ভারত ত্যাগী সাধু সন্তদের দেশ। এখানে সাধুরাই মানুষকে মুক্তির পথ দেখান। এমনই একজন মহান সাধক হলেন মহর্ষি বালানন্দ ব্রহ্মচারী। উজ্জয়নীতে আবির্ভাব হয়েছিলেন এই সাধকের। অল্পকালে পিতার প্রয়ান এর পর মা নর্মদাবাঈ ছেলেকে খুব কষ্টে বড় করেন। ব্রহ্মচারীজির পূর্ব নাম পীতাম্বর । ছোট থেকেই বালকের মন উদাসী- সংসারের প্রতি নিঃস্পৃহ। শিপ্রা নদীর তীরে মন্দির আর সাধুদের সঙ্গ লাভেই বালক আনন্দে থাকতো। মা খুবুই চিন্তিত ছিলেন। ব্রহ্মচারীজির একাধিক গুরু ছিলেন। প্রথম গুরু যোগী ব্রহ্মানন্দ। দীক্ষা প্রাপ্তির পর সাধন ভজনে ব্রহ্মচারীজির দিন কাটতে থাকে। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে অনেক সাধু সন্ন্যাসী তাঁর সাথে দর্শন লাভ করতে আসতেন । ব্রহ্মানন্দ মহারাজ তাঁর সন্ন্যাস নামকরণ করেন “বালানন্দ ব্রহ্মচারী”। এরপর তিঁনি তৎকালীন নামকরা সাধক গৌরীশঙ্কর মহারাজের কাছে শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। হিমাচল প্রদেশের কাংরা তে সেই সময়ের আর একজন সাধক গোমতীস্বামীর সাথে এই সময় বালানন্দ ব্রহ্মচারীর সাক্ষাৎ ও শাস্ত্র আলোচনা হয় । একবার ব্রহ্মচারীজী কামাখ্যা গিয়ে কলেরা তে আক্রান্ত হন। মরণাপন্ন সময়ে তিঁনি দেবীর দর্শন লাভ করেন। দেবীর কৃপায় সুস্থ হন । নর্মদা পরিভ্রমণ কালে তিঁনি সেখানে বিখ্যাত যোগী মার্কণ্ডের নিকট যোগশিক্ষা লাভ করেছিলেন ।
এরপর কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটের ধ্রুবেশ্বর মঠের অধ্যক্ষ দশনামী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী স্বামী রামগিরি মহারাজকে গুরুরূপে পেয়ে সেখানে বেদান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন ও বেদান্তে জ্ঞানলাভ করেন । যোগী শ্রীশ্যামাচরণ লাহিরী মহাশয়ের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিঁনি বাংলাতে নবদ্বীপ ও রানাঘাটে এসেছিলেন। রানাঘাটের তৎকালীন মহাকুমা শাসক রামচরণ বসুকে এক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করেন। বৈদ্যনাথ ধামে তাঁর একটি আশ্রম হয়। ব্রহ্মচারীজী ভগবান শিবের উপাসক ছিলেন। একসময় সন্তানহারানো ব্রহ্মচারীজির মা দুঃখে একটি শিবমন্দিরে গিয়ে ভগবানের কাছে অন্তরের কষ্ট নিবেদন করছিলেন। সে সময় দৈববানী হয় বৈদ্যনাথে যেতে। নর্মদা বাঈ বৈদ্যনাথে গিয়ে পুত্রকে দেখেন। শেষ জীবন তিঁনি বৈদ্যনাথ ধামে সাধন ভজনে কাটিয়ে দেন ।
বালানন্দ ব্রহ্মচারী তপসিদ্ধ যোগী ছিলেন। বহু লোকের কষ্ট উপশম নিবারণ করেছিলেন। ভক্তেরা তাঁর কাছে যেতো। অনেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণও পেয়েছিলেন। আজ বালানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজের আবির্ভাব তিথি। জন্মতিথিতে প্রণাম জানাই।
বালানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজের কিছু উপদেশঃ-
অহং বোধ পরিত্যাগ কর । নিজের অহং বোধটির স্থলে স্থাপিত করতে হবে ভগবানকে। নিজেকে মালিক মনে না করে মনে করতে হবে ম্যানেজার ।
সাধুর নিকট নিঃস্বার্থ মুমুক্ষু ভক্ত খুব বেশী আসে না। স্বার্থসিদ্ধির জন্যে যারা আসে তারা টেকে না। স্বার্থসিদ্ধি হলে ভাবে কাজ তো মিটে গেল, আর এখানে আসবার দরকার কি । স্বার্থ না মিটলে ভাবে, লাভ যখন কিছু হল না তখন এখানে এসে আর কি হবে ? এই জন্যই নিঃস্বার্থ , ধর্মপিপাসু কেউ এলে আমি খুশী হই । মন আনন্দে ভরে ওঠে । বুঝতে পারি এরা টিকবে , আমার উপদেশ এরা হেলায় নষ্ট করবে না ।
সাধু বলে তাঁকেই জানবে যিনি কাউকে দুঃখ দেন না। সংসাররূপ এই বাগানে তিনি ঘুরে বেড়ান, কিন্তু তার একটি পাতা ফুল তিনি ছেঁড়েন না।
সবকিছুই ভগবানের। তাই স্বয়ং ভগবানকেই যখন ভক্ত নিজের করে নেয়, তখন আর বাকী থাকে কী ? ঈশ্বরকে পাওয়ার সাথে সাথে সব পাওয়া হয়ে যায় ।
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কর্তব্য কর্মে রত থাকবে। বিষয়ে অনাসক্ত থেকে সর্বদা ভগবদ চিন্তায় মনকে যুক্ত রাখার অভ্যাস করতে হয় ।
যে নিজেকে ভগবৎ সমীপে উৎসর্গ করে, সে সন্তোষের সঙ্গে রোগ- শোক সব ভোগ করে যায়, তার মানসিক বিকার হয় না, সমত্ববোধ হানি হয় না ।
যতদিন হৃদয় আসন স্বচ্ছ ও নির্মল না হবে- ভগবান ততদিন আসা যাওয়া করবেন- কিন্তু বসবেন না। কারণ ভগবান ময়লা আসনে বসেন না।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন