২২ এপ্রিল ২০২০

বৈশাখী শুক্লা চতুর্দশীর সন্ধ্যায়, শ্রীহরির অবতার রূপে শ্রীশ্রীনৃসিংহ ভগবান প্রকট হয়েছিলেন।

শ্রীশ্রীনৃসিংহ ভগবান দেখতে বা শুনতে ভয়ঙ্কর হলেও তিনি হচ্ছেন ভক্তিতত্ত্বের অনন্য উদাহরণ স্বরূপ। আমরা জানি, ঈশ্বরের দিকের আমরা এক পা এগিয়ে গেলে তিনি আমাদের দিকে দশ পা এগিয়ে আসেন দর্শন দানের জন্য। সেই এক পা এগানোটাই হচ্ছে কঠিন। এর নানা পথ আছে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভক্তি। ভক্তির দ্বারা আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তিনি আসেন, চাই প্রবল ভরসা 'তাঁর' প্রতি। এই ভরসা ছিল বলেই 'রাম' নামে সমুদ্র পাথর ভেসে সেতু নির্মিত হয়েছিল ভক্ত হনুমানের দ্বারা। তবে হ্যাঁ, ভক্তিতে বোকা হলে চলবে না, যাকে অজ্ঞানতা বলে। ভক্ত প্রহ্লাদের সেই ভরসা ছিল বলেই তিনি বিশ্বাসের সাথে বলতে পেরেছিলেন তাঁর ভগবান স্তম্ভের মধ্যেও আছেন।



বহু লক্ষ বৎসর পূর্বে বৈশাখী শুক্লা চতুর্দশীর সন্ধ্যায়,  শ্রীহরির অবতার রূপে শ্রীশ্রীনরসিংহ ভগবান প্রকট হয়েছিলেন ।

সক্রেটিস বলেছিলেন ‘নিজেকে জানো’। এই রকম একটি স্বার্থপর উক্তি কি করে এত জনপ্রিয়তা পেল আমার মাথায় ধরে না। আমার মতে উক্তিটি একটি অর্ধ উন্মোচিত উক্তি। উক্তিটি হওয়া উচিত – ‘নিজেকে জানো, অন্যকেও জানো’। পরিতাপের বিষয় হলো আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে জানি না অন্যকে জানার ইচ্ছাও বহুদুরে। অথচ পারস্পরিক এই অজানা থেকেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস, যেখান থেকে জন্ম নেয় অন্যের প্রতি অসহিষ্ণু মনোবৃত্তি, সেখান থেকে জন্ম নেয় কলহ। এই সীমাবদ্ধতাকে উপড়ে ফেলতে অগ্রসর হই সনাতন ধর্ম সম্পর্কে জানার। যতটুকু জানছি তারই কিছুটা উন্মোচন করতে এই প্রয়াস।


 হিরণ্যকশিপু পূর্বজন্মে কে ছিলেন ?

বৈকুন্ঠের দ্বারী ছিলেন জয় এবং বিজয় । একবার ব্রাহ্মণরা জয় এবং বিজয়কে তাদের ঔদ্ধত্যৈর জন্য অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, মর্ত্যলোকে তিন জন্ম নাস্তিক আর নিষ্ঠুর হয়ে কাটাতে হবে। এই তিনটি জন্মই তাদের কাটাতে হবে প্রচন্ড দেব- বিরোধিতা করে, অসুর মনোভাব নিয়ে অত্যাচার করে।ভগবান এই দুই দ্বারীকে খুবই ভালবাসতেন। তবে ঔদ্ধত্যৈর শাস্তি পাওয়া উচিত বিবেচনা করে ব্রাহ্মণের সেই অভিশাপ তিনি অনুমোদন করেছিলেন ।তবে ভগবান তাদের অশ্বাস দিয়েছিলেন যে তিনি স্বয়ং নিজে মর্ত্যে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে আনবেন। জয় প্রথমে মর্ত্যে জন্ম নিয়েছিলেন হিরণ্যকশিপু হয়ে । শ্রীশ্রী নৃসিংহ দেব হিরণ্যকশিপুকে সংহার করে প্রথম জন্ম থেকে মুক্তি দেন। দ্বিতীয়বার জয়কে জন্মাতে হয়েছিল রাবন হয়ে। শ্রীরামচন্দ্র রাবনকে বধ করে দ্বিতীয় জন্ম থেকে মুক্তি দেন। শেষে জন্মাতে হয়েছিল শিশুপাল হয়ে। পরমেশ্বর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের মাথা বিছিন্ন করে তৃতীয় জন্ম থেকে মুক্তি দেন। এভাবে পরমেশ্বর স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীতে এসে স্বর্গের দ্বারী জয়কে শাপ মুক্ত করেন । মুক্তি পেয়ে বৈকুন্ঠের দ্বারী জয় আবার বৈকুন্ঠে ফিরে যায়। উল্লেখ্য , বিজয় প্রথমে হিরণক্ষ্য হয়ে জন্মগ্রহন করেন, তারপরে জন্মগ্রহন করেন কুম্ভকর্ণ হয়ে। সর্বশেষে বিজয় জন্মগ্রহন করেন কংস হয়ে। পরমেশ্বর স্বংয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে শাপ মুক্ত করেন।শাপ মুক্ত হয়ে বিজয় বৈকুন্ঠে ফিয়ে যায়।

 অবতারঃ

অবতার শব্দের আক্ষরিক অর্থ অবতরণকারী। দেবতারা যখন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে পৃথিবিতে অবতীর্ণ হন তখন তাদেরকে অবতার বলা হয়। হিন্দুধর্মে অবতারবাদ মূলত বিষ্ণুকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। বিষ্ণু ত্রিমূর্তির অন্যতম দেবতা ও হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী জগতের পালক ও রক্ষাকর্তা। ত্রিমূর্তি হচ্ছে হিন্দু ধর্মের একটি ধারণা যা মনে করা হয় জন্ম, পালন এবং বিনাশের রূপ। ব্রহ্মা হচ্ছে জন্মকর্তা যিনি মানুষের জন্ম দেয়। তিনি সকল প্রাণী এবং সকল বস্তুর পিতা। তারপরেই আছেন বিষ্ণু, যিনি মানুষকে পালন করে থাকেন। তিনিই মানুষের সকল জীবনের সমস্যা এবং সমাধানের পথের পাথেয়। সবশেষে আছেন শিব অথবা মহেশ্বর, যিনি প্রয়োজন মত মানুষের জীবনাবসনের দায়িত্ব পালন করেন। এই তিনজনকে আরো বলা হয় - তাদের সাথে পৃথিবী, জল এবং অগ্নির সম্পর্ক আছে। ব্রহ্ম হচ্ছে পৃথিবী, বিষ্ণু হচ্ছে জল এবং শিব হচ্ছে আগুন। বিষ্ণুর দশ প্রসিদ্ধ অবতারকে দশাবতার নামে পরিচিত।

১. মৎস্য :- মাছরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
২. কূর্ম :- কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৩. বরাহ :- বন্য শূকরের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৪. নৃসিংহ :- অর্ধনরসিংহরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ
৫. বামন :- খর্বকায় বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৬. পরশুরাম :- পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৭. রাম :- অযোধ্যার যুবরাজ ও রাজা রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ
৮. কৃষ্ণ :- দ্বাপরযুগে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সহ অবতীর্ণ। ভাগবত পুরাণ অনুসারে দ্বাপরযুগে অনন্ত নাগের অবতার বলরাম রূপে কৃষ্ণের সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখাসম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন। যে সকল সূত্রে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে বলরামকেই বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯. বলরাম :- কোনো কোনো মতে বিষ্ণুর নবম অবতার। (এই স্থানে বলরাম সম্পর্কে জানতে নিচে বিকল্প তালিকা দেখুন।)
১০. কল্কি :- এই ভবিষ্যৎ অবতার কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন বলে হিন্দুরা মনে করেন।

দক্ষিণ ভারতে বলরামকে দশাবতারের তালিকাভুক্ত করা হয়। এই মত অনুসারে, বুদ্ধের অবতারত্ব স্বীকৃত নয়। কোনো কোনো গ্রন্থে আবার কৃষ্ণকে অবতার তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে। একাধিক মধ্যযুগীয় ধর্মসম্প্রদায়ে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান নামে পরিচিত। গৌড়ীয় বৈষ্ণব, বল্লভ সম্প্রদায়, ও নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মতে তিনি সকল অবতারের উৎস। নিম্বার্ক মতে, কৃষ্ণ আবার শুধু সকল অবতারের উৎসই নন, তিনি স্বয়ং বিষ্ণুরও উৎস। এই বিশ্বাসের মূলে রয়েছে "ভাগবতের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি" (১।৩।২৮)।

 কোনো কোনো তালিকা অনুসারে, বলরাম কৃষ্ণের জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং গৌতম বুদ্ধের স্থলে বিষ্ণুর নবম অবতার। ভাগবত পুরাণ –এর মতে দ্বাপরযুগে শেষনাগের অবতার রূপে বলরামের আবির্ভাব। অধিকাংশ বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তিনি অবতাররূপে পূজিত হন। এই সকল তালিকায় গৌতম বুদ্ধের নাম দেখা যায় না।
মহারাষ্ট্র ও গোয়ার ঐতিহ্য অনুসারে পঞ্চাঙ্গ ও বিভিন্ন মন্দির স্থাপত্যে বিঠোবা বিষ্ণুর নবম অবতার বুদ্ধরূপে গণ্য হন। মহারাষ্ট্রের সন্তকবিরাও বিঠোবাকে বুদ্ধের রূপে বন্দনা করেছেন।

দশাবতারের তালিকা পাওয়া যায় গরুড় পুরাণে। জয়দেব রচিত প্রলয়পয়োধিজলে (গীতগোবিন্দম্ কাব্যের প্রথম সর্গের প্রথম গীত, দশাবতার স্তোত্র নামে সমধিক পরিচিত) স্তোত্রে দশটি পৃথক স্তবকে দশ অবতারের বিবরণদানের পর নিম্নোক্ত শ্লোকে দশাবতারের কীর্তির একটি সুসংবদ্ধ তালিকা প্রদান করা হয়েছে :-

বেদানুদ্ধরতে জগন্তি বহতে ভূগোলমুদ্বিভ্রতে
দৈত্যং দারয়তে বলিং ছলয়তে ক্ষত্রক্ষয়ং কুর্বতে।
পৌলস্ত্যং জয়তে হলং কলয়তে কারুণ্যমাতন্বতে
ম্লেচ্ছান মূর্চ্ছয়তে দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তুভ্যং নমঃ।।

“ বেদের উদ্ধারকারী, ত্রিলোকের ভারবহনকারী, ভূমণ্ডল উত্তোলনকারী, হিরণ্যকশিপু বিদারণকারী, বলিকে ছলনাকারী, ক্ষত্রক্ষয়কারী, দশানন-সংহারকারী, হলকর্ষণকারী, করুণাবিতরণকারী, ম্লেচ্ছধ্বংসকারী, দশরূপধারী হে কৃষ্ণ, তোমায় প্রণাম করি।।১৬।। ”

যাই হোক, এই দশ অবতারই মানব সমাজে তাঁদের প্রভাবের ভিত্তিতে সর্বাপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হন। দশাবতারের প্রথম চার জন অবতীর্ণ হয়েছিলেন সত্যযুগে। সত্যযুগের ব্যপ্তিকাল ছিল ১৭ লক্ষ ২৮ হাজার বছর। বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে এযুগের উত্‍পত্তি হয়েছিল।সত্য যুগ ছিল পুরা সময়টাই ছিল ধর্ম ও শাস্ত্র নির্ভর। কেউ শাস্ত্রনিষিদ্ধ উপায়ে অর্থ বা বিদ্যা লাভের চেষ্টা করতেন না। তপস্যাই এযুগের শ্রেষ্ঠ ধর্ম। মানুষের আয়ু ছিল ৪০০বছর। কোন রোগ শোক দুঃখ ছিল না। মানুষের সকল কামনা পূর্ণ হতো। মানুষ ছিল পুন্যবান। দেবতা ও পিতৃলোকের তৃপ্তসাধন করতেন এবং তারা ছিলেন জিতেন্দ্রিয়। সত্য যুগে মানুষ দেবতুল্য ছিলেন । মানুষের রুপে নিয়ে দেবতারা ইহ ও স্বর্গলোক বিচরন করতে পারতেন। পরের দ্রব্যকে দেখতো মাটির ঢেলার মত। চোর মিথ্যাবাদী বা প্রতারক এযুগে ছিল না। সত্যযুগে অকাল মৃত্যু ছিল না। এমনকি ছিল না রোগভয় ও দূর্ভিক্ষ । এযুগে পৃথিবী অতি শস্যশালিনী ছিল। মেঘ সময়মত বারি বর্ষণ করত এবং বৃক্ষরাজি ছিল ফলভারে অবনত।তখন যে চারজন অবতার এসেছেন তারা ছিলেন, এক - মত্‍স অবতার, চৈত্রের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে, দুই - কূর্ম অবতার ভাদ্রমাসের শুক্লা পূর্ণিমা তিথিতে, তিন - বরাহ অবতার ভাদ্রমাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে, চার - নৃসিংহ অবতার বা নরসিংহ, অর্ধনরসিংহ যিনি বৈশাখ মাসের চতুদ্দর্শী তিথিতে আর্বিভূত হন।

  নৃসিংহ (সংস্কৃত: नरसिंह, বানানান্তরে নরসিংহ) বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার। পুরাণ, উপনিষদ ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। তিনি হিন্দুদের জনপ্রিয়তম দেবতাদের অন্যতম। সাধারণত দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের অন্যতম প্রতীক তিনি ৷ প্রাচীন মহাকাব্য, মূর্তিতত্ত্ব, মন্দির ও উৎসব ইত্যাদির তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর পূজা প্রচলিত রয়েছে। নৃসিংহকে শৌর্যের মূর্তিস্বরূপ এবং তাঁর মন্ত্র শত্রুনিধন ও অমঙ্গল দূরীকরণে বিশেষ ফলপ্রসূ বলে মনে করা হয়; তাই অতীতে শাসক ও যোদ্ধারা নৃসিংহের পূজা করতেন।

নৃসিংহ অর্ধ-মনুষ্য অর্ধ-সিংহ আকারবিশিষ্ট। তাঁর দেহ মনুষ্যাকার, কিন্তু সিংহের ন্যায় মস্তক ও নখরযুক্ত। মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী নৃসিংহ অষ্টভূজ হলেও, অগ্নিপুরাণ অনুযায়ী তিনি চতুর্ভূজ। একাধিক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে তাঁর পূজা প্রচলিত। দক্ষিণ ভারতে নৃসিংহ পূজার বিশেষ প্রচলন দেখা যায়। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নৃসিংহ ‘মহারক্ষক’; তিনি ভক্তকে তার প্রয়োজনের সময় সর্বদা রক্ষা করে থাকেন।

একাধিক পুরাণ গ্রন্থে নৃসিংহের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণে নৃসিংহ-সংক্রান্ত মূল উপাখ্যানটির সতেরোটি পাঠান্তর বর্তমান। কয়েকটি কাহিনি অন্যান্য কাহিনিগুলির চেয়ে একটু বিস্তারিত। নৃসিংহ অবতারের বর্ণনা রয়েছে ভাগবত পুরাণ (সপ্তম স্কন্দ), অগ্নিপুরাণ (৪।২-৩), ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ (২।৫।৩-২৯), বায়ুপুরাণ (৬৭।৬১-৬৬), হরিবংশ (৪১ এবং ৩।৪১-৪৭), ব্রহ্মাপুরাণ (২১৩।৪৪-৭৯), বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ (১।৫৪), কূর্মপুরাণ (১।১৫।১৮-৭২), মৎস্যপুরাণ (১৬১-১৬৩), পদ্মাপুরাণ (উত্তরখণ্ড, ৫।৪২), শিবপুরাণ (২।৪।৪৩ ও ৩।১০-১২), লিঙ্গপুরাণ (১।৯৫-৯৬), স্কন্দপুরাণ ৭ (২।১৮।৬০-১৩০) ও বিষ্ণুপুরাণ (১।১৬-২০) গ্রন্থে। মহাভারত-এও (৩।২৭২।৫৬-৬০) নৃসিংহ অবতারের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া একটি প্রাচীন বৈষ্ণব তাপনী উপনিষদ (নরসিংহ তাপনী উপনিষদ) তাঁর নামে উল্লিখিত হয়েছে।

ঋগ্বেদে একটি শ্লোকাংশে একটি রূপকল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রূপকল্পটি নৃসিংহরূপী বিষ্ণুর রূপকল্প বলে অনুমিত হয়ে থাকে। উক্ত শ্লোকে বলা হয়েছে "বন্য জন্তুর ন্যায়, ভয়ংকর, বিধ্বংসী ও পর্বতচারী" রূপে বিষ্ণুর গুণ কেবল তাঁর অবতারে দৃষ্ট হয় (ঋগ্বেদ ১।১৫৪।২ক)। ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলে (১৪।১৩) বর্ণিত নামুচির উপাখ্যানে নৃসিংহের ছায়া লক্ষিত হয়: "হে ইন্দ্র, জলের বুদ্বুদের দ্বারা তুমি নামুচির মস্তক ছিন্ন করলে এবং সকল প্রতিকূল শক্তিগুলিকে নিমজ্জিত করলে।" মনে করা হয় এই ক্ষুদ্র উল্লেখটি থেকে নৃসিংহের পূর্ণ কাহিনিটি বিকাশ লাভ করেছে।

ভাগবত পুরাণ-এ বর্ণিত নৃসিংহের কাহিনিটি নিম্নরূপ :-

মহর্ষি কশ্যপের ঔরসে তৎপত্নী দিতির গর্ভে এই দৈত্যের জন্ম হয়। তার ভাইয়ের নাম হিরণ্যাক্ষ।
হিরণ্যাক্ষ নৃসিংহের পূর্ববর্তী অবতার বরাহের হাতে নিহত হয় । হিরণ্যকশিপু এই কারণে প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। দাদার হত্যার প্রতিশোধ মানসে তিনি বিষ্ণুকে হত্যা করার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই জাতীয় প্রবল ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম। তিনি বহু বছর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেন। ব্রহ্মাও হিরণ্যকশিপুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হন। তিনি হিরণ্যকশিপুর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বর দিতে চান।

হিরণ্যকশিপু বলেন :-

" হে প্রভু, হে শ্রেষ্ঠ বরদাতা, আপনি যদি আমাকে সত্যই বর দিতে চান, তবে এমন বর দিন যে বরে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হস্তে আমার মৃত্যু ঘটবে না।
আমাকে এমন বর দিন যে বরে আমার বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে আমার মৃত্যু ঘটবে না; দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে আমার মৃত্যু হবে না। আমাকে এমন বর দিন যে বরে শস্ত্রাঘাতে, মনুষ্য বা পশুর হাতে আমার মৃত্যু হবে না।
আমাকে এমন বর দিন যে বরে কোনো জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে আমার মৃত্যু হবে না; কোনো উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ আমাকে হত্যা করতে পারবে না; যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে কেউই হত্যা করতে পারে না; তাই আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমাকেও বর দিন যাতে আমারও কোনো প্রতিযোগী না থাকে। এমন বর দিন যাতে সকল জীবসত্তা ও প্রভুত্বকারী দেবতার উপর আমার একাধিপত্য স্থাপিত হয় এবং আমাকে সেই পদমর্যাদার উপযুক্ত সকল গৌরব প্রদান করুন। এছাড়া আমাকে তপস্যা ও যোগসাধনার প্রাপ্তব্য সকল সিদ্ধাই প্রদান করুন, যা কোনোদিনও আমাকে ত্যাগ করবে না। "

হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিলেন, তখন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করেন। দেবর্ষি নারদ হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়াদুকে রক্ষা করেন। দেবর্ষি দেবগণের নিকট কায়াদুকে ‘পাপহীনা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নারদ কায়াদুকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে কায়াদু প্রহ্লাদ নামে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। নারদ প্রহ্লাদকে শিক্ষিত করে তোলেন। নারদের প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত। এতে তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

ক্রমে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিতে হিরণ্যকশিপু এতটাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন যে তিনি নিজ পুত্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলেন তাঁকে ত্রিভুবনের অধিপতি রূপে স্বীকার করে নিতে। প্রহ্লাদ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা :-

"ওরে হতভাগা প্রহ্লাদ, তুই সব সময়ই আমার থেকেও মহৎ এক পরম সত্তার কথা বলিস। এমন এক সত্তা যা সর্বত্র অধিষ্ঠিত, যা সকলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং যা সর্বত্রব্যাপী। কিন্তু সে কোথায়? সে যদি সর্বত্র থাকে তবে আমার সম্মুখের এই স্তম্ভটিতে কেন নেই ? "

প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, " তিনি [এই স্তম্ভে] ছিলেন, আছে ও থাকবেন।" উপাখ্যানের অন্য একটি পাঠান্তর অনুযায়ী, প্রহ্লাদ বলেছিলেন, " তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম যষ্টিটিতেও আছেন। " হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন। তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে প্রহ্লাদের সাহায্যার্থে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু।

ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন :-
হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর বধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাঁকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাঁকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাঁকে বধ করেন তাঁরই গৃহদ্বারে।

কূর্মপুরাণ-এর বর্ণনা অনুসারে, এরপর পুরুষ ও দৈত্যদের মধ্যে এক প্রবল সংগ্রাম শুরু হয়। এই যুদ্ধে তিনি পাশুপত নামে এক মহাস্ত্রকে প্রতিহত করেন। পরে প্রহ্লাদের ভাই অনুহ্রদের নেতৃত্বাধীন দৈত্যবাহিনীকে নৃসিংহ অবতারের দেহ হতে নির্গত এক মহাসিংহ যমালয়ে প্রেরণ করেন। মৎস্যপুরাণ (১৭৯) গ্রন্থেও নৃসিংহ অবতারের বর্ণনার পর এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।

ভাগবত পুরাণ-এ আরও বলা হয়েছে: হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর সকল দেবতাই নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হন। বিফল হন স্বয়ং শিবও। সকল দেবগণ তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে ডাকেন; কিন্তু লক্ষ্মীও স্বামীর ক্রোধ নিবারণে অক্ষম হন। তখন ব্রহ্মার অনুরোধে প্রহ্লাদ এগিয়ে আসেন। ভক্ত প্রহ্লাদের স্তবগানে অবশেষে নৃসিংহদেব শান্ত হন। নৃসিংহদেব "প্রহ্লাদকে কোলে লইয়া গা চাটিতে লাগিলেন।" প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নৃসিংহদেব প্রহ্লাদকে রাজা করে দেন।

শিবপুরাণ গ্রন্থে নৃসিংহ উপাখ্যানের একটি শৈব পাঠান্তর বর্ণিত হয়েছে, যা প্রথাগত কাহিনিটির থেকে একটু ভিন্ন: নৃসিংহকে শান্ত করতে শিব প্রথমে বীরভদ্রকে প্রেরণ করেন। কিন্তু বীরভদ্র ব্যর্থ হলে শিব স্বয়ং মনুষ্য-সিংহ-পক্ষী রূপী শরভের রূপ ধারণ করেন। এই কাহিনির শেষভাগে বলা হয়েছে, শরভ কর্তৃক বদ্ধ হয়ে বিষ্ণু শিবের ভক্তে পরিণত হন। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থেও শরভের কাহিনি রয়েছে। যদিও বিজয়েন্দ্র তীর্থ প্রমুখ বৈষ্ণব দ্বৈতবাদী পণ্ডিতগণ সাত্ত্বিক পুরাণ ও শ্রুতি শাস্ত্রের ভিত্তিতে নৃসিংহের উপাখ্যানটির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে বিতর্কের অবকাশ রেখেছেন।

ACHARYA KUSH MUKHERJEE
RAMPURHAT CHAKLAMATH BIRBHUM (W.B)
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।