শ্রীভগবান্উবাচ—
ভূয় এব মহাবাহো শৃণু মে পরমং বচঃ ।যত্তেঽহং প্রীয়মাণায় বক্ষ্যামি হিতকাম্যয়া ॥১॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর অর্জ্জুন !) ভূয়ঃ এব (পুনরায়) মে (আমার) পরমং (উৎকৃষ্ট) বচঃ (বাক্য) শৃণু (শ্রবণ কর) । যৎ (যেহেতু) প্রীয়মাণায় (প্রেমবান্) তে (তোমাকে) অহম্ (আমি) হিতকাম্যয়া (হিতকামনায়) বক্ষ্যামি (বলিব) ॥১॥
শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে মহাবাহো ! পুনর্ব্বার আমার উত্তম বাক্য শ্রবণ কর । যেহেতু প্রিয়পাত্র তোমাকে আমি তোমার মঙ্গল কামনা করিয়াই ইহা বলিব ॥১॥
ন মে বিদুঃ সুরগণাঃ প্রভবং ন মহর্ষয়ঃ । অহমাদির্হি দেবানাং মহর্ষীণাঞ্চ সর্ব্বশঃ ॥২॥ |
সুরগণাঃ (দেবতাগণ) মে (আমার) প্রভবং (সর্ব্বোত্তম বা সর্ব্ববিলক্ষণ জন্ম) ন বিদুঃ (জানেন না), মহর্ষয়ঃ ন (মহর্ষিগণও জানেন না) । হি (যেহেতু) অহম্ (আমি) দেবানাং (দেবতাদিগের) মহর্ষীণাং চ (ও মহর্ষিগণের) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বপ্রকারেই) আদিঃ (আদি কারণস্বরূপ) ॥২॥
সমস্ত দেবতাগণ আমার প্রকৃষ্ট বা সর্ব্ববিলক্ষণ জন্ম জানেন না, মহর্ষিগণও জানেন না । যেহেতু আমি দেবতাদিগের ও মহর্ষিগণের সর্ব্বপ্রকারেই আদি কারণ ॥২॥
যো মামজমনাদিঞ্চ বেত্তি লোকমহেশ্বরম্ । অসংমূঢ়ঃ স মর্ত্ত্যেষু সর্ব্বপাপৈঃ প্রমুচ্যতে ॥৩॥ |
যঃ (যিনি) মাম্ (দেবকী পুত্ত্র আমাকে) অজম্ (জন্মরহিত) অনাদিং (কারণ রহিত) লোকমহেশ্বরম্ চ (ও ভূত সকলের মহান্ ঈশ্বর বলিয়া) বেত্তি (জানেন), সঃ (তিনি) মর্ত্ত্যেষু (মনুষ্যগণের মধ্যে) অসংমূঢ়ঃ (মোহ বর্জ্জিত হইয়া) সর্ব্বপাপৈঃ (ভক্তিবিরোধী সমস্ত পাপ হইতে) প্রমুচ্যতে (মুক্ত হন) ॥৩॥
যিনি দেবকী পুত্ত্ররূপে জাত আমাকে, জন্মরহিত সর্ব্বাদি ও ভূতসকলের মহান্ ঈশ্বর বলিয়া জানেন, তিনিই সমস্ত মনুষ্যলোকের মধ্যে সম্যক্ মোহরহিত হইয়া পাপ সমুদয় হইতে মুক্ত হইয়া থাকেন ॥৩॥
বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ । সুখং দুঃখং ভবোঽভাবো ভয়ঞ্চাভয়মেব চ ॥৪॥ অহিংসা সমতা তুষ্টিস্তপো দানং যশোঽযশঃ । ভবন্তি ভাবা ভূতানাং মত্ত এব পৃথগ্বিধাঃ ॥৫॥ |
বুদ্ধিঃ (সূক্ষ্মার্থনিশ্চয় সামর্থ্য), জ্ঞানম্ (আত্মা অনাত্ম বিবেক), অসংমোহঃ (ব্যগ্রতার অভাব), ক্ষমা (সহিষ্ণুতা), সত্যং (যথার্থ ভাষণ), দমঃ (বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম), শমঃ (অন্তরিন্দ্রিয় সংযম), সুখং (সুখ), দুঃখং (দুঃখ), ভবঃ (জন্ম), অভাবঃ (মৃত্যু), ভয়ং চ (ভয়), অভয়ং এব চ (এবং অভয়) ; অহিংসা (অহিংসা) সমতা (নিজের তুলনায় সর্ব্বত্র সুখ দুঃখ দর্শন), তুষ্টিঃ (সন্তোষ), তপঃ (বেদোক্ত কায়ক্লেশ), দানং (দান), যশঃ (সুখ্যাতি) অযশঃ [চ] (ও অখ্যাতি) ভূতানাং (প্রাণিবর্গের) [এতে] (এই সমস্ত) পৃথগ্বিধাঃ (নানাপ্রকার) ভাবাঃ (ভাব) মত্তঃ এব (আমা হইতেই) ভবন্তি (উৎপন্ন হইয়া থাকে ) ॥৪–৫॥
বুদ্ধি, জ্ঞান, অব্যাকুলতা, ক্ষমা, সত্যভাষণ, বাহ্য ইন্দ্রিয়গণের নিগ্রহ, অন্তরস্থ ইন্দ্রিয়গণের নিগ্রহ, সুখ, দুঃখ, জন্ম, মৃত্যু, ভয় ও অভয়, অহিংসা, সর্ব্বত্র, সমদৃষ্টি, তুষ্টি, তপস্যা দান, যশ ও অযশ, প্রাণিমাত্রের এই সকল ভিন্ন ভিন্ন ভাব আমা হইতেই উৎপন্ন হইয়া থাকে ॥৪–৫॥
মহর্ষয়ঃ সপ্ত পূর্ব্বে চত্বারো মনবস্তথা । মদ্ভাবা মানসা জাতা যেষাং লোক ইমাঃ প্রজাঃ ॥৬॥ |
সপ্ত মহর্ষয়ঃ (মরিচ্যাদি সপ্ত মহর্ষিগণ) পূর্ব্বে (তাঁহাদরও পূর্ব্ববর্ত্তী) চত্বারঃ (সনকাদি চারিজন) তথা মনবঃ (এবং স্বায়ম্ভুবাদি চতুর্দ্দশ মনুগণ) [এতে] (ইঁহারা সকলেই) মদ্ভাবাঃ (আমার প্রভাব সম্পন্ন) মানসাঃ জাতাঃ (এবং হিরণ্যগর্ভরূপী আমার মন হইতে উৎপন্ন), লোকে (এই পৃথিবীতে) ইমাঃ প্রজাঃ (এই দৃশ্যমান ব্রাহ্মণাদি প্রজাসমূহ) যেষাং (যাঁহাদের অর্থাৎ তাঁহাদেরই বংশজাত পুত্ত্রাদি ক্রমে এই পৃথিবী পরিপূর্ণ হইয়াছে) ॥৬॥
মরিচ্যাদি সপ্ত মহর্ষি, তৎপূর্ব্ববর্ত্তী সনকাদি ব্রহ্মর্ষি চতুষ্টয় এবং স্বায়ম্ভুবাদি চতুর্দ্দশ মনু ইঁহারা সকলেই আমার প্রভাব সম্পন্ন এবং হিরণ্যগর্ভরূপী আমার মন হইতে উৎপন্ন । এই ব্রহ্মাণ্ডে এই সকল দৃশ্যমান ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়াদি প্রজাসমূহই তাঁহাদের বংশজাত ॥৬॥
এতাং বিভূতিং যোগঞ্চ মম যো বেত্তি তত্ত্বতঃ । সোঽবিকল্পেন যোগেন যুজ্যতে নাত্র সংশয়ঃ ॥৭॥ |
যঃ (যিনি) মম (আমার) এতাং (এই) বিভূতিং (বিভূতি) যোগং চ (ও ভক্তিযোগ) তত্ত্বতঃ (যথার্থরূপে) বেত্তি (জ্ঞাত আছেন), সঃ (তিনি) অবিকল্পেন (নিশ্চল) যোগেন (তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা) যুজ্যতে (যুক্ত হন) ; অত্র (এই বিষয়ে) ন সংশয়ঃ [অস্তি] (সন্দেহ নাই) ॥৭॥
যিনি আমার এই বিভূতি ও ভক্তিযোগ সম্যক্রূপে অবগত আছেন, তিনি নিশ্চল তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা ভক্তিযোগের অনুষ্ঠান করেন । এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই ॥৭॥
অহং সর্ব্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্ব্বং প্রবর্ত্ততে । ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ ॥৮॥ |
অহং (আমি) সর্ব্বস্য (ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবদাদি সর্ব্ব কারণেরও) প্রভবঃ (উৎপত্তি অদ্বয়জ্ঞান স্বয়ং ভগবান্), মত্তঃ (আমা হইতে) সর্ব্বং (চিদচিৎ জগচ্চেষ্টা ও বেদাদি শাস্ত্র প্রভৃতি) প্রবর্ত্ততে (প্রবর্ত্তিত হয়), ইতি (এই রহস্য) মত্বা (উপলব্ধি করিয়া) বুধাঃ (সুমেধগণ) ভাবসমন্বিতাঃ (দাস্যসখ্যাদিভাবযুক্ত হইয়া) মাং (আমাকে) ভজন্তে (ভজন করেন) ॥৮॥
আমি ব্রহ্ম, পরমাত্মা ও নারায়ণেরও আকরতত্ত্ব অদ্বয়জ্ঞান-স্বরূপ কৃষ্ণ, আমা হইতেই চিদচিদ্ বিলাসময় বিশ্ব, তচ্চেষ্টা ও উদ্দেশ্য সাধ্য-সাধনময় বেদাদি শাস্ত্র সমস্তই প্রবর্ত্তিত—এই রহস্য বিচারপর সুমেধগণ ধর্ম্মাধর্ম্ম সমুদয় উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক রাগভক্তি অবলম্বনে আমার ভজন করিয়া থাকেন ॥৮॥
মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্ । কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি চ ॥৯॥ |
[তে] (তাঁহারা) মচ্চিত্তাঃ (আমাতে নিবেদিতাত্মা) মদ্গতপ্রাণাঃ (মদাত্মভূতা) পরস্পরম্ (পরস্পর) বোধয়ন্তঃ (স্বরূপগত ভাব বিনিময় করিতে করিতে) মাং কথয়ন্তঃ চ [সন্তঃ] (আমার কথা আলোচনা করিতে করিতে) নিত্যং (সর্ব্বদা) তুষ্যন্তি চ (তুষ্ট হন) রমন্তি চ (এবং মধুর রস আস্বাদন করেন) ॥৯॥
আমাতে নিবেদিতাত্মা ও মদাত্মভূত ভক্তগণ পরস্পর আমার কথা আলোচনা ও আমার সম্বন্ধীয়-ভাবের আদান প্রদান করিতে করিতে সর্ব্বদা স্বরূপগত বাৎসল্য মাধুর্য্যাদি রস আস্বাদন করিয়া পরিতোষ লাভ করেন ॥৯॥
তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্ব্বকম্ । দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপযান্তি তে ॥১০॥ |
[অহং] (আমি) সততযুক্তানাং (নিত্য আমার সংযোগ কামনাশীল) প্রীতিপূর্ব্বকম্ (ও স্নেহ পূর্ব্বক) ভজতাং (ভজনকারী) তেষাং (তাঁহাদিগকে) তং (সেই) বুদ্ধিযোগং (বুদ্ধিযোগ) দদামি (দান করি) যেন (যদ্দ্বারা) তে (তাঁহারা) মাম্ (আমাকে) উপযান্তি (নিকটে পাইতে পারেন) ॥১০॥
আমি সেই সর্ব্বদা আমার আত্মভূত ও প্রেমপূর্ব্বক ভজনশীল ভক্তগণকে এইরূপ বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যদ্দ্বারা তাঁহারা আমাতে উপগত হন বা বিবিধ অন্তরঙ্গ সেবাপ্রাপ্ত হন ॥১০॥
তেষামেবানুকম্পার্থমহমজ্ঞানজং তমঃ । নাশয়াম্যাত্মভাবস্থো জ্ঞানদীপেন ভাস্বতা ॥১১॥ |
তেষাম্ এব (তাঁহাদেরই) অনুকম্পার্থম্ (প্রেমাধীন হইয়াই) অহম্ (আমি) আত্মভাবস্থঃ [সন্] (তাঁদের অন্তরে প্রকাশিত হইয়া) ভাস্বতা (উজ্জ্বল) জ্ঞানদীপেন (মৎসাক্ষাৎকার রূপ জ্ঞান দ্বারা) অজ্ঞানজং (অদর্শন জন্য) তমঃ (মোহরূপ অন্ধকার) নাশয়ামি (নাশ করি) ॥১১॥
তাঁহারা জ্ঞানশূন্য প্রেমভক্তির পরমাবস্থায় ইষ্টবিরহজনিত ভ্রম-মোহাদি তমোভাবাক্রান্ত হইয়া পড়িলে আমি প্রেমাধীন হইয়া তাঁহাদের অন্তরে স্বরূপসাক্ষাৎকাররূপ উজ্জ্বল জ্ঞানদ্বারা বিরহদুঃখরূপ তমোনাশ করিয়া থাকি ॥১১॥
অথবা
তাঁহাদেরই অনুকম্পার্থ আমি জীবজগতের হৃদয়স্থ হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার নাশ করিয়া থাকি ॥১১॥
অথবা
তাঁহাদেরই অনুকম্পার্থ আমি জীবজগতের হৃদয়স্থ হইয়া উজ্জ্বল জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞানরূপ অন্ধকার নাশ করিয়া থাকি ॥১১॥
শ্রীঅর্জ্জুন উবাচ—
পরং ব্রহ্ম পরং ধাম পবিত্রং পরমং ভবান্ ।পুরুষং শাশ্বতং দিব্যমাদিদেবমজং বিভুম্ ॥১২॥ আহস্ত্বামৃষয়ঃ সর্ব্বে দেবর্ষির্নারদস্তথা । অসিতো দেবলো ব্যাসঃ স্বয়ঞ্চৈব ব্রবীষি মে ॥১৩॥ |
অর্জ্জুন উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) ভবান্ (আপনি) পরমং (পরম) পবিত্রং (অবিদ্যামালিন্যনাশক) পরং ধাম (সর্ব্বোৎকৃষ্ট শ্যামসুন্দর বপুই) পরং ব্রহ্ম (পরমব্রহ্ম অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবান্) [অহং মন্যে] (আমি মনে করি), সর্ব্বে ঋষয়ঃ (সকল ঋষিগণ) দেবর্ষিঃ নারদঃ (দেবর্ষি নারদ) অসিতঃ (অসিত) দেবলঃ (দেবল) তথা ব্যাসঃ (এবং মহর্ষি ব্যাস সকলেই) ত্বাম্ (আপনাকে) শাশ্বতং পুরুষং (সনাতন পুরুষ) দিব্যম্ (স্বয়ং প্রকাশ) আদিদেবম্ (আদিদেব) অজং (জন্মরহিত) বিভুম্ (ও সর্ব্বব্যাপক) আহুঃ (বলিয়া থাকেন), স্বয়ং চ এব (এবং আপনি নিজেই) মে (আমাকে) ব্রবীষি (বলিতেছেন) ॥১২–১৩॥
অর্জ্জুন কহিলেন—হে ভগবান্ আপনি পরব্রহ্ম, পরমাশ্রয় ও পরমপাবন ! দেবর্ষি নারদ, অসিত, দেবল ও ব্যাসাদি প্রধান প্রধান মহর্ষিগণ সকলেই আপনাকে স্বয়ংপ্রকাশ স্বয়ম্ভু, সমগ্র ঐশ্বর্য্যের মূলীভূত লীলাময় সর্ব্বাদি সনাতন পুরুষোত্তমরূপে বর্ণন করিয়াছেন, এবং আপনি নিজেও তাহাই বলিতেছেন ॥১২–১৩॥
সর্ব্বমেতদৃতং মন্যে যন্মাং বদসি কেশব । ন হি তে ভগবন্ ব্যক্তিং বিদুর্দ্দেবা ন দানবাঃ ॥১৪॥ |
[হে] কেশব ! (হে কেশব !) মাং (আমাকে) যৎ (‘ন মে বিদুঃ’ ইত্যাদি শ্লোক দ্বারা যাহা) বদসি (বলিতেছেন) এতৎ সর্ব্বম্ (এ সমস্তই) ঋতং (যথার্থ বলিয়া) মন্যে (মানি) । হি (ইহা নিশ্চয় যে) [হে] ভগবন্ (হে ভগবন্) তে (আপনার) ব্যক্তিং (পরিচয়) ন দেবাঃ দানবাঃ (কি দেবগণ, কি দানবগণ কেহই) ন বিদুঃ (জানেন না) ॥১৪॥
হে কেশব ! ‘ন মে বিদুঃ’ ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা আমাকে যাহা বলিতেছেন সে সমুদয়ই আমি যথার্থ বলিয়া মানি । হে ভগবন্ ! ইহা নিশ্চিত যে দেবগণ বা দানবগণের মধ্যে কেহই আপনার পরিচয় জানেন না ॥১৪॥
স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম । ভূতভাবন ভূতেশ দেবদেব জগৎপতে ॥১৫॥ |
[হে] পুরুষোত্তম ! (হে পুরুষোত্তম !) [হে] ভূতভাবন ! (হে জগৎপিতঃ !) [হে] ভূতেশ ! (হে ভূতনাথ !) [হে] দেবদেব ! (হে দেবারাধ্য !) [হে] জগৎপতে (হে জগন্নাথ !) ত্বং (আপনি) স্বয়ম্ এব (নিজেই) আত্মনা (চিচ্ছক্তি দ্বারা) আত্নানং (আপনাকে) বেত্থ (জানিতেছেন) ॥১৫॥
হে পুরুষোত্তম ! হে জগৎপিতা ! হে ভূতনাথ ! হে দেবদেব ! হে জগৎপতে! আপনি স্বয়ংই নিজ চিচ্ছক্তি দ্বারা আপনাকে জানিতেছেন ॥১৫॥
বক্তুমর্হস্যশেষেণ দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ । যাভির্বিভূতিভির্লোকানিমাংস্ত্বং ব্যাপ্য তিষ্ঠসি ॥১৬॥ |
ত্বং (আপনি) যাভিঃ (যে যে) বিভূতিভিঃ (ঐশ্বর্য্য দ্বারা) ইমান্ (এই) লোকান্ (লোক সমূহ) ব্যাপ্য (ব্যাপিয়া) তিষ্ঠসি (রহিয়াছেন), [তাঃ] (সেই) দিব্যাঃ (উৎকৃষ্ট) আত্মবিভূতয়ঃ (স্বকীয় ঐশ্বর্য্য সকল) অশেষেণ (সবিশেষ ভাবে) [ত্বং] হি বক্তং অর্হসি (একমাত্র আপনিই বলিতে সমর্থ) ॥১৬॥
আপনি যে যে বিভূতি দ্বারা এই লোক সকল ব্যাপিয়া অবস্থান করিতেছেন, সেই সমুদয় অলৌকিক আত্ম-বিভূতিগুলি সম্পূর্ণরূপে আমাকে অনুগ্রহ পূর্ব্বক বলুন ॥১৬॥
কথং বিদ্যামহং যোগিংস্ত্বাং সদা পরিচিন্তয়ন্ । কেষু কেষু চ ভাবেষু চিন্ত্যোঽসি ভগবন্ময়া ॥১৭॥ |
[হে] যোগিন্ ! (হে যোগমায়াধিপতে !) সদা (সর্ব্বদা) কথং (কিরূপে) পরিচিন্তয়ন্ (সর্ব্ব প্রকারে চিন্তা করিয়া) অহং (আমি) ত্বাং (আপনাকে) বিদ্যাম্ (জানিতে পারিব ?) [হে] ভগবন্ ! (হে ভগবন্ !) কেষু কেষু চ (এবং কোন্ কোন্) ভাবেষু (পদার্থ সমূহে) [ত্বং] (আপনি) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) চিন্ত্যঃ অসি (চিন্তনীয়) ॥১৭॥
হে যোগমায়াপতে ভগবন্ ! কিরূপে সর্ব্বদা সর্ব্বপ্রকারে চিন্তা করিয়া আমি আপনাকে জানিবে এবং কোন্ কোন্ পদার্থ সকলে আমি আপনার চিন্তনরূপ ভক্তি আচরণ করিব ? ॥১৭॥
বিস্তরেণাত্মনো যোগং বিভূতিঞ্চ জনার্দ্দন । ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেঽমৃতম্ ॥১৮॥ |
[হে] জনার্দ্দন ! (হে জনার্দ্দন !) আত্মনঃ (আপনার) যোগং (ভক্তিযোগ) বিভূতিং চ (ও বিভূতি) ভূয়ঃ (পুনরায়) বিস্তরেণ (বিস্তৃতভাবে) কথয় (বলুন) । হি (যেহেতু) অমৃতম্ (আপনার অমৃতময় বাক্য) শৃণ্বতঃ (শ্রবণ করিয়া) মে (আমার) তৃপ্তিঃ (তৃপ্তি) ন অস্তি (হইতেছে না) ॥১৮॥
হে জনার্দ্দন ! আপনার যোগ ও বিভূতি সকল পুনর্ব্বার সবিস্তারে বলুন । যেহেতু আপনার এই সকল উপদেশরূপ অমৃতময়বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না ॥১৮॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—
হন্ত তে কথয়িষ্যামি দিব্যা হ্যাত্মবিভূতয়ঃ ।প্রাধান্যতঃ কুরুশ্রেষ্ঠ নাস্ত্যন্তো বিস্তরস্য মে ॥১৯॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) হন্ত কুরুশ্রেষ্ঠ ! (ওহে কুরুশ্রেষ্ঠ !) দিব্যাঃ (অলৌকিক) আত্মবিভূতয়ঃ (প্রপঞ্চ চিচ্ছক্তিজাত প্রকটিত নিজ ঐশ্বর্য্য সমূহ) প্রাধান্যতঃ (প্রধান প্রধান রূপে) তে (তোমাকে) কথয়িষ্যামি (বলিব) । হি (যেহেতু) মে (আমার) বিস্তরস্য (বিস্তৃত বিভূতির) অন্তঃ (শেষ) ন অস্তি (নাই) ॥১৯॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—ওহে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! আমার অলৌকিক চিচ্ছক্তিজাত প্রপঞ্চ প্রকটিত ঐশ্বর্য্যসকল প্রধান প্রধান রূপেই তোমার নিকট বলিতেছি ; যেহেতু আমার বিস্তৃত বিভূতি সমূহের সীমা নাই ॥১৯॥
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্ব্বভূতাশয়স্থিতঃ । অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ ॥২০॥ |
[হে] গুড়াকেশ ! (হে জিতনিদ্র !) অহম্ (আমি) সর্ব্বভূতাশয়স্থিতঃ (সমস্ত জীবের অন্তঃকরণে অবস্থিত) আত্মা (পরমাত্মা) । অহম্ এব চ (এবং আমিই) ভূতানাম্ (প্রাণিগণের) আদিঃ (জন্ম), মধ্যং চ (ও স্থিতি) অন্তঃ চ (এবং নাশের হেতু) ॥২০॥
হে গুড়াকেশ ! আমি সমস্ত জীবের অন্তঃকরণে নিয়ামকরূপে অবস্থিত পরমাত্মা এবং আমিই ভূতগণের জন্ম, স্থিতি ও সংহারের কারণ ॥২০॥
আদিত্যানামহং বিষ্ণুর্জ্যোতিষাং রবিরংশুমান্ । মরীচির্ম্মরুতামস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী ॥২১॥ |
আদিত্যানাম্ (দ্বাদশ আদিত্যগণের মধ্যে) অহং (আমি) বিষ্ণুঃ (বিষ্ণু নামক আদিত্য), জ্যোতিষাং (প্রকাশকগণের মধ্যে) অংশুমান্ (মহাকিরণশালী) রবিঃ (সূর্য্য), মরুতাম্ (বায়ুগণের মধ্যে) মরীচিঃ (মরীচি নামক বায়ু) নক্ষত্রাণাম্ (নক্ষত্রগণের মধ্যে) অহং (আমি) শশী (চন্দ্র) অস্মি (হই) ॥২১॥
আমি দ্বাদশ আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণুনামক আদিত্য, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে প্রচুর কিরণশালী সূর্য্য, বায়ুগণের মধ্যে মরীচি নামক বায়ু, এবং নক্ষত্রগণের মধ্যে আমি চন্দ্ররূপে আছি ॥২১॥
বেদানাং সামবেদোঽস্মি দেবানামস্মি বাসবঃ । ইন্দ্রিয়াণাং মনশ্চাস্মি ভৃতানামস্মি চেতনা ॥২২॥ |
[অহং] (আমি) বেদানাং (বেদগণের মধ্যে) সামবেদঃ (সামবেদ) অস্মি (হই), দেবানাম্ (দেবতাগণের মধ্যে) বাসবঃ (ইন্দ্র) অস্মি (হই), ইন্দ্রিয়াণাং (ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে) মনঃ (মন) অস্মি (হই), ভূতানাম্ [চ] (এবং ভূতগণের মধ্যে) চেতনা (জ্ঞানশক্তি) অস্মি (হই) ॥২২॥
আমি বেদগণের মধ্যে সামবেদ, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র, এবং প্রাণিগণের মধ্যে জ্ঞান শক্তি ॥২২॥
রুদ্রাণাং শঙ্করশ্চাস্মি বিত্তেশো যক্ষরক্ষসাম্ । বসূনাং পাবকশ্চাস্মি মেরুঃ শিখরিণামহম্ ॥২৩॥ |
[অহং] (আমি) রুদ্রাণাং (একাদশ রুদ্রগণের মধ্যে) শঙ্করঃ (শিব) যক্ষরক্ষসাম্ চ (এবং যক্ষ ও রক্ষোগণের মধ্যে) বিত্তেশঃ (কুবের) অস্মি (হই) । বসূনাং (অষ্টবসু মধ্যে) পাবকঃ (অগ্নি), শিখরিণাম্ চ (এবং পর্ব্বত সমূহ মধ্যে) অহম্ (আমি) মেরুঃ (সুমেরু) অস্মি (হই) ॥২৩॥
আমি একাদশ রুদ্রগণের মধ্যে শঙ্কর, এবং যক্ষ ও রক্ষোগণের মধ্যে কুবের । আমি অষ্টবসু মধ্যে অগ্নি, এবং পর্ব্বতসমূহ মধ্যে সুমেরু পর্ব্বত ॥২৩॥
পুরোধসাঞ্চ মুখ্যং মাং বিদ্ধি পার্থ বৃহস্পতিম্ । সেনানীনামহং স্কন্দঃ সরসামস্মি সাগরঃ ॥২৪॥ |
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) মাং (আমাকে) পুরোধসাং (পুরোহিতগণের মধ্যে) মুখ্যং (প্রধান) বৃহস্পতিম্ (বৃহস্পতি বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) । অহম্ (আমি) সেনানীনাম্ (সেনাপতিগণের মধ্যে) স্কন্দঃ (কার্ত্তিকেয়) সরসাম্ [চ] (এবং জলাশয়গণ মধ্যে) সাগরঃ (সমুদ্র) অস্মি (হই) ॥২৪॥
হে পার্থ ! আমাকে পুরোহিতগণের মধ্যে প্রধান—বৃহস্পতি বলিয়া জানিও । আমি সেনাপতিগণের মধ্যে কার্ত্তিকেয়, এবং জলাশয় সমূহ মধ্যে সমুদ্র ॥২৪॥
মহর্ষীণাং ভৃগুরহং গিরামস্ম্যেকমক্ষরম্ । যজ্ঞানাং জপযজ্ঞোঽস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ ॥২৫॥ |
অহং (আমি) মহর্ষীণাং (মহর্ষিগণের মধ্যে) ভৃগুঃ (ভৃগু), গিরাম্ (শব্দ সমূহের মধ্যে) একম্ অক্ষরম্ (এক অক্ষর প্রণব) অস্মি (হই) । যজ্ঞানাং (যজ্ঞ সকলের মধ্যে) জপযজ্ঞঃ (জপরূপ যজ্ঞ) স্থাবরাণাং [চ] (এবং স্থাবরগণের মধ্যে) হিমালয়ঃ (হিমালয় পর্ব্বত) অস্মি (হই) ॥২৫॥
আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্য সমুদয়ের মধ্যে একাক্ষর প্রণব, যজ্ঞ সকলের মধ্যে জপযজ্ঞ এবং স্থাবরগণের মধ্যে হিমালয় পর্ব্বত ॥২৫॥
অশ্বত্থঃ সর্ব্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ । গন্ধর্ব্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ ॥২৬॥ |
[অহং] (আমি) সর্ব্ববৃক্ষাণাং (বৃক্ষ সকলের মধ্যে) অশ্বত্থঃ (অশ্বত্থ), দেবর্ষীণাং (দেবর্ষিগণের মধ্যে) নারদঃ (নারদ), গন্ধর্ব্বাণাং (গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে) চিত্ররথঃ (চিত্ররথ), সিদ্ধানাং চ (এবং সিদ্ধগণের মধ্যে) কপিলঃ মুনিঃ (কপিল মুনি) ॥২৬॥
আমি বৃক্ষ সমূহ মধ্যে অশ্বত্থ, দেবর্ষিগণের মধ্যে নারদ, গন্ধর্ব্বগণের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধগণের মধ্যে কপিল মুনি ॥২৬॥
উচ্চৈঃশ্রবসমশ্বানাং বিদ্ধি মামমৃতোদ্ভবম্ । ঐরাবতং গজেন্দ্রাণাং নরাণাঞ্চ নরাধিপম্ ॥২৭॥ |
মাম্ (আমাকে) অশ্বানাং (অশ্বগণের মধ্যে) অমৃতোদ্ভবম্ (অমৃত-নিমিত্ত মন্থন হইতে জাত) উচ্চৈঃশ্রবসম্ (উচ্চৈঃশ্রবা), গজেন্দ্রাণাং (হস্তিগণের মধ্যে) ঐরাবতং (ঐরাবত), নরাণাং চ (এবং মনুষ্যগণের মধ্যে) নরাধিপম্ (রাজা বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥২৭॥
আমাকে অশ্বগণ মধ্যে অমৃত মন্থন সময়ে উত্থিত উচ্চৈঃশ্রবা হস্তিসমূহের মধ্যে ঐরাবত এবং মনুষ্যসমূহের মধ্যে রাজা বলিয়া জানিবে ॥২৭॥
আয়ুধানামহং বজ্রং ধেনূনামস্মি কামধুক্ । প্রজনশ্চাস্মি কন্দর্পঃ সর্পাণামস্মি বাসুকিঃ ॥২৮॥ |
অহং (আমি) আয়ুধানাম্ (অস্ত্রগণের মধ্যে) বজ্রং (বজ্র), ধেনূনাম্ (ধেনুগণের মধ্যে) কামধুক্ অস্মি (কামধেনু), [কন্দর্পাণাং] (কন্দর্পগণের মধ্যে) প্রজনঃ (সন্তান উৎপত্তি হেতু) কন্দর্পঃ অস্মি (কামদেব), সর্পাণাম্ চ (এবং একমস্তকবিশিষ্ট সবিষ সর্পগণের মধ্যে) বাসুকিঃ অস্মি (সর্পরাজ বাসুকি) ॥২৮॥
আমি অস্ত্রগণের মধ্যে বজ্র ও গাভীগণের মধ্যে কামধেনু । কন্দর্পগণের মধ্যে সন্তান উৎপাদক কামদেব এবং এক মস্তকবিশিষ্ট সবিষ সর্পসমূহ মধ্যে সর্পরাজ বাসুকি ॥২৮॥
অনন্তশ্চাস্মি নাগানাং বরুণো যাদসামহম্ । পিতৄণামর্য্যমা চাস্মি যমঃ সংযমতামহম্ ॥২৯॥ |
অহম্ (আমি) নাগানাং (অনেক মস্তকবিশিষ্ট বিষহীন নাগগণের মধ্যে) অনন্তঃ (অনন্ত নাগ), যাদসাম্ চ (এবং জলচারিগণের মধ্যে) বরুণঃ অস্মি (বরুণদেব) । পিতৄণাম্ (পিতৃগণের মধ্যে) অহম্ (আমি) অর্য্যমা (অর্য্যমা), সংযমতাম্ চ (এবং দণ্ডকারিগণের মধ্যে) যমঃ অস্মি (যমরাজ) ॥২৯॥
আমি অনেক মস্তকবিশিষ্ট বিষহীন নাগগণের মধ্যে অনন্ত নাগ, এবং জলচারিগণের মধ্যে বরুণদেব । আমি পিতৃগণের মধ্যে অর্য্যমা, এবং দণ্ডবিধানকারিগণের মধ্যে যমরাজ ॥২৯॥
প্রহ্লাদশ্চাস্মি দৈত্যানাং কালঃ কলয়তামহম্ । মৃগাণাঞ্চ মৃগেন্দ্রোঽহং বৈনতেয়শ্চ পক্ষিণাম্ ॥৩০॥ |
অহম্ (আমি) দৈত্যানাং (দৈত্যগণের মধ্যে) প্রহ্লাদঃ (প্রহ্লাদ), কলয়তাম্ চ (এবং বশীকারকদিগের মধ্যে) কালঃ অস্মি (কাল) । অহং (আমি) মৃগাণাং চ (পশু সমূহের মধ্যে) মৃগেন্দ্রঃ (সিংহ), পক্ষিণাম্ চ (এবং পক্ষিগণের মধ্যে) বৈনতেয়ঃ (গরুড়) ॥৩০॥
আমি দৈত্যগণের মধ্যে প্রহ্লাদ, এবং বশকারিগণের মধ্যে কাল । আমি পশু সকলের মধ্যে সিংহ, এবং পক্ষি সকলের মধ্যে গরুড় ॥৩০॥
পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্ । ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী ॥৩১॥ |
অহম্ (আমি) পবতাম্ (পবিত্রকারী বা বেগবান্ বস্তুগণের মধ্যে) পবনঃ (পবন), শস্ত্রভৃতাম্ (শস্ত্রধারিবীরগণ মধ্যে) রমাঃ অস্মি (পরশুরাম) । ঝষাণাং (মৎস্যসমূহ মধ্যে) মকরঃ অস্মি (আমি মকর), স্রোতসাম্ চ (এবং নদীগণের মধ্যে) জাহ্নবী অস্মি (আমি জাহ্নবী) ॥৩১॥
আমি পবিত্রকারী বা বেগবান্ বস্তুগণের মধ্যে বায়ু, শস্ত্রধারী বীরগণ মধ্যে পরশুরাম, মৎস্য সমূহের মধ্যে মকর এবং নদী সমূহের মধ্যে গঙ্গা ॥৩১॥
সর্গাণামাদিরন্তশ্চ মধ্যঞ্চৈবাহমর্জ্জুন । অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাং বাদঃ প্রবদতামহম্ ॥৩২॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) সর্গাণাম্ (আকাশাদি সৃষ্টবস্তুসমূহের) আদিঃ (সৃষ্টি), অন্তঃ (সংহার) মধ্যং চ (ও স্থিতি) অহম্ এব (আমিই), বিদ্যানাং (সমস্ত বিদ্যার মধ্যে) অধ্যাত্মবিদ্যা (আত্মবিদ্যা), প্রবদতাম্ চ (এবং তর্ক বা বিচারকারিগণের মধ্যে) অহম্ (আমি) বাদঃ (তত্ত্বনির্ণায়ক বিচার) ॥৩২॥
হে অর্জ্জুন ! আকাশাদি সৃষ্ট বস্তুগণের সৃষ্টি, প্রলয় ও স্থিতি আমিই । সমুদয় বিদ্যার মধ্যে আত্মজ্ঞান, এবং তর্ক বা বিচারকারিগণের বাদ বা জল্প ও বিতণ্ডা মধ্যে আমি বাদ স্বরূপ ॥৩২॥
অক্ষরাণামকারোঽস্মি দ্বন্দ্বঃ সামাসিকস্য চ । অহমেবাক্ষয়ঃ কালো ধাতাহং বিশ্বতোমুখঃ ॥৩৩॥ |
[অহং] (আমি) অক্ষরাণাম্ (বর্ণ সকলের মধ্যে) অকারঃ (অকার), সামাসিকস্য চ (এবং সমাস সমূহ মধ্যে) দ্বন্দ্বঃ অস্মি (দ্বন্দ্বসমাস), অহম্ এব (আমিই) অক্ষয়ঃ (প্রবাহস্বরূপ অনন্ত) কালঃ (কাল), [স্রষ্টৄণাং চ] (এবং সৃষ্টিকারিগণের মধ্যে) বিশ্বতোমুখঃ (চতুর্ম্মুখ) ধাতা (ব্রহ্মা) ॥৩৩॥
আমি অকারাদি বর্ণ সকলের মধ্যে অকার এবং সমাসগণের মধ্যে দ্বন্দ্বসমাস । আমিই প্রবাহস্বরূপ অনন্তকাল, এবং সৃষ্টিকারিসকলের মধ্যে চতুর্ম্মুখ ব্রহ্মা ॥৩৩॥
মৃত্যুঃ সর্ব্বহরশ্চাহমুদ্ভবশ্চ ভবিষ্যতাম্ । কীর্ত্তিঃ শ্রীর্ব্বাক্ চ নারীণাং স্মৃতির্ম্মেধা ধৃতিঃ ক্ষমা ॥৩৪॥ |
অহম্ (আমি) [হরণকারিণাং] (হরণকারিদিগের মধ্যে) সর্ব্বহরঃ (সর্ব্বস্মৃতি নাশকারী) মৃত্যুঃ (মৃত্যু), ভবিষ্যতাম্ চ (ও ভাবি ষড়্বিধ প্রাণি-বিকার মধ্যে) উদ্ভবঃ (জন্মরূপ আদিবিকার), নারীণাং চ (এবং নারীগণের মধ্যে) কীর্ত্তিঃ (কীর্ত্তি) শ্রীঃ (কান্তি) বাক্ (সংস্কৃত বাণী) স্মৃতিঃ (স্মৃতিশক্তি) মেধা (শাস্ত্রার্থাবধারণশক্তি) ধৃতিঃ (ধৈর্য্যশক্তি) ক্ষমা চ (এবং ক্ষমারূপিনী সপ্ত ধর্ম্মপত্নী) ॥৩৪॥
আমি হরণকারিগণের মধ্যে সর্ব্বস্মৃতি নাশকারী মৃত্যু, ও ভাবি ষড়্বিধ প্রাণি-বিকার মধ্যে জন্মরূপ প্রথমবিকার, এবং নারীগণের মধ্যে কীর্ত্তি, শ্রী, বাণী, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি এবং ক্ষমা রূপিণী সপ্ত ধর্ম্মপত্নী ॥৩৪॥
বৃহৎ সাম তথা সাম্নাং গায়ত্ত্রীচ্ছন্দসামহম্ । মাসানাং মার্গশীর্ষোঽহমৃতূনাং কুসুমাকরঃ ॥৩৫॥ |
অহম্ (আমি) সাম্নাং (সামবেদীয় মন্ত্র সকলের মধ্যে) বৃহৎসাম (ইন্দ্রস্তুতিরূপ মন্ত্র বিশেষ) তথা ছন্দসাম্ (এবং ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রগণের মধ্যে) গায়ত্ত্রী (গায়ত্ত্রী মন্ত্র) । মাসানাং (মাসসমূহের মধ্যে) অহম্ (আমি) মার্গশীর্ষঃ (অগ্রহায়ণ মাস) ঋতূনাং [চ] (এবং ঋতুগণের মধ্যে) কুসুমাকরঃ (বসন্ত) ॥৩৫॥
আমি সামবেদীয় মন্ত্র সকলের মধ্যে ইন্দ্রস্তুতিরূপ বৃহৎসাম, এবং ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রগণের গায়ত্ত্রীচ্ছন্দ । মাস সমূহের মধ্যে আমি অগ্রহায়ণ মাস এবং ঋতুগণের মধ্যে বসন্ত ঋতু ॥৩৫॥
দ্যূতং ছলয়তামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্ । জয়োঽস্মি ব্যবসায়োঽস্মি সত্ত্বং সত্ত্ববতামহম্ ॥৩৬॥ |
অহম্ (আমি) ছলয়তাম্ (পরস্পর বঞ্চনাকারিগণের সম্বন্ধে) দূত্যং (দ্যূতক্রীড়া), তেজস্বিনাম্ (তেজস্বিগণের সম্বন্ধে) তেজঃ অস্মি (প্রভাব), অহম্ (আমি) [জেতৄণাং] (বিজয়িগণের সম্বন্ধে) জয়ঃ অস্মি (জয়স্বরূপ), [অহং ব্যবসায়িনাং] (আমি উদ্যমশীলগণের সম্বন্ধে) ব্যবসায়ঃ (অধ্যবসায়), সত্ত্ববতাম্ [চ] (এবং বলবান্গণের সম্বন্ধে) সত্ত্বং অস্মি (বলস্বরূপ) ॥৩৬॥
আমি পরস্পর বঞ্চনাকারিগণের সম্বন্ধে পাশা খেলা ও তেজস্বিগণের সম্বন্ধে প্রভাব । আমি বিজয়িগণের সম্বন্ধে জয়স্বরূপ, উদ্যমশীলগণের সম্বন্ধে অধ্যবসায়, এবং বলবান্গণের সম্বন্ধে বলস্বরূপ ॥৩৬॥
বৃষ্ণীনাং বাসুদেবোঽস্মি পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ । মুনীনামপ্যহং ব্যাসঃ কবীনামুশনাঃ কবিঃ ॥৩৭॥ |
অহং (আমি) বৃষ্ণীনাং (যাদবগণের মধ্যে) বাসুদেবঃ (শ্রীবাসুদেব) পাণ্ডবানাং (পাণ্ডবগণের মধ্যে) ধনঞ্জয়ঃ (অর্জ্জুন) মুনীনাম্ (মুনিগণের মধ্যে) ব্যাসঃ (ব্যাসদেব) কবীনাম্ অপি (এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ মধ্যে) উশনাঃ কবিঃ অস্মি (পণ্ডিত শুক্রাচার্য্য) ॥৩৭॥
আমি যাদবগণের মধ্যে বাসুদেব, পাণ্ডবগণের মধ্যে অর্জ্জুন, মুনিগণের মধ্যে ব্যাসদেব, এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণের মধ্যে পণ্ডিত শুক্রাচার্য্য ॥৩৭॥
দণ্ডো দময়তামস্মি নীতিরস্মি জিগীষতাম্ । মৌনং চৈবাস্মি গুহ্যানাং জ্ঞানং জ্ঞানবতামহম্ ॥৩৮॥ |
[অহং] (আমি) দময়তাম্ (দণ্ডকারিগণের সম্বন্ধে) দণ্ডঃ অস্মি (দণ্ড), জিগীষতাম্ (এবং জয়েচ্ছুগণের সম্বন্ধে) নীতিঃ অস্মি (সামাদি উপায়রূপা নীতি) । অহম্ (আমি) গুহ্যানাং (গোপ্য সকলের মধ্যে) মৌনং (মৌনভাব) জ্ঞানবতাম্ এব চ (এবং জ্ঞানবান্গণের সম্বন্ধে) জ্ঞানং অস্মি (জ্ঞান) ॥৩৮॥
আমি দণ্ডকারিগণের সম্বন্ধে দণ্ড, এবং জয়েচ্ছুগণের সম্বন্ধে সামাদি উপায়রূপা নীতি । আমি গোপনীয় সকলের মধ্যে মৌনীভাব, এবং জ্ঞানিদের সম্বন্ধে জ্ঞান ॥৩৮॥
যচ্চাপি সর্ব্বভূতানাং বীজং তদহমর্জ্জুন । ন তদন্তি বিনা যৎ স্যান্ময়া ভূতং চরাচরম্ ॥৩৯॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যৎ চ (আর যাহা) সর্ব্বভূতানাং (ভূত সকলের) বীজং (মূল কারণ) তৎ অপি (তাহাও) অহম্ (আমি) ময়া বিনা (আমাকে পরিত্যাগ করিয়া) যৎ স্যাৎ (যাহা হইতে পারে ) তৎ (সেরূপ) চরাচরম্ (স্থাবর ও জঙ্গম) ভূতং (কোনও বস্তু বা জীব) ন অস্তি (নাই) ॥৩৯॥
হে অর্জ্জুন ! আর যাহা যাহা সকল ভূতগণের উৎপত্তির কারণ বলিয়া কথিত হয় সে সকলই আমি । আমাভিন্ন যাহা হইতে পারে তাদৃশ স্থাবর বা জঙ্গম কোন বস্তু বা জীব নাই ॥৩৯॥
নান্তোঽস্তি মম দিব্যানাং বিভূতীনাং পরন্তপ । এষ তূদ্দেশতঃ প্রোক্তো বিভূতের্বিস্তরো ময়া ॥৪০॥ |
[হে] পরন্তপ ! (হে শত্রুতাপন !) মম (আমার) দিব্যানাং (অলৌকিক) বিভূতীনাং (বিভূতি সমূহের) অন্তঃ (সীমা) ন অস্তি (নাই) । এষঃ তু (কিন্তু এই) বিভূতেঃ (বিভূতির) বিস্তরঃ (বাহুল্য) উদ্দেশতঃ (সংক্ষেপেই) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) প্রোক্তঃ (কথিত হইল) ॥৪০॥
হে পরন্তপ ! আমার উৎকৃষ্ট বিভূতি সকলের অন্ত নাই ; কেবলমাত্র তোমার অবগতির জন্যই বিভূতিগণের এই বিস্তার নামমাত্র আমি তোমার নিকট বর্ণন করিলাম ॥৪০॥
যদ্যদ্বিভূতিমৎ সত্ত্বং শ্রীমদূর্জ্জিতমেব বা । তত্তদেবাবগচ্ছ ত্বং মম তেজোঽংশসম্ভবম্ ॥৪১॥ |
যৎ যৎ (যে যে) সত্ত্বং এব (বস্তুই) বিভূতিমৎ (ঐশ্বর্য্যযুক্ত), শ্রীমৎ (সৌন্দর্য্য বিশিষ্ট), ঊর্জ্জিতম্ বা (অথবা বল প্রভাবাদির আধিক্যবিশিষ্ট) তৎ তৎ এব (সেই সমস্ত বস্তুই) মম (আমার) তেজোঽংশসম্ভবম্ (প্রভাবের অংশ হইতে উৎপন্ন বলিয়া) ত্বং (তুমি) অবগচ্ছ (জানিবে) ॥৪১॥
যে যে বস্তুই ঐশ্বর্য্যযুক্ত, সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট অথবা বলপ্রভাবাদির আধিক্যবিশিষ্ট সেই সমুদয় বস্তুই আমার শক্তির অংশ হইতে উৎপন্ন বলিয়া তুমি জানিবে ॥৪১॥
অথবা বহুনৈতেন কিং জ্ঞাতেন তবার্জ্জুন । বিষ্টভ্যাহমিদং কৃৎস্নমেকাংশেন স্থিতো জগৎ ॥৪২॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) অথবা (অথবা) এতেন (এই) বহুনা (পৃথক্ পৃথক্ উপদিষ্ট) জ্ঞাতেন (জ্ঞানের দ্বারা) তব (তোমার) কিং ? (কি প্রয়োজন ?) অহম্ (আমি) ইদং (এই ) কৃৎস্নম্ (চিৎ অচিৎ সমস্ত) জগৎ (বিশ্ব) একাংশেন (প্রকৃতির অন্তর্যামী পুরুষরূপ এক অংশ দ্বারা) বিষ্টভ্য (ধারণ করিয়া) স্থিতঃ (অবস্থিত) [অস্মি] (রহিয়াছি) ॥৪২॥
অথবা হে অর্জ্জুন ! আমার বিভূতির এই বিস্তৃত জ্ঞানে তোমার কি প্রয়োজন ? আমি প্রকৃতির অন্তর্যামী কারণার্ণবশায়ী পুরুষরূপ আমার এক অংশ দ্বারা এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বকে ধারণ করিয়া অবস্থান করিতেছি ॥৪২॥
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভবগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে বিভূতিযোগো নাম দশমোঽধ্যায়ঃ ॥১০॥ |
ইতি দশম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥
গ্রন্থ-সম্পাদক—
ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল
(১) সপ্তম, অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে পরমেশ্বরের স্বরূপ বর্ণনপ্রসঙ্গে তাঁহার নানা ব্যক্ত রূপ বা বিভূতির কথা সংক্ষেপে বলা হইয়াছে । উহাই এই অধ্যায়ে সবিস্তারে বলিবেন ।
(২) ঋগ্বেদীয় নাসদীয় সূক্তের ঋষি আদি কারণ সন্বন্ধে ঠিক এই কথাই বলিয়াছে – ‘অর্বাগ্ দেবা অস্য বিসর্জ্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব’ [ঋক্|১০|১|৯|৬], – দেবতারাও এই বিসর্গের (সৃষ্টির) পরে হইল । আবার উহা সেখান হইতে নিঃসৃত হইল তাহা কে জানিবে ?
(৪,৫) তিনিই সকল অবস্থা, সকল ভাব, সকল বৃত্তির মূল কারণ । তাহাই এই দুইটি শ্লোকে বলা হইয়াছে ।
৬) সপ্ত মহর্ষি : 1)মরীচি, 2)অঙ্গিরস, 3)অত্রি, 4)পুলস্ত্য, 5)পুলহ, 6)ক্রতু, 7)বশিষ্ঠ [মভাঃ|শাঃ|৩৩৫|২৮-২৯, ৩৪০|৪৪-৪৫] । মতান্তরে 1)ভৃগু, 2)মরীচি, 3)অত্রি, 4)অঙ্গিরা, 5)পুলহ, 6)পুলস্ত্য, 7)ক্রতু ।
পূর্বে চত্বারঃ : টীকাকারগণের অনেকেই বলেন, ইঁহারা (i)সনক, (ii)সনন্দ, (iii)সনাতন, (iv)সনৎকুমার, এই চারি মহর্ষি; কিন্তু ইঁহারা সকলেই চিরকুমার, প্রজা সৃষ্টি করেন নাই । সুতরাং লোকমান্য তিলক বলেন, – ইঁহারা (i)বাসুদেব (আত্মা), (ii)সঙ্কর্ষণ (জীব), (iii)প্রদ্যুম্ন (মন), (iv)অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার), এই চারি মূর্তি বা ‘চতুর্ব্যূহ’ । মহাভারতে নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্ম বর্ণনায় এই চতুর্ব্যূহের উল্লেখ আছে এবং গীতায়ও এই ভাগবত-ধর্মই প্রতিপাদিত হইয়াছে । এখানে বলা হইতেছে যে, এই চারি ব্যূহ এক সর্বতঃপূর্ণ বাসুদেবেরই বিভাব ।
মনবঃ : চতুর্দশ মনু, যথা 1)স্বায়ম্ভূব, 2)স্বারোচিষ, 3)উত্তম, 4)তামস, 5)রৈবত, 6)চাক্ষুষ, 7)বৈবস্বত, 8)সাবর্ণি, 9)দক্ষসাবর্ণি, 10)ব্রহ্মসাবর্ণি, 11)ধর্মসাবর্ণি, 12)রুদ্রসাবর্ণি, 13)দেবসাবর্ণি, 14) ইন্দ্রসাবর্ণি । [বিশদ]
১১) ‘পরাভক্তি ও পরা বিদ্যা এক…’ [স্বামী বিবেকানন্দ] । যাঁহারা অনন্যভক্তি যোগে তাঁহার ভজনা করেন, তাঁহারা সেই ভক্তিবলেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া মায়ামোহ-নির্মুক্ত হইয়া তাঁহাকে প্রাপ্ত হন ।
১৭) অবতার, আবেশ, বিভূতি :
অবতার : ভক্তিশাস্ত্রে নানাবিধ অবতারের উল্লেখ আছে – পুরুষ অবতার (সঙ্কর্ষণাদি), লীলাবতার (মৎস্য-কূর্মাদি), যুগাবতার (শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ) ।
আবেশ : যখন কোনো মহাপুরুষে ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিশেষ অভিব্যক্তি হয়, তখন তাহাকে আবেশ বলে; যেমন সনকাদিতে জ্ঞানশক্তি, নারদে ভক্তিশক্তি, অনন্তে ভূধারণশক্তি ইত্যাদি । ইঁহাদিগকে শক্ত্যাবেশ-অবতারও বলা হয় ।
বিভূতি : বিশ্বে সর্বত্রই ঐশী শক্তিরই প্রকাশ, কিন্তু যাহা-কিছু অতিশয় ঐশ্বর্যযুক্ত, শ্রীসম্পন্ন বা শক্তিসম্পন্ন তাহাতেই তাঁহার শক্তির বিশেষ অভিব্যক্তি কল্পনা করা হয় । ইহাকেই বিভূতি বলে । বলা বাহুল্য, বিভূতি ঈশ্বর নহেন ।
‘একটি বিড়ালের মধ্যে ঈশ্বর দর্শন – সে তো খুব ভাল কথা – তাহাতে কোনো বিপদাশঙ্কা নাই, বিড়ালের বিড়ালত্ব ভুলিতে পারিলেই আর-কোনো গোল নাই, কারণ তিনিই সব । কিন্তু বিড়ালরূপী ঈশ্বর প্রতীক মাত্র ।’ – [স্বামী বিবেকানন্দ]
২১) দ্বাদশ আদিত্য – ধাতা, মিত্র, অর্যমা, রুদ্র, বরুণ, সূর্য, ভগ, বিবস্বান, পূষা, সবিতা, ত্বষ্টা, বিষ্ণু । [বিশদ]
মরুতাম্ – ঊনপঞ্চাশ বায়ুর মধ্যে ।
২২) সাধারণতঃ বেদসমূহ মধ্যে ঋগ্বেদকেই প্রধান বলা হয় এবং ৯।১৭ শ্লোকে ‘ঋক্সামযজুরেব চ’ এই কথায় উহাকেই অগ্র স্থান দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু সামবেদ গান-প্রধান বলিয়া উহার আকর্ষণী শক্তি অধিক এবং ভক্তিমার্গে পরমেশ্বরের স্তবস্তুতিমূলক সঙ্গীতেরই প্রাধান্য দেওয়া হয় । – ‘মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ ।’ এই হেতু যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকর্মাত্মক বেদ অপেক্ষা গানপ্রধান সামবেদেরেই শ্রেষ্ঠত্ব কথিত হইয়াছে ।
২৫) জপযজ্ঞ – নামমাহাত্ম্য : সর্ববিধ যজ্ঞের (দ্রব্য-, জ্ঞান-, ব্রহ্ম-, তপো-যজ্ঞ) মধ্যে জপযজ্ঞ বা নামযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ । সুতরাং উহাই শ্রীভগবানের বিভূতি । কলিতে নাম-সংকীর্তনই শ্রেষ্ঠ সাধন বলিয়া পরিগণিত । শ্রীমাদ্ভাগবত বলেন – কলি অশেষ দোষের আকর হইলেও উহার একটি মহৎ গুণ এই যে, কলিতে কৃষ্ণনাম-কীর্তন দ্বারাই সংসারবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া পরমগতি প্রাপ্ত হওয়া যায় ।
নামের দার্শনিক তত্ত্ব : নাম ও নামী অভেদ । সমগ্র জগৎ নামরূপাত্মক । ভাব, নাম ও রূপ – একই বস্তু, সূক্ষতর, কিঞ্চিৎ ঘনীভূত ও সম্পূর্ণ ঘনীভূত । সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে নাম রহিয়াছে, আর সেই নাম হইতেই এক বহির্জগৎ সৃষ্ট বা বহির্গত হইয়াছে ।
সকল ধর্মেই এই নামকে শব্দব্রহ্ম বলিয়া থাকে । হিন্দুদের মতে এই নাম বা শব্দ ওঁ; এই ওঁকার জগতের সমষ্টিভাব বা ঈশ্বরের নাম । ব্যষ্টিভাব তাঁহার অনন্ত নাম । বস্তুত এইরূপ নাম বা পবিত্র শব্দ অনেক আছে । ভক্ত যোগীরা সেই বিভিন্ন নামের সাধন-উপদেশ দিয়া থাকেন । সদ্গুরু-পরম্পরা-ক্রমে আসিলেই নাম শক্তিসম্পন্ন থাকে এবং পুনঃপুনঃ জপে তাহা অনন্তশক্তিসম্পন্ন হয় । ঐ মন্ত্রের বারবার উচ্চারণে ভক্তির উচ্চতম অবস্থা আসে । – [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তিরহস্য]
২৬) দেবর্ষি – দেবতা হইয়াও যিনি মন্ত্রদ্রষ্টা বলিয়া ঋষিত্ব লাভ করিয়াছেন, যেমন নারদ ।
গন্ধর্বগণ = দেবগায়ক
কপিলমুনি = সাংখ্যদর্শনের প্রণেতা ।
২৮) কন্দর্পঃ = কাম
প্রজনঃ : প্রাণিগণের উৎপত্তি-হেতু কন্দর্প (কাম), এই কথাতে সম্ভোগমাত্র যে কামের পরিণাম তাহা নিকৃষ্ট, ইহাই সূচিত হইয়াছে ।
২৯) অর্যমা – পিতৃগণের অধিপতি । পিতৃগণের নাম এই – অগ্নিষ্বত্বা, সৌম্য, হবিষ্মান, উষ্মপা, সুকাল, বহির্ষদ এবং আজ্যপ । বেদে অর্যমার নাম দৃষ্ট হয় ।
নাগ ও সর্প : ইহারা এ-স্থলে দুই বিভিন্ন জাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে । সর্পগণের রাজা বাসুকি এবং নাগগণের রাজা অনন্ত বা শেষনাগ । অনন্ত অগ্নিবর্ণের এবং বাসুকি হরিদ্রাবর্ণের ।
৩০) কলয়তাম্ : সকলকেই বশীভূত করেন বা সকলেরই দিন গণনা করেন কাল, অথবা ঘটনাসমূহের নির্দেশকারিগণের মধ্যে কালই শ্রেষ্ঠ । কিংবা কলয়ৎ-শব্দের অর্থ গ্রাসকারীও হয় [তিলক] ।
৩২) তর্কশাস্ত্রে তিন প্রকার তর্ক আছে – (i)জল্প (জিগীষা-পরতন্ত্র হইয়া যে-প্রকারেই হউক আত্মমত-স্থাপন), (ii)বিতণ্ডা (পরপক্ষদূষণ), (iii)জিগীষু না হইয়া কেবল সত্য নির্ণয়ের জন্য উভয় পক্ষে যে বিচার) ।
পূর্বে ২০ শ্লোকে ‘আমি ভূত সকলের আদি, অন্ত ও মধ্য’ এরূপ বলা হইয়াছে । উহা সচেতন সৃষ্টি সন্বন্ধে বলা হইয়াছে এবং এই শ্লোকে চরাচর সমগ্র সৃষ্টি সন্বন্ধেই এই কথা বলা হইল, ইহাই প্রভেদ ।
৩৩) অকার আদি বর্ণ এবং সকল বর্ণের ইচ্চারণে উহাই প্রকাশিত হয়; এই হেতু উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
দ্বন্দ্ব-সমাসে উভয় পদেরই প্রাধান্য থাকে, এই হেতু উহা শ্রেষ্ঠ ।
এখানে কাল বলিতে অবিচ্ছিন্ন প্রবাহস্বরূপ অক্ষয় কাল (eternal time) ।
৩৪) কীর্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, সেবা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, মতি – দক্ষের এই দশ কন্যার ধর্মের সহিত বিবাহ হয় । এইজন্য ইহাদিগকে ধর্মপত্নী বলে । উহার তিনটা এখানে উল্লিখিত হইয়াছে ।
৩৫) বৃহৎসাম – এই মন্ত্রদ্বারা ইন্দ্র (ব্রহ্ম) সর্বেশ্বররূপে স্তুত হন । এইহেতু মোক্ষ-প্রতিপাদক বলিয়া উহার শ্রেষ্ঠত্ব ।
মার্গশীর্ষ বা অগ্রহায়ণ মাস হইতেই সে-সময়ে বৎসর গণনা হইত, এই হেতু মার্গশীর্ষকে প্রধান স্থান দেওয়া হয়েছে [মভা|অনু|১০৬,১০৯; বাল্মিকী রামায়ণ|৩|১৬; ভাগবত|১১|১৬|২৭] । মার্গশীর্ষ নক্ষত্রকে অগ্রহায়ণী অর্থাৎ বর্ষারম্ভের নক্ষত্র বলা হইত [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক] ।
৩৬) ভাল-মন্দ সকলই তাঁহা হইতে জাত, সুতরাং বঞ্চনা করিবার শ্রেষ্ঠ উপায় যে দ্যূতক্রীড়া তাহাও তাঁহারই বিভূতি [গী|৭|১২] ।
৩৭) মুনি = বেদার্থমননশীল; কবি = সূক্ষ্মার্থদর্শী; শুক্রাচার্য = অসুরদিগের গুরু
যে শ্রেণীর যাহা প্রধান তাহাতেই ঐশ্বরিক শক্তির সমধিক বিকাশ এবং তাহাই বিভূতি বলিয়া গণ্য । এই হেতু বৃষ্ণিগণের প্রধান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণের বিভূতি । ব্যাসদেব মুনিগণের প্রধান । ইনি বেদ বিভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণ সমস্ত রচনা করেন । আবার, ব্রহ্মসূত্র বা বেদান্ত দর্শনের রচয়িতা বলিয়াও ইনি প্রসিদ্ধ । অথচ এই সকল গ্রন্থের রচনাকাল শত শত বৎসর ব্যবধান । এই হেতু অনেকে বলেন – এক ব্যাসই বহুবার জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন । যোগিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব লিখিয়াছেন যে, এক ব্যাসকেই বহুবার জন্মগ্রহণ করিতে দেখিয়াছেন । -“ইমং ব্যাসমুনিং তত্র দ্বাত্রিংশং সংস্মরাম্যহম্’’ ।
৩৮) নীতিঃ : শত্রুজয় বা রাজ্যরক্ষার উপায় । রাজনীতি (State-crafts) – সাম, দান, ভেদ, দণ্ড ।
দণ্ড, রাজ্যশাসন বা সমাজশাসনের মুখ্য উপায়, এই হেতু উহা বিভূতি; মৌনাবলম্বন করিলে মনোভাব কিছুতেই ব্যক্ত হয় না, সুতরাং উহাই শ্রেষ্ঠ গোপনহেতু ।
বিশ্বানুগ – বিশ্বাতিগ :
শ্রীভগবান বলিতেছেন, – ‘আমি একাংশে এই চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি, আমি বিশ্বরূপ ।’ তবে অপরাংশ কিরূপ, কোথায় ? মানব-বুদ্ধি বিশ্বরূপের ধারণাতেই বিহ্বল হইয়া যায়, বিশ্বের অতীত, নাম-রূপের অতীত যে বস্তু, তাহা সে ধারণাই করিতে পারে না । তাহা অনন্ত, অব্যক্ত, অজ্ঞেয় । তিনি মায়া স্বীকার করিয়া সোপাধিক হইলেও সসীম হন না । তিনি বিশ্বানুগ (Immanent) হইয়াও বিশ্বাতিগ (Transcendental), প্রপঞ্চাভিমানী হইয়াও প্রপঞ্চাতীত । তাঁহার এই প্রপঞ্চাতীত বিশ্বাতিগ নির্গুণ স্বরূপ ধারণার অতীত ।
সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
০২। http://www.scsmathinternational.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন