এষ বৈ ভগবান্ সাক্ষাদাদ্যো নারায়ণঃ পুমান্ ।
মোহয়ন্মায়য়া লোকং গূঢ়শ্চরতি বৃষ্ণিষু ।। ( ভাগবত ১\৯\১৮ )
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে । শ্রীভগবানের কৃপায় পাণ্ডবগণ যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন । কিন্তু সেই জয়লাভে আনন্দ নেই । ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন । চতুর্দিকে স্বজন বিয়োগ এবং অসংখ্য মৃত্যু তাঁকে এই প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে - ' এত বিনাশের কারণ হলাম ? এত অক্ষৌহিণী সৈন্য বধ করে রাজসূয় ভোগ প্রয়োজন ছিল কী ? ' তাঁর মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে নরক - বাস করেও তাঁর নিষ্কৃতি নেই । যদিও শাস্ত্র অনুসারে প্রজা পালনের জন্য রাজার ধর্মযুদ্ধে পাপ না হওয়ার কথা বলা হয় , তবুও শাস্ত্রবচন ধর্মরাজকে বিষাদগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছিল না । যুুদ্ধের পরিণাম এত ভয়াবহ তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে ধর্মরাজ বুঝতে পারেননি ।
ধর্মরাজের বিষাদে সকলেই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ত্রিকালদর্শী ঋষিগণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বিরত করবার জন্য উপদেশাদি দিলেন , কিন্তু তারও সুফল দেখা গেল না । তখন সকলে মিলে ঠিক করলেন যে ধর্মরাজের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ও তত্ত্ববিদ্ ভীষ্মের কাছে যাওয়াই শ্রেয় । ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব জানলে সকলের সন্দেহ দূর হবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন । তাই পিতামহ ভীষ্মের কাছে যেতে ধর্মরাজ রাজি হয়ে গেলেন ।
স্বর্ণালংকারে সজ্জিত উত্তম অশ্বযুক্ত রথে আরোহণ করে পাণ্ডবগণ ধর্মরাজের অনুগমন করলেন । তাঁদের সঙ্গে ব্যাস , ধৌম্য আদিও গেলেন । ভীষ্মের কাছে উপদেশের জন্য গমন প্রসঙ্গে একটা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং উপস্থিত থাকতে ভীষ্মের উপদেশ কেন দরকার হয়ে পড়ল ? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথায় যার জ্ঞান হয় না তার জ্ঞান হবে ভীষ্মের উপদেশে ! এই প্রসঙ্গে আরও এক সঙ্গত প্রশ্ন - স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভীষ্মের কাছে যেতে চাইলেন ? বস্তুত শ্রীভগবানের লীলার তাৎক্ষণিক বিচার করলে প্রকৃত উদ্দেশ্য জানা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না । অতএব শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে রথে করে তাঁদের অনুগমন করলেন ।
পান্ডবগণ শ্রীকৃষ্ণ ও অনুচরদের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে উপনীত হয়ে দেখলেন যে পিতামহ ভীষ্ম সেখানে স্বর্গ থেকে পতিত দেবতার ন্যায় শায়িত রয়েছেন । তাঁরা পিতামহকে প্রণাম করলেন । তখন ভরককুলতিলক ভীষ্মকে দর্শন করবার জন্য সমস্ত ব্রহ্মর্ষি , দেবর্ষি ও রাজর্ষিদেরও আগমন হয়েছিল । পিতামহ ভীষ্ম তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । সেইসকল মহান ঋষিদের উপস্থিত হতে দেখে তিনি তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান করলেন । শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং শ্রীভগবান , পিতামহ তা সম্যকভাবে জানতেন । তাই লীলায় নররূপে তথায় উপবিষ্ট ও শ্রীভগবানরূপে অন্তরে বিরাজমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তিনি অন্তরে ও বাইরে উভয়ভাবেই পূজা করলেন ।
ভীষ্ম পিতামহ পান্ডবদের বলতে লাগলেন - ' ধর্মপুত্র পাণ্ডবগণ ! তোমরা ব্রাহ্মণ , ধর্ম ও শ্রীকৃষ্ণ আশ্রিত , কষ্টকর জীবনযাপন করতে তোমরা বাধ্য হয়েছ যা তোমাদের জন্য উপযুক্ত নয় । এ বড় দুঃখ ও পরিতাপের কথা । '
পান্ডবগণ বিষণ্নবদনে ভীষ্মের কাছে বসে রয়েছেন । ভীষ্ম আবার বললেন - ' শ্রীভগবানের লীলা বুঝতে পারা কঠিন । তাঁর নাম স্মরণ করলেই যেখানে সর্বদুঃখের অবসান হয় সেই শ্রীভগবান সঙ্গে অথচ তোমাদের দুঃখ নিবারণ হচ্ছে না । আমরা ধারণা যে তোমাদের জীবনে যা কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে এ সবই তাঁর লীলামাত্র । নাহলে যেখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির , গদাযুদ্ধে নিপুণ ভীম , অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী গাণ্ডিবধারী অর্জুন এবং পরমবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বর্তমান , সেখানেও বিপদ আসে - এ অতি আশ্চর্যের কথা ! সকল সুখের কারণ উপস্থিত থাকলেও তোমাদের দুঃখের নিবৃত্তি হচ্ছে না , এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে !
এই শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান । সকলের আদি কারণ ও পরমপুরুষ নারায়ণ । কিন্তু মায়াবলে জগৎকে মোহিত করে যদুকুলে অবতীর্ণ হয়ে লীলা করছেন । এঁর মহাপ্রভাব অগম্য ও রহস্যময় , তা কেবল ভগবান শংকর , দেবর্ষি নারদ ও স্বয়ং ভগবান কপিলই জানেন । তোমাদেন মাতুল সম্পর্কিত ভ্রাতা , প্রিয় মিত্র ও হিতৈষী - যাঁকে তোমরা মন্ত্রী , কখনো দূত আবার কখনো সারথি করতেও ইতস্তত করনি , তিনি আসলে স্বয়ং পরমাত্মা ।
এই সর্বাত্মা , সমদর্শী অদ্বিতীয় , নিরহংকার এবং নিষ্পাপ পরমাত্মাতে ছোটবড় কোনো কার্যেরই শ্রেণীবিন্যাস নেই । এইরূপ সর্বত্র সমভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনন্যপ্রেমী ভক্তদের প্রতি তাঁর কী অসীম কৃপা ! এঁর নাম কামনাবাসনা ও কর্মবন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তিপ্রদান করে থাকে । ইনি দেবাদিদেব শ্রীভগবান যাঁর প্রসন্ন চতুর্ভুজ রূপ দর্শন কেবল ধ্যানযোগেই হয় । আমরা একান্ত প্রার্থনা যে তিনি যেন আমার দেহত্যাগ পর্যন্ত আমার কাছে উপস্থিত থাকেন । '
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মের উপদেশ শুনে সমবেত ঋষিগণের সম্মুখেই ধর্মবিষয়ে নানবিধ প্রশ্ন করলেন । তত্ত্বজ্ঞ ভীষ্ম তখন বর্ণাশ্রম স্বীকৃত স্বাভাবিক ধর্ম এবং বৈরাগ্যরূপ নিবৃত্তিমার্গ ও আসক্তিরূপ প্রবৃত্তিমার্গ , দানধর্ম , রাজধর্ম , মোক্ষধর্ম , স্ত্রীধর্ম ও ভগবদ্ ধর্ম তাঁকে বুুঝিয়ে বললেন ।এরই সঙ্গে তিনি ধর্ম , অর্থ , কাম ও মোক্ষ বিষয়ে উপদেশ দিলেন ।
ভীষ্মের ধর্ম ব্যাখ্যা শুনে যুধিষ্ঠিরের সকল সংশয়ের অবসান হল । পিতামহ ভীষ্ম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সোজা কথায় বুঝিয়ে দিলেন যে পাণ্ডবদের বন্ধু শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রেমে বশীভূত আর পাণ্ডবদেরও তাঁর উপর প্রেমপ্রীতি কম নয় । পাণ্ডবদের পিতামহ বলেই তিনি কৃপা করে মৃত্যুর সময় এসেছেন । মৃত্যুকালে স্বয়ং শ্রীভগবানের দর্শন লাভ করা তো অতি সৌভাগ্যের কথা ।
ধর্ম প্রসঙ্গে কয়েকদিন কাটল এবং উত্তরায়ণকাল উপস্থিত হল । তাঁর দেহত্যাগের কাল সমাগত দেখে পিতামহ ভীষ্ম তখন অপলক নয়নে শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে দেখতে তাঁতে চিত্ত সমর্পণ করে তাঁর স্তবস্তুতি করতে লাগলেন ।
ভীষ্ম বলতে লাগলেন - ' আমার শুদ্ধ ও নিরামক্ত বুদ্ধি আমি যদুকুল শিরোমণি অনন্ত শক্তির আধার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সমর্পণ করছি । তাঁর যোগমায়া দ্বারাই সমগ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে । শ্রীকৃষ্ণে আমার তৃষ্ণারহিত , কামনারহিত চিত্তবৃত্তি নিবেদন করছি । '
ত্রিলোকে যে শ্রীকৃষ্ণের রূপ কাম্য সেই তমাল সদৃশ নীলবর্ণ , সূর্যকিরণ সদৃশ উজ্জ্বল পীতবসন পরিবৃত , মুখপদ্ম যাঁর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত কেশ দ্বারা অলংকৃত সেই অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণে আমার অকপট মতি হোক ।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রের সেই সত্যপ্রতিজ্ঞ , সত্যব্রত , পরমজ্ঞানী ও পরমযোদ্ধা শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিরূপে আমার চিত্তে অঙ্কিত হয়ে আছেন । তাঁর মুখমণ্ডলে বিক্ষিপ্ত অলকরাজি যুদ্ধক্ষেত্রের ধূলিতে মলিন হয়ে গিয়েছিল আর তাঁর মুখমণ্ডলে শ্রমজনিত ঘর্মবিন্দুর অপূর্ব শোভা ছিল । সেই সুন্দর বর্মপরিহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার দেহ , মন ও আত্মা সমর্পিত হোক ।
নিজসখা অর্জুনের কথা স্বীকার করে যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে উভয় পক্ষের সৈন্যের মধ্যে রথ স্থাপন করে নিজ দৃষ্টিদ্বারা শত্রুপক্ষের আয়ু হরণ করেছিলেন , সেই পার্থসখী ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
শত্রুসৈন্যদের মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে দেখে স্বজন বধে ভীত অর্জুনকে যিনি গীতারূপে আত্মবিদ্যা উপদেশ দান করে তার সাময়িক অজ্ঞানতা দূর করেছিলেন , সেই পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আমার পরমানুরক্তি হোক । মৃত্যুকালে সারূপ্য দান শ্রীভগবানের অনন্ত কৃপা ।
আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য যিনি ( ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ) নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে রথচক্র ধারণ করেছিলেন , তখনও তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ ও ভক্তবাৎসল্যে পরিপূর্ণ ছিলেন , তিনিই আমার একমাত্র গতি , আশ্রয় হোন ।
অর্জুনের রথের রক্ষণে সর্তক বাম হস্তে ঘোড়ার রাশ ও দক্ষিণ হস্তে চাবুক ধারণকারী যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অপূর্ব রূপ ধারণ করেছিলেন সেই পার্থসারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
যাঁর সুন্দর গমন , পরিহাসবাক্য , মধুর হাস্য , সপ্রেম কৃপাকটাক্ষ দান দ্বারা পরম পূজনীয়া গোপীগণ রাসলীলার মধ্যে তাঁর অন্তর্ধানে মহাপ্রেম- বিকারগ্রস্ত হয়ে লীলার অনুকরণে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকালে শ্রেষ্ঠ মুনিঋষ্ণিগণ ও রাজাগণ উপস্থিত ছিলেন । সেই সভা মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব শ্রীকৃষ্ণকে অর্ঘ্যদানের ঘটনা আমি দেখেছি । শ্রীকৃষ্ণ সকলের আত্মা ও প্রভু । সকলেই শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব মূর্তি দর্শন করে তাঁর পূজা করেছিলেন । সেই পরমাত্মা আজ আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন । আমি কৃতকৃতার্থ ।
আকাশের সূর্য যেমন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত , তেমন ভাবেই জন্মমৃত্যুরহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ সৃষ্ট বিভিন্ন দেহীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত । প্রকৃতপক্ষে তিনি এক এবং অভিন্ন - সকল জীবের মধ্যেই বিরাজমান । আমি সম্যকরূপে অনুভব করেছি যে জন্মরহিত পরমাত্মাই হচ্ছেন এই শ্রীকৃষ্ণ । সকল জীবের হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে তিনিই বিরাজমান ।
হে ভগবান ! আপনার কৃপায় আজ আমি মোহমুক্ত , আপনার অনন্ত প্রকাশ ও অনন্ত মূর্তিতে কোনো ভেদ নেই । আপনিই যে অচিন্ত্য মহাশক্তির বলে নানারূপে আত্মপ্রকাশ করেন , তা আমি জেনেছি ।
পিতামহ ভীষ্ম এইভাবে অন্তরে কৃষ্ণধ্যান , মুখে কৃষ্ণগুণকীর্তন ও নয়নে কৃষ্ণরূপ দর্শন করতে করতে নিজেকে আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানে লীন করে দিলেন । তাঁর স্বরূপ লীলাময় শ্রীকৃষ্ণরে সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল । পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছা পূর্ণ হল । যুধিষ্ঠিরের মনে স্বজন বধের যে গ্লানি উপস্থিত হয়েছিল তা ভীষ্মের উপদেশে অপসৃত হল । মহাজ্ঞানী অষ্টবসুর অন্যতম পিতামহ ভীষ্মের নয়নযুগল অশ্রুসজল কেন হয়ে উঠেছিল তা ভক্তগণ জেনে কৃতকৃত্য হয়ে গেলেন । পিতামহ মৃত্যুকালে শ্রীভগবানকে চিনিয়ে দিয়ে গেলেন ।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
মোহয়ন্মায়য়া লোকং গূঢ়শ্চরতি বৃষ্ণিষু ।। ( ভাগবত ১\৯\১৮ )
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে । শ্রীভগবানের কৃপায় পাণ্ডবগণ যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন । কিন্তু সেই জয়লাভে আনন্দ নেই । ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন । চতুর্দিকে স্বজন বিয়োগ এবং অসংখ্য মৃত্যু তাঁকে এই প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে - ' এত বিনাশের কারণ হলাম ? এত অক্ষৌহিণী সৈন্য বধ করে রাজসূয় ভোগ প্রয়োজন ছিল কী ? ' তাঁর মনে হল যেন অনন্তকাল ধরে নরক - বাস করেও তাঁর নিষ্কৃতি নেই । যদিও শাস্ত্র অনুসারে প্রজা পালনের জন্য রাজার ধর্মযুদ্ধে পাপ না হওয়ার কথা বলা হয় , তবুও শাস্ত্রবচন ধর্মরাজকে বিষাদগ্রস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হচ্ছিল না । যুুদ্ধের পরিণাম এত ভয়াবহ তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে ধর্মরাজ বুঝতে পারেননি ।
ধর্মরাজের বিষাদে সকলেই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ত্রিকালদর্শী ঋষিগণ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বিরত করবার জন্য উপদেশাদি দিলেন , কিন্তু তারও সুফল দেখা গেল না । তখন সকলে মিলে ঠিক করলেন যে ধর্মরাজের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে শরশয্যায় শায়িত সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ও তত্ত্ববিদ্ ভীষ্মের কাছে যাওয়াই শ্রেয় । ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব জানলে সকলের সন্দেহ দূর হবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন । তাই পিতামহ ভীষ্মের কাছে যেতে ধর্মরাজ রাজি হয়ে গেলেন ।
স্বর্ণালংকারে সজ্জিত উত্তম অশ্বযুক্ত রথে আরোহণ করে পাণ্ডবগণ ধর্মরাজের অনুগমন করলেন । তাঁদের সঙ্গে ব্যাস , ধৌম্য আদিও গেলেন । ভীষ্মের কাছে উপদেশের জন্য গমন প্রসঙ্গে একটা স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং উপস্থিত থাকতে ভীষ্মের উপদেশ কেন দরকার হয়ে পড়ল ? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথায় যার জ্ঞান হয় না তার জ্ঞান হবে ভীষ্মের উপদেশে ! এই প্রসঙ্গে আরও এক সঙ্গত প্রশ্ন - স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভীষ্মের কাছে যেতে চাইলেন ? বস্তুত শ্রীভগবানের লীলার তাৎক্ষণিক বিচার করলে প্রকৃত উদ্দেশ্য জানা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না । অতএব শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে রথে করে তাঁদের অনুগমন করলেন ।
পান্ডবগণ শ্রীকৃষ্ণ ও অনুচরদের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে উপনীত হয়ে দেখলেন যে পিতামহ ভীষ্ম সেখানে স্বর্গ থেকে পতিত দেবতার ন্যায় শায়িত রয়েছেন । তাঁরা পিতামহকে প্রণাম করলেন । তখন ভরককুলতিলক ভীষ্মকে দর্শন করবার জন্য সমস্ত ব্রহ্মর্ষি , দেবর্ষি ও রাজর্ষিদেরও আগমন হয়েছিল । পিতামহ ভীষ্ম তাঁর কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন । সেইসকল মহান ঋষিদের উপস্থিত হতে দেখে তিনি তাঁদের যথাযোগ্য সম্মান করলেন । শ্রীকৃষ্ণ যে স্বয়ং শ্রীভগবান , পিতামহ তা সম্যকভাবে জানতেন । তাই লীলায় নররূপে তথায় উপবিষ্ট ও শ্রীভগবানরূপে অন্তরে বিরাজমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তিনি অন্তরে ও বাইরে উভয়ভাবেই পূজা করলেন ।
ভীষ্ম পিতামহ পান্ডবদের বলতে লাগলেন - ' ধর্মপুত্র পাণ্ডবগণ ! তোমরা ব্রাহ্মণ , ধর্ম ও শ্রীকৃষ্ণ আশ্রিত , কষ্টকর জীবনযাপন করতে তোমরা বাধ্য হয়েছ যা তোমাদের জন্য উপযুক্ত নয় । এ বড় দুঃখ ও পরিতাপের কথা । '
পান্ডবগণ বিষণ্নবদনে ভীষ্মের কাছে বসে রয়েছেন । ভীষ্ম আবার বললেন - ' শ্রীভগবানের লীলা বুঝতে পারা কঠিন । তাঁর নাম স্মরণ করলেই যেখানে সর্বদুঃখের অবসান হয় সেই শ্রীভগবান সঙ্গে অথচ তোমাদের দুঃখ নিবারণ হচ্ছে না । আমরা ধারণা যে তোমাদের জীবনে যা কিছু অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে এ সবই তাঁর লীলামাত্র । নাহলে যেখানে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির , গদাযুদ্ধে নিপুণ ভীম , অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী গাণ্ডিবধারী অর্জুন এবং পরমবান্ধব শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বর্তমান , সেখানেও বিপদ আসে - এ অতি আশ্চর্যের কথা ! সকল সুখের কারণ উপস্থিত থাকলেও তোমাদের দুঃখের নিবৃত্তি হচ্ছে না , এর চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় আর কী হতে পারে !
এই শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ ভগবান । সকলের আদি কারণ ও পরমপুরুষ নারায়ণ । কিন্তু মায়াবলে জগৎকে মোহিত করে যদুকুলে অবতীর্ণ হয়ে লীলা করছেন । এঁর মহাপ্রভাব অগম্য ও রহস্যময় , তা কেবল ভগবান শংকর , দেবর্ষি নারদ ও স্বয়ং ভগবান কপিলই জানেন । তোমাদেন মাতুল সম্পর্কিত ভ্রাতা , প্রিয় মিত্র ও হিতৈষী - যাঁকে তোমরা মন্ত্রী , কখনো দূত আবার কখনো সারথি করতেও ইতস্তত করনি , তিনি আসলে স্বয়ং পরমাত্মা ।
এই সর্বাত্মা , সমদর্শী অদ্বিতীয় , নিরহংকার এবং নিষ্পাপ পরমাত্মাতে ছোটবড় কোনো কার্যেরই শ্রেণীবিন্যাস নেই । এইরূপ সর্বত্র সমভাবাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও তাঁর অনন্যপ্রেমী ভক্তদের প্রতি তাঁর কী অসীম কৃপা ! এঁর নাম কামনাবাসনা ও কর্মবন্ধন থেকে চিরতরে মুক্তিপ্রদান করে থাকে । ইনি দেবাদিদেব শ্রীভগবান যাঁর প্রসন্ন চতুর্ভুজ রূপ দর্শন কেবল ধ্যানযোগেই হয় । আমরা একান্ত প্রার্থনা যে তিনি যেন আমার দেহত্যাগ পর্যন্ত আমার কাছে উপস্থিত থাকেন । '
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মের উপদেশ শুনে সমবেত ঋষিগণের সম্মুখেই ধর্মবিষয়ে নানবিধ প্রশ্ন করলেন । তত্ত্বজ্ঞ ভীষ্ম তখন বর্ণাশ্রম স্বীকৃত স্বাভাবিক ধর্ম এবং বৈরাগ্যরূপ নিবৃত্তিমার্গ ও আসক্তিরূপ প্রবৃত্তিমার্গ , দানধর্ম , রাজধর্ম , মোক্ষধর্ম , স্ত্রীধর্ম ও ভগবদ্ ধর্ম তাঁকে বুুঝিয়ে বললেন ।এরই সঙ্গে তিনি ধর্ম , অর্থ , কাম ও মোক্ষ বিষয়ে উপদেশ দিলেন ।
ভীষ্মের ধর্ম ব্যাখ্যা শুনে যুধিষ্ঠিরের সকল সংশয়ের অবসান হল । পিতামহ ভীষ্ম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সোজা কথায় বুঝিয়ে দিলেন যে পাণ্ডবদের বন্ধু শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রেমে বশীভূত আর পাণ্ডবদেরও তাঁর উপর প্রেমপ্রীতি কম নয় । পাণ্ডবদের পিতামহ বলেই তিনি কৃপা করে মৃত্যুর সময় এসেছেন । মৃত্যুকালে স্বয়ং শ্রীভগবানের দর্শন লাভ করা তো অতি সৌভাগ্যের কথা ।
ধর্ম প্রসঙ্গে কয়েকদিন কাটল এবং উত্তরায়ণকাল উপস্থিত হল । তাঁর দেহত্যাগের কাল সমাগত দেখে পিতামহ ভীষ্ম তখন অপলক নয়নে শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে দেখতে তাঁতে চিত্ত সমর্পণ করে তাঁর স্তবস্তুতি করতে লাগলেন ।
ভীষ্ম বলতে লাগলেন - ' আমার শুদ্ধ ও নিরামক্ত বুদ্ধি আমি যদুকুল শিরোমণি অনন্ত শক্তির আধার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে সমর্পণ করছি । তাঁর যোগমায়া দ্বারাই সমগ্র সৃষ্টি হয়ে থাকে । শ্রীকৃষ্ণে আমার তৃষ্ণারহিত , কামনারহিত চিত্তবৃত্তি নিবেদন করছি । '
ত্রিলোকে যে শ্রীকৃষ্ণের রূপ কাম্য সেই তমাল সদৃশ নীলবর্ণ , সূর্যকিরণ সদৃশ উজ্জ্বল পীতবসন পরিবৃত , মুখপদ্ম যাঁর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কুঞ্চিত কেশ দ্বারা অলংকৃত সেই অর্জুনসখা শ্রীকৃষ্ণে আমার অকপট মতি হোক ।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রের সেই সত্যপ্রতিজ্ঞ , সত্যব্রত , পরমজ্ঞানী ও পরমযোদ্ধা শ্রীকৃষ্ণ মূর্তিরূপে আমার চিত্তে অঙ্কিত হয়ে আছেন । তাঁর মুখমণ্ডলে বিক্ষিপ্ত অলকরাজি যুদ্ধক্ষেত্রের ধূলিতে মলিন হয়ে গিয়েছিল আর তাঁর মুখমণ্ডলে শ্রমজনিত ঘর্মবিন্দুর অপূর্ব শোভা ছিল । সেই সুন্দর বর্মপরিহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার দেহ , মন ও আত্মা সমর্পিত হোক ।
নিজসখা অর্জুনের কথা স্বীকার করে যিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে উভয় পক্ষের সৈন্যের মধ্যে রথ স্থাপন করে নিজ দৃষ্টিদ্বারা শত্রুপক্ষের আয়ু হরণ করেছিলেন , সেই পার্থসখী ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
শত্রুসৈন্যদের মধ্যে আত্মীয়স্বজনকে দেখে স্বজন বধে ভীত অর্জুনকে যিনি গীতারূপে আত্মবিদ্যা উপদেশ দান করে তার সাময়িক অজ্ঞানতা দূর করেছিলেন , সেই পরমপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আমার পরমানুরক্তি হোক । মৃত্যুকালে সারূপ্য দান শ্রীভগবানের অনন্ত কৃপা ।
আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য যিনি ( ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ) নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে রথচক্র ধারণ করেছিলেন , তখনও তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ ও ভক্তবাৎসল্যে পরিপূর্ণ ছিলেন , তিনিই আমার একমাত্র গতি , আশ্রয় হোন ।
অর্জুনের রথের রক্ষণে সর্তক বাম হস্তে ঘোড়ার রাশ ও দক্ষিণ হস্তে চাবুক ধারণকারী যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অপূর্ব রূপ ধারণ করেছিলেন সেই পার্থসারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
যাঁর সুন্দর গমন , পরিহাসবাক্য , মধুর হাস্য , সপ্রেম কৃপাকটাক্ষ দান দ্বারা পরম পূজনীয়া গোপীগণ রাসলীলার মধ্যে তাঁর অন্তর্ধানে মহাপ্রেম- বিকারগ্রস্ত হয়ে লীলার অনুকরণে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলেন সেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণে আমার পরম প্রীতি হোক ।
যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকালে শ্রেষ্ঠ মুনিঋষ্ণিগণ ও রাজাগণ উপস্থিত ছিলেন । সেই সভা মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব শ্রীকৃষ্ণকে অর্ঘ্যদানের ঘটনা আমি দেখেছি । শ্রীকৃষ্ণ সকলের আত্মা ও প্রভু । সকলেই শ্রীকৃষ্ণের অপূর্ব মূর্তি দর্শন করে তাঁর পূজা করেছিলেন । সেই পরমাত্মা আজ আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন । আমি কৃতকৃতার্থ ।
আকাশের সূর্য যেমন বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত , তেমন ভাবেই জন্মমৃত্যুরহিত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজ সৃষ্ট বিভিন্ন দেহীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিভাত । প্রকৃতপক্ষে তিনি এক এবং অভিন্ন - সকল জীবের মধ্যেই বিরাজমান । আমি সম্যকরূপে অনুভব করেছি যে জন্মরহিত পরমাত্মাই হচ্ছেন এই শ্রীকৃষ্ণ । সকল জীবের হৃদয়ে অন্তর্যামীরূপে তিনিই বিরাজমান ।
হে ভগবান ! আপনার কৃপায় আজ আমি মোহমুক্ত , আপনার অনন্ত প্রকাশ ও অনন্ত মূর্তিতে কোনো ভেদ নেই । আপনিই যে অচিন্ত্য মহাশক্তির বলে নানারূপে আত্মপ্রকাশ করেন , তা আমি জেনেছি ।
পিতামহ ভীষ্ম এইভাবে অন্তরে কৃষ্ণধ্যান , মুখে কৃষ্ণগুণকীর্তন ও নয়নে কৃষ্ণরূপ দর্শন করতে করতে নিজেকে আত্মস্বরূপ শ্রীভগবানে লীন করে দিলেন । তাঁর স্বরূপ লীলাময় শ্রীকৃষ্ণরে সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল । পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছা পূর্ণ হল । যুধিষ্ঠিরের মনে স্বজন বধের যে গ্লানি উপস্থিত হয়েছিল তা ভীষ্মের উপদেশে অপসৃত হল । মহাজ্ঞানী অষ্টবসুর অন্যতম পিতামহ ভীষ্মের নয়নযুগল অশ্রুসজল কেন হয়ে উঠেছিল তা ভক্তগণ জেনে কৃতকৃত্য হয়ে গেলেন । পিতামহ মৃত্যুকালে শ্রীভগবানকে চিনিয়ে দিয়ে গেলেন ।
Courtesy by: Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন