ঊদাবাঈ - এর পরিবর্তন
বিক্রমজিৎ রাণা ছিলেন কঠোর প্রকৃতির ও স্থূল অনুভূতিসম্পন্ন মানষু । তিনি স্থির করলেন অবাধ্য মীরার প্রতি কড়া নজর রাখা প্রয়োজন , এবং সে কাজে অপর কাউকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় আপন ভগিনী ঊদাবাঈকে নিযুক্ত করলেন । তাছাড়াও আরো তিন নীরা প্রহরী সর্বক্ষণ পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হলো । ঊদাবাঈ মীরার মন পরিবর্তনের জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট হলেন ।
ঊদাবাঈ - এর সঙ্গে মীরার কথোপকথনের এক চমকপ্রদ বিবরণ লোকমুখে প্রচলিত আছে , যাতে মীরার অপার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্ভীক চরিত্রের কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ।
ঊদা = মীরা তুমি সাধুসঙ্গ ত্যাগ কর । রাজ্যময় তোমার নামে হাজারো নিন্দা।
মীরা = তাতে আমার কি ? ওদের নিন্দা রটাতে দাও । আমি সাধুদের ভক্ত ।
ঊদা = তুমি মুক্তোর মালা গলায় দাও না , বহুমূল্য অলঙ্কার সে সবও ব্যবহার কর না , কেন ?
মীরা = সে সব ভাই , আমি বিদায় করেছি । সৎ চিন্তা ও সন্তোষই আমার ভূষণ ।
ঊদা = অন্য সবখানে কত রঙচঙে শোভাযাত্রা , নারী - পুরুষের কত জমাট মজলিশ , আর তোমার এখানে যত সাধু - ভক্তের মেলা ।
মীরা = দেখ দেখ , বাড়ির ছাদে উঠে , সাধুর শোভা ! কি চমৎকার না দেখাচ্ছে !
ঊদা = চিতোরের সকল মানুষ আজ তোমার জন্য লজ্জিত । মহারাণার মাথা লজ্জায় হেঁট !
মীরা = চিতোর আজ মুক্ত হয়েছে , আর রাণার পথও মুক্ত ।
ঊদা = তোমার মা - বাবা তোমার আচরণে লজ্জিত , তোমার জন্মস্থানও কলঙ্কিত ।
মীরা = ধন্য আমার মা - বাবা । ধন্য আমার জন্মভূমি ।
ঊদা = রাণা তোমার উপর ক্ষুব্ধ । তোমার জন্য তিনি রত্নখচিত পাত্রে বিষ তৈরি রেখেছেন ।
মীরা = বেশ তো বোন , আমি তা প্রভুর চরণামৃত বলে পান করব ।
ঊদা = যে সে বিষ নয় তা । অতি ভয়ানক , তা দেখা মাত্রই তুুমি মারা পড়বে ।
মীরাঃ = এ জগতে আমার তো কেউ নেই । মা বসুন্ধরা কোল পেতে আমায় গ্রহণ করবেন ।
ঊদা = রাণাজী জানতে চান , সতি করে বল তো তোমার পথ কি ?
মীরা = ক্ষুধের ধার আমার পথ । মহারাণার সাধ্য কি সেখানে পৌঁছান ?
