শ্রীভগবান্ উবাচ—
অনাশ্রিতঃ কর্ম্মফলং কার্য্যং কর্ম্ম করোতি যঃ ।স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ ॥১॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) যঃ (যে ব্যক্তি) কর্ম্মফলং (কর্ম্মফলের) অনাশ্রিতঃ (অপেক্ষা না করিয়া) কার্য্যং (অবশ্য করণীয়) কর্ম্ম (শান্ত্র বিহিত কর্ম্ম) করোতি (করেন) সঃ চ (তিনিই) সন্ন্যাসী (সন্ন্যাসী) যোগী চ (এবং তিনিই যোগী) ; ন নিরগ্নিঃ (অগ্নিহোত্রাদি কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগীও সন্ন্যাসী নহেন) ন চ অক্রিয়ঃ (বা শারীর কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগীও যোগী নহেন) ॥১॥
শ্রীভগবান্ বলিলেন—যে ব্যক্তি কর্ম্মফলের অপেক্ষা না রাখিয়া শাস্ত্রবিহিত অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম সকল আচরণ করেন, তাঁহাকেই প্রকৃত সন্ন্যাসী এবং প্রকৃত যোগী বলিয়া জানিবে । যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগী তিনিও সন্ন্যাসী নহেন, বা যিনি শারীর কর্ম্মমাত্র পরিত্যাগী তিনিও যোগী হহেন ॥১॥
যং সন্ন্যাসমিতি প্রাহুর্যোগং তং বিদ্ধি পাণ্ডব । ন হ্যসংন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন ॥২॥ |
[হে] পাণ্ডব (হে পাণ্ডব !) [সুধিয়ঃ] (পণ্ডিতগণ) যং (যে নিষ্কাম কর্ম্মযোগকে) সন্ন্যাসম্ ইতি (সন্ন্যাস বলিয়া) প্রাহুঃ (অভিহিত করেন) তম্ [এব] (তাহাকেই) যোগং (অষ্টাঙ্গ যোগ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) । হি (যেহেতু) অসংন্যস্তসঙ্কল্পঃ (ফলাসক্তি ত্যাগ [যাহানিষ্কাম কর্ম্মযোগের বৈশিষ্ট্য] না করিয়া) কশ্চন (কেহই) যোগী (জ্ঞানযোগী বা অষ্টাঙ্গ যোগী) ন ভবতি (হন না) ॥২॥
হে অর্জ্জুন ! সুধীগণ যে নিষ্কাম কর্ম্মযোগকে সন্ন্যাস বলিয়া কীর্ত্তন করেন, তাহাকেই তুমি অষ্টাঙ্গ যোগ বলিয়া জানিবে । যেহেতু, ফলাকাঙ্ক্ষা ও বিষয় ভোগ স্পৃহা পরিত্যাগ (যাহানিষ্কাম কর্ম্মযোগের বৈশিষ্ট্য) না করিয়া কেহই জ্ঞানযোগী বা অষ্টাঙ্গ যোগী বলিয়া অভিহিত হইতে পারেন না ॥২॥
আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম্ম কারণমুচ্যতে । যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ॥৩॥ |
যোগম্ (নিশ্চল ধ্যান যোগ) আরুরুক্ষোঃ (আরোহণেচ্ছু) মুনেঃ (যোগাভ্যাসকারীর) [তদারোহে] (যোগারোহণে) কর্ম্ম (কর্ম্মই) কারণম্ (কারণ বলিয়া) উচ্যতে (অভিহিত হয়) । তস্যৈব যোগারূঢ়স্য (সেই ব্যক্তিই যোগারূঢ় অর্থাৎ ধ্যাননিষ্ঠ হইলে) শমঃ (সর্ব্বকর্ম্মত্যাগ) কারণম্ (কারণ বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়) ॥৩॥
নিশ্চল ধ্যানযোগে আরোহণেচ্ছু মুনির যোগারোহণে প্রথমতঃ কর্ম্মই কারণ বলিয়া কথিত হয় । সেই ব্যক্তিই পরে ধ্যাননিষ্ট হইলে সর্ব্ব কর্ম্ম ত্যাগই তখন তাঁহার ধ্যানযোগে কারণ বলিয়া অভিহিত হয় ॥৩॥
যদা হি নেন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্ম্মস্বনুষজ্জতে । সর্ব্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী যোগারূঢ়স্তদোচ্যতে ॥৪॥ |
যদা হি (যে কালে) [যোগী) (যোগী) ইন্দ্রিয়ার্থেষু (ইন্দ্রিয়ভোগ্য শব্দাদি বিষয়ে) কর্ম্মসু [চ] (এবং তৎসাধন কর্ম্মে) ন অনুষজ্জতে (আসক্তি করেন না) সর্ব্বসঙ্কল্পসন্ন্যাসী [চ ভবতি] (এবং সমস্ত সঙ্কল্প ত্যাগ করেন) তদা (তখনই) যোগারূঢ়ঃ উচ্যতে (যোগারূঢ় শব্দ বাচ্য হন) ॥৪॥
যে সময়ে যোগী ব্যক্তি ইন্দ্রিয় ভোগ্য রূপ রসাদি বিষয় সকলের প্রতি এবং ভোগ সাধন যোগ্য কর্ম্মে আসক্তি করেন না বিশেষতঃ পূর্ণরূপে সমস্ত সঙ্কল্পের পরিত্যাগ আচরণ করেন, তখনই তিনি যোগারূঢ় নামে অভিহিত হইয়া থাকেন ॥৪॥
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ । আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥৫॥ |
আত্মনা (অনাসক্ত মন দ্বারা) আত্মানং (জীবাত্মাকে) উদ্ধরেৎ (সংসার হইতে উদ্ধার করিবে), [আত্মনা] (বিষয়াসক্ত মন দ্বারা) আত্মানম্ (জীবাত্মাকে) ন অবসাদয়েৎ (সংসারে পাতিত করিবে না) । হি (যেহেতু) আত্মা এব (মনই) আত্মনঃ (জীবের) বন্ধুঃ (বন্ধু) আত্মা এব (মনই) আত্মনঃ (জীবের) রিপুঃ (শত্রু) ॥৫॥
বিষয়ে অনাসক্ত মন দ্বারা জীবাত্মাকে সংসারকূপ হইতে উদ্ধার করিবে, কখনও বিষয়াসক্ত মন দ্বারা জীবাত্মাকে সংসারে পাতিত করিবে না । যেহেতু মনই জীবের বন্ধু এবং অবস্থাভেদে আবার সেই মনই শত্রু হইয়া থাকে ॥৫॥
বন্ধুরাত্মাত্মনস্তস্য যেনৈবাত্মাত্মনা জিতঃ । অনাত্মনস্তু শত্রুত্বে বর্ত্তেতাত্মৈব শত্রুবৎ ॥৬॥ |
যেন আত্মনা (যে জীবাত্মা কর্ত্তৃক) আত্মা (মন) জিতঃ (বশীকৃত হইয়াছে) তস্য (সেই) আত্মনঃ (জীবাত্মার) আত্মা এব (মনই) বন্ধুঃ (বন্ধু) ; তু (কিন্তু) অনাত্মনঃ (অজিতমনা ব্যক্তির) আত্মা এব (মনই) শত্রুবৎ (শত্রুর ন্যায়) শত্রুত্বে (অপকারে) বর্ত্তেত (প্রবৃত্ত হয়) ॥৬॥
যে জীব নিজের মনকে জয় করিয়াছেন, তাঁহার সেই মনই বন্ধু অর্থাৎ বন্ধুর মত হিতকারী ; কিন্তু অজিতমনা ব্যক্তির সেই মনই শত্রুর ন্যায় সর্ব্বদা অপকারে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে ॥৬॥
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ । শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু তথা মানাপমানয়োঃ ॥৭॥ |
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু (শীত-উষ্ণ ও সুখ দুঃখে) তথা মানাপমানয়োঃ (এবং মান ও অপমানে) প্রশান্তস্য (রাগদ্বেষ রহিত) জিতাত্মনঃ (জিতমনা যোগীর) আত্মা (আত্মা) পরম্ (অতিশয়) সমাহিতঃ (সমাধিস্থ) [ভবেৎ) (হয়) ॥৭॥
শীত-উষ্ণ, সুখ-দুঃখ, এবং মান-অপমান প্রভৃতি বিষয়ে রাগ-দ্বেষ শূন্য এবং বিজিতমনা যোগী ব্যক্তির আত্মা বিশেষভাবে সমাধিস্থ হইয়া থাকে ॥৭॥
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা কূটস্থো বিজিতেন্দ্রিয়ঃ । যুক্ত ইত্যুচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ ॥৮॥ |
জ্ঞানবিজ্ঞানতৃপ্তাত্মা (শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও অপরোক্ষানুভূতি দ্বারা সন্তুষ্ট চিত্ত) কূটস্থঃ (সর্ব্বকাল এক স্বভাবে অবস্থিত) বিজিতেন্দ্রিয়ঃ (জিতেন্দ্রিয়) সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চনঃ (এবং মৃত্তিকা, পাষাণ ও সুবর্ণে তুল্য দৃষ্টি) যোগী (যোগী) যুক্তঃ ইতি (আত্ম দর্শন যোগ্য বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥৮॥
শাস্ত্রীয় জ্ঞান ও সাক্ষাৎ অনুভূতির দ্বারা সর্ব্বদা সন্তুষ্টচিত্ত, সদা চিৎস্বভাবে স্থিত, জিতেন্দ্রিয় ও মৃৎপিণ্ড প্রস্তর অথবা সুবর্ণে তুল্যদৃষ্টিবিশিষ্ট যোগী ব্যক্তি আত্মদর্শনযোগ্য বলিয়া কথিত হন ॥৮॥
সুহৃন্মিত্রার্য্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু । সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে ॥৯॥ |
সুহৃম্মিত্রার্য্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু (স্বভাবতবঃ হিতাশংসী, কোনরূপ স্নেহবশতঃ হিতকারী, শত্রু, বিবাদস্থলে উপেক্ষক, বিবাদ সমাধানেচ্ছু দ্বেষপাত্র, বন্ধু) সাধুষু (সাধু) পাপেষু চ অপি (এবং পাপচারী ব্যাক্তি সমূহের প্রতিও) সমবুদ্ধিঃ (তুল্য বুদ্ধি যোগী) বিশিষ্যতে (লোষ্ট্র, পাষাণ ও সুবর্ণে সমদৃষ্টি সম্পন্ন যোগী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ) ॥৯॥
স্বভাবতঃ হিতকারী, কোনরূপ স্নেহবশতঃ হিতকামী, শত্রু, উপেক্ষক, বিবাদ সমাধানেচ্ছু, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও পাপাচারী প্রভৃতি সমস্ত জীবের প্রতি সমবুদ্ধিশালী যোগী সমলোষ্ট্রাশ্মকাঞ্চন যোগী অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বলিয়া জানিবে ॥৯॥
যোগী যুঞ্জীত সততমাত্মানং রহসি স্থিতঃ । একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীরপরিগ্রহঃ ॥১০॥ |
যোগী (যোগে আরোহণকারী ব্যক্তি) সততম্ (নিরন্তর) রহসি (নির্জ্জন স্থানে) একাকী (সঙ্গ রহিত) স্থিতঃ (অবস্থান পূর্ব্বক) যতচিত্তাত্মা (সংযত চিত্ত, সংযত দেহ যুক্ত) নিরাশীঃ (নিস্পৃহ) অপরিগ্রহঃ (এবং বিষয় পরিগ্রহ রহিত হইয়া) আত্মানং (মনকে) যুঞ্জীত (সমাধিযুক্ত করিবেন) ॥১০॥
যোগ সাধন আরম্ভকারী ব্যক্তি নিরন্তর সঙ্গরহিত নির্জ্জন স্থানে অবস্থান পূর্ব্বক চিত্ত ও দেহকে সংযত করিয়া এবং আকাঙ্ক্ষা ও বিষয়পরিগ্রহ শূন্য হইয়া মনকে সমাধিযুক্ত করিবেন ॥১০॥
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠাপ্য স্থিরমাসনমাত্মনঃ । নাত্যুচ্ছ্রিতং নাতিনীচং চেলাজিনকুশোত্তরম্ ॥১১॥ তত্রৈকাগ্রং মনঃ কৃত্বা যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ । উপবিশ্যাসনে যুঞ্জ্যাদ্যোগমাত্মবিশুদ্ধয়ে ॥১২॥ |
শুচৌ (পবিত্র) দেশে (স্থানে) স্থিরম্ (নিশ্চল) ন অত্যুচ্ছ্রিতং (অতি উচ্চ নয়) ন অতিনীচং (অতি নীচ নয়) চেলাজিনকুশোত্তরম্ (ক্রমান্বয়ে কুশ, মৃগচর্ম্মও বস্ত্র দ্বারা রচিত) আত্মনঃ (নিজের) আসনং (আসন) প্রতিষ্ঠাপ্য (সংস্থাপন পূর্ব্বক) তত্র (সেই আসনে) উপবিশ্য (বসিয়া) যতচিত্তেন্দ্রিয়ক্রিয়ঃ (চিত্ত ও ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়া সংযমন পূর্ব্বক) মনঃ (মনকে) একাগ্রং (একাগ্র) কৃত্বা (করিয়া) আত্মবিশুদ্ধয়ে (ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারের যোগ্যতা লাভের জন্য) যোগম্ (সমাধি) যুঞ্জ্যাৎ (অভ্যাস করিবেন) ॥১১–১২॥
পবিত্র স্থানে অতি উচ্চ না হয় এবং অতি নীচও না হয় এরূপ কুশোপরিস্থ মৃগচর্ম্মাদির আসনের উপর বস্ত্রদ্বারা রচিত নিজের নিশ্চল আসন সংস্থাপন পূর্ব্বক সেই আসনে উপবেশন করতঃ চিত্ত ও ইন্দ্রিয়গণের ক্রিয়াকে সংযত করিয়া মনকে একাগ্র করতঃ চিত্তশুদ্ধির জন্য সমাধি অভ্যাস করিবেন ॥১১–১২॥
সমং কায়শিরোগ্রীবং ধারয়ন্নচলং স্থিরঃ । সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রং স্বং দিশশ্চানবলোকয়ন্ ॥১৩॥ প্রশান্তাত্মা বিগতভীর্ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ । মনঃ সংযম্য মচ্চিত্তো যুক্ত আসীত মৎপরঃ ॥১৪॥ |
কায়শিরোগ্রীবং (শরীর, মস্তকও গলদেশ) সমং (সরল) অচলং (ও নিশ্চলভাবে) ধারয়ন্ (রাখিয়া) স্থিরঃ [সন্] (স্থির হইয়া) স্বং (নিজ) নাসিকাগ্রং (নাসিকার অগ্রভাগ) সংপ্রেক্ষ্য (দর্শন করিয়া অর্থাৎ চক্ষুর্দ্বয়ের মধ্যে দৃষ্টি স্থাপন পূর্ব্বক) দিশঃ চ (ও দিক্ সমূহে) অনবলোকয়ন্ (দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিয়া) প্রশান্তাত্মা (অক্ষুব্ধ মন), বিগতভীঃ (নির্ভয়), ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ (ব্রহ্মচর্য্যপরায়ণ) মনঃ সংযম্য (ও মন সংযমন পূর্ব্বক) মচ্চিত্তঃ (চতুর্ভুজ সুন্দরাকৃতি আমাকে চিন্তা করিতে করিতে) মৎপরঃ (আমার প্রতি ভক্তি পরায়ণ) যুক্তঃ (যোগী) আসীত (অবস্থান করিবেন) ॥১৩–১৪॥
দেহ-মধ্যভাগ, মস্তক ও গলদেশকে সরল ও নিশ্চলভাবে রাখিয়া স্থির হইয়া নিজের নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি স্থাপন পূর্ব্বক অন্য কোনও দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করিয়া অক্ষুব্ধ মন, ভয় শূন্য ও ব্রহ্মচর্য্য ব্রতধারী যোগী পুরুষ মনকে সমস্ত জড়ীয় বিষয় হইতে সংযমন পূর্ব্বক চতুর্ভুজ স্বরূপ আমার বিষ্ণুমূর্ত্তি চিন্তা করতঃ আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া যোগ অভ্যাস করিবেন ॥১৩–১৪॥
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী নিয়তমানসঃ । শান্তিং নির্ব্বাণপরমাং মৎসংস্থামধিগচ্ছতি ॥১৫॥ |
এবং (উক্ত প্রকারে) সদা (সর্ব্বদা) আত্মানং (মনকে) যুঞ্জন্ (ধ্যান যোগযুক্ত করিয়া) নিয়তমানসঃ (বিষয় নিবৃত্ত চিত্ত) যোগী (যোগী) মৎসংস্থাম্ (আমার জ্যোতিঃ স্বরূপ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মগতা) নির্ব্বাণপরমাং (নির্ব্বাণ প্রধান) শান্তিং (সংসার উপরিত [নাশ] রূপ মুক্তি) অধিগচ্ছতি (প্রাপ্ত হন) ॥১৫॥
এইরূপে সর্ব্বদা মনকে ধ্যানযোগ নিরত করিয়া বিষয়াভিলাষ-নিবৃত্ত-চিত্ত যোগী আমার জ্যোতিঃ স্বরূপ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মগতা যে নির্ব্বাণ মুক্তি বা সংসার নাশরূপ মোক্ষ, তাহা প্রাপ্ত হন ॥১৫॥
নাত্যশ্নতস্তু যোগোঽস্তি ন চৈকান্তমনশ্নতঃ । ন চাতিস্বপ্নশীলস্য জাগ্রতো নৈব চার্জ্জুন ॥১৬॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন ! ) অতি অশ্নতঃ তু (অতি ভোজনকারীর) যোগঃ (যোগ অর্থাৎ সমাধি) ন অস্তি (হয় না), একান্তম্ (নিতান্ত) অনশ্নতঃ (অনাহারীর ও) ন চ (হয় না), অতিস্বপ্নশীলস্য (অত্যন্ত নিদ্রালুরও) ন চ (হয় না) জাগ্রতঃ এব ন চ (জাগরণকারীর ও যোগ-সাধন হয় না) ॥১৬॥
হে অর্জ্জুন! অধিক ভোজনকারী বা নিতান্ত অনাহারী, অধিক নিদ্রাপ্রিয় বা নিতান্ত নিদ্রাশূন্য ইঁহাদের মধ্যে কাহারও যোগ-সাধন সম্ভব হয় না ॥১৬॥
যুক্তাহারবিহারস্য যুক্তচেষ্টস্য কর্ম্মসু । যুক্তস্বপ্নাববোধস্য যোগো ভবতি দুঃখহা ॥১৭॥ |
যুক্তাহারবিহারস্য (নিয়মিত আহার ও বিহারকারী) কর্ম্মসু (কর্ম্ম সমূহে) যুক্তচেষ্টস্য (নিয়মিত চেষ্টা বিশিষ্ট) যুক্তস্বপ্নাববোধস্য (পরিমিত নিদ্রা ও জাগরণকারী ব্যক্তির) দুঃখহা (দুঃখহরণে যোগ্য) যোগঃ (যোগ) ভবতি (হয়) ॥১৭॥
নিয়মিত ভাবে আহার, নিয়মিত ভাবে বিহার, কর্ম্ম সকলে নিয়মিত চেষ্টাযুক্ত, পরিমিত নিদ্রা ও পরিমিত জাগরণকারী ব্যক্তিদিগেরই ক্রমশঃ চেষ্টা দ্বারা জড়-দুঃখ-নাশী যোগ সম্ভব হইয়া থাকে ॥১৭॥
যদা বিনিয়তং চিত্তমাত্মন্যেবাবতিষ্ঠতে । নিস্পৃহঃ সর্ব্বকামেভ্যো যুক্ত ইত্যুচ্যতে তদা ॥১৮॥ |
যদা (যখন) বিনিয়তং (নিরুদ্ধ) চিত্তম্ (চিত্ত) আত্মনি এব (আত্মাতেই) অবতিষ্ঠতে (অবস্থান করে) তদা (তখন) সর্ব্বকামেভ্যঃ (সমস্ত কামনা হইতে) নিস্পৃহঃ (বিরত ব্যক্তি) যুক্তঃ ইতি (যোগযুক্ত বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হন) ॥১৮॥
যখন যোগীর চিত্তবৃত্তির বহির্ম্মখতা নিরুদ্ধ হইয়া কেবল আত্মতত্ত্বেই নিশ্চল ভাবে অবস্থান করে, তখন সমস্ত জড় কামনা শূন্য সেই ব্যক্তি যোগযুক্ত বলিয়া কথিত হইয়া থাকেন ॥১৮॥
যথা দীপো নিবাতস্থো নেঙ্গতে সোপমা স্মৃতা । যোগিনো যতচিত্তস্য যুঞ্জতো যোগমাত্মনঃ ॥১৯॥ |
যথা (যেরূপ) নিবাতস্থঃ (বায়ু শূন্য স্থানে অবস্থিত) দীপঃ (প্রদীপশিখা) ন ইঙ্গতে (বিচলিত হয় না) আত্মনঃ (আত্ম বিষয়ক) যোগম্ (যোগ) যুঞ্জুতঃ (অভ্যাসকারী) যতচিত্তস্য (একাগ্রচিত্ত) যোগিনঃ (যোগীর) সা (সেই) উপমা (দৃষ্টান্ত) স্মৃতা (কথিত হয়) ॥১৯॥
যেরূপ বায়ু শূন্য স্থানে অবস্থিত প্রদীপ (শিখা) কোন প্রকারে বিচলিত হয় না, আত্মতত্ত্বনিবিষ্ট একাগ্রচিত্ত যোগীর চিত্তের দৃষ্টান্ত সেইরূপ জানিবে ॥১৯॥
যত্রোপরমতে চিত্তং নিরুদ্ধং যোগসেবয়া । যত্র চৈবাত্মনাত্মানং পশ্যন্নাত্মনি তুষ্যতি ॥২০॥ সুখমাত্যন্তিকং যত্তদ্বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্রিয়ম্ । বেত্তি যত্র ন চৈবায়ং স্থিতশ্চলতি তত্ত্বতঃ ॥২১॥ যং লব্ধ্বা চাপরং লাভং মন্যতে নাধিকং ততঃ । যস্মিন্ স্থিতো ন দুঃখেন গুরুণাপি বিচাল্যতে ॥২২॥ তং বিদ্যাদ্দুঃখসংযোগবিয়োগং যোগসংজ্ঞিতম্ । স নিশ্চয়েন যোক্তব্যো যোগোঽনির্ব্বিণ্ণচেতসা ॥২৩॥ |
যত্র (যে সমাধি হইলে) যোগসেবয়া (যোগের অভ্যাস দ্বারা) নিরুদ্ধং (নিরোধ প্রাপ্ত) চিত্তং (চিত্ত) উপরমতে (জড়সম্বন্ধ হইতে উপশম প্রাপ্ত হয়), যত্র চ (এবং যে সমাধিতে) আত্মনা (পরমাত্মাকার অন্তঃকরণ দ্বারা) আত্মানং (পরমাত্মাকে) পশ্যন্ (দেখিয়া) আত্মনি (তাঁহাতেই) তুষ্যতি (তুষ্ট হন) । যত্র (যে সমাধি হইলে) অয়ং (এই যোগী) বুদ্ধিগ্রাহ্যম্ (আত্মাকার বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণীয়) অতীন্দ্রিয়ম্ (বিষয়েন্দ্রিয় সম্পর্ক রহিত) আত্যন্তিকং (নিত্য) যৎ সুখম্ (যে সুখ) তৎ বেত্তি (তাহা অনুভব করেন), [যত্র] চ (এবং যে সমাধিতে) স্থিতঃ [সন্] (অবস্থিত হইয়া) তত্ত্বতঃ (আত্ম স্বরূপ হইতে) ন চলতি (বিচলিত হন না) । যং লব্ধা (যাহাকে লাভ করিলে) অপরং লাভং (অন্য লাভকে) ততঃ (তাহা হইতে) অধিকং (অধিক) ন মন্যতে (মনে করেন না), যস্মিন্ চ (এবং যাহাতে) স্থিতঃ [সন্] (অবস্থিত হইয়া) গুরুণা (গুরুতর) দুঃখেন অপি (দুঃখ দ্বারাও) ন বিচাল্যতে (বিচলিত হন না) । দুঃখসংযোগবিয়োগং (যাহাতে দুঃখের সংযোগ হইবামাত্র বিয়োগ হয়) তং (তাহাকে) যোগসংজ্ঞিতম্ (যোগসংজ্ঞা প্রাপ্ত সমাধি বলিয়া) বিদ্যাৎ (জানিবে) ; অনির্ব্বিণ্ণচেতসা (অবসাদশূন্যচিত্তে) সঃ যোগঃ (সেই যোগ) নিশ্চয়েন (অধ্যবসায় সহকারে) যোক্তব্যঃ (অভ্যাস করা কর্ত্তব্য) ॥২০–২৩॥
যে সমাধিতে, যোগের অভ্যাস দ্বারা নিরুদ্ধ চিত্ত জড়পদার্থ মাত্রের চিন্তা হইতে বিরতি লাভ করে, এবং যাহাতে পরমাত্মার সহিত মিলনযোগ্য চিত্ত দ্বারা পরমাত্মাকে দেখিয়া তাঁহাতেই পরিতুষ্ট থাকেন ; যে সমাধি হইলে এই যোগী আত্মাকার বুদ্ধি দ্বারা গ্রহণীয়, বিষয় ও ইন্দ্রিয়ের সম্পর্কশূন্য, নিত্য যে সুখ, তাহা অনুভব করেন ; এবং যাহাতে অবস্থিত হইয়া আত্মস্বরূপ হইতে বিচলিত হন না ; যাহাকে (যে সমাধিকে) লাভ করিলে অন্য জড়সম্বন্ধীয় কোনও লাভকে তাহা হইতে অধিক মনে করেন না, এবং যাহাতে অবস্থিত হইয়া দুঃসহ দুঃখ দ্বারাও চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না ; অতএব যাহাতে দুঃখের সংযোগ মাত্রই বিয়োগ সাধিত হইয়া থাকে, তাহাকেই ‘যোগ’ সংজ্ঞাপ্রাপ্ত সমাধি বলিয়া জানিবে । অবসাদশূন্য চিত্তে দৃঢ়তা সহকারে সেই যোগ সাধন করা কর্ত্তব্য ॥২০–২৩॥
সঙ্কল্পপ্রভবান্ কামাংস্ত্যক্ত্বা সর্ব্বানশেষতঃ । মনসৈবেন্দ্রিয়গ্রামং বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ॥২৪॥ |
সঙ্কল্পপ্রভবান্ (সঙ্কল্প হইতে জাত) সর্ব্বান্ কামান্ (সমস্ত বিষয়কামনাকে) অশেষতঃ (বাসনার সহিত সম্পূর্ণ রূপে) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) মনসা এব (বিষয় দোষদর্শি মনের দ্বারাই) সমন্ততঃ (সর্ব্ব বিষয় হইতে) ইন্দ্রিয়গ্রামং (ইন্দ্রিয় সমূহকে) বিনিয়ম্য (নিবৃত্ত করিয়া) [যোক্তব্যঃ] (সেই যোগ অভ্যাস করিবে) ॥২৪॥
সঙ্কল্প হইতে জাত সমস্ত বিষয়-কামনাকে বাসনার সহিত নিঃশেষভাবে পরিত্যাগ করিয়া, বিষয় বাসনার দোষ-দর্শনকারী মনের দ্বারাই সমস্ত বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সমূহকে নিবৃত্ত করিয়া সেই পূর্ব্বোক্ত যোগ অভ্যাস করিবে ॥২৪॥
শনৈঃ শনৈরুপরমেদ্বুদ্ধ্যা ধৃতিগৃহীতয়া । আত্মসংস্থং মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েৎ ॥২৫॥ |
ধৃতি গৃহীতয়া (ধারণা দ্বারা বশীকৃত) বুদ্ধ্যা (বুদ্ধি দ্বারা) মনঃ (মনকে) আত্মসংস্থং কৃত্বা (আত্মাতে সম্যক্ নিশ্চল করিয়া) শনৈঃ শনৈঃ (ধীরে ধীরে অভ্যাস ক্রমে) উপরমেৎ (বহির্বিষয় হইতে নিবৃত্ত করতঃ সমাধিতে অবস্থান করিবে) কিঞ্চিৎ অপি (অন্য কিছুই) ন চিন্তয়েৎ (চিন্তা করিবে না) ॥২৫॥
ধারণা (যোগাঙ্গ বিশেষ) দ্বারা বশীভূত বুদ্ধির সাহায্যে মনকে আত্মাতে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চল করিয়া ধীরে ধীরে অভ্যাসক্রমে তাহাকে বাহ্য বিষয় হইতে নিবৃত্ত করতঃ সমাধিতে অবস্থান করিবে এবং কিছুমাত্রও চিন্তা করিবে না ॥২৫॥
যতো যতো নিশ্চলতি মনশ্চঞ্চলমস্থিরম্ । ততস্ততো নিয়ম্যৈতদাত্মন্যেব বশং নয়েৎ ॥২৬॥ |
চঞ্চলম্ (চঞ্চল) অস্থিরম্ (সুতরাং অস্থির) মনঃ (মন) যতঃ যতঃ (যে যে বিষয়ে) নিশ্চলতি (ধাবিত হয়), ততঃ ততঃ (সেই সেই বিষয় হইতে) এতৎ (এই মনকে) নিয়ম্য (প্রত্যাহার করিয়া) আত্মনি এব (আত্মাতেই) বশং নয়েৎ (বশীভূত করিবে) ॥২৬॥
স্বভাবতঃ চঞ্চল ও অস্থির মন, যে যে বিষয়ের প্রতি ধাবিত হইবে, সেই সেই বিষয় হইতেই যত্নপূর্ব্বক নিবৃত্ত করিয়া তাহাকে আত্মবশীভূত করিতে হইবে ॥২৬॥
প্রশান্তমনসং হ্যেনং যোগিনং সুখমুত্তমম্ । উপৈতি শান্তরজসং ব্রহ্মভূতমকল্মষম্ ॥২৭॥ |
শান্তরজসং (রজোগুণের বৃত্তি-নিবৃত্ত) প্রশান্তমনসং (প্রশান্তচিত্ত) অকল্মষম্ (রাগাদিদোষ শূন্য) ব্রহ্মভূতম্ (ও ব্রহ্মভাব সম্পন্ন) এনং (এই) যোগিনং হি (যোগীকেই) উত্তমম্ সুখম্ (আত্মানুভবরূপ মহৎ সুখ) উপৈতি (স্বয়ং বরণ করেন) ॥২৭॥
রজোগুণের ক্রিয়াশূন্য, প্রশান্তচিত্ত, রাগাদিদোষ বর্জ্জিত ও ব্রহ্মভাব সম্পন্ন এই যোগীকে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধিরূপ উত্তম সুখ স্বয়ংই আশ্রয় করে ॥২৭॥
যুঞ্জন্নেবং সদাত্মানং যোগী বিগতকল্মষঃ । সুখেন ব্রহ্মসংস্পর্শমত্যন্তং সুখমশ্নুতে ॥২৮॥ |
এবং (এইরূপে) আত্মানং (স্ব স্বরূপকে) সদা (সর্ব্বদা) যুঞ্জন্ (যোগের দ্বারা অনুভব করতঃ) বিগতকল্মষঃ (সর্ব্বদোষ শূন্য) যোগী (যোগী) সুখেন (অনায়াসে) ব্রহ্মসংস্পর্শম্ (পরমাত্মার অনুভব রূপ) অত্যন্তং সুখম্ (অপরিমিত সুখ) অশ্নুতে (প্রাপ্ত হন অর্থাৎ জীবন্মুক্ত হন) ॥২৮॥
এই প্রকার সর্ব্বদা আত্ম-স্বরূপে যোগানুভব দ্বারা বিগতকল্মষ যোগী অনায়াসে পরমাত্মানুভবরূপ প্রগাঢ় সুখ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন । (ইহাকেই ভক্তি সম্মত যোগ বলা হয়) ॥২৮॥
সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং সর্ব্বভূতানি চাত্মনি । ঈক্ষতে যোগযুক্তাত্মা সর্ব্বত্র সমদর্শনঃ ॥২৯॥ |
যোগযুক্তাত্মা (ব্রহ্মের সহিত যুক্ত অর্থাৎ তাদাত্ম্য প্রাপ্ত অন্তঃকরণ) সর্ব্বত্র সমদর্শনঃ (সর্ব্ব জীবে চেতন দর্শনকারী সেই যোগী) আত্মানং (পরমাত্মাকে) সর্ব্বভূতস্থম্ (সর্ব্বভূতে অবস্থিত) সর্ব্বভূতানি চ (এবং ভূত সমুদয়কে) আত্মনি (পরমাত্মাতে) [স্থিতঃ] (অবস্থিত) ঈক্ষতে (দর্শন করেন) ॥২৯॥
বৃহচ্চেতনের সহিত একীভূত চিত্ত ও সর্ব্বজীবে চেতন সন্দর্শনকারী সেই যোগীপুরুষ, পরমাত্মাকে সর্ব্বভূতে অবস্থিত, এবং ভূত সকলকেও পরমাত্মাতে অবস্থিত দর্শন করিয়া থাকেন ॥২৯॥
যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র সর্ব্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি । তস্যাহং ন প্রণশ্যমি স চ মে ন প্রণশ্যতি ॥৩০॥ |
যঃ (যিনি) মাং (আমাকে) সর্ব্বত্র (সকল পদার্থে) পশ্যতি (দর্শন করেন), সর্ব্বং চ (এবং সমস্ত প্রপঞ্চ) ময়ি (আমাতে) পশ্যতি (দর্শন করেন) ; অহং (আমি) তস্য (তাঁহার নিকট) ন প্রণশ্যামি (অদৃশ্য হই না) স চ (তিনিও) মে (আমার) ন প্রণশ্যতি (অদৃশ্য হন না অর্থাৎ আমার চিন্তা হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন না) ॥৩০॥
যে ব্যক্তি আমাকে সমুদয় পদার্থে দর্শন করেন, এবং আমাতেই সকল প্রপঞ্চ (বস্তু) দেখেন, আমি তাঁহার নিকট অদৃশ্য থাকি না, এবং তিনিও আমার অদৃশ্য হন না অর্থাৎ আমার চিন্তা হইতে কখনও ভ্রষ্ট হন না ॥৩০॥
সর্ব্বভূতস্থিতং যো মাং ভজত্যেকত্বমাস্থিতঃ । সর্ব্বথা বর্ত্তমানোঽপি স যোগী ময়ি বর্ত্ততে ॥৩১॥ |
যঃ (যে যোগী) সর্ব্বভূতস্থিতং (সর্ব্ব জীবের হৃদয়ে প্রাদেশ পরিমিত চতুর্ভুজ রূপে পৃথক্ পৃথক্ অবস্থিত) মাং (আমাকে) একত্বম্ (অভিন্ন রূপে) আস্থিতঃ (আশ্রয় পূর্ব্বক) ভজতি (শ্রবণ স্মরণাদি দ্বারা ভজন করেন) সঃ যোগী (সেই যোগী) সর্ব্বথা (সর্ব্ব প্রকারে অর্থাৎ শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া বা না করিয়া) বর্ত্তমানঃ অপি (অবস্থিত থাকিয়াও) ময়ি [এব] (আমাতেই) বর্ত্ততে (অবস্থিতি করেন) ॥৩১॥
যে যোগী সকল জীবের হৃদয়ে প্রাদেশ প্রমাণ চতুর্ভুজাকার পৃথক্ পৃথক্ অবস্থিত আমাকে অভিন্নরূপে আশ্রয়পূর্ব্বক শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণাদি দ্বারা ভজন করেন, সেই যোগী শাস্ত্রোক্ত কর্ম্মানুষ্ঠান করুন বা না করুন সর্ব্বদা তিনি আমাতেই বর্ত্তমান থাকেন ॥৩১॥
আত্মৌপম্যেন সর্ব্বত্র সমং পশ্যতি যোঽর্জ্জুন । সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ ॥৩২॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ (যে যোগী) আত্মৌপম্যেন (নিজের সাদৃশ্যে) সর্ব্বত্র (সর্ব্বভূতের) সুখং বা যদি বা দুঃখং (সুখ অথবা দুঃখকে) সমং (আপনার [সুখ-দুঃখের] সহিত সমানভাবে) পশ্যতি (দেখেন) সঃ যোগী (সেই যোগী) পরমঃ (সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া) মতঃ (আমার অভিমত) ॥৩২॥
হে অর্জ্জুন! যে যোগী পুরুষ নিজের তুলনায় সমস্ত জীবের সুখ অথবা দুঃখকে সমান দেখেন, অর্থাৎ অন্য জীবের সুখকে নিজ সুখের ন্যায় সুখকর এবং তার দুঃখকেও নিজ দুঃখের ন্যায় দুঃখজনক বলিয়া জানেন, সেই যোগী সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া আমার অভিমত ॥৩২॥
অর্জ্জুন উবাচ—
যোঽয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন ।এতস্যাহং ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাৎ স্থিতিং স্থিরাম্ ॥৩৩॥ |
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] মধুসূদন ! (হে মধুসূদন !) ত্বয়া (আপনা কর্ত্তৃক) সাম্যেন (স্ব-পর সুখ-দুঃখের সম দর্শন রূপ) অয়ং (এই) যঃ যোগঃ (যে যোগ) প্রোক্তঃ (কথিত হইল), [মনসঃ] (মনের) চঞ্চলত্বাৎ (চাঞ্চল্য বশতঃ) অহং (আমি) এতস্য (এই যোগের) স্থিরাম্ (নিত্য) স্থিতিং (স্থিতি) ন পশ্যামি (দেখিতেছি না) ॥৩৩॥
অর্জ্জুন কহিলেন—হে মধুসূদন ! আপনি নিজের ও পরের সুখ ও দুঃখকে সমদর্শনরূপ এই যে যোগের কথা বলিলেন, মনের চঞ্চলতা বশতঃ আমি এই যোগের নিত্যস্থায়িত্ব দেখিতে পাইতেছি না ॥৩৩॥
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবদ্দৃঢ়ম্ । তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্ ॥৩৪॥ |
[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) মনঃ (মন) চঞ্চলং হি (স্বভাবতঃ চঞ্চল), প্রমাথি (বুদ্ধি, শরীর ও ইন্দ্রিয়ের বিক্ষেপ জনক), বলবৎ (বিচার বুদ্ধি দ্বারাও অনিয়ম্য) দৃঢ়ম্ (ও দুর্ভেদ্য) । [অতঃ](অতএব) অহং (আমি) তস্য (তাহার অর্থাৎ মনের) নিগ্রহং (নিরোধ) বায়োঃ ইব (আকাশস্থ বায়ু নিরোধের ন্যায়) সুদুষ্করম্ (অত্যন্ত কঠিন) মন্যে (মনে করি) ॥৩৪॥
হে কৃষ্ণ ! মন স্বভাবতঃই চঞ্চল, বিবেকবতী বুদ্ধি, শরীর ও ইন্দ্রিয়গণের ক্ষোভকর, অজেয় ও অতিশয় দৃঢ় । সুতরাং আকাশস্থ বায়ুকে যেমন কুম্ভকাদি দ্বারা নিরোধ করা যায় না, সেরূপ অষ্টাঙ্গ যোগের দ্বারা সেই চঞ্চল মনের নিরোধও আমি অত্যন্ত কঠিন মনে করি ॥৩৪॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—
অসংশয়ং মহাবাহো মনো দুর্নিগ্রহং চলম্ ।অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে ॥৩৫॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর অর্জ্জুন !) মনঃ (মন) দুর্নিগ্রহং (দুঃখে নিগৃহীত হয়) চলম্ (ও চঞ্চল) [ইত্যত্র] (এ বিষয়ে) অসংশয়ম্ (সন্দেহ নাই), তু (কিন্তু) [হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীনন্দন !) অভ্যাসেন (সদ্গুরূপদিষ্ট প্রকারে পরমেশ্বর ধ্যানযোগের পুনঃ পুনঃ অনুশীলন) বৈরাগ্যেন চ (এবং বিষয় বৈরাগ্যের দ্বারা) গৃহ্যতে (বশীকৃত হয়) ॥৩৫॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে মহাবীর অর্জ্জুন ! মন অতি কষ্টে নিগৃহীত হয় ও চঞ্চল এবিষয়ে সংশয় নাই ; কিন্তু হে কুন্তীপুত্ত্র ! সদ্গুরুর উপদেশ মত পরমেশ্বরের ধ্যানযোগের পুনঃ পুনঃ অভ্যাস এবং বিষয়ের প্রতি বৈরাগ্যের দ্বারা সেই মনকে বশীভূত করা যায় ॥৩৫॥
অসংযতাত্মনা যোগো দুষ্প্রাপ ইতি মে মতিঃ । বশ্যাত্মনা তু যততা শক্যোঽবাপ্তুমুপায়তঃ ॥৩৬॥ |
অসংযতাত্মনা (অসংযত চিত্ত কর্ত্তৃক) যোগঃ (চিত্তবৃত্তি নিরোধ রূপ যোগ) দুষ্প্রাপঃ (দুর্ল্লভ) ইতি (ইহাই) মে (আমার) মতিঃ (বিচার) । তু (কিন্তু) যততা (যত্নশীল) বশ্যাত্মনা (ও সংযত চিত্ত ব্যক্তি) উপায়তঃ (সাধনা দ্বারা) অবাপ্তুম্ শক্যঃ (ইহাকে লাভ করিতে সমর্থ হন) ॥৩৬॥
অসংযতচিত্ত ব্যক্তির পক্ষে পূর্ব্বোক্ত চিত্তবৃত্তি নিরোধরূপ যোগ, দুষ্প্রাপ্য বলিয়াই আমার বিচার ; কিন্তু যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক মনকে বশীভূত করিতে যত্নশীল হন, তিনি অবশ্যই যোগসিদ্ধ হইয়া থাকেন ॥৩৬॥
অর্জ্জুন উবাচ—
অযতিঃ শ্রদ্ধয়োপেতো যোগাচ্চলিতমানসঃ ।অপ্রাপ্য যোগসংসিদ্ধিং কাং গতিং কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥৩৭॥ |
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন কহিলেন) [হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) শ্রদ্ধয়া উপেতঃ (যোগশাস্ত্রে বিশ্বাস বশতঃ যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত) অযতিঃ (অথচ অল্প যত্ন পুরুষ) যোগাৎ চলিতমানসঃ (অভ্যাস ও বৈরাগ্যের অভাবে যোগ হইতে ভ্রষ্ট চিত্ত হইয়া) যোগসংসিদ্ধিং (যোগের সম্যক্ ফল) অপ্রাপ্য (না পাইয়া) কাং গতিং (কি গতি) গচ্ছতি (লাভ করেন ?) ॥৩৭॥
অর্জ্জুন বলিলেন—হে কৃষ্ণ ! যোগশাস্ত্রে বিশ্বাস হেতু যোগাভ্যাসে প্রবৃত্ত হইয়া অল্পযত্নশীল ব্যক্তি, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের অভাবে যোগ হইতে বিষয়-প্রবণতা বশতঃ বিচলিত হইয়া নিশ্চয়ই যোগফল প্রাপ্ত হন না মনে করি, তখন তাঁহার কি গতি লাভ হয় ? ॥৩৭॥
কচ্চিন্নোভয়বিভ্রষ্টশ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি । অপ্রতিষ্ঠো মহাবাহো বিমূঢ়ো ব্রহ্মণঃ পথি ॥৩৮॥ |
[হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর !) ব্রহ্মণঃ পথি (ব্রহ্ম প্রাপ্তির উপায় রূপ পথে) বিমূঢ়ঃ (বিমূঢ়) অপ্রতিষ্ঠঃ (নিরাশ্রয়) উভয়বিভ্রষ্টঃ (কর্ম্মমার্গ ও যোগমার্গ উভয় হইতে বিচ্যুত) [সন্] (হইয়া) ছিন্নাভ্রম্ ইব (খণ্ডিত মেঘের ন্যায়) কচ্চিৎ (কি) [সঃ] (সেই ব্যক্তি) ন নশ্যতি (নষ্ট হয় না ?) ॥৩৮॥
হে মহাবাহো ! ব্রহ্মপ্রাপ্তির উপায়রূপ যোগ সাধন পথে ভ্রষ্ট এই ব্যক্তি নিরাশ্রয় এবং কর্ম্মমার্গ ও যোগমার্গ উভয় হইতে বিচ্যুত হইয়া ছিন্নভিন্ন মেঘের ন্যায় নষ্ট হয় না কি ? ॥৩৮॥
এতম্মে সংশয়ং কৃষ্ণ ছেত্তুমর্হস্যশেষতঃ । ত্বদন্যঃ সংশয়স্যাস্য ছেত্তা ন হ্যুপপদ্যতে ॥৩৯॥ |
[হে] কৃষ্ণ ! (হে কৃষ্ণ !) মে (আমার) এতৎ সংশয়ং (এই সন্দেহ) অশেষতঃ (সম্পূর্ণরূপে) ছেত্তুম্ (ছেদন করিতে) [ত্বং] (তুমি) অর্হসি (সমর্থ) । ত্বদন্যঃ (তুমি ভিন্ন) অস্য (এই) সংশয়স্য (সংশয়ের) ছেত্তা (ছেদনকারী) ন হি উপপদ্যতে (আর মিলিবে না) ॥৩৯॥
হে কৃষ্ণ ! আমার এই সংশয় সর্ব্বতোভাবে ছেদন (দূর) করিতে আপনি ভিন্ন অপর কেহ সমর্থ হইবে না । অতএব কৃপাপূর্ব্বক আপনি আমার এই সংশয়টী সম্পূর্ণরূপে ছেদন করুন ॥৩৯॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—
পার্থ নৈবেহ নামুত্র বিনাশস্তস্য বিদ্যতে ।ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্দুর্গতিং তাত গচ্ছতি ॥৪০॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পার্থ ! (হে কুন্তীনন্দন !) তস্য (তাহার) ইহ এব (এই প্রাকৃত লোকে) বিনাশঃ (স্বর্গাদিসুখভ্রংশরূপ বিনাশ) ন বিদ্যতে (নাই) অমুত্র (পরলোকে অর্থাৎ অপ্রাকৃত লোকে) [বিনাশঃ] (পরমাত্মদর্শনভ্রংশরূপ বিনাশ) ন (নাই) । [হে] তাত ! (হে বৎস !) হি (যেহেতু) কল্যাণকৃৎ (শুভ-কার্য্যানুষ্ঠানকারী) কশ্চিৎ (কোন ব্যক্তিই) দুর্গতিং (দুর্গতি) ন গচ্ছতি (প্রাপ্ত হন না) ॥৪০॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে কুন্তীনন্দন অর্জ্জুন ! যোগভ্রষ্ট সেই ব্যক্তির এই প্রাকৃত লোকে স্বর্গাদি সুখ হইতে ভ্রংশরূপ বিনাশ নাই, অথবা পরলোকে অর্থাৎ অপ্রাকৃত লোকেও তাহার পরমাত্মদর্শন হইতে ভ্রংশরূপ বিনাশ নাই । হে বৎস ! যেহেতু শুভ-কর্ম্মানুষ্ঠানকারী কোন ব্যক্তিই দুর্গতিপ্রাপ্ত হন না ॥৪০॥
প্রাপ্য পুণ্যকৃতাং লোকানুষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ । শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে যোগভ্রষ্টোঽভিজায়তে ॥৪১॥ |
যোগভ্রষ্টঃ (যোগ হইতে বিচ্যুত পুরুষ) পুণ্যকৃতাং (পুণ্যকারিগণের) লোকান্ (লোক সমূহ) প্রাপ্য (লাভ করিয়া) শাশ্বতীঃ সমা (বহু বর্ষ) [তত্র] (তথায়) উষিত্বা (বাস করিয়া) শুচীনাং (সদাচার পরায়ণ পবিত্র) শ্রীমতাং (ধনিগণের) গেহে (গৃহে) অভিজায়তে (জন্ম গ্রহণ করেন) ॥৪১॥
যোগ হইতে বিচ্যুত সেই ব্যক্তি অশ্বমেধাদি যজ্ঞকারিগণের প্রাপ্য স্বর্গাদি লোকসমূহ লাভ করিয়া বহু বর্ষকাল সেইসব লোকে বাস করতঃ সদাচার পরায়ণ পবিত্র ধনিগণের গৃহে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন ॥৪১॥
অথবা যোগিনামেব কুলে ভবতি ধীমতাম্ । এতদ্ধি দুর্ল্লভতরং লোকে জন্ম যদীদৃশম্ ॥৪২॥ |
অথবা (অথবা) যোগিনাম্ (যোগাভ্যাস নিরত) ধীমতাম্ এব (যোগের উপদেশকারিগণেরই) কুলে (বংশে) ভবতি (জন্মগ্রহণ করেন) । ঈদৃশম্ (এইরূপ) যৎ জন্ম (যে জন্ম) এতৎ হি (ইহা কিন্তু) লোকে (জগতে) দুর্ল্লভতরং (অতি দুর্ল্লভ) ॥৪২॥
অথবা দীর্ঘকাল যোগাভ্যাসের পর যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি যোগাভ্যাস নিরত যোগের উপদেশকারিগণেরই গৃহে বা বংশে জন্মগ্রহণ করেন । এইরূপ স্থানে জন্মলাভ করা দুর্ল্লভতর বলিয়া জানিবে ॥৪২॥
তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্ব্বদৈহিকম্ । যততে চ ততো ভূয়ঃ সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন ॥৪৩॥ |
[হে] কুরুনন্দন ! (হে কুরুনন্দন অর্জ্জুন !) [সঃ] (সেই যোগভ্রষ্ট পুরুষ) তত্র (উক্ত দুই প্রকার জন্মেই) পৌর্ব্বদৈহিকম্ (পূর্ব্বজন্ম কৃত) তং (সেই) বুদ্ধিসংযোগং (পরমাত্মবিষয়িণী বুদ্ধির সহিত সংযোগ) লভতে (লাভ করেন) ; ততঃ চ (তাহার পর) ভূয়ঃ (পুনর্ব্বার) সংসিদ্ধৌ (পরমাত্মদর্শনরূপ সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত) যততে (চেষ্টা করেন) ॥৪৩॥
হে কুরুনন্দন ! সেই যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি, উক্ত দ্বিবিধ জন্মের মধ্যে যে জন্মই লাভ করুন ; পূর্ব্বজন্ম কৃত সেই পরমাত্মার ভজন বিষয়ক বুদ্ধির সহিত সংযোগ লাভ করেন । তাহার পর পুনরায় অধিকতরভাবে পরমাত্মার দর্শনরূপ সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত চেষ্টা করেন ॥৪৩॥
পূর্ব্বাভ্যাসেন তেনৈব হ্রিয়তে হ্যবশোঽপি সঃ । জিজ্ঞাসুরপি যোগস্য শব্দব্রহ্মাতিবর্ত্ততে ॥৪৪॥ |
হি (যেহেতু) সঃ (তিনি) অবশঃ অপি (কোনও বিঘ্নবশতঃ অনিচ্ছুক হইলেও) তেন (সেই যোগবিষয়ক) পূর্ব্বাভ্যাসেন এব (পূর্ব্বজন্মকৃত বলবান্ অভ্যাস কর্ত্তৃকই) হ্রিয়তে (আকৃষ্ট হন) । যোগস্য (যোগবিষয়ে) জিজ্ঞাসুঃ অপি (জিজ্ঞাসু মাত্র হইয়াও) শব্দব্রহ্ম (বেদোক্ত কর্ম্মমার্গ) অতিবর্ত্ততে (অতিক্রম করেন) ॥৪৪॥
যেহেতু তিনি কোনও অন্তরায় বশতঃ অনিচ্ছুক হইলেও যোগসাধন বিষয়ে পূর্ব্বজন্মকৃত অভ্যাস বশেই তাহাতে আকৃষ্ট হন । তিনি যোগসাধনে প্রবৃত্তমাত্র হইয়াও বেদোক্ত সকাম কর্ম্মমার্গকে অতিক্রম করিয়া থাকেন, অর্থাৎ তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট ফল লাভ করেন ॥৪৪॥
প্রযত্নাদ্যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ । অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্ ॥৪৫॥ |
প্রযত্নাৎ (পূর্ব্বকৃত যত্ন অপেক্ষা) যতমানঃ (অধিক প্রযত্নশীল) সংশুদ্ধকিল্বষঃ (সম্যক্ কষায় পরিপাকে বিশুদ্ধচিত্ত) যোগী তু (যোগীও) অনেকজন্মসংসিদ্ধঃ (অনেক জন্মে সিদ্ধি লাভ করেন) । ততঃ (অনন্তর) পরাং গতিম্ (স্ব-পরমাত্মদর্শনরূপ মুক্তি অর্থাৎ মোক্ষ) যাতি (লাভ করেন) ॥৪৫॥
তখন পূর্ব্বকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর প্রযত্নশীল, ও কামনা বাসনারূপ কষায়ের সম্যক্ পরিত্যাগে বিশুদ্ধচিত্ত-যোগী অনেক জন্ম যোগ সাধনার ফলে সিদ্ধিলাভ করিয়া তৎপর তিনি পরমাগতি লাভ করেন ॥৪৫॥
তপস্বিভ্যোঽধিকো যোগী জ্ঞানিভ্যোঽপি মতোঽধিকঃ । কর্ম্মিভ্যশ্চাধিকো যোগী তম্মাদ্যোগী ভবার্জ্জুন ॥৪৬॥ |
যোগী (পরমাত্মার উপাসক) তপস্বিভ্যঃ (কৃচ্ছ্রচান্দ্রায়ণাদি তপোনিষ্ঠ অপেক্ষা) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ), জ্ঞানিভ্যঃ অপি (ব্রহ্মের উপাসক অপেক্ষাও) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ) ; যোগী (এবং যোগী) কর্ম্মিভ্যঃ চ (কর্ম্মী অপেক্ষাও) অধিকঃ (শ্রেষ্ঠ) [ইতি মে] (ইহাই আমার) মতঃ (অভিমত) । তস্মাৎ (অতএব) [হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) [ত্বং] (তুমি) যোগী ভব (যোগী হও) ॥৪৬॥
পরমাত্মার উপাসনাকারী যোগী কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদি তপোনিষ্ঠ ব্যক্তিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মের উপাসকগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ ; এবং কর্ম্মিগণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ । ইহাই আমার অভিমত জানিবে । হে অর্জ্জুন ! অতএব তুমি যোগী হও ॥৪৬॥
যোগিনামপি সর্ব্বোষাং মদ্গতেনান্তরাত্মনা । শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ॥৪৭॥ |
যঃ (যিনি) শ্রদ্ধাবান্ (ভক্তিনিরূপক শাস্ত্রে দৃঢ় বিশ্বাসযুক্ত) মদ্গতেন (আমাতেই আসক্ত) অন্তরাত্মনা (চিত্তদ্বারা) মাং (আমাকে) ভজতে (শ্রবণ কীর্ত্তনাদিযোগে সেবা করেন), সঃ (সেই ভক্ত) সর্ব্বেষাং (সকলপ্রকার) যোগিনাম্ অপি (যোগিগণের অর্থাৎ কর্ম্ম-জ্ঞান-তপস্যা-অষ্টাঙ্গযোগ-ভক্তি প্রভৃতি উপায় অবলম্বনকারিগণের মধ্যে) যুক্ততমঃ (সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ) [ইতি] (ইহাই) মে (আমার) মতঃ (অভিমত) ॥৪৭॥
যিনি ভক্তিনিরূপক শাস্ত্রে বিশ্বাসযুক্ত এবং আমাতেই আসক্ত মনের দ্বারা আমাকে শ্রবণ কীর্ত্তনাদি যোগে ভজনা করেন ; সেই ভক্ত সকল প্রকার যোগিগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ইহাই আমার অভিমত ॥৪৭॥
ইতি শ্রীমহাভরতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে ধ্যানযোগো নাম ষষ্ঠোঽধ্যায়ঃ ॥৬॥ |
ইতি ষষ্ঠ অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥
গ্রন্থ-সম্পাদক—
ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল
১) নিরগ্নি – অগ্নিসাধ্য শ্রৌতকর্মত্যাগী । ধর্মশাস্ত্রে উক্ত আছে যে, সন্ন্যাসাশ্রমীর অগ্নি রক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই । তিনি ‘নিরগ্নি’ হইয়া, সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষা দ্বারা শরীর রক্ষা করিবেন । অক্রিয় – শারীরকর্মত্যাগী অর্দ্ধমুদিতনেত্র যোগী (বলদেব) ।
২) সন্ন্যাস – কর্মযোগ – ধ্যানযোগ : গীতার মতে সন্ন্যাসের স্থূলকথা ফলসন্ন্যাস, কামনা-ত্যাগ – কেবল কর্মত্যাগ নহে । ধ্যানযোগ বা চিত্তনিরোধ-যোগেরও স্থূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, কামনাত্যাগ; কারণ, সঙ্কল্পই চিত্তবিক্ষেপের হেতু । আবার কর্মযোগেরও মূলকথা – কামনা ত্যাগ । সুতরাং সন্ন্যাস, ধ্যানযোগ, কর্মযোগ – এ তিনই এক, তিনেরই মূলকথা সঙ্কল্পত্যাগ, ইহারই সাধারণ নাম গীতোক্ত যোগ । সুতরাং এখানে যোগ বলিতে ধ্যানযোগ ও কর্মযোগ উভয়ই বুঝায়, বস্তুতঃ গীতার মতে ধ্যানযোগ কর্মযোগের অঙ্গীভূত ।
৩) শম = শান্তি (তিলক, শ্রীঅরবিন্দ); নিষ্কামকর্মীর আত্মসংযম-জনিত চিত্তপ্রসাদ – Calm of Self-mastery and Self-possession gained by works. – Sri Aurobindo.
৬) এখানে রূপকভাবে বলা হইয়াছে যে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে উদ্ধার করিবে । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আত্মা একটিই এবং সে নিজেই । সুতরাং এ কথার অর্থ এই যে, নিজেই নিজেকে প্রকৃতির বন্ধন হইতে উদ্ধার করিবে, নিজেকে অধোগামী করিবে না, জীব নিজেই নিজের শত্রু, নিজেই নিজের মিত্র ।
যোগের উদ্দেশ্য আত্মার উদ্ধার । যে পর্যন্ত মন কূটস্থ-চৈতন্যে বিলীন না হয়, সে পর্যন্ত তাহাকে সংযত করিয়া রাখিবে, ইহাই ধ্যানযোগ – ইহাই সারকথা ।
আত্মশক্তি ও কৃপাবাদ : আমাদের শাস্ত্রে দুই-রকম ধর্মোপদেশ পাওয়া যায় – (i)মায়ামুক্ত না হইলে তাঁহাকে পাওয়া যাইবে না, আবার (ii)তাঁহাকে না পাইলে মায়াও ঘুচিবে না । উভয় কথাই সত্য, উভয়ই গ্রাহ্য কারণ ইহার আগে-পরে নাই । মায়া-মুক্তি ও ঈশ্বর-প্রাপ্তি একই অবস্থা এবং ঠিক একই সময়েই হয় । এই দুই-রকম উপদেশ প্রকৃতপক্ষে দুইটি বিভিন্ন মার্গ বা সাধন-পথের সঙ্কেত ।
জ্ঞানমার্গের (আত্মস্বাতন্ত্র্য ও আত্মশক্তি) উপদেশ : মায়া বা অজ্ঞান দূর না হইলে সেই পরতত্ত্ব উপলব্ধ হয় না । আত্মার দ্বারা আত্মার উদ্ধার । সাধনদ্বারা প্রকৃতির রজস্তমোগুণকে দমন করিয়া শুদ্ধ সত্ত্বগুণের উদ্রেক করিয়া প্রকৃতির অতীত হওয়াই নিজেই নিজেকে উদ্ধার করিতে পারা ।
ভক্তিমার্গের (আত্মসমর্পণ ও কৃপাবাদ) উপদেশ : সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ না লইলে, তাঁহার কৃপা না হইলে, মায়া দূর হইবে না । ঈশ্বরই জীবকে যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার ন্যায় মায়াদ্বারা চালাইতেছেন, জীব সর্বতোভাবে তাঁহার শরণ লইলে, অনন্যভক্তিযোগে তাঁহার ভজনা করিলে ঈশ্বরই তাহাকে এমন বুদ্ধিযোগ দেন, যাহাদ্বারা সে মায়ামুক্ত হইয়া ভগবানকে পাইতে পারে ।
৯) সর্ববিষয়ে সমচিত্ততাই যোগের শ্রেষ্ঠ ফল । এই সমচিত্ততা লাভ করা অবশ্য সহজ নহে । চঞ্চল মনকে স্থির করিয়া আত্মসংস্থা করার এক বিশিষ্ট উপায় ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ ।
১৩,১৪) নাসিকাগ্রং সংপ্রেক্ষ্য – টীকাকারগণ বলেন, ঠিক নাসাগ্রই যে অবলোকন করিতে হইবে এরূপ অর্থ নহে, দৃষ্টি এদিক্ ওদিক্ না পড়ে এই জন্যই নাসাগ্রবর্তী আকাশে দৃষ্টি রাখিতে হইবে । কেহ কেহ বলেন, ইহার অর্থ ভ্রূমধ্যে দৃষ্টি রাখিয়া, কেননা নিম্নদিক হইতে ধরিলে নাসাগ্র বলিতে ভ্রূমধ্য বুঝায় । মৎপর, মচ্চিত্ত হইয়া – আমিই একমাত্র প্রিয়, বিষয়াদি নয় – এইরূপ ভাবনাদ্বারা আমাতেই চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া ।
বিবাহিত জীবনে যোগাভ্যাস : কামোপভোগই বিবাহিত জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হইলে তাহা তো পশুজীবন । কিন্তু মুনিঋষিদের মধ্যেও স্বনামখ্যাত অনেকে বিবাহিত ছিলেন এবং সন্তানের জনকও ছিলেন । শাস্ত্রে আছে, বেদ অধ্যাপনান্তে আচার্য শিষ্যকে এইরূপ উপদেশ দিতেছেন – সত্য বলিবে, ধর্মানুষ্ঠান করিবে, সন্তানধারা অবিচ্ছিন্ন রাখিবে [তৈত্তিরিয় উপনিষদ ১|১১|১] । বংশরক্ষার জন্যই বিবাহ করার এইরূপ উপদেশ সকল ধর্মশাস্ত্রেই আছে । ঐ-উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য বিবাহিত জীবনের কতটুকু সময় আবশ্যক ? – অতি সামান্য । বাকী সমস্ত জীবন ব্যাপিয়া সংযমের উপদেশ । এ-অনুশাসন সন্ন্যাসধর্মের চেয়ে বড় কম কঠোর নয়, এবং বিষয়ের মধ্যে থাকিয়া এইরূপ সংযম-সাধনে অধিকতর দৃঢ়তার প্রয়োজন, সন্দেহ নাই । এই হেতুই গৃহস্তের পক্ষে অবিহিত কালে (অর্থাৎ বংশরক্ষার্থ ভিন্ন অন্য সময়ে) স্ত্রী-সম্ভোগে নিবৃত্ত থাকাই ব্রহ্মচর্য [মহাভারত অনুশাসন পর্ব |১৬২; মনু |৩|৪৫, ৫০] । এই হেতু হিন্দুশাস্ত্রে বিবাহের অপর নাম উপযম (সংযম) ।
১৫) মৎসংস্থাম্ – আমাতেই যাহার অবস্থিতি বা সমাপ্তি (নীলকণ্ঠ); মদ্রূপেণ অবস্থিতাম্ (শ্রীধর); that has its foundation in Me (Sri Aurobindo).
২২) আত্মানন্দ পরম সুখকর, এমন কোন সুখ নাই যাহা ইহা অপেক্ষা অধিক সুখকর বলিয়া বোধ হইতে পারে, এবং এমন কোন দুঃখ নাই যাহাতে আত্মজ্ঞানীকে বিচলিত করে পারে – কেননা, তিনি আত্মারাম, বাহ্য সুখদুঃখের অতীত ।
২৩) দুঃখসংয়োগবিয়োগম্ – the putting away of the contact with pain, the divorce of the mind’s marriage with grief (Sri Aurobindo).
নির্বেদ : এত কাল যোগাভ্যাস করিলাম, সিদ্ধিলাভ হইল না, আত কত কাল কষ্ট করিব – এইরূপ হতাশভাব (মধুসূদন) ।
অনির্বণ্ণচেতসা : নির্বেদশূন্য, শৈথিল্যরহিত চিত্তে যোগাভ্যাস কর্তব্য ।
২৪-২৬) সঙ্কল্প ও কামনা :
গীতায় সঙ্কল্প ও কামনা, উভয়ই ত্যাগ করার কথা আছে । কার্যত ব্যাপার একই, কিন্তু স্বরূপত সঙ্কল্প ও কামনার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ।
সঙ্কল্প = শোভনাধ্যাস, যাহা শোভন বা সুন্দর নয় তাহাকে সুন্দর বলিয়া কল্পনা করার নাম । ইহাই অজ্ঞান, ইহা হইতেই বিষয়ে অভিলাষ জন্মে; ইহাই কাম । সুতরাং কামনা সঙ্কল্পজাত ।
ধৃতিগৃহীতয়া বুদ্ধ্যা = ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা [শঙ্কর]
উপরমেৎ = উপরতি অভ্যাস করিবেন, মনের নিরোধ করিবেন – ‘cease from mental action’.
সমাধি অভ্যাস :
কামনা ত্যাগ – সর্বপ্রকার কামনা নিঃশেষে ত্যাগ করিতে হয় ।
মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সংযম – মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহরণ করিতে হইবে । চক্ষু দর্শন করিতেছে, কিন্তু মন তাহাতে যোগ দিতেছে না, সুতরাং দেখিয়াও দেখা হইল না । চক্ষু নষ্ট হইলে বা মুদ্রিত করিয়া থাকিলেই ইন্দ্রিয়সংযম হয় না ।
চিত্তবৃত্তি নিরোধ – সাত্ত্বিকী-বুদ্ধি ভাল-মন্দ নিশ্চয় করিয়া, নিত্যানিত্য বিচার করিয়া মনকে সৎপথে চালিত করে । সাত্ত্বিকী ধৃতিশক্তি মনকে বহির্মুখী হইতে না দিয়া ভিতরে ধারণ করিয়া রাখে । এই ধৃতিসংযুক্ত বুদ্ধিদ্বারা মনকেও অন্তর্মুখী করিয়া ক্রমে-ক্রমে চিত্তবৃত্তি নিরোধ করিতে হইবে । সহসা চিত্তবৃত্তি নিরোধের চেষ্টা করিলে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা ।
আত্মাতে বিলীন – মন নির্মল হইয়া যখন আত্মাকার প্রাপ্ত হইবে, তখনই আত্মস্বরূপ প্রতিভাত হইবে । এই অবস্থায় কোন চিন্তাই থাকিবে না, আত্মচিন্তাও নয় । কারণ চিন্তা থাকিলে মনের অতীত হওয়া যায় না । এ-অবস্থায় ধ্যাতা, ধ্যান, ধ্যেয় – জ্ঞাতা, জ্ঞান, জ্ঞেয় – সবই এক হইয়া যায় । এক আত্মস্বরূপই থাকে, চিন্তা করিবে কে ? কার ? তাই ভগবান শঙ্করাচার্য বলিয়াছেন – ‘চিন্তাশূন্যতাই শ্রেষ্ঠ ধ্যান’ ।
ব্রহ্মভাব : যাহা মনের অগোচর (যেমন নির্গুণ ব্রহ্ম), তাঁহার বিষয়ে চিন্তা করা যায় না । আবার যাহা চিন্তা করা যায়, যেমন বিষয়াদি, তাহাও অতত্ত্ব, অবস্তু বলিয়া চিন্তনীয় নয়; সুতরাং মন যখন আত্মচিন্তা এবং বিষয়চিন্তা, ইহার কোনো পক্ষই অবলম্বন করে না, অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরবলম্ব হয়, তখন ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় । [ব্রহ্মবিন্দু উপনিষদ |২৬]
রাজযোগ : সমাধিযোগ/নিরোধযোগ/অষ্টাঙ্গ যোগ
যোগ – যে ক্রিয়াকৌশলে মনকে (চিত্তকে) আত্মসংস্থ করিয়া আত্মস্বরূপ বিকশিত করা যায় । চিত্ত অবস্থাভেদে পাঁচ রূপ ধারণ করে – (i)ক্ষিপ্ত – এই অবস্থায় মন কামনাকুলিত হইয়া নানা বিষয়ে ধাবিত হয়; (ii)মূঢ় – এই অবস্থায় মন তমোগুণাক্রান্ত হইয়া মোহে অভিভূত হইয়া থাকে; (iii)বিক্ষিপ্ত – এই অবস্থায় মনের চঞ্চলতা থাকিলেও উহা সময়-সময় অন্তর্মুখী হইতে চেষ্টা করে, ইহা সাধনার প্রথমাবস্থা; (iv)একাগ্র – এই অবস্থায় মন লক্ষ্য বিষয়ে সুস্থির হয়; (v)নিরুদ্ধ – এই অবস্থায় চিত্ত বৃত্তিশূন্য হইয়া থাকার মতো হয়, ইহাই চরম সমাধির অবস্থা ।
যেমন সূর্যকান্তমণিসংযোগে (আতস পাথর – magnifying glass) সূর্যরশ্মিসকল দাহ্যবস্তুতে কেন্দ্রীভূত হইলে উহাকে অগ্নিময় করিয়া তোলে, সেইরূপ ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত মন যোগদ্বারা আত্মসংস্থ হইলে উহার স্বস্বরূপ প্রকাশিত করে । রাজযোগের অষ্ট অঙ্গ – (1)যম, (2)নিয়ম, (3)আসন, (4)প্রাণায়াম, (5)প্রত্যাহার, (6)ধারণা, (7)ধ্যান, (8)সমাধি ।
যম : অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ ।
অস্তেয় – পরদ্রব্য অপহরণ করিবে না, ওকথা মুখে আনিবে না, এরূপ চিন্তাও মনে স্থান দিবে না ।
অপরিগ্রহ – কোনো অবস্থায় কাহারো নিকট হইতে দান, উপহারাদি গ্রহণ না করা । দান ইত্যাদি গ্রহণে হৃদয় সঙ্কুচিত হয়, চিত্তের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়, মানুষ হীন হইয়া যায় । অপরিগ্রহের মূলে দুইটি গুণ – (i)স্বাবলম্বন (সাংসারিক উন্নতি), (ii)বৈরাগ্য (আধ্যাত্মিক উন্নতি) ।
নিয়ম : শৌচ (বাহ্য ও অন্তঃ), সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায়, ঈশ্বরপ্রণিধান ।
স্বাধ্যায় – মন্ত্রজপ, বেদপাঠ বা ধর্মশাস্ত্রাদির অধ্যয়ন । মন্ত্রজপ – (i)বাচিক, (ii)উপাংশু (কেবল ওষ্ঠস্পন্দন হয়, শব্দ শুনা যায় না), (iii)মানস ।
ঈশ্বরপ্রণিধান – স্মরণ-মননাদি ঈশ্বরোপাসনা (স্বামী বিবেকানন্দ), ঈশ্বরে সর্বকর্ম সমর্পণ (ব্যাসভাষ্য) ।
আসন : যাহাতে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে স্বচ্ছন্দে বসিয়া থাকা যায় । যেমন সিদ্ধাসন, পদ্মাসন, সিংহাসন ও ভদ্রাসন । স্বস্তিকাসন সর্বাপেক্ষা সহজ । ‘বক্ষঃস্থল, গ্রীবা ও মস্তক সমান রাখিয়া শরীরটাকে বেশ স্বচ্ছন্দভাবে রাখিতে হইবে ।’ – স্বামী বিবেকানন্দ ।
প্রাণায়াম : (i)রেচক (বাহিরে শ্বাস ত্যাগ), (ii)পূরক (ভিতরে শ্বাস গ্রহণ), (iii)কুম্ভক (বায়ুকে শরীরের মধ্যে অথবা বাহিরে নিরুদ্ধ করিয়া রাখা) । এই সকল প্রক্রিয়া সদগুরু-উপদেশগম্য ।
প্রত্যাহার : বিষয়ে প্রবৃত্ত ইন্দ্রিয়সমূহের বলপূর্বক প্রত্যাকর্ষণের নাম ।
ধারণা : হৃৎপদ্মে, ভ্রূমধ্যে, নাসাগ্রে বা কোনো দিব্য মূর্তিতে চিত্ত আবদ্ধ রাখা । সাধারণত যোগশাস্ত্রে ধারণার ছয়টি স্থান নির্দিষ্ট করা হয় – ষট্চক্র ।
ধ্যান : যে বিষয়ে চিত্তকে ধারণা করা যায় সেই বিষয়ে অবিচ্ছিন্ন তৈলধারার ন্যায় চিত্তের একতান-প্রবাহের নাম ।
সমাধি : ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি । দুইপ্রকার – (i)সম্প্রজ্ঞাত বা সবীজ (ধ্যেয় বস্তুর সম্যক জ্ঞান থাকে), (ii)সম্প্রজ্ঞাত বা নির্বীজ বা নিরোধ-সমাধি (চিত্তবৃত্তি একেবারে তিরোহিত হয়, সমুদয় মানসিক ক্রিয়ার বিরাম হয়) ।
অষ্টাঙ্গ যোগ ও গীতোক্ত যোগ :
ধারণার পরিপক্ক অবস্থা ধ্যান, ধ্যানের পরিপক্ক অবস্থা সমাধি; ধ্যান, ধারণা, সমাধি – এই তিনটি ক্রমে এক বস্তু সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলে তাহাকে ‘সংযম’ বলে [যো.সূ.|৩|৪] । এই তিনটিই যোগের অন্তরঙ্গ-সাধন, অপরগুলিই বহিরঙ্গ-সাধন [যো.সূ.|৩|৭] । যম ও নিয়ম চিত্তশুদ্ধির উপায়, উহা সকল সাধনার ভিত্তিস্বরূপ । আসন, প্রাণায়াম, মনঃ-সংযমের সহায়ক শারীরিক-প্রক্রিয়া । এই সকলই গীতাতে সাধারণভাবে স্থানে-স্থানে উল্লিখিত হইয়াছে । প্রকৃতপক্ষে, ধ্যান ও সমাধিই যোগের মূল কথা – গীতায় উহাই বিশেষরূপে উপদিষ্ট হইয়াছে । কিন্তু গীতার পূর্ণাঙ্গ যোগে কর্ম, ধ্যান, জ্ঞান, ভক্তি এই চারিটিরই সমন্বয় ।
গান্ধীবাদ ও অহিংসা :
পূর্বোক্ত যম-নিয়মের অভ্যাস নৈতিক চরিত্র-গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির ভিত্তিস্বরূপ । মহাত্মা গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত সত্যাগ্রহাশ্রমে বিদ্যার্থীদের এগুলি অভ্যাস করিতে হইত । সত্য-অহিংসাদির অভ্যাসে সম্যক সিদ্ধ হইলে যে যোগবল বা আত্মশক্তি লাভ হয় তাহা দ্বারাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে । যেমন যোগশাস্ত্রে আছে ‘যিনি অহিংসা সাধনে চরম সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, তাঁহার সম্মুখে সকল প্রাণীই বৈরভাব ত্যাগ করে’ [যো.সূ.|২|৩৫] । মহাত্মা গান্ধী তাই বিশ্বাস করতেন অহিংসার প্রভাবে হিংস্র বন্যপশুও যখন হিংসা ত্যাগ করে, তখন অত্যাচারী নরপশু হইলেও অহিংসা ও ত্যাগের প্রভাবে তাহার ভাবান্তর (change of hearts) অনিবার্য । তাই তাঁর আন্দোলনের মূল কথা ছিল আত্মত্যাগ ও আত্মশুদ্ধি (self-sacrifice and self-purification).
২৭) যোগসিদ্ধির ফল নির্মল ব্রহ্মানন্দ ও সর্বত্র সমত্ববুদ্ধি ।
২৯-৩০) ‘যাঁহা যাঁহা নেত্র পড়ে, তাঁহা তাঁহা কৃষ্ণ স্ফুরে ।’ – [চৈ.চৈ.]
শ্রীভগবান বলিতেছেন – আমার ভক্ত কখনো আমাকে হারান না, আমিও ভক্তকে কখনো হারাই না । আমার ভক্ত সর্বত্র আমাকেই দেখেন এবং আমাতেই সমস্ত দেখেন । তিনি জগতের দিকে তাকাইলে জগৎময় আমার মূর্তিই অনুভব করেন । আবার আমার দিকে তাকাইলে তিনি দেখেন আমিই সব, আমাতেই সব । অপার সমুদ্রে যেমন তরঙ্গমালা, সেইরূপ বিধি, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, রবি, চন্দ্র, বরুণ, যমাদি সকলই আমাতে ভাসিতেছে ।
৩১) জীবে প্রেম, স্বার্থ ত্যাগ, ভক্তি ভগবানে :
‘আমাকে ভজনা করা’ এবং ‘সর্বভূতস্থ আমাকে ভজনা করা’ – এই দুই-কথার মধ্যে কি পার্থক্য তাহা প্রণিধানযোগ্য । এই কথাটি শ্রীমদ্ভাগবতে নির্গুণভক্তিতত্ত্ব-বর্ণনা প্রসঙ্গে অতি স্পষ্টরূপে উল্লেখ করা হইয়াছে –
‘আমি সর্বভূতে ভূতাত্মস্বরূপে অবস্থিত আছি । অথচ সেই আমাকে অবজ্ঞা করিয়া মনুষ্য প্রতিমাদিতে পূজারূপ বিড়ম্বনা করিয়া থাকে । সর্বভূতে অবস্থিত আত্মা ও ঈশ্বর আমাকে উপেক্ষা করিয়া যে প্রতিমাদি ভজনা করে সে ভস্মে ঘৃতাহুতি দেয় । যে প্রাণীগণের অবজ্ঞাকারী, সে বিবিধ দ্রব্য ও বিবিধ ক্রিয়াদ্বারা আমার প্রতিমাতে আমার পূজা করিলেও আমি তাহার প্রতি সন্তুষ্ট হই না । সুতরাং মানুষের কর্তব্য হইল, আমি সর্বভূতে আছি ইহা জানিয়া সকলের প্রতি সমদৃষ্টি, সকলের সহিত মিত্রতা ও দান-মানাদির দ্বারা সকলকে অর্চনা করে ।’ – [ভা|৩|২৯|২১-২২, ২৪, ২৭]
সর্বজীবের সেবাই ঈশ্বরের অর্চনা । বিশ্বপ্রেমই ঈশ্বরে ভক্তি । অবশ্য ইষ্টবস্তুর উপাসনা আবশ্যক নয়, নিষিদ্ধও নয় । ‘পুরুষ যে-পর্যন্ত সর্বভূতস্থিত আমাকে আপনার হৃদয়ের মধ্যে জানিতে না পারে, সে-পর্যন্ত প্রতিমা-প্রভৃতিতে আমার অর্চনা করিবে [ভা|৩|২৯|২৫] । সুতরাং সর্বদা মনে রাখিতে হইবে প্রতিমাতে কাহার অর্চনা হইতেছে এবং সে-অর্চনার উদ্দেশ্য কি । উহা বিস্মৃত হইয়া যদি প্রতীককেই ঈশ্বর করিয়া তুলি, তবে উহা জড়োপাসনায় পরিণত হয় ।
‘হে দৈত্যগণ, এই বিশজগৎ বিষ্ণুর বিস্তারমাত্র । তোমরা সকলকে আপনার সঙ্গে অভেদ দেখিও । এইরূপ সমত্বদর্শনই ঈশ্বর-আরাধনা ।’ [প্রহ্লাদ, বিষ্ণু পুরাণ |১|১৭|৮৪|৯০]
ইহাই বেদান্তে ব্রহ্মজ্ঞান । ইহাই যোগীর সমদর্শন, ইহাই কর্মীর নিষ্কাম কর্ম, ইহাই ভক্তের নির্গুণা ভক্তি । এই শ্লোকটিতে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি ও যোগের অপূর্ব সমন্বয় । ইহাই গীতোক্ত পূর্ণাঙ্গযোগ । তাই শ্রীঅরবিন্দ লিখিয়াছেন, এই শ্লোকটিকে সমগ্র গীতার চরম সিদ্ধান্ত বলিয়া গ্রহণ করা যায় ।
‘Whoever loves God in all and whose soul is founded upon the divine oneness, however he lives and acts, lives and acts in God – that may almost be said to sum up the whole final result of the Gita’s teaching.’ – Sri Aurobindo.
ঈশ্বর-সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা এই, তিনি জীব ও জগৎ হইতে স্বতন্ত্র । তিনি জগতের পালনকর্তা, শাসনকর্তা । তিনি প্রার্থনা মঞ্জুর করেন, দণ্ড-পুরস্কার দেন, সকলকে রক্ষা করেন । সুতরাং সমাজরক্ষক পার্থিব রাজাকে যেমন ধন্যবাদ দেওয়া সম্মান করা আমাদের কর্তব্য, সেইরূপ জগৎরক্ষক ঈশ্বরকেও ভক্তি করাও আমাদের কর্তব্য । বস্তুত, সকল ধর্মেই, সকল সমাজেই, ঈশ্বরের ধারণা কতকটা এইরূপ । ‘কিন্তু হিন্দুর ঈশ্বর সেরূপ নহেন । তিনি সর্বভূতময়, তিনি সর্বভূতের অন্তরাত্মা । কোনো মনুষ্য তাঁহা ছাড়া নাই । মনুষ্যকে না ভালবাসিলে তাঁহাকে ভালবাসা হইল না । যতক্ষণ না বুঝিতে পারিব যে, সকল জগৎই আমি, সর্বলোক ও আমাতে অভেদ, ততক্ষণ আমার জ্ঞান হয় নাই, ভক্তি হয় নাই, প্রীতি হয় নাই । অতএব জাগতিক প্রীতি হিন্দুধর্মের মূলেই আছে । অচ্ছেদ্য, অভিন্ন, জাগতিক প্রীতি ভিন্ন হিন্দুত্ব নাই । মনুষ্য-প্রীতি ভিন্ন ঈশ্বরভক্তি নাই । ভক্তি ও প্রীতি হিন্দুধর্মে অভিন্ন ।’ – বঙ্কিমচন্দ্র ।
৩২) বেদান্ত, বিশ্বপ্রেম ও হিতবাদ :
‘আজকাল অনেকের মতে নীতির ভিত্তি হিতবাদ (utility) অর্থাৎ যাহাতে অধিকাংশ লোকের অধিক পরিমাণে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হইতে পারে তাহাই নীতির ভিত্তি । ইহাদিগকে জিজ্ঞাসা করি, আমরা এই ভিত্তির উপর দণ্ডায়মান হইয়া নীতি পালন করিব, তাহার হেতু কি ? যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহা হইলে কেননা আমি অধিকাংশ লোকের অত্যধিক অনিষ্ট সাধন করিব ?
… অবশ্য নিঃস্বার্থপরতা কবিত্বহিসাবে সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব তো যুক্তি নহে, আমাকে যুক্তি দেখাও, কেন আমি নিঃস্বার্থপর হইব । হিতবাদিগণ (utilitarians) ইহার কি উত্তর দিবেন ? তাঁহারা তখন কিছুই উত্তর দিতে পারেন না ।’ – স্বামী বিবেকানন্দ ।
বস্তুত ইহার উত্তর হিন্দু ভিন্ন, হিন্দুর বেদান্ত ভিন্ন আর কেহ দিতে পারে না । ‘লোকসমূহের প্রতি অনুরাগবশত লোকসমূহ প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই লোকসমূহ প্রিয় হয় । সর্বভূতের প্রতি অনুরাগবশত সর্বভূত প্রিয় হয় না, আত্মার প্রতি (আপনার প্রতি) অনুরাগবশতই সর্বভূত প্রিয় হয় ।’ – [বৃহদারণ্যক উপনিষদ |৪|৫|৬]
তুমি অপরকে, তোমার শত্রুকেও ভালবাসিবে কেন ? কারণ তুমি তোমার আত্মাকে অর্থাৎ আপনাকে ভালবাসে বলিয়া । তুমিই সেই – ‘তত্ত্বমসি’ । এই তত্ত্বই হিন্দু-ধর্মনীতির ভিত্তি । তাই হিন্দুধর্ম কেবল হিন্দুর ধর্ম নহে, উহা বিশ্বমানবের ধর্ম, সনাতন বিশ্বধর্ম ।
‘প্রহ্লাদকে যখন হিরণ্যকশিপু জিজ্ঞাসা করিলেন, শত্রুর সঙ্গে রাজার কি রকম ব্যবহার করা কর্তব্য ? প্রহ্লাদ উত্তর করিলেন, শত্রু কে ? সকলই বিষ্ণু-(ঈশ্বর)ময়, শত্রু-মিত্র কি প্রকারে প্রভেদ করা যায় ? প্রীতিতত্ত্বের এইখানে একশেষ হইল; এবং এই এক কথাতেই সকল ধর্মের উপর হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন হইল মনে করি ।’ – বঙ্কিমচন্দ্র ।
The highest and purest morality is the immediate consequence of the Vedanta. The Gospels fix correctly as the highest law of morality – ‘Love your neighbour as yourself’. But why should I do so, since by the order of nature, I feel pain and pleasure only in myself and not in my neighbour ? The answer is not in the Bible, but it is in the Vedas – in the great formula – ‘That thou art’ (তৎ ত্বম্ অসি), which gives in three words metaphysics and morals together.’ – [Dr. Paul Deuseen,1,2]
‘The Vedanta gives profoundly-based reasons for charity and brotherliness.’ – [Sir John Woodroffe, 1]
দয়া ও মায়া :
প্রশ্নঃ আত্মজ্ঞ যোগী দ্বন্দ্ববর্জিত পুরুষ । তিনি সুখদুঃখের অতীত । তিনি জীবের সুখদুঃখে অভিভূত হইবেন কিরূপে ? সে তো তাঁহার অধঃপতন, আধ্যাত্মিক অপমৃত্যু । আর জগতের দুঃখের পসরা নিজের মাথায় লইয়া তাঁহার স্বস্তি কোথায় ? সমদর্শনের কি এই ফল ? কেবল দুঃখের মাত্রা বৃদ্ধি ?
উত্তরঃ কথাটা ধরেছ ভাল, কিন্তু তা হলে ঈশ্বরের মতো দুঃখী বোধ হয় আর কেহ নাই । তাঁহাকে ‘দয়াময়’ বলা হয়, জীবের দুঃখে দুঃখিত না হইলে তিনি দয়াময় হন কিরূপে ? স্মরণ রাখিতে হইবে, এ-স্থলে বদ্ধ জীবের কথা হইতেছে না, এ হইতেছে জীবন্মুক্ত যোগীর কথা যিনি প্রকৃতির মধ্যে থাকিয়াও, সুখদুঃখের মধ্যে থাকিয়াও সেই পরম পুরুষেই অবস্থান করেন । তাঁহার আর পতনের সম্ভাবনা কোথায় ? তাঁহার সংসারে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য জীবের যাহাতে দুঃখমোচন হয়, জীব যাহাতে সুখী হয়, তাহাই করা । তিনি নির্লিপ্তভাবে, নিষ্কামভাবে সেই কর্মই করেন – সময়-সময় সুখদুঃখের অভিনয়ও করেন – কিন্তু সে অভিনয় মাত্র, তিনি অভিভূত হন না । তাঁহার দয়া আছে, তিনি জড়পিণ্ড নহেন, কিন্তু তাঁহার মায়া নাই, অর্থাৎ সুখদুঃখাদি যে প্রকৃতির ধর্ম, তাহাতে তিনি বদ্ধ হন না । অবতারগণ, মহাপুরুষগণ, জনকাদি রাজর্ষিগণ – ইঁহারা সকলেই এইরূপেই জীবের সঙ্গে হাসিয়া-কাঁদিয়া লীলাখেলা করিয়াছেন, জীবের দুঃখমোচনের চেষ্টা করিয়াছেন । নরেন্দ্রাদি অন্তরঙ্গ ভক্তের জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের এত ব্যাকুলতা কেন ? সে দয়া, মায়া নহে । জীবের দুঃখে গৌতম গৃহত্যাগী, শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাসী । সে-ও দয়া, মায়া নহে ।
৩৫) অভ্যাস ও বৈরাগ্য :
অভ্যাসে দুঃসাধ্য কার্যও সুসাধ্য হয় । স্বভাব অভ্যাসেরই ফল । শারীরিক অভ্যাস অপেক্ষা মানসিক অভ্যাসের ফল আরও অদ্ভুত । আমাদের মনে যে কোনো চিন্তা-প্রবাহ উদিত হয়, তাহাই একটি সংস্কার রাখিয়া যায় । এই সংস্কারগুলির সমষ্টিই আমাদের স্বভাব । আমাদের বর্তমান স্বভাব পূর্ববর্তী অভ্যাসের ফল । আমাদের পরবর্তী স্বভাব হইবে বর্তমান অভ্যাসের ফল । সুতরাং সৎস্বভাব গঠন করিতে হইলে সর্বদা সৎচিন্তা ও সৎকর্মের অভ্যাস কর্তব্য । যোগ কতকগুলি সদভ্যাসের অনুশীলন মাত্র, এই জন্য ইহাকে অভ্যাসযোগ বলে । কিসের অভ্যাস ? প্রধানত বহির্মুখী চঞ্চল মনকে অন্তর্মুখী করিয়া আত্মসংস্থ করিবার অভ্যাস ।
৪০) যোগাভ্যাসের যে কোনরূপ চেষ্টামাত্রই শুভকর্ম । সম্পূর্ণ সিদ্ধি লাভ না হওয়াতে তাহার পুনর্জন্ম নির্ধারিত হয় না বটে, কিন্তু শুভকর্মজনিত অন্যরূপ শুভফল তিনি প্রাপ্ত হন, তাহার সদ্গতিই লাভ হয় ।
৪১) যিনি বিষয়-ভোগে বিরত হইয়া যোগাভ্যাসে রত ছিলেন, তিনি পরজন্মে ধনীর গৃহে যান কেন ? – তাহার সম্পূর্ণ বিষয়বৈরাগ্য জন্মে নাই বলিয়া, মৃত্যুকালে ভোগবাসনা বলবতী ছিল বলিয়া । কিন্তু যাঁহার মৃত্যুকালে তীব্র বৈরাগ্য ও মোক্ষেচ্ছা বর্তমান থাকে, তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ গতি হয়, তাহা পরবর্তী শ্লোকে বলিতেছেন ।
৪৬) তপস্বী = ‘যাঁহারা কৃচ্ছ্রসাধ্য চান্দ্রায়ণাদি-ব্রতনিষ্ঠ’ ।
কর্মী = যাঁহারা স্বর্গাদি-ফলকামনায় যাগযজ্ঞাদি কাম্য-কর্ম করেন ।
পরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার কেবল শাস্ত্রজ্ঞান আছে, আত্মা, জীব, জগৎ এ-সব কি তাহা শাস্ত্রানুশীলনে বুঝিয়াছেন, কিন্তু আত্মানুভব হয় নাই ।
অপরোক্ষ জ্ঞানী = যাঁহার প্রত্যক্ষ আত্মদর্শন হইয়াছে ।
এ-স্থলে জ্ঞানী অপেক্ষা যোগী শ্রেষ্ঠ বলায় শাস্ত্রজ্ঞানী বা পরোক্ষ জ্ঞানীকেই লক্ষ্য করা হইয়াছে ।
এ-স্থলে ‘যোগী’ = কর্মযোগী, ‘জ্ঞানী’ = সাংখ্যজ্ঞানী সন্ন্যাসী [গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক]
৪৭) নির্গুণ ব্রহ্মজ্ঞানে কর্ম ও ভক্তির স্থান কিরূপে সম্ভব ?
উঃ অক্ষর ব্রহ্ম সম, শান্ত, নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার – তিনি কর্মে লিপ্ত নন, কর্ম করে প্রকৃতি, উহাই মায়া বা অজ্ঞান; সুতরাং কর্ম অজ্ঞান-প্রসূত, উহার সহিত জ্ঞানের সমুচ্চয় হয় না এবং অচিন্ত্য, অব্যক্ত, নির্গুণ ব্রহ্মে ভক্তিও সম্ভব না । গীতা পুরুষোত্তম-তত্ত্ব দ্বারা জ্ঞানবাদিগণের এ-আপত্তি খণ্ডন করিয়াছেন । গীতায় শ্রীভগবান বলিতেছেন – প্রকৃতি কর্ম করে তা ঠিক, কিন্তু প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি – আমারই শক্তি । ক্ষর ও অক্ষর দুই-ই আমার বিভাব – আমি পুরুষোত্তম [১৫|১৬-১৮] । অহংশূন্য জীবন্মুক্তের কর্মের সহিত জ্ঞানের বিরোধ নাই, কারণ সে কর্ম তাঁহার নয়, আমারই কর্ম । আর এ-জ্ঞানের সহিত ভক্তিরও কোনো বিরোধ নাই; কেননা এ-জ্ঞান কেবল অচিন্ত্য, অব্যক্ত, অক্ষর ব্রহ্মের জ্ঞান নহে, ইহা অব্যক্ত-ব্যক্ত, নির্গুণ-গুণী ‘সমগ্র’ পুরুষোত্তমের জ্ঞান । তাই শ্রীভগবান বলিয়াছেন, জ্ঞানীই আমার শ্রেষ্ঠ ভক্ত, ‘আমার আত্মস্বরূপ’ [৭|১৭-১৮], আমাতে অব্যভিচারিণী ভক্তিই জ্ঞান [১৩|১০-১১] ।
এইরূপে গীতা কর্ম, জ্ঞান, ভক্তির সমন্বয়ে সুন্দর সম্পূর্ণ সাধনতত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন । ইহাই গীতার পূর্ণাঙ্গযোগ । গীতোক্ত যোগী একাধারে জ্ঞানী, কর্মী ও ভক্ত । এ-যোগী নিত্যসমাহিত, নিত্যমুক্ত, – যুদ্ধ-কোলাহলে তাঁহার চিত্তবিক্ষেপের ভয় কি ? এ সমাধির অর্থ ভগবৎ-সত্তায় আপন সত্তা মিলাইয়া দেওয়া, তাঁহারই প্রেমানন্দে সর্বকামনা ভুলিয়া তাঁহারই কর্ম বাহিরে দেহেন্দ্রিয়াদি দ্বারা সম্পন্ন করা, আর অন্তরে সতত সর্বাবস্থায় তাঁহাতেই অবস্থান করা ।
এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ধানযোগ বা সমাধি-যোগের প্রক্রিয়া ও ধ্যানযোগীর লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ বলে ।
সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
০২। http://www.scsmathinternational.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন