যত্তৎ সত্ত্বগুণং স্বচ্ছং শান্তং ভগবতঃ পদম্ ।
যদাহুর্বাসুদেবাখ্যং চিত্ত তম্মহদাত্মকম্ ।। ( ৩\ ২৬ \ ২১ )
ব্রহ্মার আদেশে কর্দম মুনির দাম্পত্য ধর্মানুসারে প্রজাবৃদ্ধি করা এক ভয়ানক সমস্যারূপে দেখা দিয়েছিল । সমস্যা সমাধানে কর্দম মুনি সরস্বতী নদীর তীরে সুদীর্ঘ দশ সহস্র বৎসরকাল তপস্যা করেছিলেন । সত্যযুগ আরম্ভের প্রাক্কালে কমলনয়ন ভগবান শ্রীহরি কর্দম মুনির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শব্দব্রহ্মময় রূপ ধারণ করে তাঁকে দর্শন দান করেন ।
শ্রীহরি দর্শন দান কালে মস্তকে সুবর্ণনির্মিত কিরীট , কর্ণে দেদীপ্যমান কুণ্ডল ও হস্তে শঙ্খ , চক্র , গদা ও শ্বেতপদ্ম ধারণ করেছিলেন । তাঁর চরণকমল গরুড় স্কন্ধে সংস্থাপিত ছিল । বক্ষঃস্থলে ছিলেন শ্রীলক্ষ্মীদেবী আর গলায় ছিল কৌস্তুভমণি । শ্রীভগবান তখন অনিন্দ্যসুন্দর জ্যোতির্ময় মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ।
কর্দম মুনি শ্রীভগবানকে জানালেন যে তিনি কোনো উপযুক্ত ও গার্হস্থ্য ধর্মানুকূল শীলবতী রমণীকে ভার্যারূপে লাভ করবার অভিলাষে তাঁর শরণাগত হয়েছেন । কর্দম মুনি শ্রীভগবানের স্তবস্তুতিও করলেন ।
শ্রীভগবান বললেন - ' হে কর্দম ! তোমার আত্মসংযম ও আরাধনায় আমি প্রসন্ন হয়েছি । তোমার অভিলাষ পূর্ণ করবার ব্যবস্থা তো হয়েই আছে । আগামী পরশু পৃথিবীর শাসক বিরাটকীর্তি স্বায়ম্ভুব মনু তাঁর ভার্যা শতরূপাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার নিকটে আসবেন । তাঁদের কন্য রূপ - যৌবনসম্পন্না , সুশীলা , সদ্গুণান্বিতা , কৃষ্ণলোচনা ও বিবাহযোগ্য । তাঁরা সেই যোগ্য কন্যাই তোমাকে সম্প্রদান করবেন । তোমাদের থেকে নয়টি কন্যা - সন্তান হবে । মরীচি আদি তাঁদের বিবাহ করবেন ।
তুমিও আমার আজ্ঞায় কর্মসকল অনুষ্ঠান করে শুদ্ধসত্ত্বময় হয়ে সকল কর্মফল আমাতে সমর্পণ করে আমাকেই লাভ করবে । সর্বজীবে দয়া করে তুমি আত্মজ্ঞান লাভ করবে এবং আমাকে তোমার মধ্যে স্থিত দেখবে । হে মহামুনি ! আমিও নিজ অংশকলা রূপে তোমার মধ্যে দিয়ে তোমার পত্নী দেবহূতির গর্ভে অবতীর্ণ হয়ে তত্ত্বসংহিতা ( সাংখ্য শাস্ত্র ) প্রণয়ন করর । '
শ্রীভগবান নিজ ধামে গমন করলেন আর মহর্ষি কর্দম শ্রীহরির উপদিষ্ট সময়ের জন্য তপস্যাক্ষেত্র বিন্দু সরোবরের তীরেই অবস্থান করে রইলেন । যথাসময়ে আদিরাজ স্বায়ম্ভুব মনু কন্যাসহ শ্রেষ্ঠ তীর্থস্বরূপ সেই আশ্রমে প্রবেশ তরে দেখলেন যে মুনিবর কর্দম অগ্নিতে হোম সম্পাদন করে আসনে উপবিষ্ট । মহর্ষি তখন উন্নতকায় , পদ্মপলাশলোচন , জটাজুট সুশোভিত ও চীরবসনেও দ্যুতিসম্পন্ন । মহর্ষি কর্দম স্বায়ম্ভুব মনুর নানাবিধ গুণ ও কর্মের উৎকর্ষ কীর্তন করলেন ।
আত্মপ্রশংসায় লজ্জিত সম্রাট মনু তখন বললেন - ' হে মুনিপ্রবর ! নারদমুনির কাছ থেকে আপনার সুখ্যাতি শ্রবণ করে আমার কন্যা আপনাকে পতিত্বে বরণ করতে অভিলাষী । আমি অতীব শ্রদ্ধা সহকারে এই কন্যাকে আপনার হস্তে সম্প্রদান করছি । আপনি একে গ্রহণ করুন । গার্হস্থ্য ধর্মের সমস্ত কর্মে সর্বতোভাবে এই কন্যা আপনার উপযুক্ত । ' মহর্ষি কর্দম কন্যাকে গ্রহণ করবার সময়ে বললেন - ' সন্তান উৎপাদনকাল পর্যন্ত আমি গার্হস্থ্য ধর্মানুসারে এঁর সঙ্গে থাকব । অতঃপর শ্রীভগবানের উপদিষ্ট সন্ন্যাসপ্রধান অহিংসা ধর্মের সঙ্গে শম - দমাদি ধর্মসকল পালন করব । '
মহর্ষি কর্দম ও দেবহূতির বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেলে কন্যার পিতা ও মাতা মনু ও শতরূপা স্বদেশে প্রস্থান করলেন । দেবহূতি কাম , দম্ভ , বাসনা , লোভ , পাপ ও গর্ব পরিত্যাগ করে বিশ্বাস , পবিত্রতা , গৌরব , সংযম , শুশ্রূষা , প্রেম ও মধুরবাক্যাদি সদ্গুণ দ্বারা পরম তেজস্বী পতিদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন । কমলনয়না দেবহূতি পতি মহর্ষি কর্দমের আদেশ অনুসারে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলের আধার বিন্দু সরোবরে স্নান করে পতির যোগশক্তির বিভূতি দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন । দেব - দাম্পত্য শুরু হল ।
অনন্তর দেবহূতি সর্বাঙ্গসুন্দর নয়টি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন । এইসময় শুদ্ধাসত্ত্বা সতী দেবহূতি দেখলেন যে পূর্বপ্রতিজ্ঞানুসারে তাঁর পতিদেব সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে বনগমনে উদ্যাত হয়েছেন । তখন দেবহূতি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে স্বামীকে বললেন - ' আপনি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলে আপনার এই কন্যাদেরই তাদের যোগ্য পাত্র জোগাড় করতে হবে এবং আমার জন্ম - মরণরূপ বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য সদ্গুরুর প্রয়োজন হয়ে পড়বে । আমি শ্রীভগবানের মায়ায় আপনার মতো পতিদেবতাকে লাভ করেও সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করিনি । '
দেবহূতির কথায় মহর্ষি কর্দমেরর শ্রীভগবানের দেওয়া আশ্বাস - বাণী মনে পড়ল । তিনি তখন দেবহূতিকে বললেন - ' শ্রীভগবান স্বয়ং অংশকলারূপে তোমার গর্ভে আবির্ভূত হয়ে তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানোপদেশ দান করবেন । অতএব তুমি এখন শ্রীভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হও । '
যথাসময়ে শ্রীভগবান দেবহূতির গর্ভে পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেলেন । এই পুত্রই কপিল নামে পরিচিত । অতঃপর কর্দম মুনি তাঁর নয়টি কন্যার উপযুক্ত পতি সন্ধান করে তাদের সম্প্রদান করে সন্ন্যাস গ্রহণে কৃতসংকল্প হলেন । কর্দম ঋষি তাঁর কলা নাম্নী কন্যাকে মরীচির হস্তে , অন্সূয়াকে অত্রির হস্তে , শ্রদ্ধাকে অঙ্গিরার হস্তে , হবির্ভূকে পুলস্তরে হস্তে , গতিকে পুলহের হস্তে , ক্রিয়াকে ক্রতুর হস্তে । খ্যাতিকে ভৃগুর হস্তে , অরুদ্ধতীকে বশিষ্ঠ ও শান্তিকে অথর্বা ঋষির হস্তে সম্প্রদান করেছিলেন ।
এদিকে সাক্ষাৎ দেবাদিদেব শ্রীহরিই তাঁর গৃহে অবতীর্ণ হয়েছেন বুঝতে পেরে কর্দম ঋষি একান্তে তাঁকে প্রণাম করে বললেন - ' তোমাকে আমার গৃহে অবতরণ করতে দেখে ধন্য হয়েছি ।
হে প্রভু ! তুমি ভক্তের সম্মান বৃদ্ধি করে থাক । তুমি নিজ সত্য পালনার্থে এবং সাংখ্যযোগ প্রচার করবার জন্যই আমার গৃহে পদার্পণ করেছে । সাধকগণ তত্ত্বজ্ঞানলাভের ইচ্ছায় সর্বদাই তোমার পাদপীঠ বন্দনা করেন । ঐশ্বর্য , বৈরাগ্য , যশ , জ্ঞান , বীর্য ও শ্রী - এই ষড়ৈশ্বর্যে তুমি পরিপূর্ণ । আমি তোমার শরণাগত হলাম । হে প্রভু ! তোমার কৃপায় আমি ঋণত্রয় থেকে মুক্ত । এইবার আমি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে তোমার চিন্তা করতে করতে সমস্ত দৈন্য থেকে মুক্ত হয়ে ভূমণ্ডলে বিচরণ করব । অনুমতি দাও । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মুনিবর ! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য । এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন । হে মুনিবর ! আমি অনুমতি দিলাম । তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মুনিবর ! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য । এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন । হে মুনিবর ! আমি অনুমতি দিলাম । তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও । '
আদেশ পেয়ে প্রজাপতি কর্দম ঋষি শ্রীভগবানকে প্রদক্ষিণ করে হৃষ্টচিত্তে বনগমন করলেন । বনগমনের পূর্বে তিনি তাঁর কাছে এই প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন যে ভার্যা দেবহূতিকেও সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে নিষ্কৃতি প্রদানকারী আত্মজ্ঞান তিনিই দেবেন । কালে কর্দম ঋষির বুদ্ধি অন্তর্মুখী ও নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতন শান্ত হয়ে গেল । পরমভক্তিভাবের দ্বারা সর্বান্তর্যামী সর্বজ্ঞ ভগবান বাসুদেবে চিত্ত স্থির হয়ে যাওয়াতে তিনি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন । সর্বভূতে নিজ আত্মা শ্রীভগবানকে এবং শ্রীভগবানের মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করে তিনি ইচ্ছাদ্বেষরহিত সমদর্শী হয়ে ভক্তিযোগের সাধনদ্বারা শ্রীভগবানকে পরমপদ লাভ করলেন ।
পিতা কর্দম ঋষি সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যাওয়ার পর ভগবান কপিল জননীর কল্যাণ সাধনের জন্য সেই বিন্দু সরোবর তীর্থেই অবস্থান করতে লাগলেন । একদিন তত্ত্ববেত্তা ভগবান কপিল কর্ম সম্পাদন করে নিজাসনে উপবিষ্ট ছিলেন । তখন দেবহূতি তাঁকে প্রশ্ন করলেন ।
' দেবহূতি বললেন - ' হে বিরাট ! হে প্রভু ! দুষ্ট ইন্দ্রিয়বর্গ ভোগের আসক্তিতে আমাকে অস্থির করছে আর আমাকে ঘোর অন্ধকারময় অজ্ঞানে আবদ্ধ রেখেছে । তুমি সমস্ত জীবের প্রভু ভগবান আদিপুুরুষ তথা অজ্ঞানান্ধকারে অন্ধ জীবের কাছে নেত্রস্বরূপ সূর্যের মতন উদিত হয়েছ । এই দেহ - গেহের প্রতি ' আমি , আমার ' রূপ দুরাগ্রহ তোমারই দেওয়া , তাই তুমিই এই মহামোহ দূর করো । তুমি তোমার ভক্তজনের সংসাররূপ বৃক্ষ ছেদনের কুঠারস্বরূপ । আমি তোমার শরণাগত - প্রকৃতি ও পুরুষের তত্ত্বজ্ঞান লাভের অভিলাষী । তুমি শ্রেষ্ঠ ভাগবতবেত্তা । তোমাকে প্রণাম করছি । '
ভগবান কপিল বললেন -- ' হে মাতা ! অধ্যাত্মযোগই মানুষের আত্যন্তিক কল্যাণের মুখ্য সাধন । এই যোগ প্রাকৃত সুখ ও দুঃখ নিবারণ করে । জীবের চিত্তই তার বন্ধন ও মুক্তির কারণ । বিষয় চিত্ত বন্ধনের কারণ আর পরমাত্মায় চিত্তের মুক্তি । মানব মন যখন দেহাদিতে অহংবুদ্ধি ও গেহাদিতে মমত্ববুদ্ধিজনিত কাম , লোভ আদি বিকার থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ নির্মল হয়ে যায় তখন সেই মন সুখ - দুঃখরহিত হয়ে সমভাবাপন্ন অবস্থায় এসে যায় ।
তখন জীব নিজ জ্ঞান - বৈরাগ্য ও ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে আত্মাকে সম্পর্করহিত , একমেবাদ্বিতীয় , ভেদরহিত , অখণ্ড , স্বয়ং প্রকাশ , নির্লিপ্ত ও সুখ - দুঃখরহিত রূপে দর্শন করে এবং প্রকৃতিকে দুর্বল মনে করে ।যোগীদের কাছে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সর্বাত্মা শ্রীহরির প্রতি একান্ত ভক্তি ছাড়া অন্য কোনো কল্যাণকর পথ নেই । বিবেকযুক্ত ব্যক্তি জানতে পারে যে আসক্তি হল জীবাত্মার দৃঢ় বন্ধনপাশ আর তা সাধুমহাত্মাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলে তবে মোক্ষ দ্বার উন্মুক্ত হয় । যারা সহিষ্ণু , দয়ালু ,জীবে সমভাবাপন্ন , দ্বেষরহিত , শান্ত , সরল ও সজ্জনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী , অনন্য ভক্তিসম্পন্ন , ঈশ্বর লাভের জন্য স্বজন ও কর্ম পরিত্যাগী এবং মদ্গতচিত্তে ভগবানের পবিত্র লীলা শ্রবণ - কীর্তন করে , তাদের ত্রিতাপ ব্যথিত করতে সক্ষম হয় না ।
হে মাতা ! এই সর্বসঙ্গপরিত্যাগী মহাপুরুষগণই সাধু । সাধুসঙ্গই আসক্তি জনিত সমস্ত দোষ হরণ করে নেয় । '
দেহহূতি প্রশ্ন করলেন -- ' হে ভগবান ! ভক্তির স্বরূপ কী ? যে যোগের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয় , তার লক্ষণ কী ? সরল করে বলো । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মাতা ! বেদবিহিত কর্মে নিরত ও বিষয়াদির জ্ঞানপ্রকাশকারী ইন্দ্রিয়াদির ও একাগ্রচিত্তে পুরুষের শুদ্ধসত্ত্বময় শ্রীহরির প্রতি যে নিষ্কাম আকর্ষণ তার নামই ভগবানে অহৈতুকী ভক্তি । এই ভক্তি মুক্তির চেয়েও শক্তিশালী কারণ তা কর্মসংস্কারের আধাররূপ লিঙ্গ শরীরকেও অবিলম্বে ভস্মীভূত করে ।
ভগবানের সেবায় নিত্যযুক্ত ও তাঁর প্রসন্নতা অর্জনের জন্য কর্মানুষ্ঠানকারী একনিষ্ঠ ভক্তগণ সমবেত লীলা সংকীর্তন কালে আমার সাযুজ্য মোক্ষও কামনা করে না । এই ভক্তিই তাদের ব্রহ্মানন্দ লাভ করিয়ে থাকে । তারা ঐশ্বর্য কামনা করে না কিন্তু বৈকুন্ঠধামে গমন করে সেই সকল বিভূতি স্বাভাবিকভাবেই লাভ করে থাকে । অনন্য ভক্তকে আমি ভবসাগর পার করিয়ে দিয়ে থাকি । তীব্র ভক্তিযোগের দ্বারা আমাতে চিত্ত সমাহিত করাই হল এই জগতে মানুষের পক্ষে পরম পুরুষার্থ লাভ ।
' হে মাতা ! পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব জানলে পুরুষ প্রকৃতির গুণ অর্থাৎ অহংকারাদি থেকে মুক্ত হতে পারে । এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব এইরকম ---
পুরুষ এবং পঞ্চমহাভূত ( ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ) ,
পঞ্চতম্মাত্র ( গন্ধ , রস , রূপ , স্পশ , শব্দ ) ,
অন্তকরণ ( মন , বুদ্ধি , চিত্ত , অহংকার ) ,
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ( বাক্ , পাণি , পাদ , পায়ু , উপস্থ ) ও
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ( চক্ষু , কর্ণ , নাসিকা , জিহ্বা , ত্বক্ ) । '
' পুরুষ অনাদি ( নিত্য ) , নির্গুণ , সর্বব্যাপী ও অনন্ত । তিনি হলেন স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা , ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । জড় জগতের প্রকাশ পুরুষের শক্তিদ্বারাই হয়ে থাকে । এই পরমাত্মারূপ পুরুষ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হলে নিজ ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি যা প্রকৃতি নামে পরিচিত তা তার সম্মুখে উপস্থিত হয় । পুরুষ তাকে স্বীকার করলে সৃষ্টি হয় । '
" সত্ত্বগুণপ্রধান , নির্মল , শান্ত ( বাসনাদিরহিত ) , ভগবৎ উপলব্ধি স্থান যে চিত্ত তাই মহতত্ত্ব এবং তাকেই ' বাসুদেব ' বলা হয় । ভূত , ইন্দ্রিয় ও মনরূপ অহংকারকেই পণ্ডিতগণ সাক্ষাৎ ' সংকর্ষণ ' নামক সহস্রশীর্ষ অনন্তদেব বলে থাকেন । মনের সংকল্প ও বিকল্প দ্বারাই কামনার উৎপত্তি হয় । মনস্তত্ত্বই ইন্দ্রিয়গণের অধীশ্বর ' অনিরুদ্ধ ' নামে প্রসদ্ধি । "
" শ্রীভগবান বললেন -- হে মাতা ! তৈজস অহংকার বিকারপ্রাপ্ত হলে তার থেকে ' বুদ্ধি ' নামক তত্ত্ব উৎপন্ন হয় । বিষয়ের প্রকাশরূপ বিজ্ঞান এবং ইন্দ্রিয়বিষয়ে সহায়ক হওয়া ও পদার্থসমূহের বিশেষ জ্ঞান উৎপাদন - এই হল বুদ্ধিতত্ত্বের কার্য । বৃত্তিভেদ অনুসারে সংশয় , বিপর্যয় ( বিপরীত জ্ঞান ) , নিশ্চয় , স্মৃতি এবং নিন্দ্রাও বুদ্ধিরই লক্ষণ । এই বুদ্ধিতত্ত্বই ' প্রদ্যুম্ন ' । "
তদনন্তর কপিলদেব মাতাকে মনের মালিন্য দূর করবার জন্য পরিমিত আহার , শ্রীভগবানের স্মরণ - মনন , ব্রহ্মচর্য , তপস্যা , অষ্টাঙ্গ যোগ সাধন ইত্যাদির উপদেশ দিলেন । শ্রীভগবানের যে মূর্তিতে সাধন মন স্থির করে থাকে , তার বর্ণনা দিলেন ।
কপিলদেবের সবিস্তারে দান করা উপদেশসকল মাতা দেবহূতি মন দিয়ে শুনলেন । পুত্ররূপে অবতীর্ণ শ্রীভগবান কপিলদেব মাতাকে মুক্তিমার্গের সন্ধান দিলেন । ধ্যানযোগ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের নির্দেশিত পথে সাধনা করে মাতা অচিরেই বাঞ্ছিত মুক্তি লাভ করেছিলেন ।
মহাযোগী ভগবান কপিলদেবও মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য করে পিতার আশ্রম থেকে বেরিয়ে ঈশানকোণের দিকে চলে গেলেন । সেখানে স্বয়ং সমুদ্র তাঁর পূজার্চনা করেন ও তাঁকে স্থান দেন । ত্রিলোকে শান্তি প্রদানের জন্য তিনি যোগযুক্ত হয়ে সমাধিন্থ হন ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
যদাহুর্বাসুদেবাখ্যং চিত্ত তম্মহদাত্মকম্ ।। ( ৩\ ২৬ \ ২১ )
ব্রহ্মার আদেশে কর্দম মুনির দাম্পত্য ধর্মানুসারে প্রজাবৃদ্ধি করা এক ভয়ানক সমস্যারূপে দেখা দিয়েছিল । সমস্যা সমাধানে কর্দম মুনি সরস্বতী নদীর তীরে সুদীর্ঘ দশ সহস্র বৎসরকাল তপস্যা করেছিলেন । সত্যযুগ আরম্ভের প্রাক্কালে কমলনয়ন ভগবান শ্রীহরি কর্দম মুনির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে শব্দব্রহ্মময় রূপ ধারণ করে তাঁকে দর্শন দান করেন ।
শ্রীহরি দর্শন দান কালে মস্তকে সুবর্ণনির্মিত কিরীট , কর্ণে দেদীপ্যমান কুণ্ডল ও হস্তে শঙ্খ , চক্র , গদা ও শ্বেতপদ্ম ধারণ করেছিলেন । তাঁর চরণকমল গরুড় স্কন্ধে সংস্থাপিত ছিল । বক্ষঃস্থলে ছিলেন শ্রীলক্ষ্মীদেবী আর গলায় ছিল কৌস্তুভমণি । শ্রীভগবান তখন অনিন্দ্যসুন্দর জ্যোতির্ময় মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন ।
কর্দম মুনি শ্রীভগবানকে জানালেন যে তিনি কোনো উপযুক্ত ও গার্হস্থ্য ধর্মানুকূল শীলবতী রমণীকে ভার্যারূপে লাভ করবার অভিলাষে তাঁর শরণাগত হয়েছেন । কর্দম মুনি শ্রীভগবানের স্তবস্তুতিও করলেন ।
শ্রীভগবান বললেন - ' হে কর্দম ! তোমার আত্মসংযম ও আরাধনায় আমি প্রসন্ন হয়েছি । তোমার অভিলাষ পূর্ণ করবার ব্যবস্থা তো হয়েই আছে । আগামী পরশু পৃথিবীর শাসক বিরাটকীর্তি স্বায়ম্ভুব মনু তাঁর ভার্যা শতরূপাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার নিকটে আসবেন । তাঁদের কন্য রূপ - যৌবনসম্পন্না , সুশীলা , সদ্গুণান্বিতা , কৃষ্ণলোচনা ও বিবাহযোগ্য । তাঁরা সেই যোগ্য কন্যাই তোমাকে সম্প্রদান করবেন । তোমাদের থেকে নয়টি কন্যা - সন্তান হবে । মরীচি আদি তাঁদের বিবাহ করবেন ।
তুমিও আমার আজ্ঞায় কর্মসকল অনুষ্ঠান করে শুদ্ধসত্ত্বময় হয়ে সকল কর্মফল আমাতে সমর্পণ করে আমাকেই লাভ করবে । সর্বজীবে দয়া করে তুমি আত্মজ্ঞান লাভ করবে এবং আমাকে তোমার মধ্যে স্থিত দেখবে । হে মহামুনি ! আমিও নিজ অংশকলা রূপে তোমার মধ্যে দিয়ে তোমার পত্নী দেবহূতির গর্ভে অবতীর্ণ হয়ে তত্ত্বসংহিতা ( সাংখ্য শাস্ত্র ) প্রণয়ন করর । '
শ্রীভগবান নিজ ধামে গমন করলেন আর মহর্ষি কর্দম শ্রীহরির উপদিষ্ট সময়ের জন্য তপস্যাক্ষেত্র বিন্দু সরোবরের তীরেই অবস্থান করে রইলেন । যথাসময়ে আদিরাজ স্বায়ম্ভুব মনু কন্যাসহ শ্রেষ্ঠ তীর্থস্বরূপ সেই আশ্রমে প্রবেশ তরে দেখলেন যে মুনিবর কর্দম অগ্নিতে হোম সম্পাদন করে আসনে উপবিষ্ট । মহর্ষি তখন উন্নতকায় , পদ্মপলাশলোচন , জটাজুট সুশোভিত ও চীরবসনেও দ্যুতিসম্পন্ন । মহর্ষি কর্দম স্বায়ম্ভুব মনুর নানাবিধ গুণ ও কর্মের উৎকর্ষ কীর্তন করলেন ।
আত্মপ্রশংসায় লজ্জিত সম্রাট মনু তখন বললেন - ' হে মুনিপ্রবর ! নারদমুনির কাছ থেকে আপনার সুখ্যাতি শ্রবণ করে আমার কন্যা আপনাকে পতিত্বে বরণ করতে অভিলাষী । আমি অতীব শ্রদ্ধা সহকারে এই কন্যাকে আপনার হস্তে সম্প্রদান করছি । আপনি একে গ্রহণ করুন । গার্হস্থ্য ধর্মের সমস্ত কর্মে সর্বতোভাবে এই কন্যা আপনার উপযুক্ত । ' মহর্ষি কর্দম কন্যাকে গ্রহণ করবার সময়ে বললেন - ' সন্তান উৎপাদনকাল পর্যন্ত আমি গার্হস্থ্য ধর্মানুসারে এঁর সঙ্গে থাকব । অতঃপর শ্রীভগবানের উপদিষ্ট সন্ন্যাসপ্রধান অহিংসা ধর্মের সঙ্গে শম - দমাদি ধর্মসকল পালন করব । '
মহর্ষি কর্দম ও দেবহূতির বিবাহনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়ে গেলে কন্যার পিতা ও মাতা মনু ও শতরূপা স্বদেশে প্রস্থান করলেন । দেবহূতি কাম , দম্ভ , বাসনা , লোভ , পাপ ও গর্ব পরিত্যাগ করে বিশ্বাস , পবিত্রতা , গৌরব , সংযম , শুশ্রূষা , প্রেম ও মধুরবাক্যাদি সদ্গুণ দ্বারা পরম তেজস্বী পতিদেবতাকে সন্তুষ্ট করতে লাগলেন । কমলনয়না দেবহূতি পতি মহর্ষি কর্দমের আদেশ অনুসারে সরস্বতী নদীর পবিত্র জলের আধার বিন্দু সরোবরে স্নান করে পতির যোগশক্তির বিভূতি দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন । দেব - দাম্পত্য শুরু হল ।
অনন্তর দেবহূতি সর্বাঙ্গসুন্দর নয়টি কন্যাসন্তান প্রসব করলেন । এইসময় শুদ্ধাসত্ত্বা সতী দেবহূতি দেখলেন যে পূর্বপ্রতিজ্ঞানুসারে তাঁর পতিদেব সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে বনগমনে উদ্যাত হয়েছেন । তখন দেবহূতি অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে স্বামীকে বললেন - ' আপনি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলে আপনার এই কন্যাদেরই তাদের যোগ্য পাত্র জোগাড় করতে হবে এবং আমার জন্ম - মরণরূপ বন্ধন থেকে মুক্তির জন্য সদ্গুরুর প্রয়োজন হয়ে পড়বে । আমি শ্রীভগবানের মায়ায় আপনার মতো পতিদেবতাকে লাভ করেও সংসার বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের জন্য চেষ্টা করিনি । '
দেবহূতির কথায় মহর্ষি কর্দমেরর শ্রীভগবানের দেওয়া আশ্বাস - বাণী মনে পড়ল । তিনি তখন দেবহূতিকে বললেন - ' শ্রীভগবান স্বয়ং অংশকলারূপে তোমার গর্ভে আবির্ভূত হয়ে তোমাকে ব্রহ্মজ্ঞানোপদেশ দান করবেন । অতএব তুমি এখন শ্রীভগবানের আরাধনায় প্রবৃত্ত হও । '
যথাসময়ে শ্রীভগবান দেবহূতির গর্ভে পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেলেন । এই পুত্রই কপিল নামে পরিচিত । অতঃপর কর্দম মুনি তাঁর নয়টি কন্যার উপযুক্ত পতি সন্ধান করে তাদের সম্প্রদান করে সন্ন্যাস গ্রহণে কৃতসংকল্প হলেন । কর্দম ঋষি তাঁর কলা নাম্নী কন্যাকে মরীচির হস্তে , অন্সূয়াকে অত্রির হস্তে , শ্রদ্ধাকে অঙ্গিরার হস্তে , হবির্ভূকে পুলস্তরে হস্তে , গতিকে পুলহের হস্তে , ক্রিয়াকে ক্রতুর হস্তে । খ্যাতিকে ভৃগুর হস্তে , অরুদ্ধতীকে বশিষ্ঠ ও শান্তিকে অথর্বা ঋষির হস্তে সম্প্রদান করেছিলেন ।
এদিকে সাক্ষাৎ দেবাদিদেব শ্রীহরিই তাঁর গৃহে অবতীর্ণ হয়েছেন বুঝতে পেরে কর্দম ঋষি একান্তে তাঁকে প্রণাম করে বললেন - ' তোমাকে আমার গৃহে অবতরণ করতে দেখে ধন্য হয়েছি ।
হে প্রভু ! তুমি ভক্তের সম্মান বৃদ্ধি করে থাক । তুমি নিজ সত্য পালনার্থে এবং সাংখ্যযোগ প্রচার করবার জন্যই আমার গৃহে পদার্পণ করেছে । সাধকগণ তত্ত্বজ্ঞানলাভের ইচ্ছায় সর্বদাই তোমার পাদপীঠ বন্দনা করেন । ঐশ্বর্য , বৈরাগ্য , যশ , জ্ঞান , বীর্য ও শ্রী - এই ষড়ৈশ্বর্যে তুমি পরিপূর্ণ । আমি তোমার শরণাগত হলাম । হে প্রভু ! তোমার কৃপায় আমি ঋণত্রয় থেকে মুক্ত । এইবার আমি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে তোমার চিন্তা করতে করতে সমস্ত দৈন্য থেকে মুক্ত হয়ে ভূমণ্ডলে বিচরণ করব । অনুমতি দাও । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মুনিবর ! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য । এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন । হে মুনিবর ! আমি অনুমতি দিলাম । তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মুনিবর ! বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত রকমের কর্মে আমার বাক্যই প্রামাণ্য । এই জগতে মুক্তিকামী আত্মদর্শনের উপযোগী তত্ত্বাদি জ্ঞান সম্পাদনের জন্য ও তা পুনঃপ্রবর্তিত করবার জন্যই আমার অাগমন । হে মুনিবর ! আমি অনুমতি দিলাম । তুমি স্বেচ্ছায় প্রস্থান করো আর সমস্ত কর্মফল আমাতে আহুতি দিয়ে দূর্জয় মৃত্যুকে অতিক্রম করে মোক্ষপদ লাভের জন্য আমার ভজনায় নিত্যযুক্ত হও । '
আদেশ পেয়ে প্রজাপতি কর্দম ঋষি শ্রীভগবানকে প্রদক্ষিণ করে হৃষ্টচিত্তে বনগমন করলেন । বনগমনের পূর্বে তিনি তাঁর কাছে এই প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন যে ভার্যা দেবহূতিকেও সমস্ত কর্মবন্ধন থেকে নিষ্কৃতি প্রদানকারী আত্মজ্ঞান তিনিই দেবেন । কালে কর্দম ঋষির বুদ্ধি অন্তর্মুখী ও নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের মতন শান্ত হয়ে গেল । পরমভক্তিভাবের দ্বারা সর্বান্তর্যামী সর্বজ্ঞ ভগবান বাসুদেবে চিত্ত স্থির হয়ে যাওয়াতে তিনি সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন । সর্বভূতে নিজ আত্মা শ্রীভগবানকে এবং শ্রীভগবানের মধ্যে সর্বভূতকে দর্শন করে তিনি ইচ্ছাদ্বেষরহিত সমদর্শী হয়ে ভক্তিযোগের সাধনদ্বারা শ্রীভগবানকে পরমপদ লাভ করলেন ।
পিতা কর্দম ঋষি সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যাওয়ার পর ভগবান কপিল জননীর কল্যাণ সাধনের জন্য সেই বিন্দু সরোবর তীর্থেই অবস্থান করতে লাগলেন । একদিন তত্ত্ববেত্তা ভগবান কপিল কর্ম সম্পাদন করে নিজাসনে উপবিষ্ট ছিলেন । তখন দেবহূতি তাঁকে প্রশ্ন করলেন ।
' দেবহূতি বললেন - ' হে বিরাট ! হে প্রভু ! দুষ্ট ইন্দ্রিয়বর্গ ভোগের আসক্তিতে আমাকে অস্থির করছে আর আমাকে ঘোর অন্ধকারময় অজ্ঞানে আবদ্ধ রেখেছে । তুমি সমস্ত জীবের প্রভু ভগবান আদিপুুরুষ তথা অজ্ঞানান্ধকারে অন্ধ জীবের কাছে নেত্রস্বরূপ সূর্যের মতন উদিত হয়েছ । এই দেহ - গেহের প্রতি ' আমি , আমার ' রূপ দুরাগ্রহ তোমারই দেওয়া , তাই তুমিই এই মহামোহ দূর করো । তুমি তোমার ভক্তজনের সংসাররূপ বৃক্ষ ছেদনের কুঠারস্বরূপ । আমি তোমার শরণাগত - প্রকৃতি ও পুরুষের তত্ত্বজ্ঞান লাভের অভিলাষী । তুমি শ্রেষ্ঠ ভাগবতবেত্তা । তোমাকে প্রণাম করছি । '
ভগবান কপিল বললেন -- ' হে মাতা ! অধ্যাত্মযোগই মানুষের আত্যন্তিক কল্যাণের মুখ্য সাধন । এই যোগ প্রাকৃত সুখ ও দুঃখ নিবারণ করে । জীবের চিত্তই তার বন্ধন ও মুক্তির কারণ । বিষয় চিত্ত বন্ধনের কারণ আর পরমাত্মায় চিত্তের মুক্তি । মানব মন যখন দেহাদিতে অহংবুদ্ধি ও গেহাদিতে মমত্ববুদ্ধিজনিত কাম , লোভ আদি বিকার থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ নির্মল হয়ে যায় তখন সেই মন সুখ - দুঃখরহিত হয়ে সমভাবাপন্ন অবস্থায় এসে যায় ।
তখন জীব নিজ জ্ঞান - বৈরাগ্য ও ভক্তিযুক্ত হৃদয়ে আত্মাকে সম্পর্করহিত , একমেবাদ্বিতীয় , ভেদরহিত , অখণ্ড , স্বয়ং প্রকাশ , নির্লিপ্ত ও সুখ - দুঃখরহিত রূপে দর্শন করে এবং প্রকৃতিকে দুর্বল মনে করে ।যোগীদের কাছে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য সর্বাত্মা শ্রীহরির প্রতি একান্ত ভক্তি ছাড়া অন্য কোনো কল্যাণকর পথ নেই । বিবেকযুক্ত ব্যক্তি জানতে পারে যে আসক্তি হল জীবাত্মার দৃঢ় বন্ধনপাশ আর তা সাধুমহাত্মাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলে তবে মোক্ষ দ্বার উন্মুক্ত হয় । যারা সহিষ্ণু , দয়ালু ,জীবে সমভাবাপন্ন , দ্বেষরহিত , শান্ত , সরল ও সজ্জনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী , অনন্য ভক্তিসম্পন্ন , ঈশ্বর লাভের জন্য স্বজন ও কর্ম পরিত্যাগী এবং মদ্গতচিত্তে ভগবানের পবিত্র লীলা শ্রবণ - কীর্তন করে , তাদের ত্রিতাপ ব্যথিত করতে সক্ষম হয় না ।
হে মাতা ! এই সর্বসঙ্গপরিত্যাগী মহাপুরুষগণই সাধু । সাধুসঙ্গই আসক্তি জনিত সমস্ত দোষ হরণ করে নেয় । '
দেহহূতি প্রশ্ন করলেন -- ' হে ভগবান ! ভক্তির স্বরূপ কী ? যে যোগের দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান লাভ হয় , তার লক্ষণ কী ? সরল করে বলো । '
শ্রীভগবান বললেন - ' হে মাতা ! বেদবিহিত কর্মে নিরত ও বিষয়াদির জ্ঞানপ্রকাশকারী ইন্দ্রিয়াদির ও একাগ্রচিত্তে পুরুষের শুদ্ধসত্ত্বময় শ্রীহরির প্রতি যে নিষ্কাম আকর্ষণ তার নামই ভগবানে অহৈতুকী ভক্তি । এই ভক্তি মুক্তির চেয়েও শক্তিশালী কারণ তা কর্মসংস্কারের আধাররূপ লিঙ্গ শরীরকেও অবিলম্বে ভস্মীভূত করে ।
ভগবানের সেবায় নিত্যযুক্ত ও তাঁর প্রসন্নতা অর্জনের জন্য কর্মানুষ্ঠানকারী একনিষ্ঠ ভক্তগণ সমবেত লীলা সংকীর্তন কালে আমার সাযুজ্য মোক্ষও কামনা করে না । এই ভক্তিই তাদের ব্রহ্মানন্দ লাভ করিয়ে থাকে । তারা ঐশ্বর্য কামনা করে না কিন্তু বৈকুন্ঠধামে গমন করে সেই সকল বিভূতি স্বাভাবিকভাবেই লাভ করে থাকে । অনন্য ভক্তকে আমি ভবসাগর পার করিয়ে দিয়ে থাকি । তীব্র ভক্তিযোগের দ্বারা আমাতে চিত্ত সমাহিত করাই হল এই জগতে মানুষের পক্ষে পরম পুরুষার্থ লাভ ।
' হে মাতা ! পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব জানলে পুরুষ প্রকৃতির গুণ অর্থাৎ অহংকারাদি থেকে মুক্ত হতে পারে । এই পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব এইরকম ---
পুরুষ এবং পঞ্চমহাভূত ( ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ) ,
পঞ্চতম্মাত্র ( গন্ধ , রস , রূপ , স্পশ , শব্দ ) ,
অন্তকরণ ( মন , বুদ্ধি , চিত্ত , অহংকার ) ,
পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ( বাক্ , পাণি , পাদ , পায়ু , উপস্থ ) ও
পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ( চক্ষু , কর্ণ , নাসিকা , জিহ্বা , ত্বক্ ) । '
' পুরুষ অনাদি ( নিত্য ) , নির্গুণ , সর্বব্যাপী ও অনন্ত । তিনি হলেন স্বপ্রকাশ ও চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা , ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । জড় জগতের প্রকাশ পুরুষের শক্তিদ্বারাই হয়ে থাকে । এই পরমাত্মারূপ পুরুষ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হলে নিজ ত্রিগুণাত্মিকা শক্তি যা প্রকৃতি নামে পরিচিত তা তার সম্মুখে উপস্থিত হয় । পুরুষ তাকে স্বীকার করলে সৃষ্টি হয় । '
" সত্ত্বগুণপ্রধান , নির্মল , শান্ত ( বাসনাদিরহিত ) , ভগবৎ উপলব্ধি স্থান যে চিত্ত তাই মহতত্ত্ব এবং তাকেই ' বাসুদেব ' বলা হয় । ভূত , ইন্দ্রিয় ও মনরূপ অহংকারকেই পণ্ডিতগণ সাক্ষাৎ ' সংকর্ষণ ' নামক সহস্রশীর্ষ অনন্তদেব বলে থাকেন । মনের সংকল্প ও বিকল্প দ্বারাই কামনার উৎপত্তি হয় । মনস্তত্ত্বই ইন্দ্রিয়গণের অধীশ্বর ' অনিরুদ্ধ ' নামে প্রসদ্ধি । "
" শ্রীভগবান বললেন -- হে মাতা ! তৈজস অহংকার বিকারপ্রাপ্ত হলে তার থেকে ' বুদ্ধি ' নামক তত্ত্ব উৎপন্ন হয় । বিষয়ের প্রকাশরূপ বিজ্ঞান এবং ইন্দ্রিয়বিষয়ে সহায়ক হওয়া ও পদার্থসমূহের বিশেষ জ্ঞান উৎপাদন - এই হল বুদ্ধিতত্ত্বের কার্য । বৃত্তিভেদ অনুসারে সংশয় , বিপর্যয় ( বিপরীত জ্ঞান ) , নিশ্চয় , স্মৃতি এবং নিন্দ্রাও বুদ্ধিরই লক্ষণ । এই বুদ্ধিতত্ত্বই ' প্রদ্যুম্ন ' । "
তদনন্তর কপিলদেব মাতাকে মনের মালিন্য দূর করবার জন্য পরিমিত আহার , শ্রীভগবানের স্মরণ - মনন , ব্রহ্মচর্য , তপস্যা , অষ্টাঙ্গ যোগ সাধন ইত্যাদির উপদেশ দিলেন । শ্রীভগবানের যে মূর্তিতে সাধন মন স্থির করে থাকে , তার বর্ণনা দিলেন ।
কপিলদেবের সবিস্তারে দান করা উপদেশসকল মাতা দেবহূতি মন দিয়ে শুনলেন । পুত্ররূপে অবতীর্ণ শ্রীভগবান কপিলদেব মাতাকে মুক্তিমার্গের সন্ধান দিলেন । ধ্যানযোগ অবলম্বন করে শ্রীভগবানের নির্দেশিত পথে সাধনা করে মাতা অচিরেই বাঞ্ছিত মুক্তি লাভ করেছিলেন ।
মহাযোগী ভগবান কপিলদেবও মাতৃ আজ্ঞা শিরোধার্য করে পিতার আশ্রম থেকে বেরিয়ে ঈশানকোণের দিকে চলে গেলেন । সেখানে স্বয়ং সমুদ্র তাঁর পূজার্চনা করেন ও তাঁকে স্থান দেন । ত্রিলোকে শান্তি প্রদানের জন্য তিনি যোগযুক্ত হয়ে সমাধিন্থ হন ।
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন