শৈশব ও প্রারম্ভিক জীবন
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মহাসাধিকা মীরাবাঈয়ের জীবন ঈশ্বরের প্রতি সর্বগ্রাসী প্রেমের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । মীরাবাঈয়ের নাম স্মরণমাত্র ভক্তহৃদয়ে ভক্তির প্রেরণা জাগায় । মীরার জীবনে ভারতবর্ষ দেখেছিল কৃষ্ণের প্রতি গোপীপ্রেমের পুনরাবির্ভাব , যা তার মহান আধ্যাত্মিক ধারাটিতে নব প্রাণ সঞ্চার করেতে সাহায্য করেছিল ।
ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের কন্ঠে , দেবালয়ে , মঠে , আখড়ায় , অসংখ্য পথ - চলতি পান্থনিবাসে , এমনকি চলচ্চিত্রে যদিও মীরার ভজন নিত্যদিন গীত হয়ে চলেছে , তাঁর কোন প্রামাণিক জীবন কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি । অবশ্য অনুসন্ধান কার্য চলছে । এখানে আমরা বিভিন্ন কারণে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এমন একটি জীবনীর অনুসরণ করব ।
১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজস্থানের অন্তর্গত কুড়কী গ্রামে , ক্ষত্রিয় বংশে , রতন সিং - এর কন্যারূপে মীরার জন্ম । রাজস্থানের অবস্থান ভারতবর্ষের মধ্য- পশ্চিম অঞ্চলে । ভারত ইতিহাসের বহু শৌর্য -পূর্ণ কাহিনী রাজস্থানের অধিবাসী বীর রাজপুত রমণীদের কেন্দ্র করে প্রচারিত । ঊষর মরু প্রদেশে যোদ্ধাজাতির মধ্যে মীরার আবির্ভাবে অভিনবত্ব আছে । তিনিও বীর , তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নয় , বীর রমণী তিনি ভক্তিতে , ভগবানের চরণে আত্মনিবেদনে ।
মাত্র তিন বৎসর বয়সে মীরা অধিকার করেছিল তার জীবনের প্রতিমাটিকে , যাকে জগতের কোন শক্তিই তার নিকট হতে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়নি । একদিন এক সাধুভক্ত তাঁর পিত্রালয়ে রাতের অতিথিরূপে আশ্রয় নিয়েছিলেন । তাঁর সঙ্গে ছিল এক শ্রীকৃষ্ণমূর্তি - গিরিধর গোপাল , যাঁকে তিনি নিত্য পূজা করতেন । রন সিং - এর গৃহে থাকাকালে যখন একদিন সাধুটি তাঁর ইষ্টদেবতা গিরিধরের পূজা করছেন , ছোট্ট মীরা উক্ত মূর্তিটির প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব করল এবং তাঁকে একান্ত নিজের করে পেতে চাইল ।
কিন্তু সাধুজী তাঁর উপাস্য দেবতা , যাঁকে দীর্ঘকাল যাবৎ পূজা করে আসছেন , হাতছাড়া করতে রাজি নন । মীরা অনশন করার উপক্রম করল । ছোট শিশুর ভালবাসার প্রচণ্ড দাবি হৃদয় স্পর্শ না করে পারে না । কিন্তু বাবাজীও তাঁর প্রাণের দেবতা ' গিরিধারীলাল ' ছাড়া অপর সব কিছুই দিতে প্রস্তুত । প্রেমের এই দ্বন্বে অবশেষে মীরারই জয় হলো । স্বয়ং ' গিরিধারীলাল ' সাধুজীকে স্বপ্নের মাধ্যমে মীরার কাছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন । সুতরাং অবশেষে ব্যথিত হৃদয়ে তাঁর দেবতাকে শেষবারের মতো নিমেষভাবে দর্শন করে সাধুজী কম্পিত হস্তে ' গিরিধারীলাল ' কে মীরার হাতে তুলে দিলেন । সজল চক্ষে তিনি ভগবানের অবোধ্য লীলার কথা ভাবতে ভাবতে জনারণ্যে অন্তর্হিত হলেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী পাঠকরাও অবগত আছেন ,কেমন করে ঠিক অনুরূপভাবে জটাধারী নামে এক বৈষ্ণব সাধু দক্ষিণেশ্বরে কিছুদিনের জন্য এসে , তাঁর প্রিয় ' রামলালা ' মূর্তিখানি শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট অর্পণ করে চলে গেছিলেন । তখনো জটাধারীকে ' রামলালা ' স্বপ্নে দেখা দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ।
ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে এই রহস্যপূর্ণ ভাব বিনিময়ের অর্থ আমাদের প্রাকৃত জনের বুদ্ধির অগম্য । কিন্তু তাই বলে আমাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধির উপর যেন অধিক আস্থা না রাখি এবং যা বুদ্ধির অগম্য , এমন ঘটনাসমূহ তুচ্ছজ্ঞানে বাতিল না করে দিই । আধ্যাত্মিক অনুভূতির অধিকাংশ ঘটনাই ঘটে যুক্তি - বুদ্ধির সীমানা ছাড়িয়ে । প্রেমের সেই দ্বন্ধযুদ্ধে জয়ী হয়ে মীরা যে কত আনন্দিত হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয় । কিন্তু সেই গিরিধর মূর্তির মীরার বিরহ ও আনন্দের কেন্দ্র হয়ে ওঠার ব্যাপারটি কল্পনা করা আমাদের দুঃসাধ্য ।
শিশুরা স্বভাবতই খুব চতুর । তারা জানে কেমন করে বাবা - মায়ের কাছ হতে ঠোঁট ফুলিয়ে বায়না করে খেলনা আদায় করতে হয় । এক্ষেত্রে মীরা কিন্তু ছিল অস্বাভাবিক রকম জেদী ও আগ্রাসী । সে যা অধিকার করল তা , যেমন শিশুরা আগ্রহ ফুরিয়ে গেলে খেলনা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তেমন করে ত্যাগ করল না ।
এই ঘটনার পর একদিন বাড়ির সামনে দিয়ে যখন এক বিবাহ মিছিল যাচ্ছে , মীরা তার মাকে জিজ্ঞাসা করল , " মা আমার দুল্-হা কোথায় ? '" ' দুল্-হা ' অর্থে বর অথবা প্রেমাস্পদও হয় । শিশুর সরল ছেলেমানুষী দেখে মা হেসে গিরিধারীর মূর্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে মীরাকে বলেছিলেন , " গিরিধারীলাল গোপালই তোমার দুল্-হা । " তিনি যখন একথা বলেছিলেন , তাঁর নিশ্চয় মীরার দেখা সেই স্বপ্নদৃশ্যের কথা মনে পড়েছিল , যা মীরা তাঁকে একদিন বলেছিল । স্বপ্নে মীরা দেখেছিল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার বিবাহ হচ্ছে ।
যাইহোক , মায়ের সেই কথা মীরা যে কত সত্য বলে গ্রহণ করেছিল তা আত্মীয় স্বজনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই প্রকাশ হতে থাকল । অন্তরের ভাষা মীরা তাঁর রচিত ভজনে চিরায়িত করে রেখেছেন ঃ
" মেরে তো গিরিধারী গোপাল দুসরা না কোঈ ।
যাকে শির মোর মুকুট মেরে পতি সোঈ . . . . । "
অর্থাৎ " আমার প্রভু গিরিধারী গোপাল ছাড়া আর তো কেউ নয় ।
যাঁর শিরে ময়ূর মুকট তিনিই যে আমার পতি । "
আটবছর বয়সে মীরা মাকে হারিয়ে তার ' দুদাজী'র কাছে চলে এল । তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত । ঠাকুর্দার কোলে বসে মীরা তন্ময় হয়ে শুনত মহাভারত প্রভৃতি পৌরাণিক কাহিনী । মীরা কিন্তু মনে মনে সর্বদাই জানে গিরিধারী গোপালের সঙ্গেই তার বিবাহ হয়েছে । কিন্তু অপর কেউই সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি । ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন মীরা ১৩ বছরে পা দিল , তার বাবা মেবারের মহারাণা সংগ্রাম সিংহের পুত্র যুবরাজ ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিবাহ দিলেন ।
শ্বশুরালয়ে এসে মীরা নিত্যই তার নতুন আত্মীয় পরিজনদের হতাশ করতে লাগলেন । কুলপ্রথা হিসাবে নববধূকে যখন রাজপরিবারের দেবী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হলো , মীরা জানালেন , তিতি ' গিরিধারী ' কৃষ্ণ ছাড়া অপর কাউকে প্রণাম নিবেদন করবেন না । সদ্যনতুন আত্মীয়দের নিকট মীরার এই অবাধ্যতার অর্থ বোধগম্য হলো না । তিনি কি উন্মাদ অথবা ধর্মাদ্ধ ? রাজপরিবারের নিকট তিনি শ্রদ্ধাহীন ও উদ্ধত বলে প্রতিভাত হলেন ।
মীরার ন্যায় সাধিকার মন সাধারণভাবে কাজ করে না । তিনি এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন যখন , একটি অনাবশ্যক ও অবাস্তব বিবাহ অনুষ্ঠান দ্বারা এক পরম বাস্তবে দিব্য বিবাহ ব্যাপারকে সম্পূর্ণ বাতিল করার প্রয়াস হচ্ছিল , সেই পুরুষের প্রতি কোন অনুরাগ বা তাঁকে প্রয়োজন এমন বোধ তাঁর হচ্ছিল না । তিনি যে ইতিমধ্যেই তাঁর স্বামী , তাঁর সর্বস্ব গিরিধারী গোপালকে তনু - মন - প্রাণ সমর্পণ করে দিয়েছেন । ঠিক এমনই মানসিকতার আবেগে তিনি অপর দেবতার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করাকে দ্বিচারিণীর কর্ম বলে মনে করেছিলেন । যে হৃদয়টিকে একজনের প্রতি নিবেদন করেই দিয়েছেন , তা কেমন করে পুনরায় অপর দেবতার প্রতি নিবেদন করবেন ? তা কি কপটতা নয় ?
মীরার শ্বশুলায়ের কুটুম্বদের আশাভঙ্গের আরো কারণ , তিনি যুবতী কন্যাসুলভ কোন ভোগবাসনায় উৎসাহ প্রকাশ করেননি । রাজপুত সমাজে রজোগুণের বিশেষ সমাদর , সেখানে নারী দৈহিক ও মানসিক ভোগ্যবস্তু বলেই সর্বজনস্বীকৃত । কিন্তু মীরা সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির নারী । বিবাহের পর মীরার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হতো পূজাগৃহে গিরিধরের সেবা - পূজা ও ভজন কীর্তনে । অধিকন্তু তিনি সাধু - ভক্ত - জ্ঞানীদের নিমন্ত্রণ করে ধর্মসভার আসর বসিয়ে নিয়ত তাঁদের সঙ্গে ধর্মচর্চা করতে লাগলেন । বলাবাহুল্য , তাঁর এরূপ জীবনধারার কোনটিই , রাজপরিবারের পছন্দ হলো না ।
মীরাকে আদেশ দেওয়া হলো , তিনি যেন এ সকল ত্যাগ করে রাজপরিবারের ঐতিহ্য মেনে চলেন , কিন্তু তাতে ফল হলো না । তাঁর অন্তরে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা এতই তীব্র , সাধারণ গৃহীসুলভ জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে একান্তই অসম্ভব । সুতরাং তাঁর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো । মীরা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ভজনের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন তাঁর প্রতিক্রিয়া । একটি গানে তিনি গাইছেন , " এ রাজপুরীর সকল পরিজন আমার সাধুসঙ্গ প্রিয়তার কারণে আমাকে দিচ্ছে যন্ত্রণা , আমার পূজায় ঘটাচ্ছে বিঘ্ন । গিরিধর নাগর মীরার সখ্য ও প্রিয়তম , তার সে অনুরাগ তো ঘোচার নয় , তা যে উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে । "
ক্রমশ চলবে...
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মহাসাধিকা মীরাবাঈয়ের জীবন ঈশ্বরের প্রতি সর্বগ্রাসী প্রেমের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । মীরাবাঈয়ের নাম স্মরণমাত্র ভক্তহৃদয়ে ভক্তির প্রেরণা জাগায় । মীরার জীবনে ভারতবর্ষ দেখেছিল কৃষ্ণের প্রতি গোপীপ্রেমের পুনরাবির্ভাব , যা তার মহান আধ্যাত্মিক ধারাটিতে নব প্রাণ সঞ্চার করেতে সাহায্য করেছিল ।
ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষের কন্ঠে , দেবালয়ে , মঠে , আখড়ায় , অসংখ্য পথ - চলতি পান্থনিবাসে , এমনকি চলচ্চিত্রে যদিও মীরার ভজন নিত্যদিন গীত হয়ে চলেছে , তাঁর কোন প্রামাণিক জীবন কিন্তু এখনো পাওয়া যায়নি । অবশ্য অনুসন্ধান কার্য চলছে । এখানে আমরা বিভিন্ন কারণে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় এমন একটি জীবনীর অনুসরণ করব ।
১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজস্থানের অন্তর্গত কুড়কী গ্রামে , ক্ষত্রিয় বংশে , রতন সিং - এর কন্যারূপে মীরার জন্ম । রাজস্থানের অবস্থান ভারতবর্ষের মধ্য- পশ্চিম অঞ্চলে । ভারত ইতিহাসের বহু শৌর্য -পূর্ণ কাহিনী রাজস্থানের অধিবাসী বীর রাজপুত রমণীদের কেন্দ্র করে প্রচারিত । ঊষর মরু প্রদেশে যোদ্ধাজাতির মধ্যে মীরার আবির্ভাবে অভিনবত্ব আছে । তিনিও বীর , তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নয় , বীর রমণী তিনি ভক্তিতে , ভগবানের চরণে আত্মনিবেদনে ।
মাত্র তিন বৎসর বয়সে মীরা অধিকার করেছিল তার জীবনের প্রতিমাটিকে , যাকে জগতের কোন শক্তিই তার নিকট হতে বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়নি । একদিন এক সাধুভক্ত তাঁর পিত্রালয়ে রাতের অতিথিরূপে আশ্রয় নিয়েছিলেন । তাঁর সঙ্গে ছিল এক শ্রীকৃষ্ণমূর্তি - গিরিধর গোপাল , যাঁকে তিনি নিত্য পূজা করতেন । রন সিং - এর গৃহে থাকাকালে যখন একদিন সাধুটি তাঁর ইষ্টদেবতা গিরিধরের পূজা করছেন , ছোট্ট মীরা উক্ত মূর্তিটির প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অনুভব করল এবং তাঁকে একান্ত নিজের করে পেতে চাইল ।
কিন্তু সাধুজী তাঁর উপাস্য দেবতা , যাঁকে দীর্ঘকাল যাবৎ পূজা করে আসছেন , হাতছাড়া করতে রাজি নন । মীরা অনশন করার উপক্রম করল । ছোট শিশুর ভালবাসার প্রচণ্ড দাবি হৃদয় স্পর্শ না করে পারে না । কিন্তু বাবাজীও তাঁর প্রাণের দেবতা ' গিরিধারীলাল ' ছাড়া অপর সব কিছুই দিতে প্রস্তুত । প্রেমের এই দ্বন্বে অবশেষে মীরারই জয় হলো । স্বয়ং ' গিরিধারীলাল ' সাধুজীকে স্বপ্নের মাধ্যমে মীরার কাছে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন । সুতরাং অবশেষে ব্যথিত হৃদয়ে তাঁর দেবতাকে শেষবারের মতো নিমেষভাবে দর্শন করে সাধুজী কম্পিত হস্তে ' গিরিধারীলাল ' কে মীরার হাতে তুলে দিলেন । সজল চক্ষে তিনি ভগবানের অবোধ্য লীলার কথা ভাবতে ভাবতে জনারণ্যে অন্তর্হিত হলেন ।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী পাঠকরাও অবগত আছেন ,কেমন করে ঠিক অনুরূপভাবে জটাধারী নামে এক বৈষ্ণব সাধু দক্ষিণেশ্বরে কিছুদিনের জন্য এসে , তাঁর প্রিয় ' রামলালা ' মূর্তিখানি শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট অর্পণ করে চলে গেছিলেন । তখনো জটাধারীকে ' রামলালা ' স্বপ্নে দেখা দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের নিকট থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ।
ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে এই রহস্যপূর্ণ ভাব বিনিময়ের অর্থ আমাদের প্রাকৃত জনের বুদ্ধির অগম্য । কিন্তু তাই বলে আমাদের ক্ষুদ্রবুদ্ধির উপর যেন অধিক আস্থা না রাখি এবং যা বুদ্ধির অগম্য , এমন ঘটনাসমূহ তুচ্ছজ্ঞানে বাতিল না করে দিই । আধ্যাত্মিক অনুভূতির অধিকাংশ ঘটনাই ঘটে যুক্তি - বুদ্ধির সীমানা ছাড়িয়ে । প্রেমের সেই দ্বন্ধযুদ্ধে জয়ী হয়ে মীরা যে কত আনন্দিত হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয় । কিন্তু সেই গিরিধর মূর্তির মীরার বিরহ ও আনন্দের কেন্দ্র হয়ে ওঠার ব্যাপারটি কল্পনা করা আমাদের দুঃসাধ্য ।
শিশুরা স্বভাবতই খুব চতুর । তারা জানে কেমন করে বাবা - মায়ের কাছ হতে ঠোঁট ফুলিয়ে বায়না করে খেলনা আদায় করতে হয় । এক্ষেত্রে মীরা কিন্তু ছিল অস্বাভাবিক রকম জেদী ও আগ্রাসী । সে যা অধিকার করল তা , যেমন শিশুরা আগ্রহ ফুরিয়ে গেলে খেলনা ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তেমন করে ত্যাগ করল না ।
এই ঘটনার পর একদিন বাড়ির সামনে দিয়ে যখন এক বিবাহ মিছিল যাচ্ছে , মীরা তার মাকে জিজ্ঞাসা করল , " মা আমার দুল্-হা কোথায় ? '" ' দুল্-হা ' অর্থে বর অথবা প্রেমাস্পদও হয় । শিশুর সরল ছেলেমানুষী দেখে মা হেসে গিরিধারীর মূর্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে মীরাকে বলেছিলেন , " গিরিধারীলাল গোপালই তোমার দুল্-হা । " তিনি যখন একথা বলেছিলেন , তাঁর নিশ্চয় মীরার দেখা সেই স্বপ্নদৃশ্যের কথা মনে পড়েছিল , যা মীরা তাঁকে একদিন বলেছিল । স্বপ্নে মীরা দেখেছিল শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তার বিবাহ হচ্ছে ।
যাইহোক , মায়ের সেই কথা মীরা যে কত সত্য বলে গ্রহণ করেছিল তা আত্মীয় স্বজনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই প্রকাশ হতে থাকল । অন্তরের ভাষা মীরা তাঁর রচিত ভজনে চিরায়িত করে রেখেছেন ঃ
" মেরে তো গিরিধারী গোপাল দুসরা না কোঈ ।
যাকে শির মোর মুকুট মেরে পতি সোঈ . . . . । "
অর্থাৎ " আমার প্রভু গিরিধারী গোপাল ছাড়া আর তো কেউ নয় ।
যাঁর শিরে ময়ূর মুকট তিনিই যে আমার পতি । "
আটবছর বয়সে মীরা মাকে হারিয়ে তার ' দুদাজী'র কাছে চলে এল । তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব ভক্ত । ঠাকুর্দার কোলে বসে মীরা তন্ময় হয়ে শুনত মহাভারত প্রভৃতি পৌরাণিক কাহিনী । মীরা কিন্তু মনে মনে সর্বদাই জানে গিরিধারী গোপালের সঙ্গেই তার বিবাহ হয়েছে । কিন্তু অপর কেউই সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়নি । ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দে যখন মীরা ১৩ বছরে পা দিল , তার বাবা মেবারের মহারাণা সংগ্রাম সিংহের পুত্র যুবরাজ ভোজরাজের সঙ্গে মীরার বিবাহ দিলেন ।
শ্বশুরালয়ে এসে মীরা নিত্যই তার নতুন আত্মীয় পরিজনদের হতাশ করতে লাগলেন । কুলপ্রথা হিসাবে নববধূকে যখন রাজপরিবারের দেবী মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হলো , মীরা জানালেন , তিতি ' গিরিধারী ' কৃষ্ণ ছাড়া অপর কাউকে প্রণাম নিবেদন করবেন না । সদ্যনতুন আত্মীয়দের নিকট মীরার এই অবাধ্যতার অর্থ বোধগম্য হলো না । তিনি কি উন্মাদ অথবা ধর্মাদ্ধ ? রাজপরিবারের নিকট তিনি শ্রদ্ধাহীন ও উদ্ধত বলে প্রতিভাত হলেন ।
মীরার ন্যায় সাধিকার মন সাধারণভাবে কাজ করে না । তিনি এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন যখন , একটি অনাবশ্যক ও অবাস্তব বিবাহ অনুষ্ঠান দ্বারা এক পরম বাস্তবে দিব্য বিবাহ ব্যাপারকে সম্পূর্ণ বাতিল করার প্রয়াস হচ্ছিল , সেই পুরুষের প্রতি কোন অনুরাগ বা তাঁকে প্রয়োজন এমন বোধ তাঁর হচ্ছিল না । তিনি যে ইতিমধ্যেই তাঁর স্বামী , তাঁর সর্বস্ব গিরিধারী গোপালকে তনু - মন - প্রাণ সমর্পণ করে দিয়েছেন । ঠিক এমনই মানসিকতার আবেগে তিনি অপর দেবতার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করাকে দ্বিচারিণীর কর্ম বলে মনে করেছিলেন । যে হৃদয়টিকে একজনের প্রতি নিবেদন করেই দিয়েছেন , তা কেমন করে পুনরায় অপর দেবতার প্রতি নিবেদন করবেন ? তা কি কপটতা নয় ?
মীরার শ্বশুলায়ের কুটুম্বদের আশাভঙ্গের আরো কারণ , তিনি যুবতী কন্যাসুলভ কোন ভোগবাসনায় উৎসাহ প্রকাশ করেননি । রাজপুত সমাজে রজোগুণের বিশেষ সমাদর , সেখানে নারী দৈহিক ও মানসিক ভোগ্যবস্তু বলেই সর্বজনস্বীকৃত । কিন্তু মীরা সম্পূর্ণ অন্য প্রকৃতির নারী । বিবাহের পর মীরার অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হতো পূজাগৃহে গিরিধরের সেবা - পূজা ও ভজন কীর্তনে । অধিকন্তু তিনি সাধু - ভক্ত - জ্ঞানীদের নিমন্ত্রণ করে ধর্মসভার আসর বসিয়ে নিয়ত তাঁদের সঙ্গে ধর্মচর্চা করতে লাগলেন । বলাবাহুল্য , তাঁর এরূপ জীবনধারার কোনটিই , রাজপরিবারের পছন্দ হলো না ।
মীরাকে আদেশ দেওয়া হলো , তিনি যেন এ সকল ত্যাগ করে রাজপরিবারের ঐতিহ্য মেনে চলেন , কিন্তু তাতে ফল হলো না । তাঁর অন্তরে আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা এতই তীব্র , সাধারণ গৃহীসুলভ জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে একান্তই অসম্ভব । সুতরাং তাঁর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো । মীরা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ভজনের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন তাঁর প্রতিক্রিয়া । একটি গানে তিনি গাইছেন , " এ রাজপুরীর সকল পরিজন আমার সাধুসঙ্গ প্রিয়তার কারণে আমাকে দিচ্ছে যন্ত্রণা , আমার পূজায় ঘটাচ্ছে বিঘ্ন । গিরিধর নাগর মীরার সখ্য ও প্রিয়তম , তার সে অনুরাগ তো ঘোচার নয় , তা যে উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে । "
ক্রমশ চলবে...
COurtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন