নৈমিষারণ্যে শৌনকাদি ঋষিগণ সুদীর্ঘকাল ধরে এক যজ্ঞানুষ্ঠান করছিলেন । সেই স্থানে রোমহর্ষণ -পুত্র সূত্র উগ্রশ্রবার আগমন হয়েছিল । সূত বক্তারূপে প্রসিদ্ধ ছিলেন । উপস্থিত ঋষিগণ তাঁর কাছে শ্রীহরির কথা শুনতে চাইলেন । ভগবৎ কথায় প্রীতি আছে জেনে ঋষিগণকে যে শ্রীহরিকথা সূত উগ্রশ্রবা শুনিয়েছিলেন তাই শ্রীমদ্ভাগবত ।
মহামতি , অশেষ - বুদ্ধি ব্যাসদেব ভাগবতের রচনাকার । ব্যাসদেব সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে তিনি বেদান্তসূত্র , মহাভারত , পদ্মপুরাণ আদি ১৭টি পুরাণ রচনা করে তৃপ্ত হতে না পেরে - নারদ মুনির কথায় সর্বশেষে ভাগবত রচনা করেন । অতএব ধরা যেতে পারে যে ভাগবত সকল পুরাণের সারবস্তুর সমন্বয়ে রচিত । ভাগবত রচনা করে ব্যাসদেব তাঁর আজন্ম ব্রহ্মজ্ঞানী ও পরম ভক্ত পুত্র শুকদেবকে তা শিক্ষা দেন । সূত সেই ভাগবতকথাই শৌনকাদি ঋষিগণকে বলেছিলেন । এই প্রসঙ্গে সূত বলেছিলেন ----
বাসুদেবপরং জ্ঞানং বাসুদেবপরং তপঃ ।
বাসুদেবপরো ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ ।। ( শ্রীমদ্ভাগবত ১\২\২৯ )
' জ্ঞানের দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকেই লাভ করা যায় , তপস্যা শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতার জন্যই করা হয় । শ্রীকৃষ্ণের জন্যই সমস্ত ধর্মানুষ্ঠান করা হয় আর সমস্ত গতিই শ্রীকৃষ্ণে সমর্পিত । ' অতএব ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলেন এই মহাপুরাণের হৃদয় । শ্রীহরির নাম ও তাঁর যশ কীর্তনই ভাগবতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । ভাগবত একাধারে বেদান্ত সিদ্ধান্তের আকর ও বেদান্তবেদ্য তত্ত্বকে সরস ভক্তিরসে সিক্ত করে রাগানুরাগ ভক্তিরূপে সহজলভ্য সুুমিষ্ট ফল । বেদবৃক্ষের এই সুমিষ্ট ফলের রসাস্বাদন কেবলমাত্র শুকচঞ্চু দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল । শুক যে সুমিষ্ট ফল ছাড়া অন্য ফলে চঞ্চু প্রহার করে না তা সর্বজনবিদিত ।
অতএব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠা প্রাসঙ্গিক যে সূত উগ্রশ্রবা তা হলে শ্রীমদ্ভাগবত জানলেন কেমন করে ?
এই তথ্যের মূলে গমন করে আমরা জানতে পারি যে মহাত্মা শুকদেব যখন ভাগবতকথা মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎকে শোনাচ্ছিলেন তখন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন সূত উগ্রশ্রবাও । সভাতে অন্য ব্যক্তিগণের মধ্যে শুকদেবের পিতা শ্রীমদ্ভাগবত রচনাকার ব্যাসদেব ও পিতামহ পরাশরও উপস্থিত ছিলেন । পরমহংস চূড়ামণি শুকদেবের কৃপায় সূত উগ্রশ্রবার মাধ্যমে সেই সুমিষ্ট ফলের রস আজ ভক্তদের হৃদয়ে ভাগবতধারা রূপে সঞ্চালিত ।
আমরা জানি ভক্তগণ ভগবানকে দর্শন করি সাধারণত মন্দিরে গিয়ে । মন্দিরে গিয়ে শ্রীভগবানকে দর্শন করতে হলে কিছু রীতিনীতি পালন করতেই হয় --- মন্দির খোলা থাকবার সময়ে স্নানাদি করে পবিত্র হয়ে যেতে হয় । মন্দির পর্যন্ত গিয়ে শ্রীবিগ্রহকে দূর থেকে দর্শন করতে হয় , কিন্তু ধারাপ্রবাহ বা ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার এইসকল কিছুই প্রয়োজন হয় না । গোমুখ থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার জন্য যে কোনো স্থানে যাওয়া যায় অর্থাৎ তা সর্বত্র উপলভ্য । তার সঙ্গে দূরত্ব থাকে না , কোনো বিশেষ সময়ে যেতে হয় না আর বিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই , অবগাহনেই বিশোধন হয়ে যায় । এমনই মাহাত্ম্য এই ভাগবতকথার যা ধারারূপে কর্ণপথেই ভক্তগণ পান করে থাকেন ।
চক্রবর্তী সম্রাট পরীক্ষিৎ পাণ্ডবদের পৌত্র ছিলেন । তিনি ছিলেন অশেষ গুণসম্পন্ন ও পরমভাগবত মহাভক্ত । এই পরীক্ষিৎকেই মার্তগর্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন । শ্রীভগবানের অচিন্ত্য শক্তিতে সেই দুর্নিরোধ্য ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল । অতএব পরীক্ষিৎ মাতৃগর্ভেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ করেছিলেন । ধৈর্যশালী , পরমভক্ত , সর্ববিদ্যায় পারদর্শী পরীক্ষিৎ ধর্মানুসারেই রাজ্যপালন করেছিলেন । তিনি ছিলেন জনমেজয় আদি রাজর্ষিদের জনক ও ধর্মমর্যাদা লঙ্ঘনকারীদের শাসনকর্তা । এমন সর্বগুণাধার পরমভাগবত , জনমনোরঞ্জনকারী মহারাজ পরীক্ষিৎও একটি ভুল করে মুনিপুত্রের অভিশাপের মুখে পড়েন ।
একদিন মহারাজ পরীক্ষিৎ ধনুর্বাণ নিয়ে মৃগয়া করতে বনগমনের পূর্বে তাঁর রত্নভাণ্ডারে প্রবেশ করেছিলেন । রত্নভাণ্ডারে অন্যান্য বস্তুসকলের সঙ্গে একটি সুবর্ণ নির্মিত কিরীটও ছিল । সেই কিরীট ছিল জরাসন্ধ বধের সময়ে অনুচিত ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন । সেই কিরীট মস্তকে ধারণ করে পরীক্ষিৎ মহারাজ মৃগয়ায় গমন করলে তাঁর মধ্যে জরাসন্ধের রজোগুণের সংক্রমণ হয়েছিল । মৃগয়ায় হরিণের অনুসরণ করতে করতে তিনি ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন । জলাশয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি শমীক ঋষির আশ্রমে উপনীত হন ও ঋষিকে নিমীলিত নয়নে শান্তভাবে আসনে উপবিষ্ট থাকতে দেখেন । রাজা পরীক্ষিৎ তাঁর কাছে জল প্রার্থনা করে কোনো সাড়া পেলেন না । সামান্য ভদ্রতা , উপবেশন করতে অনুরোধ , সাদর অভ্যর্থনা - এই সকলের একান্ত অভাব রাজা পরীক্ষিৎকে ক্রোধান্বিত করল । ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর মহারাজ পরীক্ষিৎ ক্রোধ ও মাৎসর্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে ঋষিকে অপমান করবার উদ্দেশ্যে ধনুকের অগ্রভাগ দ্বারা একটি মৃত সর্প মাটি থেকে তুলে ঋষির গলায় পরিয়ে দিলেন । জরাসন্ধের কিরীট ধারণের প্রভাবে তাঁর এই মহাপরাধ হয়ে গেল । শমীকনন্দন শৃঙ্গী যখন জানলেন যে রাজা তাঁর পিতাকে অপমান করেছেন , তখন তিনি ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে কৌশিকী নদীর জলে আচমন করে তাঁর বজ্রতুল্য অভিশাপ - বাক্য উচ্চারণ করলেন । তাঁর অভিশাপে মহারাজ পরীক্ষিতের সপ্তম দিবসে তক্ষক দংশনে মৃত্যু ধার্য হয়ে গেল ।
শমীক ঋষি কিন্তু পুত্রের এই আচরণ সমর্থন করলেন না । তিনি পুত্রকে বললেন যে সামান্য অপরাধে এত বড় শাস্তির প্রয়োজন ছিল না । মহারাজ পরীক্ষিৎকে তিনি ঘটনা - বিবরণ দূত দ্বারা অবহিত করালেন । মহাযশস্বী ও ভক্তচূড়ামণি মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন রাজধানীতে ফিরে এসে কিরীট খুলে রেখেছিলেন । নিন্দিত কৃতকর্মের জন্য তখন তিনি অনুতপ্ত । ক্ষণিকের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়ায় তিনি নিরপরাধ ও প্রচ্ছন্ন ব্রহ্মতেজসম্পন্ন ব্রাহ্মণের প্রতি যে অনার্যোচিত ব্যবহার করেছেন তা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলল । এমন সময়ে শমীক ঋষি প্রেরিত দূত তাঁকে ব্রহ্ম অভিশাপের কথা নিবেদন করল । অভিশাপ তাঁর মঙ্গলপ্রদ বৈরাগ্যের মূল কারণ হয়ে দাঁড়াল । তিনি ঐহিক সুখ ও স্বর্গসুখ পরিত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম সেবাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষার্থ জ্ঞানে গঙ্গাতীরে প্রায়োপবেশন করলেন । রমণীয় তুলসী বিমিশ্রিত শ্রীকৃষ্ণচরণরেণুধারী গঙ্গাবারি ত্রিলোকের পবিত্রতা প্রদানকারী ও মৃত্যুপথযাত্রীর পরম আশ্রয়স্থল ।
গঙ্গাতীরে আমরণ অনশনের সংকল্প নিয়ে তিনি সমস্ত বিষয়ে আসক্তি পরিত্যাগ করে শম - দমাদি ব্রতধারণ করে অনন্যচিত্তে শ্রীগোবিন্দ চরণকমল ধ্যানে প্রবৃত্ত হলেন । সেই সময় ত্রিলোকপাবন মহানুভব ঋষিমুনিগণ তাঁদের শিষ্যমণ্ডলীসহ সেই স্থানে সমবেত হলেন । বিশিষ্ট মুনিগণকে সমাবিষ্ট দেখে মহারাজ পরীক্ষিৎ প্রত্যেকের যথাযোগ্য অর্চনা করে ভূলুন্ঠিত হয়ে তাঁদের প্রণাম করলেন । অত্রি , বশিষ্ঠ , চ্যবন , দেবল , ভরদ্বাজ , গৌতম , পিপ্পলাদ , মৈত্রেয় , ব্যাস আদি মহাঋষি পরিশোভিত এই বিশাল সমাবেশে দিব্যজোতি ব্যাসনন্দন ভগবান শুকদেবের আগমন হল । সকলে সেই দিগম্বর অবধূতকে আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন । সকলের দ্বারা সংবর্ধিত হয়ে শুকদেব রাজপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠ আসনে উপবেশন করলেন । সেই মহাসনে উপবিষ্ট হয়ে সুমহান ভগবান শুকদেব ব্রহ্মর্ষি , দেবর্ষি ও রাজর্ষিদের মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে শুক্রাদি গ্রহ , নক্ষত্র ও তারকা পরিবেষ্টিত পূর্ণচন্দ্রের মতন শোভা পেতে লাগলেন । শুকদেব শান্তভাবে আসনে উপবিষ্ট হলে পরম ভাগবত পরীক্ষিৎ তাঁর সম্মুখে এসে ভূলুন্ঠিত হয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন । তিনি মহাত্মা শুকদেবের কাছে জানতে চাইলেন যে আসন্ন - মৃত্যু ব্যক্তির করণীয় ও শ্রীকৃষ্ণলাভরূপ পরমসিদ্ধির স্বরূপ ও সাধন কী ? মহাত্মা শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই সূত উগ্রশ্রবা পরে শৌনকাদি ঋষিদের যজ্ঞস্থলে শ্রীমদ্ভাগবত রূপে বিতরণ করেছিলেন । গঙ্গাতীরের সেই শুকদেব কথিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রুতিধর সূত্র উগ্রশ্রবা কৃপা করে ভক্তদেন পান করিয়েছিলেন যা আগামী দিনে ভক্তিপথের পথিকদের আকর গ্রন্থ ও মহাপুরাণরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিল ।
গঙ্গাতীরে গীত শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ , যমুনাতীরে অভিনীত শ্রীকৃষ্ণের অনুপম লীলার বিবরণে সমৃদ্ধ । আবার যদি আমরা সেই সৃষ্টির স্থান অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই তবে দেখব যে তা ব্যাসদেব দ্বারা সরস্বতী নদীর তীরে সৃষ্ট । তাই শ্রীমদ্ভাগবতে ত্রিবেণী সঙ্গমের মহিমা বর্তমান । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বৃন্দাবনলীলার শেষে মথুরা গমনের সময়ে তাঁর ভক্ত গোপিনীদের কথা দিয়েছিলেন যে তিনি লীলার সমাপনে আবার তাঁদের কাছে ফিরে আসবেন । তাই শোনা যায় যে দ্বারকালীলা অবসানে তিনি বৈকুন্ঠে গমন না করে শ্রীমদ্ভাগবতে লীন হয়ে গিয়েছিলেন । তাই শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীহরির বাঙ্ময় শরীররূপে ভক্তদের কাছে পূজার্চনা পেয়ে থাকে । দ্বাদশ স্কন্ধবিশিষ্ট শ্রীমদ্ভাগবতকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গিরিধারী রূপে দেখা হয়ে থাকে । গিরিধারী রূপে আমরা দেখে থাকি যে শ্রীভগবানের দক্ষিণ হস্ত কটিতে থাকলেও বাম হস্ত সব থেকে উপরে গিরিগোবর্ধন ধারণ করে আছে । তাই দ্বাদশ স্কন্ধযুক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের এক একটি স্কন্ধকে শ্রীভগবানের দেব শরীরের এক এক অঙ্গরূপে গণনা করা হয় । প্রথম থেকে দ্বাদশ স্কন্ধ তাই শ্রীভগবানের যথাক্রমে দক্ষিণ পাদ , বাম পাদ , দক্ষিণ ঊরুদেশ , বাম ঊরুদেশ , দক্ষিণ কটিদেশ , বাম কটিদেশ , দক্ষিণ হস্ত , দক্ষিণ স্কন্ধ , বাম স্কন্ধ , হৃদয় , ললাট ও বামহস্ত রূপে পরিচিত । তাই দ্বাদশাঙ্গ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীভগবান স্বয়ং - যাঁর অন্তঃকরণ হল দশম স্কন্ধ । অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকবিশিষ্ট এই মহাপুরাণে আছে ৩৩৫ অধ্যায় । সর্বত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ মহিমায় বর্তমান । তাই এর স্পর্শলাভ করলেই পবিত্রতা অর্জন সুনিশ্চিত ।
ভাগবত- ভক্ত - ভগবান এক ও অভিন্ন । এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত শ্রীভগবানের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে ---
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।। ( ৯\৪\৬৮ )
' আমার প্রেমী ভক্ত আমার হৃদয় এবং সেই প্রেমী ভক্তদের হৃদয় আমি স্বয়ং । তারা আমাকে ছাড়া আর কিছু জানে না আর আমিও তাদের ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না । '
বিশাল শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণের আদি ও অন্তে আমরা দেখি ' সত্য পরং ধীমহি ' - অর্থাৎ পরমসত্যরূপে পরমাত্মাকে আমরা ধ্যান করি । তাই এই আকর গ্রন্থের মূল বক্তব্য - পরমেশ্বর সত্যস্বরূপ , যা সর্বত্র গীত হয়েছে । তাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল - শ্রীভগবান ছাড়া জগতে আর কিছুই নেই । তিনি ' সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে তিষ্ঠতি ' নিজে বলেছেন ।
যত্র যোগশ্বর কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম ।। ( ১৮ \ ৭৮ )
তাই মানবজন্ম সফল করতে প্রয়োজন ভগবৎকৃপা ও পুরুষকার যা তাঁর কৃপাতেই লাভ করা সম্ভব । তাই শ্রীভগবানকে বারে বারে প্রণাম নিবেদন করা । মনে রাখতে হবে প্রণামে জ্ঞানযোগ ( মস্তকের ) , কর্মযোগ ( হস্তের ) ও ভক্তিযোগের ( চিত্তের ) সমন্বয় হয়ে থাকে । মস্তক অবনত হয় , হস্তদ্বয় যুক্ত হয় আর চিত্ত প্রণত হয় । তাই যোগেশ্বরকে স্মরণ যোগত্রয়ের সমন্বয়েই হয়ে থাকে ।
মহাত্মা শুকদেবের কাছে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে মহাভাগবত পরীক্ষিৎ যোগরূঢ় হয়ে সপ্তম দিবসান্তে তক্ষক দংশনে ভস্ম হয়ে শ্রীভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়ে গিয়েছিলেন । পরীক্ষিৎ পরম ভাগ্যবান ছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে তিনি মাত্র সাত দিন বেঁচে থাকবেন , অন্য কোনো জীব তা জানতে পারে না । শ্রীমদ্ভাগবতই তাঁকে মুক্তির পথে নিয়ে গিয়েছে যা আমাদের পক্ষে দৃষ্টান্তস্বরূপ । জয় - বিজয়কে উদ্ধার করবার জন্য তিনি অবতাররূপে তিনবার এই পৃথিবীতে এসেছিলেন । ভক্তের জন্য তিনি সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন । তিনি চান ভক্ত যেন তাকে মনে রাখে ।
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় ।।
মহামতি , অশেষ - বুদ্ধি ব্যাসদেব ভাগবতের রচনাকার । ব্যাসদেব সম্বন্ধে বলা হয়ে থাকে যে তিনি বেদান্তসূত্র , মহাভারত , পদ্মপুরাণ আদি ১৭টি পুরাণ রচনা করে তৃপ্ত হতে না পেরে - নারদ মুনির কথায় সর্বশেষে ভাগবত রচনা করেন । অতএব ধরা যেতে পারে যে ভাগবত সকল পুরাণের সারবস্তুর সমন্বয়ে রচিত । ভাগবত রচনা করে ব্যাসদেব তাঁর আজন্ম ব্রহ্মজ্ঞানী ও পরম ভক্ত পুত্র শুকদেবকে তা শিক্ষা দেন । সূত সেই ভাগবতকথাই শৌনকাদি ঋষিগণকে বলেছিলেন । এই প্রসঙ্গে সূত বলেছিলেন ----
বাসুদেবপরং জ্ঞানং বাসুদেবপরং তপঃ ।
বাসুদেবপরো ধর্মো বাসুদেবপরা গতিঃ ।। ( শ্রীমদ্ভাগবত ১\২\২৯ )
' জ্ঞানের দ্বারা ব্রহ্মস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণকেই লাভ করা যায় , তপস্যা শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতার জন্যই করা হয় । শ্রীকৃষ্ণের জন্যই সমস্ত ধর্মানুষ্ঠান করা হয় আর সমস্ত গতিই শ্রীকৃষ্ণে সমর্পিত । ' অতএব ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হলেন এই মহাপুরাণের হৃদয় । শ্রীহরির নাম ও তাঁর যশ কীর্তনই ভাগবতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । ভাগবত একাধারে বেদান্ত সিদ্ধান্তের আকর ও বেদান্তবেদ্য তত্ত্বকে সরস ভক্তিরসে সিক্ত করে রাগানুরাগ ভক্তিরূপে সহজলভ্য সুুমিষ্ট ফল । বেদবৃক্ষের এই সুমিষ্ট ফলের রসাস্বাদন কেবলমাত্র শুকচঞ্চু দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল । শুক যে সুমিষ্ট ফল ছাড়া অন্য ফলে চঞ্চু প্রহার করে না তা সর্বজনবিদিত ।
অতএব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠা প্রাসঙ্গিক যে সূত উগ্রশ্রবা তা হলে শ্রীমদ্ভাগবত জানলেন কেমন করে ?
এই তথ্যের মূলে গমন করে আমরা জানতে পারি যে মহাত্মা শুকদেব যখন ভাগবতকথা মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎকে শোনাচ্ছিলেন তখন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন সূত উগ্রশ্রবাও । সভাতে অন্য ব্যক্তিগণের মধ্যে শুকদেবের পিতা শ্রীমদ্ভাগবত রচনাকার ব্যাসদেব ও পিতামহ পরাশরও উপস্থিত ছিলেন । পরমহংস চূড়ামণি শুকদেবের কৃপায় সূত উগ্রশ্রবার মাধ্যমে সেই সুমিষ্ট ফলের রস আজ ভক্তদের হৃদয়ে ভাগবতধারা রূপে সঞ্চালিত ।
আমরা জানি ভক্তগণ ভগবানকে দর্শন করি সাধারণত মন্দিরে গিয়ে । মন্দিরে গিয়ে শ্রীভগবানকে দর্শন করতে হলে কিছু রীতিনীতি পালন করতেই হয় --- মন্দির খোলা থাকবার সময়ে স্নানাদি করে পবিত্র হয়ে যেতে হয় । মন্দির পর্যন্ত গিয়ে শ্রীবিগ্রহকে দূর থেকে দর্শন করতে হয় , কিন্তু ধারাপ্রবাহ বা ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার এইসকল কিছুই প্রয়োজন হয় না । গোমুখ থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভাগবতগঙ্গায় অবগাহন করবার জন্য যে কোনো স্থানে যাওয়া যায় অর্থাৎ তা সর্বত্র উপলভ্য । তার সঙ্গে দূরত্ব থাকে না , কোনো বিশেষ সময়ে যেতে হয় না আর বিশুদ্ধ হয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই , অবগাহনেই বিশোধন হয়ে যায় । এমনই মাহাত্ম্য এই ভাগবতকথার যা ধারারূপে কর্ণপথেই ভক্তগণ পান করে থাকেন ।
চক্রবর্তী সম্রাট পরীক্ষিৎ পাণ্ডবদের পৌত্র ছিলেন । তিনি ছিলেন অশেষ গুণসম্পন্ন ও পরমভাগবত মহাভক্ত । এই পরীক্ষিৎকেই মার্তগর্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন । শ্রীভগবানের অচিন্ত্য শক্তিতে সেই দুর্নিরোধ্য ব্রহ্মাস্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল । অতএব পরীক্ষিৎ মাতৃগর্ভেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ করেছিলেন । ধৈর্যশালী , পরমভক্ত , সর্ববিদ্যায় পারদর্শী পরীক্ষিৎ ধর্মানুসারেই রাজ্যপালন করেছিলেন । তিনি ছিলেন জনমেজয় আদি রাজর্ষিদের জনক ও ধর্মমর্যাদা লঙ্ঘনকারীদের শাসনকর্তা । এমন সর্বগুণাধার পরমভাগবত , জনমনোরঞ্জনকারী মহারাজ পরীক্ষিৎও একটি ভুল করে মুনিপুত্রের অভিশাপের মুখে পড়েন ।
একদিন মহারাজ পরীক্ষিৎ ধনুর্বাণ নিয়ে মৃগয়া করতে বনগমনের পূর্বে তাঁর রত্নভাণ্ডারে প্রবেশ করেছিলেন । রত্নভাণ্ডারে অন্যান্য বস্তুসকলের সঙ্গে একটি সুবর্ণ নির্মিত কিরীটও ছিল । সেই কিরীট ছিল জরাসন্ধ বধের সময়ে অনুচিত ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন । সেই কিরীট মস্তকে ধারণ করে পরীক্ষিৎ মহারাজ মৃগয়ায় গমন করলে তাঁর মধ্যে জরাসন্ধের রজোগুণের সংক্রমণ হয়েছিল । মৃগয়ায় হরিণের অনুসরণ করতে করতে তিনি ক্লান্ত , ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন । জলাশয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে তিনি শমীক ঋষির আশ্রমে উপনীত হন ও ঋষিকে নিমীলিত নয়নে শান্তভাবে আসনে উপবিষ্ট থাকতে দেখেন । রাজা পরীক্ষিৎ তাঁর কাছে জল প্রার্থনা করে কোনো সাড়া পেলেন না । সামান্য ভদ্রতা , উপবেশন করতে অনুরোধ , সাদর অভ্যর্থনা - এই সকলের একান্ত অভাব রাজা পরীক্ষিৎকে ক্রোধান্বিত করল । ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় কাতর মহারাজ পরীক্ষিৎ ক্রোধ ও মাৎসর্য দ্বারা পরিচালিত হয়ে ঋষিকে অপমান করবার উদ্দেশ্যে ধনুকের অগ্রভাগ দ্বারা একটি মৃত সর্প মাটি থেকে তুলে ঋষির গলায় পরিয়ে দিলেন । জরাসন্ধের কিরীট ধারণের প্রভাবে তাঁর এই মহাপরাধ হয়ে গেল । শমীকনন্দন শৃঙ্গী যখন জানলেন যে রাজা তাঁর পিতাকে অপমান করেছেন , তখন তিনি ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে কৌশিকী নদীর জলে আচমন করে তাঁর বজ্রতুল্য অভিশাপ - বাক্য উচ্চারণ করলেন । তাঁর অভিশাপে মহারাজ পরীক্ষিতের সপ্তম দিবসে তক্ষক দংশনে মৃত্যু ধার্য হয়ে গেল ।
শমীক ঋষি কিন্তু পুত্রের এই আচরণ সমর্থন করলেন না । তিনি পুত্রকে বললেন যে সামান্য অপরাধে এত বড় শাস্তির প্রয়োজন ছিল না । মহারাজ পরীক্ষিৎকে তিনি ঘটনা - বিবরণ দূত দ্বারা অবহিত করালেন । মহাযশস্বী ও ভক্তচূড়ামণি মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন রাজধানীতে ফিরে এসে কিরীট খুলে রেখেছিলেন । নিন্দিত কৃতকর্মের জন্য তখন তিনি অনুতপ্ত । ক্ষণিকের জন্য ক্রোধান্বিত হওয়ায় তিনি নিরপরাধ ও প্রচ্ছন্ন ব্রহ্মতেজসম্পন্ন ব্রাহ্মণের প্রতি যে অনার্যোচিত ব্যবহার করেছেন তা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলল । এমন সময়ে শমীক ঋষি প্রেরিত দূত তাঁকে ব্রহ্ম অভিশাপের কথা নিবেদন করল । অভিশাপ তাঁর মঙ্গলপ্রদ বৈরাগ্যের মূল কারণ হয়ে দাঁড়াল । তিনি ঐহিক সুখ ও স্বর্গসুখ পরিত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম সেবাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ পুরষার্থ জ্ঞানে গঙ্গাতীরে প্রায়োপবেশন করলেন । রমণীয় তুলসী বিমিশ্রিত শ্রীকৃষ্ণচরণরেণুধারী গঙ্গাবারি ত্রিলোকের পবিত্রতা প্রদানকারী ও মৃত্যুপথযাত্রীর পরম আশ্রয়স্থল ।
গঙ্গাতীরে আমরণ অনশনের সংকল্প নিয়ে তিনি সমস্ত বিষয়ে আসক্তি পরিত্যাগ করে শম - দমাদি ব্রতধারণ করে অনন্যচিত্তে শ্রীগোবিন্দ চরণকমল ধ্যানে প্রবৃত্ত হলেন । সেই সময় ত্রিলোকপাবন মহানুভব ঋষিমুনিগণ তাঁদের শিষ্যমণ্ডলীসহ সেই স্থানে সমবেত হলেন । বিশিষ্ট মুনিগণকে সমাবিষ্ট দেখে মহারাজ পরীক্ষিৎ প্রত্যেকের যথাযোগ্য অর্চনা করে ভূলুন্ঠিত হয়ে তাঁদের প্রণাম করলেন । অত্রি , বশিষ্ঠ , চ্যবন , দেবল , ভরদ্বাজ , গৌতম , পিপ্পলাদ , মৈত্রেয় , ব্যাস আদি মহাঋষি পরিশোভিত এই বিশাল সমাবেশে দিব্যজোতি ব্যাসনন্দন ভগবান শুকদেবের আগমন হল । সকলে সেই দিগম্বর অবধূতকে আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন । সকলের দ্বারা সংবর্ধিত হয়ে শুকদেব রাজপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠ আসনে উপবেশন করলেন । সেই মহাসনে উপবিষ্ট হয়ে সুমহান ভগবান শুকদেব ব্রহ্মর্ষি , দেবর্ষি ও রাজর্ষিদের মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে শুক্রাদি গ্রহ , নক্ষত্র ও তারকা পরিবেষ্টিত পূর্ণচন্দ্রের মতন শোভা পেতে লাগলেন । শুকদেব শান্তভাবে আসনে উপবিষ্ট হলে পরম ভাগবত পরীক্ষিৎ তাঁর সম্মুখে এসে ভূলুন্ঠিত হয়ে প্রণাম নিবেদন করলেন । তিনি মহাত্মা শুকদেবের কাছে জানতে চাইলেন যে আসন্ন - মৃত্যু ব্যক্তির করণীয় ও শ্রীকৃষ্ণলাভরূপ পরমসিদ্ধির স্বরূপ ও সাধন কী ? মহাত্মা শুকদেব রাজা পরীক্ষিৎকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই সূত উগ্রশ্রবা পরে শৌনকাদি ঋষিদের যজ্ঞস্থলে শ্রীমদ্ভাগবত রূপে বিতরণ করেছিলেন । গঙ্গাতীরের সেই শুকদেব কথিত শ্রীমদ্ভাগবত শ্রুতিধর সূত্র উগ্রশ্রবা কৃপা করে ভক্তদেন পান করিয়েছিলেন যা আগামী দিনে ভক্তিপথের পথিকদের আকর গ্রন্থ ও মহাপুরাণরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছিল ।
গঙ্গাতীরে গীত শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ , যমুনাতীরে অভিনীত শ্রীকৃষ্ণের অনুপম লীলার বিবরণে সমৃদ্ধ । আবার যদি আমরা সেই সৃষ্টির স্থান অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই তবে দেখব যে তা ব্যাসদেব দ্বারা সরস্বতী নদীর তীরে সৃষ্ট । তাই শ্রীমদ্ভাগবতে ত্রিবেণী সঙ্গমের মহিমা বর্তমান । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বৃন্দাবনলীলার শেষে মথুরা গমনের সময়ে তাঁর ভক্ত গোপিনীদের কথা দিয়েছিলেন যে তিনি লীলার সমাপনে আবার তাঁদের কাছে ফিরে আসবেন । তাই শোনা যায় যে দ্বারকালীলা অবসানে তিনি বৈকুন্ঠে গমন না করে শ্রীমদ্ভাগবতে লীন হয়ে গিয়েছিলেন । তাই শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীহরির বাঙ্ময় শরীররূপে ভক্তদের কাছে পূজার্চনা পেয়ে থাকে । দ্বাদশ স্কন্ধবিশিষ্ট শ্রীমদ্ভাগবতকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গিরিধারী রূপে দেখা হয়ে থাকে । গিরিধারী রূপে আমরা দেখে থাকি যে শ্রীভগবানের দক্ষিণ হস্ত কটিতে থাকলেও বাম হস্ত সব থেকে উপরে গিরিগোবর্ধন ধারণ করে আছে । তাই দ্বাদশ স্কন্ধযুক্ত শ্রীমদ্ভাগবতের এক একটি স্কন্ধকে শ্রীভগবানের দেব শরীরের এক এক অঙ্গরূপে গণনা করা হয় । প্রথম থেকে দ্বাদশ স্কন্ধ তাই শ্রীভগবানের যথাক্রমে দক্ষিণ পাদ , বাম পাদ , দক্ষিণ ঊরুদেশ , বাম ঊরুদেশ , দক্ষিণ কটিদেশ , বাম কটিদেশ , দক্ষিণ হস্ত , দক্ষিণ স্কন্ধ , বাম স্কন্ধ , হৃদয় , ললাট ও বামহস্ত রূপে পরিচিত । তাই দ্বাদশাঙ্গ শ্রীমদ্ভাগবত শ্রীভগবান স্বয়ং - যাঁর অন্তঃকরণ হল দশম স্কন্ধ । অষ্টাদশ সহস্র শ্লোকবিশিষ্ট এই মহাপুরাণে আছে ৩৩৫ অধ্যায় । সর্বত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পূর্ণ মহিমায় বর্তমান । তাই এর স্পর্শলাভ করলেই পবিত্রতা অর্জন সুনিশ্চিত ।
ভাগবত- ভক্ত - ভগবান এক ও অভিন্ন । এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত শ্রীভগবানের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে ---
সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।। ( ৯\৪\৬৮ )
' আমার প্রেমী ভক্ত আমার হৃদয় এবং সেই প্রেমী ভক্তদের হৃদয় আমি স্বয়ং । তারা আমাকে ছাড়া আর কিছু জানে না আর আমিও তাদের ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না । '
বিশাল শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণের আদি ও অন্তে আমরা দেখি ' সত্য পরং ধীমহি ' - অর্থাৎ পরমসত্যরূপে পরমাত্মাকে আমরা ধ্যান করি । তাই এই আকর গ্রন্থের মূল বক্তব্য - পরমেশ্বর সত্যস্বরূপ , যা সর্বত্র গীত হয়েছে । তাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল - শ্রীভগবান ছাড়া জগতে আর কিছুই নেই । তিনি ' সর্বভূতানাং হৃদ্দেশে তিষ্ঠতি ' নিজে বলেছেন ।
যত্র যোগশ্বর কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতির্ধ্রুবা নীতির্মতির্মম ।। ( ১৮ \ ৭৮ )
তাই মানবজন্ম সফল করতে প্রয়োজন ভগবৎকৃপা ও পুরুষকার যা তাঁর কৃপাতেই লাভ করা সম্ভব । তাই শ্রীভগবানকে বারে বারে প্রণাম নিবেদন করা । মনে রাখতে হবে প্রণামে জ্ঞানযোগ ( মস্তকের ) , কর্মযোগ ( হস্তের ) ও ভক্তিযোগের ( চিত্তের ) সমন্বয় হয়ে থাকে । মস্তক অবনত হয় , হস্তদ্বয় যুক্ত হয় আর চিত্ত প্রণত হয় । তাই যোগেশ্বরকে স্মরণ যোগত্রয়ের সমন্বয়েই হয়ে থাকে ।
মহাত্মা শুকদেবের কাছে শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করে মহাভাগবত পরীক্ষিৎ যোগরূঢ় হয়ে সপ্তম দিবসান্তে তক্ষক দংশনে ভস্ম হয়ে শ্রীভগবানের সঙ্গে মিলিত হয়ে গিয়েছিলেন । পরীক্ষিৎ পরম ভাগ্যবান ছিলেন কারণ তিনি জানতেন যে তিনি মাত্র সাত দিন বেঁচে থাকবেন , অন্য কোনো জীব তা জানতে পারে না । শ্রীমদ্ভাগবতই তাঁকে মুক্তির পথে নিয়ে গিয়েছে যা আমাদের পক্ষে দৃষ্টান্তস্বরূপ । জয় - বিজয়কে উদ্ধার করবার জন্য তিনি অবতাররূপে তিনবার এই পৃথিবীতে এসেছিলেন । ভক্তের জন্য তিনি সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন । তিনি চান ভক্ত যেন তাকে মনে রাখে ।
।। ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায় ।।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
1 Comments:
খুব ভালো লাগলো।
জয় রাধে। ❤🙏🙏🙏
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন