দশরথ হ’য়ে আসি দিল দরশন ।
দশরথ বলে শুন পবন নন্দন ।।
আমার সন্তান দুটি শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ সনে করি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
হনুমান জানতো যে প্রভু শ্রীরামের পিতা মহারাজ দশরথ বহু আগে পুত্র শোকে স্বর্গ গমন করেছেন। এ নিশ্চয়ই সেই মায়াবী। হনুমান চতুর । বলল- “আপনি একটু দাঁড়ান। বিভীষণ আসুন- তাহার পর প্রবেশ করতে দেবো।” এই বলে হনুমান ভাবল একবার বিভীষণ আসুক, তার পর এই মায়াবীর মাথায় গদার আঘাতে যমালয়ে পাঠাবো। এই শুনে মহীরাবণ পালালো। পুনঃ আসলো ভরতের রূপ ধরে । বলল-
ভরত হইয়া এল হনুমানের কাছে ।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দুই ভাই কোথা আছে ।।
চৌদ্দ বর্ষ বনবাসী মস্তকেতে জটা ।
দশরথ রাজার আমরা চারি বেটা ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
হনুমান বললেন- “ভ্রাতা ভরত! আপনি একটু প্রতীক্ষা করুন। এক মায়াবী নিশাচরের আগমন ঘটেছে। সেবক হয়ে প্রভুকে প্রহরা দিচ্ছি। বিভীষণ আসুন, আমি আপনাকে তাঁবুতে নিয়ে যাবো।” শুনে মহীরাবণ আবার পালালো। এবার আবার বুদ্ধি করে কৌশল্যা রূপ ধরল । সেই হনুমানের কাছে এসে বলল- “হনুমান! দ্বার উন্মোচন করো। চৌদ্দ বর্ষ পুত্রের মুখ দেখিনি। এই অভাগী মায়ের প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। একবার পুত্রকে দেখি। পথ ছাড়ো বাছা!” হনুমান বুঝলো এও সেই মহীরাবণের মায়া। বলল- “মাতা! আপনার পুত্রের প্রাণ সঙ্কটে। কৃপা করে প্রভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। বিভীষণকে আসতে দিন। হয়তো আপনার সাথে সাথে সেই দুষ্ট ঘাতক প্রবেশ করতে পারে।” দূর থেকে বিভীষণকে আসতে দেখে কৌশল্যারূপী মহীরাবণ দাঁত কটমট করে পালালো। এবার সেই মহীরাবণ জনক রাজার রূপ ধরল। ‘হাঁ সীতা’ বলে রোদন করতে করতে এসে বলল-
জনক বলেন শুন পবন নন্দন ।
রাম সঙ্গে আমার করাহ দরশন ।।
আমার জামাতা হন শ্রীরাম লক্ষ্মণ ।
চতুর্দশ বর্ষ গত নাহি দরশন ।।
( কৃত্তিবাসী রামায়ণ )
জনক রাজাকে দেখে হনুমান বুঝলো আবার মহীরাবণ এসেছে। হনুমান বিনয় সহ বলল- “বিভীষণ আসুন। আমি তারপর আপনাকে প্রবেশ করতে দেবো। এখন নয়। আপনি এখন বিশ্রাম গ্রহণ করুন।” মহীরাবণ পুনঃ পালালো। সে বুঝলো হনুমানকে এইভাবে ভুলিয়ে রাম লক্ষ্মণকে হরণ করা অসম্ভব । আর এখানে এখন যুদ্ধ করা যাবে না। হনুমান অনেক শক্তি রাখে। এইভেবে মহীরাবণ ভাবল এবার কূট বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে। যেই ভাবে অমনি মাথায় বুদ্ধি এলো । মহীরাবণ মায়া দ্বারা একটি সুড়ঙ্গ রচনা করলো। সে ভাবল ভেতর দিয়ে গিয়ে সেই দুই ভ্রাতাকে পাতালে নিয়ে যাবে। হনুমান কিছুই বুঝবে না। সে ত বাইরে প্রহরায়। আর পাতালে সে প্রবেশ করতে পারবে না। এই ভেবে হাসতে হাসতে মহীরাবণ পাতালে প্রবেশ করলো। তারপর সুড়ঙ্গ দিয়ে ভগবান রাম ও লক্ষ্মণের তাঁবুর মাটি খুঁড়ে উঠলো। দেখিলো দুভাই পরম যত্নে শয়ণ করছে। শরীরে নানা ক্ষত্রিয় চিহ্ন দেখতে পেলো। মহীরাবণ তখন ইষ্টদেবী পাতালভৈরবীর স্মরণ করে ধূলিপোড়া নিক্ষেপ করলো। তাহার ফলে রাম ও লক্ষ্মণ গভীর ঘুমে চলে গেলো। মহীরাবণ অতি সতর্কে তাহাদের দুজনকে দুস্কন্ধে ধারণ করলো। বিন্দু মাত্র শব্দ না করে রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে সোজা চলে গেলো পাতাল পুরী। ওদিকে হনুমান প্রহরা দিচ্ছে। বিভীষণ এসে মাঝে মাঝে দেখে যাচ্ছে। প্রভাত হল। কিন্তু প্রভু শ্রীরাম আর কুটির থেকে বহির্গমন করেন না। সকলে দেখতো প্রভু শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ প্রত্যহ অতি প্রভাতে উঠে সমুদ্রে স্নান, সূর্য দেবতাকে জল অর্পণ করতেন। কিন্তু আজ আর কেহই বের হলেন না। সকলে আশ্চর্য হল। হনুমান পুচ্ছ বাঁধন মুক্ত করলো। কুটিরে প্রবেশ করে দেখতে পেলো ভগবান শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ কেহই নেই। সকলে অবাক হল ।
( ক্রমশঃ )