এখনও ভগবানের অবতরণের সময় হয় নি । কারণ শাস্ত্রে , কলিযুগে যেরূপ অধঃপতনের কথা বলা হয়েছে , তার থেকেও বেশি অধঃপতন যদি হয় তবেই ভগবান অবতার-দেহ ধারণ করবেন । এখনও সেই সময় হয় নি । ত্রেতাযুগে রাক্ষসেরা ঋষি-মুনিদের মেরে খেয়ে হাড়ের পাহাড় তৈরী করেছিল , তবেই ভগবান অবতরণ করেছিলেন ।
বর্তমান কলিযুগে দেখা যায় যে , সেইরূপ অত্যাচার-অনাচার এখনও হয় নি । ধর্ম যদিও সামান্য মাত্রায় হ্রাস পায় , তখন ভগবান আধিকারিক পুরুষদের পাঠিয়ে তা ঠিকমতো চালাবার ব্যবস্থা করেন অথবা স্থানে স্থানে সাধু- মহাত্ম্য প্রকটিত হয়ে তাঁদের আচরণ এবং ভাষণ দ্বারা মানুষকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন ।
একভাবে দেখতে গেলে ভগবানের অবতার নিত্য । এই জগৎ-সংসার ভগবানেরই অবতার-রূপ । সাধকগণের কাছে সাধ্য এবং সাধনরূপেই ভগবান অবর্তীণ । ভক্তদের জন্য ভক্তিরূপে , জ্ঞানযোগীদের কাছে জ্ঞেয়রূপে , কর্মযোগীগণের কাছে কর্তব্যরূপে ভগবানই অবতার । ক্ষুধিতের কাছে অন্নরূপে , পিপাসার্তদের কাছে জলরূপে , বস্ত্রহীনদের কাছে বস্ত্ররূপে এবং রোগীদের কাছে ঔষধরূপে তাঁরই অবতাররূপ ।
ভোগীদের কাছে ভোগরূপে , লোভীদের কাছে অর্থ , বস্তু ইত্যাদি রূপেই তিনি অবতীর্ণ । গরমে শীতল ছায়া , শীতে উষ্ণ বস্ত্র ভগবানের অবতার রূপ । এর তাৎপর্য এই যে , জড় -চেতন , স্থাবর -জঙ্গম ইত্যাদি সকল রূপই তাঁর অবতার রূপ , কেননা বাস্তবে তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই - ' বাসুদেব সর্বম্ ' ( ৭\১৯ ) , ' সদসচ্চাহম্ ' ( ৯\১৯ ) । কিন্তু যে ব্যক্তি জগৎ-সংসার রূপে প্রকটিত প্রভুকে ভোগ্য মনে করে নিজেকে তার অধিকারী ভাবে , তার পতন হয় এবং সে জন্ম- মরণ চক্রে আবর্তিত হতে থাকে ।
যাঁরা মনে করেন ভগবান শুধুই নিরাকার , সাকার হন না , তাঁদের সে ধারণা একেবারেই ভুল । কেননা প্রাণিমাত্রই অব্যক্ত ( নিরাকার ) এবং ব্যক্ত ( সাকার ) হয়ে থাকে । এর অর্থ এই যে সমস্ত প্রাণী প্রথমে অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত ) , মাঝে ব্যক্ত ( প্রকাশিত ) , এবং শেষে আবার অব্যক্ত ( অপ্রকাশিত ) হয়ে যায় ( ২\২৮ ) । পৃথিবীরও দুই রূপ নিরাকার এবং সাকার ।
পৃথিবী তন্মাত্ররূপে নিরাকার এবং স্থূলরূপে সাকার হয়ে আছে । জল পরমাণুরূপে নিরাকার এবং মেঘ , বৃষ্টি , শিলারূপে সাকার হয়ে আছে । বায়ু নিষ্পন্দরূপে নিরাকার , স্পন্দনরূপে সাকার । দিয়াশলাই , কাঠ , পাথর ইত্যাদি আগুন নিরাকাররূপে অবস্থিত এবং ঘর্ষণ ইত্যাদি সাধন দ্বারা সাকার রূপ ধারণ করে । এইরূপে সৃষ্টিমাত্রই নিরাকার এবং সাকার হতে থাকে ।
প্রলয় এবং মহাপ্রলয় কালে সৃষ্টি নিরাকার থাকে এবং কল্প ও মহাকল্পের সময়ে সাকার রূপ ধারণ করে । যদি প্রাণিকুল নিরাকার ও সাকার হতে পারে , পৃথিবী , জল ইত্যাদি মহাভূত নিরাকার ও সাকার হতে পারে , সৃষ্টিও নিরাকার - সাকার হতে পারে , তাহলে ভগবান কি নিরাকার ও সাকার হতে পারে না ? তাঁর নিরাকার ও সাকার হওয়াতে কিসের বাধা ?
এইজন্য ভগবান গীতায় বলেছেন , ' সমস্ত জগৎ আমার অব্যক্ত স্বরূপে ব্যাপ্ত হয়ে আছে ' - ' ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা ' ( ৯\৪ ) । এখানে ভগবান নিজেকে ' ময়া ' পদ দ্বারা ব্যক্ত বা সাকার এবং ' অব্যক্তমূর্তিনা ' বাক্য দ্বারা অব্যক্ত বা নিরাকার বলে জানিয়েছেন ।
সপ্তম অধ্যায়ের চতুর্বিংশ শ্লোকে ভগবান বলেছেন , ' যারা আমাকে অব্যক্ত বা নিরাকার বলেই শুধু মানে , ব্যক্ত বা সাকার বলে নয় , তারা বুদ্ধিহীন আর যারা ব্যক্ত বা সাকার বলে মনে করে , অব্যক্ত বা নিরাকার বলে নয় , তারাও বুুদ্ধিহীন । কেননা এই দুই পক্ষই আমার পরম ভাবকে জানে না । 'ভগবান হচ্ছেন সাকার নিরাকার উভয়ই । যিনি পূর্ণরূপে এই তত্ত্ব জানেন তিনি প্রকৃত জ্ঞানী ।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
1 Comments:
ভগবান নিরাকার বা অব্যক্ত এটা গীতার কোথাও বলা হয়নি ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন