২৫ অক্টোবর ২০১৭

শ্রীমদ্ভাগব‌ত প্রাক্-কথন

‌নৈ‌মিষার‌ণ্যে শৌনকা‌দি ঋ‌ষিগণ সুদীর্ঘক‌াল ধ‌রে এক যজ্ঞানুষ্ঠান ক‌রছি‌লেন । সেই স্থা‌নে রোমহর্ষণ -পুত্র সূত্র উগ্রশ্রবার আগমন হ‌য়ে‌ছিল । সূত বক্তারূ‌পে প্র‌সিদ্ধ ছি‌লেন । উপস্থিত ঋ‌ষিগণ তাঁর কা‌ছে শ্রীহ‌রির কথা শুন‌তে চাই‌লেন । ভগবৎ কথায় প্রী‌তি আ‌ছে জেনে ঋ‌ষিগণ‌কে যে শ্রীহ‌রিকথা সূত উগ্রশ্রবা শু‌নি‌য়েছি‌লেন তাই শ্রীমদ্ভাগবত ।

মহাম‌তি , অ‌শেষ - বু‌দ্ধি ব্যাস‌দেব ভাগব‌তের রচনাকার । ব্যাস‌দেব সম্বন্ধে বলা হয়ে থা‌কে যে তিনি বেদান্তসূত্র , মহাভারত , পদ্মপুর‌াণ আ‌দি ১৭টি পুরাণ রচনা ক‌রে তৃপ্ত হ‌তে না পে‌রে - নারদ মু‌নির কথায় সর্ব‌শেষে ভাগবত রচনা ক‌রেন । অতএব ধরা যে‌তে পা‌রে যে ভাগবত সকল পুরা‌ণের সারবস্তুর সম‌ন্ব‌য়ে র‌চিত । ভাগবত রচনা ক‌রে ব্যাস‌দেব তাঁর আজন্ম ব্রহ্মজ্ঞানী ও পরম ভক্ত পুত্র শুকদেব‌কে তা শিক্ষা দেন । সূত সেই ভাগবতকথাই শৌনকা‌দি ঋ‌ষিগণ‌কে ব‌লে‌ছি‌লেন । এই প্রস‌ঙ্গে সূত ব‌লে‌ছি‌লেন ----

বাসু‌দেবপরং জ্ঞানং বাসু‌দেবপরং তপঃ ।
বাসু‌দেবপ‌রো ধ‌র্মো বাসু‌দেবপরা গ‌তিঃ ।। ( শ্রীমদ্ভাগবত ১\২\২৯ )

' জ্ঞা‌নের দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ‌কেই লাভ করা যায় , তপস্যা শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতার জন্যই করা হয় । শ্রীকৃ‌ষ্ণের জন্যই সমস্ত ধর্মানুষ্ঠান করা হয় আর সমস্ত গ‌তিই শ্রীকৃ‌ষ্ণে সম‌র্পিত । ' অতএব ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হ‌লেন এই মহাপুরা‌ণের হৃদ‌য় । শ্রীহ‌রির নাম ও তাঁর যশ কীর্তনই ভাগব‌তের মূল প্র‌তিপাদ্য বিষয় । ভাগবত একাধা‌রে বেদান্ত সিদ্ধা‌ন্তের আকর ও বেদান্ত‌বেদ্য তত্ত্ব‌কে সরস ভ‌ক্তির‌সে সিক্ত ক‌রে রাগানুরাগ ভক্তিরূ‌পে সহজলভ্য সুুমিষ্ট ফল । বেদবৃ‌ক্ষের এই সু‌মিষ্ট ফলের রসাস্বাদন কেবলমাত্র শুকচঞ্চু দ্ব‌ারাই সম্ভব হ‌য়ে‌ছি‌ল । শুক যে সু‌মিষ্ট ফল ছাড়া অন্য ফ‌লে চঞ্চু প্রহার করে ন‌া তা সর্বজন‌বি‌দিত ।

অতএব স্বাভা‌বিকভা‌বেই প্রশ্ন ওঠ‌া প্রাস‌ঙ্গিক যে সূত উগ্রশ্রবা তা হ‌লে শ্রীমদ্ভাগবত জান‌লেন কেমন করে ?

এই তথ্যের মূ‌লে গমন ক‌রে আমর‌া জান‌তে পা‌রি যে মহাত্মা শুক‌দেব যখন ভাগবতকথ‌া মৃত্যুপথযাত্রী পরী‌ক্ষিৎ‌কে শোনা‌চ্ছি‌লেন তখন সেই সভায় উপ‌স্থিত ছি‌লেন সূত উগ্রশ্রবাও । সভা‌তে অন্য ব্য‌ক্তিগ‌ণের ম‌ধ্যে শু‌কদে‌বের পিতা শ্রীমদ্ভাগবত রচনাকার ব্যাসদেব ও পিতামহ পরাশরও উপ‌স্থিত ছি‌লেন । পরমহংস চূড়াম‌ণি শুক‌দেবের কৃপ‌ায় সূত উগ্রশ্রবার মাধ্য‌মে সেই সু‌মিষ্ট ফ‌লের রস আজ ভক্ত‌দের হৃদ‌য়ে ভাগবতধ‌ারা রূ‌পে সঞ্চ‌া‌লিত ।

আমরা জা‌নি ভক্তগণ ভগবান‌কে দর্শন করি সাধারণত ম‌ন্দি‌রে গি‌য়ে । ম‌ন্দিরে গি‌য়ে শ্রীভগবান‌কে দর্শন করতে হ‌লে কিছু রী‌তিনী‌তি পালন কর‌তেই হয় --- ম‌ন্দির খোলা থাকবার সময়ে স্নানা‌দি ক‌রে প‌বিত্র হ‌য়ে যে‌তে হয় । ম‌ন্দি‌র পর্যন্ত গি‌য়ে শ্রীবিগ্রহ‌কে দূর থে‌কে দর্শন কর‌তে হয় , কিন্তু ধারাপ্রবাহ বা ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার এইসকল কিছুই প্রয়োজন হয় না । গোমুখ থে‌কে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার জন্য যে কোনো স্থানে যাওয়া যায় অর্থাৎ তা সর্বত্র উপলভ্য । তার স‌ঙ্গে দূরত্ব থাকে ন‌া , কোনো বি‌শেষ সময়ে যে‌তে হয় না আর বিশুদ্ধ হ‌য়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই , অবগাহ‌নেই বি‌শোধন হ‌য়ে যায় । এমনই মাহাত্ম্য এই ভ‌াগবতকথ‌ার যা ধারারূ‌পে কর্ণপ‌থেই ভক্তগণ পান ক‌রে থাকেন ।
চক্রবর্তী সম্রাট পরী‌ক্ষিৎ পাণ্ডব‌দের পৌত্র ছি‌লেন । তি‌নি ছি‌লেন অ‌শেষ গুণসম্পন্ন ও পরমভাগবত মহাভক্ত । এই পরী‌ক্ষিৎ‌কেই মার্তগ‌র্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থে‌কে রক্ষা ক‌রে‌ছি‌লেন । শ্রীভগবা‌নের অ‌চিন্ত্য শ‌ক্তি‌তে সেই দু‌র্নি‌রোধ্য ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হ‌য়ে‌ছিল । অতএব পরী‌ক্ষিৎ মাতৃগ‌র্ভেই ভগবান শ্রীকৃ‌ষ্ণের কৃপা লাভ ক‌রে‌ছিলেন । ধৈর্যশালী , পরমভক্ত , সর্ব‌বিদ্যায় পারদর্শী পরীক্ষিৎ ধর্মানুসা‌রেই রাজ্যপালন ক‌রে‌ছি‌লেন । তি‌নি ছি‌লেন জন‌মেজয় আ‌দি রাজ‌র্ষি‌দের জনক ও ধর্মমর্যাদা লঙ্ঘনকারী‌দের শাসনকর্তা । এমন সর্বগুণাধার পরমভাগবত , জন‌মনোরঞ্জনকারী মহারাজ পরী‌ক্ষিৎও এক‌টি ভুল ক‌রে মু‌নিপু‌ত্রের অ‌ভিশা‌পের মু‌খে প‌ড়েন ।

এক‌দিন মহারাজ পরীক্ষিৎ ধনুর্ব‌াণ নি‌য়ে মৃগয়া কর‌তে বনগমনের পূ‌র্বে তাঁর রত্নভাণ্ডা‌রে প্র‌বেশ ক‌রে‌ছি‌লেন । রত্নভাণ্ডা‌রে অন্যান্য বস্তুসক‌লের স‌ঙ্গে এক‌টি সুবর্ণ নি‌র্মিত কিরীটও ছিল । সেই কিরীট ছিল জরাসন্ধ ব‌ধের সম‌য়ে অনু‌চিত ভা‌বে ছি‌নি‌য়ে নি‌য়ে‌ছি‌লেন । সেই কিরীট মস্ত‌কে ধারণ করে পরী‌ক্ষিৎ মহারাজ মৃগয়ায় গমন কর‌লে তাঁর ম‌ধ্যে জরাস‌ন্ধের রজোগু‌ণের সংক্রমণ হ‌য়ে‌ছিল । মৃগয়ায় হ‌রি‌ণের অনুসরণ কর‌তে কর‌তে তি‌নি ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হ‌য়ে প‌ড়েন । জলাশ‌য়ের সন্ধা‌নে ঘুর‌তে ঘুর‌তে তি‌নি শমীক ঋ‌ষির আশ্র‌মে উপনীত হন ও ঋ‌ষি‌কে নিমী‌লিত নয়‌নে শান্তভা‌বে আস‌নে উপ‌বিষ্ট থাক‌তে দে‌খেন । রাজা পরী‌ক্ষিৎ তাঁর কা‌ছে জল প্রার্থনা করে কো‌নো সাড়া পে‌লেন না । সামান্য ভদ্রতা , উপ‌বেশন কর‌তে অনু‌রোধ , সাদর অভ্যর্থন‌া - এই সকলের একান্ত অভাব রাজা পরী‌ক্ষিৎ‌কে ক্রোধান্বিত করল । ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর মহারাজ পরী‌ক্ষিৎ ক্রোধ ও মাৎসর্য দ্বারা প‌রি‌চা‌লিত হ‌য়ে ঋ‌ষি‌কে অপমান করবার উ‌দ্দে‌শ্যে ধনু‌কের অগ্রভাগ দ্বারা এক‌টি মৃত সর্প মা‌টি থে‌কে তু‌লে ঋ‌ষির গলায় প‌রি‌য়ে দি‌লেন । জরাস‌ন্ধের কিরীট ধারণের প্রভাবে তাঁর এই মহাপরাধ হ‌য়ে গেল । শমীকনন্দন শৃঙ্গী যখন জান‌লেন যে রাজা তাঁর পিতা‌কে অপমান ক‌রে‌ছেন , তখন তি‌নি ক্রো‌ধে রক্তচক্ষু হ‌য়ে কৌ‌শিকী নদীর জ‌লে আচমন ক‌রে তাঁর বজ্রতুল্য অ‌ভিশাপ - বাক্য উচ্চারণ কর‌লেন । তাঁর অ‌ভিশা‌পে মহারাজ পরী‌ক্ষি‌তের সপ্তম দিব‌সে তক্ষক দংশ‌নে মৃত্যু ধার্য হ‌য়ে গেল ।

শমীক ঋ‌ষি কিন্তু পু‌ত্রের এই আচরণ সমর্থন কর‌লেন না । তি‌নি পুত্র‌কে বল‌লেন যে সামান্য অপরা‌ধে এত বড় শা‌স্তির প্র‌য়োজন ছিল না । মহারাজ পরী‌ক্ষিৎ‌কে তি‌নি ঘটনা - বিবরণ দূত দ্বারা অব‌হিত করা‌লেন । মহাযশস্বী ও ভক্তচূড়াম‌ণি মহারাজ প‌রী‌ক্ষিৎ তখন রাজধানী‌তে ফি‌রে এ‌সে কিরীট খু‌লে রে‌খে‌ছি‌লেন । নি‌ন্দিত কৃতক‌র্মের জন্য তখন তি‌নি অনুতপ্ত । ক্ষ‌ণি‌কের জন্য ক্রোধা‌ন্বিত হ‌ওয়ায় তি‌নি নিরপরাধ ও প্রচ্ছন্ন ব্রহ্ম‌তেজসম্পন্ন ব্রাহ্ম‌ণের প্র‌তি যে অনা‌র্যো‌চিত ব্যবহার ক‌রে‌ছেন তা তাঁ‌কে উ‌দ্বিগ্ন কর‌ে তুলল । এমন সম‌য়ে শমীক ঋ‌ষি প্রে‌রিত দূত তাঁকে ব্রহ্ম অ‌ভিশাপের কথা নি‌বেদন কর‌ল । অ‌ভিশাপ তাঁর মঙ্গলপ্রদ বৈরা‌গ্যের মূল কারণ হ‌য়ে দাঁড়াল । তি‌নি ঐ‌হিক সুখ ও স্বর্গসুখ প‌রিত্যাগ ক‌রে ভগবান শ্রীকৃ‌ষ্ণের পাদপ‌দ্ম সেবা‌কেই সর্ব‌শ্রেষ্ঠ পুরষার্থ জ্ঞা‌নে গঙ্গাতী‌রে প্রা‌য়োপ‌বেশন করলেন । রমণীয় তুলসী বি‌মি‌শ্রিত শ্রীকৃষ্ণচরণ‌রেণুধারী গঙ্গাবারি ত্রি‌লো‌কের প‌বিত্রতা প্রদানকারী ও মৃত্যুপথযাত্রীর পরম আশ্রয়স্থল ।

গঙ্গাতী‌রে আমরণ অনশনের সংকল্প নি‌য়ে তি‌নি সমস্ত বিষ‌য়ে আস‌ক্তি প‌রিত্যাগ ক‌রে শম - দমা‌দি ব্রতধারণ ক‌রে অনন্য‌চি‌ত্তে শ্রী‌গো‌বি‌ন্দ চরণকমল ধ্যা‌নে প্রবৃত্ত হ‌লেন । সেই সময় ত্রি‌লোকপাবন মহানুভব ঋ‌ষিমু‌নিগণ তাঁ‌দের শিষ্যমণ্ডলীসহ সেই স্থা‌নে সম‌বেত হ‌লেন । বি‌শিষ্ট মু‌নিগণ‌কে সমা‌বিষ্ট দে‌খে মহারাজ পরী‌ক্ষিৎ প্র‌ত্যে‌কের যথাযোগ্য অর্চনা করে ভূলু‌ন্ঠিত হ‌য়ে তাঁ‌দের প্রণাম কর‌লেন । অ‌ত্রি , বশিষ্ঠ , চ্যবন , দেবল , ভরদ্বাজ , গৌতম , পিপ্পলাদ , মৈ‌ত্রেয় , ব্যাস আ‌দি মহাঋ‌ষি পরি‌শো‌ভিত এই বিশাল সমা‌বে‌শে দিব্য‌জো‌তি ব্যাসনন্দন ভগবান শুকদেবের আগমন হল । সক‌লে সেই দিগম্বর অবধূত‌কে আসন থে‌কে উ‌ঠে দাঁ‌ড়ি‌য়ে সম্মান প্রদর্শন কর‌লেন । সক‌লের দ্বারা সংব‌র্ধিত হ‌য়ে শুক‌দেব রাজপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠ আস‌নে উপ‌বেশন কর‌লেন । সেই মহাস‌নে উপ‌বিষ্ট হ‌য়ে সুমহান ভগবান শুক‌দেব ব্রহ্ম‌র্ষি , দেব‌র্ষি ও রাজ‌র্ষি‌দের ম‌ধ্যে প‌রি‌বে‌ষ্টিত হ‌য়ে শুক্রা‌দি গ্রহ , নক্ষত্র ও তারকা প‌রি‌বেষ্টিত পূর্ণচন্দ্রের মতন শোভা পে‌তে লাগ‌লেন । শুক‌দেব শান্তভা‌বে আসনে উপ‌বিষ্ট হলে পরম ভাগবত পরী‌ক্ষিৎ তাঁর সম্মু‌খে এ‌সে ভূলুন্ঠিত হ‌য়ে প্রণাম নি‌বেদন কর‌লেন । তি‌নি মহাত্মা শুক‌দেবের কা‌ছে জান‌তে চাই‌লেন যে আসন্ন - মৃত্যু ব্য‌ক্তির করণীয় ও শ্রীকৃষ্ণলা‌ভরূপ পরম‌সি‌দ্ধির স্বরূপ ও সাধন কী ? মহাত্মা শুক‌দেব রাজা পরী‌ক্ষিৎ‌কে যে উপ‌দেশ দি‌য়ে‌ছি‌লেন তাই সূত উগ্রশ্রবা প‌রে শৌনকা‌দি ঋ‌ষি‌দের যজ্ঞস্থ‌লে শ্রীমদ্ভাগবত রূ‌পে বিতরণ ক‌রে‌ছিলেন । গঙ্গাতী‌রের সেই শুকদেব ক‌থিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রু‌তিধর সূত্র উগ্রশ্রবা কৃপা ক‌রে ভক্ত‌দেন পান ক‌রি‌য়ে‌ছি‌লেন যা আগামী দি‌নে ভ‌ক্তিপ‌থের প‌থিক‌দের আকর গ্রন্থ ও মহাপুরাণরূ‌পে স্বীকৃতি লাভ করে‌ছিল ।

গঙ্গাতী‌রে গীত শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ , যম‌ুনাতী‌রে অ‌ভিনীত শ্রীকৃ‌ষ্ণের অনুপম লীলার বিবর‌ণে সমৃদ্ধ । আবার য‌দি আমরা সেই সৃ‌ষ্টির স্থান অনুসন্ধা‌নে প্রবৃত্ত হই ত‌বে দেখব যে তা ব্যাস‌দেব দ্বারা সরস্বতী নদীর তী‌রে সৃষ্ট । তাই শ্রীমদ্ভাগবতে ত্রি‌বেণী সঙ্গ‌মের ম‌হিমা বর্তমান । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বৃন্দাবনলীলার শে‌ষে মথুরা গম‌নের সম‌য়ে তাঁর ভক্ত গো‌পিনী‌দের কথা দি‌য়ে‌ছি‌লেন যে তি‌নি লীল‌ার সমাপ‌নে আব‌ার তাঁ‌দের কা‌ছে ফিরে আসবেন । তাই শোনা যায় যে দ্বারকালীলা অবসা‌নে তি‌নি বৈকু‌ন্ঠে গমন না ক‌রে শ্রীমদ্ভাগব‌তে লীন হ‌য়ে গি‌য়ে‌ছি‌লেন । তাই শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীহ‌রির বাঙ্ময় শরীররূ‌পে ভক্ত‌দের কা‌ছে পূজার্চন‌া পে‌য়ে থা‌কে । দ্বাদশ স্কন্ধ‌বি‌শিষ্ট শ্রীমদ্ভাগবত‌কে ভগবান শ্রীকৃ‌ষ্ণের গি‌রিধারী রূ‌পে দেখা হ‌য়ে থাকে । গিরিধারী রূ‌পে আমরা দে‌খে থা‌কি যে শ্রীভগবা‌নের দ‌ক্ষিণ হস্ত ক‌টি‌তে থা‌কলেও বাম হস্ত সব থে‌কে উপ‌রে গি‌রি‌গোবর্ধন ধারণ ক‌রে আ‌ছে । তাই দ্বাদশ স্কন্ধযুক্ত শ্রীমদ্ভাগব‌তের এক এক‌টি স্কন্ধ‌কে শ্রীভগবা‌নের দেব শরী‌রের এক এক অঙ্গরূ‌পে গণনা করা হয় । প্রথম থে‌কে দ্বাদশ স্কন্ধ তাই শ্রীভগবা‌নের যথাক্র‌মে দ‌ক্ষিণ পাদ , বাম পাদ , দ‌ক্ষিণ ঊরু‌দেশ , বাম ঊরু‌দেশ , দ‌ক্ষিণ ক‌টি‌দেশ , বাম ক‌টি‌দেশ , দ‌ক্ষিণ হস্ত , দ‌ক্ষিণ স্কন্ধ , বাম স্কন্ধ , হৃদয় , ললাট ও বামহস্ত রূ‌পে প‌রি‌চিত । তাই দ্বাদশাঙ্গ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীভগবান স্বয়ং - যাঁর অন্তঃকরণ হল দশম স্কন্ধ । অষ্টাদশ সহস্র শ্লো‌ক‌বি‌শি‌ষ্ট এই মহাপুরা‌ণে আ‌ছে ৩৩৫ অধ্যায় । সর্বত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ ম‌হিমায় বর্তমান । তাই এর স্পর্শলাভ কর‌লেই প‌বিত্রতা অর্জন সুন‌ি‌শ্চিত ।

ভাগবত- ভক্ত - ভগবান এক ও অ‌ভিন্ন । এই প্রস‌ঙ্গে শ্রীমদ্ভাগব‌তে ব‌র্ণিত শ্রীভগবা‌নের উ‌ক্তি স্মরণ করা যে‌তে পা‌রে ---

সাধ‌বো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জান‌ন্তি নাহং তে‌ভ্যো মনাগ‌পি ।। ( ৯\৪\৬৮ )

' আমার প্রেমী ভক্ত আমার হৃদয় এবং সেই প্রেমী ভক্ত‌দের হৃদয় আ‌মি স্বয়ং । তারা আমা‌কে ছাড়া আর কিছু জা‌নে না আর আ‌মিও তা‌দের ছাড়া কিছুই ভাব‌তে পা‌রি না । '

‌বিশাল শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণের আ‌দি ও অ‌ন্তে আমরা দে‌খি ' সত্য পরং ধীম‌হি ' - অর্থাৎ পরমসত্যরূ‌পে পরমাত্মা‌কে আমরা ধ্যান ক‌রি । তাই এই আকর গ্র‌ন্থের মূল বক্তব্য - পর‌মেশ্বর সত্যস্বরূপ , যা সর্বত্র গীত হ‌য়ে‌ছে । তাই মূল প্র‌তিপাদ্য বিষয় হল - শ্রীভগবান ছাড়া জগ‌তে আর কিছুই নেই । তিনি ' সর্বভূতানাং হৃদ্দে‌শে তিষ্ঠ‌তি ' নি‌জে ব‌লে‌ছেন ।

যত্র যোগশ্বর কৃ‌ষ্ণো যত্র পা‌র্থো ধনুর্ধরঃ ।
তত্র শ্রী‌র্বিজ‌য়ো ভূ‌তির্ধ্রুবা নী‌তির্ম‌তির্মম ।। ( ১৮ \ ৭৮ )

তাই মানবজন্ম সফল কর‌তে প্র‌য়োজন ভগবৎকৃপা ও পুরুষকার যা তাঁর কৃপা‌তেই লাভ করা সম্ভব । তাই শ্রীভগবা‌নকে বা‌রে বা‌রে প্রণাম নি‌বেদন করা । ম‌নে রাখ‌তে হ‌বে প্রণা‌মে জ্ঞান‌যোগ ( মস্ত‌কের ) , কর্ম‌যোগ ( হ‌স্তের ) ও ভ‌ক্তি‌যোগের ( চি‌ত্তের ) সমন্বয় হ‌য়ে থা‌কে । মস্তক অবনত হয় , হস্তদ্বয় যুক্ত হ‌য় আর চিত্ত প্রণত হয় । তাই যোগেশ্বর‌কে স্মরণ যোগত্র‌য়ের সমন্ব‌য়েই হ‌য়ে থা‌কে ।

মহাত্ম‌া শুক‌দেবের কা‌ছে শ্রীমদ্ভাগব‌ত শ্রবণ ক‌রে মহাভাগবত পরী‌ক্ষিৎ যোগরূঢ় হ‌য়ে সপ্তম দিবসা‌ন্তে তক্ষক দংশ‌নে ভস্ম হ‌য়ে শ্রীভগবানের স‌ঙ্গে মি‌লিত হয়ে গি‌য়ে‌ছি‌লেন । পরী‌ক্ষিৎ পরম ভাগ্যবান ছি‌লেন কারণ তি‌নি জান‌তেন যে তি‌নি মাত্র সাত দিন বেঁ‌চে থাক‌বেন , অন্য কো‌নো জীব তা জান‌তে পা‌রে না । শ্রীমদ্ভাগবতই তাঁকে মু‌ক্তির প‌থে নি‌য়ে গি‌য়ে‌ছে যা আমা‌দের পক্ষে দৃষ্টান্তস্বরূপ । জয় - বিজয়‌কে উদ্ধার করবার জন্য তি‌নি অবতাররূ‌পে তিনবার এই পৃ‌থিবী‌তে এ‌সে‌ছি‌লেন । ভ‌ক্তের জন্য তি‌নি সাগ্র‌হে অ‌পেক্ষা ক‌রে থা‌কেন । তি‌নি চান ভক্ত যেন তা‌কে ম‌নে রা‌খে ।

।। ওঁ ন‌মো ভগব‌তে বাসু‌দেবায় ।।

Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
Share:

1 Comments:

Unknown বলেছেন...

খুব ভালো লাগলো।
জয় রাধে। ❤🙏🙏🙏

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।