ভগবান ব্রহ্মা অতঃপর মহারাজ পৃথুকে বললেন - ' রাজন্ ! আপনি মোক্ষধর্মজ্ঞ । আপনার এই যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই । আপনি ও ইন্দ্র দুইজনই পবিত্রকীর্তি ভগবান শ্রীহরির মূর্তি , সুতরাং আপনার স্বরূপভূত ইন্দ্রের প্রতি আপনার কুপিত হওয়া উচিত নয় । তাঁর প্রতি বৈরীভাব পরিহার করুন । '
যজ্ঞভোক্তা যজ্ঞেশ্বর সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীবিষ্ণু মহারাজ পৃথুর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন । তিনি তখন ইন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে পৃথুর নিকটে উপস্থিত হলেন ।
ভগবান শ্রীবিষ্ণু বললেন - ' রাজন্ ! এই ইন্দ্র তোমার যজ্ঞে বিঘ্ন উৎপাদন করেছে তাই সে সন্তপ্ত । তুমি তাঁকে ক্ষমা করে দাও । '
হে নরদেব ! যাঁরা সাধুপ্রকৃতির ও সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন নরলোকন তাঁরা শ্রেষ্ঠ । কোনো জীবের উপায় তাঁরা দ্রোহ পোষন করেন না । তোমার মতন ব্যক্তিও যদি আমার দৈবী মায়ায় মোহিত হয় তাহলে তো বলতে হয় যে জ্ঞানীজনের দীর্ঘকাল সেবা করে তুমি বৃথা পরিশ্রম করেছ । আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি এই দেহকে কেবলমাত্র অবিদ্যা , বাসনা ও কর্মদ্বারা মোহিত জেনে এর প্রতি আসক্ত হয় না । এইভাবে যার দেহের উপরই আসক্তি নেই সেই বিবেকযুক্ত ব্যক্তি দেহের মাধ্যমে স্বীকৃত গৃহ , পুত্র অথবা ধনসম্পদের উপর কেমন করে আসক্ত হবে ?
আত্মা এক ও অদ্বিতীয় , শুদ্ধ , স্বপ্রকাশ , নির্গুণ , গুণাশ্রয় , সর্বব্যাপী , আবরণরহিত , সর্ববিষয়ে সাক্ষী , অধিষ্ঠানরহিত । অতএব দেখা যাচ্ছে যে আত্মা দেহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা । যার এই জ্ঞান হয়েছে , তার বিষয়াসক্তি থাকে না ; তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে সে তখন ব্রহ্মানন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় - মোক্ষ লাভ করে । '
শ্রীভগবান পৃথুকে আবার বললেন - ' হে বীর ! তুমি উত্তম মধ্যম ও অধম সকলের প্রতি সমদর্শী হয়ে , সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন থেকে এবং মন ও ইন্দ্রিয়বর্গকে জয় করে প্রজাপালন করো , তাতেই তুমি পরম শান্তি ও পরমপদ লাভ করবে । অতএব পুণ্যাত্মা ব্রাহ্মণদের অনুমোদিত এবং সনাতন ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে ও অন্য সকল বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে এই পৃথিবী শাসন করো । সকলেই তোমার গৃহে সনকাদি সিদ্ধগণের দর্শন লাভ করবে । তোমার গুণ ও চরিত্রমাহাত্ম্য আমাকে প্রসন্ন করেছে । তুমি ইচ্ছা মতন বর প্রার্থনা করে নাও । '
শ্রীভগবানের আদেশে মহরাজ পৃথু ইন্দ্রের উপর তাঁর অসন্তোষ ত্যাগ করলেন । কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ইন্দ্র তাঁর পাদস্পর্শ করে ক্ষমা চাইতে উদ্যত হলে পৃথু তাঁকে প্রীতিভরে আলিঙ্গন করলেন । অতঃপর মহারাজ পৃথু বিশ্বাত্মা ভক্তবৎসল ভগবানকে পূজোপহার নিবেদন করে পরম ভক্তি সহকারে তাঁর চরণকমলযুগল ধারণ করলেন । বদ্ধাঞ্জলি আদিরাজ পৃথু নয়নযুগল প্রেমাশ্রুধারায় প্লাবিত হওয়ায় শ্রীভগবানকে দর্শন করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না , কন্ঠ কল্পরুদ্ধ হওয়ায় কিছু বলতেও পারছিলেন না ।
তিনি শ্রীভগবানকে আলিঙ্গন করে নিজ হৃদয়ে ধারণ করলেন ও সেইভাবেই অবস্থান করতে লাগলেন । অবশেষে পৃথু নিজেকে সংযত করে অতৃপ্ত নয়নে শ্রীভগবানকে দেখতে লাগলেন । শ্রীভগবানের পাদপদ্ম ভূমি স্পর্শ করেছিল আর করাগ্র গরুড়ের উন্নত স্কন্ধে বিন্যস্ত ছিলেন ।
অবশেষে পৃথু বলতে লাগলেন - ' হে মোক্ষপতি প্রভু ! আপনি ব্রহ্মা আদি রবদাতা দেবতাগণকেও রবদানে সমর্থ । বিষয়সুখের মতন তুচ্ছ পদার্থ আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি না । মহাপুরুষগণের মুখনিঃসৃত আপনার লীলাগুণগান যেখানে নেই তা যদি মোক্ষপদও হয় ও তবে তাও আমি চাই না । '
তিনি আরো বললেন - ' হে অনন্তকীর্তি ! আপনার মঙ্গয়ময় কীর্তিকথা একবার যে শ্রবণ করেছে সে যদি নিতান্তই পশুপ্রকৃতির না হয় সে সতত তাই শ্রবণ করতে আগ্রহী হবে । আপনি আমাকে অসংক্য কর্ণ তথা শ্রবণন্দ্রিয় দান করুন যাতে প্রাণ - ভরে আপনার গুণকথা শ্রবণ করতে পারি । কেবলমাত্র দুইটি কানে আপনার গুণকথা শুনে তৃপ্তি পাচ্ছি না । এই আমার প্রার্থনা । '
এইভাবে মহারাজ পৃথু শ্রীভগবানের স্তুতি করতেন লাগলেন । তাঁর স্তুতি শ্রবণ করে সর্বসাক্ষী ভগবান শ্রীহরি তাঁকে বললেন - ' রাজন্ ! আমার প্রতি তোমার ভক্তি হোক । মায়ার প্রভাব ত্যাগ করে তোমার চিত্ত যে আমাতে এইভাবে অনুরক্ত হয়েছে তা অত্যন্ত সৌভাগ্যের কথা । এখন তুমি নিশ্চিন্তে আমার আদেশ পালন করো । তোমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হোক । '
মহারাজ পৃথুর পূজার্চনা গ্রহণ করে সকল অনুগ্রহ বর্ষণ করে শ্রীভগবান প্রস্থানে উদ্যত হলেন । মহারাজ পৃথু সমাহত দেবতা , ঋষি , পিতৃপুরুষ , গর্ন্ধব , সিদ্ধ , চারণ , নাগ , কিন্নর , অপ্সরা , মানব , পক্ষী ও অন্যান্য বহুবিধ প্রাণী ও শ্রীভগবানের পার্ষদগণ - সকলকেই ভক্তিপূর্বক সম্ভাষণ ও দক্ষিণাদি ধনদ্বারা যুক্তকরে সম্মান জ্ঞাপন করলেন । ভগবান অচ্যুতও সকলের চিত্ত হরণ করে বৈকুন্ঠধামে গমন করলেন ।
অতঃপর মহারাজ পৃথু ন্যায় ও ধর্ম পথে অবিচল থেকে নিষ্কামভাবে প্রজাপালন করতে লাগলেন । তাঁর কর্ম নিষ্কাম হওয়ায় কর্মফল সঞ্চয়ের প্রশান আদৌ ছিল না । প্রারদ্ধ ক্ষয় হওয়ায় কর্মশ্রোতরূপ জন্মমৃত্যু প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । তিনি জ্ঞান ও ভক্তির চরম সীমায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন । তিনি এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করে সকলকে অতি সুন্দরভাবে নিজ কৃত্য - কর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলেন । সকলেই মহারাজ পৃথুর প্রশংসা করেছিলেন ।
এই সময়ে সূর্যসম দেদীপ্যমান মুনি চতুষ্টয়ের আগমন হয় । মহারাজ পৃথু সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠে ---
সনক , সনন্দন , সনাতন ও সনৎকুমরাকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু তখন সর্বজীবের মঙ্গলের জন্য মুনিদের প্রশ্ন করেছিলেন ---
' কিসে সকলের মঙ্গল হবে ? কেমন করে মঙ্গল হবে ? '
সনৎকুমার উত্তর দিয়েছিলেন ---
" মঙ্গল কামনায় দেহাদির প্রতি অনাসক্তি এবং পরব্রহ্মস্বরূপ আত্মার প্রতি প্রবল আসক্তি , তীব্র অনুরাগ থাকা প্রয়োজন ; ঈশ্বরে অনুরাগ ও সংসারে বিরাগ । ' আমি , আমার ' ভাব , অহংভাব ত্যাগ করলেই যথার্থ মঙ্গল হবে ।
শ্রদ্ধা ও ভাগবত ধর্মের অনুষ্ঠান , আত্মজ্ঞান লাভের ইচ্ছা , আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায় নিষ্ঠা , স্মরণ - মনন ও কীর্তন দ্বারা আত্মাকে রতি ও দেহাদিতে অনাসক্তি হয় ।
শ্রীভগবানের উপর রতি ও বিষয়ের বৈরাগ্য , অহিংসা , নিবৃত্তি , কল্যাণের জিজ্ঞাসা , লীলাকথা পানে ব্যাকুলতা , সংযম , কামনাবাসনা ত্যাগ , শৌচাদি নিয়ম পালন , পরনিন্দায় অরুচি , স্পৃহারাহিত্য ও শীত - উষ্ণ আদি দৈব সন্তাপ সহ্য করার কল্যাণ হয়ে থাকে ।
শ্রীভগবানের শরণাগত হতে হয় । নিত্যমুক্ত , নির্মল , সত্যস্বরূপ শ্রীভগবান জ্ঞানরূপে আবির্ভূত হন । শরণাগত হলেই তিনিই ভক্তের সকল ভার গ্রহণ করেন ।
শ্রীভগবানের পাদপদ্ম স্মরণ করে সহজেই অহংকার থেকে মুক্তি লাভ করা যায় , জ্ঞান ও যোগ সাধনার পথে মুক্তি পাওয়া কঠিন তাই শরণাগত বৎসল ভগবান শ্রীবাসুদেবের ভজনা করা প্রয়োজন । "
যখন সনৎকুমার সুস্পষ্টভাবে বললেন যে নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার অর্থাৎ জ্ঞান পথের চেয়ে সগুণ সাকার উপাসনা অর্থাৎ ভক্তিযোগের পথ সহজ , তখন মহারাজ পৃথু তাইতেই মগ্ন হয়ে গেলেন ।
মুনিগণের উপদেশ দান করে আকাশপথে গমন করলেন । মহারাজ পৃথু নিরাসক্তভাবে রাজ্য শাসন করতে থাকলেন । তিনি ক্ষমা গুণে ছিলেন পৃথিবীর মতন , লোক কল্যাণে স্বর্গের মতন আর তৃপ্তি বিধানে ছিলেন মেঘের মতন । তিনি বহুকাল রাজ্যপালন করে অবশেষে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের আরাধনায় ব্রতী হলেন । ক্রমে তাঁর অবিদ্যাজনিত দেহবুদ্ধি দূর হয়ে আত্মজ্ঞান লাভ হল আর তিনি পরম আকাঙ্ক্ষিত শ্রীভগবানের সান্নিধ্য লাভ করলেন । বানপ্রস্থে গমনকালে তিনি পুত্রদের রাজ্যভার দিয়ে প্রজাপালন কার্য সম্পূর্ণ করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু যেন সর্বকালের অনুকরণীয় কল্যাণের রাজমার্গসম ছিলেন । তাঁর জীবনে জ্ঞান ও ভক্তি দুইই পূর্ণরূপে দেখা গিয়েছিল । তাঁকে আদর্শরূপে গ্রহণ করে ভবসাগর পার করা সম্ভব ।
মহামুনি মৈত্রেয় কর্তৃক মহাত্মা বিদুরকে এই মহারাজ পৃথু উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছিল । আজও ভক্তগণের পক্ষে এই বৃত্তান্ত পূর্ণরূপে প্রাসঙ্গিক বলেই পরিচিত ।
--------------------0-----------------------
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
যজ্ঞভোক্তা যজ্ঞেশ্বর সর্বশক্তিমান ভগবান শ্রীবিষ্ণু মহারাজ পৃথুর উপর সন্তুষ্ট ছিলেন । তিনি তখন ইন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে পৃথুর নিকটে উপস্থিত হলেন ।
ভগবান শ্রীবিষ্ণু বললেন - ' রাজন্ ! এই ইন্দ্র তোমার যজ্ঞে বিঘ্ন উৎপাদন করেছে তাই সে সন্তপ্ত । তুমি তাঁকে ক্ষমা করে দাও । '
হে নরদেব ! যাঁরা সাধুপ্রকৃতির ও সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন নরলোকন তাঁরা শ্রেষ্ঠ । কোনো জীবের উপায় তাঁরা দ্রোহ পোষন করেন না । তোমার মতন ব্যক্তিও যদি আমার দৈবী মায়ায় মোহিত হয় তাহলে তো বলতে হয় যে জ্ঞানীজনের দীর্ঘকাল সেবা করে তুমি বৃথা পরিশ্রম করেছ । আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি এই দেহকে কেবলমাত্র অবিদ্যা , বাসনা ও কর্মদ্বারা মোহিত জেনে এর প্রতি আসক্ত হয় না । এইভাবে যার দেহের উপরই আসক্তি নেই সেই বিবেকযুক্ত ব্যক্তি দেহের মাধ্যমে স্বীকৃত গৃহ , পুত্র অথবা ধনসম্পদের উপর কেমন করে আসক্ত হবে ?
আত্মা এক ও অদ্বিতীয় , শুদ্ধ , স্বপ্রকাশ , নির্গুণ , গুণাশ্রয় , সর্বব্যাপী , আবরণরহিত , সর্ববিষয়ে সাক্ষী , অধিষ্ঠানরহিত । অতএব দেখা যাচ্ছে যে আত্মা দেহ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা । যার এই জ্ঞান হয়েছে , তার বিষয়াসক্তি থাকে না ; তত্ত্বজ্ঞান লাভ করে সে তখন ব্রহ্মানন্দে প্রতিষ্ঠিত হয় - মোক্ষ লাভ করে । '
শ্রীভগবান পৃথুকে আবার বললেন - ' হে বীর ! তুমি উত্তম মধ্যম ও অধম সকলের প্রতি সমদর্শী হয়ে , সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন থেকে এবং মন ও ইন্দ্রিয়বর্গকে জয় করে প্রজাপালন করো , তাতেই তুমি পরম শান্তি ও পরমপদ লাভ করবে । অতএব পুণ্যাত্মা ব্রাহ্মণদের অনুমোদিত এবং সনাতন ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়ে ও অন্য সকল বিষয়ে নিরাসক্ত হয়ে এই পৃথিবী শাসন করো । সকলেই তোমার গৃহে সনকাদি সিদ্ধগণের দর্শন লাভ করবে । তোমার গুণ ও চরিত্রমাহাত্ম্য আমাকে প্রসন্ন করেছে । তুমি ইচ্ছা মতন বর প্রার্থনা করে নাও । '
শ্রীভগবানের আদেশে মহরাজ পৃথু ইন্দ্রের উপর তাঁর অসন্তোষ ত্যাগ করলেন । কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত ইন্দ্র তাঁর পাদস্পর্শ করে ক্ষমা চাইতে উদ্যত হলে পৃথু তাঁকে প্রীতিভরে আলিঙ্গন করলেন । অতঃপর মহারাজ পৃথু বিশ্বাত্মা ভক্তবৎসল ভগবানকে পূজোপহার নিবেদন করে পরম ভক্তি সহকারে তাঁর চরণকমলযুগল ধারণ করলেন । বদ্ধাঞ্জলি আদিরাজ পৃথু নয়নযুগল প্রেমাশ্রুধারায় প্লাবিত হওয়ায় শ্রীভগবানকে দর্শন করতে সক্ষম হচ্ছিলেন না , কন্ঠ কল্পরুদ্ধ হওয়ায় কিছু বলতেও পারছিলেন না ।
