অযুত যোজন উচ্চ ত্রিকূট পর্বত অতীব রমণীয় স্থান ছিল । তার চারদিকে ছিল ক্ষীর সাগরের পরিবেষ্টন । বিশাল পর্বতমালায় তিনটি শৃঙ্গ তার অনুপম সৌন্দর্যের অঙ্গস্বরূপ ছিল । এই স্বর্ণময় , রৌপ্যময় ও লৌহময় তিনটি শৃঙ্গ , সমুদ্র , দিক্ সকল ও আকাশেও শোভামণ্ডিত করে রাখত । পর্বতমালা , বৃক্ষ , লতা , গুল্ম পরিশোভিত ছিল ।
চতুর্দিক থেকে সমুদ্রের ঢেউ এসে পর্বতের পাদবন্দনা করত । পর্বতে হরিতবর্ণ মরকত প্রস্তরের উপর চারদিকের ভূমি শ্যামল ছিল । পবর্তের গুহায় সিদ্ধ , চারণ গন্ধর্ব , বিদ্যাধর , নাগ , কিন্নর ও অপ্সরা সকলের আগমন হত । তাদের সংগীতের সুর যখন পর্বতে প্রতিধ্বনিত হত তখন অন্যান্য অহংকারী সিংহকুল ভিন্ন সিংহের গর্জন মনে করে অসহিষ্ণু হয়ে আরও জোরে গর্জন করে উঠত ।
পর্বত উপত্যকা ছিল বন্য পশুদের নিবাসস্থান । দেবকাননসম অরণ্যভূমিতে বৃক্ষে বৃক্ষে সুন্দর পাখিদের সুমধুর ডাক শোনা যেত । তাদের মধুর কলকাকলি পরিবেশকে আনন্দময় করে রাখত । পর্বতে বহু সুন্দর ঝরনা ও নদীসহ অনেকগুলি সরোবরও ছিল । তাদের তটভূমি মণিময় বালুকণা দ্বারা সুশোভিত ছিল । দেবাঙ্গনাসকল স্নান করায় তাদের অঙ্গস্পর্শ লাভ করে সরোবরের জল সুরভিত হয়ে থাকত । সেই সকল নদী ও সরোববের সুগন্ধযুক্ত জলকণাবাহী বায়ু অতিশয় সুখসেব্য ছিল ।
পর্বতরাজ ত্রিকূটের পাদদেশে ভগবদ্ভক্ত মহাত্মা বরুণের ঋতুমান নামে একটি উদ্যান ছিল যা দেবাঙ্গনাসকলের ক্রীড়াস্থলরূপে পরিচিত ছিল । উদ্যানটি সারা বছর পুষ্প ও ফলে সমৃদ্ধ থাকত । বিভিন্ন বৃক্ষশোভিত সেই উদ্যানে পক্ষীর কূজন ও ভ্রমরের গুঞ্জন অতীব মনোরম মনে হত । সেই উদ্যানে এক বিশাল সরোবর ছিল । সরোবরে মনোহর স্বর্ণকমল ফুটে থাকত । এই পরম আনন্দময় পরিবেশে সরোবরের এক বর্ণনাতীত সৌন্দর্য ছিল ।
এই পবর্তের গভীর জঙ্গলে এক বিশাল হস্তীবাহিনী ছিল । গজেন্দ্র সেই বাহিনীর প্রধানরূপে পরিচিত ছিল । একদিন গজেন্দ্র কন্টকাকীর্ণ কীচক বাঁশ , বেত আদি বিশাল লতা , গুল্ম ও নানা বৃক্ষ লণ্ডভণ্ড করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল । তার সেই উদ্মত্ত আচরণ ও মদস্রাবগন্ধ অন্যান্য হস্তীসকলর, সিংহ , ব্যাঘ্র , সর্প আদি হিংস্র জন্তুসকলকে ভয়ে তার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । কিন্তু তার অভয় লাভ করে অন্যান্য নিরীহ পশুগণ ওই অঞ্চলে নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগল । প্রবল গ্রীষ্মাধিক্যে গজেন্দ্র অনুগামী হস্তীবাহিনী পদভাবে পর্বতকেও কম্পিত করে এগিয়ে যাচ্ছিল ।
গণ্ডস্থল থেকে নির্গত মদস্রাবগন্ধ ভ্রমরকুলকে প্রলুব্ধ করেছিল আর তাই তারা গজেন্দের সঙ্গ ছাড়ছিল না । তৃষ্ণাকুল হস্তীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মদবিহ্বল নয়নে গজেন্দ্র দূর থেকে পদ্মরেণুগন্ধবাহী বায়ুর আঘ্রাণ লাভ করে সেই সরোবরের তীরে অতি দ্রুতগতিতে উপনীত হল । স্বর্ণকমল ও রক্তবর্ণের কমলের কেশরে সুরভিত মধুর নির্মল সরোবরে সে অবতরণ করল আর শুড় দিয়ে সেই জল পান ও স্নান করল । সে অন্য হস্তীবাহিনী সদস্যদেরও জলে স্নান করিয়ে দিল ও তা পানও করাল । শ্রীভগবানের মায়ায় মোহিত হয়ে গজেন্দ্র ক্রমেই উন্মত্তসম আচরণ করতে লাগল । তার বিপদ যে এত সন্নিকটে তা সে জানতেও পারল না ।
গণ্ডস্থল থেকে নির্গত মদস্রাবগন্ধ ভ্রমরকুলকে প্রলুব্ধ করেছিল আর তাই তারা গজেন্দের সঙ্গ ছাড়ছিল না । তৃষ্ণাকুল হস্তীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মদবিহ্বল নয়নে গজেন্দ্র দূর থেকে পদ্মরেণুগন্ধবাহী বায়ুর আঘ্রাণ লাভ করে সেই সরোবরের তীরে অতি দ্রুতগতিতে উপনীত হল । স্বর্ণকমল ও রক্তবর্ণের কমলের কেশরে সুরভিত মধুর নির্মল সরোবরে সে অবতরণ করল আর শুড় দিয়ে সেই জল পান ও স্নান করল । সে অন্য হস্তীবাহিনী সদস্যদেরও জলে স্নান করিয়ে দিল ও তা পানও করাল । শ্রীভগবানের মায়ায় মোহিত হয়ে গজেন্দ্র ক্রমেই উন্মত্তসম আচরণ করতে লাগল । তার বিপদ যে এত সন্নিকটে তা সে জানতেও পারল না ।
গজেন্দ্র যখন উন্মত্তসম ব্যবহার করছিল তখন দৈবপ্রেরিত এক অতি বলবান কুমির ( গ্রাহ ) সক্রোধে তার পা কামড়ে ধরল । অতি বলবান গজেন্দ্রও তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে কুমিরের কামড় থেকে মুক্ত করতে পারল না । হস্তীবাহিনীও দলপতিকে কুমিরের কামড় থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হল না । গজেন্দ্র ও কুমির উভয়েই পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করেছিল । কাজেই উভয় পক্ষ শক্তিশালী হওয়ায় টানাহেঁচড়া চলতেই থাকল ।
এভাবে সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেল । এই যুদ্ধ দেবতাদেরও আশ্চর্য করল । অবশেষে দেখা গেল যে প্রবল পরাক্রমশালী গজেন্দ্র শারীরিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়ছে । এই অবস্থায় গজেন্দ্র বুঝতে পারল যে কুমিররূপে কালই তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে আর তাকে রক্ষা কেবল শ্রীভগবানই করতে পারেন । এইবার সে নিজ বুদ্ধিতে মনকে চিত্তভূমিতে স্থির করে পূর্ব জন্মের সংরক্ষিত শ্রেষ্ঠ স্তোত্রসকল দ্বারা শ্রীভগবানের স্তুতি করতে লাগল ।
তখন ভক্তের রক্ষার জন্য সর্বাত্মা সর্বদেবস্বরূপ ভগবান শ্রীহরি স্বয়ং আবির্ভূত হলেন । জগদাত্মা শ্রীহরি গজেন্দ্রকে অতি কাতর অবস্থায় দেখলেন আর উচ্চারিত স্তুতি শ্রবণ করে বেদময় গরুড়ে আরোহণ করে চক্রপাণি শ্রীভগবানকে আসতে দেখে গজেন্দ্র তার শুঁড় দিয়ে একটা কমল তুলে কাতর স্বরে বলে উঠল - ' হে নারায়ণ ! হে জগদ্গুরু ! হে শ্রীভগবান ! আপনাকে প্রণাম । '
শ্রীহরি গরুড় থেকে অবতরণ করে করুণা পূর্বক স্বয়ং জলে নেমে তৎক্ষণাৎ গজেন্দ্রের সঙ্গে কুমিরকে আকর্ষণ করে সরোবরের তীরে নিয়ে এলেন । সেইখানে দেবতাগণও উপস্থিত হয়েছিলেন । তাঁদের সম্মুখেই চক্রদ্বারা শ্রীভগবান কুমিরের মুখকে ছিন্নভিন্ন করে গজেন্দ্রকে মুক্ত করলেন । শ্রীহরির কার্যে সন্তুষ্ট দেবতাগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন । স্বর্গে দুন্দুভি বেজে উঠল , গর্ন্ধবগণ নৃত্যগীত করতে লাগল এবং ঋষি , চারণ ও সিদ্ধগণ ভগবান পুরুষোত্তমের স্তুতি করতে লাগলেন ।
শ্রীভগবানের স্পর্শ লাভ করে সেই কুমির তৎক্ষণাৎ পরমসুন্দর দিব্য দেহ ধারণ করল । কুমির পূবূজন্মে ' হূহূ ' নামে এক শ্রেষ্ঠ গর্ন্ধব ছিল । ঋষি দেবলের অভিশাপে তার কুমির দেহ ধারণ করা । শ্রীভগবানের কৃপায় সে শাপমুক্ত হল । তার সমস্ত পাপ - তাপ বিনষ্ট হল । শ্রীভগবানের প্রণাম ও স্তুতি করে সে তৎক্ষণাৎ গন্ধর্বলোকে গমন করল ।
গজেন্দ্রও শ্রীভগবানের স্পর্শলাভ করে অজ্ঞানের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল । সে ভগবানসদৃশ রূপ ধারণ করে পীতবসন চতুর্ভুজ মূর্তি লাভ করল । এই গজেন্দ্র পূর্বজন্মে দ্রবিড় দেশের পাণ্ড্যবংশের রাজা ছিলেন । তাঁর নাম ছিল ইন্দ্রদ্যুম্ন । একবার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজ্য ত্যাগ করে মলয় পর্বতে বাস করছিলেন । তিনি শ্রীভগবানের উত্তম উপাসক ও যশস্বী ছিলেন । মলয় পর্বতে নিবাসকালে তিনি তপস্বীসম বসন ও জটা ধারণ করেছিলেন ।
একদিন যখন তিনি স্নান করে মৌনব্রত ধারণ করে একাগ্রচিত্তে শ্রীভগবানের পূজা করছিলেন তখন দৈববশে মহাযশস্বী অগস্ত্য মুনির সশিষ্য আগমন হয়েছিল । রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আচরণ মহামুনিকে ক্রোধান্বিত করল আর তিনি গমনকালে অভিশাপ দিলেন - ' শিক্ষাভাবে অহংকারী রাজা নিজ কর্তব্য ভুলে গিয়ে ব্রাহ্মণকে অপমান করেছে । সে হস্তীসম জড়বুদ্ধি তাই সে সেই ঘোর অন্ধকারময় হস্তীযোনিতেই গমন করুক । ' তাই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের হস্তীজন্ম হয়েছিল কিন্তু শ্রীভগবানের আরাধনার প্রভাবে তার শ্রীভগবানের স্মৃতি অক্ষত ছিল ।
ভগবান শ্রীহরি এইভাবে গজেন্দ্রকে উদ্ধার করে তাঁকে তাঁর পার্ষদ করলেন । গন্ধর্ব , সিদ্ধ ও দেবগণ তাঁর এই লীলার কীর্তন করতে লাগলেন এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর পার্ষদ গজেন্দ্রকে নিয়ে গরুড়ে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে প্রত্যাগমণ করলেন ।
জয় রাধে ।
জয় ভক্তের জয় ।
জয় শ্রীভগবানের জয় ।
চতুর্দিক থেকে সমুদ্রের ঢেউ এসে পর্বতের পাদবন্দনা করত । পর্বতে হরিতবর্ণ মরকত প্রস্তরের উপর চারদিকের ভূমি শ্যামল ছিল । পবর্তের গুহায় সিদ্ধ , চারণ গন্ধর্ব , বিদ্যাধর , নাগ , কিন্নর ও অপ্সরা সকলের আগমন হত । তাদের সংগীতের সুর যখন পর্বতে প্রতিধ্বনিত হত তখন অন্যান্য অহংকারী সিংহকুল ভিন্ন সিংহের গর্জন মনে করে অসহিষ্ণু হয়ে আরও জোরে গর্জন করে উঠত ।
পর্বত উপত্যকা ছিল বন্য পশুদের নিবাসস্থান । দেবকাননসম অরণ্যভূমিতে বৃক্ষে বৃক্ষে সুন্দর পাখিদের সুমধুর ডাক শোনা যেত । তাদের মধুর কলকাকলি পরিবেশকে আনন্দময় করে রাখত । পর্বতে বহু সুন্দর ঝরনা ও নদীসহ অনেকগুলি সরোবরও ছিল । তাদের তটভূমি মণিময় বালুকণা দ্বারা সুশোভিত ছিল । দেবাঙ্গনাসকল স্নান করায় তাদের অঙ্গস্পর্শ লাভ করে সরোবরের জল সুরভিত হয়ে থাকত । সেই সকল নদী ও সরোববের সুগন্ধযুক্ত জলকণাবাহী বায়ু অতিশয় সুখসেব্য ছিল ।
পর্বতরাজ ত্রিকূটের পাদদেশে ভগবদ্ভক্ত মহাত্মা বরুণের ঋতুমান নামে একটি উদ্যান ছিল যা দেবাঙ্গনাসকলের ক্রীড়াস্থলরূপে পরিচিত ছিল । উদ্যানটি সারা বছর পুষ্প ও ফলে সমৃদ্ধ থাকত । বিভিন্ন বৃক্ষশোভিত সেই উদ্যানে পক্ষীর কূজন ও ভ্রমরের গুঞ্জন অতীব মনোরম মনে হত । সেই উদ্যানে এক বিশাল সরোবর ছিল । সরোবরে মনোহর স্বর্ণকমল ফুটে থাকত । এই পরম আনন্দময় পরিবেশে সরোবরের এক বর্ণনাতীত সৌন্দর্য ছিল ।
এই পবর্তের গভীর জঙ্গলে এক বিশাল হস্তীবাহিনী ছিল । গজেন্দ্র সেই বাহিনীর প্রধানরূপে পরিচিত ছিল । একদিন গজেন্দ্র কন্টকাকীর্ণ কীচক বাঁশ , বেত আদি বিশাল লতা , গুল্ম ও নানা বৃক্ষ লণ্ডভণ্ড করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল । তার সেই উদ্মত্ত আচরণ ও মদস্রাবগন্ধ অন্যান্য হস্তীসকলর, সিংহ , ব্যাঘ্র , সর্প আদি হিংস্র জন্তুসকলকে ভয়ে তার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল । কিন্তু তার অভয় লাভ করে অন্যান্য নিরীহ পশুগণ ওই অঞ্চলে নির্ভয়ে বিচরণ করতে লাগল । প্রবল গ্রীষ্মাধিক্যে গজেন্দ্র অনুগামী হস্তীবাহিনী পদভাবে পর্বতকেও কম্পিত করে এগিয়ে যাচ্ছিল ।
গণ্ডস্থল থেকে নির্গত মদস্রাবগন্ধ ভ্রমরকুলকে প্রলুব্ধ করেছিল আর তাই তারা গজেন্দের সঙ্গ ছাড়ছিল না । তৃষ্ণাকুল হস্তীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মদবিহ্বল নয়নে গজেন্দ্র দূর থেকে পদ্মরেণুগন্ধবাহী বায়ুর আঘ্রাণ লাভ করে সেই সরোবরের তীরে অতি দ্রুতগতিতে উপনীত হল । স্বর্ণকমল ও রক্তবর্ণের কমলের কেশরে সুরভিত মধুর নির্মল সরোবরে সে অবতরণ করল আর শুড় দিয়ে সেই জল পান ও স্নান করল । সে অন্য হস্তীবাহিনী সদস্যদেরও জলে স্নান করিয়ে দিল ও তা পানও করাল । শ্রীভগবানের মায়ায় মোহিত হয়ে গজেন্দ্র ক্রমেই উন্মত্তসম আচরণ করতে লাগল । তার বিপদ যে এত সন্নিকটে তা সে জানতেও পারল না ।
গণ্ডস্থল থেকে নির্গত মদস্রাবগন্ধ ভ্রমরকুলকে প্রলুব্ধ করেছিল আর তাই তারা গজেন্দের সঙ্গ ছাড়ছিল না । তৃষ্ণাকুল হস্তীবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মদবিহ্বল নয়নে গজেন্দ্র দূর থেকে পদ্মরেণুগন্ধবাহী বায়ুর আঘ্রাণ লাভ করে সেই সরোবরের তীরে অতি দ্রুতগতিতে উপনীত হল । স্বর্ণকমল ও রক্তবর্ণের কমলের কেশরে সুরভিত মধুর নির্মল সরোবরে সে অবতরণ করল আর শুড় দিয়ে সেই জল পান ও স্নান করল । সে অন্য হস্তীবাহিনী সদস্যদেরও জলে স্নান করিয়ে দিল ও তা পানও করাল । শ্রীভগবানের মায়ায় মোহিত হয়ে গজেন্দ্র ক্রমেই উন্মত্তসম আচরণ করতে লাগল । তার বিপদ যে এত সন্নিকটে তা সে জানতেও পারল না ।
গজেন্দ্র যখন উন্মত্তসম ব্যবহার করছিল তখন দৈবপ্রেরিত এক অতি বলবান কুমির ( গ্রাহ ) সক্রোধে তার পা কামড়ে ধরল । অতি বলবান গজেন্দ্রও তার সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে কুমিরের কামড় থেকে মুক্ত করতে পারল না । হস্তীবাহিনীও দলপতিকে কুমিরের কামড় থেকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হল না । গজেন্দ্র ও কুমির উভয়েই পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করেছিল । কাজেই উভয় পক্ষ শক্তিশালী হওয়ায় টানাহেঁচড়া চলতেই থাকল ।
এভাবে সহস্র বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেল । এই যুদ্ধ দেবতাদেরও আশ্চর্য করল । অবশেষে দেখা গেল যে প্রবল পরাক্রমশালী গজেন্দ্র শারীরিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে অবসন্ন হয়ে পড়ছে । এই অবস্থায় গজেন্দ্র বুঝতে পারল যে কুমিররূপে কালই তাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে আর তাকে রক্ষা কেবল শ্রীভগবানই করতে পারেন । এইবার সে নিজ বুদ্ধিতে মনকে চিত্তভূমিতে স্থির করে পূর্ব জন্মের সংরক্ষিত শ্রেষ্ঠ স্তোত্রসকল দ্বারা শ্রীভগবানের স্তুতি করতে লাগল ।
তখন ভক্তের রক্ষার জন্য সর্বাত্মা সর্বদেবস্বরূপ ভগবান শ্রীহরি স্বয়ং আবির্ভূত হলেন । জগদাত্মা শ্রীহরি গজেন্দ্রকে অতি কাতর অবস্থায় দেখলেন আর উচ্চারিত স্তুতি শ্রবণ করে বেদময় গরুড়ে আরোহণ করে চক্রপাণি শ্রীভগবানকে আসতে দেখে গজেন্দ্র তার শুঁড় দিয়ে একটা কমল তুলে কাতর স্বরে বলে উঠল - ' হে নারায়ণ ! হে জগদ্গুরু ! হে শ্রীভগবান ! আপনাকে প্রণাম । '
শ্রীহরি গরুড় থেকে অবতরণ করে করুণা পূর্বক স্বয়ং জলে নেমে তৎক্ষণাৎ গজেন্দ্রের সঙ্গে কুমিরকে আকর্ষণ করে সরোবরের তীরে নিয়ে এলেন । সেইখানে দেবতাগণও উপস্থিত হয়েছিলেন । তাঁদের সম্মুখেই চক্রদ্বারা শ্রীভগবান কুমিরের মুখকে ছিন্নভিন্ন করে গজেন্দ্রকে মুক্ত করলেন । শ্রীহরির কার্যে সন্তুষ্ট দেবতাগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন । স্বর্গে দুন্দুভি বেজে উঠল , গর্ন্ধবগণ নৃত্যগীত করতে লাগল এবং ঋষি , চারণ ও সিদ্ধগণ ভগবান পুরুষোত্তমের স্তুতি করতে লাগলেন ।
শ্রীভগবানের স্পর্শ লাভ করে সেই কুমির তৎক্ষণাৎ পরমসুন্দর দিব্য দেহ ধারণ করল । কুমির পূবূজন্মে ' হূহূ ' নামে এক শ্রেষ্ঠ গর্ন্ধব ছিল । ঋষি দেবলের অভিশাপে তার কুমির দেহ ধারণ করা । শ্রীভগবানের কৃপায় সে শাপমুক্ত হল । তার সমস্ত পাপ - তাপ বিনষ্ট হল । শ্রীভগবানের প্রণাম ও স্তুতি করে সে তৎক্ষণাৎ গন্ধর্বলোকে গমন করল ।
গজেন্দ্রও শ্রীভগবানের স্পর্শলাভ করে অজ্ঞানের বন্ধন থেকে মুক্তি পেল । সে ভগবানসদৃশ রূপ ধারণ করে পীতবসন চতুর্ভুজ মূর্তি লাভ করল । এই গজেন্দ্র পূর্বজন্মে দ্রবিড় দেশের পাণ্ড্যবংশের রাজা ছিলেন । তাঁর নাম ছিল ইন্দ্রদ্যুম্ন । একবার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজ্য ত্যাগ করে মলয় পর্বতে বাস করছিলেন । তিনি শ্রীভগবানের উত্তম উপাসক ও যশস্বী ছিলেন । মলয় পর্বতে নিবাসকালে তিনি তপস্বীসম বসন ও জটা ধারণ করেছিলেন ।
একদিন যখন তিনি স্নান করে মৌনব্রত ধারণ করে একাগ্রচিত্তে শ্রীভগবানের পূজা করছিলেন তখন দৈববশে মহাযশস্বী অগস্ত্য মুনির সশিষ্য আগমন হয়েছিল । রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আচরণ মহামুনিকে ক্রোধান্বিত করল আর তিনি গমনকালে অভিশাপ দিলেন - ' শিক্ষাভাবে অহংকারী রাজা নিজ কর্তব্য ভুলে গিয়ে ব্রাহ্মণকে অপমান করেছে । সে হস্তীসম জড়বুদ্ধি তাই সে সেই ঘোর অন্ধকারময় হস্তীযোনিতেই গমন করুক । ' তাই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের হস্তীজন্ম হয়েছিল কিন্তু শ্রীভগবানের আরাধনার প্রভাবে তার শ্রীভগবানের স্মৃতি অক্ষত ছিল ।
ভগবান শ্রীহরি এইভাবে গজেন্দ্রকে উদ্ধার করে তাঁকে তাঁর পার্ষদ করলেন । গন্ধর্ব , সিদ্ধ ও দেবগণ তাঁর এই লীলার কীর্তন করতে লাগলেন এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর পার্ষদ গজেন্দ্রকে নিয়ে গরুড়ে আরোহণ করে বৈকুন্ঠে প্রত্যাগমণ করলেন ।
জয় রাধে ।
জয় ভক্তের জয় ।
জয় শ্রীভগবানের জয় ।
Writer: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন