শ্রীভগবান্ উবাচ—
ইদন্তু তে গুহ্যতমং প্রবক্ষ্যাম্যনসূয়বে ।জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং যজ্জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেঽশুভাৎ ॥১॥ |
শ্রীভগবান্ উবাচ (শ্রীভগবান্ কহিলেন) ইদং (এই) গুহ্যতমং (অত্যন্ত গোপনীয়) জ্ঞানং (আমার কীর্ত্তনাদি শুদ্ধ ভক্তিরূপ জ্ঞান) অনসূয়বে (অমৎসর) তে (তোমাকে) বিজ্ঞানসহিতং তু (আমার সাক্ষাৎ অনুভব পর্য্যন্তই) প্রবক্ষ্যামি (বলিতেছি) যৎ (যাহা) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) অশুভাৎ (সংসার বা ভক্তি প্রতিবন্ধক সমস্ত অমঙ্গল হইতে) ত্বং (তুমি) মোক্ষ্যসে (মুক্ত হইবে) ॥১॥
শ্রীভগবান্ বলিলেন—এই অতি গূঢ় আমার কীর্ত্তনাদি শুদ্ধভক্তিরূপ জ্ঞান অসূয়াশূন্য তোমাকে বিজ্ঞান অর্থাৎ আমার সাক্ষাৎ অনুভবের সহিত বলিতেছি, যাহা অবগত হইলে সংসার বা ভক্তির প্রতিবন্ধক সকল অমঙ্গল হইতে মুক্তি লাভ করিবে ॥১॥
রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমিদমুত্তমম্ । প্রত্যক্ষাবগমং ধর্ম্ম্যং সুসুখং কর্ত্তুমব্যয়ম্ ॥২॥ |
ইদম্ (এই জ্ঞান) রাজবিদ্যা (বিদ্যা সমূহের রাজা) রাজগুহ্যং (গোপনীয় জ্ঞান সমূহের রাজা) উত্তমম্ (অতিশয়) পবিত্রম্ (পবিত্র), প্রত্যক্ষাবগমং (প্রত্যক্ষ অনুভূতির বিষয়) ধর্ম্ম্যং (সমস্ত ধর্ম্মসাধক) কর্ত্তুম্ সুসুখং (অতি সুখসাধ্য) অব্যয়ম্ [চ] (এবং অবিনশ্বর বলিয়া) [বিদ্ধি] (জানিবে) ॥২॥
এই জ্ঞান বিদ্যাসমূহের রাজা, গোপনীয় জ্ঞান সমূহেরও রাজা, অতিশয় পবিত্র, অতীন্দ্রিয় হইলেও (সেবন্মুখ-ইন্দ্রিয়ের) প্রত্যক্ষ অনুভূতির বিষয়, সমস্ত ধর্ম্মসাধক, অতি সুখসাধ্য ও নির্গুণ বলিয়া জানিবে ॥২॥
অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষা ধর্ম্মস্যাস্য পরন্তপ । অপ্রাপ্য মাং নিবর্ত্তন্তে মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি ॥৩॥ |
[হে] পরন্তপ ! (হে শত্রুতাপন অর্জ্জুন !) অস্য ধর্ম্মস্য (মদ্ভক্তিরূপ এই ধর্ম্মের প্রতি) অশ্রদ্দধানাঃ (শ্রদ্ধাশূন্য) পুরুষাঃ (পুরুষগণ) মাং (আমাকে) অপ্রাপ্য (লাভ করিতে না পারিয়া) মৃত্যুসংসারবর্ত্মনি (মৃত্যুময় সংসার পথে) নিবর্ত্তন্তে (সর্ব্বদা পরিভ্রমণ করে) ॥৩॥
হে পরন্তপ ! আমার ভজনরূপ এই ধর্ম্মের প্রতি শ্রদ্ধারহিত মানবগণ আমাকে না পাইয়া মৃত্যুময় এই সংসারে পরিভ্রমণ করে ॥৩॥
ময়া ততমিদং সর্ব্বং জগদব্যক্তমূর্ত্তিনা । মৎস্থানি সর্ব্বভূতানি ন চাহং তেষ্ববস্থিতঃ ॥৪॥ |
অব্যক্তমূর্ত্তিনা (অতীন্দ্রিয় মূর্ত্তিস্বরূপ) ময়া (আমার দ্বারা) ইদং (এই) সর্ব্বং জগৎ (সমুদয় জগৎ) ততম্ (ব্যাপ্ত), সর্ব্বভূতানি (সমস্তভূতই) মৎস্থানি (পূর্ণচৈতন্যস্বরূপ আমাতে অবস্থিত) । অহং চ (কিন্তু আমি) তেষু (সেই সমুদয়ে) ন অবস্থিতঃ (অবস্থিত নহি) ॥৪॥
আমি অপ্রকাশিত ভাবে এই সমস্ত জগতে পরিব্যাপ্ত ও সমুদয় পদার্থ আমাতেই অবস্থিত রহিয়াছে । কিন্তু আমি সেই সমুদয়ে অবস্থিত নহি ॥৪॥
ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যোগমৈশ্বরম্ । ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থো মমাত্মা ভূতভাবনঃ ॥৫॥ |
মে (আমার) ঐশ্বরম্ যোগম্ (অসাধারণ অঘটন-ঘটনা-চাতুর্য্য) পশ্য (দর্শন কর) । ভূতানি ন চ মৎস্থানি (ভূতসকল আমাতে অবস্থিত নহে) মম (আমার) আত্মা (আত্মস্বরূপ) ভূতভৃৎ (ভূতগণের ধারক) ভূতভাবনঃ চ (এবং ভূতগণের পালক), [কিন্তু] ন ভূতস্থঃ (ভূতমধ্যে অবস্থিত নহে) ॥৫॥
অথবা তাহারাও আমাতে অবস্থিত নহে—আমার এই প্রকার অচিন্ত্য-ভেদাভেদরূপ ঐশ্বরিকভাব দর্শন কর । অর্থাৎ আমার আত্মস্বরূপই ভূতগণের ধারক ও ভূতগণের পালক হইয়াও তাহাতে আবদ্ধ নহে ॥৫॥
যথাকাশস্থিতো নিত্যং বায়ুং সর্ব্বত্রগো মহান্ । তথা সর্ব্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয় ॥৬॥ |
বায়ুঃ (বায়ু) সর্ব্বত্রগঃ (সর্ব্বত্র গমনশীল) মহান্ [অপি] (মহৎ পরিমাণ হইলেও) যথা (যেরূপ) নিত্যং (সর্ব্বদা) আকাশস্থিতঃ (আকাশে অবস্থিত), তথা (সেরূপ) সর্ব্বাণি ভূতানি (সমস্ত ভূতগণ) মৎস্থানি (আমাতে অবস্থিত) ইতি (ইহা) উপধারয় (নিশ্চয় কর) ॥৬॥
বায়ু সর্ব্বত্র গমনশীল ও মহান্ হইলেও যেরূপ সর্ব্বদা আকাশে অবস্থিত থাকিয়াও তাহাতে সংশ্লিষ্ট হয় না এবং আকাশও বায়ুর সহিত সংশ্লিষ্ট হয় না, সেইভাবে ভূতগণ আমাতে অবস্থিত ইহা জানিও ॥৬॥
সর্ব্বভূতানি কৌন্তেয় প্রকৃতিং যান্তি মামিকাম্ । কল্পক্ষয়ে পুনস্তানি কল্পাদৌ বিসৃজাম্যহম্ ॥৭॥ |
[হে] কৌন্তয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) কল্পক্ষয়ে (প্রলয়কালে) সর্ব্বাণি (সমস্ত) ভূতানি (ভূতগণ) মামিকাম্ (আমার) প্রকৃতিং (ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিতে) যান্তি (লয়প্রাপ্ত হয়) পুনঃ (পুনরায়) কল্পাদৌ (কল্পারম্ভে) তানি (সেই ভূত সকলকে) অহম্ (আমি) বিসৃজামি (বিশেষভাবে সৃষ্টি করি) ॥৭॥
হে কুন্তীপুত্ত্র ! প্রলয় সময়ে এই সমুদয় ভূতগণ আমার মায়া নামক প্রকৃতিতে লীন হয় । পুনরায় কল্পারম্ভে সেইসব ভূতগণকে আমি বিশেষভাবে সৃষ্টি করিয়া থাকি ॥৭॥
প্রকৃতিং স্বামবষ্টভ্য বিসৃজামি পুনঃ পুনঃ । ভূতগ্রামমিমং কৃৎস্নমবশং প্রকৃতের্বশাৎ ॥৮॥ |
[অহং] (আমি) স্বাম্প্রকৃতিং (নিজ ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতিকে) অবষ্টভ্য (আশ্রয় করিয়া) প্রকৃতেঃ বশাৎ (প্রাচীন কর্ম্মনিমিত্ত স্বভাববশে) অবশং (কর্ম্মাদি পরবশ) ইমং (এই) কৃৎস্নম্ (সমগ্র) ভূতগ্রামম্ (ভূত সমষ্টিকে) পুনঃ পুনঃ (বার বার) বিসৃজামি (সৃষ্টি করি) ॥৮॥
আমি স্বীয় মায়া নামক প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া প্রাচীনকল্পের কর্ম্মনিমিত্ত স্বভাববশতঃ কর্ম্মাদি পরবশ এই সমস্ত ভূতগণকে বারস্বার সৃষ্টি করিয়া থাকি ॥৮॥
ন চ মাং তানি কর্ম্মাণি নিবধ্নন্তি ধনঞ্জয় । উদাসীনবদাসীনমসক্তং তেষু কর্ম্মসু ॥৯॥ |
[হে] ধনঞ্জয় ! (হে ধনঞ্জয় !) তেষু কর্ম্মসু (সেই সকল সৃষ্ট্যাদি কার্য্যে) অসক্তং (আসক্তিরহিত) উদাসীনবৎ আসীনং চ (এবং উদাসীনের ন্যায় অবস্থিত) মাং (আমাকে) তানি কর্ম্মাণি (সেই সকল বিশ্ব সৃষ্ট্যাদি কর্ম্ম) ন নিবধ্নন্তি (আবদ্ধ করিতে পারে না) ॥৯॥
হে ধনঞ্জয় ! সেই সমস্ত সৃষ্ট্যাদি কর্ম্মে আসক্তিশূন্য এবং উদাসীনের মত অবস্থিত আমাকে সেই বিশ্বসৃষ্টাদি কার্য্যসকল বন্ধন করিতে পারে না ॥৯॥
ময়াধ্যক্ষেণ প্রকৃতিঃ সূয়তে সচরাচরম্ । হেতুনানেন কৌন্তয় জগদ্বিপরিবর্ত্ততে ॥১০॥ |
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীনন্দন !) ময়া অধ্যক্ষেণ (আমাকে অধ্যক্ষ অর্থাৎ নিমিত্ত স্বরূপে লাভ করিয়া) প্রকৃতিঃ (আমার মায়াশক্তি) সচরাচরম্ (স্থাবরজঙ্গমাত্মক) [জগৎ] (ব্রহ্মাণ্ড) সূয়তে (প্রসব করে), অনেন হেতুনা (এই কারণে) জগৎ (জগৎ) বিপরিবর্ত্ততে (পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হয়) ॥১০॥
হে কৌন্তেয় ! আমার অধ্যক্ষতায় আমার মায়াশক্তিই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক এই বিশ্ব প্রসব করে, এবং এই হেতু অর্থাৎ সৃষ্ট বস্তু মাত্রই বিনাশশীল বলিয়া জগৎ পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে ॥১০॥
অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষীং তনুমাশ্রিতম্ । পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্ ॥১১॥ |
মূঢ়াঃ (অবিবেকিমানবগণ) মম (আমার) মানুষীং তনুম্ (মনুষ্যাকৃতি শ্রীবিগ্রহ) আশ্রিতম্ (আশ্রিত) ভাবম্ (তত্ত্বই) পরং (সর্ব্বোৎকৃষ্ট স্বরূপ) [ইতি] (ইহা) অজানন্তঃ (জানিতে না পারিয়া) ভূতমহেশ্বরম্ (সর্ব্বভূতের মহান্ ঈশ্বর) মাং (আমাকে) অবজানন্তি (মনুষ্যবুদ্ধিতে অবজ্ঞা করে) ॥১১॥
অবিবেকী মনুষ্যগণ আমার যে মানুষাকৃতি শ্রীবিগ্রহই সর্ব্বোৎকৃষ্ট স্বরূপ ইহা না বুঝিয়া সর্ব্বভূতের মহেশ্বররূপ আমাকে প্রাকৃত মনুষ্যবুদ্ধিতে অবজ্ঞা করিয়া থাকে ॥১১॥
মোঘাশা মোঘকর্ম্মাণো মোঘজ্ঞানা বিচেতসঃ । রাক্ষসীমাসুরীঞ্চৈব প্রকৃতিং মোহিনীং শ্রিতাঃ ॥১২॥ |
[তে] (তাহারা) মোঘাশাঃ (নিষ্ফল কামনাবিশিষ্ট), মোঘকর্ম্মাণঃ (নিষ্ফল কর্ম্মা) মোঘজ্ঞানাঃ (বৃথা জ্ঞানী) বিচেতসঃ [চ] (ও বিক্ষিপ্তচিত্ত) [ভবন্তি] (হইয়া থাকে) । [এবং] মোহিনীং (মোহজনক) রাক্ষসীম্ (তামস) আসুরীং চ (ও রাজস) প্রকৃতিং এব (স্বভাবকেই) শ্রিতাঃ (আশ্রয় করিয়া থাকে)॥১২॥
সেই মূঢ়লোকগণ বিফল আশা, বৃথা কর্ম্মী, নিষ্ফল জ্ঞানী ও বিবেকবিহীন হইয়া মোহজনক তামসী বা রাজসী স্বভাবকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে ॥১২॥
মহাত্মানস্তু মাং পার্থ দৈবীং প্রকৃতিমাশ্রিতাঃ । ভজন্ত্যনন্যমনসো জ্ঞাত্বা ভূতাদিমব্যয়ম্ ॥১৩॥ |
[হে] পার্থ ! (হে পার্থ !) তু (কিন্তু) মহাত্মানঃ (ভগবদ্ভক্তিনিরত মহাত্মাগণ) দৈবীং প্রকৃতিং (দেব স্বভাবকে) আশ্রিতাঃ (প্রাপ্ত হইয়া) অনন্যমনসঃ (অনন্যচিত্তে) মাং (মনুষ্যাকৃতি আমাকেই) ভূতাদিম্ (ভূতগণের কারণ) অব্যয়ম্ [চ] (ও অবিনশ্বর) জ্ঞাত্বা (জানিয়া) ভজন্তি (ভজন করেন) ॥১৩॥
হে পার্থ ! কিন্তু মহাত্মাগণ দৈবী-প্রকৃতিকে আশ্রয়পূর্ব্বক আমাতে একাগ্রচিত্ত হইয়া মনুষ্যাকৃতি আমাকেই সর্ব্বভূতের কারণ ও সনাতন-স্বরূপ জানিয়া সেবা করিয়া থাকেন ॥১৩॥
সততং কীর্ত্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ । নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে ॥১৪॥ |
