তুমি কি চাও ?
(ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেব গোস্বামী মহারাজ)
বলতো ভাই, তুমি কি চাও ? এই যে বিশাল পৃথিবীর বক্ষে জলধিতরঙ্গ-কণার বুদ্বুদের ন্যায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে তুমিও একজন সকলেরই মত 'দেহি' 'দেহি' রবে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তুলেছ ! তোমার চাহিদা কি ? তুমি এই প্রাণীবহুল কর্ম্মমুখর জগতে দিবারাত্র অক্লাস্ত পরিশ্রম করেই চলেছ ! কেন ? সত্য কথা বল ! আমায় প্রতারণা কোরে লোকসান বই লাভ হবে না—বেশি বাক্বৈখরী দেখাবারও প্রয়োজন নাই ; শুধু সরলভাবে তোমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ একটু অনুসন্ধান কোরে, খুলে বল দেখি—কি চাই তোমার ? সুখ ! আনন্দ !! বেশ ! বেশ !! তোমার নিষ্কপট ব্যবহারে খুসী হলাম । তুমি ঠিকই বলেছ—আনন্দই সকলে চায় । আনন্দ পেলেই সবকিছু পাওয়া হয়ে যায়, অতএব, আনন্দই প্রয়োজন তাতে সন্দেহ নাই । কিন্তু কোথায় সেই আনন্দ ? ষে সমস্ত বিষয়ের জন্য তুমি দিবারাত্র কলুর বলদের ন্যায় এই সংসার ঘানি-গাছে কেবলই পাক খাচ্ছ, তা'তে কাহাকেও আনন্দ পেতে দেখেছ কি ? কেবলই তো তোমার সমধর্ম্মীদের মুখে শুনি—ধনং দেহি রূপং দেহি যশো দেহি মনোরমাভার্য্যাং দেহি—কেবল দেহি আর দেহি । হায়রে হতভাগ্য জীব ! আনন্দ যদি এতই সুলভ হবে, তবে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ভ'রে আনন্দ, আনন্দ কোরে হাহাকার ধ্বনি ওঠে কেন ? অতএব একটু ভাল কোরে ভেবে দেখ দেখি, ঐগুলি পেলেই কি তোমার আনন্দ লাভ হবে ? ঐগুলি কি তোমার প্রকৃত দাবী পূরণ কর্তে পার্বে ?—তা পার্বে না । ধনের কথা বল্ছো ? আচ্ছা ! একটুখানি তোমার ঐ সঙ্কীর্ণতার গণ্ডির বাহিরে এসে দেখ—যার প্রচুর ধন আছে, সেও সেই 'দেহি' 'দেহি' বোল ছাড়্তে পারে নাই ; কেবল, 'আরও চাই', 'আরও চাই' কোরে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আলোড়ন কোরে তুল্ছে । এই রকম, যার দশ আছে, সে শত চাইছে ; যার শত আছে, সে সহস্র চাইছে ; যার সহস্র আছে, সে লক্ষ চাইছে ; যার লক্ষ আছে, সে কোটী চাইছে—এইভাবে সকলেরই অশান্তির জনক চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে ; পরন্তু আনন্দের ছোঁয়াচও তারা পায় নাই । আরও—মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধন কিছু অর্জ্জন কর্লেও মা নিস্তারিণী তোমায় নিস্তার দেবেন—তা ভেবো না । ঐ ধন রক্ষার জন্যও আবার তোমার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখা যাবে । আজ চোরের ভয়, কাল ডাকাতের ভয়, পরশ্ব পাড়াপ্রতিবাসীর চাওয়ার ভয়, ছেলে-মেয়েদের আব্দারের বা খামখেয়ালীর ভয়, ব্যাঙ্কে রাখলে ব্যাঙ্কফেলের ভয়, ইন্কাম্ট্যাক্ম অফিসারের ভয়, পূজা-পার্ব্বণে চাঁদার ভয় ইত্যাদি রকমের কত ভয় যে তখন তোমায় পেয়ে বস্বে তার ইয়ত্তা নাই । সোজা কথায় তুমি তখন একটি প্রকাণ্ড ভয়ের ডিপো হয়ে যাবে । আনন্দ আকাশকুসুম হয়ে দাঁড়াবে । তারপর ধর্ম্মরাজের রাজ্যে ঘুস্ চলে না—এর মাঝেই হোক্, আর দুদিন পরেই হোক্—'পলাইতে ণথ নাই'—যমের দক্ষিণ দুয়ার থোলাই আছে—মর্তে তোমাকে হবেই । নাকের বদলে নরুণ পাওয়া গেলেও ধনের বদলে প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় না । কেননা—"ধনে যদি প্রাণ দিত, ধনী রাজা না মরিত, ধরামর হইত রাবণ । ধনে নাহি রাখে দেহ, দেহ গেলে নহে কেহ, অতএব কি করিবে ধন ॥" ধন, জন, রূপ, যৌবন, বন্ধু, বান্ধব, মনোরমা ভার্ষ্যা সবই পড়ে থাক্বে । কাকস্য পরিবেদনা—তখন আবার পাকাগুটী সব কেঁচে যাবে । অতএব, যে পথে প্রকৃতই আনন্দের সন্ধান পাবে বা যেভাবে প্রকৃত সুখ লাভ করা যায়, সেই পথটীরই অনুসন্ধান কর । কেবল অবুঝের মত নিজকে অনর্থের দরিয়ায় ভাসায়ে দিও না ।
শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫
(ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেব গোস্বামী মহারাজ)
বলতো ভাই, তুমি কি চাও ? এই যে বিশাল পৃথিবীর বক্ষে জলধিতরঙ্গ-কণার বুদ্বুদের ন্যায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে তুমিও একজন সকলেরই মত 'দেহি' 'দেহি' রবে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তুলেছ ! তোমার চাহিদা কি ? তুমি এই প্রাণীবহুল কর্ম্মমুখর জগতে দিবারাত্র অক্লাস্ত পরিশ্রম করেই চলেছ ! কেন ? সত্য কথা বল ! আমায় প্রতারণা কোরে লোকসান বই লাভ হবে না—বেশি বাক্বৈখরী দেখাবারও প্রয়োজন নাই ; শুধু সরলভাবে তোমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ একটু অনুসন্ধান কোরে, খুলে বল দেখি—কি চাই তোমার ? সুখ ! আনন্দ !! বেশ ! বেশ !! তোমার নিষ্কপট ব্যবহারে খুসী হলাম । তুমি ঠিকই বলেছ—আনন্দই সকলে চায় । আনন্দ পেলেই সবকিছু পাওয়া হয়ে যায়, অতএব, আনন্দই প্রয়োজন তাতে সন্দেহ নাই । কিন্তু কোথায় সেই আনন্দ ? ষে সমস্ত বিষয়ের জন্য তুমি দিবারাত্র কলুর বলদের ন্যায় এই সংসার ঘানি-গাছে কেবলই পাক খাচ্ছ, তা'তে কাহাকেও আনন্দ পেতে দেখেছ কি ? কেবলই তো তোমার সমধর্ম্মীদের মুখে শুনি—ধনং দেহি রূপং দেহি যশো দেহি মনোরমাভার্য্যাং দেহি—কেবল দেহি আর দেহি । হায়রে হতভাগ্য জীব ! আনন্দ যদি এতই সুলভ হবে, তবে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ভ'রে আনন্দ, আনন্দ কোরে হাহাকার ধ্বনি ওঠে কেন ? অতএব একটু ভাল কোরে ভেবে দেখ দেখি, ঐগুলি পেলেই কি তোমার আনন্দ লাভ হবে ? ঐগুলি কি তোমার প্রকৃত দাবী পূরণ কর্তে পার্বে ?—তা পার্বে না । ধনের কথা বল্ছো ? আচ্ছা ! একটুখানি তোমার ঐ সঙ্কীর্ণতার গণ্ডির বাহিরে এসে দেখ—যার প্রচুর ধন আছে, সেও সেই 'দেহি' 'দেহি' বোল ছাড়্তে পারে নাই ; কেবল, 'আরও চাই', 'আরও চাই' কোরে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আলোড়ন কোরে তুল্ছে । এই রকম, যার দশ আছে, সে শত চাইছে ; যার শত আছে, সে সহস্র চাইছে ; যার সহস্র আছে, সে লক্ষ চাইছে ; যার লক্ষ আছে, সে কোটী চাইছে—এইভাবে সকলেরই অশান্তির জনক চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে ; পরন্তু আনন্দের ছোঁয়াচও তারা পায় নাই । আরও—মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধন কিছু অর্জ্জন কর্লেও মা নিস্তারিণী তোমায় নিস্তার দেবেন—তা ভেবো না । ঐ ধন রক্ষার জন্যও আবার তোমার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখা যাবে । আজ চোরের ভয়, কাল ডাকাতের ভয়, পরশ্ব পাড়াপ্রতিবাসীর চাওয়ার ভয়, ছেলে-মেয়েদের আব্দারের বা খামখেয়ালীর ভয়, ব্যাঙ্কে রাখলে ব্যাঙ্কফেলের ভয়, ইন্কাম্ট্যাক্ম অফিসারের ভয়, পূজা-পার্ব্বণে চাঁদার ভয় ইত্যাদি রকমের কত ভয় যে তখন তোমায় পেয়ে বস্বে তার ইয়ত্তা নাই । সোজা কথায় তুমি তখন একটি প্রকাণ্ড ভয়ের ডিপো হয়ে যাবে । আনন্দ আকাশকুসুম হয়ে দাঁড়াবে । তারপর ধর্ম্মরাজের রাজ্যে ঘুস্ চলে না—এর মাঝেই হোক্, আর দুদিন পরেই হোক্—'পলাইতে ণথ নাই'—যমের দক্ষিণ দুয়ার থোলাই আছে—মর্তে তোমাকে হবেই । নাকের বদলে নরুণ পাওয়া গেলেও ধনের বদলে প্রাণ ফিরে পাওয়া যায় না । কেননা—"ধনে যদি প্রাণ দিত, ধনী রাজা না মরিত, ধরামর হইত রাবণ । ধনে নাহি রাখে দেহ, দেহ গেলে নহে কেহ, অতএব কি করিবে ধন ॥" ধন, জন, রূপ, যৌবন, বন্ধু, বান্ধব, মনোরমা ভার্ষ্যা সবই পড়ে থাক্বে । কাকস্য পরিবেদনা—তখন আবার পাকাগুটী সব কেঁচে যাবে । অতএব, যে পথে প্রকৃতই আনন্দের সন্ধান পাবে বা যেভাবে প্রকৃত সুখ লাভ করা যায়, সেই পথটীরই অনুসন্ধান কর । কেবল অবুঝের মত নিজকে অনর্থের দরিয়ায় ভাসায়ে দিও না ।
শ্রীগৌড়ীয়-দর্শন, ১ বর্ষ, ১ সংখ্যা
১১ হৃষিকেশ, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪ আগষ্ট, রবিবার, গৌরাব্দ ৪৬৯, বাং ১৩৬২, ইং ১৯৫৫
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন