শ্রীভগবান্ উবাচ—
ঊর্দ্ধ্বমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্ ।ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ ॥১॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ বলিলেন) [ঈশ বিমুখ জীবের কর্ম্মনির্ম্মিত এই সংসারটী] ঊর্দ্ধ্বমূলম্ (ঊর্দ্ধ্বমূল অর্থাৎ সর্ব্বোর্দ্ধতত্ত্বস্বরূপ ঈশ্বরে বৈমুখ্য যার মূল) অধঃশাখম্ (অধঃশাখাযুক্ত অর্থাৎ ব্রহ্মাদি যার শাখা) অব্যয়ম্ (জৈব স্বাতন্ত্র্য-কর্ম্মাশ্রিত জনের পক্ষে যার শেষ নাই বলিয়া অবিনশ্বর) অশ্বত্থং (অথচ ভক্তিমান্ জনের পক্ষে কা'ল পর্য্যন্ত থাকিবে না বলিয়া—নশ্বর) প্রাহুঃ (শাস্ত্রে—এইরূপ বলিয়া থাকেন) । ছন্দাংসি (সকাম কর্ম্মোপদেশক বেদবাক্য সকল) যস্য (যে সংসাররূপ অশ্বত্থবৃক্ষের) পর্ণানি (রক্ষণার্থ পত্রস্থানীয়), তং (সেই সংসার বৃক্ষকে) যঃ (যিনি) বেদ (এইরূপ জানেন) সঃ (তিনি) বেদবিৎ (বেদতাৎপর্য্যবেত্তা) ॥১॥
শ্রীভগবান্ কহিলেন—শাস্ত্রে এইরূপ বলিয়া থাকেন যে এই সংসার একটী ঊর্দ্ধ্বমূল ও অধঃশাখ অশ্বত্থ (‘কাল’ থাকে না—এইরূপ) বৃক্ষবিশেষ এবং ইহা অব্যয় । ইহার পোষাক বেদবাক্য সমূহ—এই বৃক্ষের পত্র স্থানীয়—যিনি ইহাকে এইরূপ জানেন তিনিই যথার্থ বেদজ্ঞ ।
তাৎপর্য্য এই যে,—এই সংসার ঊর্দ্ধ্বমূল অর্থাৎ ইহার মূলকারণ সর্ব্বোচ্চ ধামে সংসৃষ্ট—ঈশবৈমুখ্য, এবং অধঃশাখ অর্থাৎ ক্রমশঃ কর্ম্মফলে পশ্বাদি অধম যোনি পর্য্যন্ত পল্লবিত, ইহা একটী অশ্বত্থ অর্থাৎ কা'ল পর্য্যন্ত একভাবে থাকে না—এইরূপ বিনশ্বর, অথচ অব্যয় অর্থাৎ কার্য্যকারণ প্রবাহরূপে নিত্যদৃশ্যমান । সংসার পোষাক কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিসমূহ এই বৃক্ষের পত্রস্তানীয় অর্থাৎ পত্র যেমন বৃক্ষকে পোষণ ও শোভিত করে তদ্রূপ বৈদিক কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিসমূহ এই সংসারকে পোষণ ও উজ্জ্বল করিতেছে । যিনি এই সংসারকে নিত্যাশক্তি মায়াপ্রসূত হইলেও বিনশ্বর, কর্ম্মকাণ্ডীয় শ্রুতিপুষ্ট হইলেও সেই শ্রুতি পরোক্ষবাদ অবলম্বনে প্রকাশিত—এইরূপে বেদার্থ জানেন—তিনিই যথার্থ বেদতত্ত্বজ্ঞ ॥১॥
অধশ্চোর্দ্ধ্বং প্রসৃতাস্তস্য শাখা গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ । অধশ্চমূলান্যনুসন্ততানি কর্ম্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে ॥২॥ |
তস্য (সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের) গুণপ্রবৃদ্ধাঃ (গুণত্রয়ের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত) বিষয়প্রবালাঃ (শব্দাদিবিষয়রূপ পল্লবযুক্ত) শাখা (শাখা স্থানীয় জীবসমূহ) অধঃ (মনুষ্য পশ্বাদি যোনিতে) ঊর্দ্ধ্বং চ (ও দেবাদি যোনিতে) প্রসৃতাঃ (বিস্তৃত হইয়াছে) ; মনুষ্যলোকে (মানুষ জন্মে) কর্ম্মানুবন্ধীনি (ধর্ম্মাধর্ম্মপ্রবৃত্তি অনুসারে) মূলানি (জটা স্থানীয় কতকগুলি মূল) অধঃ চ (নিম্নদিকেও) অনুসন্ততানি (কর্ম্মফলানুসন্ধানহেতু কারণরূপে বিস্তৃত হইয়াছে) ॥২॥
ইহার (এই সংসার বৃক্ষের) কতকগুলি শাখা ঊর্দ্ধ্বে (দেবাদি লোকে) বিস্তৃত, কতকগুলি অধোদেশে (মনুষ্য, পশু ও স্থাবরাদি লোকে) বিস্তৃত এবং ইহারা (প্রকৃতির সত্ত্বাদি) গুণপুষ্ট ও (শব্দাদি) বিষয় সমূহ ইহাদের পল্লব স্বরূপ । আবার অধোদেশেও (এই বৃক্ষের) কতকগুলি মূল প্রসারিত হইয়া কর্ম্মভূমি মনুষ্যলোকে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছে ।
তাৎপর্য্য এই যে—এই নশ্বর অথচ নিত্য সংসারের সমষ্টি প্রকাশে কতকগুলি জীব সত্ত্বগুণ পুষ্ট হইয়া দেবাদি ঊর্দ্ধলোকে এবং কতকগুলি রজস্তমোগুণ প্রভাবে মনুষ্য পশু স্থাবরাদি লোকে অস্মিতাভিনিবেশে ব্যাপ্ত হইয়া বিচরণ করিতেছে । শব্দাদি বিষয় সমূহও এই সংসার-বৃক্ষশাখার পল্লব স্থানীয়—যেহেতু ইহারা জীবের অহঙ্কার-সঞ্জাত পঞ্চ তন্মাত্রেরই বিকারস্বরূপ । আবার প্রধান মূল ঈশ বৈমুখ্য বিপরীত ভাবে ঊর্দ্ধ্বে স্থাপিত হইলেও কতকগুলি পরবর্ত্তী অধোগামী বটবৃক্ষের জটা বা নামাল স্থানীয় মূল, কর্ম্মভূমি মনুষ্যলোকে সংযোজিত রহিয়াছে অর্থাৎ মনুষ্য জন্মের কর্ম্মফল ভোগচেষ্টা—পৃথক্ কারণরূপে এই সংসারবৃক্ষের পুষ্টিরস সরবরাহ করিতেছে ॥২॥
ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা । অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলম্ অসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা ॥৩॥ ততঃ পদং তৎপরিমার্গিতব্যং যস্মিন্ গতা ন নিবর্ত্তন্তি ভূয়ঃ । তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পুরাণী ॥৪॥ |
ইহ (এই মনুষ্যলোকে) অস্য (এই সংসার অশ্বত্থের) রূপং (স্বরূপ) তথা (সেই ঊর্দ্ধ্বমূলত্বাদি প্রকারে) ন উপলভ্যতে (শ্রৌতজ্ঞান ব্যতীত অবগত হওয়া যায় না) [অস্য] (ইহার) অন্তঃ ন (শেষ দেখা যায় না) আদি চ ন (আদিও দৃষ্ট হয় না) সংপ্রতিষ্ঠা চ ন (এবং আশ্রয় ও লক্ষিত হয় না) । সুবিরূঢ়মূলম্ (মায়াবাদের অতীত ঈশ বৈমুখ্যরূপ সুদৃঢ়মূল) এনং (এই) অশ্বত্থম্ (বাস্তব বিনশ্বর সংসার বৃক্ষকে) দৃঢ়েন (সাধুসঙ্গ জাত তীব্র) অসঙ্গশস্ত্রেণ (বৈরাগ্যরূপ কুঠার দ্বারা) ছিত্ত্বা ([ব্যক্তিগত সংসার] ছেদব করিয়া) ততঃ (তদনন্তর) যস্মিন্ (যে পদ) গতাঃ [সন্তঃ] (প্রাপ্ত হইয়া) [কেচিদপি] (কেহই) ভূয়ঃ (পূনর্ব্বার) ন নিবর্ত্তন্তি (প্রত্যাবর্ত্তন করেন না), যতঃ (যাঁর মায়া হইতে) [এষা] (এই) পুরাণী (চিরন্তন) প্রবৃত্তিঃ (সংসারপ্রবাহ) প্রসৃতা (প্রবাহিত হইয়াছে) তম্ এব চ (সেই) আদ্যং (আদি) পুরুষং (পুরুষের) প্রপদ্যে (শরণ লইতেছি), [ইতি এবং] (এইরূপে) [একান্তভক্ত্যা] (অনন্য ভক্তি দ্বারা) তৎপদং (সেই বিষ্ণুর পরমপদ) পরিমার্গিতব্যং (অভিগমন করা কর্ত্তব্য) ॥৩–৪॥
এই মনুষ্যলোকে সংসাররূপ অশ্বত্থ বৃক্ষের সেই স্বরূপ অর্থাৎ ঊর্দ্ধ্বমূলত্বাদি (শ্রৌতজ্ঞান ব্যতীত) জানা যায় না, বা ইহার আদি, অন্ত ও আশ্রয় দেখিতে পাওয়া যায় না । ঈশবৈমুখ্যরূপ সুদৃঢ়মূল এই অবাস্তব সংসাররূপ অশ্বত্থবৃক্ষকে সাধুসঙ্গজাত তীব্রবৈরাগ্যরূপ কুঠার দ্বারা (ব্যক্তিগত সংসার বৃক্ষ) ছেদন করিয়া তদনন্তর যে পদ লাভ করিলে কেহই পুনরায় প্রত্যাবর্ত্তন করেন না, যাঁহার মায়া হইতে এই চিরন্তনী সংসার বৃক্ষের প্রবর্ত্তন ও প্রসারণ হইয়াছে,—সেই আদি পুরুষ পরমেশ্বরের আমি শরণাপন্ন হইলাম—এই প্রকারে ঐকান্তিক ভক্তি দ্বারা সেই বিষ্ণুর পরমপদের অভিগমন করা কর্ত্তব্য ॥৩–৪॥
নির্ম্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ । দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈ গর্চ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ ॥৫॥ |
নির্ম্মানমোহাঃ (অভিমান ও মিথ্যাভিনিবেশশূন্য) জিতসঙ্গদোষা (দুঃসঙ্গরূপ দোষরহিত) অধ্যাত্মনিত্যাঃ (নিত্যানিত্য বস্তুর বিচারপরায়ণ) বিনিবৃত্তকামাঃ (সম্পূর্ণভাবে ভোগবাসনা রহিত) সুখদুঃখসংজ্ঞৈঃ (সুখ ও দুঃখাদি নামক) দ্বন্দ্বৈঃ (দ্বন্দ্বসমূহ হইতে) বিমুক্তাঃ (বিমুক্ত) [অতএব] অমূঢ়াঃ [সন্তঃ] (অজ্ঞানমুক্ত হইয়া) [তে] (সেই শরণাগতগণ) তৎ (সেই) অব্যয়ং (নিত্য) পদম্ (পরমপদ) গচ্ছন্তি (প্রাপ্ত হন) ॥৫॥
সেই শরণাগত জনগণ অভিমান ও মোহশূন্য, সঙ্গদোষ রহিত, নিত্যাত্মার অনুশীলন তৎপর, ভোগাভিলাষ শূন্য এবং সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব ও অজ্ঞান মুক্ত হইয়া সেই পরমপদ লাভ করেন ॥৫॥
ন তদ্ভাসয়তে সূর্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ । যদ্গত্বা ন নিবর্ত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম ॥৬॥ |
যৎ (যে ধাম) গত্বা (লাভ করিয়া) [প্রপন্নাঃ] (শরণাগত ব্যক্তিগণ) [ততঃ] (তাহা হইতে) ন নিবর্ত্তন্তে (প্রত্যাবৃত হন না) তৎ (তাহা) মম (আমার) পরমং (সর্ব্বপ্রকাশক) ধাম (চিন্ময় নিবাস) । তৎ (তাহাকে) সূর্য্যঃ (সূর্য্য) ন ভাসয়তে (প্রকাশ করিতে পারে না) ন শশাঙ্কঃ ( না চন্দ্র) ন পাবকঃ (না অগ্নি অর্থাৎ কেহই প্রকাশ করিতে পারে না) ॥৬॥
যে স্থান প্রাপ্ত হইয়া (প্রপন্ন জনগণ) তাহা হইতে আর প্রত্যাবর্ত্তন করেন না—তাহাই আমার পরম (সর্ব্বপ্রকাশক) ধাম । তাহাকে সূর্য্য, চন্দ্র ও অগ্নি ইহাদের কেহই প্রকাশ করিতে পারে না ॥৬॥
মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ । মনঃ ষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥৭॥ |
জীবভূতঃ (জীবরূপ) মম এব (আমারই) অংশ (বিভিন্নাংশ বা শক্তিবিশেষ) [অতএব] সনাতনঃ (নিত্য) জীবলোকে (এই জগতে) প্রকৃতিস্থানি (প্রকৃতির কার্য্য) মনঃষষ্ঠানি (মন সহ ছয়টী) ইন্দ্রিয়াণি (জ্ঞানেন্দ্রিয়কে) কর্ষতি (আকর্ষণ বা বহন করিতেছে) ॥৭॥
আমারই অংশ (অর্থাৎ বিভিন্নাংশ শক্তিবিশেষ) জীবতত্ত্ব সনাতন হইয়াও প্রকৃতির অন্তর্গত (মায়া কল্পিত) মন ও পঞ্চেন্দ্রিয় বহন করিয়া থাকে ॥৭॥
শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ । গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ ॥৮॥ |
ঈশ্বরঃ (দেহাদির স্বামী জীবাত্মা) যৎ (যে) শরীরম্ (দেহ) অবাপ্নোতি (প্রাপ্ত হন) যৎ চ অপি (ও যে শরীর হইতে) উৎক্রামতি (নিষ্ক্রান্ত হন), [তদা] (তখন) বায়ুঃ (বায়ুর) আশয়াৎ (পুষ্পাদি আধার হইতে) গন্ধান্ ইব (গন্ধ গ্রহণের ন্যায়) এতানি (এই ছয়টী ইন্দ্রিয়কে) গৃহীত্বা (গ্রহণ পূর্ব্বক) [শরীরান্তরং] (শরীরান্তরে) সংযাতি (গমন করেন) ॥৮॥
দেহাদির অধীশ্বর জীব যখন শরীর হইতে নির্গত হন তখন তিনি—বায়ুর পুষ্পাদি আধার হইতে গন্ধ গ্রহণের ন্যায়—এই সকল ইন্দ্রিয়কে সঙ্গে লইয়াই দেহান্তরে গমন করেন ॥৮॥
শ্রোত্রঞ্চক্ষুঃ স্পর্শনঞ্চ রসনং ঘ্রাণমেব চ । অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে ॥৯॥ |
অয়ং (এই জীব) শ্রোত্রং (কর্ণ) চক্ষুঃ (চক্ষু) স্পর্শনং (ত্বক্) রসনং চ (জিহ্বা) ঘ্রাণম্ এব চ (ও নাসিকা) মনঃ চ (এবং মনকে) অধিষ্ঠায় (আশ্রয় করিয়া) বিষয়ান্ (শব্দাদি বিষয় সমূহ) উপসেবতে (উপভোগ করেন) ॥৯॥
এই জীব কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্, জিহ্বা ও নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দ ও স্পর্শাদি বিষয় সকল উপভোগ করিতে থাকে ॥৯॥
উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভুঞ্জানং বা গুণান্বিতম্ । বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানবক্ষুষঃ ॥১০॥ |
বিমূঢ়াঃ (অবিবেকিগণ) উৎক্রামন্তং (দেহ হইতে গমনকালে) বা স্থিতং (বা দেহে অবস্থান কালে) ভূঞ্জানং বা অপি (কি বিষয় ভোগ কালেও) গুণান্বিতম্ (ইন্দ্রিয়াদি সমন্বিত) [জীবং] (জীবাত্মাকে) ন অনুপশ্যন্তি (দেখিতে পায় না), [কিন্তু] জ্ঞানচক্ষুষঃ (বিবেকিগণ) পশ্যন্তি (দর্শন করেন) ॥১০॥
মূঢ় মানবগণ জীবাত্মার উক্তরূপ দেহ পরিত্যাগ, দেহে অবস্থান ও বিষয়ভোগ কিছুই দেখিতে পায় না, কিন্তু জ্ঞান-চক্ষুযুক্ত ব্যক্তিসকল এ সমুদয়ই দেখিতে পান ॥১০॥
যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্ । যতন্তোঽপ্যকৃতাত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ ॥১১॥ |
যতন্তঃ (যত্নশীল) যোগিনঃ চ (যোগিগণও) আত্মনি (দেহে) অবস্থিতম্ (অবস্থিত) এনং (এই জীবাত্মাকে) পশ্যন্তি (দর্শন করেন) ; যতন্তঃ অপি (যত্ন করিয়াও) অকৃতাত্মানঃ (অশুদ্ধ চিত্ত) অচেতসঃ (অবিবেকিগণ) এনং (এই জীবাত্মাকে) ন পশ্যন্তি (দেখিতে পায় না) ॥১১॥
যত্নশীল কোন কোন যোগীও শরীরে অবস্থিত এই জীবাত্মাকে দর্শন করেন ; কিন্তু অশুদ্ধচিত্ত অবিবেকিগণ যত্ন করিয়াও এই জীবাত্মাকে দেখিতে পায় না ॥১১॥
যদাদিত্যগতং তেজো জগদ্ভাসয়তেঽখিলম্ । যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তত্তেজো বিদ্ধি মামকম্ ॥১২॥ |
আদিত্যগতং (সূর্য্যস্থিত) যৎ (যে) তেজঃ (তেজ), চন্দ্রমসি (চন্দ্রে) যৎ (যে তেজ) অগ্নৌ চ (ও অগ্নিতে) যৎ (যে তেজ) অখিলম্ (সমগ্র) জগৎ (ব্রহ্মাণ্ডকে) ভাসয়তে (প্রকাশিত করে) তৎ (সেই সমস্ত তেজ) মামকম্ (আমারই) তেজঃ (তেজ বলিয়া) বিদ্ধি (জানিও) ॥১২॥
সূর্য্যস্থিত যে তেজ অখিল জগৎকে প্রকাশ করে, চন্দ্র ও অগ্নিতে যে তেজ বিরাজমান, সেই সমুদয় আমারই তেজ বলিয়া জানিব ॥১২॥
গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা । পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্ব্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ ॥১৩॥ |
অহম্ (আমি) গাম্ (পৃথিবীতে) আবিশ্য চ (অধিষ্ঠীত হইয়া) ওজসা (নিজ শক্তি দ্বারা) ভূতানি (চরাচর প্রাণিগণকে) ধারয়ামি (ধারণ করিতেছি) রসাত্মকঃ চ (ও অমৃতময়) সোমঃ ভূত্বা (চন্দ্র হইয়া) সর্ব্বাঃ (সমস্ত) ওষধীঃ (ব্রীহি ও যবাদি ওষধিগণকে) পুষ্ণামি (পোষণ করিতেছি) ॥১৩॥
আমি পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত হইয়া নিজ শক্তি দ্বারা জীবগণকে ধারণ করিতেছি ; আবার অমৃতময় চন্দ্র স্বরূপে সমুদয় (ব্রীহি ও যবাদি) ওষধিগণকে পোষণ করিতেছি ॥১৩॥
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ । প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্ব্বিধম্ ॥১৪॥ |
অহং (আমি) বৈশ্বানরঃ (জঠরাগ্নি) ভূত্বা (হইয়া) প্রাণিনাং (প্রাণিগণের) দেহম্ (শরীরকে) আশ্রিতঃ (আশ্রয় করিয়া) প্রাণাপানসমাযুক্তঃ (প্রাণ ও অপান বায়ুর সহযোগে) চতুর্ব্বিধম্ (চারি প্রকার) অন্নং (অন্ন) পচামি (পরিপাক করিয়া থাকি) ॥১৪॥
আমি জঠরানল রূপে জীবদেহ আশ্রয় পূর্ব্বক প্রাণ ও অপান বায়ুর সহযোগে চর্ব্ব্য-চুষ্যাদি চতুর্ব্বিধ আহার্য্য পরিপাক করিয়া থাকি ॥১৪॥
সর্ব্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনঞ্চ । বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্বেদবিদেব চাহম্ ॥১৫॥ |
অহং (আমি) সর্ব্বশ্য চ (সকল প্রাণীরই) হৃদি (হৃদয়ে) সন্নিবিষ্টঃ (অন্তর্য্যামিরূপে অবস্থিত) মত্তঃ (আমা হইতে) [জীবস্য] (জীবের) স্মৃতিঃ (পূর্ব্বানুভূত বিষয়ের স্মরণ) জ্ঞানম্ (জ্ঞান) অপোহনং চ (ও তদুভয়ের বিলোপ হয়) ; সর্ব্বৈঃ চ (এবং সকল) বেদৈঃ (বেদের দ্বারা) অহম্ এব (একমাত্র আমিই) বেদ্যঃ (জ্ঞেয়), অহম্ এব (আমিই) বেদান্তকৃৎ (বেদব্যাসরূপে বেদান্ত কর্ত্তা) বেদবিৎ চ (ও বেদার্থবেত্তা) ॥১৫॥
আমি সমস্ত জীবেরই হৃদয়ে (অন্তর্যামিস্বরূপে) অবস্থিত, আমা হইতে জীবের (কর্ম্মানুসারে) স্মৃতি ও জ্ঞান এবং তদুভয়ের বিলোপ হয় ; আমিই সমস্ত বেদের একমাত্র জ্ঞাতব্য (রসময়) তত্ত্ব, আমিই বেদান্ত রচনাকারী অর্থাৎ বেদব্যাসরূপে জ্ঞেয় বেদার্থ নির্ণয়কারী ও আমিই বেদ-তাৎপর্য্য-বেত্তা ॥১৫॥
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ । ক্ষরঃ সর্ব্বাণি ভূতানি কূটস্থোঽক্ষর উচ্যতে ॥১৬॥ |
লোকে (চতুর্দ্দশ ভুবনে) ক্ষরঃ চ (ক্ষর) অক্ষরঃ চ (ও অক্ষর) ইমৌ (এই) দ্বৌ এব (দুইটি মাত্র) পুরুষৌ (চেতন তত্ত্ব) [স্তঃ] (রহিয়াছেন), [তয়োঃ] (তাহার মধ্যে) সর্ব্বাণি (ব্রহ্মাদিস্থাবরান্ত) ভূতানি (প্রাণিসকল) ক্ষরঃ (স্বরূপ হইতে বিচ্যুত হয় বলিয়া ক্ষর), কূটস্থঃ (এবং অবিচ্যুত স্বরূপে নিত্য অবস্থিত ভগবৎ-পার্ষদতত্ত্ব) অক্ষরঃ (অক্ষর শব্দে) [বিদ্বদ্ভিঃ] (জ্ঞানিগণ কর্ত্তৃক) উচ্যতে (কথিত হন) ॥১৬॥
জগতে ক্ষর ও অক্ষর এই দুইটী মাত্র পুরুষ বর্ত্তমান ; তাহার মধ্যে ব্রহ্মাদি স্থাবর পর্য্যন্ত প্রাণিসমূহ (স্ব-স্বরূপ হইতে বিচ্যুত হয় বলিয়া) ক্ষর, ও অবিচ্যুত স্বরূপে নিত্য অবস্থিত [ভগবৎ-পার্ষদ] তত্ত্বই অক্ষর শব্দবাচ্য ॥১৬॥
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ । যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥১৭॥ |
তু (কিন্তু) অন্যঃ (অক্ষর পুরুষরূপ পার্ষদতত্ত্ব হইতে ভিন্ন) উত্তমঃ (উৎকৃষ্ট) পুরুষঃ (পুরুষ) পরমাত্মা (সেই পরমাত্মারূপ অক্ষর পুরুষ) ইতি (এই শব্দে) উদাহৃতঃ (কথিত হন) । যঃ (যিনি) ঈশ্বরঃ (সকলের প্রভু) অব্যয়ঃ [সন] (সনাতনরূপে) লোকত্রয়ম্ (ত্রিজগন্মধ্যে) আবিশ্য (প্রবেশ পূর্ব্বক) বিভর্ত্তি (জীবগণকে পালন করিতেছেন) ॥১৭॥
কিন্তু এতদুভয় হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কোন উৎকৃষ্ট পুরুষকে পরমাত্মা বলা হয় । তিনিই ঈশ্বর এবং সনাতন স্বরূপে লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া জগজ্জনকে পালন করিতেছেন ॥১৭॥
যস্মাৎ ক্ষরমতীতোঽহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ । অতোঽস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ ॥১৮॥ |
যস্মাৎ (যেহেতু) অহম্ (আমি) ক্ষরম্ (ক্ষর পুরুষ জীবের) অতীতঃ (অতীত) অক্ষরাৎ অপি চ (এবং অক্ষর পুরষ মুক্তাত্মা হইতেও) উত্তম (উৎকৃষ্ট তত্ত্ব) অতঃ (অতএব) লোকে (জগতে) বেদে চ (ও বেদাদি শাস্ত্রে) পুরুষোত্তমঃ (পুরুষোত্তম নামে) প্রথিতঃ [অস্মি] (প্রসিদ্ধ হইয়াছি) ॥১৮॥
যেহেতু আমি ক্ষর পুরুষের অতীত, এবং অক্ষর পুরুষ নিত্যপার্ষদ হইতেও উত্তম, অতএব জগতে ও বেদাদি শাস্ত্রে আমাকেই ‘পুরুষোত্তম’ বলিয়া কীর্ত্তন করে ॥১৮॥
যো মামেবমসংমূঢ়ো জানাতি পুরুষোত্তমম্ । স সর্ব্ববিদ্ভজতি মাং সর্ব্বভাবেন ভারত ॥১৯॥ |
[হে] ভারত ! (হে ভারত বংশীয় !) যঃ (যিনি) অসংমূঢ়ঃ (মোহশূন্য) [সন্] (হইয়া) মাম্ (আমাকে) এবং (পূর্ব্বোক্তপ্রকারে) পুরুষোত্তমম্ (পুরুষোত্তম বলিয়া) জানাতি (জানিতে পারেন), সঃ (তিনিই) সর্ব্ববিৎ (পূর্ণতত্ত্বজ্ঞ) মাং (আমাকে) সর্ব্বভাবেন (সর্ব্বপ্রকারে অর্থাৎ মধুরাদি সর্ব্বরসে) ভজতি (ভজনা করেন) ॥১৯॥
হে ভারত ! যিনি কোনরূপে মোহিত না হইয়া পূর্ব্বোক্ত প্রকারে আমার এই সচ্চিদানন্দ-স্বরূপকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানেন তিনিই পূর্ণতত্ত্বজ্ঞ এবং সর্ব্বপ্রকারে (শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য ও মধুর রসে) আমাকেই ভজন করেন ॥১৯॥
ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ । এতদ্বুদ্ধ্বা বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত ॥২০॥ |
[হে] অনঘ ! (হে নির্ম্মৎসর !) ময়া (আমা কর্তৃক) ইতি (এই প্রকারে) গুহ্যতমং (অতি গোপনীয়) ইদম্ (এই) শাস্ত্রম্ (সর্ব্বশাস্ত্র তাৎপর্য্য) উক্তং (কথিত হইল) । [হে] ভারত ! (হে ভারত !) এতৎ (ইহা) বুদ্ধ্বা (হৃদয়ঙ্গম করিয়া) বুদ্ধিমান্ (সুমেধজন) কৃতকৃত্যঃ চ (পরম কৃত কৃতার্থ) স্যাৎ (হইয়া থাকেন) ॥২০॥
হে নির্ম্মৎসর ! আমি এই প্রকারে অতি গুহ্যতম এই সর্ব্বশাস্ত্র তাৎপর্য্য তোমাকে বলিলাম । হে ভারত ! ইহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া সুমেধজন পরম কৃতকৃতার্থ হইয়া থাকেন ॥২০॥
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষদ্সু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে পুরুষোত্তমযোগ নাম পঞ্চদশোঽধ্যায়ঃ ॥১৫॥ |
গ্রন্থ-সম্পাদক—
ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল
(১) সংসারবৃক্ষ (বৈদিক বর্ণনা) – এস্থলে সংসারকে অশ্বত্থ বৃক্ষের সহিত তুলনা করা হইয়াছে । এই সংসারবৃক্ষ ঊর্ধ্বমূল, কেননা পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা হইতেই এই বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে । এই হেতু ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা হয় । [কঠ ৬|১, মভাঃ অশ্ব ৩৫|৪৭] । এই বৃক্ষের শাখাস্থানীয় মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার প্রভৃতি পরিণামগুলি ক্রমশঃ অধোগামী, এই হেতু ইহা অধঃশাখ । পুরুষোত্তম বা পরব্রহ্ম হইতে কিরূপে প্রকৃতির বিস্তার হইয়াছে তাহা জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগে বংশবৃক্ষে দ্রষ্টব্য । এই সংসারবৃক্ষ অব্যয়, কারণ ইহা অনাদি কাল হইতে প্রবৃত্ত । বেদত্রয় এই সংসারবৃক্ষের পত্র, কারণ পত্রসমূহ যেমন বৃক্ষের আচ্ছাদনহেতু রক্ষার কারণ, সেইরূপ বেদত্রয়ও ধর্মাধর্ম প্রতিপাদন দ্বারা ছায়ার ন্যায় সর্বজীবের রক্ষক ও আশ্রয়স্বরূপ । এই সংসারবৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ, কারণ সমূল সংসারবৃক্ষকে জানিলে জীব, জগৎ, ব্রহ্ম এই তিনেরই জ্ঞান হয়, আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না ।
(২) সংসারবৃক্ষ (সাংখ্য-দৃষ্টিতে বর্ণনা) – এই সংসার প্রকৃতিরই বিস্তার । সুতরাং ঐ বৃক্ষের শাখাসকল গুণপ্রবৃদ্ধ, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, এই তিন গুণের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত । শব্দ-স্পরশাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণপল্লব-স্থানীয় । এই হেতু উহা বিষয়-প্রবাল । উহার শাখাসমূহ ঊর্ধ্ব ও অধোদিকে বিস্তৃত অর্থাৎ কর্মানুসারে জীবসকল অধোদিকে পশ্বাদি যোনিতে এবং ঊর্ধ্ব দিকে দেবাদি যোনিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে । উহার বাসনারূপ মূলসকল কর্মানুবন্ধী অর্থাৎ ধর্মাধর্মরূপ কর্মের প্রসূতি । এই মূলসকল অধোদিকে মনুষ্য-লোকে বিস্তৃত রহিয়াছে, কারণ মনুষ্যগণেরই কর্মাধিকার ও কর্মফল বিশেষরূপে প্রসিদ্ধ ।
(৬) তিনি স্বপ্রকাশ । তাঁহার প্রকাশেই জগৎ প্রকাশিত । জড় পদার্থ চন্দ্র-সূর্যাদি তাঁহাকে প্রকাশ করিবে কিরূপে ? এই শ্লোকটি প্রায় অক্ষরশঃই শ্বেতাশ্বতর ও কঠোপনিষদে আছে ।
(৭) জীব ও ব্রহ্মে ভেদ ও অভেদ – জীব ও ব্রহ্ম এক, না পৃথক্ ?
এ সম্বন্ধে নানারূপ মতভেদ লইয়াই দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে । গীতার নানাস্থলেই জীবব্রহ্মৈক্যবাদই স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় । যেমন শ্রীভগবান্ বলিতেছেন – “আমিই সর্বভূতাশয়স্থিত আত্মা” [১০|২০], “আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও” [১৩|২], “আসুরী প্রকৃতির লোক শরীরস্থ আমাকে কষ্ট দেয়” [১৭|৬] । এই সকল স্থলে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ভগবান্ই দেহে জীবরূপে অবস্থিত আছেন । ‘তত্ত্বমসি’, ‘সোহহং’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ – চারি বেদের এই চারিটি মহাবাক্যও এই সত্যই প্রচার করিতেছে যে, জীবই ব্রহ্ম ।
কিন্তু শ্রীভগবান্ এও বলিতেছেন – “জীব আমার সনাতন অংশ” [১৫|৭] । এ অংশ কিরূপ ? অদ্বৈতবাদী বলেন – ব্রহ্ম অখণ্ড, অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব, অদ্বয় বস্তু, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না । এ স্থলে ‘অংশ’ বলিতে মহাকাশের অংশ ঘটাকাশ (ঘটের মধ্যে যে আকাশ আছে) বুঝিতে হইবে । ঘট ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে । জীবেরও দেহোপাধিপশতঃ ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্তাই অবশিষ্ট থাকে (‘ব্রহ্মাদ্বয়ং শিষ্যতে’) ।
অচিন্ত্য-ভেদাভেদবাদ – এই গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে জীব ও ঈশ্বর উভয়েই চিদ্রূপ – চেতন । এই নিমিত্ত অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের চেতনাংশের সাদৃশ্যেই উভয়ের একত্ব । যেমন তেজোময় সূর্য হইতে অনন্ত রশ্মি বহির্গত হয়, অথবা অগ্নিপিণ্ড হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপ ব্রহ্ম হইতে জীবসমূহের উৎপত্তি । অগ্নি ভিন্ন স্ফুলিঙ্গের পৃথক্ অস্তিত্ব নাই, ব্রহ্ম ভিন্নও জীবের পৃথক্ সত্তা নাই । স্ফুলিঙ্গ অগ্নিই বটে, কিন্তু ঠিক অগ্নিও নয়, অগ্নি-কণা । জীব ও ব্রহ্মেও সেইরূপ অভেদ ও ভেদ আছে, জীব ব্রহ্মকণা ।
(৮-১০) জন্মান্তর-রহস্য – জীবের উৎক্রান্তি – সূক্ষ শরীর
প্রশ্ন#1 – আত্মা অকর্তা, উদাসীন, নিত্যমুক্ত । প্রকৃতি বা দেহ-বন্ধনবশতঃই তিনি বদ্ধ হন । মৃত্যুর পর যখন সেই দেহ-বন্ধন চলিয়া যায়, তখনই ত তিনি মুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপ লাভ করিতে পারেন । তখন আর প্রকৃতি থাকে কোথায় ?
প্রশ্ন#2 – জীব একদেহে পাপপুণ্যাদি সঞ্চয় করে, জন্মান্তরে অন্য দেহে তাহার ফল ভোগ করে, এই বা কিরূপ ব্যবস্থা ?
উত্তর – সাংখ্যের সৃষ্টিতত্ত্ব অনুসারে শরীর তিনরকম – (1) স্থূলশরীর – পঞ্চ স্থূলভূত (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, অপ্, পৃথিবী) দ্বারা নির্মিত, চর্মচক্ষে দৃশ্যমান্; (2) সূক্ষশরীর বা লিঙ্গ-শরীর – মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, দশেন্দ্রিয়, মন ও পঞ্চতন্মাত্র (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) দ্বারা গঠিত (মোট ১৮টি সাংখ্যোক্ত তত্ত্ব); জ্ঞানচক্ষুদ্বারা দৃশ্যমান্; (3) কারণ-শরীর – সকলের মূল কারণ প্রকৃতি ।
মৃত্যুকালে পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীরই বিনষ্ট হয়, সূক্ষ শরীর লইয়া জীব উৎক্রমণ করে এবং পূর্ব কর্মানুযায়ী নূতন স্থূল-দেহ ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ শরীর লইয়াই পাপপুণ্যাদি ফলভোগ করে এবং এই কারণেই উহার মন, বুদ্ধি, ধর্মাধর্মাদি সংস্কার অর্থাৎ স্বভাব পূর্বজন্মানুযায়ীই হয় । তবে জন্মগ্রহণ-কালে পিতামাতার দেহ হইতে লিঙ্গ-শরীর যে দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লয় তাহাতে তাহার দেহ-স্বভাবের ন্যূনাধিক ভাবান্তর ঘটিয়া থাকে । সুতরাং, কেবল স্থূল দেহের সংসর্গ লোপ হইলেই জীবের মুক্তি হয় না, সূক্ষ শরীরও যখন লোপ পায়, তখনই জীবের সত্যস্বরূপ প্রতিভাত হয় ।
এস্থলে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনকেই সূক্ষ শরীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে [১৫|৯] । দ্রষ্টব্য এই, ‘ইন্দ্রিয়’ বলিতে চক্ষু-কর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বুঝায় না, উহা স্থূল দেহের অন্তর্গত – প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তিই সূক্ষ তত্ত্ব । বেদান্তমতে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন (মোট ১৭টি অবয়বে) সূক্ষ শরীর গঠিত । সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূক্ত ।
যোগিগণ সূক্ষদেহ লইয়া স্থূলদেহ হইতে বহির্গত হইয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন (মহাভারতে জনক-সুলভা সংবাদ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য) ।
(১৩) শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ।
(১৪) দেহ যন্ত্রে এক খণ্ড রুটি ফেলিয়া দিলে উহা রক্তে পরিণত হয় । দেহাভ্যন্তরীণ কি কি প্রক্রিয়াদ্বারা এই পরিপাক-ক্রিয়া সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান বলিতে পারে । কিন্তু কোন, শক্তিবলে এই কার্য সাধিত হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান জানে না । উহা ঐশ্বরিক শক্তি ।
(১৫) আত্মচৈতন্য প্রভাবে জীবের স্মৃতি ও জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে এবং যে মোহবশতঃ স্মৃতি ও জ্ঞানের লোপ হয়, সেই মোহও ইহা হইতেই জাত । সমস্ত বেদেই তাঁহাকে জানিতে উপদেশ করেন । বেদব্যাসাদিরূপে তিনিই বেদার্থ-প্রকাশক এবং বেদবেত্তা বা ব্রহ্মবেত্তাও তিনিই, ব্রহ্ম না হইলে ব্রহ্মকে জানা যায় না ।
(১৮) পুরুষোত্তম-তত্ত্ব
এস্থলে তিনটি পুরুষের কথা বলা হইতেছে – (1) ক্ষর, (2) অক্ষর ও (3) উত্তম (পুরুষোত্তম) । ইহার কোন্টিতে কোন্ তত্ত্ব প্রকাশ করে ? শ্রীভগবান বলিতেছেন – “ক্ষর পুরুষ সর্বভূত, অক্ষর কূটস্থ এবং আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম ।” [১৫|১৬-১৮]
নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব এবং সগুণ-ব্রহ্ম
সাধারণতঃ কূটস্থ অক্ষর বলিতে নির্গুণ নির্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্বই বুঝায় । উপনিষদে এবং ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মই অদ্বয় পরতত্ত্ব । ব্রহ্মস্বরূপ কোথাও নির্গুণ, কোথাও সগুণ, কোথাও সগুণ-নির্গুণ উভয়রূপেই বর্ণনা করা হইয়াছে । শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি উপনিষদে মূল তত্ত্বের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, পুরুষ প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে । ভাগবত-শাস্ত্রে উপনিষদের এই দেব, ঈশ্বর বা সগুণ-ব্রহ্মই পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব অপেক্ষা ইঁহাকে শ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া হইয়াছে; কেননা ভক্তিমার্গে অনির্দেশ্য অচিন্ত্য নির্গুণ তত্ত্বের বিশেষ উপযোগিতা নাই । মহাভারতের নারায়ণীয় পর্বাধ্যায়ে (যাহা ভাগবত শাস্ত্রের বা সাত্বত ধর্মের মূল) এই পুরুষোত্তম শব্দ পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং তিনি নির্গুণ হইয়াও গুণধারক, তিনিই অব্যয়, পরমাত্মা, পরমেশ্বর, ইহা স্পষ্টই বলা হইয়াছে । পুরাণাদিতে ভগবান্ পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব ও পরব্রহ্ম বলিয়া কীর্তিত এবং অনেক স্থানেই তাঁহার নির্বিশেষ নির্গুণ স্বরূপ অপেক্ষা সবিশেষ সগুণ বিভাবেরই বৈশিষ্ট বর্ণিত হইয়াছে । গীতাও ভাগবত ধর্মেরই গ্রন্থ, উহাতেও পুরুষোত্তম বা ভগবত্তত্ত্বই পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ স্বরূপ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং উহাতেই ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, এরূপ বর্ণনাও আছে [১৪|২৭] ।
“জিকড়ে পহাবে তিকড়ে অপার ।
কোনীকড়ে নাহি পার ।।
এক জিনসী স্বতন্ত্র । দুসরে নাহীঁ ।।
যে দিকে দেখিবে সেই দিকেই অসীম, কোন দিকেই সীমা নাই; একমাত্র বস্তু ও স্বতন্ত্র, তাঁহাতে দ্বৈত বা অন্য কিছুই নাই ।” – [পরব্রহ্মের বর্ণনা, শ্রীসমর্থ রামদাস স্বামী, দা, ২০.২.৩, উদ্ধৃত – কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার, গীতারহস্য, লোকমান্য তিলক, অনুবাদ শ্রীজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ১৬১]
অক্ষরভাব, ক্ষরভাব ও পুরুষোত্তম ভাব
‘ব্রহ্মই সমস্ত’ এই বৈদান্তিক মূলতত্ত্বই গীতার প্রতিপাদ্য । পূর্বোক্ত তিন পুরুষ সেই মূল তত্ত্বেরই বিশ্লেষণ । ঐ তিন পুরুষ এক তত্ত্বেরই তিন বিভাব । এই পরিণামী চেতনাচেতনাত্মক জগৎ (সর্বভূতানি) তাঁহা হইতেই জল-বুদ্বুদের ন্যায় উত্থিত হইয়া আবার তাঁহাতেই বিলীন হয় । তাঁহার অপরা ও পরা প্রকৃতি সংযোগে উহা সৃষ্ট এবং তাঁহার জীবভূতা পরা প্রকৃতিই (ক্ষরভাব) উহা ধারণ করিয়া আছে । অক্ষরভাব – তাঁহার অপরিণামী, নির্বিশেষ, কূটস্থ, নির্গুণ স্বরূপ ।
পুরুষোত্তম ভাবে তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্বভূতের গতি, ভর্তা (পোষণকর্তা), প্রভু (নিয়ন্তা), সাক্ষী (শুভাশুভ দ্রষ্টা), নিবাসঃ (স্থিতি-স্থান), শরণং (রক্ষক), সুহৃৎ (উপকারকর্তা), প্রভবঃ (স্রষ্টা), প্রলয়ঃ (সংহর্তা), স্থানং (আধার), নিধানম্ (লয়স্থান) এবং অবিনাশী বীজস্বরূপ । [৯|১৮]
শ্রীঅরবিন্দ এই তিন তত্ত্বের এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন :-
(1) ক্ষর পুরুষ = সচল পরিণামী ভগবানের বহুরূপ (Multiplicity of the Divine Being) । পুরুষ এই প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র নহে, ইহা প্রকৃতিরই অন্তর্গত ।
(2) অক্ষর পুরুষ = অচল অপরিণামী ভগবানের একরূপ (The Unity of the Divine Being) । প্রকৃতির সাক্ষী, কিন্তু প্রকৃতি ও তাহার কার্য হইতে এই পুরুষ মুক্ত ।
(3) পুরুষোত্তম = পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম, পরম পুরুষ, ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’ । উল্লিখিত পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব এই দুইই (পুরুষ-) উত্তমের ।
(a) ক্ষর রূপে তিনি তাঁহার প্রকৃতির, তাঁহার শক্তির বিরাট্ ক্রিয়ার বলে, তাঁহার ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই নিজেকে সংসারে ব্যক্ত করেছেন ।
(b) অক্ষর রূপে তিনি আরও মহান্ নীরবতা ও অচলতার দ্বারা নিজেকে স্বতন্ত্র নির্লিপ্ত রাখিয়াছেন ।
(c) পুরুষোত্তম রূপে তিনি ‘প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্রতা’ এবং ‘প্রকৃতিতে লিপ্ততা’ এই দুইয়েরই উপরে ।
“পুরুষোত্তম সম্বন্ধে এইরূপ ধারণা উপনিষদে প্রায়ই সূচিত হইলেও গীতাতেই ইহা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং তাহার পর হইতে ভারতীয় ধর্মচিন্তার উপর এই ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে । যে সর্বোত্তম ভক্তিযোগ অদ্বৈতবাদের কঠিন নিগড় ছাড়াইয়া যাইতে চায়, ইহাই (অর্থাৎ এই পুরুষোত্তম-তত্ত্ব) তাহার ভিত্তি; ভক্তিরসাত্মক পুরাণ-সমূহের মূলে এই পুরুষোত্তম-বাদ নিহিত রহিয়াছে ।” – [সাংখ্য ও যোগ, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ১০৬]
কর্ম-জ্ঞান-ভক্তির সমুচ্চয়
পুরুষোত্তম-বাদ দ্বারাই গীতা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমন্বয় সাধন করিয়াছেন । ব্রহ্মবাদে উহা হয় না, কেননা মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয়; সাংখ্যদিগের পুরুষও তদ্রূপ; সুতরাং এই উভয় মতেই কর্মত্যাগ ভিন্ন মোক্ষলাভের অন্য উপায় নাই এবং এই মোক্ষ বা মিলনে ভক্তিরও স্থান নাই । এই হেতু গীতায় নিষ্ক্রিয় অক্ষর-ব্রহ্ম অপেক্ষা ক্রিয়াশীল ‘ভক্তের ভগবান্’ ‘নির্গুণ-গুণী’ ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য । ইনি পুরুষোত্তম ।
সব প্রশ্নের উত্তর – গীতার সমন্বয়
“মায়াবাদীদিগের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয় । সাংখ্যদিগের পুরুষও তদ্রূপ । অতএব, উভয়ের মতেই সংসার ও কর্ম পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসীর জীবন যাপন ভিন্ন মোক্ষলাভের আর অন্য উপায় নাই । কিন্তু, গীতার যোগ এবং বৈদান্তিক কর্মযোগ উভয় মতানুসারেই কর্ম শুধু মোক্ষের সহায় নহে – কর্মের দ্বারাই মোক্ষলাভ হইতে পারে; এবং এই কথারই যুক্তিযুক্ততা গীতা জোরের সহিত পুনঃ পুনঃ বলিয়াছে ।” – [সাংখ্য, যোগ ও বেদান্ত, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ১১৬]
“But if the Supreme is only this immutable Self and the individual is only something that has gone forth from him in the Power, then the moment it returns and takes its poise in the self, everything must cease except the supreme unity and the supreme calm. …Why then this insistence on the most violent and disastrous form of action, this chariot, this battle, this warrior, this divine charioteer ?
The Gita answers by presenting the Supreme as something greater even than the immutable Self, more comprehensive, one who is at once this Self and the Master of works in Nature.” – [The Gist of the Karmayoga, Essays on the Gita, Sri Aurobindo, pp.257]
“ভগবান্ যদি শুধু এই অক্ষর আত্মা হন এবং তাহা হইতে যে সত্তা প্রকৃতির খেলায় বাহির হইয়াছে তাহাই যদি জীব হয়, তাহা হইলে যে মুহূর্তে জীব ফিরিয়া আসিবে ও আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইবে, তখনই সমস্ত বদ্ধ হইয়া যাইবে, কেবল থাকিবে পরম ঐক্য, পরম নিস্তব্ধতা । … তাহা হইলে সর্বাপেক্ষা ভীষণ ও ধ্বংস-সঙ্কুল কর্ম করিতে পুনঃ পুনঃ আদেশ কেন, এই রথ কেন, এই যুদ্ধ কেন, এই যোদ্ধা কেন, এই দিব্য সারথি কেন ?
গীতা এই বলিয়া জবাব দিয়াছেন যে, ভগবান্ অক্ষর আত্মা অপেক্ষাও বড়, আরও অধিক ব্যাপক, তিনি একাধারে এই অক্ষর-ব্রহ্ম বটেন, আবার প্রকৃতির কার্যের অধীশ্বরও বটেন । … জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের মিলনের দ্বারা আত্মা সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি, এক কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম উভয়েরই অধীশ্বর, সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন । ইহাই গীতার সমন্বয় ।” – [কর্মযোগের সারতত্ত্ব, শ্রীঅরবিন্দের গীতা, অনুবাদ শ্রীঅনিলবরণ রায়, পৃঃ২৯২-২৯৩]
(১৯) তিনি সর্বজ্ঞ হন – অর্থাৎ আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিলে আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সগুণ-নির্গুণ, সাকার-নিরাকার, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি সংশয় আর তাঁহার উপস্থিত হয় না; তিনি জানেন, আমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম, আমিই সগুণ বিশ্বরূপ, আমিই সর্বলোক-মহেশ্বর, আমিই লীলায় অবতার, আমিই হৃদয়ে পরমাত্মা, সুতরাং তিনি সকল ভাবেই আমাকে ভজনা করেন ।
সংগ্রহঃ ০১। sanatandharmatattva.wordpress.com
০২। http://www.scsmathinternational.com
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন