সুধিয়ঃ সাধবো লোকে নরদেন নরোত্তমাঃ ।
নাভিদ্রুহ্যন্তি ভূতেভ্যো যর্হি নাত্মা কলেবরম্ ।। ( ভাগবত ৪\২০\৩ )
মহারাজ অঙ্গ রাজত্ব ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় প্রজাগণের মধ্যে অরাজকতা দেখা দিয়েছিল । তখন ব্রহ্মবাদী ভৃগু প্রমুখ মুনি মাতা সুনীথাকে আহ্বান করে ও তাঁর সম্মতি নিয়ে বেনকে পৃথিবীর অধিপতিপদে অভিষিক্ত করেছিলেন । সিংহাসনে আরোহণ করে বেন অষ্ট লোকপাল দেবতার মহিমার অংশভাগীরূপে পরিগণিত হয়ে ঔদ্ধত্য ও অহংকারের চরম সীমা অতিক্রম করল এবং নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে মহাপুরুষের অপমান করতে লাগল । তার নির্দেশ সকল যজ্ঞ , দান বা হোম নিষিদ্ধ করা হল ।
বিপদগামী রাজা বেনকে অযোগ্য জ্ঞান করে মুনিগণ তার উপর অসন্তুষ্ট হলেন । শ্রীভগবান বিষ্ণুর নিন্দাকারী রাজা বেন মৃত্যুমুখে পতিত হলে মুনিগণের পরামর্শে অমাত্যগণ বেনের দেহজাত বালক পৃথুকে সিংহাসনে বসালেন । মুনিগণ দেখলেন যে বালক পৃথু ভগবান বিষ্ণুর ভুবনপালককারী কলা ও লক্ষ্মীর অবতারস্বরূপ সংযোগ হতে উৎপন্ন । রাজাদের মধ্যে পৃথু অগ্রগণ্য হবেন । তাঁরা দেখলেন যে ভগবান শ্রীহরির অংশ পৃথুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন অর্থাৎ তিনি অংশাবতার ।
যখন ব্রাহ্মণগণ পৃথুর স্তুতি কীর্তনে মুখর হলেন , শ্রেষ্ঠ গন্ধর্বগণ গুণগান করতে লাগলেন , সিদ্ধগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন তখন পৃথু সেই অল্প বয়সেই সহাস্যে জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন - ' হে সৌম্য সূত - মাগধ - বন্ধীগণ ! এখনও ইহলোকে আমার কোনো গুণই প্রকাশিত হয়নি । তাহলে আপনারা আমার কোন্ গুণকে অবলম্বন করে স্তুতি করছেন ? আমার সম্পর্কে আপনাদের ব্যক্ত উক্তি না করে অন্য কারো স্তুতি করা উচিত । পুণ্যশ্লোক ভগবান শ্রীহরির গুণকীর্তনের মতো সাধুবাদযোগ্য বিষয় থাকা সত্ত্বেও তুচ্ছ মানুষের স্তব করা কোনো শিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে শোভনীয় নয় । ' উদারচরিত্র ব্যক্তিগণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও খ্যাতিমান হলেও নিজের প্রশংসা বাক্য শ্রবণ করা লজ্জাজনক মনে করে থাকেন ও তার নিন্দা করেন ।
ব্রাহ্মণগণ মহারাজ পৃথুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে তাঁকে প্রজাদের রক্ষকরূপে ঘোষণা করলেন । সেই সময় পৃথিবী অন্নহীন হয়ে গিয়েছিল ; চতুর্দিকে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর শীর্ণ দেহে প্রজারা তখন তাদের প্রভু পৃথুর কাছে এসে নিবেদন করলন - ' আমরা নিরন্ন ও ক্ষুধার জ্বালায় পীড়িত । আপনি আমাদের রক্ষা করুন । '
প্রজাদের দুর্দশার কথা মহারাজ পৃথু শুনলেন । অন্নাভাবের কারণও তিনি অবগত হলেন । তিনি বুঝলেন যে পৃথিবী সমস্ত অন্ন ও ঔষধির বীজ অন্তরে লুকিয়ে রেখেছে । এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তিনি পৃথিবীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধনুর্বাণ তুললেন । উদ্যত অস্ত্র পৃথিবীকে ভীত ও কম্পিত করে তুলল । পৃথিবী তখন গোরূপ ধারণ করে পলায়ন করতে থাকলে মহারাজ পৃথু তার পশ্চাদ্ধাবন করলেন , পৃথুর ক্রোধ থেকে তাঁর রক্ষা পাওয়া কঠিন ছিল । অবশেষে পলায়নে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পৃথিবী মহাভাগ পৃথুকে সম্বোধন করে বললেন - ' হে ধর্মজ্ঞ ও শরণাগত বৎসর মহারাজ ! আপনি সর্বপ্রাণীর রক্ষাকর্তা , আমাকেও রক্ষা করুন । আমি আপনার শরণাগত । '
মহারাজ পৃথু বললেন - ' হে পৃথিবী ! তুমি আমার শাসন অতিক্রম করেছ । তুমি দেবতারূপে যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করো অথচ তার পরিবর্তে আমাদের অনুদান করছ না । '
মহারাজ পৃথু জানতে পারলেন যে পুরাকালে যে সকল ( ধান্যাদি ) ঔষধি সৃষ্ট হয়েছিল তা অসৎ দুরাচারযুক্ত ব্যক্তিগণ ভোগ করছে দেখে পৃথিবীই যজ্ঞের কারণে সমস্ত ঔষুধি নিজের মধ্যে সঞ্চিত রেখেছে । দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় তা জীর্ণ হয়ে পড়ছে ।
তা পূর্বাচার্যগণের প্রদর্শিত পথে উদ্ধার করা সম্ভাব । পৃথিবী আরও বললেন - ' হে লোকপালক মহাবাহু বীব ! আপনি সর্বপ্রাণীর রক্ষায় বলপ্রদায়ক খাদ্য লাভ করতে ইচ্ছা করলে উপযুক্ত বৎস , দোহনপাত্র ও দোহনকর্তা সংগ্রহ করুন । আমি সেই বৎসের প্রতি স্নেহবশত দুগ্ধরূপে আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ করব ।
' হে প্রভু ! আরও একটি নিবেদন শুনুন । আপনি আমাকে সমতল করুন । আমি সমতল হলে জলসম্পদ ধারণ করতে সক্ষম হব । '
মহারাজ পৃথু পৃথিবীর এই প্রিয় ও কল্যাণকর উপদেশ স্বীকার করে নিলেন । তিনি স্বায়ম্ভুব মনুকে বৎস করে নিয়ে নিজের হাতে সমস্ত ধান্যাদি ঔষধি ও শস্য দুগ্ধরূপে দোহন করে নিলেন । অন্যান্য বিজ্ঞজনেরাও এইভাবে পৃথিবীর কাছ থেকে অভীষ্ট বস্তু দোহন করে নিয়েছিলেন । ঋষিগণ বৃহস্পতিকে বৎস করে ইন্দ্রিয় ( বাক্ , মন এবং শ্রোত্র ) পাত্রে দেবী বসুন্ধরার কাছ থেকে বেদরূপ পবিত্র দুগ্ধ দোহন করে নিয়েছিলেন । কপিলদেবকে বৎস করে আকাশরূপ পাত্রে সিদ্ধগণ অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি ও বিদ্যাধরগণ আকাশচারিতা প্রভৃতি বিদ্যা দোহন করেছিলেন ।
পৃথিবীর দ্বারা এইভাবে সর্বজনের সর্বকামনা পূর্তি হওয়ায় মহারাজ পৃথু স্নেহার্দ্রহৃদয় এই সর্বংসহা জীবধাত্রীকে নিজ আদরের কন্যারূপে স্বীকৃতি দিলেন । নিজ ধনুর প্রান্তভাগ দ্বারা বহু পর্বতের ঊর্ধ্বাংশ চূর্ণ করে ভূমির বিশাল অংশ সমতলে পরিণত করলেন । অতঃপর মহারাজ পৃথু প্রজাপালনে রত হলেন । এই সমতলভূমির বিভিন্ন স্থানে প্রজাদের জন্য যথাযোগ্য বাসভূমি বিভাগ করে দিলেন । তিনি গ্রাম , ছোট ও বড় নগর , বহুপ্রকারের দুর্গ , ঘোষপল্লি , গো - মহিষের বাসস্থান , সৈন্যশিবির , খনি ও তৎসন্নিত বাসভূমি , কৃষকপল্লি সবই সুনির্দিষ্টরূপে বিভাগ করে মানুষের বাসস্থানের পরিকল্পিত নির্মাণরীতি প্রবর্তন করলেন ।
এইবার ভগবান মনুর ব্রহ্মাবর্ত ক্ষেত্র - যেখানে সরস্বতী নদী পূর্বমুখে প্রবাহিতা , সেইখানে মহারাজ পৃথু শত অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য দীক্ষিত হলেন । দেবরাজ ইন্দ্র যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন । মহারাজ পৃথুর যজ্ঞে যজ্ঞাত্মা সর্বলোকগুরু জগদীশ্বর ভগবান শ্রীহরি যজ্ঞেশ্বররূপে সাক্ষাৎ দর্শন দিয়েছিলেন । তাঁর সঙ্গে ব্রহ্মা , শিব এবং নিজ নিজ অনুচরবৃন্দ সহ লোকপালগণও উপস্থিত হয়েছিলেন । গর্ন্ধব , মুনি এবং অপ্সরাগণ তখন শ্রীভগবানের স্তুতিগাণ করছিলেন ।
সিদ্ধ , বিদ্যাধর , দৈত্য , দানব , যক্ষ , সুনন্দ - নন্দাদি প্রধান পার্ষদগণ এবং যাঁরা সর্বদাই শ্রীভগবানের সেবার জন্য উৎসুক ছিল কপিল ও নারদ , দত্তাত্রেয় এবং সনকাদি যোগেশ্বরগণ সকলে শ্রীহরির অনুগমন করেছিলেন । যজ্ঞধেনুরূপে উপস্থিত পৃথিবী কামধেনুরূপে যজমান মহারাজকে প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যই প্রদান করেছিলেন । নদীসকল ইক্ষু - দ্রাক্ষাদি সর্বপ্রকার রস বহন করে এনেছিল এবং অতি বৃহৎ মধুবর্ষী বৃক্ষসমূহ দুগ্ধ , দধি , অন্ন এবং ঘৃতাদি বিভিন্ন দ্রব্য প্রদান করেছিল । পর্বতসকল খাদ্যদ্রব্য ও লোকপালগণ বিবিধ উপহার দ্রব্য প্রদান করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু কেবলমাত্র ভগবান শ্রীহরিকে নিজ প্রভু বলে মনে করতেন । শ্রীহরির কৃপায় তাঁর প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল যা ইন্দ্রের ঈর্ষার কারণ হয় । মহারাজ পৃথু যখন অন্তিম ( শততম ) যজ্ঞ দ্বারা ভগবান যজ্ঞেশ্বরের আরাধনা করেছিলেন তখন ইন্দ্র ঈর্ষাবশে গুপ্তরূপে তাঁর যজ্ঞের অশ্ব হরণ করলেন। অশ্বটিকে নিয়ে পলায়নের সময়ে ভগবান অত্রিমুনি তাঁকে দেখতে পেলেন । ইন্দ্র তখন মস্তকে জটাজুট ধারণ করে থাকায় ও অঙ্গে ভস্ম ধারণ করায় পৃথু তনয় তাঁকে মূর্তিমান ধর্ম মনে করে বাধা দিলেন না । কিন্তু মহর্ষি অত্রি ইন্দ্রকে চিনিয়ে দিলে পৃথুকুমার আকাশপথে দ্রুতবেগে ইন্দ্রের পশ্চাদ্ধাব করলেন ।
ইন্দ্র ভীত হয়ে অন্তর্ধান করলে বীর রাজপুত্র যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে আনলেন । অতঃপর রাজকুমার ' বিজিতাশ্ব ' রূপে মুনিগণ কর্তৃক পরিচিত হলেন । ইন্দ্রের বারবার বাধাদান মহারাজ পৃথুকে ক্রোধান্বিত করল । তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন । ঋত্বিকগণ দেখলেন যে পরাক্রমশালী মহারাজ পৃথু ইন্দ্রকে বধ করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন । তাঁরা মহারাজ পৃথুকে বললেন যে ,যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার পর কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞপশু ভিন্ন অন্য কাউকে বধ করা অনুচিত । তাঁরা আরও বললেন যে অমোঘ মন্ত্রদ্বারা আবাহন করে ইন্দ্রকে তাঁরা বলপূর্বক অগ্নিতে আহুতি দিয়ে দেবেন ।
যজমান মহারাজ পৃথুকে এই কথা বলে তাঁর ঋত্বিকগণ সক্রোধে ইন্দ্রকে আবাহন করলেন । তাঁরা আহুতি দিতে উদ্যত হলে স্বয়ং ব্রহ্মা আবির্ভূত হয়ে বললেন - হে ঋত্বিকগণ ! ইন্দ্রকে আহুতি দান অনুচিত কার্য , কারণ ইন্দ্র তো যজ্ঞ নামে পরিচিত ; তা বস্তুত শ্রীভগবানের মূর্তি । তোমাদের যজ্ঞদ্বারা আরাধিত দেবতাগণও ইন্দ্রেরই অংশবিশেষ । তাই যজ্ঞদ্বারা ইন্দ্রকে বিনাশ করবার চিন্তা সঠিক নয় । মহারাজ পৃথু বিপুল কীর্তিসমূহের মধ্যে একটি যজ্ঞ না হয় অসম্পূর্ণই রইল তাতে কিছু এসে যাবে না । শতযজ্ঞ সম্পাদন না হয় না হল । '
বাকীঅংশ আগামীপর্বে
=========O========
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
নাভিদ্রুহ্যন্তি ভূতেভ্যো যর্হি নাত্মা কলেবরম্ ।। ( ভাগবত ৪\২০\৩ )
মহারাজ অঙ্গ রাজত্ব ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় প্রজাগণের মধ্যে অরাজকতা দেখা দিয়েছিল । তখন ব্রহ্মবাদী ভৃগু প্রমুখ মুনি মাতা সুনীথাকে আহ্বান করে ও তাঁর সম্মতি নিয়ে বেনকে পৃথিবীর অধিপতিপদে অভিষিক্ত করেছিলেন । সিংহাসনে আরোহণ করে বেন অষ্ট লোকপাল দেবতার মহিমার অংশভাগীরূপে পরিগণিত হয়ে ঔদ্ধত্য ও অহংকারের চরম সীমা অতিক্রম করল এবং নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে মহাপুরুষের অপমান করতে লাগল । তার নির্দেশ সকল যজ্ঞ , দান বা হোম নিষিদ্ধ করা হল ।
বিপদগামী রাজা বেনকে অযোগ্য জ্ঞান করে মুনিগণ তার উপর অসন্তুষ্ট হলেন । শ্রীভগবান বিষ্ণুর নিন্দাকারী রাজা বেন মৃত্যুমুখে পতিত হলে মুনিগণের পরামর্শে অমাত্যগণ বেনের দেহজাত বালক পৃথুকে সিংহাসনে বসালেন । মুনিগণ দেখলেন যে বালক পৃথু ভগবান বিষ্ণুর ভুবনপালককারী কলা ও লক্ষ্মীর অবতারস্বরূপ সংযোগ হতে উৎপন্ন । রাজাদের মধ্যে পৃথু অগ্রগণ্য হবেন । তাঁরা দেখলেন যে ভগবান শ্রীহরির অংশ পৃথুরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন অর্থাৎ তিনি অংশাবতার ।
যখন ব্রাহ্মণগণ পৃথুর স্তুতি কীর্তনে মুখর হলেন , শ্রেষ্ঠ গন্ধর্বগণ গুণগান করতে লাগলেন , সিদ্ধগণ পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন তখন পৃথু সেই অল্প বয়সেই সহাস্যে জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন - ' হে সৌম্য সূত - মাগধ - বন্ধীগণ ! এখনও ইহলোকে আমার কোনো গুণই প্রকাশিত হয়নি । তাহলে আপনারা আমার কোন্ গুণকে অবলম্বন করে স্তুতি করছেন ? আমার সম্পর্কে আপনাদের ব্যক্ত উক্তি না করে অন্য কারো স্তুতি করা উচিত । পুণ্যশ্লোক ভগবান শ্রীহরির গুণকীর্তনের মতো সাধুবাদযোগ্য বিষয় থাকা সত্ত্বেও তুচ্ছ মানুষের স্তব করা কোনো শিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে শোভনীয় নয় । ' উদারচরিত্র ব্যক্তিগণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও খ্যাতিমান হলেও নিজের প্রশংসা বাক্য শ্রবণ করা লজ্জাজনক মনে করে থাকেন ও তার নিন্দা করেন ।
ব্রাহ্মণগণ মহারাজ পৃথুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে তাঁকে প্রজাদের রক্ষকরূপে ঘোষণা করলেন । সেই সময় পৃথিবী অন্নহীন হয়ে গিয়েছিল ; চতুর্দিকে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল । ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর শীর্ণ দেহে প্রজারা তখন তাদের প্রভু পৃথুর কাছে এসে নিবেদন করলন - ' আমরা নিরন্ন ও ক্ষুধার জ্বালায় পীড়িত । আপনি আমাদের রক্ষা করুন । '
প্রজাদের দুর্দশার কথা মহারাজ পৃথু শুনলেন । অন্নাভাবের কারণও তিনি অবগত হলেন । তিনি বুঝলেন যে পৃথিবী সমস্ত অন্ন ও ঔষধির বীজ অন্তরে লুকিয়ে রেখেছে । এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে তিনি পৃথিবীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ধনুর্বাণ তুললেন । উদ্যত অস্ত্র পৃথিবীকে ভীত ও কম্পিত করে তুলল । পৃথিবী তখন গোরূপ ধারণ করে পলায়ন করতে থাকলে মহারাজ পৃথু তার পশ্চাদ্ধাবন করলেন , পৃথুর ক্রোধ থেকে তাঁর রক্ষা পাওয়া কঠিন ছিল । অবশেষে পলায়নে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে পৃথিবী মহাভাগ পৃথুকে সম্বোধন করে বললেন - ' হে ধর্মজ্ঞ ও শরণাগত বৎসর মহারাজ ! আপনি সর্বপ্রাণীর রক্ষাকর্তা , আমাকেও রক্ষা করুন । আমি আপনার শরণাগত । '
মহারাজ পৃথু বললেন - ' হে পৃথিবী ! তুমি আমার শাসন অতিক্রম করেছ । তুমি দেবতারূপে যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করো অথচ তার পরিবর্তে আমাদের অনুদান করছ না । '
মহারাজ পৃথু জানতে পারলেন যে পুরাকালে যে সকল ( ধান্যাদি ) ঔষধি সৃষ্ট হয়েছিল তা অসৎ দুরাচারযুক্ত ব্যক্তিগণ ভোগ করছে দেখে পৃথিবীই যজ্ঞের কারণে সমস্ত ঔষুধি নিজের মধ্যে সঞ্চিত রেখেছে । দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ায় তা জীর্ণ হয়ে পড়ছে ।
তা পূর্বাচার্যগণের প্রদর্শিত পথে উদ্ধার করা সম্ভাব । পৃথিবী আরও বললেন - ' হে লোকপালক মহাবাহু বীব ! আপনি সর্বপ্রাণীর রক্ষায় বলপ্রদায়ক খাদ্য লাভ করতে ইচ্ছা করলে উপযুক্ত বৎস , দোহনপাত্র ও দোহনকর্তা সংগ্রহ করুন । আমি সেই বৎসের প্রতি স্নেহবশত দুগ্ধরূপে আপনার অভীষ্ট সিদ্ধ করব ।
' হে প্রভু ! আরও একটি নিবেদন শুনুন । আপনি আমাকে সমতল করুন । আমি সমতল হলে জলসম্পদ ধারণ করতে সক্ষম হব । '
মহারাজ পৃথু পৃথিবীর এই প্রিয় ও কল্যাণকর উপদেশ স্বীকার করে নিলেন । তিনি স্বায়ম্ভুব মনুকে বৎস করে নিয়ে নিজের হাতে সমস্ত ধান্যাদি ঔষধি ও শস্য দুগ্ধরূপে দোহন করে নিলেন । অন্যান্য বিজ্ঞজনেরাও এইভাবে পৃথিবীর কাছ থেকে অভীষ্ট বস্তু দোহন করে নিয়েছিলেন । ঋষিগণ বৃহস্পতিকে বৎস করে ইন্দ্রিয় ( বাক্ , মন এবং শ্রোত্র ) পাত্রে দেবী বসুন্ধরার কাছ থেকে বেদরূপ পবিত্র দুগ্ধ দোহন করে নিয়েছিলেন । কপিলদেবকে বৎস করে আকাশরূপ পাত্রে সিদ্ধগণ অণিমাদি অষ্টসিদ্ধি ও বিদ্যাধরগণ আকাশচারিতা প্রভৃতি বিদ্যা দোহন করেছিলেন ।
পৃথিবীর দ্বারা এইভাবে সর্বজনের সর্বকামনা পূর্তি হওয়ায় মহারাজ পৃথু স্নেহার্দ্রহৃদয় এই সর্বংসহা জীবধাত্রীকে নিজ আদরের কন্যারূপে স্বীকৃতি দিলেন । নিজ ধনুর প্রান্তভাগ দ্বারা বহু পর্বতের ঊর্ধ্বাংশ চূর্ণ করে ভূমির বিশাল অংশ সমতলে পরিণত করলেন । অতঃপর মহারাজ পৃথু প্রজাপালনে রত হলেন । এই সমতলভূমির বিভিন্ন স্থানে প্রজাদের জন্য যথাযোগ্য বাসভূমি বিভাগ করে দিলেন । তিনি গ্রাম , ছোট ও বড় নগর , বহুপ্রকারের দুর্গ , ঘোষপল্লি , গো - মহিষের বাসস্থান , সৈন্যশিবির , খনি ও তৎসন্নিত বাসভূমি , কৃষকপল্লি সবই সুনির্দিষ্টরূপে বিভাগ করে মানুষের বাসস্থানের পরিকল্পিত নির্মাণরীতি প্রবর্তন করলেন ।
এইবার ভগবান মনুর ব্রহ্মাবর্ত ক্ষেত্র - যেখানে সরস্বতী নদী পূর্বমুখে প্রবাহিতা , সেইখানে মহারাজ পৃথু শত অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য দীক্ষিত হলেন । দেবরাজ ইন্দ্র যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন । মহারাজ পৃথুর যজ্ঞে যজ্ঞাত্মা সর্বলোকগুরু জগদীশ্বর ভগবান শ্রীহরি যজ্ঞেশ্বররূপে সাক্ষাৎ দর্শন দিয়েছিলেন । তাঁর সঙ্গে ব্রহ্মা , শিব এবং নিজ নিজ অনুচরবৃন্দ সহ লোকপালগণও উপস্থিত হয়েছিলেন । গর্ন্ধব , মুনি এবং অপ্সরাগণ তখন শ্রীভগবানের স্তুতিগাণ করছিলেন ।
সিদ্ধ , বিদ্যাধর , দৈত্য , দানব , যক্ষ , সুনন্দ - নন্দাদি প্রধান পার্ষদগণ এবং যাঁরা সর্বদাই শ্রীভগবানের সেবার জন্য উৎসুক ছিল কপিল ও নারদ , দত্তাত্রেয় এবং সনকাদি যোগেশ্বরগণ সকলে শ্রীহরির অনুগমন করেছিলেন । যজ্ঞধেনুরূপে উপস্থিত পৃথিবী কামধেনুরূপে যজমান মহারাজকে প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যই প্রদান করেছিলেন । নদীসকল ইক্ষু - দ্রাক্ষাদি সর্বপ্রকার রস বহন করে এনেছিল এবং অতি বৃহৎ মধুবর্ষী বৃক্ষসমূহ দুগ্ধ , দধি , অন্ন এবং ঘৃতাদি বিভিন্ন দ্রব্য প্রদান করেছিল । পর্বতসকল খাদ্যদ্রব্য ও লোকপালগণ বিবিধ উপহার দ্রব্য প্রদান করেছিলেন ।
মহারাজ পৃথু কেবলমাত্র ভগবান শ্রীহরিকে নিজ প্রভু বলে মনে করতেন । শ্রীহরির কৃপায় তাঁর প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল যা ইন্দ্রের ঈর্ষার কারণ হয় । মহারাজ পৃথু যখন অন্তিম ( শততম ) যজ্ঞ দ্বারা ভগবান যজ্ঞেশ্বরের আরাধনা করেছিলেন তখন ইন্দ্র ঈর্ষাবশে গুপ্তরূপে তাঁর যজ্ঞের অশ্ব হরণ করলেন। অশ্বটিকে নিয়ে পলায়নের সময়ে ভগবান অত্রিমুনি তাঁকে দেখতে পেলেন । ইন্দ্র তখন মস্তকে জটাজুট ধারণ করে থাকায় ও অঙ্গে ভস্ম ধারণ করায় পৃথু তনয় তাঁকে মূর্তিমান ধর্ম মনে করে বাধা দিলেন না । কিন্তু মহর্ষি অত্রি ইন্দ্রকে চিনিয়ে দিলে পৃথুকুমার আকাশপথে দ্রুতবেগে ইন্দ্রের পশ্চাদ্ধাব করলেন ।
ইন্দ্র ভীত হয়ে অন্তর্ধান করলে বীর রাজপুত্র যজ্ঞের অশ্ব ফিরিয়ে আনলেন । অতঃপর রাজকুমার ' বিজিতাশ্ব ' রূপে মুনিগণ কর্তৃক পরিচিত হলেন । ইন্দ্রের বারবার বাধাদান মহারাজ পৃথুকে ক্রোধান্বিত করল । তিনি রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন । ঋত্বিকগণ দেখলেন যে পরাক্রমশালী মহারাজ পৃথু ইন্দ্রকে বধ করবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন । তাঁরা মহারাজ পৃথুকে বললেন যে ,যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার পর কেবলমাত্র শাস্ত্রবিহিত যজ্ঞপশু ভিন্ন অন্য কাউকে বধ করা অনুচিত । তাঁরা আরও বললেন যে অমোঘ মন্ত্রদ্বারা আবাহন করে ইন্দ্রকে তাঁরা বলপূর্বক অগ্নিতে আহুতি দিয়ে দেবেন ।
যজমান মহারাজ পৃথুকে এই কথা বলে তাঁর ঋত্বিকগণ সক্রোধে ইন্দ্রকে আবাহন করলেন । তাঁরা আহুতি দিতে উদ্যত হলে স্বয়ং ব্রহ্মা আবির্ভূত হয়ে বললেন - হে ঋত্বিকগণ ! ইন্দ্রকে আহুতি দান অনুচিত কার্য , কারণ ইন্দ্র তো যজ্ঞ নামে পরিচিত ; তা বস্তুত শ্রীভগবানের মূর্তি । তোমাদের যজ্ঞদ্বারা আরাধিত দেবতাগণও ইন্দ্রেরই অংশবিশেষ । তাই যজ্ঞদ্বারা ইন্দ্রকে বিনাশ করবার চিন্তা সঠিক নয় । মহারাজ পৃথু বিপুল কীর্তিসমূহের মধ্যে একটি যজ্ঞ না হয় অসম্পূর্ণই রইল তাতে কিছু এসে যাবে না । শতযজ্ঞ সম্পাদন না হয় না হল । '
বাকীঅংশ আগামীপর্বে
=========O========
লেখকঃ - Joy Shree Radha Madhav
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন