আম্নায়ঃ প্রাহ তত্ত্বং হরিমিহ পরমং সর্ব্বশক্তিং রসব্ধিং
তদ্ভিন্নাংশাংশ্চ জীবান্ প্রকৃতি-কবলিতান্ তদ্বিমুক্তাংশ্চ ভাবাৎ ।
ভেদাভেদ-প্রকাশং সকলমপি হরেঃ সাধনং শুদ্ধভক্তিং
সাধ্যং তৎ প্রীতিমেবেত্যুপদিশতি জনান্ গৌরচন্দ্র স্বয়ং সঃ ॥
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
স্বয়ং ভগবান্ শ্রীমদ্ গৌরচন্দ্র এই দশটি তত্ত্ব জীবগণকে উপদেশ করিতেছেন ।
(১) আম্নায়-বাক্যই প্রধান প্রমাণ । তদ্দ্বারা নিম্নলিখিত নয়টি সিদ্ধান্ত উপদিষ্ট হইয়াছে ।
(২) কৃষ্ণস্বরূপ হরি জগন্মধ্যে পরমতত্ত্ব ।
(৩) তিনি সর্ব্বশক্তিমান্ ।
(৪) তিনি অখিল-রসামৃত-সমুদ্র ।
(৫) জীবসকল হরির বিভিন্নাংশ তত্ত্ব ।
(৬) তটস্থ গঠনবশতঃ জীবসকল বদ্ধদশায় প্রকৃতিকর্ত্তৃক কবলিত ।
(৭) তটস্থ ধর্ম্মবশতঃ জীবসকল মুক্তদশায় প্রকৃতি হইতে মুক্ত ।
(৮) জীব-জড়াত্মক সমস্ত বিশ্বই শ্রীহরি হইতে যুগপৎ ভেদ ও অভেদ ।
(৯) শুদ্ধভক্তিই জীবের সাধন ।
(১০) শুদ্ধ-কৃষ্ণপ্রীতিই জীবের সাধ্য ।
শুদ্ধভক্তির ক্রমপন্থা
(শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুর শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু হইতে উদ্ধৃত)
(১) শ্রদ্ধা—সাধুসঙ্গে শাস্ত্র-শ্রবণদ্বারা শাস্ত্রের অর্থে বিশ্বাস ।
(২) সাধুসঙ্গ—দ্বিতীয় সাধুসঙ্গ, ভজনরীতি-শিক্ষার জন্য ইহাই গুরুপদাশ্রয় ।
(৩) ভজনক্রিয়া—গুরু ও সাধুগণের উপদেশ-ক্রমে শ্রবণ-কীর্ত্তনাদিরূপ ভজন ।
(৪) অনর্থনিবৃত্তি—পরমপুরুষার্থ বিরোধী পাপ, অবিদ্যাদি ক্লেশ ক্ষয় ।
(৫) নিষ্ঠা—চিত্তবিক্ষেপশূন্য নিরন্তর ভজন ।
(৬) রুচি—বুদ্ধিপূর্ব্বক ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে অভিলাষ ।
(৭) আসক্তি—ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে স্বাভাবিকী রুচি ।
(৮) ভাব—প্রেমসূর্য্যের কিরণস্থলীয় বিশুদ্ধসত্ত্বরূপ রুচিদ্বারা চিত্তকে যে তত্ত্ব মসৃণ করে, তাহাকেই ‘ভাব’ বলে ।
(৯) প্রেম—যখন সেই ভাব চিত্তকে সম্যক্ মসৃণ করিয়া অত্যন্ত মমতা দ্বারা পরিচিত হয় এবং স্বয়ং গাঢ়-স্বরূপ হয়, তখন তাহাকে পণ্ডিতসকল ‘প্রেম” বলিয়া উক্তি করেন ।
চতুঃষষ্টি ভক্ত্যঙ্গ
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অমৃতপ্রবাহভাষ্য হইতে উদ্ধৃত)
(১) গুরুপাদাশ্রয়, (২) মন্ত্রদীক্ষা, (৩) গুরুসেবা, (৪) সদ্ধর্ম্ম শিক্ষা ও জিজ্ঞাসা, (৫) সাধুদিগের পথানুগমন, (৬) কৃষ্ণপ্রীতির জন্য নিজের ভোগত্যাগ, (৭) কৃষ্ণতীর্থে বাস, (৮) যাহামাত্র পাইলে জীবন নির্ব্বাহ হয়, সেইরূপ পরিমাণে প্রতিগ্রহ, (৯) একদশীর উপবাস, (১০) ধাত্রি-অশ্বত্থ-গো-বিপ্র-বৈষ্ণবের সম্মান, (১১) সেবাপরাধ ও নামাপরাধকে দূরে বর্জ্জন, (১২) অবৈষ্ণব-সঙ্গত্যাগ, (১৩) বহুশিষ্য না করা, (১৪) বহুগ্রন্থের কলা অর্থাৎ আংশিক অভ্যাস এবং ব্যাখ্যাবাদত্যাগ, (১৫) হানিতে এবং লাভে সমবুদ্ধি, (১৬) শোকাদির বশ না হওয়া, (১৭) অন্য দেবতা বা শাস্ত্রের অবজ্ঞা না করা, (১৮) বিষ্ণু ও বৈষ্ণবের নিন্দা না শুনা, (১৯) গ্রাম্যবার্ত্তা অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষের ইন্দ্রিয়তর্পণমূলক গৃহবার্ত্তা না শুনা, (২০) প্রাণিমাত্রের মনের উদ্বেগ না জন্মান, ব্যবহারে অকার্পণ্য, মহারম্ভের অনুদ্যম, (২১) শ্রবণ, (২২) কীর্ত্তন, (২৩) স্মরণ, (২৪) পূজন, (২৫) বন্দন, (২৬) পরিচর্য্যা, (২৭) দাস্য, (২৮) সখ্য, (২৯) আত্মনিবেদন, (৩০) শ্রীবিগ্রহের অগ্রে নৃত্য, (৩১) গীত, (৩২) বিজ্ঞপ্তি, (৩৩) দণ্ডবৎ প্রণাম, (৩৪) অভ্যুত্থান অর্থাৎ ভগবান্ বা ভক্ত আসিতেছেন দেখিয়া দাঁড়ান, (৩৫) অনুব্রজ্যা অর্থাৎ ভক্ত বা ভগবান্ যাত্রা করিলে পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়া, (৩৬) তীর্থে এবং ভগবদ্গৃহে গমন, (৩৭) পরিক্রমা, (৩৮) স্তবপাঠ, (৩৯) জপ, (৪০) সংকীর্ত্তন, (৪১) ভগবৎ-প্রসাদী ধূপ ও মাল্যের গন্ধগ্রহণ, (৪২) মহাপ্রসাদ সেবন, (৪৩) আরত্রিক-মহোৎসব-দর্শন, (৪৪) শ্রীমূর্ত্তি-দর্শন, (৪৫) নিজ প্রিয়বস্তু ভগবান্েক অর্পণ, (৪৬) ধ্যান, (৪৭) তুলসী-সেবন, (৪৮) বৈষ্ণব-সেবন, (৪৯) মথুরায় বাস, (৫০) ভাগবতের আস্বাদ, (৫১) কৃষ্ণের জন্য অখিল চেষ্টা, (৫২) তাঁহার কৃপা-প্রতীক্ষা, (৫৩) ভক্তগণের সহিত জন্মদিনাদির মহোৎসব, (৫৪) সর্ব্বপ্রকারে শরণাপত্তি, (৫৫) কার্ত্তিকাদি ব্রত, দেহে (৫৬) বৈষ্ণবচিহ্ণধারণ, দেহে (৫৭) হরিনামাক্ষরধারণ, দেহে (৫৮) নির্ম্মাল্যধারণ, (৫৯) চরণামৃত পান, (৬০) সাধুসঙ্গ, (৬১) নামকীর্ত্তন, (৬২) ভাগবৎ-শ্রবণ, (৬৩) মথুরাবাস, (৬৪) শ্রদ্ধাপূর্ব্বক শ্রীমূর্ত্তি-সেবা ।
চতুর্থ প্রকার অনর্
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীভজনরহস্য হইতে উদ্ধৃত)
(১) তত্ত্ব বিভ্রম—(ক) স্বতত্ত্বে ভ্রম, (খ) পরত্ত্বে ভ্রম, (গ) সাধ্য-সাধন-তত্ত্বে ভ্রম, (ঘ) বিরোধী বিষয়ে ভ্রম ।
(২) অসত্তৃষ্ণা—(ক) ঐহিক বিষয়ে এষণা অর্থাৎ ইচ্ছা বা অন্বেষণ, (খ) পারত্রিক বিষয়ে অশুভা এষণা, (গ) যোগ-বিভূতিবাঞ্ছা ও মোক্ষ কামনা ।
(৩) অপরাধ—(ক) নামাপরাধ, (খ) সেবাপরাধ, (গ) বৈষ্ণবাপরাধ, (ঘ) ধামাপরাধ, (ঙ) জীবাপরাধ ।
(৪) হৃদয়দৌর্ব্বল্য—(ক) তুচ্ছ অর্থাৎ কৃষ্ণেতর বিষয়ে আসক্তি, (খ) কুটীনাটী অর্থাৎ কপটতা, (গ) মাৎসর্য্য অর্থাৎ পরশ্রী কাতরতা, ও (ঘ) প্রতিষ্ঠাশা ।
পঞ্চরোগ
(১) অবিদ্যা—অজ্ঞান অর্থাৎ জীব নিজের চিৎস্বরূপ ভুলিয়াছে ।
(২) অস্মিতা—স্থুল জড়দেহে আত্মবুদ্ধি ও স্ত্রী-পুত্রাদির নশ্বরদেহে মমতাবুদ্ধি ।
(৩) রাগ—দেহের অনুকূল জড়বিষয়ে তীব্র আসক্তি ।
(৪) দ্বেষ—বিষয় ভোগের প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষবুদ্ধি ।
(৫) অভিনিবেশ—অনুকূল বিষয়ের প্রতি মমতা বা আবিষ্টতা এবং তাহার ত্যাগে অসহিষ্ণুতা ।
বদ্ধজীবের চারপ্রকার দোষ
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত হইতে উদ্ধৃত)
(১) ভ্রম—যে বস্তু যাহা নহে, তৎসম্বন্ধে মিথ্যজ্ঞান; যথা—রজ্জুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজত-ভ্রম ।
(২) প্রমাদ—অনবধানতা, এককথা অন্যপ্রকারে উপলব্ধি করা বা শ্রবণ করা বা বলা । (৩) বিপ্রলিপ্সা—বঞ্চনেচ্ছু ।
(৪) করণাপাটব—ইন্দ্রিয়ের অপটুতা; যথা—চক্ষুর দূরদর্শনরাহিত্য, ক্ষুদ্রবস্তুদর্শনরাহিত্য, কাম্লাদিরোগে বর্ণ (রূপ) জ্ঞানের বিপর্য্যয়, সুদূর-স্থিত শব্দশ্রবণে অক্ষমতা ।
দশবিধ নামাপরাধ
(১) সাধুনিন্দা,
(২) কৃষ্ণেতর দেবতায় স্বতন্ত্র ভগবদ্ জ্ঞান,
(৩) গুর্ববজ্ঞা,
(৪) শ্রুতিশাস্ত্র-নিন্দন,
(৫) শ্রীহরিনামে অর্থবাদ,
(৬) শ্রীনামে কল্পনা জ্ঞান,
(৭) শ্রীনামবলে পাপবুদ্ধি,
(৮) শ্রীহরিনাম গ্রহণকে প্রমাদবশতঃ অন্য শুভকর্মের সহিত সমান জ্ঞান,
(৯) জড়-আসক্তি-ক্রমে শ্রদ্ধাহীনে নাম-দান,
(১০) শ্রীনাম-মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াও জড় অহং-মমাদি ভাবপ্রযুক্ত নামের প্রতি অপ্রীতি ।
চতুর্থ প্রকার সাধুনিন্দা
যিনি বৈষ্ণবের (১) জাতি দোষ, (২) কাদাচিৎক অর্থাৎ প্রমাদাগত দোষ, (৩) নষ্টপ্রায় দোষ, (৪) শরণাগতির পূর্ব্বাচরিত দোষ ধরিয়া বৈষ্ণবকে নিন্দা করেন, তিনি বৈষ্ণব নিন্দুক ।
৩২ প্রকার সেবাপরাধ
(১) যানাদি-যোগে অথবা পাদুকা পরিধান করিয়া ভগবদ্-গৃহে গমন, (২) ভগবজ্জন্মাদি যাত্রার উৎসব না করা, (৩) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে প্রণাম না করা, (৪) উচ্ছিষ্টগাত্রে অথবা অশুচি অবস্থায় শ্রীবিগ্রহের বন্দনা, (৫) একহস্তে প্রণাম, (৬) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পায়চারি করা, (৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পাদ-প্রসারণ, (৮) পর্যঙ্ক-বন্ধন অর্থাৎ শ্রীবিগ্রহের অগ্রে হস্তদ্বয়দ্বারা জানুদ্বয় বন্ধনপূর্ব্বক উপবেশন, (৯–১৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে শয়ন, ভোজন, মিথ্যাভাষণ, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা , পরস্পর ইত কথার আলোচনা, রোদন, কলহ, কাহারও প্রতি নিগ্রহ, কাহারও প্রতি অনুগ্রহ, (১৮) সাধারণের প্রতি নিষ্ঠুর-বাক্য-ব্যবহার, (১৯) লোমকম্বলে আবৃত হইয়া সেবাকার্যাদি করা, (২০-২৩) শ্রীমূর্তির সম্মুখে পরনিন্দা, পরস্তুতি, অশ্লীল-বাক্য ব্যবহার, অপানবায়ু পরিত্যাগ, (২৪) বিত্তশাঠ্য অর্থাৎ সামর্থ্য থাকিতে অল্প উপচারে অথবা অল্প ব্যয়ে পূজা ও উৎসবাদি করা, (২৫) অনিবেদিত বস্তু গ্রহণ, (২৬) যে সময়ে যে ফল ও শস্যাদি উৎপন্ন হয়, সেই সময়ে তাহা অর্পণ না করা, (২৭) সংগৃহীত দ্রব্যের অগ্রভাগ অন্যকে প্রদান করিয়া অবশিষ্টাংশ ব্যঞ্জনে প্রদান, (২৮) শ্রীমূর্তিকে পশ্চাতে রাখিয়া উপবেশন, (২৯) শ্রীমূর্তির সম্মুখে অন্যকে অভিবাদন, (৩০) শ্রীগুরুদেবের অগ্রে স্তবাদি না করিয়া মৌনভাবে অবস্থান, (৩১) শ্রীগুরুদেবের সম্মুখে আত্ম-প্রশংসা, (৩২) দেবতা-নিন্দা ।
দশবিধ ধামাপরাধ
(১) শ্রীধাম-প্রদর্শক শ্রীগুরু ও সাধুকে অবজ্ঞা, (২) শ্রীধামকে অনিত্য-বোধ, (৩) শ্রীধামবাসী ও ভ্রমণকারীর প্রতি হিংসা ও জাতিবুদ্ধি, (৪) শ্রীধামে বসিয়া বিষয়কার্যাদির অনুষ্ঠান, (৫) শ্রীধাম-সেবাচ্ছলে শ্রীধাম-বিগ্রহের ব্যবসায় ও অর্থোপার্জন, (৬) জড়-বুদ্ধিতে ধামের সহিত জড়দেশের অথবা অন্য দেবতীর্থের সমজ্ঞান ও পরিমাণচেষ্টা, (৭) শ্রীধামবাস-বলে পাপাচরণ, (৮) শ্রীনবদ্বীপ ও শ্রীবৃন্দাবনে ভেদজ্ঞান, (৯) ধামমাহাত্ম্যমূলক শাস্ত্র-নিন্দা এবং (১০) শ্রীধাম-মাহাত্ম্যে অবিশ্বাসমূলে অর্থবাদ ও কল্পনা-জ্ঞান ।
কলির পাঁচ স্থান
(শ্রীমদ্ভাগবতম্ হইতে উদ্ধৃত)
(১) দ্যূত; যথা—তাস, দাবা, পাশা, ঘোড়দৌড়, জলের খেলা, জুয়া, লটারি, সতরঞ্চ, দশপঁচিশ, বাঘবন্দী, প্রভৃতি । তার মধ্যে মিথ্যা থাকে । এই করিলে সত্যের নাশ হয় ।
(২) পান; যথা—তাম্বূল, গুবাক, নস্য, তামাক, গাঁজা, অহিফেন, সুরা, ভাং, কালকূট, ধুস্তর, তাড়ি, প্রভৃতি । মাধ্বিক, ঐক্ষব, দ্রাক্ষ্য, তাল, খর্জ্জুর, পনসজাত, মৈরেয়, মাক্ষিক, টাঙ্ক, মাধুক, নারিকেলজাত ও অন্নজাত এই দ্বাদশপ্রকার মদ্যও পান মধ্যে গণ্য । তার মধ্যে গর্ব্ব থাকে । এই করিলে দয়ার নাশ হয় ।
(৩) স্ত্রী; যথা—অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ ও নিজ বৈধ স্ত্রীতে আসক্তি (এবং স্ত্রীসঙ্গীর সঙ্গ) । তার মধ্যে কাম থাকে । এই করিলে শৌচের নাশ হয় ।
(৪) সূনা অর্থাৎ নিজ দেহ পোষণের জন্য অপরকে হত্যা করা । প্রাণিবধের মধ্যে হিংসা থাকে । এই করিলে সত্য, দয়া, শৌচ এবং তপের নাশ হয় । পশুহননে অনুমোদনকারী, হতপশুর মাংসবিভাগকারী, স্বয়ং হন্তা, মাংসক্রয়বিক্রয়কারী, পাচক, পরিবেশক, এবং ভক্ষক এই কয়জনই ঘাতকশ্রেণীভুক্ত ।
(৫) জাত অর্থাৎ সুবর্ণ, রৌপ্যাদি দ্রব্য এবং টাকা পসায়া । স্বর্ণের মধ্যে মিথ্যা, গর্ব্ব, স্ত্রীজনিত কাম, হিংসা, ও শত্রুতা নামক একটী পঞ্চম অনর্থ বিরাজিত ।
ভক্তির প্রতিকূল
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) বাক্যবেগ—ভূতোদ্বেগকারী বচনপ্রয়োগ ।
(২) মনবেগ—নানাবিধ মনোরথ ।
(৩) ক্রোধবেগ—রূঢ়বাক্যাদি-প্রয়োগ ।
(৪) জিহ্বাবেগ—মধুর-অম্ল-কটু-লবণ-কষায়-তিক্তভেদে ষড়বিধ রস-লালসা ।
(৫) উদরবেগ—অত্যন্ত ভোজন-প্রয়াস ।
(৬) উপস্থবেগ—স্ত্রী-পুরুষ-সংযোগ-লালসা ।
ভক্তির কণ্টক
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) অত্যাহার—অধিক আহরণ বা সংগ্রহ বা সঞ্চয়চেষ্টা ।
(২) প্রয়াস—ভক্তি-বিরোধিচেষ্টা বা বিষয়োদ্যম ।
(৩) প্রজল্প—কালহরণকারী অনাবশ্যক গ্রাম্যকথা ।
(৪) নিয়মাগ্রহ—উচ্চাধিকার-প্রাপ্ত-সময়ে নিম্নাধিকারগত নিয়মে আগ্রহ এবং ভক্তিপোষক নিয়মের অগ্রহণ ।
(৫) জনসঙ্গ—শুদ্ধভক্ত-জনসঙ্গ ব্যতীত অন্যজনসঙ্গ ।
(৬) লৌল্য—নানামতবাদি-সঙ্গে অস্থির-সিদ্ধান্ত অর্থাৎ চাঞ্চল্য এবং তুচ্ছ বিষয়ে আকৃষ্ট হওয়া ।
ভক্তির অনুকূল
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) উৎসাহ—ভক্তির অনুষ্ঠানে ঔৎসুক্য, আদরের সহিত অনুশীলন ।
(২) নিশ্চয়—দৃঢ় বিশ্বাস ।
(৩) ধৈর্য্য—অভীষ্টলাভে বিলম্ব দেখিয়া সাধনাঙ্গে শৈথিল্য না করা ।
(৪) ভক্তিপোষক কর্ম্ম— শ্রবণ-কীর্ত্তনাদি এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্য স্বীয় ভোগ-সুখ-পারিত্যাগাদি ।
(৫) সঙ্গত্যাগ—অধর্ম্ম, স্ত্রীসঙ্গ, ও স্ত্রৈণ-ভাবরূপ যোষিৎসঙ্গ, যোষিৎসঙ্গি-সঙ্গ এবং অভক্ত অর্থাৎ বিষয়ী, মায়াবাদী, নিরীশ্বর ও ধর্ম্মধ্বজীর সঙ্গত্যাগ ।
(৬) সদ্বৃত্তি—সাধুগণ যে সদাচার অনুষ্ঠান করিয়াছেন এবং যে বৃত্তির দ্বারা জীবন নির্ব্বাহ করিয়াছেন ।
জয় ধ্বনি
জয় সপরিকর শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দর জীউ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেব-গোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী ভগবান্ শ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর কী জয় ! জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু কী জয় !
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী ঠাকুর কী জয় !
শ্রীনরোত্তম শ্যামানন্দ শ্রীনিবাস আচার্য্য প্রভু-ত্রয় কী জয় !
শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কী জয় !
শ্রীরূপ, সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট, দাস রঘুনাথ, ষড়্-গোস্বামী প্রভু কী জয় !
শ্রীরূপানুগ গুরুবর্গ কী জয় !
নামাচার্য্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল স্বরূপ দামোদর, শ্রীল রায় রামানন্দ শ্রীগৌরশক্তিবর্গ কী জয় !
প্রমসে কহো শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীমন মহাপ্রভু কী জয় !
শ্রীনবদ্বীপধাম কী জয় !
শ্রীপুরুষোত্তমধাম কী জয় !
বলদেব-সুভদ্রা-জগন্নাথ জীউ কী জয় !
শ্রীবৃন্দাবনধাম কী জয় !
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ গোপ-গোপী শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড গিরিগোবর্দ্ধন কী জয় !
গঙ্গা যমুনা কী জয় !
ভক্তিদেবী বৃন্দাদেবী তুলসীদেবী কী জয় !
গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কী জয় !
আকর মঠরাজ শ্রীচৈতন্য মঠ কী জয় !
তদীয় শাখা মঠসমূহ কী জয় !
শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ কী জয় !
বিশ্বব্যাপী তদীয় শাখা মঠ কী জয় !
অনন্তকোটী বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
সমবেত বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
হরিনামসঙ্কীর্ত্তন কী জয় !
নিতাই গৌর প্রেমানন্দে !
হরিবোল !
শ্রীহরিবাসর তিথি বিধি
প্রশ্ন: কখন শ্রীহরিবাসর তিথি পালনীয় ?
উত্তর: ভগবান্ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর লিখেছেন যে “একাদশীতে অরুণোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ এবং অন্যব্রতে সূর্য্যোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ করিয়া অবিদ্ধা ব্রতই পালনীয় । বিদ্ধা-ব্রত-পালন দোষ এবং অবিদ্ধা ব্রতপালনেই ভক্তি হয়” । শ্রীহরিভক্তিবিলাসমতে বছরের সকল শুদ্ধ (অবিদ্ধা) ব্রত তিথি বিশুদ্ধ সারস্বত গৌড়ীয় পঞ্জিকায় জানা যাবে ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীব্রতের পালন করতে হবে কেন ?
উত্তর: ষড়গোস্বামী অন্যতম মহাজন শ্রীল সনাতন গোস্বামী প্রভু লিখেছেন একাদশীব্রতের নিত্যতার (অবশ্য-কর্ত্তব্যতা) চারিটি কারণ—
তচ্চ কৃষ্ণপ্রীণনত্বাদ্বিধিপ্রাপ্তত্বতস্তথা ।
ভোজনস্য নিষেধাচ্চাকরণে প্রত্যবায়তঃ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস: ১২।৪)
“(১) শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতু, (২) শাস্ত্রীর বিধি থাকায়, (৩) ব্রতদিনে (অন্ন) ভোজন নিষেধ থাকায় এবং (৪) ব্রত অকরণে দোষভাগী হইতে হয়” । তিনি তাঁহার নিজ-কৃত ভাষ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন যে যদিও অকরণে দোষভাগীতা মুখ্য নিত্যতা, তবুও শুদ্ধভক্তগণের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতুতাই পরম মুখ্য, এই কারণে তিনি তাহাই প্রথম লিখেছিলেন এবং আরো বলেছেন—
তত্র ব্রতস্য নিত্যত্বাদবশ্যং তৎ সমাচরেৎ ।
সর্ব্বপাপাহং সর্ব্বার্থদং শ্রীকৃষ্ণতোষণম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩)
“এই শ্রীহরিবাসর-ব্রতের নিত্যতাহেতু সর্ব্বপাপহারী, সর্ব্বফলপ্রদ ও শ্রীকৃষ্ণতোষণ-ব্রত অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আচরণ করিবেন” ।
একাদশীব্রতং নাম সর্ব্বকামফলপ্রদম্ ।
কর্ত্তব্যং সর্ব্বদা বিপ্রৈর্বিষ্ণুপ্রীণনকারণম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৮ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“সকল কামফলপ্রদ শ্রীএকাদশীব্রত বিষ্ণু-তোষণের জন্যই বিপ্রগণের সর্ব্বদা আচরণ করা কর্ত্তব্য” । আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ চতুর্ব্বর্গ ফল (ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) এসে গেলেও ঐকান্তিক শুদ্ধভক্ত ঐ সকল তুচ্ছ ফল অনুরক্ত না হয়ে পঞ্চমপুরুষার্থ প্রেমফল লাভে আগ্রহী হয়ে থাকেন ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীতে অন্ন শস্যাদি গ্রহণ নিষেধ কেন ?
উত্তর: শাস্ত্র এই রূপ বলেছেন—
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাসমানি চ ।
অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে ।
তানি পাপান্যবাপ্নোতি ভুঞ্জানো হরিবাসরে
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১৯ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“ব্রহ্মহত্যা ও তৎসম এবং যতকিছু পাপ শ্রীহরিবাসরদিনে অন্নকে আশ্রয় করে থাকে । সুতরাং একাদশীতে অন্ন ভোজনকারী ব্যক্তি ঐসকল পাপ যুক্ত হয় ।”
সোঽশ্নাতি পার্থিবং পাপং যোঽশ্নোতি মধুভির্দ্দিনে ।
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২০ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“যে ব্যক্তি শ্রীহরিবাসরে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি পৃথিবীর যতকিছু পাপ ভোগ করে ।”
মাতৃহা পিতৃহা চৈব ভ্রাতৃহা গুরুহা তথা ।
একাদশ্যান্তু যো ভুঙ্ক্তে বিষ্ণুলোকাচ্চ্যুতো ভবেৎ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২১ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“যে ব্যক্তি একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ও গুরুহত্যার পাপ সকল প্রাপ্ত হয় এবং বিষ্ণুলোকে কখনও গমন করতে পরে না, বা বৈষ্ণবধর্ম্মচ্যুত হওয়ায় বৈষ্ণব সঙ্গ পায় না ।”
ইত্যাদি শাস্ত্র প্রমাণ অনুসারে শ্রীএকাদশীতে উপবাস করা কর্ত্তব্য ।
প্রশ্ন: উপবাস কাহাকে বলে ?
উত্তর: নিকটে বাস—গৃহকার্য্য-বিষয়কার্য্যাদি পরিত্যাগ করে ভগবানের নিকটে বাস । যথা—
উপাবৃত্তস্য পাপেভ্যো যস্তু বাসো গুণৈঃ সহ ।
উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ঃ সর্ব্বভোগবিবর্জ্জিতঃ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১৩।৩৫ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“সকল পাপ হতে নিবৃত্ত হয়ে সদ্গুণ সমূহের সহিত যে মনুষ্যের বাস হয়, তাহাকে উপবাস বলে, এই উপবাসে সমস্ত ভোগ বর্জ্জিত জানতে হবে” ।
বৈষ্ণবো যদি ভুঞ্জীত একাদশ্যাং প্রমাদতঃ ।
বিষ্ণ্বর্চ্চনং বৃথা তস্য নরকং ঘোরমাপ্নুয়াৎ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩২ সংখ্যায় ব্রহ্মবৈবর্ত্তপূরণ-বাক্য)
“বৈষ্ণব যদি ভ্রম বশতঃ একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, তবে তাহার বিষ্ণুপূজা বিফল হয় এবং তাহার ভয়ঙ্কর নরক প্রাপ্তি হয়” ।
প্রশ্ন: কিভাবে শ্রীহরিবাসর তিথি পালন করতে হবে ?
উত্তর: শ্রীহরিবাসরের মূলকৃত্য শ্রবণ, কীর্ত্তনাদি নববিধা-ভক্তি যজন । যেমন শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেন (শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১০,২১)—
শ্রীহরিবাসর-দিনে কৃষ্ণনামরসপানে তৃপ্ত হয় বৈষ্ণব সুজন ।
অন্য রস নাহি লয় অন্য কথা নাহি কয় সর্ব্বভোগ করয়ে বর্জ্জন ॥
শ্রীনামভজন আর একাদশী ব্রত ।
এক-তত্ত্ব নিত্য জানি’ হও তাহে রত ॥
শ্রীহরি-বাসরে অধিক কীর্ত্তনদ্বয় করণীয়—সকালে শ্রীহরিবাসরে হরিকীর্ত্তন-বিধান ও রাত্রিতে শুদ্ধ ভকত-চরণ-রেনু ভজন-অনুকূল । শ্রীহরিবাসরে উপবাস এবং পারণ করা কর্ত্তব্য, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—
প্রসাদ ভোজন নিত্য শুদ্ধ বৈষ্ণবের কৃত্য অপ্রসাদ না করে ভক্ষণ ।
শুদ্ধা একাদশী যবে নিরাহার থাকে তবে পারণেতে প্রসাদ ভোজন ॥১১॥
পঞ্জিকায় উল্লিখিত পারণ সময়ের মধ্যে শ্রীএকাদশী ব্রত ভঙ্গের জন্য মহাপ্রসাদাদি গ্রহণ অবশ্য কর্ত্তব্য । শ্রীহরিবাসরে যেন সারাদিন সেবা-সাধনে থাকা যায় তার জন্য শাস্ত্র অনুমোদিত অনুকল্প গ্রহণীয়, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—
অনুকল্পস্থানমাত্র নিরন্ন প্রসাদপাত্র বৈষ্ণবকে জানিহ নিশ্চিত ।
শ্রীএকাদশীতে অনুকল্প আয়োজন এই রূপ—
অষ্টৈতান্যব্রতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ ।
হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১০০ সংখ্যায় মহাভারত-বাক্য)
“জল, ফল, মূল, দুগ্ধ, ঘৃত ও ব্রাহ্মণ প্রার্থনীয়, গুরুবাক্য ও ঔষধ—এই আটটি ব্রতনাশক হয় না” । শ্রীমঠে ভক্তগণ এইভাবে অনুকল্প গ্রহণ করেন—
সকালে—পূর্ণ উপবাস ।
মধ্যাহ্নে—লবণ, গোল মরীচ, জীরা, আদা সহ আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বিভিন্ন ফল (কলা, শশা আদি), বাদাম, পেপে মিষ্টি আলু পায়েস বা সাগু ।
রাত্রিতে—আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বাদাম, দুধ ।
শুধু ঘি, বাদাম তেল, সূর্য্যমুখী তেল ব্যবহার করা যাবে । শস্যযুক্ত কোন দ্রব্য যেমন গুড়া মশলা, ময়দাযুক্ত সাগু ইত্যাদি গ্রহণ করা যাবে না । সেইজন্য ঘরের তৈরী ঘি, ছানা অথবা নারকেল মিষ্টি দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে । এই সকল পঞ্চ রবিশস্য অবশ্যই বর্জ্জনীয়—(১) ধান্য অথবা ধান্যজাতীয় দ্রব্য—চাল, চিড়া, মুড়ি প্রভৃতি, (২) গোধূম—আটা, ময়দা প্রভৃতি, (৩) যব—যবের ছাতু, বার্লি প্রভৃতি, (৪) ডাল—মুগ, মসূর, ছোলা, মটর, অড়হর, কলাই, খেসারি প্রভৃতি, (৫) সরিষার তৈল ও তিল তৈল ।
তদ্ভিন্নাংশাংশ্চ জীবান্ প্রকৃতি-কবলিতান্ তদ্বিমুক্তাংশ্চ ভাবাৎ ।
ভেদাভেদ-প্রকাশং সকলমপি হরেঃ সাধনং শুদ্ধভক্তিং
সাধ্যং তৎ প্রীতিমেবেত্যুপদিশতি জনান্ গৌরচন্দ্র স্বয়ং সঃ ॥
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর)
স্বয়ং ভগবান্ শ্রীমদ্ গৌরচন্দ্র এই দশটি তত্ত্ব জীবগণকে উপদেশ করিতেছেন ।
(১) আম্নায়-বাক্যই প্রধান প্রমাণ । তদ্দ্বারা নিম্নলিখিত নয়টি সিদ্ধান্ত উপদিষ্ট হইয়াছে ।
(২) কৃষ্ণস্বরূপ হরি জগন্মধ্যে পরমতত্ত্ব ।
(৩) তিনি সর্ব্বশক্তিমান্ ।
(৪) তিনি অখিল-রসামৃত-সমুদ্র ।
(৫) জীবসকল হরির বিভিন্নাংশ তত্ত্ব ।
(৬) তটস্থ গঠনবশতঃ জীবসকল বদ্ধদশায় প্রকৃতিকর্ত্তৃক কবলিত ।
(৭) তটস্থ ধর্ম্মবশতঃ জীবসকল মুক্তদশায় প্রকৃতি হইতে মুক্ত ।
(৮) জীব-জড়াত্মক সমস্ত বিশ্বই শ্রীহরি হইতে যুগপৎ ভেদ ও অভেদ ।
(৯) শুদ্ধভক্তিই জীবের সাধন ।
(১০) শুদ্ধ-কৃষ্ণপ্রীতিই জীবের সাধ্য ।
শুদ্ধভক্তির ক্রমপন্থা
(শ্রীল রূপ গোস্বামী প্রভুর শ্রীভক্তিরসামৃতসিন্ধু হইতে উদ্ধৃত)
(১) শ্রদ্ধা—সাধুসঙ্গে শাস্ত্র-শ্রবণদ্বারা শাস্ত্রের অর্থে বিশ্বাস ।
(২) সাধুসঙ্গ—দ্বিতীয় সাধুসঙ্গ, ভজনরীতি-শিক্ষার জন্য ইহাই গুরুপদাশ্রয় ।
(৩) ভজনক্রিয়া—গুরু ও সাধুগণের উপদেশ-ক্রমে শ্রবণ-কীর্ত্তনাদিরূপ ভজন ।
(৪) অনর্থনিবৃত্তি—পরমপুরুষার্থ বিরোধী পাপ, অবিদ্যাদি ক্লেশ ক্ষয় ।
(৫) নিষ্ঠা—চিত্তবিক্ষেপশূন্য নিরন্তর ভজন ।
(৬) রুচি—বুদ্ধিপূর্ব্বক ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে অভিলাষ ।
(৭) আসক্তি—ভজনে বা ভজনীয় বিষয়ে স্বাভাবিকী রুচি ।
(৮) ভাব—প্রেমসূর্য্যের কিরণস্থলীয় বিশুদ্ধসত্ত্বরূপ রুচিদ্বারা চিত্তকে যে তত্ত্ব মসৃণ করে, তাহাকেই ‘ভাব’ বলে ।
(৯) প্রেম—যখন সেই ভাব চিত্তকে সম্যক্ মসৃণ করিয়া অত্যন্ত মমতা দ্বারা পরিচিত হয় এবং স্বয়ং গাঢ়-স্বরূপ হয়, তখন তাহাকে পণ্ডিতসকল ‘প্রেম” বলিয়া উক্তি করেন ।
চতুঃষষ্টি ভক্ত্যঙ্গ
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের অমৃতপ্রবাহভাষ্য হইতে উদ্ধৃত)
(১) গুরুপাদাশ্রয়, (২) মন্ত্রদীক্ষা, (৩) গুরুসেবা, (৪) সদ্ধর্ম্ম শিক্ষা ও জিজ্ঞাসা, (৫) সাধুদিগের পথানুগমন, (৬) কৃষ্ণপ্রীতির জন্য নিজের ভোগত্যাগ, (৭) কৃষ্ণতীর্থে বাস, (৮) যাহামাত্র পাইলে জীবন নির্ব্বাহ হয়, সেইরূপ পরিমাণে প্রতিগ্রহ, (৯) একদশীর উপবাস, (১০) ধাত্রি-অশ্বত্থ-গো-বিপ্র-বৈষ্ণবের সম্মান, (১১) সেবাপরাধ ও নামাপরাধকে দূরে বর্জ্জন, (১২) অবৈষ্ণব-সঙ্গত্যাগ, (১৩) বহুশিষ্য না করা, (১৪) বহুগ্রন্থের কলা অর্থাৎ আংশিক অভ্যাস এবং ব্যাখ্যাবাদত্যাগ, (১৫) হানিতে এবং লাভে সমবুদ্ধি, (১৬) শোকাদির বশ না হওয়া, (১৭) অন্য দেবতা বা শাস্ত্রের অবজ্ঞা না করা, (১৮) বিষ্ণু ও বৈষ্ণবের নিন্দা না শুনা, (১৯) গ্রাম্যবার্ত্তা অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষের ইন্দ্রিয়তর্পণমূলক গৃহবার্ত্তা না শুনা, (২০) প্রাণিমাত্রের মনের উদ্বেগ না জন্মান, ব্যবহারে অকার্পণ্য, মহারম্ভের অনুদ্যম, (২১) শ্রবণ, (২২) কীর্ত্তন, (২৩) স্মরণ, (২৪) পূজন, (২৫) বন্দন, (২৬) পরিচর্য্যা, (২৭) দাস্য, (২৮) সখ্য, (২৯) আত্মনিবেদন, (৩০) শ্রীবিগ্রহের অগ্রে নৃত্য, (৩১) গীত, (৩২) বিজ্ঞপ্তি, (৩৩) দণ্ডবৎ প্রণাম, (৩৪) অভ্যুত্থান অর্থাৎ ভগবান্ বা ভক্ত আসিতেছেন দেখিয়া দাঁড়ান, (৩৫) অনুব্রজ্যা অর্থাৎ ভক্ত বা ভগবান্ যাত্রা করিলে পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়া, (৩৬) তীর্থে এবং ভগবদ্গৃহে গমন, (৩৭) পরিক্রমা, (৩৮) স্তবপাঠ, (৩৯) জপ, (৪০) সংকীর্ত্তন, (৪১) ভগবৎ-প্রসাদী ধূপ ও মাল্যের গন্ধগ্রহণ, (৪২) মহাপ্রসাদ সেবন, (৪৩) আরত্রিক-মহোৎসব-দর্শন, (৪৪) শ্রীমূর্ত্তি-দর্শন, (৪৫) নিজ প্রিয়বস্তু ভগবান্েক অর্পণ, (৪৬) ধ্যান, (৪৭) তুলসী-সেবন, (৪৮) বৈষ্ণব-সেবন, (৪৯) মথুরায় বাস, (৫০) ভাগবতের আস্বাদ, (৫১) কৃষ্ণের জন্য অখিল চেষ্টা, (৫২) তাঁহার কৃপা-প্রতীক্ষা, (৫৩) ভক্তগণের সহিত জন্মদিনাদির মহোৎসব, (৫৪) সর্ব্বপ্রকারে শরণাপত্তি, (৫৫) কার্ত্তিকাদি ব্রত, দেহে (৫৬) বৈষ্ণবচিহ্ণধারণ, দেহে (৫৭) হরিনামাক্ষরধারণ, দেহে (৫৮) নির্ম্মাল্যধারণ, (৫৯) চরণামৃত পান, (৬০) সাধুসঙ্গ, (৬১) নামকীর্ত্তন, (৬২) ভাগবৎ-শ্রবণ, (৬৩) মথুরাবাস, (৬৪) শ্রদ্ধাপূর্ব্বক শ্রীমূর্ত্তি-সেবা ।
চতুর্থ প্রকার অনর্
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুরের শ্রীভজনরহস্য হইতে উদ্ধৃত)
(১) তত্ত্ব বিভ্রম—(ক) স্বতত্ত্বে ভ্রম, (খ) পরত্ত্বে ভ্রম, (গ) সাধ্য-সাধন-তত্ত্বে ভ্রম, (ঘ) বিরোধী বিষয়ে ভ্রম ।
(২) অসত্তৃষ্ণা—(ক) ঐহিক বিষয়ে এষণা অর্থাৎ ইচ্ছা বা অন্বেষণ, (খ) পারত্রিক বিষয়ে অশুভা এষণা, (গ) যোগ-বিভূতিবাঞ্ছা ও মোক্ষ কামনা ।
(৩) অপরাধ—(ক) নামাপরাধ, (খ) সেবাপরাধ, (গ) বৈষ্ণবাপরাধ, (ঘ) ধামাপরাধ, (ঙ) জীবাপরাধ ।
(৪) হৃদয়দৌর্ব্বল্য—(ক) তুচ্ছ অর্থাৎ কৃষ্ণেতর বিষয়ে আসক্তি, (খ) কুটীনাটী অর্থাৎ কপটতা, (গ) মাৎসর্য্য অর্থাৎ পরশ্রী কাতরতা, ও (ঘ) প্রতিষ্ঠাশা ।
পঞ্চরোগ
(১) অবিদ্যা—অজ্ঞান অর্থাৎ জীব নিজের চিৎস্বরূপ ভুলিয়াছে ।
(২) অস্মিতা—স্থুল জড়দেহে আত্মবুদ্ধি ও স্ত্রী-পুত্রাদির নশ্বরদেহে মমতাবুদ্ধি ।
(৩) রাগ—দেহের অনুকূল জড়বিষয়ে তীব্র আসক্তি ।
(৪) দ্বেষ—বিষয় ভোগের প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষবুদ্ধি ।
(৫) অভিনিবেশ—অনুকূল বিষয়ের প্রতি মমতা বা আবিষ্টতা এবং তাহার ত্যাগে অসহিষ্ণুতা ।
বদ্ধজীবের চারপ্রকার দোষ
(শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত হইতে উদ্ধৃত)
(১) ভ্রম—যে বস্তু যাহা নহে, তৎসম্বন্ধে মিথ্যজ্ঞান; যথা—রজ্জুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজত-ভ্রম ।
(২) প্রমাদ—অনবধানতা, এককথা অন্যপ্রকারে উপলব্ধি করা বা শ্রবণ করা বা বলা । (৩) বিপ্রলিপ্সা—বঞ্চনেচ্ছু ।
(৪) করণাপাটব—ইন্দ্রিয়ের অপটুতা; যথা—চক্ষুর দূরদর্শনরাহিত্য, ক্ষুদ্রবস্তুদর্শনরাহিত্য, কাম্লাদিরোগে বর্ণ (রূপ) জ্ঞানের বিপর্য্যয়, সুদূর-স্থিত শব্দশ্রবণে অক্ষমতা ।
দশবিধ নামাপরাধ
(১) সাধুনিন্দা,
(২) কৃষ্ণেতর দেবতায় স্বতন্ত্র ভগবদ্ জ্ঞান,
(৩) গুর্ববজ্ঞা,
(৪) শ্রুতিশাস্ত্র-নিন্দন,
(৫) শ্রীহরিনামে অর্থবাদ,
(৬) শ্রীনামে কল্পনা জ্ঞান,
(৭) শ্রীনামবলে পাপবুদ্ধি,
(৮) শ্রীহরিনাম গ্রহণকে প্রমাদবশতঃ অন্য শুভকর্মের সহিত সমান জ্ঞান,
(৯) জড়-আসক্তি-ক্রমে শ্রদ্ধাহীনে নাম-দান,
(১০) শ্রীনাম-মাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়াও জড় অহং-মমাদি ভাবপ্রযুক্ত নামের প্রতি অপ্রীতি ।
চতুর্থ প্রকার সাধুনিন্দা
যিনি বৈষ্ণবের (১) জাতি দোষ, (২) কাদাচিৎক অর্থাৎ প্রমাদাগত দোষ, (৩) নষ্টপ্রায় দোষ, (৪) শরণাগতির পূর্ব্বাচরিত দোষ ধরিয়া বৈষ্ণবকে নিন্দা করেন, তিনি বৈষ্ণব নিন্দুক ।
৩২ প্রকার সেবাপরাধ
(১) যানাদি-যোগে অথবা পাদুকা পরিধান করিয়া ভগবদ্-গৃহে গমন, (২) ভগবজ্জন্মাদি যাত্রার উৎসব না করা, (৩) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে প্রণাম না করা, (৪) উচ্ছিষ্টগাত্রে অথবা অশুচি অবস্থায় শ্রীবিগ্রহের বন্দনা, (৫) একহস্তে প্রণাম, (৬) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পায়চারি করা, (৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে পাদ-প্রসারণ, (৮) পর্যঙ্ক-বন্ধন অর্থাৎ শ্রীবিগ্রহের অগ্রে হস্তদ্বয়দ্বারা জানুদ্বয় বন্ধনপূর্ব্বক উপবেশন, (৯–১৭) শ্রীবিগ্রহের সম্মুখে শয়ন, ভোজন, মিথ্যাভাষণ, উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা , পরস্পর ইত কথার আলোচনা, রোদন, কলহ, কাহারও প্রতি নিগ্রহ, কাহারও প্রতি অনুগ্রহ, (১৮) সাধারণের প্রতি নিষ্ঠুর-বাক্য-ব্যবহার, (১৯) লোমকম্বলে আবৃত হইয়া সেবাকার্যাদি করা, (২০-২৩) শ্রীমূর্তির সম্মুখে পরনিন্দা, পরস্তুতি, অশ্লীল-বাক্য ব্যবহার, অপানবায়ু পরিত্যাগ, (২৪) বিত্তশাঠ্য অর্থাৎ সামর্থ্য থাকিতে অল্প উপচারে অথবা অল্প ব্যয়ে পূজা ও উৎসবাদি করা, (২৫) অনিবেদিত বস্তু গ্রহণ, (২৬) যে সময়ে যে ফল ও শস্যাদি উৎপন্ন হয়, সেই সময়ে তাহা অর্পণ না করা, (২৭) সংগৃহীত দ্রব্যের অগ্রভাগ অন্যকে প্রদান করিয়া অবশিষ্টাংশ ব্যঞ্জনে প্রদান, (২৮) শ্রীমূর্তিকে পশ্চাতে রাখিয়া উপবেশন, (২৯) শ্রীমূর্তির সম্মুখে অন্যকে অভিবাদন, (৩০) শ্রীগুরুদেবের অগ্রে স্তবাদি না করিয়া মৌনভাবে অবস্থান, (৩১) শ্রীগুরুদেবের সম্মুখে আত্ম-প্রশংসা, (৩২) দেবতা-নিন্দা ।
দশবিধ ধামাপরাধ
(১) শ্রীধাম-প্রদর্শক শ্রীগুরু ও সাধুকে অবজ্ঞা, (২) শ্রীধামকে অনিত্য-বোধ, (৩) শ্রীধামবাসী ও ভ্রমণকারীর প্রতি হিংসা ও জাতিবুদ্ধি, (৪) শ্রীধামে বসিয়া বিষয়কার্যাদির অনুষ্ঠান, (৫) শ্রীধাম-সেবাচ্ছলে শ্রীধাম-বিগ্রহের ব্যবসায় ও অর্থোপার্জন, (৬) জড়-বুদ্ধিতে ধামের সহিত জড়দেশের অথবা অন্য দেবতীর্থের সমজ্ঞান ও পরিমাণচেষ্টা, (৭) শ্রীধামবাস-বলে পাপাচরণ, (৮) শ্রীনবদ্বীপ ও শ্রীবৃন্দাবনে ভেদজ্ঞান, (৯) ধামমাহাত্ম্যমূলক শাস্ত্র-নিন্দা এবং (১০) শ্রীধাম-মাহাত্ম্যে অবিশ্বাসমূলে অর্থবাদ ও কল্পনা-জ্ঞান ।
কলির পাঁচ স্থান
(শ্রীমদ্ভাগবতম্ হইতে উদ্ধৃত)
(১) দ্যূত; যথা—তাস, দাবা, পাশা, ঘোড়দৌড়, জলের খেলা, জুয়া, লটারি, সতরঞ্চ, দশপঁচিশ, বাঘবন্দী, প্রভৃতি । তার মধ্যে মিথ্যা থাকে । এই করিলে সত্যের নাশ হয় ।
(২) পান; যথা—তাম্বূল, গুবাক, নস্য, তামাক, গাঁজা, অহিফেন, সুরা, ভাং, কালকূট, ধুস্তর, তাড়ি, প্রভৃতি । মাধ্বিক, ঐক্ষব, দ্রাক্ষ্য, তাল, খর্জ্জুর, পনসজাত, মৈরেয়, মাক্ষিক, টাঙ্ক, মাধুক, নারিকেলজাত ও অন্নজাত এই দ্বাদশপ্রকার মদ্যও পান মধ্যে গণ্য । তার মধ্যে গর্ব্ব থাকে । এই করিলে দয়ার নাশ হয় ।
(৩) স্ত্রী; যথা—অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ ও নিজ বৈধ স্ত্রীতে আসক্তি (এবং স্ত্রীসঙ্গীর সঙ্গ) । তার মধ্যে কাম থাকে । এই করিলে শৌচের নাশ হয় ।
(৪) সূনা অর্থাৎ নিজ দেহ পোষণের জন্য অপরকে হত্যা করা । প্রাণিবধের মধ্যে হিংসা থাকে । এই করিলে সত্য, দয়া, শৌচ এবং তপের নাশ হয় । পশুহননে অনুমোদনকারী, হতপশুর মাংসবিভাগকারী, স্বয়ং হন্তা, মাংসক্রয়বিক্রয়কারী, পাচক, পরিবেশক, এবং ভক্ষক এই কয়জনই ঘাতকশ্রেণীভুক্ত ।
(৫) জাত অর্থাৎ সুবর্ণ, রৌপ্যাদি দ্রব্য এবং টাকা পসায়া । স্বর্ণের মধ্যে মিথ্যা, গর্ব্ব, স্ত্রীজনিত কাম, হিংসা, ও শত্রুতা নামক একটী পঞ্চম অনর্থ বিরাজিত ।
ভক্তির প্রতিকূল
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) বাক্যবেগ—ভূতোদ্বেগকারী বচনপ্রয়োগ ।
(২) মনবেগ—নানাবিধ মনোরথ ।
(৩) ক্রোধবেগ—রূঢ়বাক্যাদি-প্রয়োগ ।
(৪) জিহ্বাবেগ—মধুর-অম্ল-কটু-লবণ-কষায়-তিক্তভেদে ষড়বিধ রস-লালসা ।
(৫) উদরবেগ—অত্যন্ত ভোজন-প্রয়াস ।
(৬) উপস্থবেগ—স্ত্রী-পুরুষ-সংযোগ-লালসা ।
ভক্তির কণ্টক
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) অত্যাহার—অধিক আহরণ বা সংগ্রহ বা সঞ্চয়চেষ্টা ।
(২) প্রয়াস—ভক্তি-বিরোধিচেষ্টা বা বিষয়োদ্যম ।
(৩) প্রজল্প—কালহরণকারী অনাবশ্যক গ্রাম্যকথা ।
(৪) নিয়মাগ্রহ—উচ্চাধিকার-প্রাপ্ত-সময়ে নিম্নাধিকারগত নিয়মে আগ্রহ এবং ভক্তিপোষক নিয়মের অগ্রহণ ।
(৫) জনসঙ্গ—শুদ্ধভক্ত-জনসঙ্গ ব্যতীত অন্যজনসঙ্গ ।
(৬) লৌল্য—নানামতবাদি-সঙ্গে অস্থির-সিদ্ধান্ত অর্থাৎ চাঞ্চল্য এবং তুচ্ছ বিষয়ে আকৃষ্ট হওয়া ।
ভক্তির অনুকূল
(শ্রীল ভক্তিবিনোদ প্রভুর শ্রীউপদেশামৃতের পীযূষবর্ষিণী বৃত্তি হইতে উদ্ধৃত)
(১) উৎসাহ—ভক্তির অনুষ্ঠানে ঔৎসুক্য, আদরের সহিত অনুশীলন ।
(২) নিশ্চয়—দৃঢ় বিশ্বাস ।
(৩) ধৈর্য্য—অভীষ্টলাভে বিলম্ব দেখিয়া সাধনাঙ্গে শৈথিল্য না করা ।
(৪) ভক্তিপোষক কর্ম্ম— শ্রবণ-কীর্ত্তনাদি এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্য স্বীয় ভোগ-সুখ-পারিত্যাগাদি ।
(৫) সঙ্গত্যাগ—অধর্ম্ম, স্ত্রীসঙ্গ, ও স্ত্রৈণ-ভাবরূপ যোষিৎসঙ্গ, যোষিৎসঙ্গি-সঙ্গ এবং অভক্ত অর্থাৎ বিষয়ী, মায়াবাদী, নিরীশ্বর ও ধর্ম্মধ্বজীর সঙ্গত্যাগ ।
(৬) সদ্বৃত্তি—সাধুগণ যে সদাচার অনুষ্ঠান করিয়াছেন এবং যে বৃত্তির দ্বারা জীবন নির্ব্বাহ করিয়াছেন ।
জয় ধ্বনি
জয় সপরিকর শ্রীশ্রীগুরু-গৌরাঙ্গ-গান্ধর্ব্বা-গোবিন্দসুন্দর জীউ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিনির্ম্মল আচার্য্য মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিসুন্দর গোবিন্দ দেব-গোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী শ্রীমদ্ভক্তিরক্ষক শ্রীধর দেবগোস্বামী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ পরমহংস পরিব্রাজকাচার্য্যবর্য্য অষ্টোত্তরশতশ্রী ভগবান্ শ্রীমদ্ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর কী জয় !
জয় ঁও বিষ্ণুপাদ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল সচ্চিদানন্দ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর কী জয় ! জয় ওঁ বিষ্ণুপাদ শ্রীল জগন্নাথ দাস বাবাজী মহারাজ কী জয় !
শ্রীল বলদেব বিদ্যাভূষণ প্রভু কী জয় !
শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্ত্তী ঠাকুর কী জয় !
শ্রীনরোত্তম শ্যামানন্দ শ্রীনিবাস আচার্য্য প্রভু-ত্রয় কী জয় !
শ্রীল বৃন্দাবন দাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী কী জয় !
শ্রীরূপ, সনাতন, ভট্ট রঘুনাথ, শ্রীজীব, গোপাল ভট্ট, দাস রঘুনাথ, ষড়্-গোস্বামী প্রভু কী জয় !
শ্রীরূপানুগ গুরুবর্গ কী জয় !
নামাচার্য্য শ্রীল হরিদাস ঠাকুর কী জয় !
শ্রীল স্বরূপ দামোদর, শ্রীল রায় রামানন্দ শ্রীগৌরশক্তিবর্গ কী জয় !
প্রমসে কহো শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌরভক্তবৃন্দ কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কী জয় !
সপার্ষদ শ্রীমন মহাপ্রভু কী জয় !
শ্রীনবদ্বীপধাম কী জয় !
শ্রীপুরুষোত্তমধাম কী জয় !
বলদেব-সুভদ্রা-জগন্নাথ জীউ কী জয় !
শ্রীবৃন্দাবনধাম কী জয় !
শ্রীশ্রীরাধাকৃষ্ণ গোপ-গোপী শ্যামকুণ্ড রাধাকুণ্ড গিরিগোবর্দ্ধন কী জয় !
গঙ্গা যমুনা কী জয় !
ভক্তিদেবী বৃন্দাদেবী তুলসীদেবী কী জয় !
গ্রন্থরাজ শ্রীমদ্ভাগবতম্ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কী জয় !
আকর মঠরাজ শ্রীচৈতন্য মঠ কী জয় !
তদীয় শাখা মঠসমূহ কী জয় !
শ্রীচৈতন্য-সারস্বত মঠ কী জয় !
বিশ্বব্যাপী তদীয় শাখা মঠ কী জয় !
অনন্তকোটী বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
সমবেত বৈষ্ণববৃন্দ কী জয় !
হরিনামসঙ্কীর্ত্তন কী জয় !
নিতাই গৌর প্রেমানন্দে !
হরিবোল !
শ্রীহরিবাসর তিথি বিধি
প্রশ্ন: কখন শ্রীহরিবাসর তিথি পালনীয় ?
উত্তর: ভগবান্ শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর লিখেছেন যে “একাদশীতে অরুণোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ এবং অন্যব্রতে সূর্য্যোদয়-বিদ্ধা ত্যাগ করিয়া অবিদ্ধা ব্রতই পালনীয় । বিদ্ধা-ব্রত-পালন দোষ এবং অবিদ্ধা ব্রতপালনেই ভক্তি হয়” । শ্রীহরিভক্তিবিলাসমতে বছরের সকল শুদ্ধ (অবিদ্ধা) ব্রত তিথি বিশুদ্ধ সারস্বত গৌড়ীয় পঞ্জিকায় জানা যাবে ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীব্রতের পালন করতে হবে কেন ?
উত্তর: ষড়গোস্বামী অন্যতম মহাজন শ্রীল সনাতন গোস্বামী প্রভু লিখেছেন একাদশীব্রতের নিত্যতার (অবশ্য-কর্ত্তব্যতা) চারিটি কারণ—
তচ্চ কৃষ্ণপ্রীণনত্বাদ্বিধিপ্রাপ্তত্বতস্তথা ।
ভোজনস্য নিষেধাচ্চাকরণে প্রত্যবায়তঃ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস: ১২।৪)
“(১) শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতু, (২) শাস্ত্রীর বিধি থাকায়, (৩) ব্রতদিনে (অন্ন) ভোজন নিষেধ থাকায় এবং (৪) ব্রত অকরণে দোষভাগী হইতে হয়” । তিনি তাঁহার নিজ-কৃত ভাষ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন যে যদিও অকরণে দোষভাগীতা মুখ্য নিত্যতা, তবুও শুদ্ধভক্তগণের পক্ষে শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিহেতুতাই পরম মুখ্য, এই কারণে তিনি তাহাই প্রথম লিখেছিলেন এবং আরো বলেছেন—
তত্র ব্রতস্য নিত্যত্বাদবশ্যং তৎ সমাচরেৎ ।
সর্ব্বপাপাহং সর্ব্বার্থদং শ্রীকৃষ্ণতোষণম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩)
“এই শ্রীহরিবাসর-ব্রতের নিত্যতাহেতু সর্ব্বপাপহারী, সর্ব্বফলপ্রদ ও শ্রীকৃষ্ণতোষণ-ব্রত অবশ্য সম্পূর্ণভাবে আচরণ করিবেন” ।
একাদশীব্রতং নাম সর্ব্বকামফলপ্রদম্ ।
কর্ত্তব্যং সর্ব্বদা বিপ্রৈর্বিষ্ণুপ্রীণনকারণম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৮ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“সকল কামফলপ্রদ শ্রীএকাদশীব্রত বিষ্ণু-তোষণের জন্যই বিপ্রগণের সর্ব্বদা আচরণ করা কর্ত্তব্য” । আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ চতুর্ব্বর্গ ফল (ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ) এসে গেলেও ঐকান্তিক শুদ্ধভক্ত ঐ সকল তুচ্ছ ফল অনুরক্ত না হয়ে পঞ্চমপুরুষার্থ প্রেমফল লাভে আগ্রহী হয়ে থাকেন ।
প্রশ্ন: শ্রীএকাদশীতে অন্ন শস্যাদি গ্রহণ নিষেধ কেন ?
উত্তর: শাস্ত্র এই রূপ বলেছেন—
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাসমানি চ ।
অন্নমাশ্রিত্য তিষ্ঠন্তি সম্প্রাপ্তে হরিবাসরে ।
তানি পাপান্যবাপ্নোতি ভুঞ্জানো হরিবাসরে
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১৯ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“ব্রহ্মহত্যা ও তৎসম এবং যতকিছু পাপ শ্রীহরিবাসরদিনে অন্নকে আশ্রয় করে থাকে । সুতরাং একাদশীতে অন্ন ভোজনকারী ব্যক্তি ঐসকল পাপ যুক্ত হয় ।”
সোঽশ্নাতি পার্থিবং পাপং যোঽশ্নোতি মধুভির্দ্দিনে ।
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২০ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“যে ব্যক্তি শ্রীহরিবাসরে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি পৃথিবীর যতকিছু পাপ ভোগ করে ।”
মাতৃহা পিতৃহা চৈব ভ্রাতৃহা গুরুহা তথা ।
একাদশ্যান্তু যো ভুঙ্ক্তে বিষ্ণুলোকাচ্চ্যুতো ভবেