অনিকেত তীর্থযাত্রী
মীরা এখন গৃহহারা । কিন্তু তাই বলে তিনি নিঃসঙ্গ নন । তাঁর ভক্তি জারিত ভজনের দুর্বার আকর্ষণে , যেখানেই তিনি যান জনতা অনুসরণ করে তাঁকে । তাঁর দিব্য পবিত্র সৌন্দর্য , রাজকীয় মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব , অগাধ ভক্তি , নির্ভীকতা ,পরিপূর্ণ শরণাগতি এবং সর্বোপরি তাঁর হৃদয়মথিত সঙ্গীত , এমনকি ভারতবর্ষেও এক অভূতপূর্ব ব্যাপার ।
ভারতবর্ষের মতো দেশ , যেখানে অগণিত সাধুর জন্ম সেখানেও মীরা অনন্যা । ভগবানের প্রতি সেরূপ নিষ্কাম প্রেম , অতুলনীয় ত্যাগ ও সকলই প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত বহু দেখা গেছে ; কিন্তু সঙ্গীতকে অবলম্বন করে ঐশী প্রেমের যে প্রবল আবেগ মীরার মধ্যে দেখা গেছে , তা বহু মরমীয়া সঙ্গীতজ্ঞ সাধকের মধ্যেও তাঁকে অতুলনীয়া করে রেখেছে এবং আধ্যাত্মিক রস পিপাসুদের কাছে তাঁর নাম আজো অনুপ্রেরণা জাগাতে সাহায্যে করে ।
পরম প্রেমাস্পদের পদতলে একান্তে নিভৃতে আত্মনিবেদন করে এমন আরো কত গান যে মীরা রচনা করেছিলেন তার হিসাব কে রাখে ! আমরা মোটামুটি তাঁর রচিত প্রচলিত পাঁচশত গানের কথাই জানি । সেগুলি আধ্যাত্মিক জগতের অমূল্য সম্পদ । সে সকল ভক্তি রসাশ্রিত ভজন শুনলে অথবা গাইলে মীরার ঈশ্বর প্রেমের আবেগটুকু হৃদয়কে আলোড়িত না করে পারে না ।
পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে সর্বত্র ভক্তি প্রেমের মহা প্লাবন সৃষ্টি করে মীরা অবশেষে এসে পৌঁছালেন বৈষ্ণবদের মহাতীর্থ বৃন্দাবনে । এই বৃন্দাবনের কুঞ্জে কুঞ্জে চিম্ময়দেহে কৃষ্ণ কত লীলা করেছেন গোপীদের সাথে । গোপীরা ছিলেন কৃষ্ণের একনিষ্ট ভক্ত । কৃষ্ণকে তাঁরা মধুরভাবে উপাসনা করেছিলেন । মীরার ভাবও সেই তেমনটিই । কারো বা মতে , পূর্ব - পূর্ব জন্মে মীরা স্বয়ং বৃন্দাবনের গোপী ছিলেন । সুতরাং যে ব্রজভূমে মীরার আনন্দের কারণ সহজেই অনুমেয় ।
অবশ্য তা নিরবচ্ছিন্ন সুখকর কখনই ছিল না । অনুক্ষণ কৃষ্ণচিন্তা ও তাঁর অবাধ দর্শন কামনায় মীরার হৃদয় যন্ত্রণা ছিল অবর্ণনীয় । বিরহ যাতনায় বাহ্য চৈতন্য লুপ্ত হয়ে মুহুর্মুহু ভাব - সমাধি ঘটত তাঁর । মীরার যে অসাধারণ ভক্তি - প্রেমের পরিচয় পেয়ে ভক্তের দল তাঁর নিকট উপস্থিত হতে লাগল এবং দৈবী প্রেম আস্বাদনের জন্য তাঁর সঙ্গে ভজনে যোগ দিতে থাকল । ফলে সর্বত্রই মীরার অবস্থান ক্ষেত্র সাধারণের উৎসব ক্ষেত্রে পরিণত হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের বেদনার কারণও হলো ।
কিন্তু এতৎসত্ত্বেও মীরা কখনো সাধুসঙ্গের সুযোগ কিঞ্চিন্মাত্রও হারাননি । বৃন্দাবনে সেই সময়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর মহাভক্ত শ্রীরূপ গোস্বামী সাধনভজন করছিলেন । মীরা তাঁর দর্শন অভিলাষী হলেন । কিন্তু সেই অতি আচারী , পরম বৈষ্ণব তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃত হলেন , যেহেতু সাক্ষাৎ প্রার্থী একজন নারী । প্রত্যাখ্যাত হয়ে মীরা রূপ গোস্বামীকে একটি লিপি পাঠালেন , যা পড়ে তাঁর চৈতন্যোদয় ঘটেছিল ।
মীরা লিখেছিলেন , " অতি আশ্চর্য , মহাত্মাজী এখনো লিঙ্গভেদ ত্যাগ করতে পারেননি ! অধিকন্তু , পবিত্র বৃন্দাবনে , আমার ধারণা , কৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ , বাকি সবাই প্রকৃতি । গোস্বামীজী নিজেকে যদি গোপী জ্ঞান না করে কৃষ্ণই ভেবে থাকেন , তবে তাঁর এ ব্রজভূমি যেখানে কৃষ্ণ লীলা করেছিলেন , তা ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয় । "
গোস্বামীজী তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করেছিলেন , তিনি উন্নততর ও গভীরতর আধ্যাত্মিক অনুভূতিসম্পন্ন এক ব্যাক্তিত্বের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন । অনতিবিলম্বেই তিনি মীরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন এবং মীরাও সাধুর প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন ।
এখানে কিছু ব্যাখ্যার প্রয়োজন । মীরা কি অর্থে বলেছিলেন , কৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ , অপর সকলেই প্রকৃতি ? সংক্ষেপে তার অর্থ - সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরই হলেন একমাত্র কর্তা , কর্ম ও কারণ এবং তাঁর সৃষ্ট জীব , অর্থাৎ দেহধারী আত্মা হলো ভাবগ্রাহী , প্রতিবেদনশীল এক সত্তামাত্র । সকল শক্তির উত্তর উৎস হলেন ঈশ্বর এবং জীব সেই শক্তির ধারক ও প্রকাশক । এই অর্থে সাধক ঈশ্বরকে দেখেন একমাত্র পুরুষতত্ত্বরূপে এবং অপর সকল জীবকে - নারী - পুরুষকে নির্বিশেষে - প্রকৃতিরূপে ।
বৃন্দাবনের কুঞ্জে , শ্রীকৃষ্ণের লীলাভূমিতে , পরিক্রমাকালে মীরা রচনা করেছিলেন তাঁর সেই অপূর্ব হৃদয়স্পর্শী গানটি --
তোমার ফুলবাগানের চাকর রাখ ওগো গিরিধারীলাল
মালিনী সেজে করব সেবা নিত্য দিবস - কাল ।
সেবার বেতন তব দরশন
আর কিছু না চা'ব
কুঞ্জবনে তোমার লীলা
সেই গুণগান গা'ব ।
তোমার মূরতি করিব আরতি
স্মরিব তব নাম
ভক্তিভাব পরম লাভ
দাসীর মনস্কাম ।
মযূরকন্ঠী মুকুট শিরে
বিজলী সম বেশ
গলে দোলে তাঁর কুসুম মালা
আহা , কি অপরূপ বেশ !
বংশীধারী রাখাল রাজা
ওগো আমার স্বামী
কুঞ্জবনে রোপিব যতনে
পুষ্পলতা আনি ।
অঙ্গে জড়ায়ে পীত শাড়ীখানি
বসব তোমার ধ্যানে
হে মোর প্রিয় , সেই ক্ষণটিতে
দিও দেখা অভাজনে ।
বৃন্দাবনে আসে কত যোগী
যোগ সাধনা লাগি ;
আসে কত সাধু বাউল উদাসী
জপ - তপ - কৃচ্ছ্র অভিলাষী ।
গিরিধারীলাল মীরার পতি
অপরূপ তাঁর লীলা
মীরা কহে মন , কর ধৈর্যধারণ
আসিবেন নন্দলালা ।
রাতের গভীরে যমুনার তীরে
দেবেন দেখা প্রভু গিরিধারী ।
বৃন্দাবন হতে অতঃপর মথুরা ও অন্যান্য তীর্থদর্শন সেরে মীরা অবশেষে দ্বারকায় ও সেখানেই বাকিজীবন অতিবাহিত করেন । মথুরা বৃন্দাবনের ন্যায় দ্বারকাও কৃষ্ণলীলার পুণ্যভূমি । কৃষ্ণ সেখানে রণছোড়জী নামে বিখ্যাত । রণছোড়জীর মন্দিরে প্রভুর পদতলে মীরা ভজনানন্দে মহাসুখে ছিলেন । তিনি গুজরাটী ভাষা আয়ত্তে এনে সেই ভাষায় গানও রচনা করেছিলেন এবং উচ্চস্তরের সাধিকারূপে স্থানীয় মানুষের গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন ।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন