২৩ নভেম্বর ২০১৭

শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা: তৃতীয় অধ্যায় – কর্মযোগ

অর্জ্জুন উবাচ—
জ্যায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দ্দন ।
তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিযোজয়সি কেশব ॥১॥

অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] জনার্দ্দন ! (হে জনার্দ্দন !) [হে] কেশব ! (হে কেশব !) কর্ম্মণঃ (রাজসিক ও সাত্ত্বিক কর্ম্ম অপেক্ষা) বুদ্ধিঃ (সাত্ত্বিক জ্ঞান) জ্যায়সী চেৎ (যদি শ্রেষ্ঠ বলিয়া) তে (তোমার) মতা (অভিমত হয়) তৎ কিং (তবে কেন) ঘোরে কর্ম্মণি (যুদ্ধরূপ ভয়ানক কর্ম্মে) মাং (আমাকে) নিযোজয়সি (নিযুক্ত করিতেছ ?) ॥১॥

অর্জ্জুন কহিলেন—হে জনার্দ্দন ! হে কেশব ! সাত্ত্বিক ও রাজসিক কর্ম্ম অপেক্ষা ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিই যদি শ্রেষ্ঠ বলিয়া তোমার মনে হয়, তবে কিজন্য আমাকে যুদ্ধরূপ হিংসাত্মক কর্ম্মে নিযুক্ত করিতেছ ? ॥১॥

ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে ।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োঽহমাপ্নুয়াম্ ॥২॥

ব্যামিশ্রেণ ইব (কোন স্থলে কর্ম্মের, কোন স্থলে জ্ঞানের প্রশংসারূপ নানাবিধ অর্থমিশ্রিত) বাক্যেন (বাক্যের দ্বারা) মে (আমার) বুদ্ধিং (বুদ্ধিকে) মোহয়সি ইব (বিমোহিতপ্রায় করিতেছ) তৎ (সুতরাং) একং (উভয়ের মধ্যে একটীকে) নিশ্চিত্য (নিশ্চিয় করিয়া) বদ (বল) যেন (যাহার দ্বারা) অহম্ (আমি) শ্রেয়ঃ (মঙ্গল) আপ্নুয়াম্ (লাভ করিতে পারি) ॥২॥

কোন স্থলে কর্ম্মের, কোন স্থলে জ্ঞানের প্রশংসারূপ নানাবিধ অর্থমিশ্রিত বাক্যের দ্বারা আমার বুদ্ধিকে সন্দেহযুক্ত করিতেছ । অতএব এই উভয়ের মধ্যে একটীকে নিশ্চয় করিয়া উপদেশ কর, যাহার আশ্রয়ে আমি মঙ্গল লাভ করিতে পারি ॥২॥

শ্রীভগবানুবাচ—
লোকেঽস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ ॥৩॥

শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) [হে] অনঘ ! (হে নিষ্পাপ অর্জ্জুন !) অস্মিন্লোকে (এই জগতে) দ্বিবিধা (দুই প্রকার) নিষ্ঠা (নিষ্ঠার কথা) ময়া (মৎ কর্ত্তৃক) পুরা (পূর্ব্ব অধ্যায়ে) প্রোক্তা (উক্ত হইয়াছে) । সাংখ্যানাং (চিদনুভবযুক্ত জ্ঞানিগণের) জ্ঞানযোগেন (জ্ঞানযোগের দ্বারা) যোগিনাম্ (জড়ানুভবপ্রধান সাধকদিগের) কর্ম্মযোগেন (ঈশ্বরে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ দ্বারা) [নিষ্ঠা স্থাপিতা] (মর্য্যাদা স্থাপিত হইয়াছে) ॥৩॥

শ্রীভগবান্ কহিলেন—হে অনঘ ! ইহলোকে যে দুইপ্রকার নিষ্ঠার বিষয় পূর্ব্ব অধ্যায়ে আমি বর্ণন করিয়াছি । উহাতে চিদনুভবযুক্ত জ্ঞানিদিগের জ্ঞানযোগের দ্বারা এবং জড়ানুভব প্রধান সাধকগণের ভগবদর্পিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগদ্বারা মাত্র ভক্তিযোগ সাধনের (নিম্ন) সীমা নির্দ্ধারণ করিয়াছি । বস্তুতঃ ভক্তিভূমি লাভ করিবার সোপান একই । আরোহিদিগের অবস্থাক্রমে নিষ্ঠাই কেবল দুই প্রকার হয় ॥৩॥

ন কর্ম্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্ম্যং পুরুষোঽশ্নুতে ।
ন চ সন্ন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥৪॥

পুরুষঃ (পুরুষ) কর্ম্মণাম্ (শাস্ত্রীয় কর্ম্মের) অনারম্ভাৎ (অনুষ্ঠান না করিয়া) নৈষ্কর্ম্ম্যং (কর্ম্মাতীত চৈতন্যাবস্থা) ন অশ্নুতে (লাভ করিতে পারে না) । সন্ন্যসনাৎ এব চ (কেবল শাস্ত্রীয় কর্ম্ম পরিত্যাগ করিলেই) সিদ্ধিং (সিদ্ধি) ন সমধিগচ্ছতি (লাভ করিতে পারে না) ॥৪॥

পুরুষ শাস্ত্রীয় কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলে নৈষ্কর্ম্ম্যরূপ জ্ঞান লাভ করিতে পারে না । অশুদ্ধচিত্ত ব্যক্তি শাস্ত্রীয় কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া কিরূপে সিদ্ধিলাভ করিবে ? ॥৪॥

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈগু ণৈঃ ॥৫॥

জাতু (কদাচিৎ) ক্ষণমপি (ক্ষণকালও) কশ্চিৎ (কেহ) অকর্ম্মকৃৎ (কর্ম্ম না করিয়া) ন হি তিষ্ঠতি (থাকিতেই পারে না) । সর্ব্বঃ হি (সমস্ত জীবই) প্রকৃতিজৈঃ গুণৈঃ (প্রকৃতিজাত গুণ সমূহ দ্বারা) অবশঃ [সন্] (অস্বতন্ত্র হইয়া) কর্ম্ম কার্য্যতে (কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়) ॥৫॥

কেহ কখনও কোন কর্ম্ম না করিয়া ক্ষণকালও অবস্থান করিতে পারে না, প্রকৃতিসিদ্ধ গুণের দ্বারা উত্তেজিত হইয়া অস্বতন্ত্ররূপে বাধ্য হইয়া সকলেই কর্ম্ম করিয়া থাকে । সুতরাং অশুদ্ধচিত্ত পুরুষের পক্ষে শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট চিত্তশোধক কর্ম্ম পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য নহে ॥৫॥

কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্ ।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে ॥৬॥

যঃ (যে ব্যক্তি) কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি (হস্তপদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয়গুলিকে) সংযম্য (সংযত করিয়া) মনসা (মনে মনে) ইন্দ্রিয়ার্থান্ (ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়গুলিকে) স্মরন্ আস্তে (স্মরণ পূর্ব্বক অবস্থান করে) সঃ (সেই ব্যক্তি) বিমূঢ়াত্মা (মূঢ়চিত্ত) মিথ্যাচারঃ (কপটাচার বা দাম্ভিক বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়) ॥৬॥

যে ব্যক্তি হস্তপদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয় সকলকে বাহির সংযত করিয়া ও মনে মনে সেই সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করে—সেই বিমূঢ়চিত্ত ব্যক্তিকে মিথ্যাচারী বলিয়া জানিবে ॥৬॥

যাস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেঽর্জ্জুন ।
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে ॥৭॥

[হে] অর্জ্জুন ! (হে ধনঞ্জয় !) যঃ তু (কিন্তু যে ব্যক্তি) মনসা (মনের দ্বারা ) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সমূহকে) নিয়ম্য (সংযত করিয়া) কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ (কর্ম্মেন্দ্রিয়গণ দ্বারা) কর্ম্মযোগম্ (শাস্ত্রীয় কর্ম্মযোগ) আরভতে (আরম্ভ করেন), অসক্তঃ (অফলাকাঙ্ক্ষী) সঃ (সেই ব্যক্তি) বিশিষ্যতে (মিথ্যাচারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট) ॥৭॥

হে অর্জ্জুন ! যিনি মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়সকলকে নিয়মিত করিয়া কর্ম্মেন্দ্রিয়গণের দ্বারা গৃহস্থধর্ম্মে অনাসক্তরূপে কর্ম্মযোগ আরম্ভ করিয়াছেন, তিনি পূর্ব্বোক্ত “মিথ্যাচারী” অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ॥৭॥

নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ ॥৮॥

ত্বং (তুমি) নিয়তং কর্ম্ম (সন্ধ্যোপাসনাদি নিত্য-কর্ম্ম) কুরু (কর) হি (যেহেতু) অকর্ম্মণঃ (কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা) কর্ম্ম (কর্ম্মানুষ্ঠান) জ্যায়ঃ (শ্রেষ্ঠ) । অকর্ম্মণঃ চ (কর্ম্ম ত্যাগ করিলে) তে (তোমার) শরীরযাত্রাপি (দেহ যাত্রাও) ন প্রাসিধ্যেৎ (নির্ব্বাহ হইবে না) ॥৮॥

তুমি সন্ধ্যোপাসনাদি নিত্যকর্ম্ম করিতে থাক, যেহেতু কর্ম্মত্যাগ দ্বারা যখন শরীর যাত্রাও নির্ব্বাহ হয় না, তখন অনধিকারী ব্যক্তির কর্ম্মত্যাগ অপেক্ষা কর্ম্ম করাই শ্রেষ্ঠ । কাম্যকর্ম্ম পরিত্যাগ পূর্ব্বক সন্ধ্যা উপাসনাদি নিত্যকর্ম্ম করিতে করিতে চিত্তশুদ্ধ হইলে জ্ঞানভূমি অতিক্রম করতঃ নির্গুণ ভক্তি লাভ করিবে ॥৮॥

যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোঽন্যত্র লোকোঽয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ ।
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর ॥৯॥

[হে] কৌন্তেয় ! (হে অর্জ্জুন !) যজ্ঞার্থাৎ (বিষ্ণুতে অর্পিত নিষ্কাম ধর্ম্মের জন্য) কর্ম্মণঃ অন্যত্র (কর্ম্ম ব্যতীত) অয়ং লোকঃ (এই জীবলোক) কর্ম্মবন্ধনঃ [ভবতি] (অন্য সমস্ত কর্ম্ম দ্বারা বন্ধন প্রাপ্ত হয়) । [অতঃ] (অতএব) তদর্থং (সেই যজ্ঞের উদ্দেশ্যে) মুক্তসঙ্গঃ [সন্] (আসক্তিরহিত হইয়া) কর্ম্ম সমাচর (কর্ম্মের সম্যক্ অনুষ্ঠান কর) ॥৯॥

ভগবদর্পিত নিষ্কাম-ধর্ম্মকে যজ্ঞ বলে । হে অর্জ্জুন ! সেই যজ্ঞের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য যে সকল কর্ম্ম করা য়ায়, সে সমুদায়কেই ‘কর্ম্মবন্ধন’ অর্থাৎ সংসার বন্ধনের কারণ বলিয়া জানিবে । অতএব তুমি কর্ম্মফলাকাঙ্ক্ষা রহিত হইয়া সেই যজ্ঞের উদ্দেশ্যে সমুদয় কর্ম্ম আচরণ কর । এবম্বিধ কর্ম্মই ভক্তিযোগের সাধকস্বরূপ হইয়া ভগবত্তত্ত্বজ্ঞান উৎপন্ন করতঃ নির্গুণ ভক্তি লাভ করাইবে ॥৯॥

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোঽস্ত্বিষ্টকামধুক্ ॥১০॥

পুরা (সৃষ্টির প্রারম্ভে) প্রজাপতিঃ (ব্রহ্মা) সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ (বিষ্ণুতে অর্পিত নিষ্কাম-ধর্ম্মানুষ্ঠানকারিণী প্রজা সকল) সৃষ্ট্বা (সৃষ্টি করিয়া) উবাচ (বলিয়াছিলেন) অনেন (এই ধর্ম্মের দ্বারা) প্রসবিষ্যধ্বম্ (বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও), এষঃ (এই যজ্ঞ) বঃ (তোমাদিগের) ইষ্টকামধুক্ (অভীষ্ট ভোগপ্রদ) অস্তু (হউক) ॥১০॥

ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রারম্ভে যজ্ঞের সহিত প্রজাগণকে সৃষ্টি করিয়া এইরূপ আদেশ করিয়াছিলেন যে, তোমরা এই যজ্ঞরূপ ধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়া উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হও, এই যজ্ঞই তোমাদের সমস্ত কাম প্রদান করুন ॥১০॥

দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ ॥১১॥

অনেন (এই যজ্ঞদ্বারা) দেবান্ (দেবতাগণকে) [যূয়ং] (তোমরা) ভাবয়ত (প্রীতিযুক্ত কর) তে দেবাঃ অপি (সেই দেবতাগণও প্রীতিযুক্ত হইয়া) বঃ (তোমাদিগকে) ভাবয়ন্তু (অভীষ্ট ফলপ্রদান পূর্ব্বক প্রীতিযুক্ত করুন) [এবং] (এইরূপে) পরস্পরং (পরস্পর পরস্পরকে) ভাবয়ন্তঃ (প্রীত করিলে) পরম্ শ্রেয়ঃ (পরম কল্যাণ) অবাপ্স্যথ (লাভ করিবে) ॥১১॥

এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবতাগণকে প্রীত কর, সেই সকল দেবতাগণও প্রীতিযুক্ত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ফলপ্রদানে প্রীত করুন । পরস্পর এইরূপ প্রীত সম্পাদন করিলে পরমমঙ্গল লাভ করিবে ॥১১॥

ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্­ক্তে স্তেন এব সঃ ॥১২॥

দেবাঃ (বিরাট্ পুরুষ মদঙ্গভূত—দেবগণ) যজ্ঞভাবিতাঃ [সন্তঃ] (যজ্ঞের দ্বারা প্রীত হইয়া) বঃ (তোমাদিগকে) ইষ্টান্ ভোগান্ (অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু) দাস্যন্তে (প্রদান করিবেন) । হি (অতএব) [বৃষ্ট্যাদিদ্বারেণ] (বৃষ্টি প্রভৃতি দ্বারা) তৈঃ দত্তান্ (তাঁহাদের প্রদত্ত অন্নাদি বস্তুসকল) এভ্যঃ (সেই সকল মদাশ্রিত—দেবগণকে) [পঞ্চ যজ্ঞাদিভিঃ] (পঞ্চ যজ্ঞাদি দ্বারা) অপ্রদায় (প্রদান না করিয়া) যঃ (যিনি) ভুঙ্­ক্তে (ভোজন করেন) সঃ (সেই ব্যক্তি) স্তেনঃ এব (চোরই) ॥১২॥

আমার বহিরঙ্গভূত দেবতাগণ যজ্ঞের দ্বারা প্রীত হইয়াই তোমাদের অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু সকল প্রদান করিয়া থাকেন । বৃষ্ট্যাদি দ্বারা তাঁহাদের প্রদত্ত সেই অন্নাদি বস্তু সকল পঞ্চ মহাযজ্ঞাদি দ্বারা মদাশ্রিত—দেবতাগণকে প্রদান না করিয়া যে ব্যক্তি স্বয়ং ভোজন করে সে চোরই অর্থাৎ চোরস্বরূপ দোষভাক্ হইয়া থাকে ॥১২॥

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্ব্বকিল্বিষৈঃ ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ ॥১৩॥

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ (বৈশ্বদেবাদি যজ্ঞাবশিষ্ট অন্ন ভোজনকারী) সন্তঃ (সাধুগণ) সর্ব্বকিল্বিষৈঃ (পঞ্চসূনাজনিত সমস্ত পাপ হইতে) মুচ্যন্তে (মুক্ত হন) । যে তু (কিন্তু যাহারা) আত্মকারণাৎ (কেবল নিজের ভোজনের নিমিত্ত) পচন্তি (পাক করে) তে (সেই) পাপাঃ (পাপিষ্ঠবগণ) অঘং [এব] (পাপই) ভুঞ্জতে (ভোজন করে) ॥১৩॥

বৈশ্বদেবাদি পঞ্চ মহাযজ্ঞের অবশিষ্ট অন্নাদি ভোজনকারী সাধুগণ পঞ্চসূনা (পঞ্চবিধ জীবহিংসা) জাত সমস্ত পাপ হইতে মুক্ত হইয়া থাকেন । কিন্তু যাহারা শুধু নিজের ভোজন নিমিত্ত পাক করে, সেই দুরাচারগণ পাপই ভোজন করে ॥১৩॥

অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ ॥১৪॥

অন্নাৎ (শুক্র শোণিতরূপে পরিণত অন্ন হইতে) ভূতানি (প্রাণী [দেহ] সকল) ভবন্তি (উৎপন্ন হয়), পর্জ্জন্যাৎ (বৃষ্টি হইতে) অন্ন-সম্ভবঃ (অন্নের উৎপত্তি হয়) যজ্ঞাৎ (যজ্ঞ হইতে) পর্জ্জন্যঃ (বৃষ্টি) ভবতি (হয়) যজ্ঞঃ (এবং যজ্ঞ) কর্ম্মসমুদ্ভবঃ (কর্ম্ম হইতে উৎপন্ন হয়) ॥১৪॥

অন্ন হইতে প্রাণিগণের উৎপত্তি হয়, বৃষ্টি হইতে অন্ন উৎপন্ন হয়, যজ্ঞ হইতে বৃষ্টি হইয়া থাকে এবং যজ্ঞ কর্ম্ম হইতে সমুদ্ভূত হয় ॥১৪॥

কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মোক্ষরসমুদ্ভবম্ ।
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ ॥১৫॥

কর্ম্ম (কর্ম্ম) ব্রহ্মোদ্ভবং (বেদ হইতে উৎপন্ন) বিদ্ধি (জানিবে), ব্রহ্ম (বেদ) অক্ষর সমুদ্ভবম্ (অক্ষর অর্থাৎ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত), তস্মাৎ (অতএব) সর্ব্বগতং (সর্ব্বব্যাপক) ব্রহ্ম (পরব্রহ্ম) যজ্ঞে (যজ্ঞে) নিত্যং (সর্ব্বদা) প্রতিষ্ঠিতম্ (প্রতিষ্ঠিত আছেন) ॥১৫॥

ব্রহ্ম (বেদ) হইতে কর্ম্ম উদ্ভূত এবং ঐ বেদ অক্ষর অর্থাৎ অচ্যুত হইতে উৎপন্ন, সুতরাং সর্ব্বব্যাপক ভগবান্ অচ্যুত যজ্ঞে নিত্যকালই প্রতিষ্ঠিত ॥১৫॥

এবং প্রবর্ত্তিতং চক্রং নানুবর্ত্তয়তীহ যঃ ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি ॥১৬॥

[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) যঃ ( যে কর্ম্মাধিকারী বা জ্ঞানাধিকারী মানব) এবং (এইরূপে) [পরমপুরুষেণ] (পরম পুরুষ ভগবান্ কর্ত্তৃক) প্রবর্ত্তিতং (কার্য্যকারণভাবে প্রবর্ত্তিত) চক্রং (চক্রকে) ইহ (এই জীবনে) ন অনুবর্ত্তয়তি (অনুর্বত্তন করে না) সঃ (সেই) অঘায়ুঃ (পাপপূর্ণ জীবন) ইন্দ্রিয়ারামঃ (ইন্দ্রিয়াসক্ত পুরুষ) মোঘং (বৃথা) জীবতি (জীবন ধারণ করে) ॥১৬॥

হে অর্জ্জুন ! যে কর্ম্মাধিকারী বা জ্ঞানাধিকারী মনুষ্য এইরূপে পরমপুরুষ স্বয়ং ভগবান্ কর্ত্তৃক কার্য্যকারণ ভাবে প্রবর্ত্তিত এই চক্রের (নিয়মের) প্রবর্ত্তন করে না, সেই পাপপূর্ণ-জীবন, ইন্দ্রিয়াসক্ত মানব বৃথাই জীবন ধারণ করে ॥১৬॥

যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ ।
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে ॥১৭॥

তু (কিন্তু) যঃ মানবঃ (যে মানব) আত্মরতিঃ (আত্মাতেই প্রীতি বিশিষ্ট) আত্মতৃপ্তঃ এব চ (ও অত্মাতেই তৃপ্ত) আত্মনি এব চ (এবং আত্মাতেই) সন্তুষ্টঃ (সম্যক্ তুষ্ট) স্যাৎ (থাকেন), তস্য (তাঁহার) কার্য্যং (করণীয়) ন বিদ্যতে (কিছুই নাই) ॥১৭॥

কিন্তু যে মানব আত্মাতেই প্রীতিবিশিষ্ট ও আত্মাতেই তৃপ্ত এবং আত্মাতেই সম্যক্ তুষ্ট থাকেন ; তাঁহার করণীয়রূপে কোন কার্য্য নাই, কেবল মাত্র শরীর যাত্রা নির্ব্বাহের জন্য তিনি কর্ম্ম করিয়া থাকেন ॥১৭॥

নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন ।
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থ-ব্যপাশ্রয়ঃ ॥১৮॥

ইহ (এ জগতে) তস্য (সেই আত্মারাম পুরুষের) কৃতেন (কৃতকর্ম্ম দ্বারা) অর্থঃ ন এব (পূর্ণ্য হয় না) অকৃতেন (কর্ম্মের অকরণ হেতু) কশ্চন [অনর্থঃ] ন (কোনও পাপ হয় না), অস্য সর্ব্বভূতেষু চ (এবং এই ব্যক্তির নিখিল প্রাণীগণের মধ্যে) কশ্চিৎ (কেহই) অর্থ ব্যপাশ্রয়ঃ (স্ব-প্রয়োজনে আশ্রয়নীয়) ন [ভবতি] (হয় না) ॥১৮॥

ইহলোকে সেই আত্মারাম পুরুষের অনুষ্ঠিত কর্ম্মের জন্য কোনও পুণ্য সঞ্চয় হয় না, এবং কর্ত্তব্য কর্ম্মের অননুষ্ঠান জন্য কোন পাপও উৎপন্ন হয় না । আব্রহ্ম-স্থাবর পর্য্যন্ত ভূত সকলের মধ্যে এই ব্যক্তির স্বপ্রয়োজনে কেহই আশ্রয়নীয় হন না ॥১৮॥

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং কর্ম্ম সমাচর ।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ ॥১৯॥

তস্মাৎ (অতএব) অসক্তঃ [সন্] (ফলাসক্তি রহিত হইয়া) সততং (সর্ব্বদা) কার্য্যং কর্ম্ম (বিহিত কর্ম্ম) সমাচর (সম্যক্ আচরণ কর), হি (যেহেতু) অসক্তঃ [সন্] (অনাসক্ত হইয়া) কর্ম্ম আচরন্ (কর্ম্ম করিলে) পুরুষঃ (পুরুষ) পরম্ (অর্থাৎ পরমভক্তি) আপ্নোতি (লাভ করেন) ॥১৯॥

অতএব ফলাসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক সর্ব্বদা অবশ্য কর্ত্তব্যরূপে বিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান কর । যেহেতু অনাসক্তভাবে কর্ম্ম করিতে করিতে জীবের মোক্ষ লাভ হয় । নিষ্কাম কর্ম্ম সকলের চরম পরিপাক্কাবস্থায় যে পরমাভক্তি জন্মে তাহাই মোক্ষ ॥১৯॥

কর্ম্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সম্পশ্যন্ কর্ত্তুমর্হসি ॥২০॥

জনকাদয়ঃ (জনকাদি জ্ঞানিগণ) কর্ম্মণা এব (কর্ম্মের দ্বারাই) হি (নিশ্চিত) সংসিদ্ধিম্ (ভক্তিরূপ সম্যক্ সিদ্ধি) আস্থিতাঃ (লাভ করিয়াছিলেন) । লোকসংগ্রহম্ অপি সংপশ্যন্ এব (লোকে শিক্ষা গ্রহণ করিবে এইরূপ বিবেচনায়ও) [কর্ম্ম] (কর্ম্ম) কর্ত্তুম্ (করিতে) অর্হসি (যোগ্য হও) ॥২০॥

জনক প্রভৃতি জ্ঞানাধিকারী ব্যক্তিগণও কর্ম্মের দ্বারাই ভক্তিরূপ সংসিদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন । অতএব লোকশিক্ষার্থ তোমার কর্ম্ম করা উচিত ॥২০॥

যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে ॥২১॥

শ্রেষ্ঠঃ (শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি) যৎ যৎ (যাহা যাহা) আচরতি (আচরণ করেন) ইতরঃ জনঃ (সাধারণ ব্যক্তি) তৎ তৎ এব (সেই সেই কর্ম্মই) [আচরতি] (আচরণ করে), সঃ (সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি) যৎ (যাহাকে) প্রমাণং (প্রমাণ বলিয়া) কুরুতে (স্বীকার করেন) লোকঃ (সাধারণ লোকও) তৎ (তাহাই) অনুবর্ত্ততে (অনুসরণ করে) ॥২১॥

শ্রেষ্ঠ লোক যেরূপ আচরণ করিয়া থাকেন, সাধারণ লোকসকল তাহারই অনুকরণ করেন । তিনি যাহাকে প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করেন, সাধারণ লোকও তাহাতেই অনুবর্ত্তী হয় ॥২১॥

ন মে পার্থাস্তি কর্ত্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন ।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি ॥২২॥

হে পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) ত্রিষু লোকেষু (ত্রিজগতে) মে (আমার) কিঞ্চন (কোন) কর্ত্তব্যং নাস্তি (করণীয় নাই) [যতঃ] (যেহেতু) [মম] (আমার) অনবাপ্তম্ (অপ্রাপ্ত) অবাপ্তব্যং (বা প্রাপ্য) [কিঞ্চন নাস্তি] (কিছুই নাই) [তথাপি] কর্ম্মণি (কর্ম্মে) বর্ত্তে এব চ (প্রবর্ত্তমান রহিয়াছি) ॥২২॥

হে অর্জ্জুন ! আমি পরমেশ্বর এই ত্রিলোক মধ্যে আমার কিছুই কর্ত্তব্য নাই ; যেহেতু আমার অপ্রাপ্ত বা পাইবার যোগ্য কিছুমাত্র বস্তু নাই, তথাপি আমি নিজে কর্ম্মাচরণ করিতেছি ॥২২॥

যদি হ্যহং ন বর্ত্তেয়ং জাতু কর্ম্মণ্যতন্দ্রিতঃ ।
মমবর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ ॥২৩॥

[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) যদি জাতু (যদি কখনও) অতন্দ্রিতঃ [সন্] (অনবহিত হইয়া) অহম্ (আমি) কর্ম্মণি (কর্ম্মে) ন বর্ত্তেয়ং (প্রবৃত্ত না হই), [তর্হি] (তবে) হি (নিশ্চয়ই) মনুষ্যাঃ (মানবগণ) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বথা) মম (আমার) বর্ত্ম (পথ) অনুবর্ত্তন্তে (অনুসরণ করিবে) ॥২৩॥

হে অর্জ্জুন ! কখনও যদি আমি অনবহিত হইয়া কর্ম্মানুষ্ঠান না করি, তবে আমার অনুবর্ত্তী হইয়া সকল মনুষ্যই কর্ম্ম পরিত্যাগ করিবে ॥২৩॥

উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম্ ।
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ ॥২৪॥

চেৎ (যদি) অহম্ (আমি) কর্ম্ম (কর্ম্ম) ন কর্য্যাম্ (না করি) [তর্হি] (তবে) ইমে লোকাঃ (এই সমস্ত লোকই) [কর্ম্ম ত্যক্ত্বা] (কর্ম্মত্যাগ পূর্ব্বক) উৎসীদেয়ুঃ (বিনষ্ট হইবে), চ (এবং) [অহং] (আমি) সঙ্করস্য (বর্ণসঙ্করের) কর্ত্তা (কর্ত্তা) স্যাম্ (হইব), [এবং অহমেব] (এইরূপে আমিই) ইমাঃ প্রজাঃ (এই সমস্ত প্রজাকে) উপহন্যাম্ (বিনাশ করিব) ॥২৪॥

যদি আমি কর্ম্ম না করি তবে আমার দৃষ্টান্তে এই সমস্ত লোকই কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া উৎসন্ন হইবে এবং আমি বর্ণ-সঙ্করের প্রবর্ত্তক হইব, এইরূপে আমিই এই সমস্ত প্রজাকে বিনষ্ট করিব ॥২৪॥

সক্তাঃ কর্ম্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্ব্বন্তি ভারত ।
কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুলোকসংগ্রহম্ ॥২৫॥

[হে] ভারত ! (হে অর্জ্জুন !) কর্ম্মণি সক্তাঃ (কর্ম্মে আসক্ত) অবিদ্বাংসঃ (অজ্ঞগণ) যথা (যেরূপ) [কর্ম্মাণি] কুর্ব্বন্তি (কর্ম্ম করিয়া থাকে) বিদ্বান্ (জ্ঞানী ব্যক্তি) অসক্তঃ (আসক্তি রহিত) [সন্] (হইয়া) লোকসংগ্রহম্ (লোক সংগ্রহ) চিকীর্ষুঃ (করিতে ইচ্ছুক হইয়া) তথা (সেইরূপ কর্ম্ম) কুর্য্যাৎ (করিবেন) ॥২৫॥

হে অর্জ্জুন ! কর্ম্মে আসক্ত অজ্ঞগণ যেরূপ কর্ম্ম করিয়া থাকে, সেইরূপ জ্ঞানিগণও কর্ম্মে অনাসক্ত হইয়া কর্ম্মাধিকারিদিগের স্বধর্ম্ম রক্ষার নিমিত্ত কর্ম্মাচরণ করিবেন, অর্থাৎ উভয়ের কর্ম্মের প্রকার পৃথক নয়, আসক্তি ও অনাসক্তিরূপ নিষ্ঠাই পৃথক জানিবে ॥২৫॥

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্ ।
যোজয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ ॥২৬॥

বিদ্বান্ (জ্ঞানযোগের উপদেশক) কর্ম্মসঙ্গিনাম্ (কর্ম্মে আসক্ত চিত্ত) অজ্ঞানাম্ (অজ্ঞ ব্যক্তিগণের) বুদ্ধিভেদং (‘কর্ম্ম ত্যাগ পূর্ব্বক জ্ঞানাভ্যাস কর’ এইরূপ বুদ্ধিভেদ) ন জনয়েৎ (জন্মাইবে না) । [অপি তু] (অথচ) যুক্তঃ [সন্] (অনাসক্ত হইয়া) সর্ব্বকর্ম্মাণি (সমস্ত কর্ম্ম) সমাচরন্ (সম্যক্ আচরণ পূর্ব্বক) [অজ্ঞান্] (অজ্ঞগণকে) যোজয়েৎ (কর্ম্মে নিযুক্ত রাখিবেন) ॥২৬॥

জ্ঞানযোগের উপদেষ্টা কর্ম্মাসক্ত অজ্ঞগণের ‘কর্ম্মত্যাগ পূর্ব্বক জ্ঞানাভ্যাস কর’ এইরূপ বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না । উপরন্তু নিজে সমাহিত চিত্তে নিষ্কাম কর্ম্ম সমূহের অনুষ্ঠান পূর্ব্বক অজ্ঞ লোকদিগকেও (সেই ভাবে) কর্ম্মেই নিযুক্ত রাখিবেন ॥২৬॥

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্ব্বশঃ ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে ॥২৭॥

প্রকৃতেঃ (প্রকৃতির) গুণৈঃ (কার্য্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা) সর্ব্বশঃ (সর্ব্বপ্রকারে) কর্ম্মাণি (কর্ম্ম সকল) ক্রিয়মাণানি (সম্পাদিত হয়), [কিন্তু] অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা (দেহাদিতে অহং বুদ্ধি দ্বারা বিমূঢ় চিত্ত ব্যক্তি) অহং কর্ত্তা (আমিই কর্ত্তা) ইতি (এইরূপ) মন্যতে (মনে করে) ॥২৭॥

কার্য্য সমূহ সর্ব্বতোভাবে প্রকৃতির গুণের (কার্য্যের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের) দ্বারা সম্পাদিত হয় । কিন্তু দেহাদিতে অহং বুদ্ধি দ্বারা বিমুগ্ধচিত্ত মানব ‘আমিই উহা সম্পন্ন করিতেছি’ মনে করে ॥২৭॥

তত্ত্ববিৎ তু মহাবাহো গুণকর্ম্মবিভাগয়োঃ ।
গুণা গুণেষু বর্ত্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে ॥২৮॥

[হে] মহাবাহো ! (হে বীরশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) গুণকর্ম্ম বিভাগয়োঃ (গুণ বিভাগ ও তদীয় কার্য্যের যে বিভাগ অর্থাৎ সত্ত্ব রজঃ তমঃ এইসকল গুণ ভেদ এবং তাহাদের কার্য্য দেবতা, ইন্দ্রিয় ও বিষয়রূপ কার্য্যভেদের) তত্ত্ববিৎ (স্বরূপ যিনি জানেন), [সঃ] (তিনি) তু (কিন্তু) গুণাঃ (দেবতা কর্ত্তৃক প্রেরিত চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়) গুণেষু (রূপাদি স্ব স্ব বিষয়ে) বর্ত্তন্তে (প্রবৃত্ত হয়) ইতি (ইহা) মত্বা (মনে করিয়া) ন সজ্জতে (তাহাতে আসক্ত হন না) ॥২৮॥

হে মহাবীর অর্জ্জুন ! গুণের বিভাগ ও তদীয় কার্য্যের বিভাগ অর্থাৎ সত্ত্ব রজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়, এবং দেবতা, ইন্দ্রিয় ও বিষয়রূপ কার্য্য সমূহের তত্ত্ব যিনি অবগত আছেন, তিনি কিন্তু ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাতৃ-দেবতাকর্ত্তৃক প্রেরিত চক্ষুকর্ণাদি ইন্দ্রিয়গণই রূপাদি স্ব স্ব গ্রাহ্যবিষয়সমূহে প্রবৃত্ত হইয়া থাকে—এইরূপ মনে করিয়া নিজের কর্ত্তৃত্বাভিমান করেন না ॥২৮॥

প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়াঃ সজ্জন্তে গুণকর্ম্মসু ।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ ॥২৯॥

প্রকৃতেঃ (প্রকৃতির) গুণসংমূঢ়াঃ (গুণ সমূহ দ্বারা ভূতাবিষ্টের ন্যায় আবিষ্ট জীবগণ) গুণকর্ম্মসু (গুণ কার্য্য বিষয় সমূহে) সজ্জন্তে (আসক্ত হয়); তান্ (সেই সকল) অকৃৎস্নবিদঃ (অসর্ব্বজ্ঞ) মন্দান্ (মন্দবুদ্ধিগণকে) কৃৎস্নবিৎ (সর্ব্বজ্ঞ বিদ্বান্ ব্যক্তি) ন বিচালয়েৎ (আত্ম অনাত্ম বিচার গ্রহণ করাইতে চেষ্টা করিবেন না) [কিন্তু গুণাবেশ-নিবর্ত্তকং নিষ্কাম কর্ম্মৈব কারয়েৎ] (কিন্তু গুণাবেশ নিবর্ত্তক নিষ্কাম কর্ম্মই করাইবেন) ॥২৯॥

প্রকৃতির গুণসমূহ দ্বারা ভূতাবিষ্ট মানুষের মত সম্যক্­রূপে মুগ্ধ ব্যক্তিগণ ইন্দ্রিয় ও তদ্­বিষয়ক কর্ম্মসমূহে আসক্ত হয় । সর্ব্বজ্ঞ বিদ্বান্ ব্যক্তি সেইসকল অজ্ঞ মন্দমতিগণকে (অনধিকারিগণকে) তত্ত্ববিচার প্রদর্শন পূর্ব্বক বিচলিত করিবেন না । গুণাবেশ নিবর্ত্তক নিষ্কাম কর্ম্মেরই উপদেশ দান করিবেন ॥২৯॥

ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীর্নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ ॥৩০॥

অধ্যাত্মচেতসা (আত্মস্বরূপনিষ্ঠ চিত্তে) ময়ি (আমাতে) সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি (সমস্ত কর্ম্ম) সংন্যস্য (সমর্পণ করিয়া) নিরাশীঃ (নিষ্কাম), নির্ম্মামঃ (সর্ব্বত্র মমতাশূন্য) বিগতজ্বরঃ [চ] (ও খেদ রহিত) ভূত্বা (হইয়া) যুধ্যস্ব (যুদ্ধ কর) ॥৩০॥

সমস্ত কর্ম্ম আমাতে সমর্পণ পূর্ব্বক ‘অন্তর্যামীর অধীনে আমি কর্ম্ম করিতেছি’ এইরূপ বুদ্ধিতে নিষ্কাম, মমতাশূন্য ও শোকরহিত হইয়া (স্বধর্ম্মরূপ) যুদ্ধ অবলম্বন কর ॥৩০॥

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ ।
শ্রদ্ধাবন্তোঽনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেঽপি কর্ম্মভিঃ ॥৩১॥

যে (যে সকল) মানবাঃ (মনুষ্য) শ্রদ্ধাবন্তঃ (শ্রদ্ধাবান্) অনসূয়ন্তঃ (ও অসূয়া রহিত হইয়া) মে (আমার) ইদং (এই) মতম্ (অভিমত নিষ্কাম কর্ম্মযোগের) নিত্যম্ (সর্ব্বদা) অনুতিষ্ঠন্তি (অনুষ্ঠান করেন) তে অপি (তাঁহারাও) কর্ম্মভিঃ (কর্ম্ম বন্ধন হইতে) মুচ্যন্তে (মুক্ত হন) ॥৩১॥

যে সকল মানব শ্রদ্ধালু ও দোষদৃষ্টি-রহিত হইয়া আমার অভিমত এই নিষ্কাম কর্ম্মযোগের সতত অনুবর্ত্তন করেন—কর্ম্ম করিয়াও তাঁহারা সেই কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন ॥৩১॥

যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্ ।
সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ ॥৩২॥

যে তু (পরন্তু যাহারা) মে এতৎ মতম্ (আমার এই উপদেশ) অভ্যসূয়ন্তঃ (অসূয়াবশতঃ) ন অনুতিষ্ঠন্তি (পালন করে না) তান্ (তাহাদিগকে) সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়ান্ (সমস্ত জ্ঞানে বঞ্চিত ), নষ্টান্ (পুরুষার্থ বিভ্রষ্ট) অচেতসঃ (ও নির্ব্বোধ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥৩২॥

আর যাহারা অসূয়া পরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুবর্ত্তন করে না, সেই বিবেক শূন্য জনগণকে সর্ব্ববিধজ্ঞানে বিমূঢ় ও বিনাশপ্রাপ্ত বলিয়া জানিবে ॥৩২॥

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি ।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি ॥৩৩॥

জ্ঞানবান্ অপি (জ্ঞানী ব্যক্তিও) স্বস্যাঃ প্রকৃতেঃ (স্বীয় প্রকৃতির) সদৃশং (অনুরূপ) চেষ্টতে (কার্য্য করে), ভূতানি (প্রাণিগণ) প্রকৃতিং যান্তি (তাদৃশ চেষ্টার ফলে তাদৃশ স্বভাবের অধীন হয়) নিগ্রহঃ (শাস্ত্রকৃত বা রাজকৃত দণ্ড)[তেষাং] (তাহাদের) কিং করিষ্যতি (কি করিবে) ॥৩৩॥

জ্ঞানবান্ ব্যক্তিও স্বীয় প্রকৃতির অর্থাৎ দুঃস্বভাবের অনুরূপ চেষ্টা করে । সুতরাং জীবগণ তাদৃশ চেষ্টার ফলে নিজে তাদৃশ স্বভাবের অধীন হইয়া পড়ে । শাস্ত্রকৃত বা রাজকৃত দণ্ডের ভয় তখন তাহাদিগকে রোধ করিতে পারে না ॥৩৩॥

ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ॥৩৪॥

ইন্দ্রিয়ষ্য ইন্দ্রিয়স্য (সমস্ত ইন্দ্রিয়ের) অর্থে (স্ব স্ব বিষয়ে) রাগদ্বেষৌ (আসক্তি ও দ্বেষ) ব্যবস্থিতৌ (বিশেষভাবে অবস্থিত) । [তথাপি] তয়োঃ (সেই রাগদ্বেষের) বশং ন আগচ্ছেৎ (বশীভূত হইবে না) । হি (যেহেতু) তৌ (সেই রাগ ও দ্বেষ) অস্য (সাধকের) পরিপন্থিনৌ (বিরোধী) ॥৩৪॥

সমস্ত ইন্দ্রিয়গণেরই নিজ নিজ গ্রহণীয় বস্তুতে অনুরাগ ও বিরাগ বিশেষভাবে বর্ত্তমান রহিয়াছে । তাহা হইলেও এই রাগ বা দ্বেষের কখনও বশবর্ত্তী হইবে না । যেহেতু এই বিষয়ানুরাগ বা বিষয় বিরাগ সাধক ব্যক্তির পরম শত্রু বলিয়া জানিবে । (ইহাতে ভক্তি বিষয়ক রাগ বা বিরাগ লক্ষীভূত নহে) ॥৩৪॥

শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ ॥৩৫॥

স্বনুষ্ঠিতাৎ (নির্দ্দোষভাবে অনুষ্ঠিত) পরধর্ম্মাৎ (পরধর্ম্ম অপেক্ষা) বিগুণঃ (কিঞ্চিৎ দোষযুক্ত) স্বধর্ম্মঃ (স্বকীয় ধর্ম্ম) শ্রেয়ান্ (শ্রেষ্ঠ) । স্বধর্ম্মে (স্ব স্ব বর্ণ ও আশ্রমোচিত ধর্ম্ম) নিধনং (মরণও) শ্রেয়ঃ (ভাল) পরধর্ম্মঃ (পরধর্ম্ম) ভয়াবহঃ (তদপেক্ষা ভয়ানক) ॥৩৫॥

নির্দ্দোষভাবে আচরিত অন্যের ধর্ম্ম অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অঙ্গহীন স্বীয় ধর্ম্মাচরণ ভাল । স্ব স্ব বর্ণ ও আশ্রমোচিত ধর্ম্মে বর্ত্তমান থাকিয়া নিধনপ্রাপ্ত হওয়া মঙ্গলপ্রদ হইয়া থাকে ; যেহেতু পরধর্ম্ম আচরণ ভয়াবহ জানিবে । (অধোক্ষজে ভক্তি সর্ব্বজীবের নিত্য স্বাভাবিক পরমধর্ম্ম হওয়ায়, ইহা বাহ্যিক সুদুরাচারযুক্ত হইলেও মায়িক সত্ত্বাদি গুণাশ্রিত সদাচার সংস্কারযুক্ত অনাত্ম ধর্ম্ম হইতে সর্ব্বদা শ্রেষ্ঠ । সাধুসঙ্গে এই শুদ্ধভক্তি যাজন করিতে করিতে দেহপাত হইলেও শ্রেয়ঃস্কর ; যেহেতু অবিদ্যাশ্রিত সংষ্কারের অনিশ্চয়তাপূর্ণ ঔপাধিক সদাচার দ্বিতীয়াভিনিবেশ থাকায় ভয়াবহ ।) ॥৩৫॥

অর্জ্জুন উবাচ—
অথ কেন প্রযুক্তোঽয়ং পাপঞ্চরতি পূরুষঃ ।
অনিচ্ছন্নপি বাষ্ণের্য় বলাদিব নিয়োজিতঃ ॥৩৬॥

অর্জ্জুনঃ উবাচ (অর্জ্জুন বলিলেন) [হে] বার্ষ্ণেয় ! (হে বৃষ্ণিবংশাবতংস !) অনিচ্ছন্ অপি (ইচ্ছা না করিলেও) অথ কেন প্রযুক্তঃ [সন্] (কাহা কর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া) অয়ং পুরুষঃ (এই জীব) বলাং (বলপূর্ব্বক) নিযোজিতঃ ইব (যেন নিযোজিত হইয়াই) পাপং (পাপ) চরতি (আচরণ করে) ॥৩৬॥

অর্জ্জুন বলিলেন—হে বার্ষ্ণেয় ! ইচ্ছা না করিলেও কাহার প্রেরণায় এই জীব বলপূর্ব্বক নিয়োজিতের মত বাধ্য হইয়া পাপকার্য্য আচরণ করিয়া থাকে ? ॥৩৬॥

শ্রীভগবান্ উবাচ—
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ ॥৩৭॥

শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) এষঃ কামঃ (এই বিষয়াভিলাষরূপ কামই) এষঃ ক্রোধঃ (ক্রোধরূপে পরিণত হয়) রজোগুণসমুদ্ভবঃ (কাম রজোগুণ হইতে উৎপন্ন, এবং এই কাম হইতেই তামস ক্রোধ জন্মে), মহাশনঃ (দুষ্পূরণীয়) মহাপাপ্মা (ও অতি উগ্র) ইহ (এই জগতে) এনং (এই কামকেই) বৈরিণম্ (জীবের প্রধান শত্রু বলিয়া) বিদ্ধি (জানিবে) ॥৩৭॥

শ্রীভগবান্ কহিলেন—রজোগুণসমুদ্ভূত কামই পুরুষকে পাপে প্রবৃত্তি দেয় । ‘কাম’ বিষয়াভিলাষ স্বরূপ, ঐ কামই অবস্থাভেদে রূপান্তর প্রাপ্ত হইয়া ক্রোধ হয় । এই কামের কিছুতেই পূর্ত্তি হয় না এবং সে অতিশয় উগ্র । এই জগতে উক্ত কামকেই জীবের প্রধান শত্রু বলিয়া জানিবে ॥৩৭॥

ধূমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ ।
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ ॥৩৮॥

যথা (যেমন) বহ্নিঃ (অগ্নি) ধূমেন (ধূম দ্বারা) আব্রিয়তে (আবৃত থাকে), যথা (যেমন) আদর্শঃ (দর্পণ) মলেন (ময়লার দ্বারা) [আব্রিয়তে] (আবৃত থাকে), যথা চ (এবং যেমন) উল্বেন (জরায়ু দ্বারা) গর্ভঃ (গর্ভ) আবৃতঃ (আবৃত থাকে), তথা (সেইরূপ) তেন (সেই কাম দ্বারা) ইদম্ (এই জ্ঞান) আবৃতম্ (আবৃত থাকে) ॥৩৮॥

যেমন ধূমের দ্বারা অগ্নি কিঞ্চিৎ আবৃত থাকে, যেমন দর্পণ ময়লা দ্বারা গাঢ় আবৃত থাকে, এবং যেমন জরায়ু দ্বারা গর্ভস্থ জীব অতি গাঢ়ভাবে আবৃত থাকে ; সেইরূপ এই কামের দ্বারা উক্ত ত্রিবিধ রূপে (সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণাশ্রয়ে) জীবচৈতন্য আচ্ছন্ন রহিয়াছে ॥৩৮॥

আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা ।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ ॥৩৯॥

[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র অর্জ্জুন !) জ্ঞানিনঃ (জ্ঞানিগণেরও) নিত্যবৈরিণা (চিরশত্রু) এতেন (এই) দুষ্পূরেণ (দুষ্পূরণীয়) অনলেন চ (অনল সদৃশ) কামরূপেণ (কামও তন্মূল অজ্ঞান কর্ত্তৃক) জ্ঞানম্ (বিবেক জ্ঞান) আবৃতম্ (আবৃত হয়) ॥৩৯॥

হে অর্জ্জুন ! জ্ঞানীর চিরশত্রু—(ঘৃতাহুতি দ্বারা) দুষ্পূরণীয় অনল সদৃশ এই ‘কাম’ ও তন্মূল অজ্ঞান কর্ত্তৃক—বিবেক-জ্ঞান আবৃত হয় ॥৩৯॥

ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে ।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ ॥৪০॥

অস্য (এই কামরূপ শত্রুর) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয়গণ) মনঃ বুদ্ধিঃ (মন ও বুদ্ধি) অধিষ্ঠানম্ (আশ্রয়স্থল বলিয়া) উচ্যতে (কথিত হয়), এষঃ (এই কাম) এতৈঃ (এই সকল ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা) জ্ঞানম্ (বিবেক জ্ঞানকে) আবৃত্য (আবৃত করিয়া) দেহিনম্ (জীবকে) বিমোহয়তি (বিমোহিত করে) ॥৪০॥

ইন্দ্রিয়গণ, মন ও বুদ্ধিকে এই কামরূপ শত্রুর আশ্রয়-স্থল বলা হইয়াছে । ঐ কাম এই সকল ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা বিবেক-জ্ঞানকে আচ্ছাদন করিয়া জীবকে বিমোহিত করে অর্থাৎ জড়বিষয়ে নিক্ষেপ করে ॥৪০॥

তস্মাৎ ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ ।
পাপ্মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ ॥৪১॥

[হে] ভরতর্ষভ ! (হে ভরত শ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন !) তস্মাৎ (অতএব) ত্বম্ (তুমি) আদৌ (প্রথমতঃ) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রিয় সকলকে) নিয়ম্য (বশীভূত করিয়া) জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ (জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিনাশক) পাপ্মানং (পাপরূপ) এনং (এই কামকে) হি (স্পষ্টতঃ) প্রজহি (বিনাশ কর) ॥৪১॥

হে ভরতবংশাবতংস ! অতএব তুমি প্রথমে ইন্দিয়গণকে স্বীয় বশীভূত করিয়া শাস্ত্রীয় আত্মানাত্ম-বিবেকরূপ ‘জ্ঞান’ ও তৎসম্বন্ধীয় চিন্ময় অনুভব হইতে লব্ধ ‘বিজ্ঞান’ এই উভয়ের ধ্বংসকারী পাপস্বরূপ এই কামকে প্রকাশ্যভাবে বিনাশ কর ॥৪১॥

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধের্যঃ পরতস্তু সঃ ॥৪২॥

[বিষয়েভ্যঃ] (জড় বিষয় হইতে) ইন্দ্রিয়াণি (ইন্দ্রয়গণকে) পরাণি (শ্রেষ্ঠ) [পণ্ডিতাঃ] (পণ্ডিতগণ) আহুঃ (বলিয়া থাকেন), ইন্দ্রিয়েভ্যঃ (ইন্দ্রিয় সকল হইতে) মনঃ (মনকে) পরং (শ্রষ্ঠ), মনসঃ তু (মন অপেক্ষাও) বুদ্ধিঃ (নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি) পরা (শ্রেষ্ঠ) । যঃ তু (আর যিনি) বুদ্ধেঃ (বুদ্ধি অপেক্ষাও) পরতঃ (পরতর) সঃ (তিনিই জীবাত্মা) ॥৪২॥

পণ্ডিতগণ বলেন জড় বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ, ইন্দ্রিয়সকল হইতে মন শ্রেষ্ঠ, মন অপেক্ষাও নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তিরূপ বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ । আবার যিনি বুদ্ধি অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, তিনিই সেই (জীবাত্মা) ॥৪২॥

এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা ।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ ॥৪৩॥

[হে] মহাবাহো ! (হে মহাবীর অর্জ্জুন !) এবং (এইরূপে) বুদ্ধেঃ পরং (বুদ্ধি হইতে পৃথক্ জীবাত্মাকে) বুদ্ধা (জানিয়া) আত্মানম্ (মনকে) আত্মনা (ঈদৃশ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি দ্বারা) সংস্তভ্য (স্থির করিয়া) দুরাসদম্ (দুর্জ্জয়) কামরূপং (কামরূপ) শত্রুং (শত্রুকে) জহি (বিনাশ কর) ॥৪৩॥

হে মহাবীর অর্জ্জুন ! এইরূপে বুদ্ধি হইতে সম্পূর্ণভাবে পৃথক জীবাত্মাকে অবগত হইয়া ঈদৃশ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিদ্বারা মনকে নিশ্চল করিয়া কামরূপ দুর্জ্জয় শত্রুকে বিনষ্ট কর ॥৪৩॥

ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে কর্ম্মযোগো নাম তৃতীয়োঽধ্যায়ঃ ॥৩॥

ইতি তৃতীয় অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥

                                                                                                   গ্রন্থ-সম্পাদক—
                                                                                       ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
                                                                                         শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
                                                                                        শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল

৪) নৈষ্কর্ম্য লাভ : কর্মবন্ধন হইতে মুক্তি বা নিষ্কৃতির অবস্থাকে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি বা মোক্ষ বলে । শ্রীগীতা বলেন সন্ন্যাসমার্গে মোক্ষ লাভ হয় জ্ঞানের ফলে, কর্মত্যাগের ফলে নয় । কর্ম বন্ধনের কারণ নয়, অহঙ্কার ও কামনাই বন্ধনের কারণ । কামনা ত্যাগেও জ্ঞানের প্রয়োজন এবং সেই হেতুই নিষ্কাম-কর্মও মোক্ষপ্রদ । মোক্ষের জন্য চাই, অহঙ্কার ও ফলাসক্তি ত্যাগ, কর্মত্যাগ প্রয়োজন হয় না । বস্তুত দেহধারী জীব একেবারে কর্মত্যাগ করিতেই পারে না ।
৬-৭) মিথাচারী ও কর্মযোগী : হস্তপদাদি সংযত করিয়া ধ্যানে বসিয়াছি । মন বিষয়ে ভ্রমণ করিতেছে । আমি মিথাচারী । এই অবস্থা উল্টাইয়া লইতে পারিলে আমি কর্মযোগী হইব । অর্থাৎ যখন ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়-কর্ম করিতেছি, কিন্তু মন ঈশ্বরে নিবিষ্ট আছে, বিষয়-কর্মও তাঁহারই কর্ম মনে করিয়া কর্তব্যবোধে করিতেছি, উহাতে আসক্তি নাই, ফলাকাঙ্ক্ষা নাই । সিদ্ধি-অসিদ্ধিতে হর্ষ-বিষাদ নাই ।
৮) নিয়ত কর্ম : সাধারণত শাস্ত্রবিহিত কর্তব্য-কর্ম (duty), স্বধর্ম – লোকমান্য তিলক । এখানে ইন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া (নিয়ম্য) যে কর্ম তাহাই বুঝায় (controlled action) ।
ধর্মশাস্ত্র : স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা নিবারণপূর্বক ধর্ম ও লোকরক্ষার উদ্দেশ্যে যে সকল বিধি-নিষেধ প্রবর্তিত হইয়াছে । শাস্ত্র সকল সম্প্রদায়ের, সকল সমাজের, সকল জাতিরই আছে । সকলের পক্ষেই শাস্ত্রবিহিত কর্মই কর্তব্য-কর্ম । হিন্দুর কর্মজীবনে ও ধর্মজীবনে পার্থক্য নাই, তাই হিন্দুর সাংসারিক-কর্ম-নিয়ামক শাস্ত্রু ধর্মশাস্ত্র । তিন সহস্র-বৎসর পূর্বে প্রবর্তিত কোনো শাস্ত্রবিধি যদি অবস্থার পরিবর্তনে সমাজরক্ষার প্রতিকূল বোধ হয়, তবে তাহা অবশ্যই ত্যাজ্য । কেননা, যুক্তিহীন, গতানুগতিক ভাবে শাস্ত্র অনুসরণ করিলে ধর্মহানি হয় –
কেবলং শাস্ত্রমাশ্রিত্য ন কর্তব্যো বিনির্ণয়ঃ ।যুক্তিহীনবিচারেণ ধর্মহানিঃ প্রজায়তে ।। – বৃহস্পতি
স্বয়ং ব্রহ্মাও যদি অযৌক্তিক কথা বলেন, তবে তাহা তৃণবৎ পরিত্যাগ করিবে ।
অন্যং তৃণমিব ত্যাজ্যমপ্যুক্তং পদ্মজন্মনা – বশিষ্ঠ
৯) ‘যজ্ঞার্থ’ কর্ম কি ? বৈদিক যাগযজ্ঞাদি-ক্রিয়াকাণ্ড সমস্তই রূপাত্মক, উহাদের অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থ আছে । ‘যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ, অতএব যজ্ঞার্থে কর্ম করার এরূপ অর্থও অসঙ্গত নহে যে, ত্যাগের ভাবে কর্মানুষ্ঠান করা । এইরূপ কর্মানুষ্ঠান যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন মানব-জীবন একটি মহাযজ্ঞের আকার ধারণ করে । সেই যজ্ঞের বেদী জগতের হিত, ত্যাগ, আত্মবলিদান এবং যজ্ঞেশ্বর স্বয়ং ভগবান ।’ [গীতায় যজ্ঞতত্ত্ব, বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]
১৩) পঞ্চমহাযজ্ঞ : মানুষ জীবনরক্ষার্থ অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রাণিহিংসা করিতে বাধ হয় । শাস্ত্রকারগণ গৃহস্তের পাঁচ প্রকার ‘সূনা’ অর্থাৎ জীবহিংসা-স্থানের উল্লেখ করেন । যথা – (i)উদূখল, (ii)জাঁতা, (iii)চুল্লী, (iv)জলকুম্ভ ও (v)ঝাঁটা । এগুলি গৃহস্তের নিত্য-ব্যবহার্য, অথচ এগুলি দ্বারা কীটপতঙ্গাদি প্রাণিবধও অনিবার্য, সুতরাং তাহাতে পাপও অবশ্যম্ভাবী । এই পাপমোচনার্থ পঞ্চমহাযজ্ঞের ব্যবস্থা । যথা – (i)অধ্যাপনা (এবং সন্ধ্যোপাসনাদি) ব্রহ্মযজ্ঞ/ঋষিযজ্ঞ, (ii)তর্পণাদি পিতৃযজ্ঞ, (iii)হোমাদি দৈবযজ্ঞ, (iv)কাকাদি-জীবজন্তুকে খাদ্যপ্রদান ভৃতযজ্ঞ ও (v)অতিথি-সৎকার নৃযজ্ঞ । সকলের প্রতিই মানুষের কর্তব্য আছে, এই কর্তব্যকেই শাস্ত্রে ‘ঋণ’ বলে । ত্যাগমূলক পঞ্চযজ্ঞদ্বারা পিতৃঋণ, দেবঋণ ইত্যাদি পরিশোধ করিতে হয় ।
১৪-১৫) গীতায় যজ্ঞবিধি : গীতা সকাম-যজ্ঞেরই বিরোধী, নিষ্কাম-যজ্ঞের নহে । যজ্ঞ, দান ও তপস্যা – এই সকল কর্ম চিত্তশুদ্ধিকর, উহা অবশ্যকর্তব্য; কিন্তু আসক্তি ও ফলকামনা ত্যাগ করিয়া এই সকল কর্ম করিতে হইবে [১৮|৫-৬] । ‘গীতার শ্লোকগুলিতে যে-যজ্ঞের বিধান আছে তাহাতে যদি আমরা কেবল আনুষ্ঠানিক যজ্ঞই বুঝি তাহা হইলে আমরা গীতোক্ত কর্ম-তত্ত্ব যথার্থ বুঝিতে পারিব না; বস্তুত, এই শ্লোকগুলির মধ্যে গভীর গূঢ়ার্থ আছে ।’ – [শ্রীঅরবিন্দ] । ‘যজ্ঞের মর্মভাব ত্যাগ (sacrifice) – [বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ দত্ত]
রহস্য – যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞাদি
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শক্রমেই ‘কাম্য কর্ম’ রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, কিন্তু নিষ্কামভাবে, কর্তব্যানুরোধে । এই রাজসূয়-যজ্ঞের উদেশ্য প্রধানত জরাসন্ধ, শিশুপাল প্রভৃতি ধর্মদ্বেষী অত্যাচারী ‘অসুরগণ’কে নত বা নিহত করিয়া একচ্ছত্র ধর্মরাজ্য সংস্থাপন । কিন্তু ঈদৃশ অশ্বমেধ-যজ্ঞ অপেক্ষাও যে বিশুদ্ধ ত্যাগ-লক্ষণ নৃযজ্ঞাদির শ্রেষ্ঠতা কম নহে, মহাভারতকার সুবর্ণনকুল-উপাখ্যানে তাহাও প্রদর্শন করিয়াছেন ।
সুবর্ণনকুল-উপাখ্যান : এক নকুল যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ-যজ্ঞস্থলে আসিয়া অবিরত লুণ্ঠিত হইতেছিল । দেখা গেল, নকুলটির মুখ ও শরীরের অর্ধাংশ স্বর্ণময় । অদ্ভুত জীবটির অদ্ভুত কর্মের কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে নকুল বলিল – দেখিলাম, কুরুক্ষেত্রে এক উঞ্ছবৃত্তি ব্রাহ্মণ সপরিবারে উপবাসী থাকিয়া অতিথিকে সঞ্চিত সমস্ত যবচূর্ণ প্রদান করিলেন । সেই অতিথির ভোজনপাত্রে যৎকিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্ট অবশিষ্ট ছিল, সেই পবিত্র যবকণার সংস্পর্শে আমার মুখ ও দেহার্ধ স্বর্ণময় হইয়াছে । অপরার্ধ স্বর্ণময় করিবার জন্য আমি নানা যজ্ঞস্থলে যাইয়া লুণ্ঠিত হইলাম, কিন্তু দেখিলাম এ-যজ্ঞ অপেক্ষা সেই ব্রাহ্মণের শক্তুযজ্ঞই শ্রেষ্ঠ; কেননা আমার দেহ স্বর্ণময় হইল না ।
১৭-১৯) জ্ঞানীর কর্ম : ‘উচ্চতর সত্যের অভিমুখ হইলেই কর্ম ত্যাগ করিতে হইবে না – সেই সত্য লাভ করিবার পূর্বে ও পরে নিষ্কাম কর্মসাধনই গূঢ় রহস্য । মুক্ত পুরুষের কর্মের দ্বারা লাভ করিবার কিছুই নাই, তবে কর্ম হইতে বিরত থাকিয়াও তাঁহার কোনো লাভ নাই এবং কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তাঁহাকে কর্ম করিতে বা কর্ম ত্যাগ করিতে হয় না, অতএব যে কর্ম করিতে হইবে (জগতের জন্য, লোক-সংগ্রহার্থে [৩|২০]) সর্বদা অনাসক্ত হইয়া তাহা কর ।’ – শ্রীঅরবিন্দের গীতা
২০) লোকসংগ্রহম্‌ : লোকরক্ষা, সৃষ্টিরক্ষা । এ-স্থলে ‘লোক’ শব্দের অর্থ ব্যাপক । শুধু মনুষ্য-লোকের নহে, দেবাদি সমস্ত লোকের ধারণ-পোষণ হইয়া পরস্পরের শ্রেয় সম্পাদন করিবে । জ্ঞানী পুরুষ সমস্ত জগতের চক্ষু, ইঁহারা যদি নিজের কর্ম ত্যাগ করেন, তাহা হইলে অন্ধতমসাচ্ছন্ন হইয়া সমস্ত জগৎ ধ্বংস না হইয়া যায় না । লোকদিগকে জ্ঞানী করিয়া উন্নতির পথে আনয়ন করা জ্ঞানী পুরুষদিগেরই কর্তব্য ।
২৪) সঙ্করস্য : ‘সঙ্কর’ অর্থ পরস্পর-বিরুদ্ধ পদার্থের মিলন বা মিশ্রণ, উহার ফল সামাজিক বিশৃঙ্খলা । বর্ণসঙ্কর উহার প্রকার বিশেষ । বর্ণসঙ্কর, কর্মসঙ্কর, নানাভাবেই সাঙ্কর্য উপস্থিত হইতে পারে । লোকে স্বধর্মানুসারে কর্তব্য-পালন না করিলেই এইরূপ সাঙ্কর্য উপস্থিত হয় । এ-স্থলে সঙ্কর-শব্দের সাধারণ ব্যাপক অর্থ গ্রহণই কর্তব্য । মূল শ্লোকে “বর্ণের” উল্লেখ নেই [uploader’s comment] ।
শ্লোকের তাৎপর্য – আমি কর্ম না করিলে আমার দৃষ্টান্তের অনুসরণে সকলে স্বীয় কর্তব্য-কর্ম ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিবে । স্বেচ্ছাচারে সাঙ্কর্য ও বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী । সামাজিক বিশৃঙ্খলায় ধর্মলোপ, সমাজের বিনাশ । সুতরাং লোক-শিক্ষার্থ, লোক-সংগ্রহার্থ আমি কর্ম করি, তুমিও তাহাই কর ।
কৃষ্ণই হিন্দুর জাতীয় আদর্শ : ‘আপনি আচরি ধর্ম লোকেরে শিখায়’ – শ্রীচৈতন্য-লীলাপ্রসঙ্গ । অবতারগণ মানব-ধর্ম স্বীকার করিয়া মানবী-শক্তির সাহায্যেই কর্ম করিয়া থাকেন, নচেৎ লোকে তাঁহাদের আদর্শ ধরিতে পারে না । এইভাবে দেখিলে, তাঁহারা আদর্শ মনুষ্য । শ্রীচৈতন্য, ভক্তরূপে স্বয়ং আচরণ করিয়া প্রেমভক্তি শিক্ষা দিয়াছেন । বুদ্ধদেব ত্যাগ ও বৈরাগ্যের প্রতিমূর্তি । শ্রীরামচন্দ্রে কর্তব্যনিষ্ঠার চরমোৎকর্ষ । আর শ্রীকৃষ্ণ সর্বতঃপূর্ণ, সর্বকর্মকৃৎ ।
২৫) নিষ্কাম কর্মের উদ্দেশ্য : দুইটি উদ্দেশ্য – (i)ভগবানের অর্চনা, (ii)সৃষ্টি রক্ষা । জ্ঞানী যদি কর্মত্যাগী হন, তবে জ্ঞান প্রচার করিবে কে ? কর্মে নিষ্কামতা শিক্ষা দিবে কে ? সংসার-কীট কর্মীকে ভগবানের দিকে আকর্ষণ করিবে কে ? কর্মী যদি স্বার্থান্বেষী হন, তবে জগতের দুঃখ মোচন করিবে কে ? তাই প্রহ্লাদ দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন –
‘প্রায়ই দেখা যায়, মুনিরা নির্জনে মৌনাবলম্বন করিয়া তপস্যা করেন, তাঁহারা তো লোকের দিকে দৃষ্টি করেন না । তাঁহারা তো পরার্থনিষ্ঠ নন, তাঁহারা নিজের মুক্তির জন্যই ব্যস্ত, সুতরাং স্বার্থপর ।’
অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে যেমন রামকৃষ্ণ মিশন অথবা ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সন্ন্যাসীবৃন্দ । কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে সেবাধর্মী সন্ন্যাসীবৃন্দের কর্মজীবনের আদর্শ কেবল সমাজ-সেবা বা ভূতহিত নয়, উহা তাঁহাদের শিক্ষার আনুষঙ্গিক ফল এবং উচ্চস্তরে উঠিবার সোপানমাত্র । স্বামী বিবাকানন্দের শিক্ষার মূল কথা ভাগবত-জীবন লাভ, সর্বজীবকে সত্ত্বশুদ্ধ করিয়া ভগবানের দিকে আকৃষ্ট করা । বর্তমান ভারতবাসী তমোগুণাক্রান্ত, রজোগুণের উদ্রেক না হইলে সত্ত্বে যাওয়া যায় না, এই জন্য তিনি কর্মের উপর এত জোর দিয়াছেন ।
‘দেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, সমাজসেবা, সমষ্টির সাধনা, এই সমস্ত যে আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থপরতার হস্ত হইতে পরিত্রাণ লাভ করিয়া অপরের জীবনের সহিত নিজের একত্ব উপলব্ধি করিবার প্রকৃষ্ট উপায় তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই । আদিম স্বার্থপরতার পর ইহা দ্বিতীয় অবস্থা । কিন্তু গীতা আরো উচ্চ তৃতীয় অবস্থার কথা বলিয়াছেন । দ্বিতীয় অবস্থাটি সেই তৃতীয় অবস্থায় উঠিবার আংশিক উপায় মাত্র । সেই এক সর্বাতীত সার্বজনীন ভাগবত সত্তা ও চৈতন্যের মধ্যে মানবের সমগ্র ব্যক্তিত্বকে হারাইয়া ক্ষুদ্র আমিকে হারাইয়া, বৃহত্তর আমাকে পাইয়া যে ভাগবত অবস্থা লাভ করা যায়, গীতায় তাহারই নিয়ম বর্ণিত হইয়াছে ।’ – শ্রীঅরবিন্দের গীতা (সংক্ষিপ্ত) ।
২৬) সন্ন্যাসবাদে ভারতের দুর্দশা :
প্রাচীন ভারত কর্মদ্বারাই গৌরবলাভ করিয়াছিল, শিক্ষা-সভ্যতায়, শিল্প-সাহিত্যে, শৌর্য-বীর্যে জগতে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল । সেই ভারতবাসী আজ অলস, অকর্মা, বাক্যবাগীশ বলিয়া জগতে উপহাসাস্পদ । এ-দুর্দশা কেন ? ভারতকে কর্ম হইতে বিচ্যুত করিল কে ? ভারতে এ-বুদ্ধিভেদ জন্মিল কিরূপে ?
বুদ্ধদেবের অষ্টাঙ্গ পথ, শঙ্করের মায়াবাদ, পরবর্তী ধর্মাচার্যগণের দ্বৈতবাদ, এ-সকলে জ্ঞান, বৈরাগ্য, প্রেম, ভক্তি সবই আছে, কিন্তু কর্মের প্রেরণা নাই, কর্মপ্রশংসা নাই, কর্মোপদেশ নাই । কুরুক্ষেত্রের সমরাঙ্গনে যে শঙ্খধ্বনি উত্থিত হইয়াছিল, ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন’, সে ধ্বনির আর কেহ প্রতিধ্বনি করেন নাই, তেমন কথা ভারতবাসী তিন-সহস্র বৎসরের মধ্যে আর শুনে নাই । মধ্যযুগে সে কেবল শুনিয়াছে – ‘কর্মে জীবের বন্ধন, জ্ঞানেই মুক্তি’, ‘সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেই মানুষ নারায়ণ হয়’ এই সব । ফলে, সংসারে জাতবিতৃষ্ণ, কর্মবিমুখ অদৃষ্টবাদীর সৃষ্টি, দলে-দলে অনধিকারীর সন্ন্যাস গ্রহণ, ধর্মধ্বজী ভিক্ষোপজীবীর সংখ্যাবৃদ্ধি । এইরূপে কালে সমাজ হইতে রজোগুণের সম্পূর্ণ অন্তর্ধান হইল, সত্ত্বগুণাশ্রিত অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তি সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া জ্ঞানভক্তির চর্চায় নিযুক্ত রহিলেন – তমোগুণাক্রান্ত নিদ্রাভিভূত জনসাধারণ শত্রুর আক্রমণে চমকিত হইয়া ‘কপালের লিখন’ বলিয়া চিত্তকে প্রবোধ দিল ।
পূর্বে যে-সকল মহাপুরুষের কথা উল্লিখিত হইল ইঁহারা সকলেই যুগাবতার । সনাতন ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হইলে, সেই গ্লানি নিবারণ করিয়া উহার বিশুদ্ধি ও সময়োপযোগী পরিবর্তন সাধনের জন্যই যুগধর্মের প্রবর্তন হয় । তত্তৎকালে ঐ সকল ধর্মপ্রবর্তনের প্রয়োজন ছিল বলিয়াই এই যুগাবতারগণের আবির্ভাব । ইঁহারা কখনো অনধিকারীকে সোহহং জ্ঞান বা সন্ন্যসাদি উপদেশ দেন নাই । কিন্তু কালের গতিতে যুগধর্মেরও ব্যভিচার হয়, লোকে উহার প্রকৃত মর্ম গ্রহণ করিতে না পারিয়া নানারূপ উপধর্মের সৃষ্টি করে, উহাতেই কুফল ঘটে ।
২৭-৩০) কর্মী ও কর্মযোগী :
প্রশ্নঃ জ্ঞানীও কর্ম করেন, অজ্ঞানও কর্ম করেন, তবে জ্ঞানী ও অজ্ঞানে পার্থক্য কি ?
উত্তরঃ অজ্ঞান ব্যক্তি মনে করেন, কর্ম করি আমি, জ্ঞানী মনে করেন, কর্ম করেন প্রকৃতি । অজ্ঞান ‘আমি’টাকে কর্মের সহিত যোগ করিয়া দেন বলিয়াই ফলাসক্ত হন । সুতরাং অজ্ঞানের কর্ম ভোগ, জ্ঞানীর কর্ম যোগ । কর্মী হইলেই কর্মযোগী হয় না । কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্খা বর্জন ব্যতীত কর্ম যোগে পরিণত হয় না ।
‘কাঁচা আমি’ ও ‘পাকা আমি’ : “মানুষের ভিতর ‘কাঁচা আমি’ ও ‘পাকা আমি’, এই দুই রকম ‘আমি’ আছে । অহঙ্কারী আমি কাঁচা আমি । এ-আমি মহাশত্রু । ইহাকে সংহার করা চাই । মুক্তি হবে কবে, অহং যাবে যবে । সমাধি হলে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়, আর অহং থাকে না । জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে তবে জেনো সে বিদ্যার আমি, ভক্তির আমি, দাস আমি, সে অবিদ্যার আমি নয় । সে পাকা আমি । প্রহ্লাদ, নারদ, হনুমান, এঁরা সমাধির পর ভক্তি রেখেছিলেন; শঙ্করাচার্য, রামানুজ, এঁরা বিদ্যার আমি রেখেছিলেন ।” – শ্রীরামকৃষ্ণ ।
সমাধি : সমাধি হইলেই যে বাহ্য বিষয়ের জ্ঞান লোপ পাইবে, তাঁহার শরীর ও মনের জ্ঞানও লোপ পাইবে, এমন-কি তাঁহার শরীর দগ্ধ করিলেও জ্ঞান হইবে না, তাহা নহে । সমাধিস্থ ব্যক্তির প্রধান লক্ষণ এই যে, তাঁহার ভিতর হইতে সমস্ত কামনা দূর হয়, সংসারের শুভাশুভ, সুখ-দুঃখ, কর্ম-কোলাহলে মন সম্পূর্ণ অবিচলিত থাকে, তিনি আত্মার আনন্দেই তৃপ্ত থাকেন – যখন সাধারণের চক্ষুতে তাঁহাকে দেখায় যে, তিনি সাংসারিক বাহ্য-ব্যাপারে ব্যস্ত, তখনো সম্পূর্ণভাবে ভগবানের দিকেই তাঁহার লক্ষ্য থাকে ।
৩৩) স্বভাব কাহাকে বলে ?
জীবমাত্রেই একটি বিশেষ প্রকৃতি লইয়া জন্মগ্রহণ করে এবং প্রকৃতির অনুগামী হইয়া সে কর্ম করে । এই প্রকৃতি কি ? শাস্ত্রকারগণ বলেন, পূর্বজন্মার্জিত ধর্মাধর্ম-জ্ঞানেচ্ছাদিজনিত যে-সংস্কার তাহা বর্তমান জন্মে অভিব্যক্ত হয়; এই সংস্কারের নামই প্রকৃতি । পূর্বে বলা হইয়াছে যে, ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতির প্রেরণায়ই জীব কর্ম করে [৩|২৭-২৯] । বস্তুত, এই প্রাক্তন সংস্কারের মূলেও সেই ত্রিগুণ । পূর্বজন্মের ধর্মাধর্ম কর্মফলে গুণবিশেষের প্রাবল্য বা হ্রাস হইয়া স্বভাবের যে অবস্থা দাঁড়ায়, তাহাই প্রাচীন সংস্কার বা অভ্যাস । কাহারো মধ্যে সত্ত্বগুণের, কাহাতে রজোগুণের, কাহাতে তমোগুণের প্রাবল্য । আবার গুণত্রয়ের সংযোগে নানাবিধ মিশ্রগুণেরও উৎপত্তি হয়; যথা – সত্ত্ব-রজঃ, রজ-স্তমঃ ইত্যাদি । যখন যাহার মধ্যে যে গুণ প্রবল হয়, তখন তাহার মধ্যে সেই গুণের কার্য হইয়া থাকে । ইহাকেই স্বভাবজ কর্ম বলে । এ-স্থলে বলা হইতেছে, জীবের প্রবৃত্তি স্বভাবেরই অনুবর্তন করে, স্বভাবই বলবান, ইন্দ্রিয়ের নিগ্রহে বা শাস্ত্রাদির শাসনে কোন ফল হয় না ।
৩৪) তবে কি জীবের স্বাতন্ত্র্য নাই, তাহার আত্মোন্নতির উপায় নাই ?
আছে । ইন্দ্রিয়সমূহকে নিগ্রহ বা পীড়ন না করিয়া তাহাদিগকে বশীভূত করিতে হইবে । স্ব-স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক, কিন্তু জীবের রাগদ্বেষের বশে যাওয়া উচিত নয় । যিনি রাগদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, তিনি ইন্দ্রিয়ের অধীন নন, ইন্দ্রিয়সমূহই তাঁহার অধীন হয় । এইরূপ আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়দ্বারা স্বকর্ম করিতে হইবে, স্বধর্ম পালন করিতে হইবে [২|৬৪] ।
৩৫) যুগধর্ম : সময়োপযোগী পরিবর্তন সাধনের জন্যই যুগধর্মের প্রবর্তন হয় এবং সনাতন ধর্মের বিশুদ্ধি রক্ষিত হয় । বিশদ : স্বধর্ম বলিতে কি বুঝায় ?
৩৭) ষড়রিপু : (i)কাম, (ii)ক্রোধ, (iii)লোভ, (iv)মোহ, (v)মদ, (vi)মাৎসর্য ।
কাম = যে-কোন রূপ ভোগবাসনা ।
ক্রোধ = বাসনা প্রতিহত হইলেই ক্রোধের উদ্রেক হয় ।
লোভ = মিষ্টরসাদি বা ধনাদির দিকে অতিমাত্রায় আকৃষ্ট হওয়া ।
মোহ = বিষয়-বাসনারূপ অজ্ঞান বা মায়া যা আত্মজ্ঞান আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, উহার অতীত নিত্যবস্তুকে দেখিতে দেয় না ।
মদ = এই অজ্ঞানতার ফলে ‘আমি ধনী’, ‘আমি জ্ঞানী’ এইরূপ অহমিকা ।
মাৎসর্য = পরশ্রীকাতরতা; পরের উন্নতি-দর্শনে নিজের অহমিকার খণ্ডনের ফলে উপস্থিত চিত্তক্ষোভ ।
সুতরাং, ষড়রিপুগুলির ্মূল হইতেছে কাম, কামনা বা বাসনা । এইগুলি এক বস্তুরই বিভিন্ন বিকাশ, এক ভাবেরই বিভিন্ন বিভাব ।
৩৮) বিষয়-বাসনা থাকিতে আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না । যেমন ধূম অপসারিত হইলে অগ্নি প্রকাশিত হয়, ধূলিমল অপসারিত হইলে দর্পণের স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়, প্রসবের দ্বারা জরায়ূ প্রসারিত হইলে ভ্রুণের প্রকাশ হয়, সেইরূপ বিষয়-বাসনা বিদূরিত হলে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয় (সংসারের ক্ষয় হয়) ।
৪৩) আত্মস্বাতন্ত্র্য ও প্রকৃতির বশ্যতা :
জীব যখন ‘পাকা আমি’কে জানিতে পারে, তাঁহার প্রেরণা বুঝিতে পারে, তখন তাহার প্রকৃতির বশ্যতা থাকে না । ‘পাকা আমি’র জ্ঞানের দ্বারা ‘কাঁচা আমি’ দূরীভূত হন – ইহাকেই বলা হইতেছে – আত্মার দ্বারা আত্মাকে স্থির করা বা নিজেই নিজেকে স্থির করা । ইহারই নাম আত্ম-স্বাতন্ত্র্য ।
সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
০২। http://www.scsmathinternational.com
Share:

Total Pageviews

বিভাগ সমুহ

অন্যান্য (91) অবতারবাদ (7) অর্জুন (4) আদ্যশক্তি (68) আর্য (1) ইতিহাস (30) উপনিষদ (5) ঋগ্বেদ সংহিতা (10) একাদশী (10) একেশ্বরবাদ (1) কল্কি অবতার (3) কৃষ্ণভক্তগণ (11) ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু (21) ক্ষুদিরাম (1) গায়ত্রী মন্ত্র (2) গীতার বানী (14) গুরু তত্ত্ব (6) গোমাতা (1) গোহত্যা (1) চাণক্য নীতি (3) জগন্নাথ (23) জয় শ্রী রাম (7) জানা-অজানা (7) জীবন দর্শন (68) জীবনাচরন (56) জ্ঞ (1) জ্যোতিষ শ্রাস্ত্র (4) তন্ত্রসাধনা (2) তীর্থস্থান (18) দেব দেবী (60) নারী (8) নিজেকে জানার জন্য সনাতন ধর্ম চর্চাক্ষেত্র (9) নীতিশিক্ষা (14) পরমেশ্বর ভগবান (25) পূজা পার্বন (43) পৌরানিক কাহিনী (8) প্রশ্নোত্তর (39) প্রাচীন শহর (19) বর্ন ভেদ (14) বাবা লোকনাথ (1) বিজ্ঞান ও সনাতন ধর্ম (39) বিভিন্ন দেশে সনাতন ধর্ম (11) বেদ (35) বেদের বানী (14) বৈদিক দর্শন (3) ভক্ত (4) ভক্তিবাদ (43) ভাগবত (14) ভোলানাথ (6) মনুসংহিতা (1) মন্দির (38) মহাদেব (7) মহাভারত (39) মূর্তি পুজা (5) যোগসাধনা (3) যোগাসন (3) যৌক্তিক ব্যাখ্যা (26) রহস্য ও সনাতন (1) রাধা রানি (8) রামকৃষ্ণ দেবের বানী (7) রামায়ন (14) রামায়ন কথা (211) লাভ জিহাদ (2) শঙ্করাচার্য (3) শিব (36) শিব লিঙ্গ (15) শ্রীকৃষ্ণ (67) শ্রীকৃষ্ণ চরিত (42) শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (9) শ্রীমদ্ভগবদগীতা (40) শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা (4) শ্রীমদ্ভাগব‌ত (1) সংস্কৃত ভাষা (4) সনাতন ধর্ম (13) সনাতন ধর্মের হাজারো প্রশ্নের উত্তর (3) সফটওয়্যার (1) সাধু - মনীষীবৃন্দ (2) সামবেদ সংহিতা (9) সাম্প্রতিক খবর (21) সৃষ্টি তত্ত্ব (15) স্বামী বিবেকানন্দ (37) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (14) স্মরনীয় যারা (67) হরিরাম কীর্ত্তন (6) হিন্দু নির্যাতনের চিত্র (23) হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র ও অন্যান্য অর্থের পরিচিতি (8) হিন্দুত্ববাদ. (83) shiv (4) shiv lingo (4)

আর্টিকেল সমুহ

অনুসরণকারী

" সনাতন সন্দেশ " ফেসবুক পেজ সম্পর্কে কিছু কথা

  • “সনাতন সন্দেশ-sanatan swandesh" এমন একটি পেজ যা সনাতন ধর্মের বিভিন্ন শাখা ও সনাতন সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার জন্য অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গঠন করা হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানা, পাশাপাশি অন্য ধর্মকেও সম্মান দেওয়া। আমাদের লক্ষ্য সনাতন ধর্মের বর্তমান প্রজন্মের মাঝে সনাতনের চেতনা ও নেতৃত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা কুসংষ্কারমুক্ত একটি বৈদিক সনাতন সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এ পথচলায় আপনাদের সকলের সহযোগিতা কাম্য । এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সনাতন ধর্মের যে কেউ লাইক দিয়ে এর সদস্য হতে পারে।