ঊদা = রাণার অবাধ্য হয়ো না , মীরা । তাঁর কথা শোন । তিনি ক্রুদ্ধ হলে জগতে আর কোথাও তোমার স্থান নেই জেনো ।
মীরা = গিরিধারীলাল আমার আশ্রয় , ঊদা । কায় - মনো - বাক্যে আমি তাঁরই শরণাগত ।
কিন্তু ঊদাবাঈয়ের সকল চেষ্টা মীনাবাঈয়ের মনের পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হলো । মীরা তাঁর নিজের জগতে বিচরণ করতে থাকলেন , ইহজগতের ভয় , প্রলোভন কোন কিছুই তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো না ।
অবশ্য পরিবর্তন ঘটেছিল তবে তা মীরার নয় ঊদাবাঈয়ের । স্পর্শমণির ছোঁয়ায় লোহা সোনায় রূপান্তরিত হলো । ঊদার উপর বিক্রমজিতের ভরসা ছিল যথেষ্ট , কারণ তাঁর ধারণা সে তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত । কিন্তু সাধুসঙ্গ অতি বিস্ফোরক বস্তু । একদিন জগৎ ভুলে , একমাত্র তাঁর দয়িতের চিন্তায় মগ্ন হয়ে , ভাবে বিভোর মীরা গাইছিলেন ঃ
ত্যাজেছি সকল লজ্জা , সখি , ত্যাজেছি কুল - মান
যবে পেয়েছি আমার শ্যাম ।
ভুলেছি সকল সুখ
আমার টুটুছে বন্ধন ভয় ।
আহা ! কি বা শোভা তাঁর শিরে শিখী - পাখা
ললাটে তিলকরেখা ,
ত্রিভুবনে কে বা পারে ভুলিতে
ঐ ভুবন মোহন সাজ ?
চিকন যুগল গণ্ডে তাঁর কর্ণকুণ্ডল ছায়া
সুনীল সায়রে সঞ্চরে যথা
ক্রীড়াচঞ্চল মীন ,
বঙ্কিম ভ্রূ , চপল নয়ন --
লজ্জা পায় খঞ্জনার রূপ অভিমান ।
সুচারু তাঁর তীক্ষ্ম নাসা , নয়ন ভুলানো বেশ
রক্তগোলাপ ওষ্ঠে শোভে মধুর হাস্য রেস ।
সুষ্ঠু শোভন দন্তে বিছুরে
শুভ্র আলোক রাশি ,
বিজলী চমকে আভরণে তাঁর
আলোর পরশ লাগি ।
তনু - মন - প্রাণ মীরা করিয়াছে দান
ঐ অপরূপ রূপ হেরি !
মীরার হৃদয় - উৎসারিত সেই গানের মাধুর্য ঊদাবাঈয়ের প্রাণে ঘটাতে থাকে প্রবল বিক্রিয়া , তার অন্তর্জগতে ঘটে পরিবর্তন ,মীরার পদতলে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করে তাঁর শিষ্যত্ব । ঊদার পক্ষে অতঃপর শুরু হলো ভিন্ন প্রকার রাত্রি জাগরণ । তার যে পরিবর্তন ঘটেছিল তা ছিল তাৎক্ষণিক । এখন সে গিরিধরের সাক্ষাৎ দর্শনলাভের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা বোধ করতে থাকল এবং যাতে তিনি দর্শন দেন তার জন্য মীরার নিকট কাতর প্রার্থনা করল ।
মীরা স্বভাবতই ছিলেন উদার প্রকৃতির । ঊদার ব্যাকুলতা তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করল এবং তিনি ঊদাবাঈয়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য গিরিধরের নিকট আকুল প্রার্থনা জানালেন । তখন মধ্যরাত্রি । ঊদা ও তার অপর তিন সঙ্গিনী - মিথুলা , চম্পা , চামেলী মন্দিরে বসে আসে । মীরা তাঁর মধুর কিন্নরী কন্ঠে একের পর এক ভজন গেয়ে চলছেন । হঠাৎ সকলের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে স্বয়ং গিরিধারীলালের দিব্য আবির্ভাব । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , " মীরা , আজ রাতে তুমি কেন এত যন্ত্রণা কাতর ? " সাধুসঙ্গে এমন করেই অসম্ভবও সম্ভব হয় । এর ফলে কেবলমাত্র ঊদাই নয় , অপর তিনজন যারা আদৌ বিশেষ আগ্রহী ছিল না , তাদেরও ঈশ্বন দর্শন হলো ।
ক্রমশ চলবে ...
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
বিক্রমজিৎ রাণা ছিলেন কঠোর প্রকৃতির ও স্থূল অনুভূতিসম্পন্ন মানষু । তিনি স্থির করলেন অবাধ্য মীরার প্রতি কড়া নজর রাখা প্রয়োজন , এবং সে কাজে অপর কাউকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না হওয়ায় আপন ভগিনী ঊদাবাঈকে নিযুক্ত করলেন । তাছাড়াও আরো তিন নীরা প্রহরী সর্বক্ষণ পাহারা দেওয়ার জন্য মোতায়েন করা হলো । ঊদাবাঈ মীরার মন পরিবর্তনের জন্য সর্বতোভাবে সচেষ্ট হলেন ।
ঊদাবাঈ - এর সঙ্গে মীরার কথোপকথনের এক চমকপ্রদ বিবরণ লোকমুখে প্রচলিত আছে , যাতে মীরার অপার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্ভীক চরিত্রের কিছু পরিচয় পাওয়া যায় ।
ঊদা = মীরা তুমি সাধুসঙ্গ ত্যাগ কর । রাজ্যময় তোমার নামে হাজারো নিন্দা।
মীরা = তাতে আমার কি ? ওদের নিন্দা রটাতে দাও । আমি সাধুদের ভক্ত ।
ঊদা = তুমি মুক্তোর মালা গলায় দাও না , বহুমূল্য অলঙ্কার সে সবও ব্যবহার কর না , কেন ?
মীরা = সে সব ভাই , আমি বিদায় করেছি । সৎ চিন্তা ও সন্তোষই আমার ভূষণ ।
ঊদা = অন্য সবখানে কত রঙচঙে শোভাযাত্রা , নারী - পুরুষের কত জমাট মজলিশ , আর তোমার এখানে যত সাধু - ভক্তের মেলা ।
মীরা = দেখ দেখ , বাড়ির ছাদে উঠে , সাধুর শোভা ! কি চমৎকার না দেখাচ্ছে !
ঊদা = চিতোরের সকল মানুষ আজ তোমার জন্য লজ্জিত । মহারাণার মাথা লজ্জায় হেঁট !
মীরা = চিতোর আজ মুক্ত হয়েছে , আর রাণার পথও মুক্ত ।
ঊদা = তোমার মা - বাবা তোমার আচরণে লজ্জিত , তোমার জন্মস্থানও কলঙ্কিত ।
মীরা = ধন্য আমার মা - বাবা । ধন্য আমার জন্মভূমি ।
ঊদা = রাণা তোমার উপর ক্ষুব্ধ । তোমার জন্য তিনি রত্নখচিত পাত্রে বিষ তৈরি রেখেছেন ।
মীরা = বেশ তো বোন , আমি তা প্রভুর চরণামৃত বলে পান করব ।
ঊদা = যে সে বিষ নয় তা । অতি ভয়ানক , তা দেখা মাত্রই তুুমি মারা পড়বে ।
মীরাঃ = এ জগতে আমার তো কেউ নেই । মা বসুন্ধরা কোল পেতে আমায় গ্রহণ করবেন ।
ঊদা = রাণাজী জানতে চান , সতি করে বল তো তোমার পথ কি ?
মীরা = ক্ষুধের ধার আমার পথ । মহারাণার সাধ্য কি সেখানে পৌঁছান ?
ঊদা = রাণার অবাধ্য হয়ো না , মীরা । তাঁর কথা শোন । তিনি ক্রুদ্ধ হলে জগতে আর কোথাও তোমার স্থান নেই জেনো ।
মীরা = গিরিধারীলাল আমার আশ্রয় , ঊদা । কায় - মনো - বাক্যে আমি তাঁরই শরণাগত ।
কিন্তু ঊদাবাঈয়ের সকল চেষ্টা মীনাবাঈয়ের মনের পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হলো । মীরা তাঁর নিজের জগতে বিচরণ করতে থাকলেন , ইহজগতের ভয় , প্রলোভন কোন কিছুই তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলো না ।
অবশ্য পরিবর্তন ঘটেছিল তবে তা মীরার নয় ঊদাবাঈয়ের । স্পর্শমণির ছোঁয়ায় লোহা সোনায় রূপান্তরিত হলো । ঊদার উপর বিক্রমজিতের ভরসা ছিল যথেষ্ট , কারণ তাঁর ধারণা সে তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত । কিন্তু সাধুসঙ্গ অতি বিস্ফোরক বস্তু । একদিন জগৎ ভুলে , একমাত্র তাঁর দয়িতের চিন্তায় মগ্ন হয়ে , ভাবে বিভোর মীরা গাইছিলেন ঃ
ত্যাজেছি সকল লজ্জা , সখি , ত্যাজেছি কুল - মান
যবে পেয়েছি আমার শ্যাম ।
ভুলেছি সকল সুখ
আমার টুটুছে বন্ধন ভয় ।
আহা ! কি বা শোভা তাঁর শিরে শিখী - পাখা
ললাটে তিলকরেখা ,
ত্রিভুবনে কে বা পারে ভুলিতে
ঐ ভুবন মোহন সাজ ?
চিকন যুগল গণ্ডে তাঁর কর্ণকুণ্ডল ছায়া
সুনীল সায়রে সঞ্চরে যথা
ক্রীড়াচঞ্চল মীন ,
বঙ্কিম ভ্রূ , চপল নয়ন --
লজ্জা পায় খঞ্জনার রূপ অভিমান ।
সুচারু তাঁর তীক্ষ্ম নাসা , নয়ন ভুলানো বেশ
রক্তগোলাপ ওষ্ঠে শোভে মধুর হাস্য রেস ।
সুষ্ঠু শোভন দন্তে বিছুরে
শুভ্র আলোক রাশি ,
বিজলী চমকে আভরণে তাঁর
আলোর পরশ লাগি ।
তনু - মন - প্রাণ মীরা করিয়াছে দান
ঐ অপরূপ রূপ হেরি !
মীরার হৃদয় - উৎসারিত সেই গানের মাধুর্য ঊদাবাঈয়ের প্রাণে ঘটাতে থাকে প্রবল বিক্রিয়া , তার অন্তর্জগতে ঘটে পরিবর্তন ,মীরার পদতলে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করে তাঁর শিষ্যত্ব । ঊদার পক্ষে অতঃপর শুরু হলো ভিন্ন প্রকার রাত্রি জাগরণ । তার যে পরিবর্তন ঘটেছিল তা ছিল তাৎক্ষণিক । এখন সে গিরিধরের সাক্ষাৎ দর্শনলাভের জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা বোধ করতে থাকল এবং যাতে তিনি দর্শন দেন তার জন্য মীরার নিকট কাতর প্রার্থনা করল ।
মীরা স্বভাবতই ছিলেন উদার প্রকৃতির । ঊদার ব্যাকুলতা তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করল এবং তিনি ঊদাবাঈয়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্য গিরিধরের নিকট আকুল প্রার্থনা জানালেন । তখন মধ্যরাত্রি । ঊদা ও তার অপর তিন সঙ্গিনী - মিথুলা , চম্পা , চামেলী মন্দিরে বসে আসে । মীরা তাঁর মধুর কিন্নরী কন্ঠে একের পর এক ভজন গেয়ে চলছেন । হঠাৎ সকলের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে স্বয়ং গিরিধারীলালের দিব্য আবির্ভাব । তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , " মীরা , আজ রাতে তুমি কেন এত যন্ত্রণা কাতর ? " সাধুসঙ্গে এমন করেই অসম্ভবও সম্ভব হয় । এর ফলে কেবলমাত্র ঊদাই নয় , অপর তিনজন যারা আদৌ বিশেষ আগ্রহী ছিল না , তাদেরও ঈশ্বন দর্শন হলো ।
ক্রমশ চলবে ...
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন