১০ এপ্রিল ২০২০

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস ।

ফুলুকে বলা হয় 'বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী'। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বলত ফুলু নাকি বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশে বিপ্লবী। ফুলু নাকি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলোনের সময় বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার টাকা দিত। ফুলুর দেশপ্রেম এতই উগ্র ছিল, যে ঢাকার একজন উচ্চপদস্থ অফিসার বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, 'স্যার পি.সি. রায়ের মতো লোক যদি আধ-ডজন থাকতেন, এতদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে যেত।' ১৯১৯ সালে ফুলুকে ব্রিটিশরা দিয়েছিল Companion of the Indian Empire(C.I.E.) উপাধি, সেই বছরই কলকাতার টাউন হলে রাউলাট বিলের বিরোধিতায় গর্জে উঠেছিল ফুলু, বলেছিল, 'দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।'
প্রেসিডেন্সি কলেজে ২৭ বছর পড়িয়েছে ফুলু। ক্লাসে ফুলু পড়াতো বাংলা ভাষায়। নীচের দিকেই ক্লাস নিতে ভালোবাসত ফুলু, সে বলত 'কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাইস্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়।' সে সব সময় চাইত তার ছাত্রছাত্রীরা তাকে ছাপিয়ে যাক। তাই সে লিখেছিল , ' সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে, কিন্ত পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।' ফুলুর এক মুসলিম ছাত্র ছিলেন ডঃ কুদরত-ই খুদা। ১৯১৫ সালে কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি পরীক্ষায় কুদরত-ই খুদা প্রথম শ্রেণী পাওয়ায় কয়েকজন কট্টর হিন্দু শিক্ষক ফুলুকে অনুরোধ করেছিলেন কুদরত-ই খুদাকে প্রথম শ্রেণী না দেওয়ার জন্য। কিন্ত ফুলু যে অসাম্প্রদায়িক পিতার ভাবাদর্শে দীক্ষিত। ফুলুর কাছে যে যোগ্য সে যোগ্যই। তাই ফুলু রাজি হয়নি।

ফুলুকে একবার বিশ্বকবি লিখেওছিলেন, '…যেসব জন্ম-সাহিত্যিক গোলমালের মধ্যে ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়ে, জাত খুইয়ে বৈজ্ঞানিকের হাটে হারিয়ে গিয়েছেন তাদের ফের জাতে তুলব। আমার এক একবার সন্দেহ হয় আপনিও বা সেই দলের একজন হবেন।' আসলে বিশ্বকবি অনুভব করেছিলেন, বিলেতে পড়াশুনা করলেও এবং ইংরেজিতে চোস্ত হলেও বাংলা ভাষা ছিল ফুলুর প্রাণ এবং ফুলুর মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক সাহিত্যিক। ফুলুর ৭০ তম জন্মজয়ন্তীর দিনে রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, আবেগমথিত কণ্ঠে বিশ্বকবি বলেছিলেন, 'আমরা দুজনে সহযাত্রী, কালের তরীতে আমরা প্রায় একঘাটে এসে পৌছেছি।' সেদিন রবীন্দ্রনাথ ফুলুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি তাম্রফলক, তাতে খোদাই করা ছিল কবির লেখা দুটি লাইন -'প্রেম রসায়নে ওগো সর্বজনপ্রিয়, করিলে বিশ্বের জনে আপন আত্মীয়।'
ছোটবেলা থেকেই কলা খেতে ভালোবাসত ফুলু, সকালে টিফিন করত দুটো কলা দিয়ে। চাঁপাকলা ফুলুর খুব প্রিয় ছিল। সেই সময় এক পয়সায় দুটো চাঁপাকলা পাওয়া যেত। একদিন এক ছাত্র স্যারের জন্য তিন পয়সা দিয়ে দুটো কলা নিয়ে আসায় কি রাগ ফুলুর, ছাত্রকে বলেছিল, 'নবাবি করতে শিখেছ, আমায় পথে বসাবে?'
এর কিছুক্ষণ পরেই কংগ্রেস নেতা ড . প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ এসেছিলেন ফুলুর কাছে, তাঁর তিনহাজার টাকা দরকার ছিল। যে যুগে এক পয়সায় দুটো কলা পাওয়া যেত, সে যুগে তিন হাজার টাকার মুল্য সহজেই অনুমেয়। বিনা বাক্যব্যয়ে তিনহাজার টাকার চেক লিখে দিয়েছিল ফুলু।
'বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী' রাড়ুলীর ফুলুর নাম তখন সারা বিশ্ব জানে। সাইমন কমিশনের সদস্যরা বিজ্ঞান কলেজের কথা ও ফুলুর কথা লন্ডনে অনেক শুনেছিল। তারা কলকাতায় এসে বিজ্ঞান কলেজ পরিদর্শনে এসেছিল, আসল উদ্দেশ্য ছিল ফুলুকে দেখা। এক দুপুরে তারা ফুলুর ঘরে এসে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। 'বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী' মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিস্কারক স্যার পি,সি,রায় গামছা পরে চেয়ারে বসে আছেন। কারণ ফুলু তার ধুতি খানা কেচে রোদে শুকাতে দিয়েছিল। ঘরের এক কোণে স্টোভ জ্বলছে, নিজের খাবার নিজেই রান্না করছিল ফুলু। একটু লজ্জা না পেয়ে ফুলু নাকি সেই অবস্থাতেই সাইমন কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
তিনি বুঝেছিলেন, ‘‘একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস। মূলধন বলতে ছিল, মাত্র আটশো টাকা আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস।
তাঁর আদর্শ বাঙালি পালন করে না।
আজকের প্রজন্ম তাঁর নামও শোনেনি।
আমাদের ক্ষমা করবেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
সংগৃহীত


Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।