মেঘের আড়াল হত মেঘনাদের যুদ্ধ বিদ্যার কথা সকলেই জানতো । নানা প্রকার ঘাতক অস্ত্র প্রয়োগ করলো। বানরদের মুণ্ড গুলো যেনো শরের আঘাতে উড়ে গেলো। মনে হল একটা চোখের পলকে ঝড় এসে সমস্ত মুণ্ড গুলো উড়িয়ে নিয়ে গেলো। কবন্ধ হয়ে হয়ে বানরেরা ভূপতিত হল। আবার শিলা বান নিক্ষেপ করা মাত্র আকাশ হতে বৃষ্টির ন্যায় শিলা বর্ষণ আরম্ভ হল। বানরেরা সেই শিলা থেকে বাঁচবার জন্য এদিক সেদিক দৌড়ঝাঁপ আরম্ভ করলো। কিন্তু সেই শিলাগুলির তলায় পিষ্ট হল। এরপর পর্বত বাণ মন্ত্র পড়ে নিক্ষেপ করলেন মেঘনাদ। বৃহৎ পর্বত যুদ্ধভূমিতে পতিত হয়ে সব বানর মরল। মেঘনাদ এইভাবেই যুদ্ধ চালালেন যেনো চোখের পলকে কটকে কটক কপিদল নষ্ট হল । অট্টহাস্য করে মেঘনাদ যুদ্ধ আরম্ভ করলো। ধীরে ধীরে মেঘনাদ আকাশ মার্গে উঠে যুদ্ধভূমিতে আসলে তার পেছন পেছন রাক্ষস সেনারাও আসলো। তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। মেঘনাদের অস্ত্রে যেনো চারপাশ ঢেকে দিলো। বানরেরা নষ্ট হতে আরম্ভ করলো। এই দেখে মেঘনাদ বলল- “নিকুম্ভিলা যজ্ঞ পূর্ণ না করেও আমি অতি শক্তি রাখি। আজ এই যুদ্ধে আমি রাম, লক্ষ্মণ কে বধ করে যুদ্ধ সমাপন করবো।” ক্ষিপ্ত হয়ে লক্ষ্মণ তখন মন্ত্র পড়ে কালান্তক বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণের তেজে রাক্ষসেরা দমবন্ধ হয়ে মরল । তারপর লক্ষ্মণ ঠাকুর যমাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। লক্ষ লক্ষ রাক্ষসেরা ভূপতিত হল সেই অস্ত্রের প্রভাবে। লক্ষ্মণের বাণে এইরূপে রাক্ষস নিধন হতে দেখে মেঘনাদ গর্জন করে দাঁত কটমট করলেন। লক্ষ্মণ হাস্য করে বলল- “ওরে পাপীষ্ঠি! এই ভাবে গর্জন না করে যুদ্ধবিদ্যা দ্বারা শত্রু নিধন করে নিজ শক্তির পরিচয় দে। এইরূপ বালক স্বভাব তোমার সাজে না।” এই শুনে মেঘনাদ আরোও উত্তেজিত হল। লক্ষ্মণের দিকে পাঁচটি তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ করলো। বাণের আঘাতে লক্ষ্মণের তনু থেকে রুধির নির্গত হল। লক্ষ্মণ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে মেঘনাদের দিকে পাঁচটি বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই বাণগুলি থেকে উজ্জ্বল জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল্ল। তা যখন মেঘনাদের বুকে বিঁধলো তখন মনে হল মেঘনাদ পাঁচটি উজ্জ্বল মণি ধারণ করেছেন। মেঘনাদের কিছুই হল না। রথ শুদ্ধো অদৃশ্য হল ।
হনুমান এগিয়ে গেলো। কহিল –
হনুমান বলে বেটা তোর রণ চুরি ।
দেখাদেখি আজই তোরে দিব যমপুরী ।।
না জানি ধরিতে অস্ত্র বানর জাতি ।
এ কারণে এতদিন তোর অব্যহতি ।।
মল্লযুদ্ধ কর বেটা , ফেল ধনুর্বাণ ।
একটা চাপরে বেটা তোর বধিব পরাণ ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
হনুমান আর অঙ্গদ যখন যুদ্ধ আরম্ভ করলো তখন মেঘনাদ একটি ত্রিশূল হস্তে নিলো ।
লৈ ত্রিসূল ধাবা কপি ভাগে ।
আএ জহুঁ রামানুজ আগে ।।
আবা পরম ক্রোধ কর মারা ।
গর্জ ঘোর রব বারহিঁ বারা ।।
কোপি মরুতসুত অঙ্গদ ধাএ ।
হতি ত্রিসূল উর ধরনি গিরাএ ।।
( তুলসীদাসী রামায়ণ )
অর্থাৎ- সেই ত্রিশূল তখন মেঘনাদ অঙ্গদ আর হনুমানের দিকে ছুড়লো। ত্রিশূলের আঘাতে হনুমান আর অঙ্গদ ধরাশায়ী হল। পুনঃ সেই ত্রিশূল মেঘনাদের কাছে ফিরে গেলো।
মেঘনাদ হাস্য করে সেই ত্রিশূল লক্ষ্মণের দিকে নিক্ষেপ করলো। মেঘনাদ তখন পাশুপাত অস্ত্র নিক্ষেপ করলো। পাশুপাতের আঘাতে সেই ত্রিশূল চূর্ণ হল। মেঘনাদ অদৃশ্য হল। লক্ষ্মণ কেবল তাহার অট্টহাসি শুনতে পেয়ে সেইদিকেই শর নিক্ষেপ করলো। মেঘনাদ একবার দৃশ্য হয় আবার অদৃশ্য হয়ে বাণ নিক্ষেপ করে। অট্টহাস্য করে মেঘনাদ পুনঃ প্রকট হয়ে উল্কা বাণে বানর দল বিনষ্ট করে বললেন- “লক্ষ্মণ। স্মরণে আছে নাগপাশে তোদের দুইভ্রাতাকে কিভাবে আবদ্ধ করেছিলাম! তাহা কি বিস্মৃত হয়েছিস?” এই বলে মেঘনাদ দশটি শর নিক্ষেপ করলেন । লক্ষ্মণের বুকে দশটি শর বিঁধলে লক্ষ্মণ সেগুলিকে তুলে ফেলে দিলেন। তাঁহার বুক থেকে রক্তপাত হচ্ছিল্ল। লক্ষ্মণ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে “নারাচ অস্ত্র” প্রকট করলেন। সেই অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্র গিয়ে বিঁধলো মেঘনাদের বুকে। মেঘনাদের কবচ ছিন্নভিন্ন হল।
মেঘনাদ সমানে প্রকট হন। আবার অদৃশ্য হন। বাণে বাণে চারপাশ ছেয়ে গেলো। গগনে দেবতারা উপস্থিত হয়ে দেববিজয়ী ইন্দ্রজিতের সাথে লক্ষ্মণের যুদ্ধ দেখতে লাগলো। ভয়ানক যুদ্ধ চলল। কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারে না। রাক্ষস ও বানর উভয়ে মরল। তখন লক্ষ্মণ “দেবজয়” নামক অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্রের আঘাতে মেঘনাদের রথ চূর্ণ হল। রথ ভূপতিত হলে সারথি, অশ্ব সকল হত হল। মেঘনাদ সহসা গগনে উঠে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে বাণাদি বর্ষণ আরম্ভ করলো। আবার কখনো দৃশ্যমান হল। দৃশ্যমান হয়ে যুদ্ধ আরম্ভ করলো। লক্ষ্মণের দেহে শর ফুটলো। লক্ষ্মণ সেদিকে না দেখে যুদ্ধ করতে লাগলো। এরপর এলো সেই মহেন্দ্র ক্ষণ । লক্ষ্মণ ধনুকে ঐন্দ্রাস্ত্র প্রকট করলেন। বললেন- “যদি আমার অগ্রজ দাদা বিষ্ণুর অবতার হন। যদি আমি কায়মনবাক্যে আমার অগ্রজ শ্রীরামের সেবা করে থাকি, তবে এই অস্ত্রে মেঘনাদ হত হোক।” এই বলে লক্ষ্মণ মেঘনাদকে লক্ষ্য করে ঐন্দ্রাস্ত্র ছুড়লেন । সেই অস্ত্রের থেকে জ্বালামুখীর ন্যায় অগ্নিশিখা ও স্ফুলিঙ্গ নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল্ল। মেঘনাদ সমানে শেল, শূল, জাঠা , গদা, বর্শা ও বহু শর , দিব্যাস্ত্র নিক্ষিপ্ত করেও সেই ঐন্দ্রাস্ত্রকে ব্যর্থ করতে পারলেন না। সেই অস্ত্র গিয়ে মেঘনাদের শিরোচ্ছেদ করলো। আকাশ থেকে মেঘনাদ ধরিত্রীর বুকে পড়লো। দেবতারা লক্ষ্মণের ওপর পুস্পবৃষ্টি করলেন। শঙ্খ, কাঁস্রম ন্যাকড়া, দুন্দুভি, মঙ্গল বাদ্য স্বর্গে বাজতে লাগলো। ইন্দ্রদেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কারণ মেঘনাদ যতদিন জীবিত ছিলো, ইন্দ্রদেবতা নিজের পরাজয়ের গ্লানিতে ভুগছিলেন । লক্ষ্মণের আদেশে মেঘনাদের কাটা মুণ্ড বানরেরা নিয়ে গেলো শ্রীরামের কাছে। শ্রীরাম সেই বীর মেঘনাদের মুণ্ড পুস্পে শোভিত স্থানে রাখলেন। অপরদিকে রাক্ষসেরা মেঘনাদের ছিন্নমুণ্ডহীন দেহ লঙ্কায় নিয়ে গেলো।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন