সাধবো হৃদয়ং মহ্যং সাধূনাং হৃদয়ং ত্বহম্ ।
মদন্যৎ তে ন জানন্তি নাহং তেভ্যো মনাগপি ।। ( ভাগবত ৯\৪\৬৮ )
রাজা অম্বরীষ অতি ভাগ্যবান ব্যক্তি ছিলেন । পৃথিবীর সপ্ত দ্বীপ , অতুল সম্পত্তি ও অতুলনীয় ঐশ্বর্য তাঁর করায়ত্ত ছিল । যদিও এই সকল সম্পদ সাধারণ ব্যক্তিগণের জন্য অতি দুর্লভ বস্তু তবুও তিনি এই সকলকে স্বপ্ন তুল্যই মনে করতেন । তিনি জানতেন যে ধনসম্পদ নরকের দ্বারস্বরূপ । এই বস্তু অনিত্য ।
তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর প্রেমী সাধুদের উপরে গভীর প্রেমপ্রীতি পোষণ করতেন । নিজ মন , বাণী , হস্ত , কর্ণ , সকলই ভগবান অচ্যুতের সঙ্গে তিনি যুক্ত রেখেছিলেন ; মন শ্রীপাদপদ্মে , বাণী গুণ - সংকীর্তনে , হস্ত মন্দির মার্জন - সেবনে , ও কর্ণ মঙ্গলময় কথা শ্রবণে নিত্য যুক্ত থাকত । নেত্র মুকুন্দমূর্তি ও মন্দির দর্শনে , অঙ্গ ভগবদ্ভক্ত অঙ্গস্পর্শে , নাসিকা তাঁর শ্রীপাদপদ্মে স্পর্শ লাভ করা তুলসীর দিব্য ঘ্রাণ লাভে এবং রসনা শ্রীভগবান অর্পিত নৈবেদ্য প্রসাদে যুক্ত থাকত ।
অম্বরীষের চরণ , শ্রীভগবানের স্মৃতি বিজড়িত স্থান সকল পরিভ্রমণে আর মস্তক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণ বন্দনায় যুক্ত থাকত । মাল্য চন্দন আদি ভোগসামগ্রী তিনি শ্রীভগবানের সেবায় সমর্পণ করে দিয়েছিলেন । তিনি বিশ্বাস করতেন যে পবিত্রকীর্তি শ্রীভগবান , সকল প্রাণীর অন্তরাত্মায় বিরাজ করেন । তিনি তাঁর সমস্ত কর্ম যজ্ঞপুরুষ , ইন্দ্রিয়াতীত ভগবানের প্রতি তাঁরা সর্বাত্মা ও সর্বস্বরূপ জ্ঞানে সমর্পণ করে দিয়ে ভগবদ্ভক্ত ব্রাহ্মণদের আজ্ঞায় অনুকূলে পৃথিবী শাসন করতেন ।
ধম্ব নামক নির্জল দেশে সরস্বতী নদীর প্রবাহের সম্মুখে বশিষ্ঠ , অসিত , গৌতম আদি বিভিন্ন আচার্য দ্বারা তিনি মহান ঐশ্বর্যসম্পন্ন সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ ও বৃহৎ দক্ষিণাযুক্ত বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ করে যজ্ঞাধিপতি শ্রীভগবানের আরাধনা করেছিলেন । তিনি হৃদয়ে অনন্ত প্রেম প্রদানকারী শ্রীহরির নিত্য নিরন্তর দর্শন লাভ করতেন ।
এইভাবে রাজা অম্বরীষ তপস্যায় যুক্ত ভক্তিযোগ ও প্রজাপালনরূপ স্বধর্ম দ্বারা শ্রীভগবানকে প্রসন্ন করতে লাগলেন । তিনি জানতেন যে ভোগযুক্ত বস্তুসকল অনিত্য । তাঁর অনন্য প্রেমময় ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে শ্রীভগবান তাঁর রক্ষা নিমিত্ত সুদর্শন চক্রকে নিযুক্ত করে দিয়েছিলেন যা শত্রুদের জন্য যেমন ভীতিপ্রদ ছিল তেমনি মিত্রদের জন্য রক্ষাকবচ তুল্যও ছিল ।
রাজা অম্বরীষভার্যাও তাঁর মতন ধর্মপরায়ণা , সংসারে বৈরাগ্যসম্পন্না ও ভক্তিপরায়ণা ছিলেন । একবার রাজা অম্বরীষ নিজ ভার্যাসহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করবার জন্য একবর্ষব্যাপী দ্বাদশীপ্রধান একাদশীব্রতের নিয়ম ধারণ করলেন । ব্রত সমাপনে কার্তিক মাসে তিনি ত্রিরাত্রি উপবাস করলেন এবং যুমনায় স্নান করে মধুবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পূজার্চনা করলেন ।
তিনি মহাভিষেক বিধি অনুসরণ করে সব সামগ্রী ও সম্পত্তি দ্বারা শ্রীভগবানের অভিষেক করলেন এবং তম্ময়চিত্তে বস্ত্র , আভরণ , চন্দন , মাল্য এবং অর্ঘ্য আদি দ্বারা তাঁরা পূজা করলেন । যদিও মহাভাগ্যবান ব্রাহ্মণদের এই পূজায় প্রয়োজনীয়তা ছিল না । তাঁরা সিদ্ধ ছিলেন ও তাঁদের কামনাসকল পূরণ হয়ে গিয়েছিল তবুও রাজা অম্বরীষ তাঁদের ভক্তিভাবে পূজা করলেন ।
তিনি ব্রাহ্মণদের উত্তম আহারে সেবাকার্য সমাপন করে ষাট কোটি সুসজ্জিত গাভী দান করলেন ; দানের পূর্বে গাভীসমূহ শৃঙ্গ সুবর্ণ - মণ্ডিত , খুব রৌপমণ্ডিত ও পৃষ্টদেশ সুন্দর বস্ত্রদ্বারা সুসজ্জিত করে দেওয়া হয়েছিল । গাভীসকল সুশীল , তরুণ , পৃষ্টদেশ সুন্দর - দর্শন , সবৎসা ও দুগ্ধবতী ছিল । ব্রাহ্মণদের দানকার্য সমাপনে তাঁদের অনুমতি নিয়ে রাজা অম্বরীষ ব্রতপারণের জন্য উদ্যোগী হলেন । এইকালেই সহসা সেইখানে দুর্বাসা মুনির অতিথিরূপে আগমন হল ।
রাজা অম্বরীষ তাঁকে আসতে দেখেই অভ্যর্থনা করে তাঁকে আসন দান করলেন ও মাঙ্গলিক দ্রব্যাদি সহযোগে তাঁর পূজার্চনা করলেন । অতঃপর রাজা মহামুনিকে সেবা গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করলেন । দুর্বাসা মুনি অম্বরীষের প্রার্থনা স্বীকার করে আহারের পূর্বে স্নানের নিমিত্ত যমুনা নদীতে গমন করলেন । তিনি ব্রহ্মাধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যমুনার জলে স্নান করতে লাগলেন ।
দ্বাদশী অবসান আসন্ন দেখে ধর্মজ্ঞ অম্বরীষ ধর্মসংকট থেকে মুক্তি লাভ হেতু ব্রাহ্মণদের পরামর্শ চাইলেন । তিনি বললেন -- ' হে ব্রাহ্মণদেবতাগণ ! ব্রাহ্মণকে আহার না করিয়ে স্বয়ং আহার করা আবার অন্যদিকে দ্বাদশী পারণ না করা দুইই দোষযুক্ত । অতএব এখন আমার কী করা শ্রেয় যাতে আমার মঙ্গল হয় ও আমি পাপের ভাগী না হই । ' ব্রাহ্মণকুল ভেবেচিন্তে পরামর্শ দিয়ে বললেন যে - ' হে রাজর্ষি ! শ্রুতিকথন অনুসারে কেবল জল পান করে নেওয়া দোষযুক্ত হয় না । '
তখন শ্রীভগবানের চিন্তায় নিমগ্ন থেকে রাজা অম্বরীষ জল পান করে নিলেন ; আর দুর্বাসামুনির আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন । আবশ্যক কার্যাদি সমাপন করে যখন দুর্বাসা মুনি ফিরে এলেন তখন রাজা এগিয়ে গিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন । দুর্বাসা মুনি কিন্তু অনুমানে বুঝতে পারলেন যে রাজা পারণকার্য সমাপন করে দিয়েছেন । মুনি তখন ভয়ানক ক্ষুধার্ত ছিলেন ।
পারণকার্য তাঁকে আহার না করিয়েই করে নেওয়া হয়েছে তাই তিনি অতিশয় ক্রোধান্বিত হলেন আর ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন । তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করে ভয়াবহ মূর্তি ধারণ করে বললেন --- ' আরে ! ক্রূর ! ধনসম্পদমদে মত্ত দুর্মদ ! ভগবদ্ভক্তিহীন , তুই নিজেকে বড় ভাবিস ! আজ তুই ধর্ম লঙ্ঘন করে অতি অন্যায় করেছিস । আমি অতিথি হয়ে এসেছি । অতিথি সৎকারের নিমন্ত্রণ দিয়েও অতিথির আহারের পূর্বে আহার করেছিস ? এর উপযুক্ত শাস্তি তুই পাবি । '
==============
বাকী অংশ আগামীপর্বে
==============
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন