২৫ অক্টোবর ২০১৭

ভগবান আর ভগবা‌নের নাম জ‌পের মাহাত্ম্য কি ভিন্ন - না একই ?

যে বস্তুর নাম গুড় , তার সেই না‌মে গুড় নামক বস্তুর অভাব আ‌ছে অর্থাৎ গু‌ড়ের নাম‌টির ম‌ধ্যে গুড় নেই । যতক্ষণ রস‌নে‌ন্দ্রিয় বা জি‌ভের স‌ঙ্গে সম্বন্ধ না করা হ‌চ্ছে ততক্ষণ মুখ মিষ্টতা লাভ করে না , কেননা জি‌ভে গুড় নেই । ঠিক এইরকম ধনীর নাম নি‌লে ধন প্রাপ্ত হয় না । কেননা ধনী নাম‌টির স‌ঙ্গে ধ‌নের কোন অ‌স্তিত্ব নেই । কিন্তু ভগবা‌নের নাম‌টির স‌ঙ্গে ভগবান সর্বদা হ‌া‌জির । নামী ( ভগবান ) থে‌কে নাম আলাদা নন এবং নাম থে‌কে নামী ( ভগবান ) আলাদা নন । নামী‌তে নাম উপ‌স্থিত এবং না‌মেও নামী হা‌জির । অতএব নামীর অর্থাৎ ভগবা‌নের নাম নি‌লে ভগবান‌কে পাওয়া যায় ও নামী স্বয়ং প্রক‌টিত হন ।

কৃষ্ণে‌তি নামা‌নিচি নিঃসর‌ন্তি রা‌ত্রি‌ন্দিবং বৈ প্র‌তি‌রোমকূপাৎ ।

যস্যার্জুনস্য প্র‌তি তং সুগীতগী‌তে ন না‌ম্নো ম‌হিমা ভ‌বেৎ কিম্ ।।

নাম এবং নামী অর্থাৎ ভগবন্নাম এবং ভগবান অ‌ভেদ , অতএব দু‌টি‌কে ম্মরণ করার একই মাাহাত্ম্য । ভগবন্নাম তিনরূ‌পে নেওয়া যায় --

১। ম‌নের দ্বারা - ম‌নের দ্বারা নাম স্মরণ হয় , যার বর্ণনা ভগবান ' যো মাং স্মর‌তি নিত্যশঃ ' ( ৮\১৪ ) পদদ্বারা ক‌রে‌ছেন ।

২ । বাণীর দ্বারা - বাণীর দ্বারা নামজপ হয় , যা‌কে ভগবান ' যজ্ঞানাং জপয‌জ্ঞোহ‌স্মি ' ( ১০\২৫ ) পদদ্বার‌া নি‌জের স্বরূপ ব‌লে‌ছেন।

গীতায় ভগবান ওঁ , তৎ , সৎ পরমাত্মার এই তিন‌টি নাম ব‌লে‌ছেন - " ওঁ তৎস‌দি‌তি নি‌র্দে‌শো ব্রহ্মণস্ত্রি‌বিধঃ স্মৃতঃ । প্রণব বা ওঁকার‌কে ভগবান নি‌জের স্বরূপ ব‌লে জানি‌য়ে‌ছেনন। ' প্রণব সর্ব‌বে‌দেষ‌ু ( ৭\৮ ) । ' গিরাম‌স্ম্যেকমক্ষ‌রম্ ' ( ১০\২৫ ) । ভগবান ব‌লে‌ছেন , যে মানুষ ওঁ - এই অক্ষর প্রণব উচ্চারণ ক‌রে এবং আমা‌কে স্মরণ ক‌রে শরীর ত্যাগ ক‌রে , সে পরমগ‌তি প্রাপ্ত হয় । ( ৮\১৩)

অর্জুনও ভগবা‌নের বিরাট রূ‌পের স্তু‌তি দ্বার‌া ম‌হিমা কীর্তন ক‌রে‌ছেন , যেমন - ' হে প্রভু ! অ‌নেক দেবতা বিহ্বল হ‌য়ে হাত জোড় ক‌রে আপনার ম‌হিমা কীর্তন কর‌ছেন । ' হে অন্তর্যামী ভগবান ! আপনার নাম ইত্যা‌দির কীর্তন করার এই সম্পূর্ণ জগৎ আন‌ন্দে বি‌ভোর হ‌য়ে প্রেমানুরাগ প্রাপ্ত হ‌চ্ছে । আপনার নামা‌দি কীর্তনে ভীত হয়ে রাক্ষসগণ দশ‌দি‌কে ছু‌টে পালা‌চ্ছে এবং সিদ্ধগণ আপনা‌কে নমস্কার জানা‌চ্ছে ।

জ্ঞাতব্য == সুষু‌প্তি বা গভীর নিদ্রার সম‌য়ে সকল ই‌ন্দ্রিয় ম‌নে , মন বু‌দ্ধি‌তে , ব‌ু‌দ্ধি অহং - এ এবং অহং অ‌বিদ্যা‌তে লীন হ‌য়ে যায় , অর্থাৎ সুষুপ্তি‌তে অহংভা‌বের আভাসও থা‌কে না । গভীর নিদ্রাভ‌ঙ্গে প্রথ‌মে অহংভা‌বের আভাস হয় , প‌রে ক্রমশঃ দেশ , কাল , অবস্থা ইত্যা‌দির আভাস হয় । কিন্তু গভীর নিদ্রায় নি‌দ্রিত ব্য‌ক্তির নাম ধ‌রে ডাক‌লে সে জে‌গে ও‌ঠে , অর্থাৎ অ‌বিদ্যা‌তে লীন হওয়া গভীর নিদ্রায় নি‌দ্রিত ব্য‌ক্তি পর্যন্ত শব্দ পৌঁছায় । তাৎপর্য এই যে শ‌ব্দে অ‌চিন্তীয় শ‌ক্তি আ‌ছে , তাই শব্দ অ‌বিদ্যা‌কে ভেদ ক‌রে অহং পর্যন্ত পৌঁছায় । যেমন অনা‌দিকাল থে‌কে অবিদ্যায় আচ্ছা‌দিত জ্ঞানহীন ব্য‌ক্তির ম‌তো সংসা‌রে মোহগ্রস্ত ব্য‌ক্তির গুরুমু‌খে উপ‌দেশ শ্রবণ কর‌লে নি‌জের স্বরূপ সম্ব‌ন্ধে বোধ জাগ্রত হয় , অর্থাৎ অ‌বিদ্যাসম্পন্ন মানুষ‌কে শব্দদ্বারা তত্ত্বজ্ঞান করা‌নো যায় । শ‌ব্দে এমন বি‌শেষ শ‌ক্তি আ‌ছে যে , যা ই‌ন্দ্রি‌য়ের সাম‌নে নেই , শব্দ সেই প‌রোক্ষ বিষ‌য়ের জ্ঞান ক‌রি‌য়ে দেয় । এইরূপ যে ব্য‌ক্তি তৎপরতার স‌ঙ্গে ভগবৎ- নাম জপ ক‌রে , ঐ নাম তার স্বরূ‌পের বোধ করায় এবং ভগবা‌নের দর্শন পাই‌য়ে দেয় ।

তত্ত্বজ্ঞ জীবন্মুক্ত মহাপুরু‌ষের মুখ‌নিঃসৃত বাণী‌তে যে শব্দ ( উপদেশ ) নিঃসৃত হয় , শ্রদ্ধাসহকা‌রে য‌দি তা কেউ শো‌নে তবে তার আচরণ , ভাব সব‌কিছু শুধ‌রে যায় এবং অজ্ঞান দূরীভূত হ‌য়ে সে বোধসম্পন্ন হয় । কিন্তু যার বাণী‌তে অসত্য , কটুত্ব , বৃথা বাগাড়ম্বর , নিন্দা পরচর্চা ইত্যা‌দির দোষ থা‌কে তার কথায় কা‌রো উপর কোন প্রভাব প‌ড়ে না , কারণ তার এরূপ আচরণের ফ‌লে শ‌ব্দের শ‌ক্তি সংকু‌চিত হয় , তা‌তে শ‌ক্তি থা‌কে না । এইভা‌বেই স্বয়ং বক্তার মধ্যেও ভ্রম , প্রমাদ , লিপ্সা এবং করণাপাটব -- এই চার প্রকার দোষ থা‌কে ।

ভ্রম == বক্তা যে বিষয়‌টি বর্ণনা কর‌ছেন , তি‌নি য‌দি তা ঠিকম‌তো না জা‌নেন অর্থাৎ কিছুটা জা‌নেন আর কিছুটা জা‌নেন না - ত‌বে এ‌কে ' ভ্রম ' বলা হয় ।

প্রমাদ == যি‌নি উপ‌দেশ দেবার সময় সর্তক থা‌কেন না ,;‌বেপ‌রোয়া হ‌য়ে কথা ব‌লেন , শ্রোতা কোন শ্রেণীর , তারা কতটা বোঝে এই সমস্ত তি‌নি উপেক্ষা ক‌রেন - এ‌কে বলা হয় ' প্রমাদ ' ।

‌লিপ্সা = যে কোন ভা‌বে ( আমার ) পূজা হোক , সম্মান হোক , শ্রোতারা প্রচুর টাকা দিক , আমার স্বাথূ সিদ্ধ হোক , শ্রোতারা কোন প্রকা‌রে অধীন হোক , সব প‌রি‌স্থি‌তি অনুকূল হোক , বক্তা যদি এই সব ইচ্ছা রা‌খেন , - তা‌কে বল‌া হয় ' লিপ্সা ' ।

করণাপাটাব === ব‌ক্তব্যের শৈলী‌তে কুশলতা নেই , বক্তা শ্রোতার ভাষা জা‌নেন না , শ্রোতা কি ধর‌নের কথা বুঝ‌তে পার‌বে অর্থাৎ কিভা‌বে বর্ণনা কর‌লে শ্রোতারা বুঝ‌তে পার‌বে তা জা‌নে না , এ‌কে বলা হয় করণাপাটাব ।

এই চার দোষ বক্তার ম‌ধ্যে থাক‌লে তাঁর কথার শ্রোতার জ্ঞান উৎপন্ন হয় না । এই সকল দোষর‌হিত যে সকল শব্দ , তার দ্বারা শ্রোতার জ্ঞান উৎপন্ন হয় । শ্রোতাও য‌দি শ্রদ্ধা , বিশ্বাস , জিজ্ঞাসা , তৎপরতা , সংযতেন্দ্রিয়তা ইত্যা‌দি‌তে যুক্ত হয় এবং পরমাত্মাপ্রা‌প্তি য‌দি তার উ‌দ্দে‌শ্য হয় , তাহ‌লে বক্তার কথায় তাঁর জ্ঞান হয় । এর তাৎপর্য এই যে , বক্তা অ‌যোগ্য হ‌লে শ্রোতার ওপর কোন প্রভাব প‌ড়ে না এবং শ্রোতা অ‌যোগ্য হ‌লে তার ওপর বক্তার কোন প্রভাব প‌ড়ে না । দুজ‌নের যোগ্যতা থাক‌লে তাহ‌লেই বক্তার কথার প্রভাব শ্রোতার ওপর প‌ড়ে । কিন্তু ভগবা‌নের নামে এমনই শ‌ক্তি যে , মানুষ যেভা‌বেই তাঁর নামজপ করুক না কেন তার তা‌তে মঙ্গলই হয় ।

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হ‌য়ে‌ছে

সা‌ঙ্কেতাং প‌রিহাস্যং বা স্তোডং হেলন‌মেব বা ।

‌বৈকুন্ঠনামগ্রহণ‌শেষাঘহ‌রং বিদুঃ ।। ( ৬\২\৯৪)

ভগবান নি‌জের নাম সম্ব‌ন্ধে ব‌লে‌ছেন , ' যে জীব শ্রদ্ধা বা অব‌হেলা‌তেও আমার নাম উচ্চারণ ক‌রে , তার নাম সর্বদা আমার অন্ত‌রে থা‌কে ' ---

শ্রদ্ধয়া হেলয়া নাম রট‌ন্তি মম জন্তবঃ ।

‌তেযাং নাম সদা পার্থ বর্ততে হৃদ‌য়ে মম ।।

Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।