তিনি শ্রীভগবানকে আলিঙ্গন করে নিজ হৃদয়ে ধারণ করলেন ও সেইভাবেই অবস্থান করতে লাগলেন । অবশেষে পৃথু নিজেকে সংযত করে অতৃপ্ত নয়নে শ্রীভগবানকে দেখতে লাগলেন । শ্রীভগবানের পাদপদ্ম ভূমি স্পর্শ করেছিল আর করাগ্র গরুড়ের উন্নত স্কন্ধে বিন্যস্ত ছিলেন ।
অবশেষে পৃথু বলতে লাগলেন - ' হে মোক্ষপতি প্রভু ! আপনি ব্রহ্মা আদি রবদাতা দেবতাগণকেও রবদানে সমর্থ । বিষয়সুখের মতন তুচ্ছ পদার্থ আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি না । মহাপুরুষগণের মুখনিঃসৃত আপনার লীলাগুণগান যেখানে নেই তা যদি মোক্ষপদও হয় ও তবে তাও আমি চাই না । '
তিনি আরো বললেন - ' হে অনন্তকীর্তি ! আপনার মঙ্গয়ময় কীর্তিকথা একবার যে শ্রবণ করেছে সে যদি নিতান্তই পশুপ্রকৃতির না হয় সে সতত তাই শ্রবণ করতে আগ্রহী হবে । আপনি আমাকে অসংক্য কর্ণ তথা শ্রবণন্দ্রিয় দান করুন যাতে প্রাণ - ভরে আপনার গুণকথা শ্রবণ করতে পারি । কেবলমাত্র দুইটি কানে আপনার গুণকথা শুনে তৃপ্তি পাচ্ছি না । এই আমার প্রার্থনা । '
এইভাবে মহারাজ পৃথু শ্রীভগবানের স্তুতি করতেন লাগলেন । তাঁর স্তুতি শ্রবণ করে সর্বসাক্ষী ভগবান শ্রীহরি তাঁকে বললেন - ' রাজন্ ! আমার প্রতি তোমার ভক্তি হোক । মায়ার প্রভাব ত্যাগ করে তোমার চিত্ত যে আমাতে এইভাবে অনুরক্ত হয়েছে তা অত্যন্ত সৌভাগ্যের কথা । এখন তুমি নিশ্চিন্তে আমার আদেশ পালন করো । তোমার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হোক । '
মহারাজ পৃথুর পূজার্চনা গ্রহণ করে সকল অনুগ্রহ বর্ষণ করে শ্রীভগবান প্রস্থানে উদ্যত হলেন । মহারাজ পৃথু সমাহত দেবতা , ঋষি , পিতৃপুরুষ , গর্ন্ধব , সিদ্ধ , চারণ , নাগ , কিন্নর , অপ্সরা , মানব , পক্ষী ও অন্যান্য বহুবিধ প্রাণী ও শ্রীভগবানের পার্ষদগণ - সকলকেই ভক্তিপূর্বক সম্ভাষণ ও দক্ষিণাদি ধনদ্বারা যুক্তকরে সম্মান জ্ঞাপন করলেন । ভগবান অচ্যুতও সকলের চিত্ত হরণ করে বৈকুন্ঠধামে গমন করলেন ।
অতঃপর মহারাজ পৃথু ন্যায় ও ধর্ম পথে অবিচল থেকে নিষ্কামভাবে প্রজাপালন করতে লাগলেন । তাঁর কর্ম নিষ্কাম হওয়ায় কর্মফল সঞ্চয়ের প্রশান আদৌ ছিল না । প্রারদ্ধ ক্ষয় হওয়ায় কর্মশ্রোতরূপ জন্মমৃত্যু প্রবাহ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । তিনি জ্ঞান ও ভক্তির চরম সীমায় উপনীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন । তিনি এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করে সকলকে অতি সুন্দরভাবে নিজ কৃত্য - কর্ম সম্বন্ধে উপদেশ দিয়েছিলেন । সকলেই মহারাজ পৃথুর প্রশংসা করেছিলেন ।
এই সময়ে সূর্যসম দেদীপ্যমান মুনি চতুষ্টয়ের আগমন হয় । মহারাজ পৃথু সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে উঠে ---
সনক , সনন্দন , সনাতন ও সনৎকুমরাকে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু তখন সর্বজীবের মঙ্গলের জন্য মুনিদের প্রশ্ন করেছিলেন ---
' কিসে সকলের মঙ্গল হবে ? কেমন করে মঙ্গল হবে ? '
সনৎকুমার উত্তর দিয়েছিলেন ---
" মঙ্গল কামনায় দেহাদির প্রতি অনাসক্তি এবং পরব্রহ্মস্বরূপ আত্মার প্রতি প্রবল আসক্তি , তীব্র অনুরাগ থাকা প্রয়োজন ; ঈশ্বরে অনুরাগ ও সংসারে বিরাগ । ' আমি , আমার ' ভাব , অহংভাব ত্যাগ করলেই যথার্থ মঙ্গল হবে ।
শ্রদ্ধা ও ভাগবত ধর্মের অনুষ্ঠান , আত্মজ্ঞান লাভের ইচ্ছা , আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায় নিষ্ঠা , স্মরণ - মনন ও কীর্তন দ্বারা আত্মাকে রতি ও দেহাদিতে অনাসক্তি হয় ।
শ্রীভগবানের উপর রতি ও বিষয়ের বৈরাগ্য , অহিংসা , নিবৃত্তি , কল্যাণের জিজ্ঞাসা , লীলাকথা পানে ব্যাকুলতা , সংযম , কামনাবাসনা ত্যাগ , শৌচাদি নিয়ম পালন , পরনিন্দায় অরুচি , স্পৃহারাহিত্য ও শীত - উষ্ণ আদি দৈব সন্তাপ সহ্য করার কল্যাণ হয়ে থাকে ।
শ্রীভগবানের শরণাগত হতে হয় । নিত্যমুক্ত , নির্মল , সত্যস্বরূপ শ্রীভগবান জ্ঞানরূপে আবির্ভূত হন । শরণাগত হলেই তিনিই ভক্তের সকল ভার গ্রহণ করেন ।
শ্রীভগবানের পাদপদ্ম স্মরণ করে সহজেই অহংকার থেকে মুক্তি লাভ করা যায় , জ্ঞান ও যোগ সাধনার পথে মুক্তি পাওয়া কঠিন তাই শরণাগত বৎসল ভগবান শ্রীবাসুদেবের ভজনা করা প্রয়োজন । "
যখন সনৎকুমার সুস্পষ্টভাবে বললেন যে নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনার অর্থাৎ জ্ঞান পথের চেয়ে সগুণ সাকার উপাসনা অর্থাৎ ভক্তিযোগের পথ সহজ , তখন মহারাজ পৃথু তাইতেই মগ্ন হয়ে গেলেন ।
মুনিগণের উপদেশ দান করে আকাশপথে গমন করলেন । মহারাজ পৃথু নিরাসক্তভাবে রাজ্য শাসন করতে থাকলেন । তিনি ক্ষমা গুণে ছিলেন পৃথিবীর মতন , লোক কল্যাণে স্বর্গের মতন আর তৃপ্তি বিধানে ছিলেন মেঘের মতন । তিনি বহুকাল রাজ্যপালন করে অবশেষে বানপ্রস্থ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের আরাধনায় ব্রতী হলেন । ক্রমে তাঁর অবিদ্যাজনিত দেহবুদ্ধি দূর হয়ে আত্মজ্ঞান লাভ হল আর তিনি পরম আকাঙ্ক্ষিত শ্রীভগবানের সান্নিধ্য লাভ করলেন । বানপ্রস্থে গমনকালে তিনি পুত্রদের রাজ্যভার দিয়ে প্রজাপালন কার্য সম্পূর্ণ করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু যেন সর্বকালের অনুকরণীয় কল্যাণের রাজমার্গসম ছিলেন । তাঁর জীবনে জ্ঞান ও ভক্তি দুইই পূর্ণরূপে দেখা গিয়েছিল । তাঁকে আদর্শরূপে গ্রহণ করে ভবসাগর পার করা সম্ভব ।
মহামুনি মৈত্রেয় কর্তৃক মহাত্মা বিদুরকে এই মহারাজ পৃথু উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছিল । আজও ভক্তগণের পক্ষে এই বৃত্তান্ত পূর্ণরূপে প্রাসঙ্গিক বলেই পরিচিত ।
--------------------0-----------------------
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন