গায়ত্রী মন্ত্রের দ্রষ্টা ঋষি – বিশ্বামিত্র। বিশ্বামিত্র ঋষি নিজের জীবনের প্রথম দিকে ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন।তাঁর নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের উপর প্রচন্ড আত্মাভিমান ছিলো। একদিন তিনি তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় পাশেই অবস্থিত বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে এলেন। ব্রাহ্মণ বশিষ্ঠ মুনি একজন ব্রহ্মর্ষি ছিলেন। বশিষ্ঠ মুনি, ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রকে কিছু সময়ের জন্য তাঁর আশ্রমে বিশ্রাম নিতে বললেন এবং ভোজন গ্রহন করার জন্য অনুরোধ করলেন। রাজা বিশ্বামিত্র ভোজন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালেন, কারণ তিনি চিন্তা করলেন যে তাঁর সাথে হাজার খানেক সৈন্য আছে। এই বনে এতজন সৈন্যের খাবারের আয়োজন করা বড্ড ঝামেলার বিষয়। কিন্তু বশিষ্ঠ মুনি বললেন যে তাদের ভোজন করেই যেতে হবে। তারপর বশিষ্ঠ মুনি নিজ কক্ষে প্রবেশ করলেন।ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের নিকট একটি দৈব শক্তিসম্পন্ন গোমাতা ছিলো। যাহাকে কামধেনু বলা হয়।প্রকৃতপক্ষে কামধেনু হলেন একজন দেবী, যিনি গোমাতা রূপে ছিলেন তাহার নিকট। কামধেনু মায়ের কাছে যা চাওয়া হয় তিনি তাই প্রদান করেন।
তারপর কামধেনু মায়ের নিকট ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ সবার খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রার্থনা করলেন। সাথে সাথে হাজার সৈন্য-সামন্তের খাবার প্রকটিত হলো।তারপর ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ, রাজা বিশ্বামিত্র সহ সকলকেই খাবার গ্রহনের জন্য খাবার কক্ষে ডাকলেন। রাজা বিশ্বামিত্র এতো মানুষের খাবার ক্ষণিক সময়ের মধ্যে প্রস্তুত দেখে বিস্মিত হলেন। তিনি বশিষ্ঠ মুনিকে জিজ্ঞেস করলেন যে এই জঙ্গলের মধ্যে তিনি কিভাবে এতো মানুষের খাবার এতো কম সময়ে প্রস্তুত করলেন।
তখন বশিষ্ঠ মুনি বললেন যে তাঁর নিকট একটি গাভী আছে। তিনি তাকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করেন। সেই গাভীটিই তাকে তাঁর প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রদান করেন। এবার রাজা বিশ্বামিত্রের মনে লোভ চলে এলো। তিনি ভাবলেন রাজা তো তিনি। এই কামধেনু তো তাঁর প্রাপ্য। তিনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠকে বললেন যে তাকে এই গাভী দিয়ে দিতে। এর বিনিময়ে বশিষ্ঠ মুনি যা চাইবেন বিশ্বামিত্র তাই তাকে দিবেন। বশিষ্ঠ মুনি বললেন যে এই ভুল যাতে বিশ্বামিত্র না করেন কারন ইনি একজন দেবী, ইনি বিক্রির বস্তু নয়। ইনি তাঁর সমস্ত প্রয়োজন পূরন করেন। তাছাড়া তিনি ঐ জায়গায় থাকেন যেখানে ব্রহ্মবিদ্যার চর্চা করা হয়, যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান আছে। তিনি বিশ্বামিত্রের রাজপ্রাসাদে যাবেন না। তখন রাজা বিশ্বামিত্র রেগে গেলেন এবং বললেন এই গাভী তিনি নিবেনই। তিনি তার সৈন্য-সামন্তকে বললেন গাভীটিকে জোরপূর্বক নিয়ে আসতে। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ তাকে শেষবারের মতো সর্তক করলেন তাও রাজা বিশ্বামিত্র কর্ণপাত করলেন না। তারপর বশিষ্ঠ মুনি তাঁর ব্রহ্মদন্ড তোলার সাথে সাথে রাজা বিশ্বামিত্রের সমগ্র সৈন্য মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো।
বিশ্বামিত্র এটা দেখে হকচকিয়ে গেলেন। আসলে এটা ছিলো ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের ব্রহ্মজ্ঞানের শক্তি। "Power of the realization of Brahman(ultimate reality). তারপর রাজা বিশ্বামিত্র নিজে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠকে আঘাত করতে উদ্যত হবার সাথে সাথে বশিষ্ঠ মুনি ব্রহ্মদন্ড তোলা মাত্রই রাজা বিশ্বামিত্র শক্তিহীন হয়ে পড়লেন।
তখন বিশ্বামিত্র বললেন, "ধিক বলম্ ক্ষত্রিয় বলম্, ব্রহ্ম বলম্ এব বলম্" অর্থাৎ, বশিষ্ঠের ব্রহ্মজ্ঞানের শক্তির কাছে আমার রাজত্ব, আমার অহংকার, আমার সৈন্য এগুলো ধূলিকণার সমানও নয়।ব্রহ্মবিদ্যার শক্তিই সর্বোচ্চ শক্তি। যে ব্যক্তি এই ব্রহ্মবিদ্যা জানেন তিনি এতই শক্তিশালী যে কোন শস্ত্র ছাড়াই তাঁর ইচ্ছামাত্রই এতো হাজার হাজার সৈন্য লুটিয়ে পড়ে। তখন বিশ্বামিত্র বললেন, "ঠিক আছে, আমিও এই ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করবো তারপর তোমাকে দেখে নিবো।"
এরপর রাজা বিশ্বামিত্র নিজ রাজ্য তাঁর পুত্রকে দিয়ে বনে চলে গেলেন। তিনি বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। আস্তে আস্তে তারমধ্যে কিছু পরিবর্তন আসতে লাগলো। কিন্তু তখনো তাঁর ক্রোধ ও দ্বেষভাব সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। তাঁর তপস্যা চলাকালীন সময়ে ত্রিশঙ্কু রাজার আগমন ঘটলো। ত্রিশঙ্কু ছিলেন সেই রাজা যার মনের ইচ্ছে ছিলো স্বশরীরে স্বর্গে যাওয়া। প্রথমে তিনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের নিকট গেলেন এবং তাঁর ইচ্ছা বাক্ত করলেন। বশিষ্ঠ মুনি তাকে এখান থেকে চলে যেতে বললেন এবং আরো বললেন যে তিনি এসব স্বর্গে পাঠানোর কাজ করেন না। তখন রাজা ত্রিশঙ্কু আসলো তপস্বী বিশ্বামিত্রের নিকট। বিশ্বামিত্র যখন শুনলেন বশিষ্ঠ মুনি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তখন তিনি ত্রিশঙ্কুকে কথা দিলেন যে তিনি তাকে স্বশরীরে স্বর্গে পাঠাবেন। কারন তখনও তার মধ্যে বশিষ্ঠ মুনির প্রতি হিংসা কাজ করছিলো। বিশ্বামিত্র এতেদিন তাঁর তপস্যার ফলে অর্জিত শক্তি দিয়ে তাকে স্বশরীরে স্বর্গে পাঠাতে লাগলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র এলেন এবং বললেন এটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। একজন ব্যক্তি মৃত্যুর পরই তার কর্ম অনুসারে স্বর্গ বা নরকে যেতে পারে কিন্তু মৃত্যুর আগে স্বশরীরে নয়। বিশ্বামিত্র তাঁর তপোবলে রাজা ত্রিশঙ্কুকে উপরে তুলছেন আর অন্যদিকে দেবরাজ ইন্দ্র তাকে উপরে উঠতে বাঁধা দিচ্ছেন। এই অবস্থায় রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝের শুণ্যস্থানে অবস্থান করছিলেন। তখন বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে সেই শূন্যস্থানেই নিজ তপোবলে স্বর্গের ন্যায় আলাদা এক জগৎ সৃষ্টি করলেন।
সেখানকার রাজা ত্রিশঙ্কুকে করে দিলেন। এসব করার পর বিশ্বামিত্রের উপলব্ধি হলো তিনি তাঁর তপস্যায় অর্জিত সমস্ত শক্তি এসব অবান্তর কাজে শেষ করে ফেলেছেন। এরপর তিনি আবার পুরোদমে তপস্যা শুরু করলেন। এরপর আবার ঘটলো আরেক ঘটনা। বিশ্বামিত্র তাঁর তপোবলে স্বর্গ দখল করে ফেলেন কিনা এই ভয়ে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের অপ্সরা মেনকাকে পাঠালেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। তপস্বী হলেও বিশ্বামিত্রের মধ্যে কামের প্রভাব তখনো বিরাজমান ছিল। সেই কামের প্রভাবে অপ্সরা মেনকার প্ররোচনায় বিশ্বামিত্রের পতন ঘটে। তিনি কামের প্রভাবেই বহুদিন কাটিয়ে দেন এবং তাঁর তপস্যার কথা বহুকাল বিস্মৃত হয়ে থাকেন। হঠাৎ একদিন যখন বিশ্বামিত্রের মনে পড়লো যে তিনি আবার ভুল পথে চলে গেছেন তখন তিনি পুনরায় এসব ত্যাগ করে তপস্যায় বসলেন। এবার বহুকাল তপস্যা করার পর তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবতা ব্রহ্মা তাকে দেখা দিলেন এবং তাকে মহর্ষি উপাধি দিলেন। তখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র; দেবতা ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমি কি ব্রহ্মর্ষি উপাধি পাবার যোগ্য নই?" দেবতা ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, "না। ব্রহ্মর্ষি উপাধির জন্য তোমাকে একজন ব্রহ্মর্ষির আর্শীবাদ নিতে হবে। সুতরাং, তুমি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের কাছে যাও এবং তার আর্শীবাদ নাও। যদি তুমি তোমার সমস্ত অহংকার চিরতরে ত্যাগ করে বশিষ্ঠের আর্শীবাদ নিতে পারো তবেই তুমি ব্রহ্মর্ষি হতে পারবে।" এই শুনে মহর্ষি বিশ্বামিত্র; ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের নিকট এলো। যখন তিনি বশিষ্ঠ মুনির গৃহের দ্বারপ্রান্তে এলেন তখন তিনি ভিতরে থাকা বশিষ্ঠ মুনি ও অরুন্ধতীর কথোপকথন শুনলেন। বশিষ্ঠ মুনি অরুন্ধতীকে বলছিলেন, "আমি বিশ্বামিত্রের কৃত তপস্যা দেখেছি এবং আমি তাকে মন থেকে আর্শীবাদ করেছি যেন সে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে। তারমধ্যে একটু অহংকার আছে। সে এটা অতিক্রম করতে পারলেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হবে। আমি তাকে সেই পথে সাহায্য করছি।" এটা শোনা মাত্রই বিশ্বামিত্র লজ্জা পেল। তাঁর যার প্রতি এত ঘৃণা সেই কিনা বিশ্বামিত্রের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করছে! তখন বিশ্বামিত্র বুঝলো কেন বশিষ্ঠ ব্রহ্মর্ষি। তিনি তখনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের চরণে লুটিয়ে পড়লেন। যেই মাত্র মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মাথা ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের চরণ স্পর্শ করলো সাথে সাথে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের দেহ থেকে একটা অবিরত আধ্যাত্মিক শক্তি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হওয়া শুরু করলো। তখনই বিশ্বামিত্র ব্রহ্ম-গায়ত্রী উচ্চারণ করলেন ও সমাধিতে চলে গেলেন।
এই হল সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র, মহামন্ত্র — গায়ত্রী মন্ত্র প্রকাশিত হওয়ার পেছনের ইতিহাস।
গায়ত্রী মন্ত্র —
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্ব্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।।
ব্যাখ্যা — ওঁ (ব্রহ্ম) ভূঃ ভুবঃ স্বঃ (স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল এই তিন লোক অথবা সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ অথবা ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান এই তিনকাল) তৎসবিতুঃ (এই ত্রিলোকের, এই ত্রিগুণের অথবা এই ত্রিকালের প্রসবকারীর অর্থাৎ, সৃষ্টিকারী ব্রহ্মের) বরেণ্যং ভর্গো (শ্রেষ্ঠ স্বতঃপ্রকাশ তেজ) দেবস্য (দেবের অর্থাৎ, ত্রিজগৎ, ত্রিগুণ ও ত্রিকাল সৃষ্টিকারী স্বয়ংদীপ্ত পরমব্রহ্মের) ধীমহি (ধ্যান করছি) ধিয়ো (বিবেক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিসমূহ) য়ো (যিনি) নঃ (আমাদের) প্রচোদয়াৎ (প্রেরণ করছেন) ওঁ (ব্রহ্ম)
অর্থাৎ — যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি সমূহকে প্রেরণ করেন, সেই ত্রিলোক-প্রসবিতা, ত্রিগুণ-স্রষ্টা, ত্রিকাল-সৃজনকারী পরমব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ স্বতঃপ্রকাশ তেজের ধ্যান করি।
Courtesy by: Soma Dey
তারপর কামধেনু মায়ের নিকট ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ সবার খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য প্রার্থনা করলেন। সাথে সাথে হাজার সৈন্য-সামন্তের খাবার প্রকটিত হলো।তারপর ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ, রাজা বিশ্বামিত্র সহ সকলকেই খাবার গ্রহনের জন্য খাবার কক্ষে ডাকলেন। রাজা বিশ্বামিত্র এতো মানুষের খাবার ক্ষণিক সময়ের মধ্যে প্রস্তুত দেখে বিস্মিত হলেন। তিনি বশিষ্ঠ মুনিকে জিজ্ঞেস করলেন যে এই জঙ্গলের মধ্যে তিনি কিভাবে এতো মানুষের খাবার এতো কম সময়ে প্রস্তুত করলেন।
তখন বশিষ্ঠ মুনি বললেন যে তাঁর নিকট একটি গাভী আছে। তিনি তাকে মাতৃজ্ঞানে বন্দনা করেন। সেই গাভীটিই তাকে তাঁর প্রয়োজনীয় সবকিছু প্রদান করেন। এবার রাজা বিশ্বামিত্রের মনে লোভ চলে এলো। তিনি ভাবলেন রাজা তো তিনি। এই কামধেনু তো তাঁর প্রাপ্য। তিনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠকে বললেন যে তাকে এই গাভী দিয়ে দিতে। এর বিনিময়ে বশিষ্ঠ মুনি যা চাইবেন বিশ্বামিত্র তাই তাকে দিবেন। বশিষ্ঠ মুনি বললেন যে এই ভুল যাতে বিশ্বামিত্র না করেন কারন ইনি একজন দেবী, ইনি বিক্রির বস্তু নয়। ইনি তাঁর সমস্ত প্রয়োজন পূরন করেন। তাছাড়া তিনি ঐ জায়গায় থাকেন যেখানে ব্রহ্মবিদ্যার চর্চা করা হয়, যেখানে ব্রহ্মজ্ঞান আছে। তিনি বিশ্বামিত্রের রাজপ্রাসাদে যাবেন না। তখন রাজা বিশ্বামিত্র রেগে গেলেন এবং বললেন এই গাভী তিনি নিবেনই। তিনি তার সৈন্য-সামন্তকে বললেন গাভীটিকে জোরপূর্বক নিয়ে আসতে। ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ তাকে শেষবারের মতো সর্তক করলেন তাও রাজা বিশ্বামিত্র কর্ণপাত করলেন না। তারপর বশিষ্ঠ মুনি তাঁর ব্রহ্মদন্ড তোলার সাথে সাথে রাজা বিশ্বামিত্রের সমগ্র সৈন্য মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লো।
বিশ্বামিত্র এটা দেখে হকচকিয়ে গেলেন। আসলে এটা ছিলো ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের ব্রহ্মজ্ঞানের শক্তি। "Power of the realization of Brahman(ultimate reality). তারপর রাজা বিশ্বামিত্র নিজে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠকে আঘাত করতে উদ্যত হবার সাথে সাথে বশিষ্ঠ মুনি ব্রহ্মদন্ড তোলা মাত্রই রাজা বিশ্বামিত্র শক্তিহীন হয়ে পড়লেন।
তখন বিশ্বামিত্র বললেন, "ধিক বলম্ ক্ষত্রিয় বলম্, ব্রহ্ম বলম্ এব বলম্" অর্থাৎ, বশিষ্ঠের ব্রহ্মজ্ঞানের শক্তির কাছে আমার রাজত্ব, আমার অহংকার, আমার সৈন্য এগুলো ধূলিকণার সমানও নয়।ব্রহ্মবিদ্যার শক্তিই সর্বোচ্চ শক্তি। যে ব্যক্তি এই ব্রহ্মবিদ্যা জানেন তিনি এতই শক্তিশালী যে কোন শস্ত্র ছাড়াই তাঁর ইচ্ছামাত্রই এতো হাজার হাজার সৈন্য লুটিয়ে পড়ে। তখন বিশ্বামিত্র বললেন, "ঠিক আছে, আমিও এই ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করবো তারপর তোমাকে দেখে নিবো।"
এরপর রাজা বিশ্বামিত্র নিজ রাজ্য তাঁর পুত্রকে দিয়ে বনে চলে গেলেন। তিনি বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। আস্তে আস্তে তারমধ্যে কিছু পরিবর্তন আসতে লাগলো। কিন্তু তখনো তাঁর ক্রোধ ও দ্বেষভাব সম্পূর্ণ দূরীভূত হয়নি। তাঁর তপস্যা চলাকালীন সময়ে ত্রিশঙ্কু রাজার আগমন ঘটলো। ত্রিশঙ্কু ছিলেন সেই রাজা যার মনের ইচ্ছে ছিলো স্বশরীরে স্বর্গে যাওয়া। প্রথমে তিনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের নিকট গেলেন এবং তাঁর ইচ্ছা বাক্ত করলেন। বশিষ্ঠ মুনি তাকে এখান থেকে চলে যেতে বললেন এবং আরো বললেন যে তিনি এসব স্বর্গে পাঠানোর কাজ করেন না। তখন রাজা ত্রিশঙ্কু আসলো তপস্বী বিশ্বামিত্রের নিকট। বিশ্বামিত্র যখন শুনলেন বশিষ্ঠ মুনি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তখন তিনি ত্রিশঙ্কুকে কথা দিলেন যে তিনি তাকে স্বশরীরে স্বর্গে পাঠাবেন। কারন তখনও তার মধ্যে বশিষ্ঠ মুনির প্রতি হিংসা কাজ করছিলো। বিশ্বামিত্র এতেদিন তাঁর তপস্যার ফলে অর্জিত শক্তি দিয়ে তাকে স্বশরীরে স্বর্গে পাঠাতে লাগলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র এলেন এবং বললেন এটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। একজন ব্যক্তি মৃত্যুর পরই তার কর্ম অনুসারে স্বর্গ বা নরকে যেতে পারে কিন্তু মৃত্যুর আগে স্বশরীরে নয়। বিশ্বামিত্র তাঁর তপোবলে রাজা ত্রিশঙ্কুকে উপরে তুলছেন আর অন্যদিকে দেবরাজ ইন্দ্র তাকে উপরে উঠতে বাঁধা দিচ্ছেন। এই অবস্থায় রাজা ত্রিশঙ্কু স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝের শুণ্যস্থানে অবস্থান করছিলেন। তখন বিশ্বামিত্র রেগে গিয়ে সেই শূন্যস্থানেই নিজ তপোবলে স্বর্গের ন্যায় আলাদা এক জগৎ সৃষ্টি করলেন।
সেখানকার রাজা ত্রিশঙ্কুকে করে দিলেন। এসব করার পর বিশ্বামিত্রের উপলব্ধি হলো তিনি তাঁর তপস্যায় অর্জিত সমস্ত শক্তি এসব অবান্তর কাজে শেষ করে ফেলেছেন। এরপর তিনি আবার পুরোদমে তপস্যা শুরু করলেন। এরপর আবার ঘটলো আরেক ঘটনা। বিশ্বামিত্র তাঁর তপোবলে স্বর্গ দখল করে ফেলেন কিনা এই ভয়ে দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গের অপ্সরা মেনকাকে পাঠালেন বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। তপস্বী হলেও বিশ্বামিত্রের মধ্যে কামের প্রভাব তখনো বিরাজমান ছিল। সেই কামের প্রভাবে অপ্সরা মেনকার প্ররোচনায় বিশ্বামিত্রের পতন ঘটে। তিনি কামের প্রভাবেই বহুদিন কাটিয়ে দেন এবং তাঁর তপস্যার কথা বহুকাল বিস্মৃত হয়ে থাকেন। হঠাৎ একদিন যখন বিশ্বামিত্রের মনে পড়লো যে তিনি আবার ভুল পথে চলে গেছেন তখন তিনি পুনরায় এসব ত্যাগ করে তপস্যায় বসলেন। এবার বহুকাল তপস্যা করার পর তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবতা ব্রহ্মা তাকে দেখা দিলেন এবং তাকে মহর্ষি উপাধি দিলেন। তখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র; দেবতা ব্রহ্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, "আমি কি ব্রহ্মর্ষি উপাধি পাবার যোগ্য নই?" দেবতা ব্রহ্মা উত্তর দিলেন, "না। ব্রহ্মর্ষি উপাধির জন্য তোমাকে একজন ব্রহ্মর্ষির আর্শীবাদ নিতে হবে। সুতরাং, তুমি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের কাছে যাও এবং তার আর্শীবাদ নাও। যদি তুমি তোমার সমস্ত অহংকার চিরতরে ত্যাগ করে বশিষ্ঠের আর্শীবাদ নিতে পারো তবেই তুমি ব্রহ্মর্ষি হতে পারবে।" এই শুনে মহর্ষি বিশ্বামিত্র; ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের নিকট এলো। যখন তিনি বশিষ্ঠ মুনির গৃহের দ্বারপ্রান্তে এলেন তখন তিনি ভিতরে থাকা বশিষ্ঠ মুনি ও অরুন্ধতীর কথোপকথন শুনলেন। বশিষ্ঠ মুনি অরুন্ধতীকে বলছিলেন, "আমি বিশ্বামিত্রের কৃত তপস্যা দেখেছি এবং আমি তাকে মন থেকে আর্শীবাদ করেছি যেন সে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে। তারমধ্যে একটু অহংকার আছে। সে এটা অতিক্রম করতে পারলেই ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হবে। আমি তাকে সেই পথে সাহায্য করছি।" এটা শোনা মাত্রই বিশ্বামিত্র লজ্জা পেল। তাঁর যার প্রতি এত ঘৃণা সেই কিনা বিশ্বামিত্রের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সাহায্য করছে! তখন বিশ্বামিত্র বুঝলো কেন বশিষ্ঠ ব্রহ্মর্ষি। তিনি তখনি ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের চরণে লুটিয়ে পড়লেন। যেই মাত্র মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মাথা ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের চরণ স্পর্শ করলো সাথে সাথে ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠের দেহ থেকে একটা অবিরত আধ্যাত্মিক শক্তি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হওয়া শুরু করলো। তখনই বিশ্বামিত্র ব্রহ্ম-গায়ত্রী উচ্চারণ করলেন ও সমাধিতে চলে গেলেন।
এই হল সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র, মহামন্ত্র — গায়ত্রী মন্ত্র প্রকাশিত হওয়ার পেছনের ইতিহাস।
গায়ত্রী মন্ত্র —
ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ তৎসবিতুর্ব্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।।
ব্যাখ্যা — ওঁ (ব্রহ্ম) ভূঃ ভুবঃ স্বঃ (স্বর্গ, মর্ত্ত্য, পাতাল এই তিন লোক অথবা সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণ অথবা ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান এই তিনকাল) তৎসবিতুঃ (এই ত্রিলোকের, এই ত্রিগুণের অথবা এই ত্রিকালের প্রসবকারীর অর্থাৎ, সৃষ্টিকারী ব্রহ্মের) বরেণ্যং ভর্গো (শ্রেষ্ঠ স্বতঃপ্রকাশ তেজ) দেবস্য (দেবের অর্থাৎ, ত্রিজগৎ, ত্রিগুণ ও ত্রিকাল সৃষ্টিকারী স্বয়ংদীপ্ত পরমব্রহ্মের) ধীমহি (ধ্যান করছি) ধিয়ো (বিবেক অথবা বুদ্ধিবৃত্তিসমূহ) য়ো (যিনি) নঃ (আমাদের) প্রচোদয়াৎ (প্রেরণ করছেন) ওঁ (ব্রহ্ম)
অর্থাৎ — যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি সমূহকে প্রেরণ করেন, সেই ত্রিলোক-প্রসবিতা, ত্রিগুণ-স্রষ্টা, ত্রিকাল-সৃজনকারী পরমব্রহ্মের শ্রেষ্ঠ স্বতঃপ্রকাশ তেজের ধ্যান করি।
Courtesy by: Soma Dey
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন