবে ।
‘অহংকার’ এর প্রকৃতি কেমন ?
“জ্ঞানস্য মোহ, যাম অহম মামেতি”
অহংকার-‘আমিই এই দেহ’ এবং ‘আমার এই দেহ সম্পর্কিত সবকিছুই আমার’-এই দুইটি ভ্রান্ত ধারণার সূত্রপাত ঘটায় । এই ধরণের চেতনা একজন মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে । এমনকি মনস্তাত্ত্বিক গণ একে ‘আত্ম-প্রজন্ম’ বলেও আখ্যায়িত করেন । মানুষ এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয় যে তারা সমগ্র পৃথিবীকে তার সমস্যা এবং প্রয়োজন পূরনে ব্যবহার করতে চায় । যখন পৃথিবীর প্রত্যেক এই প্রকার চিন্তা করতে থাকে, তখন তার ফল দাঁড়ায় জটিলতা এবং প্রতিযোগিতা, যার পরিণতি হল যুদ্ধ এবং ধ্বংস ।
যখন ভালবাসার এই প্রবনতা ভুল পথে পরিচালিত হয়, তখনই অহংকার মনকে বশীভূত করে ফেলে, একে সবচেয়ে দুর্দান্ত শত্রুতে পরিণত করে । এর পরিণামে মন ষড়রিপু (যেমন, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য) দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে ।
মনের প্রকৃতি হল চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা, ভোগ এবং ত্যাগ । মন যখনই ষড়রিপুর কবলে পড়ে, তখন এর প্রভাব তার প্রতিটি চিন্তা, কথা বা কাজে প্রতিফলিত হয় । তাই অর্জুন বলেছেন যে, মনকে নিয়ন্ত্রন করা বায়ুকে নিয়ন্ত্রন করার চেয়েও অত্য্যন্ত কঠিন । শ্রীকৃষ্ণ বর্ণনা করেছেন যে, কাম যখন মনকে বশীভূত করে ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সুখ খুঁজে বেড়ায়, তখন তা আগুনের ন্যায় সর্বদা অতৃপ্ত থাকে, যাতে বহু পরিমাণ জ্বালানি সরবরাহ করলেও তা অতৃপ্তই রয়ে যায় । তিনি বর্ণনা করেছেন-
আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিনা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষপূরেনানলেন চ ।। (গীতা ৩/৩৯)
অনুবাদঃ কামরূপী চির শত্রুর দ্বারা জীবের শুদ্ধ চেতনা আবৃত হয় । এই কাম দুর্বারিত অগ্নির মতো চির অতৃপ্ত ।
একটি বস্তু যেমন আরেকটি বস্তুকে আকর্ষণ করে, ঠিক তেমনি একজন মানুষের হতাশার অন্যতম কারণ হল তার চারপাশের পরিবেশের প্রভাব ।
উদাহরনঃ একটি আবর্জনাময় পরিবেশ যেমন ইঁদুর এবং তেলাপোকাদের আকর্ষণ করে, তেমনি একটি কলুষিত মন জড়জগতের প্রভাবকে আকর্ষণ করে ।
(পরবর্তী পর্বে হতাশার সমাধান সমূহ আলোচনা করা হবে) (চলবে........)
Written by : Sankirtan Madhab Das
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন