নির্যাতন ও নির্বাসন
রাণা বিক্রমজিৎ বুঝি আভাসে বুঝেছিলেন ঊদার আর ভরসা করা যায় না । তিনি মীরার গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য বিশেষ প্রহরীর ব্যবস্থা করলেন ।
অবশেষে একদিন মীরা ধরা পড়ল । গভীর রাত্রে প্রহরী এসে চুপিচুুপি রাণাকে খরব দিলে , মীরা মন্দিরে কারও সঙ্গে রঙ্গ - রসিকতা করছে । মুক্ত তরবারি মুঠোয় ধরে তক্ষুণি ছুটে গেলেন রাণা মন্দিরের অভ্যন্তরে । কিন্তু ইতস্তত দৃষ্টিনিক্ষেপ করে কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন মীরাকে , " কোথায় সেই নাগর , যার সঙ্গে এতক্ষণ ঠাট্টা - তামাশা চলছিল ? "
" আমায় কেন এ প্রশ্ন করছেন , মহারাণা ? " মীরা জবাব দিলেন , ' সে তো আপনার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে । "
ক্রুদ্ধ ও নীতি - নিষ্ঠ রাণা কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে অগ্রসর হলেন বিশেষভাবে অনুসন্ধানের অভিপ্রায়ে । হঠাৎ তাঁর সম্মুখে রাণা দেখতে পেলেন , এক ভীষণাকার নর - সিংহ মূর্তি । মহাপরাক্রমশালী রাণা তরবারি হাতে মূর্ছিত হয়ে ভূমি - শয্যা গ্রহণ করলেন ।
মীরা বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলেন না । তাঁর প্রেমাষ্পদ , যিনি এতক্ষণ তাঁর সঙ্গে রঙ্গ - ক্রীড়া করেছিলেন , তিনিই যে এখন তারা পীড়নকারীকে ভয় দেখাতে ক্রুর মূর্তি ধারণ করেছেন ।
রাণার পক্ষে সে ছিল এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা । রাজপরিবারের মর্যাদা বজায় রাখতে অবশেষে তিনি স্পষ্টতই মীরাকে চিতোর ত্যাগের আদেশ দিলেন । বস্তুত তা ছিল মীরার নির্বাসন দণ্ড । রাজকূলবধূর পক্ষে এরূপ দণ্ডভোগ খুব সহজ ব্যাপার ছিল না , বলাই বাহুল্য । কিন্তু মীরা ছিলেন চিরবিপ্লবী । অদৃষ্টকে তিনি কি পরোয়া করেন ? স্বয়ং গিরিধারীই কি তাঁর প্রিয়তম ও আশ্রয়দাতা নন ?
গৃহত্যাগকালে স্পষ্ট স্বরে তাঁর কন্ঠে বেজে উঠল গানঃ
রাণা যদি ক্রুদ্ধ হন আমার পরে , সখি ,
তাতে কি বা ক্ষতি আমার ?
আমি তো গাবই গিরিধারীর যশোগাথা ।
বিরক্ত রাণার রাজ্যে আমার আশ্রয়ের অভাব হবে না ,
কিন্তু প্রভু যদি মুখ ফিরিয়ে নেন ,
তাহলে যে কোথাও ঠাঁই হবে না আমার ।
সখি , জাগতিক এই নিয়ম নীতির পরোয়া করি না আমি ,
মুক্তির জয়ধ্বজা উড়িয়ে আমি পথ চলে যাব ।
সখি , মীরা শরণ নিয়েছে গিরিধারীর চরণতলে
সে তাঁকেই আশ্রয় করে থাকবে চিরকাল ।
মীরার চিতোর ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের ভাগ্যলক্ষ্মীও বিদায় নিলেন । তাঁর নির্বাসনের অনতিকাল পরেই মুসলমান বিজেতারা চিতোরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল ।
কিছুকালের জন্য মীরা মের্তায় তাঁর খুল্লতাতের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন । কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মীরা অবশেষে রাজস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । গিরিধরের বুঝি বা কিঞ্চিৎ অভিলাষ ছিল , এক অভিজাত রাজকূলবধূকে ধূলিধূসরিত রাজপথে তাঁর নাম গুণকীর্তন সহ ভিক্ষারতা দেখতে । মীরা তখন আক্ষরিক অর্থেই এক ভিক্ষুণী । তীর্থ হতে তীর্থান্তরে হরিনামগুণ কীর্তন করে ফেরা এক চারণ কবি ।
সেই পরীক্ষার দিনে ঈশ্বরে শরণাগতির ভাব তাঁর শতগুণে বর্ধিত হয়েছিল । বৈরাগ্যের চিরন্তন বাণী তাঁর কন্ঠে ভাষায়িত হলো মধুর সুরে ঃ
তোমারি লাগি ছাড়িনু সকল সুখ
আত্ম বন্ধু প্রিয় পরিজন , ত্যাজেছি তোমারি তরে ।
আমাকে ত্যাগ করো না প্রভু ,
ভুলো না আমায় ।
তীর্থ পরিক্রমাকালে , এমন অনেক মুহূর্ত এসেছে যখন মীরার মনে হয়েছে , প্রভু গিরিধারী বুঝি তাঁকে ত্যাগ করেছেন । কিন্তু সে হতাশা বোধ তাঁর প্রিয় ইষ্টের নিত্য অবিচ্ছিন্ন দর্শন কামনায় ।
তাই এক সদ্যব্রতীর ব্যাকুলতায় জানিয়েছেন তাঁর আর্তি ঈশ্বরের দরবারে ঃ
" প্রভু ইহজীবনে কি তুমি দেখা দেবে না আমায় ? "
ক্রমশঃ চলবে
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
রাণা বিক্রমজিৎ বুঝি আভাসে বুঝেছিলেন ঊদার আর ভরসা করা যায় না । তিনি মীরার গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য বিশেষ প্রহরীর ব্যবস্থা করলেন ।
অবশেষে একদিন মীরা ধরা পড়ল । গভীর রাত্রে প্রহরী এসে চুপিচুুপি রাণাকে খরব দিলে , মীরা মন্দিরে কারও সঙ্গে রঙ্গ - রসিকতা করছে । মুক্ত তরবারি মুঠোয় ধরে তক্ষুণি ছুটে গেলেন রাণা মন্দিরের অভ্যন্তরে । কিন্তু ইতস্তত দৃষ্টিনিক্ষেপ করে কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন মীরাকে , " কোথায় সেই নাগর , যার সঙ্গে এতক্ষণ ঠাট্টা - তামাশা চলছিল ? "
" আমায় কেন এ প্রশ্ন করছেন , মহারাণা ? " মীরা জবাব দিলেন , ' সে তো আপনার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে । "
ক্রুদ্ধ ও নীতি - নিষ্ঠ রাণা কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে না পেয়ে অগ্রসর হলেন বিশেষভাবে অনুসন্ধানের অভিপ্রায়ে । হঠাৎ তাঁর সম্মুখে রাণা দেখতে পেলেন , এক ভীষণাকার নর - সিংহ মূর্তি । মহাপরাক্রমশালী রাণা তরবারি হাতে মূর্ছিত হয়ে ভূমি - শয্যা গ্রহণ করলেন ।
মীরা বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলেন না । তাঁর প্রেমাষ্পদ , যিনি এতক্ষণ তাঁর সঙ্গে রঙ্গ - ক্রীড়া করেছিলেন , তিনিই যে এখন তারা পীড়নকারীকে ভয় দেখাতে ক্রুর মূর্তি ধারণ করেছেন ।
রাণার পক্ষে সে ছিল এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা । রাজপরিবারের মর্যাদা বজায় রাখতে অবশেষে তিনি স্পষ্টতই মীরাকে চিতোর ত্যাগের আদেশ দিলেন । বস্তুত তা ছিল মীরার নির্বাসন দণ্ড । রাজকূলবধূর পক্ষে এরূপ দণ্ডভোগ খুব সহজ ব্যাপার ছিল না , বলাই বাহুল্য । কিন্তু মীরা ছিলেন চিরবিপ্লবী । অদৃষ্টকে তিনি কি পরোয়া করেন ? স্বয়ং গিরিধারীই কি তাঁর প্রিয়তম ও আশ্রয়দাতা নন ?
গৃহত্যাগকালে স্পষ্ট স্বরে তাঁর কন্ঠে বেজে উঠল গানঃ
রাণা যদি ক্রুদ্ধ হন আমার পরে , সখি ,
তাতে কি বা ক্ষতি আমার ?
আমি তো গাবই গিরিধারীর যশোগাথা ।
বিরক্ত রাণার রাজ্যে আমার আশ্রয়ের অভাব হবে না ,
কিন্তু প্রভু যদি মুখ ফিরিয়ে নেন ,
তাহলে যে কোথাও ঠাঁই হবে না আমার ।
সখি , জাগতিক এই নিয়ম নীতির পরোয়া করি না আমি ,
মুক্তির জয়ধ্বজা উড়িয়ে আমি পথ চলে যাব ।
সখি , মীরা শরণ নিয়েছে গিরিধারীর চরণতলে
সে তাঁকেই আশ্রয় করে থাকবে চিরকাল ।
মীরার চিতোর ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের ভাগ্যলক্ষ্মীও বিদায় নিলেন । তাঁর নির্বাসনের অনতিকাল পরেই মুসলমান বিজেতারা চিতোরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল ।
কিছুকালের জন্য মীরা মের্তায় তাঁর খুল্লতাতের গৃহে আশ্রয় নিয়েছিলেন । কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মীরা অবশেষে রাজস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । গিরিধরের বুঝি বা কিঞ্চিৎ অভিলাষ ছিল , এক অভিজাত রাজকূলবধূকে ধূলিধূসরিত রাজপথে তাঁর নাম গুণকীর্তন সহ ভিক্ষারতা দেখতে । মীরা তখন আক্ষরিক অর্থেই এক ভিক্ষুণী । তীর্থ হতে তীর্থান্তরে হরিনামগুণ কীর্তন করে ফেরা এক চারণ কবি ।
সেই পরীক্ষার দিনে ঈশ্বরে শরণাগতির ভাব তাঁর শতগুণে বর্ধিত হয়েছিল । বৈরাগ্যের চিরন্তন বাণী তাঁর কন্ঠে ভাষায়িত হলো মধুর সুরে ঃ
তোমারি লাগি ছাড়িনু সকল সুখ
আত্ম বন্ধু প্রিয় পরিজন , ত্যাজেছি তোমারি তরে ।
আমাকে ত্যাগ করো না প্রভু ,
ভুলো না আমায় ।
তীর্থ পরিক্রমাকালে , এমন অনেক মুহূর্ত এসেছে যখন মীরার মনে হয়েছে , প্রভু গিরিধারী বুঝি তাঁকে ত্যাগ করেছেন । কিন্তু সে হতাশা বোধ তাঁর প্রিয় ইষ্টের নিত্য অবিচ্ছিন্ন দর্শন কামনায় ।
তাই এক সদ্যব্রতীর ব্যাকুলতায় জানিয়েছেন তাঁর আর্তি ঈশ্বরের দরবারে ঃ
" প্রভু ইহজীবনে কি তুমি দেখা দেবে না আমায় ? "
ক্রমশঃ চলবে
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন