মহীরাবণ এরপর মাতা মন্দোদরীকে প্রণাম করে বলল- “মাতা! আমি আপনার গর্ভ হতে জনম নেবার সৌভাগ্য প্রাপ্ত করিনি । কিন্তু মাতঃ! আমি আপনাকেই মাতা বলে জানি। বিপদের সময় কেন আমাকে স্মরণ করলেন না? আমার ভ্রাতা, তাত একে একে সবাই নিহত হয়েছে। শুনেছি কাকা বিভীষণ সেই শত্রু দলের সাথে মিলেছে। কেন মাতঃ! আমাকে একটিবার সংবাদ দিলেন না। আমি থাকলে আমার ভ্রাতারা কেউ নিহত হতেন না। কবে সেই রাম, লক্ষ্মণের শব এনে লঙ্কায় রেখে দিতাম।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! আমি তোমাকে কদাপি আলাদা জ্ঞান করিনি। নিজ পুত্র মেঘনাদের ন্যায় দেখি তোমাকে। তাই বলছি পুত্র, তুমি এই যুদ্ধে অংশ কদাপি নিয়ো না। এই যুদ্ধের ফল কেবল রাক্ষস জাতির ধ্বংস। আর তোমার পিতার দম্ভ একে একে বলশালী রাক্ষসদের যমের দুয়ারে প্রেরণ করেছে। পুত্র তুমিই এখন কেবল বংশজ। তোমার কিছু হোক আমি চাই না। তুমি বরং পাতালে ফিরে যাও। তোমার পিতার কথা শোনার অর্থই যমের পদধ্বনি শ্রবণ করা। তুমি সেই ভুল করো না।” এই বলে মন্দোদরী, মহীকে বোঝালো। মহী বলল- “মাতাঃ! আপনি এই পুত্রের বিক্রম দেখেন নি। আমি যে কি করতে পারি, তা রাম, লক্ষ্মণ ত দূর- কাকা বিভীষণ অবধি বুঝতে পারবেন না। আমি লঙ্কায় খুব কম সময় এসেছি, তাই কাকা বিভীষণ আমার দুর্বলতার কথা জানেন না। আর এটাই আমার কাছে মহাস্ত্র। এমন ভাবে রাম লক্ষ্মণকে বধ করবো যে গোলকধাঁধার মতো বানরেরা কেবল খুঁজে যাবে কিন্তু পাবে না। পাতালে প্রবেশ করা সহজ কর্ম নয়। তাহা দেবতাদেরও অসাধ্য।” মন্দোদরী বলল- “পুত্র! তোমার ন্যয় এমন অনেকেই বলেছিল । তারা কিন্তু কেউ সফল হয় নি। কারণ শ্রীরাম অজেয়। তাঁহাকে পরাজিত কেউ করতে পারে না। তাই বলছি এই মুহূর্তে সীতাকে ফিরিয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।” রাবণ আবার ধমক দিয়ে স্ত্রীকে শান্ত করলো। তাহার পর শ্রীরামকে গালাগালি দিয়ে নিবৃত্ত করলো। মহীরাবণ দর্প করে নিজের শক্তির কথা বলছিল। মন্দোদরী বলল- “পুত্র মহী! মনে হচ্ছে এবার আমাদের মুখাগ্নি করার জন্য সত্যই কেউ থাকবে না। কারণ শ্রীরামের সাথে শত্রুতা স্থাপন করে তুমি নিজের বিনাশকেই আহ্বান করলে।” এই বলে মন্দোদরী প্রস্থান করলো।
রাবণ বলল- “মহী! তোমার পরিকল্পনা কি?” মহী বলল- “পিতা! আপনি জানেন যে আমি পাতালভৈরবীর উপাসক। আমি একজন তন্ত্রসিদ্ধ। দেবীর কৃপায় নানা রকম সিদ্ধ মন্ত্র আমার করায়ত্ত । আসছে অমাবস্যায় আমি রাম লক্ষ্মণকে পাতালে নিয়ে বলি দেবো পাতাল ভৈরবীর চরণে। শুনেছি রাম ও লক্ষ্মণ অযোধ্যার সম্রাট দশরথের পুত্র। তাহারা জাতিতে ক্ষত্রিয়। আর ক্ষত্রিয় ব্যক্তি বলির জন্য প্রশস্ত। দেবীকে রাজরক্তে অভিষেক করিয়ে আমি মহাশক্তি প্রাপ্ত করবো।” রাবণ বলল- “পুত্র! তুমি তাহাদের বলি দাও আর হত্যা করো- যেমন মন চায় তাই করো। কিন্তু এই আপদদিগকে লঙ্কা থেকে বিতারিত করো। কিন্তু খুব সাবধান- ঘরের শত্রু বিভীষণ গিয়ে এখন তাদের দলে মিশে সব কিছু বলে দিচ্ছে। এই অবস্থায় রাম লক্ষ্মণ কে পাতালে নিয়ে গিয়ে বলি দেওয়া সহজ কাজ নয়।” মহী বলল- “পিতা! তারা কেবল মায়ার খেলা দেখেছে, কিন্তু তন্ত্রের ক্ষমতা দেখে নি। এ মায়া নয়। বিশাল এক মায়াজাল। এর থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সহজ নয়। এমন ভাবে হরণ করবো, যে তাঁরা নিজেরাও আশ্চর্য হবে।” এই শুনে রাবণ আর মহী উভয়ে হাস্যাদি করতে লাগলো। অপরদিকে বানর শিবিরে তখন বিভীষণ, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, শ্রীরাম, লক্ষ্মণ ও বানর সেনারা আলোচনা করছিলেন । ভগবান রাম বললেন- “বিভীষণ! লঙ্কায় আর বড় কোন বীর বেঁচে নেই- তাইতো?” বিভীষণ বলল- “প্রভু একজনই বেঁচে, আর তিনি হলেন আমার অগ্রজ দশানন। কিন্তু আরোও একজন আছে, যে বীরের বীর। ছলাকলায় পটু । সে হলেন অগ্রজ রাবণের মানস পুত্র মহীরাবণ। সে পাতালে থাকে। পাতালভৈরবীর উপাসক সে। আর একজন তন্ত্র সিদ্ধ। সে লঙ্কায় খুবুই কম আসে। তাই তার সম্বন্ধে বিষদ ভাবে আমিও জানি না। শুধু এইটুকু জানি সে তন্ত্র দ্বারা এমন সব অসাধ্য সাধন করতে পারে, যা কেহই উপলব্ধি করতে পারে না।”
শুনে বানরেরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন। সকলে অবাক হলেন। বিভীষণ বললেন- “প্রভু! এই বীর মহীরাবণ কদাপি সম্মুখ সমরে আসবে না। কারণ সে জানে এতে সে জয়ী হবে না। সে এমন কিছু তান্ত্রিক ক্ষমতার বিস্তার করবে, যা কেহই বুঝতে পারবে না, কিন্তু তাঁর কার্যসিদ্ধি হবে । এই মহীরাবণ কখন কোথায় কিভাবে আঘাত হানবে কেউই জানে না। আমি আমার চর মারফৎ সংবাদ পেয়েছি মহীরাবণ এসে আমার অগ্রজ দশাননের সাথে দেখা করেছে। এবার নিশ্চয়ই মহীরাবণ কিছু করবে। পাতালে মহীরাবনের পুত্র অহীরাবণ থাকে । সেও পিতার ন্যয় পরাক্রম রাখে। উভয়ে নরবলি দিয়ে পাতালভৈরবীর উপাসনা করে।” এরপর বিভীষণ হনুমানকে বললেন- “পবনপুত্র! তুমি প্রভুর একনিষ্ঠ সেবক। এবার তোমাকে প্রভুর সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। বিশেষ করে প্রভু ও লক্ষ্মণ ঠাকুর যখন শয়ন করবেন। কারণ মহীরাবণ কখন কোথায় কার ছদ্দবেশে এসে মায়া বিস্তার করে- তা কেও জানে না। মারীচ অপেক্ষাও সে অধিক রূপ পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে ।” বানর শিবিরে সত্যই মহীরাবণের আতঙ্ক বিস্তৃত হল। রাত্রিকালে প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ একটি কুটিরে শয়ন করলেন। চারপাশে কড়া প্রহরা দেওয়া হল। হনুমান করলেন কি , তাঁর লাঙ্গুল বিশাল করলেন। তার পর সেই লাঙুল দিয়ে প্রভুর কুটিরকে আস্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে রেখে দিলেন । যাহাতে একটি পিঁপড়ে অবধি না প্রবেশ করে। হনুমান বলল- “এই আমার পুচ্ছ ডিঙিয়ে কেউ এই কুটিরে প্রবেশ করতে পারবে না। দেখি কিভাবে মহীরাবণ আসে। আসলেই গদার আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করবো।” বানেররা সব গদা নিয়ে চারদিকে প্রহরা দিতে লাগলো। কেউ কেউ মশাল জ্বালিয়ে প্রহরা দিতে লাগলো। হনুমান সেই অবস্থায় বসে থাকলো। অপরদিকে মহীরাবণ সব কিছু দেখে হাস্য করছিলো ।
( ক্রমশঃ )
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন