২৩ নভেম্বর ২০১৭

মানবজীবনের সার্থকতা কোথায় ?

"লব্ধ্বা সুদুর্লভমিদং বহুসম্ভবান্তে
মানুষ্যমর্থদমনিত্যমপীহ ধীরঃ ।
তূর্ণং যতেত ন পতেদনুমৃত্যযাব-
ন্নিঃশ্রেয়সায় বিষয়ঃ খলু সর্ব্বতঃ স্যাৎ ॥"

-শ্রীমদ্ভাগবতম্

      উপরোক্ত শ্নোকটি হইতে ষ্পষ্টই প্রতীয়মান হইতেছে যে এই মানবজীবন জীবের কত সুদুর্লভ ও মূল্যবান সস্পদ । দেবদুর্লভ এই অমূল্য সম্পদ লাভ করিয়া জীব যদি ইহার সার্থকতা উপলব্ধি করিতে না পারে, যদি মায়ার মোহে বিভ্রাস্ত জীব প্রাকৃত জগতের সুখ-দুঃখের অন্বেষণে এই জীবনে প্রাপ্ত অল্প কয়েকটি বৎসর বৃথা অতিবাহিত করিয়া দেয়, তাহা হইলে তাহার আর দুঃখের অবধি থাকে না । অনন্তের (Eternity) তুলনায় মনুষ্যের এই জীবিতকাল কতটুকু ? কয়েকটি নিমেষমাত্র বলিলেও অত্যুক্তি হয় না । কিন্তু তথাপি এই অল্প কয়েকক্ষণ অতি মূল্যবান—ইহার একাংশও বৃথা ব্যয় করিলে পরিণামে অশেষ দুঃখ ভোগ করিতে হয় । জন্ম যখন হইয়াছে, তখন মৃত্যু একদিন ঘটিবেই । আর এই অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে যখন একদিন না একদিন বরণ করিতেই হইবে—ইহার অনিবার্য্য গতি রোধ করিবার মত শক্তি যখন মানুষের নাই, তখন এই পার্থিব জগতের সুখ-দুঃখ, সম্পদ-বিপদের মধ্যে নিজকে সম্পূর্ণ ভাবে নিমজ্জিত করিয়া এবং অবশেষে মৃত্যুকালে দারা-পুত্র-পরিজনের জন্য চিন্তা করিতে করিতে সজলনয়নে এই পৃথিবী হইতে বিদায় লওয়া যে অতিমাত্রায় মূর্খতার পরিচয়—ইহা যে কেহ চিন্তা করিলে উপলব্ধি করিতে পারিবেন ।

      তথাকথিত পার্থিব-সভ্যতাগর্ব্বিত, অজ্ঞানতার গভীরতম পঙ্কে নিমজ্জিত, মায়ামুগ্ধ-জীব, এই চরম সত্যকে অস্বীকার করিবার স্পর্দ্ধা দেখায়—সাংসারিক লাভালাভের অঙ্ক নির্দ্ধারণ করিয়া, নানা পাপকর্ম্মে জীবনের দিনগুলি অতিবাহিত করিয়া অবশেষে মৃত্যবরণ করে এবং পরিণামে অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে । ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে ?

      জীবনের এই ভয়ঙ্কর পরিণামের কথা যুগে যুগে মহাপুরুষগণ জীবকে বারবার স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন । অশ্রুসজল-নয়নে প্রতিটী জীবের কাছে তাঁহাদের কাতর আবেদন জানাইয়া বলিয়াছেন ;— ওগো অমৃতের সন্তানগণ, এই মূল্যহীন জাগতিক লাভ-লোকসান ব্যাপারে বৃথা কালক্ষেপ না করিয়া একবার শ্রীভগবানের শরণ লও । তাঁহার শ্রীচরণে নিজেকে নিঃশেষে বিলাইয়া দাও ও তাঁহাতেই নিজের মন-প্রাণ, সমস্ত সত্ত্বা অর্পণ কর—দেখিবে, পরম শান্তি লাভ করিবে, অনন্ত আনন্দের সন্ধান পাইবে । জাগতিক সুখ-দুঃখ, জরা, ব্যাধি সকলের ঊর্দ্ধ্বে তুমি স্থানলাভ করিবে ; মৃত্যুও তোমাকে ভয় দেখাইতে সাহস করিবে না—তুমি মৃত্যুঞ্জয়ী হইবে । সেই আত্মচেতনা লাভ করিয়া নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে পারিবে ; দেখিবে—তুমি কত বড়, কত মহান্ ! ক্ষণিক সুখ-মোহে কর্ত্তব্যপথ বিস্মৃত হইয়া যে পার্থিব বিষয়ে নিজকে এতদিন লিপ্ত রাখিতে চাহিয়াছ, সেই জগৎ কত ক্ষুদ্র ! সে আজ তোমার দিকে মুগ্ধ-বিস্ময়ে চাহিয়া—তোমার পূজায় নিজকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে । স্বর্গের অমরগণও তোমার ন্যায় মর-জীবন কামনা করিতেছে ।

      ইহাই মনুষ্যজীবনের চরমতম সার্থকতা । কিন্তু কৃপাময় শ্রীভগবানের কৃপা ব্যতিরেকে ইহা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে । সেইজন্য—

শ্রবণং কীর্ত্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনং ।
অর্চ্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্ ॥

এইভাবে নিঃশেষে তাঁহার চরণে নিজের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করিয়া মনে-প্রাণে তাঁহার সেবায় নিজকে নিয়োগ করিলে তবেই তাঁহার কৃপালাভ করা যায়,—নচেৎ নিছক স্বার্থান্ধভাবে লাভালাভের কথা চিন্তা করিয়া এবং বহু গ্রন্থ পাঠ দ্বারা সারাজীবন তর্ক ও বিচারাদি করিয়াও তাঁহার কণামাত্র কৃপা লাভ করা যায় না । "বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর," তাঁহার উপর অনন্ত-বিশ্বাস রাখিয়া একান্ত নির্ভরশীলভাবে ভজবৎ কথা শ্রবণ-কীর্ত্তন ও ভগবৎ সেবায় সদাসর্ব্বদা প্রতিটী মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করিতে হইবে এবং পরিপূর্ণভাবে তাঁহাতেঈ আত্মসমর্পণ করিতে হইবে । আমি যখন তাঁহার সেবায় মন-প্রাণ অর্পণ করিয়াছি, তখন আমার কথা নিতিই বিন্তা করিবেন, নিজের জন্য আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই ;— এই যে পূর্ণ-বিশ্বাস ও অনন্ত-বির্ভরতা ইহার তুলনা নাই । সকল শাস্ত্রগ্রন্থাদির ঊর্দ্ধ্বে ইহার স্থান । এইরূপভাবে ভজনা করিয়া ভক্ত, ভগবানের কৃপালাভে সমর্থ হন এবং তদনুগ্রহ লাভ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ জ্ঞান করেন । শ্রীভগবানও ভক্তের এইরূপ সেবায় পরম প্রীতিলাভ করেন ।

শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫

Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।