[তে] (তাঁহারা) সততং (দেশ, কাল ও পাত্রশুদ্ধি নিরপেক্ষ হইয়া সর্ব্বদা) মাং কীর্ত্তয়ন্তঃ (আমার নাম রূপাদি কীর্ত্তনকারী), যতন্তঃ (আমার স্বরূপগুণাদি নির্ণয়ে যত্নশীল) দৃঢ়ব্রতাঃ চ (এবং অপতিত ভাবে একাদশ্যাদি ও নামগ্রহণাদি নিয়ম পালনকারী হইয়া) নমস্যন্তঃ চ (আমাকে নমস্কারাদি সর্ব্ববিধ ভক্তিপূর্ব্বক) নিত্যযুক্তাঃ (ভবিষ্যতে আমার নিত্য সংযোগ আকাঙ্ক্ষায়) ভক্ত্যা (ভক্তিযোগ দ্বারা) মাম্ (আমাকে) উপাসতে (ভজনা করেন) ॥১৪॥
তাঁহারা কাল, দেশ ও পাত্রের শুদ্ধি অশুদ্ধি বিচারশূন্য হইয়া সর্ব্বদা আমার নাম, রূপ, গুণ ও লীলাদি কীর্ত্তনরত, আমার স্বরূপ গুণাদি নির্ণয়ে যত্নশীল এবং অপতিত ভাবে একাদশ্যাদি ও নাম গ্রহণাদি নিয়ম পালনকারী হইয়া আমার প্রতি নমস্কারাদি সর্ব্ববিধ ভক্তি আচরণ করতঃ ভবিষ্যতে আমার সহিত নিত্য সংযোগের আকাঙ্ক্ষায় ভক্তিযোগ দ্বারা আমাকে উপাসনা করেন ॥১৪॥
জ্ঞানযজ্ঞেন চাপ্যন্যে যজন্তো মামুপাসতে । একত্বেন পৃথক্ত্বেন বহুধা বিশ্বতোমুখম্ ॥১৫॥ |
অপি চ (আর) জ্ঞানযজ্ঞেন (জ্ঞানরূপ যজ্ঞের দ্বারা) যজন্তঃ (যজনকারী) অন্যে (অপর অহংগ্রহোপাসকগণ) একত্বেন (অভেদ চিন্তন দ্বারা), [অন্যে] (অন্য প্রতীকোপাসকগণ) পৃথক্ত্বেন (বিষ্ণুই আদিত্যাদিরূপে অবস্থিত এইরূপ ভেদচিন্তা দ্বারা) [অন্যে চ] (এবং অন্য বিশ্বরূপোপাসকগণ) বহুধা (বহু প্রকারে) বিশ্বতোমুখম্ (বিশ্বরূপ) মাম্ (আমাকে) উপাসতে (উপাসনা করেন) ॥১৫॥
আর জ্ঞানমার্গীয় উপাসকগণ কেহ কেহ আমার সহিত নিজের অভেদত্ব, কেহ বা আমার সহিত দেবতান্তরের অভেদত্ব, কেহ বা আমার সহিত অমার বিশ্ববিভূতির অভেদ ভাবনাপূর্ব্বক নানাপ্রকারে আমারই উপাসনা করিয়া থাকেন ॥১৫॥
অহং ক্রতুরহং যজ্ঞঃ স্বধাহমহমৌষধম্ । মন্ত্রোঽহমহমেবাজ্যমহমগ্নিরহং হুতম্ ॥১৬॥ |
অহং (আমি) ক্রতুঃ (অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞ) অহং (আমি) যজ্ঞঃ (বৈশ্বদেবাদি স্মৃত্যুক্ত পঞ্চযজ্ঞ) অহম্ (আমি) স্বধা (পিতৃলোক উদ্দেশে শ্রাদ্ধাদি) অহম্ (আমি) ঔষধম্ (ওষধিজাত অন্ন) অহম্ (আমি) মন্ত্রঃ (মন্ত্র), অহম্ (আমি) আজ্যম্ (ঘৃতাদি) অহং (আমি) অগ্নিঃ (অগ্নি) অহং এব (আমিই) হুতম্ (হোমক্রিয়া) ॥১৬॥
আমি অগ্নিষ্টোমাদি শ্রৌতযজ্ঞ, আমি বৈশ্বদেবাদি স্মৃত্যুক্ত পঞ্চযজ্ঞ, আমি পিতৃগণ-উদ্দেশে শ্রাদ্ধাদি, আমি ঔষধ, আমি মন্ত্র, আমি ঘৃতাদি, আমি অগ্নি এবং আমিই হোমক্রিয়া ॥১৬॥
পিতামহস্য জগতো মাতা ধাতা পিতামহঃ । বেদ্যং পবিত্রমোঙ্কার ঋক্ সাম যজুরেব চ ॥১৭॥ |
অহম্ (আমি) অস্য (এই) জগতঃ (জগতের) পিতা (পিতা), মাতা (মাতা), ধাতা (কর্ম্মফলপ্রদাতা), পিতামহঃ (পিতামহ), বেদ্যং (জ্ঞেয় বস্তু), পবিত্রম্ (শুদ্ধি সম্পাদক) ওঙ্কারঃ (প্রণব), ঋক (ঋগ্বেদ), সাম (সামবেদ) যজুঃ এব চ (এবং যজুর্ব্বেদও আমিই) ॥১৭॥
আমি এই জগতের পিতা, মাতা, কর্ম্মফলবিধাতা, পিতামহ, জ্ঞেয় বস্তু, শুদ্ধি-সম্পাদক প্রণব, ঋগ্বেদ, সামবেদ ও যজুর্ব্বেদ—এই সবই আমি ॥১৭॥
গতির্ভর্ত্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ । প্রভবঃ প্রলয়ঃ স্থানং নিধানং বীজমব্যয়ম্ ॥১৮॥ |
[অহং] (আমি) গতিঃ (কর্ম্মফল) ভর্ত্তা (পতি) প্রভুঃ (নিয়ন্তা) সাক্ষী (শুভাশুভদ্রষ্টা) নিবাসঃ (আশ্রয়স্থান) শরণং (রক্ষক) সুহৃৎ (নিরুপাধিহিতকারী) প্রভবঃ (সৃষ্টি) প্রলয়ঃ (প্রলয়) স্থানং (ও স্থিতিক্রিয়া) নিধানং (আকর) অব্যয়ম্ বীজম্ (অবিনাশিকারণ) ॥১৮॥
এবং আমিই সকলের গতি, পতি, নিয়ন্তা, শুভাশুভ দ্রষ্টা, আশ্রয়স্থান, রক্ষক, নিরুপাধি-হিতকারী, সৃষ্টি, সংহার ও স্থিতিক্রিয়া, আকর বীজস্বরূপ অব্যয়-পুরুষ ॥১৮॥
তপাম্যহমহং বর্ষং নিগৃহ্ণাম্যুৎসৃজামি চ । অমৃতঞ্চৈব মৃত্যুশ্চ সদসচ্চাহমর্জ্জুন ॥১৯॥ |
[হে] অর্জ্জুন ! (হে অর্জ্জুন !) অহম্ (আমি) তপামি (উত্তাপ দান করি) অহং (আমি) বর্ষং (বারিবর্ষণ) উৎসৃজামি (করিয়া থাকি) নিগৃহ্ণামি চ (এবং কখনও তাহা আকর্ষণ করিয়া থাকি) অহম্ এব (আমিই) অমৃতং (মোক্ষ) মৃত্যুঃ চ (এবং মৃত্যু), সৎ (স্থূল) অসৎ চ (ও সূক্ষ্ম সমুদয় বস্তু) ॥১৯॥
হে অর্জ্জুন ! আমি সূর্য্যস্বরূপে গ্রীষ্মকালে উত্তাপ দান করি, বর্ষাকালে আমি বারিবর্ষণ করিয়া থাকি, আবার কখনও কখনও বর্ষণকে আকর্ষণ করিয়া থাকি । আমিই মোক্ষ এবং মৃত্যু, স্থূল ও সূক্ষ্ম সমুদয় বস্তু ॥১৯॥
ত্রৈবিদ্যা মাং সোমপাঃ পূতপাপা যজ্ঞৈরিষ্ট্বা স্বর্গতিং প্রার্থয়ন্তে । তে পুণ্যমাসাদ্য সুরেন্দ্রলোকম্ অশ্নন্তি দিব্যান্ দিবি দেবভোগান্ ॥২০॥ |
ত্রৈবিদ্যাঃ (বেদত্রয়োক্ত কর্ম্মানুষ্ঠান পরায়ণ) সোমপাঃ (যজ্ঞশেষ সোমপানকারী) পূতপাপাঃ (নিষ্পাপ ব্যক্তিগণ) মাং (ইন্দ্রাদিরূপ আমাকে) যজ্ঞৈঃ (যজ্ঞ দ্বারা) ইষ্ট্বা (পূজা করিয়া) স্বর্গতিং (স্বর্গলোক) প্রার্থয়ন্তে (কামনা করেন) তে (তাঁহারা) পুণ্যম্ (পুণ্যফল-স্বরূপ) সুরেন্দ্রলোকম্ (ইন্দ্রলোক) আসাদ্য (প্রাপ্ত হইয়া) দিবি (স্বর্গে) দিব্যান্ (উত্তম) দেবভোগান্ (দেবোচিতসুখ) অশ্নন্তি (ভোগ করেন) ॥২০॥
বেদত্রয়োক্ত কর্ম্মানুষ্ঠানকারিগণ বেদবিহিত যজ্ঞসমূহ দ্বারা ইন্দ্রাদিরূপে আমাকেই পূজা করিয়া যজ্ঞশেষ সোমপান পূর্ব্বক নিষ্পাপ হইয়া স্বর্গলোক প্রার্থনা করেন ; তাঁহারা তখন পুণ্যফল স্বরূপ দেবলোক প্রাপ্ত হইয়া স্বর্গে দিব্যভোগসকল ভোগ করিয়া থাকেন ॥২০॥
তে তং ভুক্ত্বা স্বর্গলোকং বিশালং ক্ষীণে পুণ্যে মর্ত্ত্যলোকং বিশন্তি । এবং ত্রয়ীধর্ম্মমনুপ্রপন্না, গতাগতং কামকামা লভন্তে ॥২১॥ |
তে (তাঁহারা) তং (সেই) বিশালং (বিপুল) স্বর্গলোকং (স্বর্গলোকের সুখ) ভুক্ত্বা (ভোগ করিয়া) পুণ্যে ক্ষীণে (পুণ্যক্ষয়ে) মর্ত্ত্যলোকং (মর্ত্ত্যলোকে) বিশন্তি (প্রবেশ করেন) ; এবং (এইরূপে) ত্রয়ীধর্ম্মম্ (বেদত্রয় বিহিত ধর্ম্ম) অনুপ্রপন্নাঃ (অনুষ্ঠানে তৎপর) কামকামাঃ (ভোগেচ্ছু মানবগণ) গতাগতং (সংসারে যাতাযাত) লভন্তে (লাভ করিয়া থাকেন) ॥২১॥
তাঁহারা সেই বিশাল স্বর্গলোকের সুখ ভোগ করিয়া পুণ্যক্ষয়প্রাপ্ত হইলে এই মর্ত্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন ; এইরূপে বেদবিহিত ধর্ম্মের অনুসরণকারী কামকামী ব্যক্তিগণ সংসারে পুনঃ পুনঃ যাতায়াত বা জন্ম-মরণ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন ॥২১॥
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্য্যুপাসতে । তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্ ॥২২॥ |
অনন্যাঃ (অন্য কামনা-রহিত) মাং চিন্তয়ন্তঃ (আমার চিন্তা-নিরত) যে জনাঃ (যে সকল ব্যাক্তিগণ) পর্য্যুপাসতে (সর্ব্বতোভাবে আমারই উপাসনা করেন), তেষাং (সেই) নিত্যাভিযুক্তানাং (নিত্য সংযোগকামিগণের) যোগক্ষেমং (যোগ অপ্রাপ্য ধনাদি লাভ, ক্ষেম সেইসব রক্ষা এই উভয় কার্য্যই) অহং (আমি) বহামি (বহন করিয়া থাকি) ॥২২॥
অনন্যভাবযুক্ত আমার চিন্তানিরত যে সকল ব্যক্তি সর্ব্বতোভাবে একমাত্র আমারই উপাসনা করেন, সেই সকল মদেকনিষ্ঠ ভক্তগণের প্রয়োজনীয় বস্তু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ ভার আমিই বহন করিয়া থাকি ॥২২॥
যেঽপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ । তেঽপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্ব্বকম্ ॥২৩॥ |
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) যে (যে সকল ব্যক্তি) অন্যদেবতাভক্তাঃ অপি (অন্য দেবতার ভক্ত হইয়াও) শ্রদ্ধয়া অন্বিতাঃ (শ্রদ্ধা সহকারে) যজন্তে (পূজা করেন), তে অপি (তাহারাও) অবিধিপূর্ব্বকম্ (মৎপ্রাপকবিধি ব্যতিরেকে) মাম্ এব (আমাকেই) যজন্তি (পূজা করেন) ॥২৩॥
হে কৌন্তেয় ! যে সকল ব্যক্তি শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া ভক্তি সহকারে অন্য দেবতার উপাসনা করেন, তাহারাও আমারই পূজা করিয়া থাকেন কিন্তু তাহা অবিধিপূর্ব্বক ॥২৩॥
অহং হি সর্ব্বযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ । ন তু মামভিজানন্তি তত্ত্বেনাতশ্চ্যবন্তি তে ॥২৪॥ |
হি (যেহেতু) অহং এব (আমিই) সর্ব্বযজ্ঞানাং (সমস্ত যজ্ঞের) ভোক্তা চ (ভোক্তা) প্রভুঃ চ (এবং ফলদাতা) তু (কিন্তু) তে (তাহারা) মাম্ (আমাকে) তত্ত্বেন (যথার্থরূপে) ন অভিজানন্তি (জানিতে পারে না), অতঃ (এইজন্য) [পুনঃ] (পুনরায়) চ্যবন্তি (জন্মগ্রহণ করে) ॥২৪॥
যেহেতু আমিই যজ্ঞ সমূহের ভোক্তা এবং ফলদাতা । কিন্তু তাহারা আমাকে উক্ত স্বরূপে জানিতে পারে না সুতরাং পুনরায় জন্মাদি লাভ করিয়া থাকে ॥২৪॥
যান্তি দেবব্রতা দেবান্ পিতৄন্ যান্তি পিতৃব্রতাঃ । ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্যাজিনোঽপি মাম্ ॥২৫॥ |
দেবব্রতাঃ (দেবপূজকগণ) দেবান্ (দেবতাগণকে) যান্তি (প্রাপ্ত হন), পিতৃব্রতাঃ (পিতৃকার্য্যনিরতগণ) পিতৄন্ (পিতৃগণকে) যান্তি (প্রাপ্ত হন), ভূতেজ্যাঃ (ভূতপূজকগণ) ভূতানি (ভূতগণকে) যান্তি (প্রাপ্ত হন), মদ্যাজিনঃ (এবং আমার পূজকগণ) মাম্ অপি (আমাকেই) যান্তি (প্রাপ্ত হন) ॥২৫॥
অন্যদেব পূজকগণ সেই সেই দেবতাকে লাভ করেন, শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়াপরায়ণগণ পিতৃলোক গমন করেন, ভূতপূজকগণ ভূতলোক প্রাপ্ত হন, এবং আমার পূজকগণ আমাকেই লাভ করেন ॥২৫॥
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি । তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্রযতাত্মনঃ ॥২৬॥ |
যঃ (যিনি) ভক্ত্যা (ভক্তির সহিত) মে (আমাকে) পত্রং (পত্র) পুষ্পং (পুষ্প) ফলং (ফল) তোয়ং (ও জল) প্রযচ্ছতি (প্রদান করেন), অহং (আমি) প্রযতাত্মনঃ (আমার ভক্তিপ্রভাবে বিশুদ্ধচিত্ত) [তস্য] (সেই ব্যক্তির) ভক্ত্যুপহৃতম্ (ভক্তিপূর্ব্বক প্রদত্ত) তৎ (সেই পত্রাদি) অশ্নামি (সমস্তই ভক্ষণ করি অর্থাৎ অতি প্রীতির সহিত যথাযোগ্যভাবে গ্রহণ করি) ॥২৬॥
যিনি ভক্তির সহিত আমাকে পত্র, পুষ্প, ফল ও জল প্রদান করেন, আমি, আমার প্রতি ভক্তিপ্রভাবে বিশুদ্ধচিত্ত সেই ভক্তের ভক্তিপূর্ব্বক সমর্পিত সেই পত্রাদি সমস্তই ভক্ষণ করিয়া থাকি অর্থাৎ অত্যন্ত প্রীতিযুক্ত হইয়া যথাযোগ্য ভাবে গ্রহণ করি ॥২৬॥
যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ । যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম্ ॥২৭॥ |
[হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীনন্দন !) [ত্বং] (তুমি) যৎ (লৌকিক বা বৈদিক যে কর্ম্ম) করোষি (কর), যৎ (যাহা কিছু) অশ্নাসি (ভোজন কর), যৎ (যাহা) জুহোষি (হোম কর), যৎ (যাহা কিছু) দদাসি (দান কর), যৎ (যে) তপস্যসি (ব্রতাদি কর) ; তৎ (তাহা সমস্তই) মদর্পণম্ (আমাতে যে প্রকারে অর্পিত হয় সেইরূপ ভাবে) কুরুষ্ব (কর) ॥২৭॥
হে কৌন্তেয় ! তুমি লৌকিক না বৈদিক যে সকল কর্ম্ম কর, যাহা কিছু আহার কর, যাহা হোম কর, যাহা কিছু দান কর, যে ব্রতাদি কর ; সে সমুদয়ই আমাতে যেভাবে অর্পিত হয় সেরূপে কর ॥২৭॥
শুভাশুভফলৈরেবং মোক্ষ্যসে কর্ম্মবন্ধনৈঃ । সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা বিমুক্তো মামুপৈষ্যসি ॥২৮॥ |
এবং (এইরূপে) [কর্ম্ম কুর্ব্বন্] (সমস্ত কর্ম্ম করিলে) শুভাশুভফলৈঃ (শুভ বা অশুভ ফলরূপ) কর্ম্মবন্ধনৈঃ (কর্ম্মবন্ধন সমূহ হইতে) মোক্ষ্যসে (মুক্ত হইবে) । সন্ন্যাসযোগযুক্তাত্মা (কর্ম্মফল ত্যাগরূপ যোগযুক্তমনা তুমি) বিমুক্তঃ [সন্] (মুক্তগণের মধ্যেও বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হইয়া) মাম্ উপৈষ্যসি (আমার নিকট গমন করিবে) ॥২৮॥
এইরূপে লৌকিক বা বৈদিক সমস্ত কর্ম্ম করিলেও তজ্জন্য শুভাশুভ ফলরূপ কর্ম্মবন্ধন সকল হইতে তুমি মুক্ত হইবে এবং মনে কর্ম্মফলের আসক্তি না থাকা হেতু তুমি মুক্তগণের মধ্যেও বিশিষ্টতা লাভ করিয়া আমার নিকট গমন করিবে ॥২৮॥
সমোঽহং সর্ব্বভূতেষু ন মে দ্বেষ্যোঽস্তি ন প্রিয়ঃ । যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম্ ॥২৯॥ |
অহং (আমি) সর্ব্বভূতেষু (সমস্ত ভূতের প্রতি) সমঃ (তুল্য ভাবাপন্ন) [অতএব] মে (আমার) দ্বেষ্যঃ (শত্রু) ন অস্তি (নাই), প্রিয়ঃ [চ] ন [অস্তি] (এবং প্রিয়ও নাই) ; তু (কিন্তু) যে (যাঁহারা) মাং (আমাকে) ভক্ত্যা (ভক্তিপূর্ব্বক) ভজন্তি (ভজনা করেন), তে (তাঁহারা) ময়ি (আমাতে) [যথা আসক্তাঃ] (যেরূপ আসক্ত), অহম্ অপি চ (আমিও) তেষু (তাঁহাদিগের প্রতি) [তথা আসক্তঃ] (সেইরূপ আসক্ত থাকি) ॥২৯॥
আমি সকল জীবের প্রতি সমভাবাপন্ন, সুতরাং আমার কেহ শত্রু নাই অথবা প্রিয়ও নাই । তথাপি যাঁহারা আমাকে ভক্তিসহকারে ভজনা করেন, তাঁহারা আমাতে যেমন সর্ব্বদা আসক্ত থাকেন, আমিও তাঁহাদিগের প্রতি সেইরূপ আসক্ত থাকি ॥২৯॥
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্ । সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগ্ব্যবসিতো হি সঃ ॥৩০॥ |
চেৎ (যদি) সুদুরাচারঃ অপি (অতি কুৎসিত আচার ব্যক্তিও) অনন্যভাক্ [সন্] (কর্ম্ম-জ্ঞানাদি-গত অন্য ভজন পরিত্যাগ করিয়া) মাম্ (কেবলমাত্র আমাকেই) ভজতে (ভজন করেন), সঃ (তিনি) সাধুঃ এব (সাধু বলিয়াই) মন্তব্যঃ (মান্য হন) হি (যেহেতু) সঃ (তিনি) সম্যক্ ব্যবসিতঃ (উত্তম নিশ্চয় বিশিষ্ট) ॥৩০॥
যদি অত্যন্ত কুৎসিত আচার সম্পন্ন ব্যক্তিও কর্ম্ম-জ্ঞানাদিগত অন্য পূজা পরিত্যাগ পূর্ব্বক একমাত্র পুমর্থবোধে আমাকেই ভজনা করেন, তবে তিনি সাধু বলিয়াই মাননীয় হন, যেহেতু তিনি উত্তম নিশ্চয় করিয়াছেন ॥৩০॥
ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্ম্মাত্মা শশ্বচ্ছান্তিং নিগচ্ছতি । কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি ॥৩১॥ |
[সঃ] (মদ্ভজনকারী সেই ব্যক্তি) ক্ষিপ্রং (শীঘ্র) ধর্ম্মাত্মা (সদাচারভূষিত) ভবতি (হন), শশ্বৎ (সর্ব্বদাই) শান্তিং (অনর্থোপশম জনিত সুখ) নিগচ্ছতি (সুষ্ঠুরূপে প্রাপ্ত হন) । [হে] কৌন্তেয় ! (হে কুন্তীপুত্ত্র !) মে (আমার) ভক্তঃ (ভক্ত) ন প্রণশ্যতি (কখনও বিনষ্ট হয় না) [ইতি] (ইহা) প্রতিজানীহি (প্রতিজ্ঞা কর—ঘোষণা কর) ॥৩১॥
সেই সুদুরাচার ব্যক্তি শ্রীঘ্রই সদাচারভূষিত হইয়া সর্ব্বদা নিত্যা শান্তি লাভ করিয়া থাকেন । হে কৌন্তেয় ! তুমি ঘোষণা করিয়া বল যে আমার ভক্তের কখনও বিনাশ নাই ॥৩১॥
মাং হি পার্থ ব্যপাশ্রিত্য যেঽপি স্যুঃ পাপযোনয়ঃ । স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্রাস্তেঽপি যান্তি পরাং গতিম্ ॥৩২॥ |
[হে] পার্থ ! (হে অর্জ্জুন !) যে অপি (যাহারা) পাপ যোনয়ঃ (অন্ত্যজাদি যোনিতে উৎপন্ন) স্ত্রিয়ঃ (স্ত্রী) বৈশ্যাঃ (বৈশ্য) তথা শূদ্রাঃ (এবং শূদ্র) স্যুঃ (হইয়াছে) তে অপি (তাহারাও) মাং (আমাকে) ব্যপাশ্রিত্য (বিশেষভাবে আশ্রয় করিয়া) হি (নিশ্চয়ই) পরাং গতিম্ (পরমাগতি) যান্তি (প্রাপ্ত হয়) ॥৩২॥
হে পার্থ ! যাহারা অন্ত্যজাদির বংশে উৎপন্ন, স্ত্রীজাতি, বৈশ্যজাতি বা শূদ্রজাতিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহারাও আমাকে সম্যক্রূপে আশ্রয় করিয়া উত্তমগতি লাভ করে ॥৩২॥
কিং পুনর্ব্রাহ্মণাঃ পুণ্যা ভক্তা রাজর্ষয়স্তথা । অনিত্যমসুখং লোকমিমং প্রাপ্য ভজস্ব মাম্ ॥৩৩॥ |
পুণ্যাঃ (পবিত্র) ব্রাহ্মণাঃ (ব্রাহ্মণগণ) তথা (এবং) রাজর্ষয়ঃ (ক্ষত্ত্রিয়গণ) ভক্তাঃ [সন্তঃ] (ভক্ত হইয়া) [পরাং গতিং যান্তি] (পরম গতি লাভ করিবেন) কিং পুনঃ (তাহাতে আর কথা কি ?) [অতএব] অনিত্যম্ (অনিত্য) অসুখং (দুঃখপূর্ণ) ইমং (এই) লোকম্ (মনুষ্যদেহ) প্রাপ্য (লাভ করিয়া) মাম্ (আমাকে) ভজস্ব (ভজনা কর) ॥৩৩॥
সুতরাং পবিত্র ব্রাহ্মণগণ বা ক্ষত্ত্রিয়গণ ভক্ত হইয়া যে পরমগতি প্রাপ্ত হইবেন সে সম্বন্ধে আর কথা কি আছে ? অতএব অনিত্য ও দুঃখকর এই মনুষ্যদেহ—বহু যোনি ভ্রমণের পর প্রাপ্ত হইয়া—আমাকেই আরাধনা কর ॥৩৩॥
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু । মামেবৈষ্যসি যুক্ত্বৈবমাত্মানং মৎপরায়ণঃ ॥৩৪॥ |
মন্মনাঃ (মদ্গতচিত্ত) মদ্ভক্তঃ (আমার সেবক) মদ্যাজী [চ] (ও আমার পূজা পরায়ণ) ভব (হও) । মাং (আমাকে) নমস্কুরু (নমষ্কার কর) । এবম্ (এইরূপে) আত্মানং (মন ও দেহ) যুক্ত্বা (আমাতে অর্পণপূর্ব্বক) মৎপরায়ণঃ (আমাকে আশ্রয় করিয়া) মাম্ এব (আমাকেই) এষ্যসি (প্রাপ্ত হইবে) ॥৩৪॥
আমাতে দত্ত-চিত্ত, আমার প্রতি ভক্তিপরায়ণ ও আমার অর্চ্চনে নিরত হও এবং আমাকেই নমস্কার কর । এইরূপে মন ও দেহ আমাতে অর্পণ পূর্ব্বক আমাকে আশ্রয় করিয়া আমাকেই প্রাপ্ত হইবে ॥৩৪॥
ইতি শ্রীমহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে রাজগুহ্য- যোগো নাম নবমোঽধ্যায়ঃ ॥৯॥ |
ইতি নবম অধ্যায়ের অন্বয় সমাপ্ত ॥
গ্রন্থ-সম্পাদক—
ত্রিদণ্ডিভিক্ষু—শ্রীভক্তিরক্ষক শ্রীধর
শ্রীচৈতন্য সারস্বত মঠ, নবদ্বীপ
শ্রীজন্মাষ্টমী বঙ্গাব্দ ১৩৬৮ সাল
১) শিষ্য শ্রদ্ধাহীন এবং দোষদর্শী হইলে গুরু তাহাকে গুহ্য বিষয় উপদেশ দেন না । কিন্তু অর্জুন সেরূপ নহেন । তিনি গুহ্য বিষয় শ্রবণের অধিকারী, ‘অসূয়াশূন্য’ শব্দে তাহাই প্রকাশ পাইতেছে ।
২) রাজগুহ্য রাজবিদ্যা কি ?
বিদ্যামাত্রই সেকালে গুহ্য থাকিত । কেননা, অধিকারী শিষ্যগণ ব্যতীত অন্য কাহাকেও উহা উপদেশ করা হইত না । এই সকল গুহ্যবিদ্যার মধ্যে গীতোক্ত ভক্তিযোগই শ্রেষ্ঠ, তাই উহাকে রাজগুহ্য বলা হইয়াছে । ব্রহ্মবিদ্যা-সম্বন্ধে এই অধ্যায়ে এমন কিছু বলা হয় নাই, যাহা পূর্বে কথিত হয় নাই এবং যাহাকে গুহ্যতম বলা যাইতে পারে । ‘ইহা সুস্পষ্ট যে, অক্ষর অব্যক্ত ব্রহ্মের জ্ঞানকে লক্ষ্য করিয়া এই বর্ণনা করা হয় নাই । কিন্তু রাজবিদ্যা শব্দে এ-স্থলে ভক্তিমার্গই বিবক্ষিত হইয়াছে ।’ – [লোকমান্য তিলক]
১২) পাষণ্ডী = ভগবদ্বিমুখ অসুর লোক যেমন কংস, শিশুপাল ।
মোঘাশাঃ : শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা অন্য দেবতারা শীঘ্র কামনা পূর্ণ করিবে, যাহারা এইরূপ নিষ্ফল আশা করে ।
মোঘকর্মাণঃ : ঈশ্বর-বিমুখ বলিয়া যাহাদের যাগযজ্ঞাদি কর্ম নিষ্ফল হয় ।
মোঘজ্ঞানাঃ : ভগবদ্ভক্তিহীন বলিয়া যাহাদের শাস্ত্রপাণ্ডিত্যাদি সমস্তই নিষ্ফল হয় ।
১৫) মত-পথ :
পরমেশ্বর বিশ্বতোমুখ, এই হেতুই তাঁহার উপাসনা-প্রণালীও বিভিন্ন হয় । জ্ঞান-যজ্ঞের অর্থ পরমেশ্বরের স্বরূপ-জ্ঞানের দ্বারাই বিচার করিয়া উহার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা । কিন্তু পরমেশ্বরের এই জ্ঞানও দ্বৈত-অদ্বৈত প্রভৃতি ভেদে অনেক প্রকারের হইতে পারে । এই কারণে জ্ঞান-যজ্ঞও বিভিন্ন প্রকারের হইতে পারে । ‘ ‘একত্ব’, ‘পৃথকত্ব’ প্রভৃতি পদের দ্বারা বুঝা যায় যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্রভৃতি সম্প্রদায় যদিও আধুনিক, তথাপি কল্পনাসকল প্রাচীন ।’ – [গীতারহস্য|লোকমান্য তিলক]
১৬) ক্রতু, যজ্ঞ – এই দুইটি সদৃশার্থক হইলেও একার্থক নহে । ‘যজ্ঞ’ শব্দ ‘ক্রতু’ শব্দ অপেক্ষা অধিক ব্যাপক । শ্রৌত যজ্ঞকে ক্রতু বলে । এস্থলে দুইটি শব্দই ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া ক্রতু অর্থে অগ্নিষ্টোমাদি শ্রৌত যজ্ঞ এবং যজ্ঞ অর্থে স্মার্ত যজ্ঞাদি বুঝিতে হবে ।
১৮) বিবিধ কর্ম বা সধনায় যে গতি বা ফল পাওয়া যায় তাহা তিনিই । যে যাহা করুক তাহার শেষ গতি তিনিই । শুভাশুভ যে কোন কর্ম লোকে করে তিনি সবই দেখেন, এই জন্য তিনিই সাক্ষী । সর্বভূত তাঁহাতেই বাস করে, তাই তিনি নিবাস । তিনি প্রভব, প্রলয় ও স্থান অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি, লয়কর্তা । প্রলয়েও জীবসমূহ বীজ অবস্থায় তাহাতে অবস্থান করে, এই জন্য তিনি নিধান । প্রত্যুপকারের আশা না করিয়া সকলের উপকার করেন, তাই তিনি সুহৃৎ । তিনি আর্তের আর্তিহর, তাই তিনি শরণ ।
১৯) সৎ ও অসৎ : এই শব্দদ্বয় গীতা এবং বেদান্তাদি-শাস্ত্রে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে ।
সৎ = অক্ষর অবিনাশী অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু; অসৎ = নশ্বর ব্যক্ত জগৎ ।
সৎ = অব্যক্ত প্রকৃতি; অসৎ = ব্যক্ত জগৎ ।
সৎ = অস্তি, আছে; অসৎ = নাস্তি, নাই । যে-বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং যাহার নাশ হইয়া থাকে সেই বস্তুই সৎ বা অসৎ । যাহা সৃষ্টির পূর্বেও ছিল এবং পরেও থাকিবে, তৎসম্বন্ধে ‘আছে’ বা ‘নাই’ এরূপ কিছুই বলা যায় না । তাই ব্রহ্মতত্ত্বের বর্ণনায় কখনো ‘ন সৎ ন অসৎ’ বলা হয় । কেননা, সেই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মবস্তু সত-অসৎ, আলোক-অন্ধকার, জ্ঞান-অজ্ঞান ইত্যাদি পরস্পর সতত-সাপেক্ষ দ্বৈত-বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ।
প্রাচীন উপনিষদাদিতে অনেক স্থলে বিপরীতার্থে এই শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হইয়াছে । অর্থাৎ ‘সৎ’ = দৃশ্য ব্যক্ত জগৎ; ‘তৎ’ বা ‘অসৎ’ = অব্যক্ত ব্রহ্মবস্তু ।
২১) বেদোক্ত যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠানকারী সকাম ব্যক্তিগণ পুণ্যফল-স্বরূপ স্বর্গলোক প্রাপ্ত হন বটে, কিন্তু মোক্ষ প্রাপ্ত হন না । একথা পূর্বে আরও কয়েক বার বলা হইয়াছে (২|৪২-৪৫, ৮|১৬,২৫ ইত্যাদি) । ২০-২৫ এই কয়েকটা শ্লোকে ফলাশায় দেবোপাসনা ও নিষ্কাম ঈশ্বরোপাসনায় পার্থক্য দেখান হইতেছে ।
২২) যোগক্ষেম : ভক্তের ভগবান, ঈশ্বর-চিন্তা ও বিষয়-চিন্তা
ভগবানের কর্ম দ্বিবিধ – (i)গৌণী ভক্তিযোগ (স্মরণ, কীর্তন, পূজার্চনাদি), (ii)নির্গুণা বা পরা ভক্তি সহকারে গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ (সর্বভূতে ঈশ্বর আছেন জানিয়া সর্বভূতের হিতসাধন) ।
কিন্তু দিবারাত্র ঈশ্বরচিন্তা করিব বা সর্বভূতের হিতসাধনে দেশের কাজে, দশের কাজে ব্যস্ত থাকিব, তবে সংসার-চিন্তা, দেহের চিন্তা করিব কখন ? দেহরক্ষা না হইলে ঈশ্বরচিন্তাও হয় না, দশের কাজও হয় না – ‘নিজে বাঁচিলে তবে ধর্ম’ [বিশ্বামিত্র]; ‘আত্মানং সততং রক্ষেৎ’ [মনু] । ইহার উত্তরে শ্রীভগবান বলিতেছেন, যাহারা নিত্যযুক্ত হইয়া সতত আমারই চিন্তায়, আমারই কর্মে মগ্ন থাকে, তাহাদের যোগক্ষেম আমিই বহন করি অর্থাৎ দেহাদি-রক্ষণের ভার আমিই গ্রহণ করি । অন্যের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থাও ঈশ্বর করেন; তবে তাহাদিগকে চেষ্টা করিতে হয়, নিত্যযুক্ত (পাটোয়ারী বুদ্ধি-সহকারে নহে) ভগবদ্ভক্তের চেষ্টা করিতে হয় না, এই পার্থক্য ।
২৪) অন্য দেবতার পূজাও তোমারই পূজা । তবে তাহাদিগের পূজা করিলে সদ্গতিলাভ হইবে না কেন ? কারণ, অন্যদেবতা-ভক্তেরা আমার প্রকৃত স্বরূপ জানে না; তাহারা মনে করে সেই সেই দেবতাই ঈশ্বর । এই অজ্ঞানতাবশতঃই তাহাদের সদ্গতি হয় না । তাহারা সংসারে পতিত হয় । কেননা, অন্য দেবতারা মোক্ষ দিতে পারেন না ।
একেশ্বরবাদ – বহুদেবোপাসনা – মূর্তিপূজা
হিন্দু বহুদেবোপাসক হইলেও বহু-ঈশ্বরবাদী নহেন, প্রতিমা-পূজক হইলেও পৌত্তলিক (Idolator) নহেন । বেদে কতিপয় দেবতার উল্লেখ আছে, কিন্তু সে সকলই এক, বহুত্ব কল্পনামাত্র (‘একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি’ ঋগ্বেদ ১০|১১৪|৫) । দেবতাদিগেরও পূর্বে সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২|২] ।
সুতরাং দেবতাগণ ঈশ্বর নহেন, ঈশ্বরের শক্তিবিশেষের বিভিন্ন প্রকাশ বা বিভূতি । ভয়ে, বিস্ময়ে, ভক্তিতে বা স্বার্থবুদ্ধিতে শক্তিমানের পূজা, বীর-পূজা, সকলেই করে; দেবগণের পূজাও তদ্রূপ, উহাতে অন্যবিধ ইষ্টলাভ হইতে পারে, ঈশ্বরলাভ হয় না ।
হিন্দুরা যে দেবদেবীর মূর্তি পূজা করেন, তাহাকে প্রতিমা (holy image বা প্রতীক symbol) বলে, পুত্তলিকা (Idol) বলে না । নাম-রূপ ব্যতীত মনুষ্যমন সেই অনন্তশক্তিমৎ অব্যক্ত বস্তু ধারণা করিতে পারে না; তাই ঈশ্বরের শক্তি-বিশেষের সহিত সাদৃশ্য কল্পনা করিয়া চিন্তার অবলম্বন-স্বরূপ একটা প্রতীক (symbol) গ্রহণ করা হয় মাত্র । মূর্তির প্রাণ-প্রতিষ্ঠা, স্তব-স্তুতি, ধ্যান-প্রণাম ইত্যাদি মন্ত্রাদির প্রতি লক্ষ্য করিলে স্পষ্টই বুঝা যায়, সাধক প্রতীক-অবলম্বনে ঈশ্বরেরই পূজা করিতেছেন, পুতুল পূজা করিতেছেন না । এইজন্যই প্রতিমা-পূজক ও পৌত্তলিক এক কথা নহে । কিন্তু যাঁহারা প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদিগের প্রতিমারও প্রয়োজন হয় না । বস্তুত তাঁহার প্রতিমা (তুলনা) নাই ।
২৬) আমার পূজা অনায়াস-সাধ্য । ইহাতে বহুব্যয়সাধ্য উপকরণের প্রয়োজন নাই । ভক্তিসহ যাহা কিছু আমার ভক্ত আমাকে দান করেন, দরিদ্র ব্রাহ্মণ শ্রীদামের চিপিটকের ন্যায় তাহাই আমি আগ্রহের সহিত গ্রহণ করি । আমি দ্রব্যের কাঙ্গাল নহি, ভক্তির কাঙ্গাল । এই কথাটা বুঝাইবার জন্য ‘ভক্তিপূর্বক’ শব্দটা দুইবার ব্যবহৃত হইয়াছে ।
সাকারোপাসনা :
‘ফল-পুষ্পাদি প্রদান করিতে হইলে তাহা যে প্রতিমায় অর্পণ করিতে হইবে এমন কথা নাই । ঈশ্বর সর্বত্র আছেন, যেখানে দিবে সেখানেই তিনি পাইবেন ।’ – [বঙ্কিমচন্দ্র]
মানববুদ্ধি নাম-রূপের অতীত কোনো অতীন্দ্রিয় বস্তুর ধারণা করিতে পারে না, সুতরাং যে-পর্যন্ত না সাধক প্রকৃতির অতীত হইয়া অতীন্দ্রিয় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন, সে-পর্যন্ত তাঁহাকে সাকারের মধ্য দিয়া, স্থূলের মধ্য দিয়াই সূক্ষ্মে যাইতে হইবে, অন্য গতি নাই ।
‘আপনারা মনকে স্থির করিবার অথবা কোনোরূপ চিন্তা করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন – আপনারা মনে-মনে মূর্তি গঠন না করিয়া থাকিতে পারিতেছেন না । দুই প্রকার ব্যক্তির মূর্তি-পূজার প্রয়োজন হয় না । এক নরপশু, যে ধর্মের কোনো ধার ধারে না, আর সিদ্ধপুরুষ – যিনি এই সকল সোপান-পরম্পরা অতিক্রম করিয়াছেন । আমরা যতদিন এই দুই অবস্থার মধ্যে অবস্থিত, ততদিন আমাদের ভিতরে-বাহিরে, কোনো-না-কোনো রূপ আদর্শ বা মূর্তির প্রয়োজন হইয়া থাকে ।’ – [স্বামী বিবেকানন্দ, ভক্তি-রহস্য]
২৯) নরসিংহ : পুত্রের (প্রহ্লাদের) প্রীতি ও পিতার (হিরণ্যকশিপুর) বিদ্বেষ মূর্তিমান নরসিংহ-রূপ ধারণ করিল । বিদ্বেষ-সিংহ অভক্তকে বিনাশ করিল, ভক্তবৎসল নরদেব ভক্তকে ক্রোড়ে লইলেন । এই ভক্ত-রক্ষক ও অভক্ত-নাশক রূপ ভক্তের প্রীতি- ও অভক্তের বিদ্বেষ-ভাবেরই প্রতিমূর্তি – উহা ভগবানের বৈষম্য-প্রসূত নহে ।
৩১) ভক্তি-স্পর্শমণি :
অতি পাপাসক্ত ব্যক্তিও যদি নিমেষমাত্র অচ্যুতের ধ্যান করেন, তবে তিনি তপস্বী বলিয়া পরিগণিত হন; তিনি যাঁহাদিগের মধ্যে উপবেশন করেন তাঁহারাও পবিত্র বলিয়া পরিগণিত হন ।
নিমেষমাত্রে অসাধু সাধু হইয়া উঠে, এ-কথা অত্যুক্তি নহে । অন্ধকার গৃহে দীপ জ্বালিলে নিমেষমাত্রেই গৃহ আলোকিত হয়, স্পর্শমণির সংস্পর্শে নিমেষমাত্রেই লৌহখণ্ড সুবর্ণ হয়, ভক্তিস্পর্শেও মানুষ নিমেষমাত্রেই পবিত্র হইয়া যায় । ভক্তির এই পতিতপাবনী শক্তি আছে । কৃষ্ণসেবা, সাধুসঙ্গ, গুরুকৃপায় উহা লাভ হয় । মহাপুরুষগণ এই শক্তি সঞ্চারিত করিতে পারেন ।
তাই দেখি, সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ ধনলোভে বৃন্দাবনে দৌড়িলেন, সনাতন গোশ্বামীর নিকট পার্থিব স্পর্শমণি পাইলেন; কিন্তু উহা লইয়া আর গৃহে ফিরিতে পারিলেন না । গোস্বামীর পাদমূলে লুণ্ঠিত হইয়া সেই অপার্থিব স্পর্শমণি যাচ্ঞা করিলেন –
‘যে ধনে হইয়া ধনী, মণিরে মান না মণি
তাহারই খানিক
মাগি আমি নত শিরে’ । এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মাণিক !
প্রায়শ্চিত্ত : জীবের পাপের সীমা নাই । শাস্ত্রেও বিধি-নিষেধের অন্ত নাই । সুতরাং প্রায়শ্চিত্তেরও নানা বিধান । গ্রহ-বিপ্রকে স্বর্ণদান হইতে তুষানলে জীবনদান পর্যন্ত কৃচ্ছ্র, অতিকৃচ্ছ্র, মহাকৃচ্ছ্র ইত্যাদি-রূপ প্রায়শ্চিত্তের অসংখ্য বিধি-ব্যবস্থা । কৃচ্ছ্র-সাধনে চিত্ত-শুদ্ধি হয়, সন্দেহ নাই; কিন্তু আন্তরিক অনুশোচনা ও ভগবদ্ভক্তির সহিত সংযুক্ত না হইলে উহা প্রাণহীন অনুষ্ঠান মাত্রে পর্যবসিত হয় । বরং দেশ-কাল-পাত্র-ভেদে সুব্যবস্থিত না হইলে সামাজিক অত্যাচার বলিয়াই গণ্য হয় ।
৩২) পাপযোনয়ঃ : পাপযোনি-সম্ভূত, নীচকুলজাত (অন্ত্যজ) । এই শব্দটি স্ত্রী-শূদ্রাদির বিশেষণ নয় ।
শাস্ত্রজ্ঞানশূন্য স্ত্রী-শূদ্রাদির পক্ষে জ্ঞানযোগের সাহায্যে মুক্তি লাভ সম্ভবপর নহে । কিন্তু ভক্তিযোগ জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলের পক্ষেই সুখসাধ্য; ভাগবত ধর্মের ইহাই বিশেষত্ব । ইহাতে জাতিভেদ-জনিত অধিকারভেদ নাই ।
৩৪) ঐকান্তিক ধর্ম – ভগবৎ-শরণাগতি :
একান্ত ভাবে ভগবানের শরণ লইয়া নিত্যযুক্ত হইয়া তাঁহার ভজনা করা এবং স্বধর্মরূপে ভৃত্যবৎ তাঁহারই কর্ম সম্পাদন করা ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন