২২ নভেম্বর ২০১৭

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা : প্রথম অধ্যায় – অর্জুনবিষাদযোগ

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ—
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয় ॥১॥

ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ—(ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন) [হে] সঞ্জয় ! (হে সঞ্জয় ! ) ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে (ধর্ম্মভূমি কুরুক্ষেত্রে) যুযুৎসবঃ (যুদ্ধ করিতে ইচ্ছুক) সমবেতাঃ (সমবেত) মামকাঃ (দুর্য্যোধনাদি) পাণ্ডবাশ্চ (এবং যুধিষ্ঠিরাদি) এব (অনন্তর) কিম্ (কি) অকুর্ব্বত (করিয়াছিলেন ? ) ॥১॥

অনুবাদ—ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, হে সঞ্জয় ! ধর্ম্মভূমি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধার্থ সমবেত হইয়া মৎপুত্ত্র ও পাণ্ডুপুত্রগণ কি করিলেন ? ॥১॥



সঞ্জয় উবাচ—
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা ।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ ॥২॥

সঞ্জয়ঃ উবাচ—(সঞ্জয় কহিলেন) তদা তু (তখন) রাজা দুর্য্যোধনঃ (দুর্য্যোধন) পাণ্ডবানীকং (পাণ্ডবসৈন্যকে) ব্যূঢ়ং (ব্যূহাকারে অবস্থিত) দৃষ্ট্বা (দেখিয়া) আচার্য্যং (দ্রোণাচার্য্যের) উপসঙ্গম্য (নিকটে গমন করিয়া) বচনং (নিম্নোক্ত বাক্য) অব্রবীৎ (বলিয়াছিলেন) ॥২॥

সঞ্জয় বলিলেন, রাজা দুর্য্যোধন, পাণ্ডব-সৈন্য সামন্তগণকে ব্যূহরচনায় অবস্থিত দেখিয়া, দ্রোণাচার্য্যের নিকট গমনপূর্ব্বক বলিলেন ॥২॥



পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্ত্রাণামাচার্য্য মহতীং চমূম্ ।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্ত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা ॥৩॥

[হে] আচার্য্য (হে আচার্য্যদেব !) তব (আপনার) ধীমতা শিষ্যেণ দ্রুপদপুত্রেণ (বুদ্ধিমান্শিষ্য দ্রুপদপুত্ত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ত্তৃক) ব্যূঢ়াং (ব্যূহাকারে স্থাপিত) পাণ্ডুপুত্ত্রাণাং (পাণ্ডবগণের) এতাং মহতীং (এই বিশাল) চমূং (সপ্তাক্ষৌহিণী পরিমিত সেনাকে) পশ্য (দেখুন) ॥৩॥

হে আচার্য্য! আপনার শিষ্য, ধীমান্ ধৃষ্টদ্যুম্ন কর্ত্তৃক ব্যূহ রচনায় অবস্থিত পাণ্ডবগণের মহান্ সৈন্যসমাবেশ নিরীক্ষণ করুন ॥৩॥



অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জ্জুনসমা যুধি ।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ ॥৪॥
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্ ।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ ॥৫॥
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্ ।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ ॥৬॥

অত্র (এই ব্যূহে) মহেষ্বাসাঃ (মহাধনুর্ধারী) যুধি (যুদ্ধে) ভীমার্জ্জুনসমাঃ (ভীমার্জ্জুনের সমান) শূরাঃ (বীরগণ) [সন্তি] (রহিয়াছেন) [যথা] যুযুধানঃ (সাত্যকি) বিরাটশ্চ (বিরাট রাজা) মহারথঃ দ্রুপদশ্চ (মহারথদ্রুপদ) ধৃষ্টকেতুঃ (ধৃষ্টকেতু) চেকিতানঃ (চেকিতান রাজা) বীর্য্যবান্ কাশীরাজশ্চ (বলশালী কাশীরাজ) পুরুজিৎ (পুরুজিৎ) কুন্তিভোজশ্চ (কুন্তিভোজ) নরপুঙ্গবঃ (নরশ্রেষ্ঠ) শৈব্যঃ চ (শৈব্যরাজ) বিক্রান্তঃ (বিক্রমশালী) যুধামন্যুশ্চ (যুধামন্যু) বীর্য্যবান্ উত্তমৌজাশ্চ (বীর উত্তমৌজা) সৌভদ্রঃ (অভিমন্যু) দ্রৌপদেয়াশ্চ (ও দ্রৌপদীর প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতি পঞ্চ পুত্ত্র) সর্ব্বে এব মহারথাঃ (সকলেই মহারথ) ॥৪–৬॥

এই পাণ্ডবসৈন্য মধ্যে মহাধনুর্দ্ধর ভীমার্জ্জুন ও তৎসমকক্ষ যোদ্ধাগণ আছেন । যথা সাত্যকি, বিরাটরাজ, মহারথদ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্য্যবান্ উত্তমৌজা, অভিমন্যু, ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ—ইঁহারা সকলেই মহারথ ॥৪–৬॥



অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম ।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে ॥৭॥

[হে] দ্বিজোত্তম ! (হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্রোণ !) অস্মাকং (আমাদের) [মধ্যে] তু যে বিশিষ্টাঃ (যাঁহারা প্রধান) মম সৈন্যস্য (আমার সৈন্যগণের) নায়কাঃ (নায়ক) তান্ (তাঁহাদিগকে) নিবোধ (জানুন) তে সংজ্ঞার্থং (আপনার সম্যক্ অবগতির জন্য) তান্ (তাঁহাদিগের নাম) ব্রবীমি (বলিতেছি) ॥৭॥

হে দ্বিজোত্তম ! আমাদেরও যে সকল বিশিষ্ট বীর এবং সেনানায়ক আছেন, সে সকলও জানুন । আপনার সম্যক্ জ্ঞানার্থ নিবেদন করিতেছি ॥৭॥



ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ ॥৮॥
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধবিশারদাঃ ॥৯॥

ভবান্ (আপনি) ভীষ্মশ্চ (ভীষ্ম) কর্ণশ্চ (কর্ণ) সমিতিঞ্জয়ঃ কৃপশ্চ (যুদ্ধজয়ী কৃপ) অশ্বত্থামা (অশ্বত্থামা) বিকর্ণশ্চ (বিকর্ণ) সৌমদত্তিঃ (ভূরিশ্রবা) জয়দ্রথঃ (জয়দ্রথ) নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ (বিবিধ শস্ত্রধারী) অন্যে চ বহবঃ শূরাঃ (অন্যান্য বহুবীর) [সন্তি] (আছেন), সর্ব্বে (তাঁহারা সকলে) যুদ্ধবিশারদাঃ (যুদ্ধপারদর্শী) মদর্থে (আমার জন্য) ত্যক্তজীবিতাঃ (প্রাণ-ত্যাগেও কৃতসঙ্কল্প) ॥৮–৯॥

রণবিজয়ী আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সৌমদত্তি (ভূরিশ্রবা) ও জয়দ্রথ এবং ইহা ছাড়াও অনেক আছেন,যাঁহারা যুদ্ধবিশারদ, নানাশস্ত্রপ্রহরণধারী, বীরপুরুষ, এবং আমার জন্য প্রাণত্যাগে কৃতসংকল্প ॥৮–৯॥



অপর্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ ।
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ ॥১০॥

ভীষ্মাভিরক্ষিতম্ (ভীষ্মের দ্বারা পরিরক্ষিত) অস্মাকম্ তৎ বলং (আমাদের তাদৃশ সৈন্যগণ) অপর্য্যাপ্তং (অপর্য্যাপ্ত, প্রচুর নহে) তু (কিন্তু) ভীমাভিরক্ষিতম্ (ভীম কর্ত্তৃক পরিরক্ষিত) এতেষাং (ইহাদের) ইদং বলং (এই সৈন্যদল) পর্য্যাপ্তং (পর্য্যাপ্ত, প্রচুর) [ভাতি] (মনে হয়) ॥১০॥

ভীষ্মের দ্বারা অভিরক্ষিত আমাদের সৈন্যবল অপর্য্যাপ্ত (প্রচুর নহে), কিন্তু ভীমের দ্বারা রক্ষিত পাণ্ডবসৈন্য সমূহ পর্য্যাপ্ত (প্রচুর) ॥১০॥



অয়নেষু চ সর্ব্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি ॥১১॥

ভবন্তঃ (আপনারা) সর্ব্বে এব হি (সকলেই) সর্ব্বেষু অয়নেষু চ (সকল ব্যূহ-প্রবেশ পথে) যথাভাগম্ (বিভাগানুসারে) অবস্থিতাঃ [সন্তঃ] (অবস্থিত হইয়া) ভীষ্মমেব (ভীষ্মকেই) অভিরক্ষন্তু (সর্ব্বতোভাবে রক্ষা করুন) ॥১১॥

অতএব আপনারা ব্যূহদ্বারে স্ব-স্ব বিভাগানুযায়ী অবস্থান পূর্ব্বক সকলে পিতামহ ভীষ্মকেই রক্ষা করুন ॥১১॥



তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্ ॥১২॥

প্রতাপবান্ (প্রতাপশালী) কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ (ভীষ্ম) তস্য (তাঁহার অর্থাৎ দুর্য্যোধনের) হর্ষং সংজনয়ন্ (হর্ষ উৎপাদনার্থ) উচ্চৈঃ (উচ্চৈঃস্বরে) সিংহনাদং বিনদ্য (সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া) শঙ্খং দধ্মৌ (শঙ্খ বাজাইলেন) ॥১২॥

অনন্তর প্রবলপ্রতাপ কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্য্যোধনের হর্ষোৎপত্তির নিমিত্ত সিংহনাদপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে শঙ্খধ্বনি করিলেন ॥১২॥



ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোঽভবৎ ॥১৩॥

ততঃ (তদনন্তর) শঙ্খাশ্চ, ভের্য্যশ্চ, পণবানক-গোমুখাঃ (শঙ্খ, ভেরী, মাদল, ঢক্কা ও রণশিঙ্গাপ্রভৃতি বাদ্য সকল) সহসা এব অভ্যহন্যন্ত (তৎক্ষণাৎ বাজিয়া উঠিল) স শব্দঃ (সেই শব্দ) তুমুলঃ অভবৎ (প্রবল হইল) ॥১৩॥

তারপরেই শঙ্খ, ভেরী, মাদল, পটহ, রণশিঙ্গা প্রভৃতি সহসা বাদিত হইলে তুমুল শব্দ উদ্ভূত হইল ॥১৩॥



ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ।
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ ॥১৪॥

ততঃ (তৎপরে) শ্বেতৈঃ হয়ৈঃ যুক্তে (শ্বেতবর্ণ অশ্ব-যুক্ত) মহতি স্যন্দনে (মহন্রথে) স্থিতৌ (অবস্থিত) মাধবঃ পাণ্ডবশ্চ এব (শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুন উভয়েই) দিব্যৌ শঙ্খৌ (অলৌকিক শঙ্খদ্বয়) প্রদধ্মতুঃ (বাজাইলেন) ॥১৪॥

এদিকে ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জ্জুন শ্বেতবর্ণ অশ্বযুক্ত মহান্রথে অবস্থান পূর্ব্বক দিব্য-শঙ্খ-ধ্বনি করিলেন ॥১৪॥



পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ ।
পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ ॥১৫॥

হৃষীকেশঃ (শ্রীকৃষ্ণ) পাঞ্চজন্যং (পাঞ্চজন্য) ধনঞ্জয়ঃ (অর্জ্জুন) দেবদত্তং (দেবদত্ত) ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ (ঘোরকর্ম্মা ভীমসেন) পৌণ্ড্রং (পৌণ্ড্র নামক) মহাশঙ্খং (মহাশঙ্খ) দধ্মৌ (বাজাইলেন) ॥১৫॥

হৃষীকেশ স্বীয় ‘পাঞ্চজন্য’, ধনঞ্জয় ‘দেবদত্ত’, এবং ভীমকর্ম্মা ভীমসেন, ‘পৌণ্ড্র’ নামক শঙ্খ বাজাইলেন ॥১৫॥



অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্ত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষ-মণিপুষ্পকৌ ॥১৬॥

কুন্তীপুত্ত্রঃ রাজা যুধিষ্ঠিরঃ (কুন্তীপুত্ত্র রাজা যুধিষ্ঠির) অনন্তবিজয়ং (অনন্তবিজয়) নকুলঃ সহদেবশ্চ (নকুল ও সহাদেব) সুঘোষ-মণিপুষ্পকৌ (সুঘোষ ও মণিপুষ্পক নামক শঙ্খদ্বয়) [দষ্মৌ] (বাজাইলেন) ॥১৬॥

কুন্তীপুত্ত্র রাজা যুধিষ্ঠির ‘অনন্তবিজয়’ নকুল ‘সুঘোষ’ এবং সহদেব ‘মণিপুষ্পক’ নামক শঙ্খ বাজাইলেন ॥১৬॥



কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ ॥১৭॥
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে ।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথক্ ॥১৮॥

[হে] পৃথিবীপতে ! (হে পৃথিবীনাথ ধৃতরাষ্ট্র !) পরমেষ্বাসঃ (মহাধর্নুদ্ধারী) কাশ্যশ্চ (কাশীরাজ) মহারথঃ শিখণ্ডী চ (মহারথ শিখণ্ডী) ধৃষ্টদ্যুম্নঃ বিরাটশ্চ (ধৃষ্টদ্যুম্ন ও বিরাট রাজা) অপরাজিতঃ (রণবিজয়ী) সাত্যকিশ্চ (সাত্যকি) দ্রুপদঃ (দ্রুপদ রাজা) দ্রৌপদেয়াশ্চ (দ্রৌপদীর তনয়গণ) মহাবাহুঃ সৌভদ্রশ্চ (এবং মহাবাহু অভিমন্যু) সর্ব্বশঃ (সকলেই) পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খান্ (পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ সকল) দধ্মুঃ (বাজাইলেন) ॥১৭–১৮॥

হে পৃথিবীপতে ! উৎকৃষ্ট ধনুর্দ্ধারী কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট রাজা এবং অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ রাজা, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, এবং মহাবাহু সুভদ্রা-তনয় অভিমন্যু, ইঁহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খধ্বনি করিলেন ॥১৭–১৮॥



স ঘোষো ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ ।
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোঽভ্যনুনাদয়ন্ ॥১৯॥

নভশ্চ পৃথিবীং চ এব (আকাশ ও পৃথিবীকে) অভ্যনুনাদয়ন্ (প্রতিধ্বনিত করিয়া) সঃ তুমুলঃ ঘোষঃ (সেই তুমুল শব্দ) ধার্ত্তরাষ্ট্রানাং (ধৃতরাষ্ট্র তনয়গণের) হৃদয়ানি[ণি?] (হৃদয় সকল) ব্যদারয়ৎ (বিদীর্ণ করিল) ॥১৯॥

সেই সকল তুমুল শঙ্খনাদ ধরাতল এবং গগনমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিতে করিতে যেন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদীর্ণ করিতে লাগিল ॥১৯॥



অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ ।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে ॥২০॥

[হে] মহীপতে ! (হে মহারাজ !) অথ (অনন্তর) শাস্ত্র-সম্পাতে (অস্ত্রাদি নিক্ষেপ) প্রবৃত্তে [সতি] (আরম্ভ কালে) কপিধ্বজঃ পাণ্ডবঃ (বানরধ্বজ অর্জ্জুন) ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ (ধৃতরাষ্ট্র পুত্ত্রগণকে) ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা (যুদ্ধোদ্যোগে অবস্থিত দেখিয়া) ধনুঃ উদ্যম্য (ধনু উত্তোলন পূর্ব্বক) তদা (তৎকালে) হৃষীকেশং (শ্রীকৃষ্ণকে) ইদং বাক্যম্ (এই বাক্য) আহ (বলিয়াছিলেন) ॥২০॥

হে মহীপতে ! তৎকালে শস্ত্র-নিক্ষেপে সমুদ্যত কপিধ্বজ-রথারূঢ় ধনঞ্জয়, দুর্য্যোধনাদিকে যুদ্ধোদ্যোগে অবস্থিত দেখিয়া ধনু উত্তোলন পূর্ব্বক শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিলেন ॥২০॥



অর্জ্জুন উবাচ—
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে রথং স্থাপয় মেঽচ্যুত ॥২১॥

অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] অচ্যুত ! (হে অচ্যুত !) উভয়োঃ সেনয়োঃ মধ্যে (উভয় সেনার মধ্যস্থলে) মে রথঃ (আমার রথ) স্থাপয় (স্থাপন কর) ॥২১॥

অর্জ্জুন কহিলেন—হে কৃষ্ণ ! উভয় সেনার মধ্যস্থলে আমার রথ স্থাপন কর ॥২১॥



যাবদেতান্নিরীক্ষেঽহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্ ।
কৈর্ম্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে ॥২২॥
যোৎস্যমানানবেক্ষেঽহং য এতেঽত্র সমাগতাঃ ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্ব্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ ॥২৩॥

যাবৎ (যে পর্য্যন্ত) অহং (আমি) যোদ্ধু কামান্ অবস্থিতান্ এতান্ (যুদ্ধাভিলাষী এই সকল বীরগণকে) নিরীক্ষে (নিরীক্ষণ করি) অস্মিন্রণসমুদ্যমে (এই যুদ্ধে) কৈ সহ (কাহাদিগের সহিত) ময়া যোদ্ধব্যং (আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে) অত্র যুদ্ধে (এই সংগ্রামে) দুর্ব্বুদ্ধেঃ (দুর্ম্মতি) ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য (দুর্য্যোধনের) প্রিয়চিকীর্ষবঃ (হিতৈষী) এতে যে সমাগতাঃ (যে সকল ব্যক্তি আসিয়াছেন) [তান্] (সেই সকল) যোৎস্যমানান্ (যোদ্ধৃগণকে) অহং (আমি) অবেক্ষে (অবলোকন করি) ॥২২–২৩॥

যতক্ষণ এই যুদ্ধক্ষেত্রে কাহার কাহার সহিত আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে, এবং এই যুদ্ধে দুর্ব্বদ্ধি দুর্য্যোধনের প্রিয় সাধনেচ্ছায় যুদ্ধার্থ যাঁহারা আসিয়াছেন, সেই সকল অবস্থিত যোদ্ধাগণকে আমি নিরীক্ষণ করি ॥২২–২৩॥



সঞ্জয় উবাচ—
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত ।
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্ ॥২৪॥
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্ ।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি ॥২৫॥

সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় কহিলেন) [হে] ভারত ! (হে ধৃতরাষ্ট !) গুড়াকেশেন (জিতনিদ্র অর্জ্জুন কর্ত্তৃক) এবং উক্তঃ [সন্] (এইরূপে উক্ত হইয়া) হৃষীকেশঃ (শ্রীকৃষ্ণ) উভয়োঃ সেনয়োঃ মধ্যে (উভয় সেনার মধ্যে) ভীষ্ম-দ্রোণ-প্রমুখতঃ (ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি) সর্ব্বেষাং চ মহীক্ষিতাম্ (এবং সমুদয় রাজগণের) [পুরতঃ] (সম্মুখে) রথোত্তমম্ (উত্তম রথ) স্থাপয়িত্বা (স্থাপন পূর্ব্বক) [হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) সমবেতান্ (সমবেত) এতান্ কুরূন্ (এই সকল কুরুপক্ষীয়গণকে) পশ্য (দেখ) ইতি উবাচ ইহা বলিয়াছিলেন) ॥২৪–২৫॥

সঞ্জয় কহিলেন—হে ভারত ! গুড়াকেশ অর্জ্জুন এইকথা বলিলে, (সর্ব্বেন্দ্রিয় নিয়ন্তা) শ্রীকৃষ্ণ, উভয় সেনার মধ্যস্থলে ভীষ্ম, দ্রোণ ও সমুদয় রাজন্যবর্গের সম্মুখে সেই উত্তম রথ স্থাপন পূর্ব্বক কহিলেন, হে পার্থ ! যুদ্ধার্থ সমবেত এই কৌরবগণকে নিরীক্ষণ কর ॥২৪–২৫॥



তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৄনথ পিতামহান্ ।
আচার্য্যাম্মাতুলান্ ভ্রাতৄন্ পুত্ত্রান্ পৌত্ত্রান্ সখীংস্তথা ।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি ॥২৬॥

অথ(অনন্তর) পার্থঃ অপি (অর্জ্জুনও) তত্র (তথায়) উভয়োঃ সেনয়োঃ [মধ্যে] (উভয় সেনার মধ্যে) স্থিতান্ (অবস্থিত) পিতৄন্ (পিতৃব্য) পিতামহান্ (পিতামহ) আচার্য্যান্ (আচার্য্য) মাতুলান্ (মাতুল) ভ্রাতৄন্ (ভ্রাতা) পুত্ত্রান্ (পুত্ত্র) পৌত্ত্রান্ (পৌত্ত্র) সখীন্ (সখা) তথা শ্বশুরান্ (শ্বশুর) সুহৃদশ্চ এব (এবং সুহৃদ্গণকেই) অপশ্যৎ (দেখিতে পাইলেন) ॥২৬॥

অনন্তর পার্থ, উভয়সেনার মধ্যে অবস্থিত পিতৃস্থানীয়গণকে, পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা, পুত্ত্র, পৌত্ত্র, সখা, শ্বশুর ও অন্যান্য বন্ধুগণকে দেখিতে পাইলেন ॥২৬॥



তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্ ।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ ॥২৭॥

সঃ কৌন্তেয়ঃ (সেই কুন্তীপুত্ত্র) [তত্র] (রণস্থলে) অবস্থিতান্ (অবস্থিত) তান্ সর্ব্বান্ বন্ধূন্ (সেই সকল বন্ধুগণকে) সমীক্ষ্য (দেখিয়া) পরয়া কৃপয়া আবিষ্টঃ (অতিশয় কৃপাপরবশ) বিষীদন্ [সন্] (ও বিষণ্ণ হইয়া) ইদম্ অব্রবীৎ (ইহা বলিয়াছিলেন) ॥২৭॥

সেই কৌন্তেয় রণস্থলে অবস্থিত সেই সমস্ত বন্ধুগণকে দেখিয়া অত্যন্ত কৃপা-পরবশ ও বিষণ্ণ হইয়া এইকথা বলিলেন ॥২৭॥



অর্জ্জুন উবাচ—
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূন্ সমবস্থিতান্ ।
সীদন্তি মম গাত্রণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি ॥২৮॥

অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ!) যুযুৎসূন্ (যুদ্ধার্থী) ইমান্ স্বজনান্ (এই সকল স্বজনগণকে) সমবস্থিতান্ (সমবেত) দৃষ্ট্বা (দেখিয়া) মম গাত্রাণি (আমার শরীর) সীদন্তি (অবসন্ন হইতেছে) মুখং চ পরিশুষ্যতি (এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে) ॥২৮॥

অর্জ্জুন বলিলেন, হে কৃষ্ণ! এই স্বজনগণকে যুদ্ধাভিলাষে সম্যক্ অবস্থিত দেখিয়া আমার অঙ্গসকল অবসন্ন ও মুখ পরিশুষ্ক হইতেছে ॥২৮॥



বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে ।
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে ॥২৯॥

মে শরীরে (আমার শরীরে) বেপথুঃ (কম্প) চ (এবং) রোমহর্ষঃ চ (রোমাঞ্চও) জায়তে (হইতেছে) হস্তাৎ (হাত হইতে) গাণ্ডীবং (গাণ্ডীব ধনু) স্রংসতে (খসিয়া পড়িতেছে) ত্বক্ চ পরিদহ্যতে এব (এবং চর্ম্মও দগ্ধ হইতেছে) ॥২৯॥

আমার শরীর রোমাঞ্চিত ও কম্পিত হইতেছে । হস্ত হইতে গাণ্ডীব ধনু খসিয়া পড়িতেছে এবং গাত্রদাহ হইতেছে ॥২৯॥



ন চ শক্লোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব ॥৩০॥

[হে] কেশব ! (হে শ্রীকৃষ্ণ !) [অহং] (আমি) অবস্থাতুং চ (আর অবস্থান করিতেও) ন শক্নোমি (পারিতেছি না) মে মনঃ (আমার মন) ভ্রমতি ইব (যেন চঞ্চল হইতেছে) বিপরীতানি নিমিত্তানি চ (এবং কুলক্ষণযুক্ত নিমিত্ত সকলও) পশ্যামি (দেখিতেছি) ॥৩০॥

আমি আর অবস্থান করিতে পারিতেছি না । আমার চিত্ত উদ্[zero space]ভ্রান্ত হইতেছে । হে কেশব ! আমি কেবল বিপরীত ভাব-বিশিষ্ট দুর্ল্লক্ষণ সমূহ দেখিতেছি ॥৩০॥



ন চ শ্রেয়োঽনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে ।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ ॥৩১॥

[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) আহবে (যুদ্ধে) স্বজনং হত্বা (বন্ধুজনকে বিনাশ করিয়া) শ্রেয়ঃ চ (মঙ্গলও) ন অনুপশ্যামি (দেখিতেছি না) [অহং] (আমি) বিজয়ং ন কাঙ্ক্ষে (বিজয় আকাঙ্ক্ষা করি না) রাজ্যং সুখানি চ ন (রাজ্য এবং সুখও চাহি না) ॥৩১॥

এই যুদ্ধে স্বজনবধে কিছুমাত্র মঙ্গল দেখি না । হে কৃষ্ণ ! আমি বিজয় আকাঙ্ক্ষা করি না, রাজ্যও চাই না, সুখও চাই না ॥৩১॥



কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা ।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাং সুখানি চ ॥৩২॥
ত ইমেঽবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ ।
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্ত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ ॥৩৩॥
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্ত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা ।
এতান্ ন হস্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোঽপি মধুসূদন ॥৩৪॥

[হে] গোবিন্দ ! (হে শ্রীকৃষ্ণ!) যেষাম্ অর্থে (যাঁহাদের জন্য) নঃ (আমাদিগের) রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ (রাজ্য, ভোগ ও সুখসকল) কাঙ্ক্ষিতং (আকাঙ্ক্ষিত) তে ইমে (সেই এই সব) আচার্য্যাঃ (আচার্য্য) পিতরঃ (পিতৃব্য) পুত্ত্রাঃ (পুত্ত্র) তথা এব ব পিতামহাঃ (এবং তদ্রূপ পিতামহ) মাতুলাঃ (মাতুল) শ্বশুরাঃ (শ্বশুর) পৌত্ত্রাঃ (পৌত্ত্র) শ্যালাঃ (শ্যালক) তথা সম্বন্ধিনঃ (এবং কুটুম্বগণ) ধনানি প্রাণান্ চ (ধন ও প্রাণ) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ স্বীকার করিয়া) যুদ্ধে অবস্থিতাঃ (যুদ্ধে উপস্থিত হইয়াছেন) [অতএব] নঃ রাজ্যেন কিম্ (আমাদের রাজ্যেই বা কি প্রয়োজন ? ) ভোগৈঃ জীবিতেন বা কিম্ (ভোগ এবং জীবনেই বা কি প্রয়োজন ? ) [হে] মধুসূদন ! (হে মধুসূদন ! ) ঘ্নতঃ অপি (তাহাদিগের দ্বারা হত হইলেও) এতান্ হন্তুং [আমি] (ইহাদিগকে বধ করিতে) ন ইচ্ছামি (ইচ্ছা করি না) ॥৩২–৩৪॥

হে গোবিন্দ ! আমাদের রাজ্যে কি প্রয়োজন ? ভোগ সুখেরই বা কি প্রয়োজন ? যাঁহাদের জন্য আমরা রাজ্য, ভোগ ও সুখের আকাঙ্ক্ষা করি (আজ) সেই আচার্য্য, পিতৃব্য, পুত্ত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্ত্র, শ্যালক ও অন্য সম্বন্ধিগণ—সকলেই, ধন ও প্রাণ পর্য্যন্ত ত্যাগ স্বীকার করিয়া এই যুদ্ধে উপস্থিত হইয়াছেন । অতএব হে মধুসূদন ! যদি ইহারা আমাকে হত্যাও করে তথাপি আমি ইহাদিগকে হনন করিতে ইচ্ছা করি না ॥৩২–৩৪॥



অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিন্নু মহীকৃতে ।
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন ॥৩৫॥

[হে] জনার্দ্দন ! (হে শ্রীকৃষ্ণ ! ) মহীকৃতে কিং নু (পৃথিবীর রাজত্বের নিমিত্ত কি কথা ? ) ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ অপি (ত্রিভুবনের রাজত্বের জন্যও) ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ (দুর্য্যোধনাদিকে) নিহত্য (বধ করিয়া) নঃ (আমাদিগের) কা প্রীতিঃ স্যাৎ (কি সুখ লাভ হইবে ?) ॥৩৫॥

হে জনার্দ্দন ! পৃথিবী কেন ? ত্রৈলোক্যের আধিপত্য লাভ করিলেও এই দুর্য্যোধনাদিকে নিধন করিয়া আমাদের কি প্রীতিলাভ হইবে? ॥৩৫॥



পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ স্ববান্ধবান্ ।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব ॥৩৬॥

[হে] মাধব ! (হে মাধব ! ) এতান্ আততায়িনঃ (এই সকল আততায়ীকে) হত্বা (বধ করিয়া) অস্মান্ (আমাদিগকে) পাপম্ এব (পাপই) আশ্রয়েৎ (আশ্রয় করিবে) । তস্মাৎ (অতএব) বয়ং (আমরা) স্ববান্ধবান্ (নিজ আত্মীয়) ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ (দুর্য্যোধনাদিকে) হন্তুং (বধ করিতে) ন অর্হাঃ (পারি না) । হি (যেহেতু) স্বজনং হত্বা (স্বজনগণকে বধ করিয়া) [বয়ং] (আমরা) কথং (কি প্রকারে) সুখিনঃ (সুখী) স্যাম (হইব ? ) ॥৩৬॥

ঐ আচার্য্যাদি আততায়ী হইলেও ইঁহাদিগকে হত্যা করিলে আমাদিগকে পাপই আশ্রয় করিবে । অতএব আমাদের বান্ধব ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে সংহার করিতে পারি না । হে মাধব ! স্বজন হত্যা করিয়া কিরূপে আমরা সুখী হইব ॥৩৬॥



যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ ॥৩৭॥
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুম্ ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন ॥৩৮॥

[হে] জনার্দ্দন ! (হে জনার্দ্দন ! ) যদ্যপি এতে (যদিও ইহারা) লোভোপহতচেতসঃ [সন্তঃ] (লোভাক্রান্তচিত্ত হইয়া) কুলক্ষয়কৃতং দোষং (কুলক্ষয়জনিত দোষ) মিত্রদ্রোহে চ (এবং স্বজনবিরোধে) পাতকং ন পশ্যন্তি (পাতক দেখিতেছে না) । [তথাপি] কুলক্ষয়কৃতং দোষং (কুলক্ষয়জনিত দোষ) প্রপশ্যদ্ভিঃ (সম্যক্ দর্শনকারী ) [অস্মাভিঃ] (আমরা) অস্মাৎ পাপাৎ (এই পাপ হইতে) নিবর্ত্তিতুং কথং ন জ্ঞেয়ম্ (নিবৃত্ত কেন না হইব ? ) ॥৩৭–৩৮॥

যদিও লোভহতচিত্ত ইহারা কুলক্ষয় কৃতদোষ এবং বন্ধু বিচ্ছেদ জনিত পাপ দেখিতে পাইতেছে না, তথাপি হে জনার্দ্দন ! আমরা কুলক্ষয় জনিত দোষ সম্যক্ দেখিয়াও কেন এই পাপ হইতে নিবৃত্ত হইব না ? ॥৩৭–৩৮॥



কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মাঃ সনাতনাঃ ।
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোঽভিভবত্যুত ॥৩৯॥

কুলক্ষয়ে (কুলক্ষয় হইলে) সনাতনাঃ (কুলপরম্পরা প্রাপ্ত) কুলধর্ম্মাঃ প্রণশ্যন্তি (কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হইবে) ধর্ম্ম নষ্টে [সতি] (ধর্ম্ম বিনষ্ট হইলে) অধর্ম্মঃ (অধর্ম্ম) কৃৎস্নম্ উত কুলম্ (সমস্ত বংশকেই) অভিভবতি (অভিভূত করে) ॥৩৯॥

কুলক্ষয়ে সনাতন কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হয় । ধর্ম্ম নষ্ট হইলে অবশিষ্ট সমস্ত কুলই অধর্ম্মে অভিভূত হইয়া থাকে ॥৩৯॥



অধর্ম্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ ॥৪০॥

[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ ! ) অধর্ম্মাভিভবাৎ (কুল অধর্ম্মে অভিভূত হইলে) কুলস্ত্রিয়ঃ (কুলস্ত্রীগণ) প্রদুষ্যন্তি (ব্যভিচারিণী হয়) । [হে] বার্ষ্ণেয় (হে বৃষ্ণিবংশধর ! ) স্ত্রীষু দুষ্টাষু [সৎসু] (কুলস্ত্রীগণ ব্যাভিচারিণী হইলে) বর্ণসঙ্করঃ (বর্ণসঙ্কর) জায়তে (জন্মে) ॥৪০॥

হে বৃষ্ণি বংশধর কৃষ্ণ ! অধর্ম্মে অভিভূত কুলস্ত্রী সকল ব্যাভিচারিণী হয়, স্ত্রীগণ ব্যভিচারিণী হইলে বর্ণসঙ্কর জন্মে ॥৪০॥



সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ ॥৪১॥

সঙ্করঃ (বর্ণসঙ্কর) কুলস্য কুলঘ্নানাং চ (কুল ও কুলনাশকগণের) নরকায় এব [ভবতি] (নরকের নিমিত্তই হইয়া থাকে) । এষাং (ইহাদিগের) লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ পিতরঃ (পিতৃগণ পিণ্ড ও তর্পণাদি কার্য্য লোপ হেতু) পতন্তি হি (নিশ্চয়ই পতিত হন) ॥৪১॥

বর্ণসঙ্কর কুলের ও কুলনাশকগণের নরকপ্রাপ্তির কারণ হয়, এবং ইহাদের পিতৃগণ পিণ্ড এবং তর্পণাদির লোপ হেতু নিশ্চিতই নরকে পতিত হন ॥৪১॥



দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ ॥৪২॥

কুলঘ্নানাং (কুলনাশকগণের) এতৈঃ (এই সকল) বর্ণসঙ্করকারকৈঃ (বর্ণসঙ্করকারক) দোষৈঃ (দোষে) শাশ্বতাঃ (সনাতন) জাতি-ধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ (বর্ণধর্ম্ম ও কুলধর্ম্ম) উৎসাদ্যন্তে (উৎসন্ন হইয়া যায়) ॥৪২॥

এইসব বর্ণসঙ্করকারী কুলঘ্নগণের দোষে সনাতন কুলধর্ম্ম এবং জাতিধর্ম্ম উচ্ছন্ন হইয়া যায় ॥৪২॥



উৎসন্নকুলধর্ম্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দ্দন ।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম ॥৪৩॥

[হে] জনার্দ্দন ! (হে জনার্দ্দন ! ) উৎসন্নকুলধর্ম্মাণাং (যাহাদের কুলধর্ম্ম বিনষ্ট হয়) [তেষাং] মনুষ্যাণাং (সেই সকল মনুষ্যের) নিয়তং (চিরকাল) নরকে বাসঃ (নরকে বাস) ভবতি (হয়), ইতি (এরূপ) [বয়ং] অনুশুশ্রুম (আমরা শুনিয়াছি) ॥৪৩॥

হে জনার্দ্দন ! শুনিয়াছি যে সকল মনুষ্যের কুলধর্ম্ম, জাতিধর্ম্ম ও আশ্রমধর্ম্ম উৎসন্ন হইয়া যায়, তাহাদিগকে নিয়ত নরকে বাস করিতে হয় ॥৪৩॥



অহোবত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ম্ ।
যদ্রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ ॥৪৪॥

অহোবত (হায় ! কি দুঃখের বিষয়) বয়ং (আমরা) মহৎ পাপং (মহাপাপ) কর্ত্তুং (করিতে) ব্যবসিতাঃ (কৃতনিশ্চয় হইয়াছি) যৎ (যেহেতু) রাজ্যসুখলোভেন (রাজ্যসুখ লোভে) স্বজনং হন্তুং (আত্মীয়-বধে) উদ্যতাঃ (উদ্যত হইয়াছি) ॥৪৪॥

হায় ! আমরা কি মহৎ পাপ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছি, যেহেতু তুচ্ছ রাজ্যসুখের লোভে স্বজন বধে উদ্যত হইয়াছি ॥৪৪॥



যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ ॥৪৫॥

যদি (যদি) শস্ত্রপাণয়ঃ (অস্ত্রধারী) ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ (ধৃতরাষ্ট্রপুত্ত্রগণ) অপ্রতীকারং (প্রতীকার রহিত) অশস্ত্রং (ও শস্ত্রহীন) মাং (আমাকে) রণে (যুদ্ধে) হন্যুঃ (বধ করে) তৎ (তবে তাহাই) মে (আমার পক্ষে) ক্ষেমতরং (অধিকতর হিতকর) ভবেৎ (হইবে) ॥৪৫॥

যদি অস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্র-পুত্ত্রগণ প্রতীকার-বিমুখ ও অস্ত্রহীন অবস্থায় আমাকে এই রণস্থলে হত্যা করে, তাহাই আমার পক্ষে মঙ্গলজনক হইবে ॥৪৫॥



সঞ্জয় উবাচ—
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ ॥৪৬॥

সঞ্জয়ঃ উবাচ (সঞ্জয় কহিলেন) অর্জ্জুনঃ (অর্জ্জুন) এবং উক্ত্বা (এইরূপ বলিয়া) সংখ্যে (যুদ্ধক্ষেত্রে) সশরং চাপং (শরের সহিত ধনুঃ) বিসৃজ্য (পরিত্যাগপূর্ব্বক) শোকসংবিগ্নমানসঃ (শোকাকুল চিত্ত হইয়া) রথোপস্থে (রথোপরি) উপাবিশৎ (উপবিষ্ট হইলেন) ॥৪৬॥

সঞ্জয় কহিলেন—অর্জ্জুন এই বলিয়া সেই সংগ্রাম স্থলে ধনুর্ব্বাণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক শোকাকুলিত চিত্তে রথোপরি উপবেশন করিলেন ॥৪৬॥



ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে সৈন্যদর্শনং নাম
প্রথমোঽধ্যায়ঃ ॥

ইতি প্রথম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥

                                                                                                   গ্রন্থ-সম্পাদক—
                                                                                       ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
                                                                                         শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
                                                                                        শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল

১) সঞ্জয়ের দিব্যচক্ষু প্রাপ্তি

যুদ্ধারম্ভের পূর্বে ব্যাসদেব অন্ধরাজকে যুদ্ধদর্শনার্থ দিব্যচক্ষু প্রদান করিতে চাহিলেন । ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অসম্মত হইয়া বলিলেন – আমি জ্ঞাতি-কুটুম্বের নিধন দেখিতে চাই না, আপনার তপঃপ্রভাবে যাহাতে যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথ শ্রবণ করিতে পারি, আপনি তাহাই করুন । তখন ব্যাসদেব রাজ-অমাত্য সঞ্জয়কে বর প্রদান করেন । সেই বরপ্রভাবে তিনি দিব্যদৃষ্টি লাভ করিয়া যুদ্ধাদি সন্দর্শন ও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বাক্যাদি-শ্রবণ ও মনোভাব সমস্ত পরিজ্ঞাত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট বর্ণনা করিয়াছিলেন । গীতার সমস্তই সঞ্জয়-বাক্য [মভাঃ|ভীঃ|১|২৪] । ‘পরম যোগশক্তির আধার মহামুনি ব্যাস যে এই দিব্য চক্ষু সঞ্জয়কে দিতে সক্ষম ছিলেন, তাহা অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ দেখিতে পাই না’ – শ্রীঅরবিন্দ ।

ধর্মক্ষেত্র – যুদ্ধক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র

কুরুক্ষেত্র চিরকালই পরম পুণ্যভূমি বলিয়া পরিচিত । জাবাল উপনিষদে ও শতপথব্রাহ্মণে ইহাকে দেবযজন অর্থাৎ দেবতাদের ‘যজ্ঞস্থান’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । ইহার প্রাচীন নাম সমন্তপঞ্চক । পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করিয়া এই স্থানে পিতৃ-তর্পণ করিয়াছিলেন । দুর্যোধনাদির পূর্বপুরুষ বিখ্যাত কুরু রাজা এই স্থানে হল-চালনা করিয়া এই বর লাভ করিয়াছিলেন যে, যে-ব্যক্তি এই স্থানে তপস্যা করিবে অথবা যুদ্ধে প্রাণত্যাগ করিবে, সে স্বর্গে গমন করিবে । তদবধিই ইহার নাম কুরুক্ষেত্র । প্রাচীন গ্রন্থাদীতে সর্বত্রই কুরুক্ষেত্রকে ধর্মক্ষেত্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে । বনপর্বের তীর্থযাত্রা পর্বাধ্যায়ে কুরুক্ষেত্রকে তিন লোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে; সুতরাং ‘ধর্মক্ষেত্র’ এই বিশেষণটি একান্ত সুসঙ্গত ও প্রয়োজনীয় ।

৩) ‘আপনার ধীমান শিষ্য’ – এ-কথাটি দুর্যোধন শ্লেষাত্মক ভাবেই ব্যবহার করিয়াছেন । আবার ‘ধৃষ্টদ্যুম্ন’ না বলিয়া ‘দ্রুপদপুত্র’ বলিয়া দ্রোণাচার্যের পূর্বশত্রুতা স্মরণ করাইয়া দিতেছেন ।

৫) কুন্তিভোজঃ পুরুজিৎ – একই ব্যক্তি, ইনি ভীমসেনাদির মাতুল । কুন্তিভোজ কৌলিক নাম ।

৬) মহারথ = যিনি একাকী দশ-সহস্র ধনুর্ধারীর সহিত যুদ্ধ করেন এবং যিনি শস্ত্রশাস্ত্রে প্রবীণ, তিনিই মহারথ ।

৮) সমিতিঞ্জয়ঃ = সমিতি(সংগ্রামে) জয় লাভ করে যে অর্থাৎ যুদ্ধজয়ী ।
সৌমদত্তিঃ = সোমদত্ত-পুত্র বিখ্যাত ভূরিশ্রবা ।

১০) পর্যাপ্ত = যাহা আয়ত্ত করা যায়, পরিমাণ করা যায় অর্থাৎ পরিমিত, সীমাবদ্ধ । অর্থান্তরে যথেষ্ট, সমর্থ ।
অপর্যাপ্ত = অপরিমিত, অসংখ্য । অর্থান্তরে অপ্রচুর, অসমর্থ ।
এই অনুবাদে প্রথম অর্থই গ্রহণ করে তাৎপর্য এইভাবে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে – ‘আমাদের সৈন্য অপরিমিত অর্থাৎ বৃহৎ, তাহাতে বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম আমাদের সেনাপতি; আর উহাদের সৈন্য পরিমিত অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, আর নগন্য ভীম উহাদের সেনাপতি – সুতরাং আমাদের জয় হইবে না কেন ?’

শ্রীধর স্বামীর টীকায় শেষোক্ত ব্যাখ্যাই আছে । এঁনার মতে, পরের শ্লোকে ‘সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন’ এ-কথায় বুঝা যায় যে, দুর্যোধনের মনে কিছু ভয়ের উদ্রেক হইয়াছিল এবং তিনি নিজের সৈন্যবল অপ্রচুর বা অসমর্থ মনে করিতেছেন । কিন্তু দুর্যোধনের ভয় পাওয়ার কথা মহাভারতে কোথাও নাই । বরং ঠিক ইহার বিপরীত কথাই আছে [মভাঃ|উঃ|১-৬৯, মভাঃ|ভীঃ|৫১|৬|৯] যাহা হইতে বুঝা যায় যে সকলকে উৎসাহ-দানার্থই এ-সকল কথা বলা হইয়াছিল । এই কারণে লোকমান্য তিলক প্রমুখ অনেকে পূর্বোক্ত প্রথম অর্থই গ্রহণ করিয়াছেন ।

১১) ‘সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করুন’ – দুর্যোধনের এই আশঙ্কার তাৎপর্য
ভীষ্ম সমরে অপরাজেয়, তথাপি তাঁহার জন্য দুর্যোধনের এত আশঙ্কা কেন ? দুর্যোধন পূর্বেই এই আশঙ্কা ব্যক্ত করিয়াছেন – ‘ভীষ্ম একাই সসৈন্য পাণ্ডবকে বধ করিতে পারেন, কিন্তু তিনি শিখণ্ডীকে বধ করিবেন না, সুতরাং সকলে সতর্ক হইয়া সর্ব দিক হইতে ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন, আমরা যেন জম্বুক-শিখণ্ডী দ্বারা অতর্কিতভাবে ভীষ্মসিংহকে বধ না করাই’ [মভাঃ|ভীঃ|১৫|১৪-২০] ।

১৩) পণব = মৃদঙ্গ, আনক = ঢাক, গোমুখ = রণশঙ্খ; সেকালের বিউগ্‌ল্‌ (bugle) ছিল শঙ্খ ।

২৪) ভারত = দুষ্মন্ত-রাজার পুত্র ভরতের বংশধর, এখানে ধৃতরাষ্ট্র ।
গুড়াকেশেন = গুড়াকা (নিদ্রা, আলস্য), তাহার ঈশ, অর্থাৎ নিদ্রালস্যজয়ী, এখানে অর্জুন ।
হৃষীকেশঃ = হৃষীক ইন্দ্রিয়, তাহার ঈশ, অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গণের প্রভু, শ্রীকৃষ্ণ ।

৩৬) আততায়ী (assassin)
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ । ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ।।
ছয়জন আততায়ী – (i)অগ্নিদ (যে ঘরে আগুন দেয়), (ii)গরদ (যে বিষ দেয়), (iii)বধার্থ অস্ত্রধারী, (iv)ধনাপহারী, (v)ভূমি-অপহারী ও (vi)দারা-হরণকারী ।
দুর্যোধনাদি প্রায় এ-সমস্ত কর্মই করিয়াছেন; সুতরাং তাহারা আততায়ী ।
Six types of assassin (who can be killed as per law) : one who (i)commits arson, (ii)gives poison, (iii)wields weapon to kill, (iv)steals wealth, (v)steals land, (vi)steals wife.
অর্থশাস্ত্রমতে (law) আততায়ী বধ্য [মনু|৮|৩৫০-৫১] । কিন্তু ধর্মশাস্ত্রমতে (morality) “অহিংসা পরমো ধর্মঃ’, ‘গুরুজনাদিরবধ্যঃ’, ‘ন পাপে প্রতিপাপঃ স্যাৎ’ ইত্যাদি । অর্থশাস্ত্র হইতে ধর্মশাস্ত্র বলবৎ । সুতরাং আততায়ী হইলেও গুরুজনাদি-বধে পাপভাগী হইতে হইবে, ইহাই অর্জুনোক্তির মর্ম ।

৪২) বর্ণধর্ম = ব্রাহ্মণের অধ্যাপনাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষাদি, বৈশ্যের কৃষি-বাণিজ্যাদি, শূদ্রের পরিচর্যাদি । (অর্জুন এস্থলে জাতিধর্ম ও বর্ণধর্ম সমার্থক রূপে ব্যবহার করিয়াছেন কিন্তু মানুষের জাতি তার জন্মের সহিত সম্পর্কিত আর শ্রীকৃষ্ণের বর্ণ মানুষের গুণের ও কর্মের সহিত সম্পর্কিত [গীতা|৪|১৩], uploader’s comment ।) বর্ণ বনাম জাতি
কুলধর্ম = কৌলিক উপাসনা-পদ্ধতি ও আচার-নিয়মাদি ।
আশ্রমধর্ম = ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ, সন্ন্যাস ।

সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
             ০২। http://www.scsmathinternational.com
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।