২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-৩৩)



মহীরাবণ এরপর মাতা মন্দোদরীকে প্রণাম করে বলল- “মাতা! আমি আপনার গর্ভ হতে জনম নেবার সৌভাগ্য প্রাপ্ত করিনি । কিন্তু মাতঃ! আমি আপনাকেই মাতা বলে জানি। বিপদের সময় কেন আমাকে স্মরণ করলেন না? আমার ভ্রাতা, তাত একে একে সবাই নিহত হয়েছে। শুনেছি কাকা বিভীষণ সেই শত্রু দলের সাথে মিলেছে। কেন মাতঃ! আমাকে একটিবার সংবাদ দিলেন না। আমি থাকলে আমার ভ্রাতারা কেউ নিহত হতেন না। কবে সেই রাম, লক্ষ্মণের শব এনে লঙ্কায় রেখে দিতাম।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! আমি তোমাকে কদাপি আলাদা জ্ঞান করিনি। নিজ পুত্র মেঘনাদের ন্যায় দেখি তোমাকে। তাই বলছি পুত্র, তুমি এই যুদ্ধে অংশ কদাপি নিয়ো না। এই যুদ্ধের ফল কেবল রাক্ষস জাতির ধ্বংস। আর তোমার পিতার দম্ভ একে একে বলশালী রাক্ষসদের যমের দুয়ারে প্রেরণ করেছে। পুত্র তুমিই এখন কেবল বংশজ। তোমার কিছু হোক আমি চাই না। তুমি বরং পাতালে ফিরে যাও। তোমার পিতার কথা শোনার অর্থই যমের পদধ্বনি শ্রবণ করা। তুমি সেই ভুল করো না।” এই বলে মন্দোদরী, মহীকে বোঝালো। মহী বলল- “মাতাঃ! আপনি এই পুত্রের বিক্রম দেখেন নি। আমি যে কি করতে পারি, তা রাম, লক্ষ্মণ ত দূর- কাকা বিভীষণ অবধি বুঝতে পারবেন না। আমি লঙ্কায় খুব কম সময় এসেছি, তাই কাকা বিভীষণ আমার দুর্বলতার কথা জানেন না। আর এটাই আমার কাছে মহাস্ত্র। এমন ভাবে রাম লক্ষ্মণকে বধ করবো যে গোলকধাঁধার মতো বানরেরা কেবল খুঁজে যাবে কিন্তু পাবে না। পাতালে প্রবেশ করা সহজ কর্ম নয়। তাহা দেবতাদেরও অসাধ্য।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র! তোমার ন্যয় এমন অনেকেই বলেছিল । তারা কিন্তু কেউ সফল হয় নি। কারণ শ্রীরাম অজেয়। তাঁহাকে পরাজিত কেউ করতে পারে না। তাই বলছি এই মুহূর্তে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।” রাবণ আবার ধমক দিয়ে স্ত্রীকে শান্ত করলো। তাহার পর শ্রীরামকে গালাগালি দিয়ে নিবৃত্ত করলো। মহীরাবণ দর্প করে নিজের শক্তির কথা বলছিল। মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! মনে হচ্ছে এবার আমাদের মুখাগ্নি করার জন্য সত্যই কেউ থাকবে না। কারণ শ্রীরামের সাথে শত্রুতা স্থাপন করে তুমি নিজের বিনাশকেই আহ্বান করলে।” এই বলে মন্দোদরী প্রস্থান করলো।

রাবণ বলল- “মহী! তোমার পরিকল্পনা কি?” মহী বলল- “পিতা! আপনি জানেন যে আমি পাতালভৈরবীর উপাসক। আমি একজন তন্ত্রসিদ্ধ। দেবীর কৃপায় নানা রকম সিদ্ধ মন্ত্র আমার করায়ত্ত । আসছে অমাবস্যায় আমি রাম লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে বলি দেবো পাতাল ভৈরবীর চরণে। শুনেছি রাম ও লক্ষ্মণ অযোধ্যার সম্রাট দশরথের পুত্র। তাহারা জাতিতে ক্ষত্রিয়। আর ক্ষত্রিয় ব্যক্তি বলির জন্য প্রশস্ত। দেবীকে রাজরক্তে অভিষেক করিয়ে আমি মহাশক্তি প্রাপ্ত করবো।” রাবণ বলল- “পুত্র! তুমি তাহাদের বলি দাও আর হত্যা করো- যেমন মন চায় তাই করো। কিন্তু এই আপদদিগকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করো। কিন্তু খুব সাবধান- ঘরের শত্রু বিভীষণ গিয়ে এখন তাদের দলে মিশে সব কিছু বলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় রাম লক্ষ্মণ কে পাতালে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া সহজ কাজ নয়।” মহী বলল- “পিতা! তারা কেবল মায়ার খেলা দেখেছে, কিন্তু তন্ত্রের ক্ষমতা দেখে নি। এ মায়া নয়। বিশাল এক মায়াজাল। এর থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ নয়। এমন ভাবে হরণ করবো, যে তাঁরা নিজেরাও আশ্চর্য হবে।” এই শুনে রাবণ আর মহী উভয়ে হাস্যাদি করতে লাগলো। অপরদিকে বানর শিবিরে তখন বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও বানর সেনারা আলোচনা করছিলেন । ভগবান রাম বললেন- “বিভীষণ! লঙ্কায় আর বড় কোন বীর বেঁচে নেই- তাইতো?” বিভীষণ বলল- “প্রভু একজনই বেঁচে, আর তিনি হলেন আমার অগ্রজ দশানন। কিন্তু আরোও একজন আছে, যে বীরের বীর। ছলাকলায় পটু । সে হলেন অগ্রজ রাবণের মানস পুত্র মহীরাবণ। সে পাতালে থাকে। পাতালভৈরবীর উপাসক সে। আর একজন তন্ত্র সিদ্ধ। সে লঙ্কায় খুবুই কম আসে। তাই তার সম্বন্ধে বিষদ ভাবে আমিও জানি না। শুধু এইটুকু জানি সে তন্ত্র দ্বারা এমন সব অসাধ্য সাধন করতে পারে, যা কেহই উপলব্ধি করতে পারে না।”

শুনে বানরেরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। সকলে অবাক হলেন। বিভীষণ বললেন- “প্রভু! এই বীর মহীরাবণ কদাপি সম্মুখ সমরে আসবে না। কারণ সে জানে এতে সে জয়ী হবে না। সে এমন কিছু তান্ত্রিক ক্ষমতার বিস্তার করবে, যা কেহই বুঝতে পারবে না, কিন্তু তাঁর কার্যসিদ্ধি হবে । এই মহীরাবণ কখন কোথায় কিভাবে আঘাত হানবে কেউই জানে না। আমি আমার চর মারফৎ সংবাদ পেয়েছি মহীরাবণ এসে আমার অগ্রজ দশাননের সাথে দেখা করেছে। এবার নিশ্চয়ই মহীরাবণ কিছু করবে। পাতালে মহীরাবনের পুত্র অহীরাবণ থাকে । সেও পিতার ন্যয় পরাক্রম রাখে। উভয়ে নরবলি দিয়ে পাতালভৈরবীর উপাসনা করে।” এরপর বিভীষণ হনুমানকে বললেন- “পবনপুত্র! তুমি প্রভুর একনিষ্ঠ সেবক। এবার তোমাকে প্রভুর সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে প্রভু ও লক্ষ্মণ ঠাকুর যখন শয়ন করবেন। কারণ মহীরাবণ কখন কোথায় কার ছদ্দবেশে এসে মায়া বিস্তার করে- তা কেও জানে না। মারীচ অপেক্ষাও সে অধিক রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে ।” বানর শিবিরে সত্যই মহীরাবণের আতঙ্ক বিস্তৃত হল। রাত্রিকালে প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ একটি কুটিরে শয়ন করলেন। চারপাশে কড়া প্রহরা দেওয়া হল। হনুমান করলেন কি , তাঁর লাঙ্গুল বিশাল করলেন। তার পর সেই লাঙুল দিয়ে প্রভুর কুটিরকে আস্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে রেখে দিলেন । যাহাতে একটি পিঁপড়ে অবধি না প্রবেশ করে। হনুমান বলল- “এই আমার পুচ্ছ ডিঙিয়ে কেউ এই কুটিরে প্রবেশ করতে পারবে না। দেখি কিভাবে মহীরাবণ আসে। আসলেই গদার আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করবো।” বানেররা সব গদা নিয়ে চারদিকে প্রহরা দিতে লাগলো। কেউ কেউ মশাল জ্বালিয়ে প্রহরা দিতে লাগলো। হনুমান সেই অবস্থায় বসে থাকলো। অপরদিকে মহীরাবণ সব কিছু দেখে হাস্য করছিলো ।

( ক্রমশঃ )

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।