ভগবান মানবের মঙ্গলসাধনে আর ভক্তদের বিশেষভাবে দৃঢ় করবার জন্য তাঁদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন । যদিও তিনি আমাদের অন্তরের প্রতিটি অভিপ্রায়কে ভালোভাবে জানেন তবুও শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা - অযোগ্যতা জেনেও তাদের পরীক্ষা করেন তেমনভাবেই তিনি সতত আমাদের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন । শিক্ষক তো সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা জানেন না তাই সেইখানে পরীক্ষা নেওয়ার যুক্তি আছে কিন্তু ভগবান তো অন্তর্যামী - সব কিছুই জানেন , তাঁর কিছুই অজানা নয় ।
আমরা যাকে বিপদ - আপদ বলি তা বস্তুত ভগবানের দ্বারা বিহিত এবং তা উপস্থিত হয় ক্রমাগত আমাদের শক্তসামর্থ্য আর উত্থান সুনিশ্চিত করবার জন্য । অনিচ্ছা ও পরের ইচ্ছায় যে পরিস্থিতি উপস্থিত হয় তাকে ভগবানের বিধান মনে করে প্রসন্ন থাকা উচিত । এই কথা কেবল অনিচ্ছা ও পরের ইচ্ছায় লাভ করা সুখ - দুঃখাদি ভোগেই সীমাবদ্ধ , নতুন কর্মসম্বন্ধে নয় । নতুন কর্ম তো ভগবানের আশ্রয় নিয়ে নিজ সাত্ত্বিক বুদ্ধির দ্বারা তাঁর আদেশ অনুসারে সুচারুরূপে সম্পন্ন করুন । সকল কর্মেই এই ভাব থাকা প্রয়োজন ।অনুকূল - প্রতিকূল পরিস্থিতিকে যার রাগ - দ্বেষ , হর্ষ - শোক যতটা ক্ষীণ হয়েছে সে আধ্যাত্মিক পথে ততটাই অগ্রসর হয়েছে । বিকার অধিক থাকলে অধঃপতনও তদনুরূপ হয় ।
বিকার দুই প্রকারের হয়ে থাকে ১ । মুক্তি প্রদায়ক আর ২ । পতনকারক ।
মুক্তি প্রদায়ক বিকার হল অন্যের দুঃখ দেখে দুঃখী হওয়া আর অপরের সুখে সুখী হওয়া । এটি বিকার হলেও যেহেতু মুক্তিপ্রদায়ক তাই তা গ্রহণযোগ্য হয় । যে বিকার পতন সুনিশ্চিত করে - তা হল নিজ দুঃখে দুঃখী আর নিজ সুখে অর্থাৎ সুখ প্রদায়ক বস্তু প্রাপ্তিতে হর্ষিত হওয়া । এই বিকার ত্যাজ্য । কিন্তু যে বিকার এই দুই থেকেও বড় বিকার তা অতিশয় লজ্জাজনক তা হল অপরের দুঃখে সুখী হওয়া , প্রফুল্ল হওয়া আর অপরকে সুখী দেখে , উন্নত দেখে ঈর্ষা অনুভব করা । এটি অতিশয় সংকীর্ণতার লক্ষণ ।
এটি হল অাসুরিক স্বভাব । আর এর থেকে বড় অপরাধ হল , যে উপকার করে তারও অপকার করা । এইরূপ সংকীর্ণমনা ব্যক্তির জন্য শাস্ত্রে কোনো শব্দই নেই ।
সর্বোত্তম কী ? যে অপকার করে তাও উপকার করা । এতেই নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত হয় । যিনি উত্তম ক্ষমাযুক্ত ব্যক্তি তিনি কোন নিয়মের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না । তাঁদের তো ক্ষমা করা স্বভাব হয়ে থাকে । তাঁরা তো স্বভাবেই সর্বভূতে বিদ্বেষ বিরহিত হয়ে সকলের বন্ধু হয়ে যান । তাঁদের অন্তরে সকলের প্রতি করুণাভাব থাকে । সাধু ব্যক্তি যদি শোনেন যে তাঁর অপকারকারী দণ্ড পাবে , তাহলে তিনি খুবই কষ্ট পান , তাঁর অশ্রুপাত হতে থাকে ।
এক মহানুভব ব্যক্তি নৌকায় বসে পারাপার হচ্ছিলেন । সেই নৌকাতেই দুইজন অত্যাচারী দুষ্টও বসেছিল । অহেতুক অপরকে কষ্ট দেওয়া তো দুষ্টের স্বভাবই হয়ে থাকে । সেই মহানুভব ব্যক্তির সৌম্য , ঋজু ও শান্ত আকৃতি তাদের ক্লেশ প্রদান করতে লাগল । দুষ্ট দুইজন সংকেত করে সেই মহানুভব ব্যক্তিকে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করল । তারা আস্তে আস্তে করে তাঁকে নৌকা থেকে ঠেলে জলে ফেলে দিতে উদ্যত হল ।
সেই সময়েই দৈববাণী হল - ' এই দুইজন অতিশয় দুষ্ট , অত্যাচারী ও আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে । এরা আপনাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে চায় । আপনি অনুমতি দিলে এদেরই নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি । ' দৈববাণী শ্রবণ করে মহানুভব ব্যক্তি ক্রন্দন করতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন - ' আমি কী অপরাধী - যার জন্য এদের ডুবিয়ে মেরে ফেলবার কথা শুনছি । ' মহানুভবের করুণায় পরিপূর্ণ কথাগুলি শ্রবণ করে আবার দৈববার্তা হল - দণ্ড না দিয়ে কী করলে ভালো হয় ? তখন তিনি বললেন - এঁরা আমার দর্শন করেছেন , স্পর্শ করেছেন আর আমার সঙ্গ লাভ করেছেন । আমি যদি ঈশ্বরের কৃপাধন্য হই আর সাধু বলে পরিচিত হই তাহলে সাধুসঙ্গ লাভে যেন এঁদেরও সেই লাভ হয় আর এঁরাও প্রকৃত সাধুব্যক্তি হয়ে যান । '
সেই মহানুভব ব্যক্তির ও দৈববাণীর বৃত্তান্ত শ্রবণ করে দুষ্ট ব্যক্তিদের উপর খুবই অতিশ্রয় প্রভাব পড়ল । তারা মহানুভব ব্যক্তির চরণযুগলে লুটিয়ে পড়ল আর তখন থেকেই সাধু ব্যক্তিতে পরিণত হল ।
এই হল উচ্চ শ্রেণীর ব্যবহার । এতে দয়া , ক্ষমা , অহিংসা ও অক্রোধ সবই পূর্ণরূপে বিদ্যমান । এই সকলই উচ্চভাবসম্পন্ন । দৈববাণী শ্রবণ করে মহানুভব ব্যক্তি ক্রন্দন মুখর হয়েছিলেন তা অবশ্যই বিকার ছিল কিন্তু সেই বিকার অপরের হিতকাঙ্ক্ষায় ছিল তাই তা মুক্তিদায়ক হয় । এই হল মহাপুরুষের সিদ্ধান্ত , তাঁদের অন্তরের ব্যঞ্জনা । এই আচরণকে যে কেউ বাস্তবে পরিণত করতে পারে । সকলের যাতে কল্যাণ হয় - এই মনোভাব যেন সর্বদা থাকে । এইটুকু হলেই হবে । একেই বলা হয় কর্মযোগ ।
কর্মযোগ তাহলে কী ? যে কার্যে স্বার্থ থাকবে না , কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা থাকবে না আর যা অপরের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে তাই তো কর্মযোগ । এই কর্মযোগের স্বপ্ল পালনেই কল্যাণ সুনিশ্চিত । ঈশ্বর নিজ মুখে বলেছেন --
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে ।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ।। ( ২ \ ৪০ ) ।।
' নিষ্কাম কর্মযোগে আরম্ভের বিফলতা হয় না অর্থাৎ বীজের বিনাশ হয় না আর বিপরীত ফলরূপ দোষও হয় না । উপরন্তু এই নিষ্কাম কর্মযোগরূপ ধর্মের অল্প সাধনাও জন্ম - মৃত্যুরূপ মহাভয় থেকে রক্ষা করে । '
অতএব এর অন্তর্নিহিত ভাব এই সামান্য কর্মও নিঃস্বার্থভাবে সম্পাদন করলে তা মুক্তি প্রদায়ক হয়ে থাকে । এবং যাঁর সম্পূর্ণ কর্ম নিঃস্বার্থভাবে সতত সম্পাদিত হয় তিনি তো মুক্তিস্বরূপ হয়ে থাকেন । তাঁর দর্শন , স্পর্শ ও বাণীতে অন্যরা পবিত্র হয়ে যায় - মুক্ত হয়ে যায় । তাই স্বেচ্ছায় যা কিছু কর্ম করা হয় তা যেন সাবধানে করা হয় , স্বার্থত্যাগ করে করা হয় আর অপরের কল্যাণে জন্য যেন করা হয় । সেই কর্মই করা উচিত যাতে ঈশ্বর প্রসন্ন হন , আর সতত তা প্রসন্নচিত্তে এই মনে করা যে , ঈশ্বরের হস্ত মস্তকের উপর সতত ধরা আছে । যেন তিনি সর্বদা মাথার উপর হাত রেখে আমাদের আশীর্বাদ করছেন ।
এই পথই উকৃষ্ট পথ ঈশ্বর সাধনায় । নিজ বুদ্ধি অনুসারে সেই কার্য সম্পাদনই যেন হতে থাকে যাতে ঈশ্বর প্রসন্ন হন । স্বেচ্ছায় তো ভগবানের প্রসন্নতা অনুসারে ও তাঁর আদেশ শিরোধার্য করে কার্য সম্পাদন করা আর অনিচ্ছা ও অপরের ইচ্ছায় সম্পাদিত কর্মকে ঈশ্বরের প্রেরিত মঙ্গলময় বিধান মনে করা । অপরের ইচ্ছায় সম্পাদিত কর্মের বিষয় এই চিন্তা ধারণ করা ভালো যে ঈশ্বরই এমন করিয়েছেন আর অনিচ্ছায় সম্পাদিত কর্ম সম্বন্ধে ঈশ্বর স্বয়ংই তা করিয়েছেন - এরূপ মনে করা সর্বোত্তম । এইরূপ মনে করে সর্বদা প্রসন্নচিত্ত থাকা উচিত । একেই বলা হয় ভক্তি , শরণাগতি ও কর্মযোগ ।
যে কার্যে ভগবানের সম্মতি আছে তাই করা আর তা কেবল তাঁর জন্যই সম্পন্ন করা । সব কিছু ঈশ্বরের মনে করে তাঁকে অর্পণ করা আর সকল কার্য সম্পাদনকালে তাঁকে মনে রাখা প্রয়োজন । ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিটি পরিস্থিতিতে কর্ম সম্পাদনকালে তাঁকে স্মরণ করে ও সন্তোষ অনুভব করে প্রসন্ন থাকা উচিত । প্রশ্ন উঠতে পারে যে কী ভেবে প্রসন্ন থাকব ? প্রসন্ন থাকা সম্ভব ভগবানের দয়ার কথা মনে করে , যেমন দেখ ! ভগবানের কী অসীম কৃপা আমার উপরে ! সকলের উপরে !
অসীম কৃপার কথা মনে করে এত আনন্দ হওয়া দরকার যেন তা চিত্তে উথলে পড়ে ! সতত আনন্দে মুগ্ধ থাকা । প্রয়োজনে বারে বারে প্রসন্নচিত্ত হওয়া । আহা ! প্রভু কত দয়াময় । এটি সর্বোৎকৃষ্ট সাধনা আর এইটাই ভক্তি আর এরই নাম শরণাগত হওয়া । ঈশ্বরের কৃপা ,রুচি এবং তার স্বরূপ স্মরণ করে প্রসন্ন চিত্ত থাকা দরকার । সুখ - দুঃখ যাই আসুক , তাতেই তাঁর কৃপা দর্শন করা । নিজে যা করবেন তাতে লক্ষ্য রাখতে হয় যে এই কার্যে ঈশ্বরের অনুমোদন রয়েছে তো ?
ঈশ্বরের দয়া ও অভিরুচির প্রতি লক্ষ্য থাকলে তাঁর স্বরূপের প্রতি স্বতই অন্তরে বজায় থাকবে । যখন আপনি এই মনে করবেন - ' কোন একজন মহাপুরুষ আমার উপর কত কৃপা করেছেন তখন স্বতই তাঁর স্মৃতি হবে আর যখন আপনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কাজ করবেন তখনও তাঁর স্মৃতি সতত বর্তমান থাকবেই । তদনুরূপভাবে ভগবানের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য ।অতএব ভগবানের প্রসন্নতা লাভেচ্ছু ব্যক্তিগণ ভগবানের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকবেন আর তা প্রত্যক্ষ করে উত্তরোত্তর প্রসন্ন হবেন । তাঁর প্রীতির জন্যই কার্য সম্পাদন করে যাওয়া উচিত এবং সতত তাঁকে স্মরণে রাখা উচিত ।
আমরা যাকে বিপদ - আপদ বলি তা বস্তুত ভগবানের দ্বারা বিহিত এবং তা উপস্থিত হয় ক্রমাগত আমাদের শক্তসামর্থ্য আর উত্থান সুনিশ্চিত করবার জন্য । অনিচ্ছা ও পরের ইচ্ছায় যে পরিস্থিতি উপস্থিত হয় তাকে ভগবানের বিধান মনে করে প্রসন্ন থাকা উচিত । এই কথা কেবল অনিচ্ছা ও পরের ইচ্ছায় লাভ করা সুখ - দুঃখাদি ভোগেই সীমাবদ্ধ , নতুন কর্মসম্বন্ধে নয় । নতুন কর্ম তো ভগবানের আশ্রয় নিয়ে নিজ সাত্ত্বিক বুদ্ধির দ্বারা তাঁর আদেশ অনুসারে সুচারুরূপে সম্পন্ন করুন । সকল কর্মেই এই ভাব থাকা প্রয়োজন ।অনুকূল - প্রতিকূল পরিস্থিতিকে যার রাগ - দ্বেষ , হর্ষ - শোক যতটা ক্ষীণ হয়েছে সে আধ্যাত্মিক পথে ততটাই অগ্রসর হয়েছে । বিকার অধিক থাকলে অধঃপতনও তদনুরূপ হয় ।
বিকার দুই প্রকারের হয়ে থাকে ১ । মুক্তি প্রদায়ক আর ২ । পতনকারক ।
মুক্তি প্রদায়ক বিকার হল অন্যের দুঃখ দেখে দুঃখী হওয়া আর অপরের সুখে সুখী হওয়া । এটি বিকার হলেও যেহেতু মুক্তিপ্রদায়ক তাই তা গ্রহণযোগ্য হয় । যে বিকার পতন সুনিশ্চিত করে - তা হল নিজ দুঃখে দুঃখী আর নিজ সুখে অর্থাৎ সুখ প্রদায়ক বস্তু প্রাপ্তিতে হর্ষিত হওয়া । এই বিকার ত্যাজ্য । কিন্তু যে বিকার এই দুই থেকেও বড় বিকার তা অতিশয় লজ্জাজনক তা হল অপরের দুঃখে সুখী হওয়া , প্রফুল্ল হওয়া আর অপরকে সুখী দেখে , উন্নত দেখে ঈর্ষা অনুভব করা । এটি অতিশয় সংকীর্ণতার লক্ষণ ।
এটি হল অাসুরিক স্বভাব । আর এর থেকে বড় অপরাধ হল , যে উপকার করে তারও অপকার করা । এইরূপ সংকীর্ণমনা ব্যক্তির জন্য শাস্ত্রে কোনো শব্দই নেই ।
সর্বোত্তম কী ? যে অপকার করে তাও উপকার করা । এতেই নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত হয় । যিনি উত্তম ক্ষমাযুক্ত ব্যক্তি তিনি কোন নিয়মের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না । তাঁদের তো ক্ষমা করা স্বভাব হয়ে থাকে । তাঁরা তো স্বভাবেই সর্বভূতে বিদ্বেষ বিরহিত হয়ে সকলের বন্ধু হয়ে যান । তাঁদের অন্তরে সকলের প্রতি করুণাভাব থাকে । সাধু ব্যক্তি যদি শোনেন যে তাঁর অপকারকারী দণ্ড পাবে , তাহলে তিনি খুবই কষ্ট পান , তাঁর অশ্রুপাত হতে থাকে ।
এক মহানুভব ব্যক্তি নৌকায় বসে পারাপার হচ্ছিলেন । সেই নৌকাতেই দুইজন অত্যাচারী দুষ্টও বসেছিল । অহেতুক অপরকে কষ্ট দেওয়া তো দুষ্টের স্বভাবই হয়ে থাকে । সেই মহানুভব ব্যক্তির সৌম্য , ঋজু ও শান্ত আকৃতি তাদের ক্লেশ প্রদান করতে লাগল । দুষ্ট দুইজন সংকেত করে সেই মহানুভব ব্যক্তিকে নদীতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করল । তারা আস্তে আস্তে করে তাঁকে নৌকা থেকে ঠেলে জলে ফেলে দিতে উদ্যত হল ।
সেই সময়েই দৈববাণী হল - ' এই দুইজন অতিশয় দুষ্ট , অত্যাচারী ও আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে । এরা আপনাকে নদীতে ডুবিয়ে মেরে ফেলতে চায় । আপনি অনুমতি দিলে এদেরই নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি । ' দৈববাণী শ্রবণ করে মহানুভব ব্যক্তি ক্রন্দন করতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন - ' আমি কী অপরাধী - যার জন্য এদের ডুবিয়ে মেরে ফেলবার কথা শুনছি । ' মহানুভবের করুণায় পরিপূর্ণ কথাগুলি শ্রবণ করে আবার দৈববার্তা হল - দণ্ড না দিয়ে কী করলে ভালো হয় ? তখন তিনি বললেন - এঁরা আমার দর্শন করেছেন , স্পর্শ করেছেন আর আমার সঙ্গ লাভ করেছেন । আমি যদি ঈশ্বরের কৃপাধন্য হই আর সাধু বলে পরিচিত হই তাহলে সাধুসঙ্গ লাভে যেন এঁদেরও সেই লাভ হয় আর এঁরাও প্রকৃত সাধুব্যক্তি হয়ে যান । '
সেই মহানুভব ব্যক্তির ও দৈববাণীর বৃত্তান্ত শ্রবণ করে দুষ্ট ব্যক্তিদের উপর খুবই অতিশ্রয় প্রভাব পড়ল । তারা মহানুভব ব্যক্তির চরণযুগলে লুটিয়ে পড়ল আর তখন থেকেই সাধু ব্যক্তিতে পরিণত হল ।
এই হল উচ্চ শ্রেণীর ব্যবহার । এতে দয়া , ক্ষমা , অহিংসা ও অক্রোধ সবই পূর্ণরূপে বিদ্যমান । এই সকলই উচ্চভাবসম্পন্ন । দৈববাণী শ্রবণ করে মহানুভব ব্যক্তি ক্রন্দন মুখর হয়েছিলেন তা অবশ্যই বিকার ছিল কিন্তু সেই বিকার অপরের হিতকাঙ্ক্ষায় ছিল তাই তা মুক্তিদায়ক হয় । এই হল মহাপুরুষের সিদ্ধান্ত , তাঁদের অন্তরের ব্যঞ্জনা । এই আচরণকে যে কেউ বাস্তবে পরিণত করতে পারে । সকলের যাতে কল্যাণ হয় - এই মনোভাব যেন সর্বদা থাকে । এইটুকু হলেই হবে । একেই বলা হয় কর্মযোগ ।
কর্মযোগ তাহলে কী ? যে কার্যে স্বার্থ থাকবে না , কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা থাকবে না আর যা অপরের কল্যাণে নিবেদিত থাকবে তাই তো কর্মযোগ । এই কর্মযোগের স্বপ্ল পালনেই কল্যাণ সুনিশ্চিত । ঈশ্বর নিজ মুখে বলেছেন --
নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে ।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ ।। ( ২ \ ৪০ ) ।।
' নিষ্কাম কর্মযোগে আরম্ভের বিফলতা হয় না অর্থাৎ বীজের বিনাশ হয় না আর বিপরীত ফলরূপ দোষও হয় না । উপরন্তু এই নিষ্কাম কর্মযোগরূপ ধর্মের অল্প সাধনাও জন্ম - মৃত্যুরূপ মহাভয় থেকে রক্ষা করে । '
অতএব এর অন্তর্নিহিত ভাব এই সামান্য কর্মও নিঃস্বার্থভাবে সম্পাদন করলে তা মুক্তি প্রদায়ক হয়ে থাকে । এবং যাঁর সম্পূর্ণ কর্ম নিঃস্বার্থভাবে সতত সম্পাদিত হয় তিনি তো মুক্তিস্বরূপ হয়ে থাকেন । তাঁর দর্শন , স্পর্শ ও বাণীতে অন্যরা পবিত্র হয়ে যায় - মুক্ত হয়ে যায় । তাই স্বেচ্ছায় যা কিছু কর্ম করা হয় তা যেন সাবধানে করা হয় , স্বার্থত্যাগ করে করা হয় আর অপরের কল্যাণে জন্য যেন করা হয় । সেই কর্মই করা উচিত যাতে ঈশ্বর প্রসন্ন হন , আর সতত তা প্রসন্নচিত্তে এই মনে করা যে , ঈশ্বরের হস্ত মস্তকের উপর সতত ধরা আছে । যেন তিনি সর্বদা মাথার উপর হাত রেখে আমাদের আশীর্বাদ করছেন ।
এই পথই উকৃষ্ট পথ ঈশ্বর সাধনায় । নিজ বুদ্ধি অনুসারে সেই কার্য সম্পাদনই যেন হতে থাকে যাতে ঈশ্বর প্রসন্ন হন । স্বেচ্ছায় তো ভগবানের প্রসন্নতা অনুসারে ও তাঁর আদেশ শিরোধার্য করে কার্য সম্পাদন করা আর অনিচ্ছা ও অপরের ইচ্ছায় সম্পাদিত কর্মকে ঈশ্বরের প্রেরিত মঙ্গলময় বিধান মনে করা । অপরের ইচ্ছায় সম্পাদিত কর্মের বিষয় এই চিন্তা ধারণ করা ভালো যে ঈশ্বরই এমন করিয়েছেন আর অনিচ্ছায় সম্পাদিত কর্ম সম্বন্ধে ঈশ্বর স্বয়ংই তা করিয়েছেন - এরূপ মনে করা সর্বোত্তম । এইরূপ মনে করে সর্বদা প্রসন্নচিত্ত থাকা উচিত । একেই বলা হয় ভক্তি , শরণাগতি ও কর্মযোগ ।
যে কার্যে ভগবানের সম্মতি আছে তাই করা আর তা কেবল তাঁর জন্যই সম্পন্ন করা । সব কিছু ঈশ্বরের মনে করে তাঁকে অর্পণ করা আর সকল কার্য সম্পাদনকালে তাঁকে মনে রাখা প্রয়োজন । ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিটি পরিস্থিতিতে কর্ম সম্পাদনকালে তাঁকে স্মরণ করে ও সন্তোষ অনুভব করে প্রসন্ন থাকা উচিত । প্রশ্ন উঠতে পারে যে কী ভেবে প্রসন্ন থাকব ? প্রসন্ন থাকা সম্ভব ভগবানের দয়ার কথা মনে করে , যেমন দেখ ! ভগবানের কী অসীম কৃপা আমার উপরে ! সকলের উপরে !
অসীম কৃপার কথা মনে করে এত আনন্দ হওয়া দরকার যেন তা চিত্তে উথলে পড়ে ! সতত আনন্দে মুগ্ধ থাকা । প্রয়োজনে বারে বারে প্রসন্নচিত্ত হওয়া । আহা ! প্রভু কত দয়াময় । এটি সর্বোৎকৃষ্ট সাধনা আর এইটাই ভক্তি আর এরই নাম শরণাগত হওয়া । ঈশ্বরের কৃপা ,রুচি এবং তার স্বরূপ স্মরণ করে প্রসন্ন চিত্ত থাকা দরকার । সুখ - দুঃখ যাই আসুক , তাতেই তাঁর কৃপা দর্শন করা । নিজে যা করবেন তাতে লক্ষ্য রাখতে হয় যে এই কার্যে ঈশ্বরের অনুমোদন রয়েছে তো ?
ঈশ্বরের দয়া ও অভিরুচির প্রতি লক্ষ্য থাকলে তাঁর স্বরূপের প্রতি স্বতই অন্তরে বজায় থাকবে । যখন আপনি এই মনে করবেন - ' কোন একজন মহাপুরুষ আমার উপর কত কৃপা করেছেন তখন স্বতই তাঁর স্মৃতি হবে আর যখন আপনি তাঁর ইচ্ছা অনুসারে কাজ করবেন তখনও তাঁর স্মৃতি সতত বর্তমান থাকবেই । তদনুরূপভাবে ভগবানের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য ।অতএব ভগবানের প্রসন্নতা লাভেচ্ছু ব্যক্তিগণ ভগবানের দয়ার উপর নির্ভর করে থাকবেন আর তা প্রত্যক্ষ করে উত্তরোত্তর প্রসন্ন হবেন । তাঁর প্রীতির জন্যই কার্য সম্পাদন করে যাওয়া উচিত এবং সতত তাঁকে স্মরণে রাখা উচিত ।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন