শ্রীভগবান্ উবাচ—
ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্ ।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেঽব্রবীৎ ॥১॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) অহম্ (আমি) অব্যয়ম্ (অব্যয়) ইমম্ (এই) যোগম্ (এই) যোগম্ (নিষ্কাম কর্ম্মসাধ্য জ্ঞানযোগের কথা) বিবস্বতে (সূর্য্যকে) প্রোক্তবান্ (পুরাকালে বলিয়াছিলাম), বিবস্বান্ (সূর্য্য) মনবে (স্বীয় পুত্ত্র বৈবস্বত মনুকে) প্রাহ (বলেন) মনুঃ (মনু) ইক্ষ্বাকবে (স্বপুত্ত্র ইক্ষ্বাকুকে) অব্রবীৎ (বলিয়াছিলেন) ॥১॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—আমি পূর্ব্বে সূর্য্যকে এই অব্যয় নিষ্কাম-কর্ম্মসাধ্য জ্ঞানযোগের কথা বলিয়াছিলাম । সূর্য্য তাহাই নিজ পুত্ত্র বৈবস্বত মনুকে বলেন, এবং মনুও তাহাই স্বীয় পুত্ত্র ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন ॥১॥
এবং পরম্পরা-প্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ । স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ ॥২॥ |
এবং (এইরূপে) পরম্পরা-প্রাপ্তম্ (পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত) ইমং (এই যোগ) রাজর্ষয়ঃ (রাজর্ষিগণ) বিদুঃ (অবগত হন), [হে] পরন্তপ ! (হে শত্রু দমন অর্জ্জুন !) সঃ যোগঃ (সেই জ্ঞান যোগ) মহতা কালেন (বহুকাল গত হওয়ায়) ইহ (বর্ত্তমানে) নষ্টঃ (নষ্টপ্রায় হইয়াছে) ॥২॥
হে পরন্তপ ! এইরূপে পরম্পরাপ্রাপ্ত এই জ্ঞানযোগ নিমি, জনক প্রভৃতি রাজর্ষিগণ অবগত হইয়াছিলেন । সেই যোগ অনেক কাল গত হওয়ায় আপাততঃ নষ্টপ্রায় হইয়াছে ॥২॥
স এবায়ং ময়া তেঽদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ । ভক্তোঽসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্ ॥৩॥ |
[ত্বম্] (তুমি) মে (আমার) ভক্তঃ সখা চ (ভক্ত ও সখা) ইতি [হেতোঃ] (এইজন্য) অয়ং সঃ এব (এই সেই) পুরাতনঃ (পুরাতন) যোগঃ (যোগ) অদ্য (আজ) ময়া (আমা কর্ত্তৃক) তে (তোমার নিকট) প্রোক্তঃ (কথিত হইল), হি (যেহেতু) এতৎ (ইহা) উত্তমম্ রহস্যম্ (অতি গোপনীয়) ॥৩॥
সেই সনাতন যোগ অদ্য আমি তোমাকে বলিলাম, যেহেতু তুমি আমার ভক্ত ও সখা, অতএব এই উত্তম যোগ অত্যন্ত গোপনীয় হইলেও তোমাকে আমি উপদেশ করিলাম ॥৩॥
অর্জ্জুন উবাচ—
অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ ।
কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি ॥৪॥ |
অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) ভবতঃ (আপনার) জন্ম (জন্ম) অপরং (ইদানীন্তন) বিবস্বতঃ (সূর্য্যের) জন্ম (জন্ম) পরম্ (পূর্ব্বে হইয়াছে) [তস্মাৎ] (অতএব) ত্বম্ (তুমি) আদৌ (পুরাকালে) [ইমং যোগং] (এই যোগ) প্রোক্তবান্ (বলিয়াছিলে) ইতি (এই যে কথা) এতৎ (ইহা) [অহং] (আমি) কথম্ (কিরূপে) বিজানীয়াং (বুঝিতে পারি ?) ॥৪॥
অর্জ্জুন বলিলেন—বিবস্বান্ (সূর্য্য) পূর্ব্বকালে জন্মিয়াছিলেন এবং তুমি ইদানীন্তন জন্মগ্রহণ করিয়াছ । সুতরাং তুমিই যে পূর্ব্বে সূর্য্যকে এই যোগ উপদেশ করিয়াছিলে এ কথা কি প্রকারে বিশ্বাস করা যায়? ॥৪॥
শ্রীভগবান্ উবাচ—
বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জ্জুন ।
তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ॥৫॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) [হে] পরন্তপ অর্জ্জুন ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) মে তব চ (আমার ও তোমার) বহূনি (বহু) জন্মানি (জন্ম) অতীতানি (অতীত হইয়াছে) ; অহং (আমি) তানি (সেই) সর্ব্বাণি (সমস্তই) বেদ (অবগত আছি), ত্বং ((তুমি কিন্তু) [তানি] (সে সকল) ন বেত্থ (জান না) ॥৫॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন ! আমার এবং তোমার অনেক জন্ম বিগত হইয়াছে । পরমেশ্বরত্ব হেতু আমি সে সমস্ত স্মরণ করিতে পারি । তুমি অণুচৈতন্য জীব, সে সব স্মরণ করিতে পার না ॥৫॥
অজোঽপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোঽপি সন্ । প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া ॥৬॥ |
[অহম্] (আমি) অজঃ (জন্মরহিত) সন্ অপি (হইয়াও) অব্যয়াত্মা (অনশ্বর শরীর) [সন্ অপি] (হইয়াও) ভূতানাম্ (প্রাণিগণের) ঈশ্বরঃ (ঈশ্বর) সন্ অপি (হইয়াও) স্বাম্ প্রকৃতিম্ (স্বকীয় সচ্চিদানন্দ স্বরূপকে) অধিষ্ঠায় (অধিষ্ঠান করিয়া) আত্মমায়য়া (যোগমায়া বিস্তারে) সম্ভবামি (দেব-মনুষ্য-তির্য্যক্ প্রভৃতি লোকে আবির্ভূত হই) ॥৬॥
আমি জন্ম-মৃত্যু-রহিত নিত্য-বিগ্রহ এবং সমস্ত জীবের নিয়ামক হইয়াও নিজ স্বরূপে অধিষ্ঠিত থাকিয়া স্বেচ্ছায় যোগমায়া বিস্তার-পূর্ব্বক জগতে আবির্ভূত হই ॥৬॥
যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত । অভ্যুত্থানমধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ ॥৭॥ |
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) যদা যদা হি (যে যে সময়েই) ধর্ম্মস্য (ধর্ম্মের) গ্লানিঃ (গ্লানি) অধর্ম্মস্য [চ] (এবং অধর্ম্মের) অভ্যুত্থানম্ (প্রাদুর্ভাব) ভবতি (হয়), তদা (তখনই) আত্মানং (নিজের স্বরূপকে) অহম্ (আমি) সৃজামি (সৃষ্ট দেহের মত প্রদর্শন করাই ) ॥৭॥
হে ভারত ! যখন যখন ধর্ম্মের গ্লানি ও অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি সৃষ্ট দেহবৎ আত্মপ্রকাশ করি, অর্থাৎ আবির্ভূত হই ॥৭॥
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ । ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥৮॥ |
সাধূনাং (সাধুগণের) পরিত্রাণায় (পরিত্রাণের জন্য) [তথা] (এবং) দুষ্কৃতাম্ (দুষ্কৃতগণের) বিনাশায় (বিনাশের হেতু) ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় চ (এবং মদীয় ধ্যান-যজন-পরিচর্য্যা-সঙ্কীর্ত্তনরূপ ধর্ম্ম সম্যক্রূপে স্থাপন করিবার নিমিত্ত) [অহং] (আমি) যুগে যুগে (প্রতি যুগে ) সম্ভবামি (আবির্ভূত হই) ॥৮॥
সাধুগণের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারিগণের বিনাশ ও ধর্ম্মকে সম্যক্ প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমি যুগে যুগে আবির্ভূত হই ॥৮॥
জন্ম কর্ম্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ । ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জম্ম নৈতি মামেতি সোঽর্জ্জুন ॥৯॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ (যিনি) মে (আমার) এবং (এইরূপ) দিব্যম্ (স্বেচ্ছাকৃত ও অপ্রাকৃত) জন্ম কর্ম্ম চ (জন্ম ও কর্ম্ম) তত্ত্বতঃ (পূর্ব্বোক্তমত তত্ত্ব বিচারক্রমে) বেত্তি (অবগত হন), সঃ (তিনি) দেহং (বর্ত্তমান দেহ) ত্যক্ত্বা (ত্যাগ করিয়া) পুনঃ (পুনর্ব্বার) জন্ম (জন্ম) ন এতি (গ্রহণ করেন না), [কিন্তু] মাম্ এতি (আমাকে প্রাপ্ত হন) ॥৯॥
হে অর্জ্জুন ! যিনি আমার এইরূপ স্বেচ্ছাকৃত অপ্রাকৃত জন্ম ও কর্ম্ম যথার্থভাবে অবগত হন, তিনি নিজের এই বর্ত্তমান দেহটী পরিত্যাগ করিয়া পুনরায় আর জন্মগ্রহণ করেন না কিন্তু আমাকেই প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ আমার চিচ্ছক্তি প্রকাশরূপ হ্লাদিনী-শক্তির বশীভূত হইয়া আমার নিত্যসেবা প্রাপ্ত হন ॥৯॥
বীতরাগভয়ক্রোধা মম্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ । বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ ॥১০॥ |
বীতরাগভয়ক্রোধাঃ (জড় বিষয়ে প্রীতি, ভয় ও ক্রোধশূন্য হইয়া) মম্ময়াঃ (আমার বিষয় শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণে নিবিষ্ট চিত্ত) মাম্ উপাশ্রিতাঃ (আমার আশ্রিত) বহবঃ (বহু ব্যক্তি) জ্ঞানতপসা (মদীয় জ্ঞানের ও মৎসম্বন্ধীয় তপস্যা দ্বারা) পূতাঃ [সন্তঃ] (নির্ম্মল হইয়া) মদ্ভাবম্ (আমাতে ভাব-ভক্তি) আগতাঃ (লাভ করিয়াছেন) ॥১০॥
জড়বিষয়ে প্রীতি, ভয় ও ক্রোধশূন্য, আমার বিষয়ে শ্রবণ, কীর্ত্তন ও স্মরণে নিবিষ্টচিত্ত ও আমারই আশ্রিত বহু ব্যক্তি মৎসম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তপস্যায় বিশুদ্ধ হইয়া আমার পবিত্র প্রেমলাভ করিয়াছেন ॥১০॥
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্ । মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ ॥১১॥ |
যে (যাহারা) যথা (যে প্রকারে) মাং (আমাকে) প্রপদ্যন্তে (ভজনা করে), অহম্ (আমি) তান্ (তাহাদিগকে) তথা এব (সেই প্রকারেই) ভজামি (ভজন ফল দান করি) । [হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) সর্ব্বশঃ মনুষ্যাঃ (জ্ঞানি-কর্ম্মি-যোগি-দেবতান্তর-ভজনকারী সকল মনুষ্যই) মম বর্ত্ম (আমার পথের) অনুবর্ত্তন্তে (অনুসরণ করে) ॥১১॥
যে ব্যক্তি আমার প্রতি যেভাবে প্রপত্তি স্বীকার করেন, আমি তাহাকে সেইভাবেই ভজন করি । সকল মতেরই চরম উদ্দেশ্য স্বরূপ আমি সকলেরই প্রাপ্য । সমস্ত মনুষ্যই আমার বিবিধ বর্ত্মের অনুসরণ করে ॥১১॥
কাঙ্ক্ষন্তঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ । ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্ম্মজা ॥১২॥ |
ইহ (এই মনুষ্য লোকে) কর্ম্মণাং (কর্ম্ম সমূহের) সিদ্ধিং (সাফল্য) কাঙ্ক্ষন্তঃ (কামনাকারী ব্যক্তিগণ) দেবতাঃ (ইন্দ্রাদি দেবতাগণের) যজন্তে (ভজনা করিয়া থাকে), হি (যেহেতু) মানুষে লোকে (মনুষ্য লোকে) কর্ম্মজা (কর্ম্ম জন্য) সিদ্ধিঃ (স্বর্গাদি ফল) ক্ষিপ্রং (শ্রীঘ্রই) ভবতি (হইয়া থাকে) ॥১২॥
এই মনুষ্যলোকে কর্ম্মসমূহের সহজে সাফল্য কামনাশীল ব্যক্তিগণ ইন্দ্রাদি দেবতাগণকে ভজনা করেন । তদ্দ্বারা মনুষ্যলোকে কর্ম্মজ ফল স্বর্গাদি লাভ অতি শীঘ্রই সংঘটিত হইয়া থাকে ॥১২॥
চাতুর্ব্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ । তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্ত্তারমব্যয়ম্ ॥১৩॥ |
ময়া (আমা কর্ত্তৃক) গুণকর্ম্মবিভাগশঃ (সত্ত্বাদি গুণ ও শম দমাদি কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে) চাতুর্ব্বর্ণ্যং (ব্রাহ্মণাদি চারিটী বর্ণ) সৃষ্টং (সৃষ্ট হইয়াছে) । তস্য (সেই বর্ণ ধর্ম্মের ও বর্ণ সকলের) কর্ত্তারম্ অপি (স্রষ্টা হইলেও) মাং (আমাকে) অকর্ত্তারম্ (বস্তুতঃ গুণাতীত স্বরূপ বলিয়া অস্রষ্টা) অব্যয়ম্ (ও নির্ব্বিকার বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥১৩॥
সত্ত্বাদিগুণ ও শমদমাদি কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে ব্রাহ্মণাদি বর্ণচতুষ্টয় আমিই সৃজন করিয়াছি । জগতে আমি বই আর কেহ কর্ত্তা নাই । কিন্তু সেই বর্ণধর্ম্মের কর্ত্তা হইলেও আমাকে বস্তুতঃ গুণাতীত স্বরূপ বলিয়া অকর্ত্তা ও অব্যয় বলিয়া জানিতে হইবে ॥১৩॥
ন মাং কর্ম্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা । ইতি মাং যোঽভিজানাতি কর্ম্মভির্ন স বধ্যতে ॥১৪॥ |
কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সকল) [জীবমিব] (জীবের ন্যায়) মাং (আমাকে) ন লিম্পন্তি (লিপ্ত করিতে পারে না), মে (আমার) কর্ম্মফলে (কর্ম্মফল স্বর্গাদিতেও) স্পৃহা (স্পৃহা) ন [অস্তি] (নাই), ইতি (এইরূপ) যঃ (যিনি) মাং (আমাকে) অভিজানাতি (সাম্যক্ জানিতে পারেন) সঃ (তিনি) কর্ম্মভিঃ (কর্ম্মের দ্বারা) ন বধ্যতে (বদ্ধ হন না) ॥১৪॥
জীবের অদৃষ্ট বশতঃ যে কর্ম্মতত্ত্ব আমি সৃষ্টি করিয়াছি, তাহা আমাকে লিপ্ত করিতে পারে না । কর্ম্মফলেও আমার স্পৃহা নাই, (যেহেতু অতি তুচ্ছ কর্ম্মফল আমি যে ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ ভগবান্ আমার পক্ষে নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ।) জীবের কর্ম্মমার্গ ও আমার স্বতন্ত্রতা বিচার পূর্ব্বক যিনি আমার অব্যয়তত্ত্ব অবগত হইতে পারেন, তিনি কখনই কর্ম্ম দ্বারা বদ্ধ হন না । শুদ্ধভক্তি আচরণ করতঃ আমাকেই লাভ করেন ॥১৪॥
এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ । কুরু কর্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতরং কৃতম্ ॥১৫॥ |
এবং (এইরূপ) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) পূর্ব্বৈঃ (পূর্ব্ব পূর্ব্ব) মুমুক্ষুভিঃ অপি (মুক্তিকামিগণও) কর্ম্ম (মদর্পিত কর্ম্ম) কৃতং (করিয়াছেন) । তস্মাৎ (অতএব) ত্বং (তুমি) পূর্ব্বৈঃ (প্রাচীন জনকাদি মহাজন কর্ত্তৃক) পূর্ব্বতরং কৃতম্ (পূর্ব্বে অনুষ্ঠিত) কর্ম্ম এব (নিষ্কাম কর্ম্মযোগই) কুরু (অবলম্বন কর) ॥১৫॥
পূর্ব্ব পূর্ব্ব মুমুক্ষুগণ এই তত্ত্ব অবগত হইয়া সকাম কর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিষ্কাম মদর্পিত কর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াছেন । অতএব তুমিও পূর্ব্ব পূর্ব্ব মহাজন অনুষ্ঠিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ অবলম্বন কর ॥১৫॥
কিং কর্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োঽপ্যত্র মোহিতাঃ । তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেঽশুভাৎ ॥১৬॥ |
কিং কর্ম্ম (কর্ম্ম কি ?) কিম্ অকর্ম্ম (অকর্ম্মই বা কি ?) ইতি অত্র (এই তত্ত্ব নিরূপণে) কবয়ঃ অপি (জ্ঞানিগণও) মোহিতাঃ [ভবন্তি] (মোহ প্রাপ্ত হন), [অতঃ] (অতএব) যৎ জ্ঞাত্বা (যাহা জানিয়া) অশুভাৎ (অমঙ্গলপূর্ণ সংসার হইতে) মোক্ষ্যসে (মুক্তি লাভ করিতে পারিবে) তৎ কর্ম্ম (সেই কর্ম্ম ও অকর্ম্ম) তে (তোমাকে) প্রবক্ষ্যামি (বলিব) ॥১৬॥
কাহাকে কর্ম্ম ও কাহাকে অকর্ম্ম বলে তাহা স্থিরীকরণ সম্বন্ধে জ্ঞানিগণও মোহপ্রাপ্ত হইয়া থাকেন । অতএব যাহা অবগত হইয়া তুমি অমঙ্গলপূর্ণ সংসার হইতে মুক্তিলাভ করিবে সেই কর্ম্ম ও অকর্ম্ম সম্বন্ধে তোমাকে উপদেশ করিতেছি ॥১৬॥
কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ । অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ ॥১৭॥ |
কর্ম্মণঃ অপি (বেদবিহিত কর্ম্মেরও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) বিকর্ম্মণঃ চ (শাস্ত্র নিষিদ্ধ কর্ম্মের সম্বন্ধেও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) অকর্ম্মণঃ চ (এবং কর্ম্মের অকরণ অর্থাৎ সন্ন্যাস সম্বন্ধেও) বোদ্ধব্যং (জানিবার বিষয়) [অস্তি] (আছে) । হি (যেহেতু) কর্ম্মণঃ (কর্ম্ম, বিকর্ম্ম ও অকর্ম্মের) গতিঃ (যথার্থ তত্ত্ব) গহনা (অতিশয় দুর্গম) ॥১৭॥
বেদবিহিত কর্ম্মেরও জানিবার বিষয় আছে, শাস্ত্র নিষিদ্ধ কর্ম্মের সম্বন্ধেও জানিবার বিষয় আছে, এবং কর্ম্মের সন্ন্যাস সম্বন্ধেও জানিবার বিষয় আছে । কর্ত্তব্যাচরণই ‘কর্ম্ম’, নিষিদ্ধাচরণই ‘বিকর্ম্ম’, এবং কর্ম্মের অকরণ বা সন্ন্যাসই ‘অকর্ম্ম’, ইহাদের নিগূঢ় তত্ত্ব নিরূপণ সুকঠিন ॥১৭॥
কর্ম্মণ্যকর্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ । স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ ॥১৮॥ |
যঃ (যিনি) কর্ম্মণি (শুদ্ধান্তঃকরণ জ্ঞানিকর্ত্তৃক অনুষ্ঠীয়মান নিষ্কাম কর্ম্ম যোগে) অকর্ম্ম (বন্ধকত্ব নাই বলিয়া উহা কর্ম্ম নয় এইরূপ) অকর্ম্মণি চ (এবং অশুদ্ধান্তঃ করণ সন্ন্যাসী কর্ত্তৃক কর্ম্মের অকরণে) কর্ম্ম (দুর্গতি প্রাপক কর্ম্মবন্ধন) পশ্যেৎ (দর্শন করেন) সঃ (তিনিই) মনুষ্যেষু (মনুষ্যদিগের মধ্যে) বুদ্ধিমান্ (বিবেকী), সঃ (তিনিই) যুক্তঃ (যোগী) কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ (এবং সম্পূর্ণ কর্ম্মের অনুষ্ঠাতা) ॥১৮॥
যিনি শুদ্ধান্তঃকরণ জ্ঞানীর নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠানে বন্ধকত্ব নাই সুতরাং উহা কর্ম্ম নয় এইরূপ জানেন ; এবং অশুদ্ধান্তঃকরণ সন্ন্যাসীর কর্ম্মত্যাগে দুর্গতি প্রাপক কর্ম্মবন্ধন উপলব্ধি করেন, তিনিই মনুষ্যদিগের মধ্যে বুদ্ধিমান্ যোগী এবং সম্পূর্ণ কর্ম্মানুষ্ঠাতা ॥১৮॥
যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ । জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ ॥১৯॥ |
যস্য (যাঁহার) সর্ব্বে (সমস্ত) সমারম্ভাঃ (কর্ম্ম) কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ (ফল কামনা রহিত) জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং (তিনি জ্ঞানরূপ অগ্নিতে বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মসমূহ দগ্ধ করিয়াছেন) তম্ (তাঁহাকে) বুধাঃ (সুধীগণ) পণ্ডিতঃ (পণ্ডিত) আহুঃ (বলেন) ॥১৯॥
যাঁহার সমুদয় কর্ম্মাচরণ ফলকামনা শূন্য, জ্ঞানাগ্নিতে বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্ম্মসমূহ দগ্ধকারী তাঁহাকে বিবেকিগণ ‘পণ্ডিত’ বলেন ॥১৯॥
ত্যক্ত্বা কর্ম্মফলাসঙ্গং নিত্যতৃপ্তো নিরাশ্রয়ঃ । কর্ম্মণ্যভিপ্রবৃত্তোঽপি নৈব কিঞ্চিৎ করোতি সঃ ॥২০॥ |
[যঃ] (যিনি) কর্ম্মফলাসঙ্গং (কর্ম্ম ফলের আসক্তি) ত্যক্তা (ত্যাগ করিয়া) নিত্যতৃপ্তঃ (নিত্য নিজানন্দে তৃপ্ত) নিরাশ্রয়ঃ (এবং যোগক্ষেম নিমিত্ত আশ্রয় নিরপেক্ষ) সঃ (তিনি) কর্ম্মণি (সমস্ত কর্ম্মে) অভিপ্রবৃত্তঃ অপি ( সম্যক্ প্রবৃত্ত হইলেও) কিঞ্চিৎ এব (কিছুই) ন করোতি (করেন না) ॥২০॥
যিনি কর্ম্মফলের আসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক নিত্য নিজানন্দে পরিতৃপ্ত এবং যোগ ও ক্ষেমের নিমিত্ত আশ্রয় নিরপেক্ষ, তিনি সমস্ত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হইয়াও কিছুই করেন না অর্থাৎ সেই সমস্ত কর্ম্মফলে আবদ্ধ হন না ॥২০॥
নিরাশীর্যতচিত্তাত্মা ত্যক্তসর্ব্বপরিগ্রহঃ । শারীরং কেবলং কর্ম্ম কুর্ব্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্ ॥২১॥ |
[সঃ] (তিনি) নিরাশীঃ (নিষ্কাম) যতচিত্তাত্মা (সংযত চিত্ত ও শরীর) ত্যক্তসর্ব্বপরিগ্রহঃ (এবং সর্ব্ব প্রকার পরিগ্রহ ত্যাগী) [সন্] (হইয়া) কেবলং (কেবল) শারীরং (শরীর রক্ষার্থ অসৎপ্রতিগ্রহাদি) কর্ম্ম (কর্ম্ম) কুর্ব্বন্ [অপি] (করিয়াও) কিল্বষম্ (পাপ) ন আপ্নোতি (গ্রস্ত হন না) ॥২১॥
তিনি ফলাশা ও সমস্ত পরিগ্রহ অর্থাৎ সংগ্রহচেষ্টাতিশয্য ত্যাগ করতঃ স্বীয় শরীর ও চিত্তকে বুদ্ধির অধীন রাখিয়া যদি কেবলমাত্র শরীর যাত্রা-নির্ব্বাহের জন্য অসৎ প্রতিগ্রহাদি কর্ম্ম করিয়াও থাকেন, তাহাতে তাঁহার সেই কর্ম্ম-জনিত পাপ বা পূণ্য কিছুই হয় না ॥২১॥
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টো দ্বন্দ্বাতীতো বিমৎসরঃ । সমঃ সিদ্ধাবসিদ্ধৌ চ কৃত্বাপি ন নিবধ্যতে ॥২২॥ |
যদৃচ্ছালাভসন্তুষ্টঃ (অনায়াসে প্রাপ্ত বস্তুতে সন্তষ্ট), দ্বন্দ্বাতীতঃ (শীতোষ্ণ সুখদুঃখাদি সহনশীল), বিমৎসরঃ (অন্যের প্রতি দ্বেষ শূন্য), সিদ্ধৌ অসিদ্ধৌ চ (এবং কার্য্যের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি বিষয়ে) সমঃ (হর্ষ ও বিষাদরহিত) [জনঃ] (ব্যক্তি) [কর্ম্ম] কৃত্বা অপি (কর্ম্ম করিয়াও) ন নিবধ্যতে (বদ্ধ হন না) ॥২২॥
তিনি অনায়াসে যাহা প্রাপ্ত হন, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষ ইত্যাদি দ্বন্দ্বের বশীভূত হন না, মাৎসর্য্যকে দূর করেন ; কার্য্যের সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে হর্ষ বা বিষাদযুক্ত হন না অর্থাৎ তুল্য জ্ঞান করেন । অতএব যে কর্ম্মই করুন তাহাতে নিজে বদ্ধ হন না ॥২২॥
গতসঙ্গস্য মুক্তস্য জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ । যজ্ঞায়াচরতঃ কর্ম্ম সমগ্রং প্রবিলীয়তে ॥২৩॥ |
গতসঙ্গস্য (আসক্তি রহিত), মুক্তস্য (মুক্ত), জ্ঞানাবস্থিতচেতসঃ (জ্ঞানে অবস্থিত চিত্ত), যজ্ঞায় (এবং যজ্ঞের অর্থাৎ পরমেশ্বরের প্রীত্যর্থে) কর্ম্ম আচরতঃ (কর্ম্ম আচরণকারী পুরুষের) সমগ্রং (সমুদয়) [কর্ম্ম] (কর্ম্ম) প্রবিলীয়তে (প্রকৃষ্টরূপে লয়প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ ফলজনক হয় না) ॥২৩॥
আসক্তি রহিত, মুক্ত ও জ্ঞানে অবস্থিত চিত্ত পুরুষের যজ্ঞের জন্য যে কর্ম্ম আচরিত হয়, তাঁহার আচরিত সেই সমস্ত কর্ম্ম প্রকৃষ্টরূপে লয় পাইয়া যায় । কর্ম্মমীমাংসকগণ যাহাকে ‘অপূর্ব্ব’ বলেন, নিষ্কাম-কর্ম্মযোগীর কর্ম্মসকল সেই অপূর্ব্বতা লাভ করে না ॥২৩॥
ব্রক্ষার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্ । ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা ॥২৪॥ |
অর্পণং (স্রুক্স্রুবাদি) ব্রহ্ম (ব্রহ্ম স্বরূপ) [অর্প্যমাণম্] (অর্প্যমাণ) হবিঃ (ঘৃতাদিও) ব্রহ্ম (ব্রহ্মস্বরূপ) ব্রহ্মণা (হবন কর্ত্ত্রা] (ব্রহ্মস্বরূপ হোতৃপুরুষ কর্ত্তৃক) ব্রহ্মাগ্নৌ (ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নিতে) হুতম্ (হোমও) [ব্রহ্ম] (ব্রহ্মস্বরূপ) [ভবতি] (হয়) ; [এবং বিবেকবতা] (এইরূপ বিচারযুক্ত) তেন (সেই পুরুষের) ব্রহ্মকর্ম্মসমাধিনা (ব্রহ্মাত্মক কর্ম্মে চিত্তের একাগ্রতা নিবন্ধন) ব্রহ্ম এব (ব্রহ্মই) গন্তব্যম্ (লভ্য হয়) ॥২৪॥
যজ্ঞের মূল তত্ত্ব বলিতেছেন—স্রুক্স্রুবাদি, অর্প্যমাণ ঘৃতাদি হোমীয় অগ্নি, আহুতি প্রদানকারী ব্রাহ্মণ এবং হোমক্রিয়া বা তৎফল এই সমস্তই ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া থাকে । এইরূপ বিচারযুক্ত পুরুষের ব্রহ্মাত্মক কর্ম্মে চিত্তের একাগ্রতা নিবন্ধন তিনি ব্রহ্মকেই লাভ করিয়া থাকেন ॥২৪॥
দৈবমেবাপরে যজ্ঞং যোগিনঃ পর্য্যুপাসতে । ব্রহ্মাগ্নাবপরে যজ্ঞং যজ্ঞেনৈবোপজুহ্বতি ॥২৫॥ |
অপরে (অপর) যোগিনঃ (কর্ম্মযোগিগণ) দৈবম্ যজ্ঞং এব (ইন্দ্রাদিদেবোদ্দেশ্যক যজ্ঞেরই) পর্য্যুপাসতে (উপাসনা করেন), অপরে (জ্ঞানযোগিগণ) ব্রহ্মাগ্নৌ (তৎপদার্থ পরমাত্মরূপ অগ্নিতে) যজ্ঞং (হবিঃ স্থানীয় ত্বংপদার্থ জীবাত্মাকে) যজ্ঞেন এব (প্রণবরূপ মন্ত্র দ্বারাই) উপজুহ্বতি (আহুতি প্রদান করেন) ॥২৫॥
অপর কর্ম্মযোগিগণ ইন্দ্র বরুণাদি দেবগণের পূজারূপ দৈবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন । অন্য জ্ঞানযোগিগণ তৎপদার্থ পরমাত্মরূপ অগ্নিতে হবিঃ স্থানীয় ত্বংপদার্থ জীবাত্মাকে প্রণবরূপ মন্ত্র দ্বারাই হোম করেন ॥২৫॥
শ্রোত্রাদীনীন্দ্রিয়াণ্যন্যে সংযমাগ্নিষু জুহ্বতি । শব্দাদীন্ বিষয়ানন্য ইন্দ্রিয়াগ্নিষু জুহ্বতি ॥২৬॥ |
অন্যে (নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারিগণ) সংযমাগ্নিষু (ইন্দ্রিয়সংযমরূপ অগ্নিতে অর্থাৎ সংযত মনে) শ্রোত্রাদীনি (শ্রোত্র চক্ষুরাদি) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সকলকে) জুহ্বতি (হোম করেন), অন্যে (অপর ব্রহ্মচারিগণ) ইন্দ্রিয়াগ্নিষু (ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে) শব্দাদীন্ (শব্দাদি) বিষয়ান্ (বিষয় সমূহকে) জুহ্বতি (হোম করেন) ॥২৬॥
অপর নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারিগণ মনঃ সংযমরূপ অগ্নিতে শ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয় সকলকে হোম করেন । স্বধর্ম্মপরায়ণ গৃহিসকল শব্দাদি বিষয়সমূহকে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে হোম করেন ॥২৬॥
সর্ব্বাণীন্দ্রিয়কর্ম্মাণি প্রাণকর্ম্মাণি চাপরে । আত্মসংযমযোগাগ্নৌ জুহ্বতি জ্ঞানদীপিতে ॥২৭॥ |
অপরে (শুদ্ধত্বংপদার্থবিজ্ঞগণ) জ্ঞানদীপিতে (জ্ঞানদ্বারা প্রদীপ্ত) আত্মসংযমযোগাগ্নৌ (ত্বং পদার্থের শুদ্বিরূপ অগ্নিতে) সর্ব্বাণি (সমস্ত) ইন্দ্রিয়কর্ম্মাণি (ইন্দ্রিয় ও তাহাদের কর্ম্ম শ্রবণ দর্শনাদি) প্রাণকর্ম্মাণি চ (এবং দশপ্রাণ ও তাহাদের কার্য্য) জুহ্বতি (হোম করিয়া থাকেন) ॥২৭॥
প্রত্যগাত্মার অনুসন্ধানকারী কৈবল্যবাদী পাতঞ্জলাদি যোগিসকল জ্ঞান দ্বারা ত্বংপদার্থের শুদ্ধিরূপ অগ্নিতে সমস্ত ইন্দ্রিয়গণ ও তাহাদের কর্ম্ম শ্রবণ দর্শনাদি এবং দশপ্রাণও তাহাদের কার্য্য সমুদয়ই হোম করিয়া থাকেন ॥২৭॥
দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞা যোগযজ্ঞাস্তথাপরে । স্বাধ্যায়জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ যতয়ঃ সংশিতব্রতাঃ ॥২৮॥ |
[কেচিৎ] (কেহ কেহ) দ্রব্যযজ্ঞাঃ (দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞ করেন) [কেচিৎ] (কেহ কেহ) তপোযজ্ঞাঃ (কৃচ্ছ্র চান্দ্রয়ণাদিরূপ যজ্ঞ করেন) তথা অপরে (এবং অপর কেহ কেহ) যোগযজ্ঞাঃ (অষ্টাঙ্গ যোগরূপ যজ্ঞ করেন) [কেচন] (আবার কেহ কেহ) স্বাধ্যায়-জ্ঞান-যজ্ঞাশ্চ (বা বেদপাঠ ও বেদার্থজ্ঞানরূপ যজ্ঞকারী) [এতে সর্ব্বে] (ইহারা সকলেই) যতয়ঃ (যত্নশীল) সংশিতব্রতাঃ (ও তীক্ষ্ণব্রতকারী) ॥২৮॥
কেহ কেহ দ্রব্যদানরূপ যজ্ঞশীল, কেহ কেহ কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদিরূপ যজ্ঞশীল, কেহ কেহ অষ্টাঙ্গযোগরূপ যজ্ঞশীল এবং অপর কেহ বা বেদপাঠ ও বেদার্থ জ্ঞানরূপ যজ্ঞকারী । ইহারা সকলেই যত্নশীল ও তীক্ষ্ণব্রতকারী ॥২৮॥
অপানে জুহ্বতি প্রাণং প্রাণেঽপানং তথাপরে । প্রাণাপানগতী রুদ্ধা প্রাণায়ামপরায়ণাঃ । অপরে নিয়তাহারাঃ প্রাণান্ প্রাণেষু জুহ্বতি ॥২৯॥ |
অপরে (অপর কেহ) অপানে (অধোবৃত্তি বায়ুতে) প্রাণং (উর্দ্ধবৃত্তি বায়ুকে) জুহ্বতি (পূরককালে একীভূত করেন) তথা (সেইরূপ) প্রাণে অপানং (রেচককালে অপান বায়ুকে প্রাণ বায়ুতে) জুহ্বতি (হোম করেন) ; প্রাণাপানগতী (কুম্ভককালে প্রাণ ও অপানের গতিকে) রুদ্ধা (নিরোধ পূর্ব্বক) প্রাণায়ামপরায়ণাঃ (প্রাণায়াম পরায়ণ) [ভবন্তি] (হইয়া থাকেন) । অপরে (অপর ইন্দ্রিয়-জয়কামিগণ) নিয়তাহারাঃ (আহার সংকোচ পূর্ব্বক) প্রাণেষু (প্রাণ বায়ুতে) প্রাণান্ (ইন্দ্রিয় সকলকে) জুহ্বতি (হোম করেন) ॥২৯॥
অপর কেহ কেহ অধোবৃত্তি বায়ুতে উর্দ্ধবৃত্তি-বায়ুকে পূরককালে একীভূত করেন, সেইরূপ রেচককালে অপান বায়ুকে প্রাণবায়ুতে হোম করেন ; এবং কুম্ভককালে প্রাণ ও অপানের গতি নিরোধপূর্ব্বক প্রাণায়াম পরায়ণ হইয়া থাকেন । অপর ইন্দ্রিয় জয়কামিগণ আহার সঙ্কোচ অভ্যাস করিয়া প্রাণবায়ুতে ইন্দ্রিয় সকলকে হোম করেন ॥২৯॥
সর্ব্বেঽপ্যেতে যজ্ঞবিদো যজ্ঞক্ষয়িতকল্মষাঃ । যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্ ॥৩০॥ |
এতে সর্ব্বে অপি (ইহারা সকলেই) যজ্ঞবিদঃ (যজ্ঞতত্ত্ববিৎ) যজ্ঞক্ষয়িতকল্মষাঃ (যজ্ঞের দ্বারা ক্ষীণপাপ) যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজঃ (যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত অর্থাৎ ভোগ, ঐশ্বর্য্য ও সিদ্ধি প্রভৃতি ভোগ করেন) ; সনাতনম্ (এবং জ্ঞান দ্বারা সনাতন) ব্রহ্ম (ব্রহ্মকেই) যান্তি (লাভ করেন) ॥৩০॥
ইহারা সকলেই যজ্ঞতত্ত্ববেত্তা, যজ্ঞের দ্বারা ক্ষীণ পাপ হইয়া যজ্ঞাবশিষ্ট অমৃত অর্থাৎ ভোগ, ঐশ্বর্য্য ও সিদ্ধি প্রভৃতি ভোগ করতঃ অবশেষে পূর্ব্বোক্ত সনাতন ব্রহ্মকেই লাভ করেন ॥৩০॥
নায়ং লোকোঽস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোঽন্যঃ কুরুসত্তম ॥৩১॥ |
[হে] কুরুসত্তম ! (হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) অযজ্ঞস্য (যজ্ঞরহিত ব্যক্তির) অয়ং লোকঃ [অপি] (এই অল্পসুখবিশিষ্ট মনুষ্যলোকও) ন [অস্তি] (নাই) অন্যঃ [লোকঃ] (অপর স্বর্গলোক) কুতঃ [প্রাপ্তব্যঃ] (কিরূপে প্রাপ্তি সম্ভব হইবে ? ) ॥৩১॥
হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন ! যজ্ঞানুষ্ঠানবিহীন ব্যক্তির পক্ষে ইহলোক প্রাপ্তিই সম্ভব হয় না, তখন ইহাদের পরলোক প্রাপ্তি কিরূপে সম্ভব হইবে ? ॥৩১॥
এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্রহ্মণো মুখে । কর্ম্মজান্ বিদ্ধি তান্ সর্ব্বানেবং জ্ঞাত্বা বিমোক্ষ্যসে ॥৩২॥ |
ব্রহ্মণঃ মুখে (বেদরূপ মুখে) এবং (এই প্রকার) বহুবিধাঃ (বহুবিধ) যজ্ঞাঃ (যজ্ঞ) বিততাঃ (স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে), [ত্বং] (তুমি) তান্ সর্ব্বান্ (সেই সকল যজ্ঞকেই) কর্ম্মজান্ (বাক্য-মন-কায় কর্ম্মজনিত বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে), এবং (এইরূপ) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) বিমোক্ষ্যসে (কর্ম্ম-বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করিবে) ॥৩২॥
এই সমস্ত প্রকার যজ্ঞই বেদোক্ত বা বেদানুগত শাস্ত্রোক্ত ; ইহারা সকলেই বাক্য-মন-কায়-কর্ম্ম-জনিত, অতএব কর্ম্মজ । এইরূপে কর্ম্মতত্ত্ব বিচার করিতে পারিলে কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবে ॥৩২॥
শ্রেয়ান্ দ্রব্যময়াদ্যজ্ঞাজ্ জ্ঞানযজ্ঞঃ পরন্তপ । সর্ব্বং কর্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে ॥৩৩॥ |
[হে] পরন্তপ পার্থ ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) [তেষু অপি] (সেই যজ্ঞগুলির মধ্যেও) দ্রব্যময়াৎ (ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ ইত্যাদিরূপ দ্রব্যময়) যজ্ঞাৎ (যজ্ঞ হইতে) জ্ঞানযজ্ঞঃ (ব্রহ্মাগ্নাবপরে ইত্যাদি শ্লোকোক্ত জ্ঞানযজ্ঞ) শ্রেয়ান্ (শ্রেষ্ঠ) । [যতঃ] (যেহেতু) জ্ঞানে [সতি] (জ্ঞানের উদয় হইলে) সর্ব্বং কর্ম্ম (সমুদয় কর্ম্ম) অখিলং [সৎ] (অব্যর্থ হইয়া) পরিসমাপ্যতে (সমাপ্ত হয় অর্থাৎ জ্ঞানের অনন্তর কর্ম্ম থাকে না) ॥৩৩॥
হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন ! সেই সমস্ত যজ্ঞগুলির মধ্যেও ‘ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবিঃ’ ইত্যাদিরূপ দ্রব্যময় যজ্ঞ হইতে ‘ব্রহ্মাগ্নাবপরে’ ইত্যাদি শ্লোকোক্ত জ্ঞানযজ্ঞ অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ । যেহেতু সমস্ত কর্ম্মই জ্ঞানে পরিসমাপ্তি লাভ করে ॥৩৩॥
তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া । উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ ॥৩৪॥ |
প্রণিপাতেন (তত্ত্বদর্শী গুরুকে দণ্ডবৎ নমস্কার), পরিপ্রশ্নেন (সঙ্গত প্রশ্ন), সেবয়া (ও অকপট পরিচর্য্যা দ্বারা) তৎ (পূর্ব্বোক্ত সেই জ্ঞানের কথা) বিদ্ধি (জানিতে হইবে) ; জ্ঞানিনঃ (শাস্ত্রজ্ঞানী) তত্ত্বদর্শিনঃ (পরব্রহ্ম বিষয়ে অপরোক্ষানুভূতি সম্পন্ন মহাত্মগণ) তে (তোমাকে) জ্ঞানং (জ্ঞান) উপদেক্ষ্যন্তি (উপদেশ করিবেন) ॥৩৪॥
তুমি তত্ত্বদর্শী গুরুকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত, সঙ্গত প্রশ্ন ও অকৃত্রিম সেবা করতঃ সন্তুষ্ট করিয়া পূর্ব্বোক্ত সেই জ্ঞানের কথা জানিতে পারিবে । শাস্ত্রজ্ঞানে সুনিপুণ ও পরব্রহ্ম বিষয়ে সাক্ষাৎ অনুভূতি সম্পন্ন মহাপুরুষগণ তোমাকে তত্ত্বজ্ঞান উপদেশ করিবেন ॥৩৪॥
যজ্জ্ঞাত্বা ন পুনর্মোহমেবং যাস্যসি পাণ্ডব । যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি ॥৩৫॥ |
[হে] পাণ্ডব ! (হে পাণ্ডব !) যৎ [জ্ঞানং] (আত্মা দেহাদি হইতে ভিন্ন এইরূপ যে জ্ঞান) জ্ঞাত্বা (লাভ করিয়া) পুনঃ (পুনরায়) এবং (এইরূপ) মোহম্ (মোহ) ন যাস্যসি (প্রাপ্ত হইবে না), যেন [মোহবিগমেন] (নিত্যসিদ্ধ আত্মজ্ঞান লাভে মোহ নষ্ট হইলে) অশেষাণি ভূতানি (মনুষ্য তির্য্যক্ প্রভৃতি ভূত সমুদয়) আত্মনি (জীবাত্মায়) [উপাধিত্বেন] (উপাধিরূপে অবস্থিত) [পৃথক্] দ্রক্ষ্যসি (পৃথক্ দর্শন করিবে), অথো (অনন্তর) ময়ি (আমাতে) [কার্য্যত্বেন স্থিতানি] (কার্য্যরূপে অবস্থিত) [দ্রক্ষ্যসি] (দর্শন করিবে) ॥৩৫॥
হে পাণ্ডব ! গুরূপদিষ্ট সেই তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিলে আর তোমাকে এরূপ মোহ আশ্রয় করিবে না । সেই তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা তুমি জানিতে পারিবে যে, মনুষ্য তির্য্যগাদি ভূতসকল এক জীবাত্মারূপ তত্ত্বে অবস্থিত ; উপাধি দ্বারা তাহাদের জড়ীয় তারতম্য ঘটিয়াছে এবং এ সমুদয়ই পরম কারণরূপ আমাতে কার্য্যরূপে অবস্থিতি করে ॥৩৫॥
অপি চেদসি পাপেভ্যঃ সর্ব্বেভ্যঃ পাপকৃত্তমঃ । সর্ব্বং জ্ঞানপ্লবেনৈব বৃজিনং সন্তরিষ্যসি ॥৩৬॥ |
চেৎ (যদি) সর্ব্বেভ্যঃ অপি পাপেভ্যঃ (সমস্ত পাপী হইতেও পাপকৃত্তমঃ (অধিক পাপিষ্ঠ) অসি (হও), [তথাপি] সর্ব্বং (সমস্ত) বৃজিনং (পাপ ও দুঃখ) জ্ঞানপ্লবেন এব (জ্ঞানরূপ ভেলা দ্বারা) সন্তরিষ্যসি (সমুত্তীর্ণ হইবে) ॥৩৬॥
যদিও তুমি অত্যন্ত পাপ আচরণ করিয়া থাক, তাহা হইলেও জ্ঞানপোতে আরোহণ পূর্ব্বক সমস্ত দুঃখ সমুদ্র পার হইয়া যাইবে ॥৩৬॥
যথৈধাংসি সমিদ্ধোঽগ্নির্ভস্মসাৎ কুরুতেঽর্জ্জুন । জ্ঞানাগ্নিঃ সর্ব্বকর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা ॥৩৭॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) যথা (যেরূপ) সমিদ্ধঃ (সম্যক্রূপে প্রজ্জ্বলিত) অগ্নিঃ (অগ্নি) এধাংসি (কাষ্ঠ সমূহকে) ভস্মসাৎ (ভস্মসাৎ) কুরুতে (করে), তথা (সেইরূপ) জ্ঞানাগ্নিঃ (জ্ঞানরূপ অগ্নি) সর্ব্বকর্ম্মাণি (বর্ত্তমান দেহারম্ভক প্রারব্ধ ভিন্ন সমুদয় কর্ম্মকে) ভস্মসাৎ (ভস্মসাৎ) কুরুতে (করে) ॥৩৭॥
প্রবলরূপে জ্বলিত অগ্নি যেমত কাষ্ঠাদিকে ভস্মসাৎ করে, হে অর্জ্জুন ! জ্ঞানাগ্নিও সেইরূপ সমস্ত কর্ম্মকে দগ্ধ করিয়া থাকে ॥৩৭॥
ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে । তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি ॥৩৮॥ |
ইহ (তপস্যাদির মধ্যে) জ্ঞানেন সদৃশং (জ্ঞানের তুল্য) পবিত্রম্ (পবিত্র) [কিমপি] ন হি বিদ্যতে (আর কিছুই নাই) তৎ (সেই জ্ঞান) যোগসংসিদ্ধঃ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগে সমাক্ সিদ্ধ ব্যক্তি) কালেন (বহুকাল পরে) আত্মনি (আত্মাতে) স্বয়ং (স্বয়ং প্রাপ্তরূপে) বিন্দতি (লাভ করেন) ॥৩৮॥
পূর্ব্বোক্ত তপস্যাদির মধ্যে জ্ঞানের সমান পবিত্র পদার্থ আর কিছুই নাই । নিষ্কাম কর্ম্মযোগের সাধনায় সুসিদ্ধ মানব দীর্ঘকাল পরে সেই জ্ঞান স্বীয় আত্মাতে স্বয়ং প্রাপ্তরূপে লাভ করিয়া থাকেন ॥৩৮॥
শ্রদ্ধাবান্ লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ । জ্ঞানং লব্ধ্বা পরাং শান্তিমচিরেণাধিগচ্ছতি ॥৩৯॥ |
শ্রদ্ধাবান্ (নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধি হইলেই জ্ঞান হয়, এই শাস্ত্রীয় অর্থে আস্তিক্য বুদ্ধিমান্), তৎপরঃ (নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠানরত) সংযতেন্দ্রিয়ঃ (এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি) জ্ঞানং (জ্ঞান) লভতে (লাভ করেন) । জ্ঞানং (জ্ঞান) লব্ধ্বা (লাভ করিয়া) অচিরেণ (অতিশ্রীঘ্র) পরাং শান্তিম্ (সংসার ক্ষয়রূপ পরাশান্তি) অধিগচ্ছতি (লাভ করেন) ॥৩৯॥
নিষ্কাম কর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা অন্তঃকরণ শুদ্ধ হইলে পর জ্ঞান হয় । এই শাস্ত্র তাৎপর্য্যে আস্তিক্য বুদ্ধিমান্, শ্রদ্ধা-সহকারে নিষ্কাম-কর্ম্মযোগ অনুষ্ঠানরত এবং জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিই সেই জ্ঞান লাভ করেন । তিনি এই জ্ঞান লাভ করিয়া শ্রীঘ্রই সংসারক্ষয়রূপ পরাশান্তি লাভ করিয়া থাকেন ॥৩৯॥
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি । নায়ং লোকোঽস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ ॥৪০॥ |
অজ্ঞঃ (পশ্বাদিবৎমূঢ়) অশ্রদ্দধানঃ (শ্রাস্ত্রজ্ঞান থাকিলেও নানামতবাদদৃষ্টে অবিশ্বস্ত) সংশয়াত্মা চ (এবং শ্রদ্ধা থাকিলেও আমার এই বিষয় সিদ্ধি হইবে কিনা এইরূপ সন্দেহাকুলচিত্ত ব্যক্তি) বিনশ্যতি (বিনষ্ট হয় অর্থাৎ কল্যাণ হইতে বিচ্যুত হয়) । সংশয়াত্মনঃ (সংশয়িতচিত্ত মানবের) অয়ং লোকঃ (এই মনুষ্যলোক) ন [অস্তি] (নাই) ন চ পরঃ (পরলোকও নাই) ন চ সুখং অস্তি (বৈষয়িক সুখও নাই) ॥৪০॥
শাস্ত্রজ্ঞানহীন পশ্বাদির মত মূঢ়, শাস্ত্রজ্ঞান থাকিলেও নানা মতবাদ দেখিয়া শাস্ত্রার্থে বিশ্বাসশূন্য, এবং শ্রদ্ধা থাকিলেও ‘আমার এই বিষয় সিদ্ধ হইবে কিনা’ এইরূপ সন্দেহাক্রান্ত মতি মানব কখনও মঙ্গললাভ করিতে পারে না । সংশয়াত্মার ইহলোকে বা পরলোকে কোথাও সুখ লাভ হয় না, কারণ সংশয়রূপ দুঃখই তাহার শান্তি নাশ করে ॥৪০॥
যোগসংন্যস্তকর্ম্মাণং জ্ঞানসংছিন্নসংশয়ম্ । আত্মবন্তং ন কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় ॥৪১॥ |
[হে] ধনঞ্জয় ! (হে ধনঞ্জয় !) যোগসংন্যস্তকর্ম্মাণং (নিষ্কাম কর্ম্মযোগের অনন্তরই যিনি সন্ন্যাস বিধিতে কর্ম্মত্যাগ করিয়াছেন), জ্ঞানসংছিন্ন-সংশয়ম্ (তদনন্তর জ্ঞানাভ্যাস দ্বারা সংশয় নাশ করিয়াছেন) আত্মবন্তং (এবং আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন) কর্ম্মাণি (কর্ম্মসমূহ) [তম্] (তাঁহাকে) ন নিবধ্নন্তি (বদ্ধ করিতে পারে না) ॥৪১॥
হে ধনঞ্জয় ! যিনি নিষ্কাম কর্ম্মযোগের দ্বারা কর্ম্ম সন্ন্যাস করেন, তারপর জ্ঞানাভ্যাস দ্বারা সংশয় সমূহ নাশ করেন এবং আত্মার চিন্ময়স্বরূপ অবগত হন, তাঁহাকে কোন কর্ম্মই আবদ্ধ করিতে পারে না ॥৪১॥
তস্মাদজ্ঞানসম্ভূতং হৃৎস্থং জ্ঞানাসিনাত্মনঃ । ছিত্ত্বৈনং সংশয়ং যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত ॥৪২॥ |
[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (অতএব) আত্মনঃ (তোমার) অজ্ঞানসম্ভূতং (অজ্ঞান হইতে উদ্ভূত) হৃৎস্থং (হৃদয়স্থিত) এনং (এই) সংশয়ং (সংশয়কে) জ্ঞানাসিনা (জ্ঞানরূপ খড়্গ দ্বারা) ছিত্ত্বা (ছেদন করিয়া) যোগম্ (নিষ্কাম কর্ম্মযোগ) আতিষ্ঠ (আশ্রয় কর) উত্তিষ্ঠ [চ] (এবং [যুদ্ধার্থ] উত্থিত হও) ॥৪২॥
হে ভারত ! অতএব তোমার অজ্ঞান সম্ভূত হৃদয়স্থিত এই সংশয়কে জ্ঞানখড়্গ দ্বারা ছেদন কর, এবং নিষ্কাম কর্ম্মযোগ আশ্রয় পূর্ব্বক (যুদ্ধার্থ) উত্থিত হও ॥৪২॥
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে জ্ঞানযোগো নাম চতুর্থোঽধ্যায়ঃ ॥৪॥ |
ইতি চতুর্থ অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥
গ্রন্থ-সম্পাদক—
ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল
১) বিবস্বান (সূর্য) হইতেই সূর্যবংশের উৎপত্তি । বিবস্বানের পুত্র মনু, মনুর পুত্র ইক্ষ্বাকু । এই বৈবস্বত মনু হইতে ৫৮তম অধস্তন পুরুষ শ্রীরামচন্দ্র ।
এই শ্লোকে যে যোগধর্মের কথা উল্লেখ করা হইল, ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্বে কথিত নারায়ণীয় ধর্ম বা সাত্বত ধর্ম । কল্পে কল্পে এই ধর্ম কিরূপে আবির্ভূত হইয়া প্রচারিত হইয়াছে তথাত তাহার বিস্তারিত পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে । এ-স্থলে মাত্র ব্রহ্মার সপ্তম জন্মে অর্থাৎ বর্তমান কল্পে ত্রেতাযুগের প্রথমে এই ধর্ম কিরূপে প্রচারিত হইয়াছিল, সেই পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে ।
২) রাজর্ষি = রাজা হইয়াও যিনি ঋষি, যেমন জনকাদি । সুতরাং যাঁহারা জ্ঞানী ও কর্মী, ইহা তাঁহাদেরই অধিগম্য ।
৬) মায়া = পরমেশ্বরের অপূর্ব সৃষ্টি-কৌশল, যোগমায়া, যোগ । শঙ্কর মতে অবস্তু বা ভ্রমাত্মক কোনো কিছু (illusion) ।
পরমেশ্বরের নিজের অব্যক্ত স্বরূপ হইতে সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিবার অচিন্ত্য শক্তিকেই গীতাতে ‘মায়া’ বলা হইয়াছে [তিলক] ।
অবতারতত্ত্ব :
সর্বভূতেশ্বর জন্মমৃত্যু-রহিত, প্রাণিগণের যেরূপ জন্মমৃত্যু হয়, তাঁহার সেরূপে আবির্ভাব হয় না । তিনি তাঁহার ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া মায়াবলে আবির্ভূত হন অর্থাৎ মায়া-শরীর ধারণ করেন [শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য] । কিন্তু ভক্তিপন্থী শ্রীধরস্বামী প্রভৃতি বলেন – উহাই তাঁহার নিত্যসিদ্ধ-চিদ্রূপ, উহা জড়রূপ নহে ।
মহাভারতে নারায়ণীয়-পর্বাধ্যায়ে যে দশ অবতারের উল্লেখ আছে তাহাতে বুদ্ধ অবতার নাই, প্রথমে হংস (swan) অবতার । পরবর্তী পুরাণসমূহে বুদ্ধ-অবতার লইয়াই দশ অবতারের গণনা হইয়াছে । ভাগবতে দ্বাবিংশ অবতারের উল্লেখ আছে, এবং এই প্রসিদ্ধ শ্লোকাংশ আছে – ‘শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান পরব্রহ্ম; সমস্ত অবতার তাঁহারই অংশ ও কলা’ । বিশদ
বেদান্তমতে ঈশ্বর কেবল এক নন, তিনি অদ্বিতীয়, একমেবদ্বিতীয়ম্, তিনিই সমস্ত, তিনি ছাড়া আর-কিছু নাই, সকলই তাঁহার সত্তায় সত্তাবান, সকলই তাঁহার মধ্যেই আছে, তিনি সকলের মধ্যেই আছেন । সুতরাং অজ আত্মার দেহ-সম্পর্ক গ্রহণ করা অসম্ভব তো নহেই, বরং সেই সম্পর্কেই জগতের অস্তিত্ব । কাজেই হিন্দুর পক্ষে অবতার-বাদ কেবল ভক্তি-বিশ্বাসের বিষয়মাত্র নহে, উহা বেদান্তের দৃঢ় ভিত্তির উপরেই প্রতিষ্ঠিত ।
৮) যুগে যুগে – তত্ত্বদবসরে, তত্তৎ সময়ে (শ্রীধর, বলদেব) যখনই ধর্মের গ্লানি হয়, তখনই অবতার; এক যুগে একাধিক অবতারও হয় ।
১১) গীতার এই শ্লোকটির তাৎপর্য বুঝিলে প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত-পার্থক্য থাকে না, হিন্দুর হৃদয়ে ধর্মবিদ্বেষ থাকিতে পারে না । হিন্দুর নিকট কৃষ্ণ, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ সকলেই এক ।
‘ইহাই প্রকৃত হিন্দুধর্ম । হিন্দুধর্মের তুল্য উদার ধর্ম আর নাই – আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্য আর নাই ।’ [বঙ্কিমচন্দ্র]
১৩) অব্যয় – অবিকারী (নীলকন্ঠ) । তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, ‘নির্গুণো-গুণী’ । নির্গুণ বিভাবে তিনি নির্বিশেষ নিষ্ক্রিয়; সগুণবিভাবে তিনি সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্তা । তাই তিনি কর্তা হইয়াও অকর্তা, ক্রিয়াশীল হইয়াও অবিকারী । কেহ সকামভাবে রাজসিক বা তামসিক পূজার্চনা করে, কেহ নিষ্কাম ভাবে উপাসনা করে । এরূপ কর্ম-বৈচিত্র্য কেন? তুমিই ত এসব ঘটাও ? – না, প্রকৃতিভেদবশতঃ এইরূপ হয় । প্রকৃতিভেদ অনুসারে বর্ণভেদ বা কর্মভেদ আমি করিয়াছি – কিন্তু আমি উহার কর্তা হইলেও উহাতে লিপ্ত হই না বলিয়া আমি অকর্তা । জীবেরও এই তত্ত্ব জানিয়া নিষ্কামভাবে স্বধর্ম পালন করা উচিত । মুমুক্ষু ব্যক্তিগণ পূর্বে এই ভাবেই কর্ম করিযাছেন ।
চাতুর্বর্ণের উৎপত্তি
১৪) শ্রীভগবান্ আদর্শ কর্মযোগী, তাঁহার নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা বুঝিতে পারিলে মনুষ্য নিষ্কাম কর্মের মর্ম বুঝিতে পারে, তাহার কর্ম নিষ্কাম হয় । সুতরাং কর্ম করিয়াও সে কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় ।
১৬) কর্ম – বিহিত কর্ম; বিকর্ম – অবিহিত কর্ম; অকর্ম – কর্মশূন্যতা; কর্মত্যাগ, কিছু না করিয়া তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন ।
১৮) কর্মতত্ত্বঃ, বিকর্মতত্ত্ব, অকর্মতত্ত্ব :
কর্মতত্ত্বঃ : যিনি কর্মে অকর্ম দর্শন করেন অর্থাৎ যিনি কর্ম করিয়াও মনে করেন যে দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম করিতেছে, আমি কিছুই করি না, তিনিই বুদ্ধিমান্, কেন না কর্ম করিয়াও তিনি কর্মের ফলভোগী হন না । অর্থাৎ যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন, তাঁহার কর্মও অকর্মস্বরূপ ।
বিকর্মতত্ত্বঃ : কর্ম করিয়াও তাহার ফলভোগী হন না সুতরাং নির্লিপ্ত অনহঙ্কারী কর্মযোগীর পক্ষে বিকর্মও অকর্মস্বরূপ ।
অকর্মতত্ত্বঃ : আর যিনি অকর্মে কর্ম দর্শন করেন, তিনিই বুদ্ধিমান্ । অনেকে আলস্যহেতু, দুঃখবুদ্ধিতে কর্তব্যকর্ম ত্যাগ করেন, কিন্তু তাহারা জানেন না এ অবস্থায় প্রকৃতির ক্রিয়া চলিতে থাকে, কর্মবন্ধ হয় না । এই যে কর্মত্যাগ বা অকর্ম ইহা প্রকৃতপক্ষে কর্ম, কেননা ইহা বন্ধনের কারণ । আবার ইহারা কর্ম ত্যাগ করিয়া মনে করেন, আমি কর্ম করি না, আমি বন্ধনমুক্ত । কিন্তু “আমি কর্ম করি” ইহা যেমন অভিমান, “আমি কর্ম করি না” ইহাও সেইরূপ অভিমান, সুতরাং বন্ধনের কারণ । ইহারা বুঝেন না যে কর্ম করে প্রকৃত, ‘আমি’ নহে । বস্তুতঃ ‘আমি’ ত্যাগ না হইলে কেবল কর্মত্যাগে বন্ধন-মুক্ত হওয়া যায় না । সুতরাং এইরূপ অকর্ম বা কর্মত্যাগও বন্ধনহেতু বলিয়া প্রকৃতপক্ষে কর্মই ।
১৯) নিষ্কাম কর্ম দিব্য কর্ম, ভাগবৎ কর্ম ! ‘আমি করিতেছি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান যাঁহার নাই, তিনি কর্ম করিয়াও তাহার ফলভাগী হন না । অহং-বুদ্ধিত্যাগই প্রকৃত জ্ঞান । এই জ্ঞানরূপ অগ্নিদ্বারা তাঁহার কর্মের ফল দগ্ধ হইয়াছে, তাঁহার কর্মের ফলভাগিত্ব বিনষ্ট হইয়াছে । এইরূপ ব্যক্তিই কর্মে অকর্ম অর্থাৎ কর্মশূন্যতা দেখেন ।
২৩) যজ্ঞতত্ত্ব :
বৈদিক যজ্ঞাদি লইয়াই হিন্দুধর্মের আরম্ভ । যজ্ঞমাত্রেরই মূল তাৎপর্য হইতেছে ত্যাগ এবং ত্যাগের ফলস্বরূপ ভোগ – দিব্যভোগ (‘অমৃতমশ্নুতে’) । নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ প্রভৃতি স্মার্ত-যজ্ঞগুলি সকলই ত্যাগমূলক । প্রাচীনকালে যজ্ঞই ঈশ্বর-আরাধনার প্রধান অঙ্গ ছিল । কালক্রমে এই সকল যজ্ঞবিধি অতি জটিল ও বিস্তৃত হইয়া পড়ে ।
বেদের ব্রাহ্মণভাগে বিবিধ যাগযজ্ঞাদির বিস্তৃত বিবরণ আছে । বৈদিক ক্রিয়াকর্ম ও বৈদিক মন্ত্রের দুইটি অঙ্গ ছিল – (i)বাহ্য, আনুষ্ঠানিক; (ii)আভ্যন্তরীণ, আধ্যাত্মিক । বাহ্য অনুষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে কোনো আধ্যাত্মিক গূঢ়-তত্ত্বেরই রূপক বা প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হইত । যেমন সোমরস = অমৃত/অমরত্ব/ভূমানন্দের প্রতীক; ধান = ধনের প্রতীক; দূর্বা = দীর্ঘায়ুর প্রতীক । দূর্বার মৃত্যু নাই, রৌদ্রে পুড়িয়া, বর্ষায় পচিয়া গেলেও আবার গজাইয়া উঠে । উহার আর এক নাম ‘অমর’ । সুতরাং ধান-দূর্বা মস্তকে দেওয়ার অর্থ – ধনেশ্বর হও, চিরায়ু লাভ কর । বস্তুত, হিন্দুদিগের পূজার্চনা, আচার-অনুষ্ঠান সমস্তই রূপক বা প্রতীক-তান্ত্রিক (symbolic) ।
ক্রমে ব্রহ্মবিদ্যা বা জ্ঞানমার্গের প্রভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি গৌণ বলিয়া বিবেচিত হইতে লাগিল এবং জ্ঞানযজ্ঞ/ব্রহ্মযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ বলে নির্ধারিত হইল । তাহার পর ভাগবত-ধর্ম ও ভক্রিমার্গের প্রচার হইলে পুরাণাদি-শাস্ত্রে জপযজ্ঞ/নামযজ্ঞেরই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে । শ্রীগীতায়ও ভগবান দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞেরই শ্রেষ্ঠতা দিয়াছেন । বস্তুত ভারতীয় ধর্মচিন্তার ক্রমবিকাশ ও সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে যজ্ঞশব্দের অর্থ ও তাৎপর্য সম্প্রসারিত হইয়াছে । গীতায় এই সম্প্রসারণের সকল স্তরই স্বীকার করা হইয়াছে এবং যজ্ঞের যে মূলতত্ত্ব ত্যাগ, ঈশ্বরার্পণ, নিষ্কামতা তাহা যুক্ত করিয়া সবগুলিই মোক্ষপ্রদ করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।
২৪) যিনি কর্মে ও কর্মের অঙ্গসকলে ব্রহ্মই দেখেন, তিনি ব্রহ্মত্বই প্রাপ্ত হন – ‘ব্রহ্মবিদ ব্রহ্মৈব ভবতি’ ।
জ্ঞানীর কর্ম ব্রহ্মকর্ম :
যিনি যজ্ঞ করিতে বসিয়া স্রুবাদি (হবিঃ-অর্পণ করিবার জন্য হাতা) কিছু দেখিতে পান না, সর্বত্রই ব্রহ্ম দর্শন করেন, ব্রহ্ম ব্যতীত আর-কিছু ভাবনা করিতে পারেন না, ব্রহ্মে একাগ্রচিত্ত সেই যোগী পুরুষ ব্রহ্মই প্রাপ্ত হন । এই স্থলে ‘যজ্ঞ’-শব্দ রূপার্থক; বস্তুত জ্ঞানীর কর্মকেই এখানে যজ্ঞরূপে কল্পনা করা হইয়াছে । ইহাই কর্মযোগের শেষ কথা, এই অবস্থায় কর্ম জ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয় । এই জন্যই বলা হইয়াছে, ‘সাংখ্যগণ যে স্থান লাভ করেন, কর্মযোগীও তাহাই প্রাপ্ত হন’ [৫|৫] । যাঁহারা ‘সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগকে পৃথক বলেন তাঁহারা অজ্ঞ’ [৫|৪] । ‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম’ (এ-সমস্তই ব্রহ্ম), ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ (আমি ব্রহ্ম), ইত্যাদি শ্রুতিবাক্য এই জ্ঞানই প্রচার করিয়াছেন । জীবের অহংবুদ্ধি যখন সম্পূর্ণ বিদূরিত হয়, তখনই এই পূর্ণ একত্বের জ্ঞান আবির্ভূত হয় । তখন জ্ঞাতা-জ্ঞেয়, উপাস্য-উপাসক, কর্তা-কর্ম-করণ এইসকল ভেদবুদ্ধি থাকে না; সর্বত্রই এক তত্ত্ব, এক শক্তিই আবির্ভূত হয় । এইরূপ জ্ঞানে যিনি কর্ম করিতে পারেন, জীবনযাপন করিতে পারেন, তাঁহার কর্ম-বন্ধন কি ? তিনি তো মুক্ত পুরুষ ।
কর্ম, ভক্তি, জ্ঞান – এই তিন মার্গেরই শেষ ফল অদ্বয় তত্ত্বোপলব্ধি, পার্থক্য প্রারম্ভে ও সাধনাবস্থায় ।
কর্মীর আরম্ভ লোকরক্ষার্থ বা ঈশ্বরপ্রীত্যর্থ নিষ্কাম কর্মে;
ভক্তের আরম্ভ নিষ্কাম উপাসনায়;
জ্ঞানমার্গী সাধকগণ প্রারম্ভ হইতেই অদ্বৈতভাবে চিন্তা করেন ।
বিশিষ্ট চিন্তা :
প্রকৃত পক্ষে জ্ঞানমার্গী সাধকগণদের কোনো উপাসনা নাই, কেননা সকলই যখন ব্রহ্ম, তখন কে কাহার উপাসনা করিবে ? কেবল ব্রহ্মচিন্তাই তাঁহাদের উপাসনা, তাই এই উপাসনার নাম ‘বিশিষ্ট চিন্তা’ । ইহা ত্রিবিধ –
অঙ্গাববিদ্ধ উপাসনা = যজ্ঞের অঙ্গবিশেষকে ব্রহ্ম ভাবনা করা ।
প্রতীক উপাসনা = যাহা ব্রহ্ম নয়, তাহাকে ব্রহ্ম-ভাবনা, যেমন মনকে ব্রহ্ম ভাবিয়া উপাসনা করা ।
অহংগ্রহ = আত্মা ব্রহ্ম হইতে অভিন্ন, আমিই ব্রহ্ম (‘অহং ব্রহ্মাস্মি’) – এইরূপ ভাব-সাধনা ।
২৫-২৭) ‘যজ্ঞ’ শব্দ রূপকার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । যজ্ঞের লাক্ষণিক অর্থ গ্রহণ করিয়া বিভিন্ন সাধন-প্রণালী বর্ণিত হইয়াছে :-
দৈবযজ্ঞ : ইন্দ্র-বরুণাদি দেবতার উদ্দেশে
ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞ বা জ্ঞানযজ্ঞ : ব্রহ্মাগ্নিতে জীবাত্মার আহুতি
সংযমযজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে রূপরসাদি-বিষয় হইতে প্রত্যাহার
ইন্দ্রিয়যজ্ঞ : ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে শব্দাদি-বিষয়সমূহের আহূতি (নির্লিপ্ত সংসারী)
আত্মসংযম বা সমাধি-যজ্ঞ : আত্মাতে চিত্তকে একাগ্র করা (ধ্যানযোগিগণ)
প্রাণকর্মাণি – প্রাণ, অপান, ব্যান, উদান, সমান – মনুষ্য শরীরে এই পঞ্চপ্রাণ আছে :-
প্রাণবায়ুর কর্ম : বহির্নয়ন
অপান বায়ু্র কর্ম : অধোনয়ন
ব্যান বায়ু্র কর্ম : আকুঞ্চন ও প্রসারণ
উদান বায়ু্র কর্ম : ঊর্দ্ধনয়ন
সমান বায়ুর কর্ম : ভুক্তপদার্থের পরিপাক-করণ
২৮) এই শ্লোকে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের কথা বলা হইল :-
দ্রব্যযজ্ঞ : দ্রব্যত্যাগরূপ যজ্ঞ । পূর্বের দৈবযজ্ঞ ও ব্রহ্মার্পণ যজ্ঞও দ্রব্যযজ্ঞ । উহা শ্রৌত কর্ম, আর বাপী-কূপাদি খনন, দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্নসত্র দান ইত্যাদি স্মার্ত-কর্ম । এ-সকল এবং পুষ্পপত্র-নৈবেদ্যাদি দ্বারা পূজার্চনা সমস্তই দ্রব্যযজ্ঞ ।
তপোযজ্ঞ : কৃচ্ছ্র-চান্দ্রায়ণাদি উপবাস ব্রত
যোগযজ্ঞ : অষ্টাঙ্গ যোগ বা রাজযোগ – যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি ।
স্বাধ্যায়-যজ্ঞ : ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক যথাবিধি বেদাভ্যাস
বেদজ্ঞান-যজ্ঞ : যুক্তিদ্বারা বেদার্থ নিশ্চয় করা
২৯) প্রাণবায়ু = হৃদয় হইতে যে বায়ু বাহিরে আসে; অপান বায়ু = বাহির হইতে যে বায়ু হৃদয়ে প্রবেশ করে ।
প্রাণায়াম : প্রাণ = প্রাণবায়ু, আয়াম = নিরোধ; অর্থাৎ প্রাণবায়ুর নিরোধ । ইহা তিন প্রকার – (i)পূরক, (ii)রেচক, (iii)কুম্ভক ।
পূরক প্রাণায়াম : প্রশ্বাস দ্বারা অপান বায়ুকে শরীর-ভিতরে প্রবেশ করাইলে প্রাণবায়ুর গতি রোধ হয়, ইহাই অপানে প্রাণের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুতে পূর্ণ হয় ।
রেচক প্রাণায়াম : নিঃশ্বাস দ্বারা প্রাণবায়ুকে শরীর থেকে নিঃসারণ করিলে অপান বায়ুর অন্তঃপ্রবেশরূপ গতিরোধ হয়, অর্থাৎ বাহিরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করিতে পারে না, ইহাই প্রাণে অপানের আহুতি; ইহাতে অন্তর বায়ুশূন্য হয় ।
কুম্ভক প্রাণায়াম : প্রাণ ও অপানের গতি রোধ করিয়া অর্থাৎ রেচন-পূরণ পরিত্যাগ-পূর্বক বায়ুকে শরীরের মধ্যে নিরুদ্ধ করিয়া অবস্থিতি করেন । এইরূপ কুম্ভকে শরীর স্থির হইলে ইন্দ্রিয়সমূহ প্রাণবায়ুতে লয় হইয়া যায়, ইহাই প্রাণে ইন্দ্রিয়সমূহের আহুতি ।
৩০) একথার তাৎপর্য এই যে, যজ্ঞই সংসারের নিয়ম । প্রত্যেকের কর্তব্য সম্পাদন দ্বারা, পরস্পরের ত্যাগ স্বীকার দ্বারা, আদান-প্রদান দ্বারাই জগৎ চলিতেছে এবং উহাতেই প্রত্যেকের সুখ-স্বাতন্ত্র্য অব্যাহত আছে । যে এই বিশ্ব-যজ্ঞ ব্যাপারে যোগদান করে না, যজ্ঞস্বরূপে স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে না, তাহার ইহকাল ও পরকাল উভয়ই বিনষ্ট হয়, তাহার জীবন ব্যর্থ হয় ।
৩১) যজ্ঞাবশিষ্ট দ্রব্যকে অমৃত বলে । এ-স্থলে ইহা রূপকার্থক । যজ্ঞস্বরূপ কৃত নিষ্কাম কর্মদ্বারাই মোক্ষ লাভ হয় ।
৩৪) পরিপ্রশ্নেন – আমি কে ? আমার সংসার-বন্ধন কেন ? কিরূপে বন্ধনমুক্ত হইব ? ইত্যাদি প্রশ্ন দ্বারা ।
৩৭) ‘ইহা দ্বারা মোটেই বুঝায় না যে, যখন জ্ঞান সম্পূর্ণ হয় তখন কর্ম বন্ধ হইয়া যায়’ – [শ্রী অরবিন্দ]
পারমার্থিক জ্ঞান কি ? যাহা দ্বারা সর্বভূত এবং স্বীয় আত্মা অভিন্ন বোধ হয় এবং তারপর বোধ হয় সেই আত্মা শ্রীভগবানেরই সত্ত্বা, – আমি, সর্বভূত, যাহা কিছু তাঁহার সত্তায়ই সত্তাবান, তাঁহারই আত্ম-অভিব্যক্তি, তিনিই সকলের মূল [গী|৪|৩৫] ।
প্রাকৃত/লৌকিক জ্ঞান কি ? চক্ষু-কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা, বুদ্ধিবিচার দ্বারা নানা বিষয়ে আমরা যে জ্ঞানলাভ করি । ইহাতে শ্রদ্ধার প্রয়োজন হয় না । এই সকল নিম্নস্তরের সত্যের সহিত মিথ্যা মিশ্রিত থাকে, সংশয়বুদ্ধিতে পরীক্ষা করিয়া (scientific method) মিথ্যা হইতে সত্যকে পৃথক করিয়া লইতে হয় ।
৪০) যে অজ্ঞ, অর্থাৎ যাহার শাস্ত্রাদির জ্ঞান নাই, এবং যে সদুপদেশ লাভ করে নাই এবং যে শ্রদ্ধাহীন অর্থাৎ সদুপদেশ পাইয়াও যে তাহা বিশ্বাস করে না এবং তদনুসারে কার্য্য করে না, সুতরাং যে সংশয়াত্মা – অর্থাৎ যাহার সকল বিষয়েই সংশয় – এইটি কি ঠিক, না ঐটি ঠিক, – এইরূপ চিন্তায় যে সন্দেহাকুল তাহার অত্মোন্নতির কোন উপায় নাই ।
৪১) অর্থাৎ – জ্ঞানী কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না, সুতরাং জ্ঞানীরও কর্ম আছে, একথা স্পষ্টই বলা হইল, তবে সে কর্ম অকর্মস্বরূপ ।
রহস্য : কর্ম ও জ্ঞানে সংযোগ কিরূপে সম্ভব ?
গতি ও স্থিতি, আলোক ও অন্ধকার যেমন একত্র থাকিতে পারে না, তদ্রূপ কর্ম ও জ্ঞানের সমুচ্চয় অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয় । সন্ন্যাসবাদিগণ এইরূপ যুক্তিবলেই জ্ঞান-কর্মের অস্বীকার করেন । ‘আমিত্ব’ বর্জন করিয়াও ‘আমি’ রাখা, জ্ঞানলাভ করিয়াও কর্ম করা – এটা অসম্ভব নহে । বস্তুত যোগিগণ সর্বদাই আবশ্যক কর্ম করেন যেমন রাজর্ষি জনকাদি, দেবর্ষি নারদাদি, ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠাদি, মহর্ষি বিশ্বমিত্রাদি, পরমহংস রামকৃষ্ণাদি । সর্বোপরি শ্রীভগবান স্বয়ং নিজ কর্মের আদর্শ দেখাইয়া, জ্ঞানিগণকে বিশ্বকর্মে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন – ‘লোকরক্ষার্থ জ্ঞানিগণও অনাসক্তচিত্তে কর্ম করিবে’ । ইহার উপর আর টীকা-টীপ্পনী চলে না, দার্শনিক মতবাদ যাহাই হউক ।
৪২) তুমি যুদ্ধে অনিচ্ছুক, কারণ তোমার হৃদয়ে নানারূপ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে । গুরুজনাদি বধ করিয়া কি পাপভাগী হইব ? আত্মীয়-স্বজনাদির বিনাশে শোক-সন্তপ্ত হইয়া রাজ্যলাভেই বা কি সুখ হইবে ? এইরূপ শোক, মোহ ও সংশয়ে অভিভূত হইয়া তুমি স্বীয় কর্তব্য বিস্মৃত হইয়াছ । তোমার এই সংশয় অজ্ঞান-সম্ভূত । যাঁহার দেহাত্মবোধ বিদূরিত হইয়াছে, সর্বভূতে একাত্মবোধ জন্মিয়াছে – তাঁহার চিত্তে এ সকল সংশয় উদিত হয় না; তিনি শোক-দুঃখে অভিভূত হন না [ঈশোপনিষৎ|৭]; ইহাই প্রকৃত জ্ঞান, তাহা পূর্বে বলিয়াছি । শ্রদ্ধা, আত্মসংযম একনিষ্ঠা – সেই জ্ঞান লাভের যে উপায় তাহাও বলিয়াছি । আমার বাক্যে তোমার শ্রদ্ধা আছে, তোমার আত্মসংযম ও একনিষ্ঠা আছে, সুতরাং তোমাকে আমি জ্ঞানোপদেশ দিতেছি । তুমি আত্মজ্ঞান লাভপূর্বক নিঃসন্দেহ হইয়া নিষ্কাম কর্মযোগ অবলম্বন কর, স্বীয় কর্তব্য পালন কর, যুদ্ধ কর ।
সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
০২। http://www.scsmathinternational.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন