প্রিয় মিলন
মীরা চিতোর ত্যাগ করার অনতিকাল পরেই মেবার রাজ্যে নেমে এল চরম দুর্যোগ । মুসলমান আক্রমণের ফলে সমগ্র রাজ্য বিপর্যয় উপস্থিত হলো এবং রাজধানী চিতোর অত্যন্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো । বিক্রমজীৎ রাণা , যিনি মীরাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন তিনিও সিংহাসনচ্যূত হলেন । নব অভিষিক্ত রাজা উদয়সিংহ ধর্মভীরু প্রকৃতির ছিলেন । তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হলো , মীরার উপর রাজপরিবারের অন্যায় অত্যাচারের কারণে রাজ্যের এই দুর্ভাগ্য ।
কালক্ষেপ না করে তিনি রাজপুরোহিত ও কিছু নির্ভরযোগ্য পারিষদকে দ্বারকায় পাঠালেন মীরাকে চিতোরে ফিরিয়ে আনতে । কিন্তু তাঁদের পুনঃপুনঃ অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও মীরা চিতোর ফিরে যেতে সম্মত হলেন না । প্রভুর আশ্রয় ছেড়ে তিনি আর কোথাও যেতে রাজি নন । তাঁর কাছে চিতোরের কি মূল্য ? অবশেষে রাজপুরোহিত প্রভৃতি রাণার প্রতিনিধিরা চরমপন্থা হিসাবে অনশন শুরু করলেন । তাঁদের এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন মীরাকে বিচলিত করল । তাঁকে উপলক্ষ করে কেউ মৃত্যুবরণ করবে - এ যে তাঁর পক্ষে অসহনীয় !
অসহায় মীরা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে রণছোড়জীর শরণ নিলেন এবং করুণসুরে দেবতার কাছে নিবেদন করলেন দুটি ভজন ঃ
সকল জীবের দুঃখহারী তুমি তো গে গিরিধারী ।
দুঃখ শোকে তুমি আছ নাথ মীরা তব চিরদাসী ।
দ্বিতীয়টিতে তিনি গাইলেন ঃ
পূর্ণ হউক তোমার
ওগো প্রিয় সুন্দর
আমা পরে তব করুণা অপার
মোর নহে কেহ প্রিয়তর
অনশনে মোর বৃথা দিন যায়
রাত কাটে তব আশে
দিনে দিনে ক্ষয় , তুচ্ছ এ কায়
পরাণ বুঝি বা নাশে ।
গিরিধারী নাগর , মীরা ডাকে কাতর
ভিখ্ মাগে তব পায়
দিও না দিও না ফাঁকি , ওগো শ্যামসুন্দর
শেষ ক্ষণে কোলে নিও তায় ।
কথিত আছে , রণছোড়জী সেই পবিত্র , আত্মনিবেদিত হৃদয়ের প্রার্থনা ও ব্যাকুল আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন । বাইরে তখন সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা অবিরত মন্দির প্রাঙ্গণে সশব্দে আছড়ে পড়ছে ; গর্ভগৃহের অন্তরালে মীরার সঙ্গীতধ্বনি দেবতার হৃদয়ে শূণ্য আকাশে তোলে মহা আলোড়ন । দেবালয়ে মীরা তখন তার প্রিয়তমের সঙ্গে একাকী ।তাঁর বিরহ ব্যথা সুর হয়ে ঝরে পড়ে । রাজপুরোহিত তাঁর অনুচরবৃন্দসহ বাইরে তখন অপেক্ষমান অনেক আশা নিয়ে । চিতোরের ভাগ্যলক্ষ্মীকে তাঁরা ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তাঁর আপন রাজ্যে । সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ ঘটে চলে অবিরাম....... । সময় অপেক্ষা করে না কারো জন্যে । দেবালয়ের সিংহদুয়ার থাকে তেমনই রুদ্ধ ।
অবশেষে বাইরে থেকে যখন দুয়ার খোলা হলো , অদ্ভুত ব্যাপার , মীরা অন্তর্হিত ।
রণছোড়জী মীরাকে যেতে দেননি , তিনি তাকে টেনে নিয়েছেন আপন হৃদয়ে ।
কোথায় তিনি গেলেন অথবা যেতে পারেন ? মন্দির ছিল অর্গলবদ্ধ । রাজপুরোহিত অনুচর সহ বাইরে দুয়ারে পাহারারত । ভিতরে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো । ঠিক তখনই আকাশ হতে ভেসে এল মীরার স্বর -- তাঁর গাওয়া গানের অন্তিম দুটি পঙক্তি --
গিরিধারী নাগর , মীরা ডাকে কাতর ভিখ্ মাগে তব পায়ে ।
দিও না দিও না ফাঁকি , ওগো শ্যামসুন্দর শেষ ক্ষণে কোলে নিও তায় । ।
কোথা হতে আসে এ কন্ঠস্বর ? মীরা কি কোথাও লুকিয়ে আছেন ? বহু অনুসন্ধান করেও কিন্তু কোথাও তাঁকে পাওয়া গেল না । মীরাকে আর চিতোরে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় । তিনি তাঁর চির - রাজ্য দয়িতের হৃদয় মধ্যে ফিরে গেছেন চিরকালের জন্য । প্রেমের জোরে মীরার স্থূলদেহ বিলীন হয়ে গেছে দেবতার শরীরে । সে সত্য প্রমাণিত হলো যখন , আবিস্কৃত হলো তাঁর ওড়নাখানি রণছোড়জীর মূর্তির মুখমণ্ডলে ।
ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে , যেখানে ভক্ত ইষ্টদেবতার মূর্তিতে লীল হয়ে গেছেন । মীরার যেরূপ গিরিধারীলালের প্রতি প্রেম , অনুরূপ উচ্ছৃসিত প্রেমের আবেগ অনুভব করতেন অণ্ডাল তাঁর ইষ্টদেবতা শ্রীরঙ্গনাথের প্রতি । তিনিও তাঁর প্রিয়তম রঙ্গনাথ ব্যতীত অপর কাকেও বিবাহ করতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন এবং অবশেষে একদিন তাঁর আরাধ্য দেবতার শরীরে বিলীন হয়ে গেছিলেন , অথবা বলা যায় যেন শ্রীরঙ্গনাথ তাঁকে আপনার মধ্যে আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন ।
তাঁর রচিত ভক্তিগীত যা অপূর্ব প্রেরণাদায়ক গীতিকাব্য বলে তামিল সাহিত্যে পরিগণিত , সমগ্র দক্ষিণ ভারতে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে সর্বত্র বিশেষত পৌষ মাঘ মাসে ঊষাকালে প্রাতঃকালীন প্রার্থনা হিসাবে গীত হয়ে থাকে । মীরার সমসাময়িককালে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কেও এরূপ জনশ্রুতি আছে যে , তিনি পুরীধামে অতি রহস্যজনক ভাবে শ্রীজগন্নাথদেবের শরীরে লীন হয়ে গেছিলেন । তুকারাম নামে আর এক বিখ্যাত সাধক সম্পর্কেও অনুরূপ ঘটনা শোনা যায় । ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মীরার অন্তর্ধান ঘটেছিল , এমনটি মোটামুটি সকলে বিশ্বাম করে থাকেন ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
মীরা চিতোর ত্যাগ করার অনতিকাল পরেই মেবার রাজ্যে নেমে এল চরম দুর্যোগ । মুসলমান আক্রমণের ফলে সমগ্র রাজ্য বিপর্যয় উপস্থিত হলো এবং রাজধানী চিতোর অত্যন্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলো । বিক্রমজীৎ রাণা , যিনি মীরাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন তিনিও সিংহাসনচ্যূত হলেন । নব অভিষিক্ত রাজা উদয়সিংহ ধর্মভীরু প্রকৃতির ছিলেন । তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হলো , মীরার উপর রাজপরিবারের অন্যায় অত্যাচারের কারণে রাজ্যের এই দুর্ভাগ্য ।
কালক্ষেপ না করে তিনি রাজপুরোহিত ও কিছু নির্ভরযোগ্য পারিষদকে দ্বারকায় পাঠালেন মীরাকে চিতোরে ফিরিয়ে আনতে । কিন্তু তাঁদের পুনঃপুনঃ অনুরোধ উপরোধ সত্ত্বেও মীরা চিতোর ফিরে যেতে সম্মত হলেন না । প্রভুর আশ্রয় ছেড়ে তিনি আর কোথাও যেতে রাজি নন । তাঁর কাছে চিতোরের কি মূল্য ? অবশেষে রাজপুরোহিত প্রভৃতি রাণার প্রতিনিধিরা চরমপন্থা হিসাবে অনশন শুরু করলেন । তাঁদের এই সত্যাগ্রহ আন্দোলন মীরাকে বিচলিত করল । তাঁকে উপলক্ষ করে কেউ মৃত্যুবরণ করবে - এ যে তাঁর পক্ষে অসহনীয় !
অসহায় মীরা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করে রণছোড়জীর শরণ নিলেন এবং করুণসুরে দেবতার কাছে নিবেদন করলেন দুটি ভজন ঃ
সকল জীবের দুঃখহারী তুমি তো গে গিরিধারী ।
দুঃখ শোকে তুমি আছ নাথ মীরা তব চিরদাসী ।
দ্বিতীয়টিতে তিনি গাইলেন ঃ
পূর্ণ হউক তোমার
ওগো প্রিয় সুন্দর
আমা পরে তব করুণা অপার
মোর নহে কেহ প্রিয়তর
অনশনে মোর বৃথা দিন যায়
রাত কাটে তব আশে
দিনে দিনে ক্ষয় , তুচ্ছ এ কায়
পরাণ বুঝি বা নাশে ।
গিরিধারী নাগর , মীরা ডাকে কাতর
ভিখ্ মাগে তব পায়
দিও না দিও না ফাঁকি , ওগো শ্যামসুন্দর
শেষ ক্ষণে কোলে নিও তায় ।
কথিত আছে , রণছোড়জী সেই পবিত্র , আত্মনিবেদিত হৃদয়ের প্রার্থনা ও ব্যাকুল আবেদনে সাড়া দিয়েছিলেন । বাইরে তখন সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা অবিরত মন্দির প্রাঙ্গণে সশব্দে আছড়ে পড়ছে ; গর্ভগৃহের অন্তরালে মীরার সঙ্গীতধ্বনি দেবতার হৃদয়ে শূণ্য আকাশে তোলে মহা আলোড়ন । দেবালয়ে মীরা তখন তার প্রিয়তমের সঙ্গে একাকী ।তাঁর বিরহ ব্যথা সুর হয়ে ঝরে পড়ে । রাজপুরোহিত তাঁর অনুচরবৃন্দসহ বাইরে তখন অপেক্ষমান অনেক আশা নিয়ে । চিতোরের ভাগ্যলক্ষ্মীকে তাঁরা ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তাঁর আপন রাজ্যে । সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গ ঘটে চলে অবিরাম....... । সময় অপেক্ষা করে না কারো জন্যে । দেবালয়ের সিংহদুয়ার থাকে তেমনই রুদ্ধ ।
অবশেষে বাইরে থেকে যখন দুয়ার খোলা হলো , অদ্ভুত ব্যাপার , মীরা অন্তর্হিত ।
রণছোড়জী মীরাকে যেতে দেননি , তিনি তাকে টেনে নিয়েছেন আপন হৃদয়ে ।
কোথায় তিনি গেলেন অথবা যেতে পারেন ? মন্দির ছিল অর্গলবদ্ধ । রাজপুরোহিত অনুচর সহ বাইরে দুয়ারে পাহারারত । ভিতরে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো । ঠিক তখনই আকাশ হতে ভেসে এল মীরার স্বর -- তাঁর গাওয়া গানের অন্তিম দুটি পঙক্তি --
গিরিধারী নাগর , মীরা ডাকে কাতর ভিখ্ মাগে তব পায়ে ।
দিও না দিও না ফাঁকি , ওগো শ্যামসুন্দর শেষ ক্ষণে কোলে নিও তায় । ।
কোথা হতে আসে এ কন্ঠস্বর ? মীরা কি কোথাও লুকিয়ে আছেন ? বহু অনুসন্ধান করেও কিন্তু কোথাও তাঁকে পাওয়া গেল না । মীরাকে আর চিতোরে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় । তিনি তাঁর চির - রাজ্য দয়িতের হৃদয় মধ্যে ফিরে গেছেন চিরকালের জন্য । প্রেমের জোরে মীরার স্থূলদেহ বিলীন হয়ে গেছে দেবতার শরীরে । সে সত্য প্রমাণিত হলো যখন , আবিস্কৃত হলো তাঁর ওড়নাখানি রণছোড়জীর মূর্তির মুখমণ্ডলে ।
ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে , যেখানে ভক্ত ইষ্টদেবতার মূর্তিতে লীল হয়ে গেছেন । মীরার যেরূপ গিরিধারীলালের প্রতি প্রেম , অনুরূপ উচ্ছৃসিত প্রেমের আবেগ অনুভব করতেন অণ্ডাল তাঁর ইষ্টদেবতা শ্রীরঙ্গনাথের প্রতি । তিনিও তাঁর প্রিয়তম রঙ্গনাথ ব্যতীত অপর কাকেও বিবাহ করতে অস্বীকৃত হয়েছিলেন এবং অবশেষে একদিন তাঁর আরাধ্য দেবতার শরীরে বিলীন হয়ে গেছিলেন , অথবা বলা যায় যেন শ্রীরঙ্গনাথ তাঁকে আপনার মধ্যে আত্মসাৎ করে নিয়েছিলেন ।
তাঁর রচিত ভক্তিগীত যা অপূর্ব প্রেরণাদায়ক গীতিকাব্য বলে তামিল সাহিত্যে পরিগণিত , সমগ্র দক্ষিণ ভারতে তামিল অধ্যুষিত অঞ্চলে সর্বত্র বিশেষত পৌষ মাঘ মাসে ঊষাকালে প্রাতঃকালীন প্রার্থনা হিসাবে গীত হয়ে থাকে । মীরার সমসাময়িককালে শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কেও এরূপ জনশ্রুতি আছে যে , তিনি পুরীধামে অতি রহস্যজনক ভাবে শ্রীজগন্নাথদেবের শরীরে লীন হয়ে গেছিলেন । তুকারাম নামে আর এক বিখ্যাত সাধক সম্পর্কেও অনুরূপ ঘটনা শোনা যায় । ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মীরার অন্তর্ধান ঘটেছিল , এমনটি মোটামুটি সকলে বিশ্বাম করে থাকেন ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন