২৫ জুলাই ২০১৬

রামায়ণ কথা ( লঙ্কাকাণ্ড পর্ব-২৫)




লঙ্কার বীরেরা একে একে নিহত হচ্ছে দেখে রাবণ খুবুই ভেঙ্গে পড়লো । রাজসভাতে আসন একে একে শূন্য হচ্ছে। যে বীর যুদ্ধে যায় সে যেনো মৃত্যুর মুখে যায় । আর ফিরে আসে না। রাবণ তখন পুত্র বীরবাহুর কথা মনে পড়লো । বীরবাহু ছিলো রাবণের গন্ধর্ব জাতির স্ত্রীর পুত্র । সে সময় বীরবাহু গন্ধর্বলোকে ছিলো। রাবণ সংবাদ প্রেরণ করলো। বহুকাল ধরে বীরবাহু লঙ্কায় ছিলো না দেখে সে লঙ্কার ব্যাপারে কিছুই জানতো না। লঙ্কায় ফিরে আসলে রাবণ তাকে সকল কথা বলল। পুত্রকে দেখে রাবণ স্নেহ প্রদান করে যুদ্ধে যেতে আদেশ দিলো । বীরবাহু বলল-

বীরবাহু বলে, শঙ্কা না কর রাজন ।


ইঙ্গিতে মারিয়া দিব শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।।
এত বলি বীরবাহু ভাবে মনে মন ।
বিষ্ণুহস্তে মৈলে যাব বৈকুণ্ঠ ভুবন ।।
বীরবাহু বলে পিতা তুমি জান ভালে ।
ইন্দ্র আদি দেব কাঁপে আমারে দেখিলে ।।
বিদায় করহ যাব রণের ভিতর ।
এত বলি বীরবাহু চলিল সত্বর ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )

বীরবাহু অল্পকালে ব্রহ্মার আরাধনা করে অদ্ভুদ এক বর পেয়েছিলো। ব্রহ্মা , তাহাকে একটি দিব্য হস্তী দিয়েছিলো। বলেছিলেন যে যতক্ষণ যুদ্ধে সেই দিব্য হস্তী জীবিত থাকবে ততক্ষণ বীরবাহুর নিধন অসম্ভব। কিন্তু সেই হস্তী নিধন হলে বীরবাহু মরবে । বীরবাহু সেই হস্তীর পৃষ্ঠে গদা, মুষল, বর্শা, ধনুক, শর পূর্ণ তূণ, তরবারি নিয়ে উঠলো । রাবণের আদেশে ধূম্রাক্ষ , ভস্মাক্ষ নামক অতি বীর রাক্ষস চলল । হস্তী, ঘোড়া, রথ , বীভৎস দর্শন রাক্ষসেরা নানা ঘাতক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে চলল। রাক্ষসদের অট্টহাস্যে গগন মণ্ডল ধবনিত হল। লঙ্কার দ্বার খুলতেই রাক্ষসেরা বের হল। রাক্ষস আর বানরদের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হল। দুই দলমিলেমিশে গেলো। যতদূর দেখা যায় কেবল রক্তের বহির্গমন , অঙ্গপ্রত্যঙ্গচ্ছেদ আর মৃত্যুচিতকার ছাড়া অপর কিছুই শোনা যায় না। রাবণের প্রেরিত গজহস্তীরা তাণ্ডব করে কপি কটক নষ্ট করতে লাগলো।

কপি সেনারা উচ্চমাত্রার প্রস্তর নিক্ষেপ করে হস্তীগুলিকে নিধন করলো । গদা, বর্শা দ্বারা রথ গুলিকে নষ্ট করলো। জাম্বুবানের ভল্লুক সেনারা যখন হৈহৈ করে এগিয়ে গেলো তখন বীরবাহু তীক্ষ্ণ শরে জাম্বুবানের কটক ছিন্নভিন্ন করে দিলো। ধরাশায়ী হয়ে জাম্বুবান পালালো । নল, নীল দুই ভ্রাতা বীরবাহুর দিকে বৃহৎ প্রস্তর নিক্ষেপ করলে বীরবাহু অনায়েসে প্রস্তর খণ্ডখণ্ড করে দিলো। নল নীলের দিকে মণিবাণ নিক্ষেপ করলো। নল, নীল উভয়ে পলায়ন করলো। গবাক্ষ, কুমুদ, দিবিদ, কেশরী, গয়, সুবের নামক বানরেরা যুদ্ধ করতে আসার আগেই বীরবাহুর নিক্ষিপ্ত শরে কিছুই আর করতে পারলো না। সকলে পলায়ন করলো। অঙ্গদ, সুগ্রীব আসলে উভয়ে বীরবাহুর শরে আহত হল। হনুমানের সমস্ত শরীর থেকে রক্তধারা বের হল। এরপর বড় বড় বীরেরা পলায়ন করলে বীরবাহু অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করলেন। কোটি কোটি বানরেরা ভস্ম হল। পর্বত বাণ নিক্ষেপ করা মাত্র বিশাল পর্বত কপিদলের মাঝে পড়ে কপিদের পিষ্ট করলো। ব্জ্রবাণ নিক্ষেপ করলে, বাজ পড়ে কপিরা নষ্ট হল। বানরেরা গিয়ে ভগবান শ্রীরামের কাছে বললেন- “প্রভু ! এই রাক্ষস আজ সব ধ্বংস করে দেবে। আপনি কিছু করুন।” বিভীষণ তখন বীরবাহুর পরিচয় দিয়ে ব্রহ্মার বর প্রদানের ঘটনা বললেন। ভগবান শ্রীরাম তখন যুদ্ধে আসলেন। তাঁর পেছনে বানরেরা যুদ্ধে আসলো। ভগবান শ্রীরাম চোখের নিমিষে নানা দিব্যাস্ত্রে কোটি কোটি রাক্ষস বধ করলেন। রাক্ষসেরা ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে পড়লো । ধূম্রাক্ষ কে এত বাণ মারলেন যে ধূম্রাক্ষ রাক্ষসের সকল অস্ত্র, ধনুক, বর্ম ধ্বংস হল। অন্তিমে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরাম ধনুকে অর্ধচন্দ্র বাণ জুড়লেন। সেই মহাস্ত্র থেকে এত জ্যোতি বের হল যে চতুর্দিকে কেউ আর চোখে মেলে তাকাতে পারলো না। ভগবান শ্রীরাম সেই অর্ধচন্দ্র বাণ ধূম্রাক্ষের দিকে ছুড়লেন । ধূম্রাক্ষ প্রাণ ভয়ে পালাতে লাগলো। কিন্তু রেহাই পেলো না। অর্ধচন্দ্র বাণ সোজা গিয়ে ধূম্রাক্ষের মুণ্ড কেটে ফেললো ।

ভস্মাক্ষ রাক্ষস তখন ক্রোধে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ভগবানের রামের দিকে কালপাশ, মহাশিরা, উল্কা বাণ নিক্ষেপ করলেন। ভীষণ দিব্যাস্ত্র সকল আসতে দেখে ভগবান শ্রীরাম জ্বালা বাণ, বরুণ বাণ, ইন্দ্রাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করলেন। রাক্ষসের অস্ত্রগুলি ধ্বংস হল। কিন্তু ভস্মাক্ষ হার মানলো না। নানা প্রকার ঘাতক অস্ত্র সকল নিক্ষেপ করতেই থাকলো। গদা, বর্শা নিক্ষেপ করলো। ভগবান শ্রীরাম তাহা ধ্বংস করে দিলেন । এর পর ভগবান শ্রীরাম ইন্দ্রচক্র নামক শর ধনুকে যোজনা করলেন । সেই বাণ থেকে এত ঘোর শব্দ আসছিলো যে সমুদ্রে উথালপাতাল অবস্থা হল। ভগবান শ্রীরাম সেই বাণ নিক্ষেপ করলেন । সেই বাণ ভয়ানক শব্দে ছুটে আসলো। দেখতে দেখতে সেই বাণের আঘাতে ভস্মাক্ষের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে পড়লো। বীরবাহু তখন সমানে কপিদের নিধন করেই যাচ্ছেন। ভগবান শ্রীরামকে দেখে অন্তরে অন্তরে প্রণাম জানালেন। ভগবান শ্রীরাম বললেন- “বীরবাহু ! তোমার মধ্যে দেবত্ব ভাব আছে। কারণ মাতার বংশ অনুযায়ী তুমি গন্ধর্ব। আমি চাইনা কোন দেবাংশকে হত্যা করতে। অতএব যুদ্ধ হতে পলায়ন করো।” যাহাত প্রভুর হস্তে মৃত্যু প্রাপ্তি হয় তার জন্য বীরবাহু , প্রভু শ্রীরামকে নানান কুবাক্য বলতে লাগলেন। বললেন- “আমি দশানন পুত্র। আমি আজ তোমাদের হত্যা করবো।” এই বলে বীরবাহু নানা অস্ত্রে প্রভু শ্রীরামের সেনাদের হত্যা আরম্ভ করলেন ভগবান শ্রীরাম জবাব দিতে লাগলেন। বীরবাহুর অস্ত্র সকল ধ্বংস করলেন। বীরবাহুকে অনেক আঘাত করলেন। কিন্তু কিছুতেই বীরবাহু মরে না। তখন বিভীষণের কথা মনে হল। ধনুকে ব্রহ্মশিরা অস্ত্র জুড়লেন । সেই অস্ত্র ছুড়লেন। সেই অস্ত্রের আঘাতে বীরবাহুর সেই দিব্য হস্তীর শিরোচ্ছেদ হল। বীরবাহু ভূপতিত হলে ভগবান শ্রীরাম বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। দেখতে দেখতে ভগবান শ্রীরামের বাণে বীরবাহুর শিরোচ্ছেদ হল । এইভাবে সেদিনের যুদ্ধ সমাপন হল।

( ক্রমশঃ )
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।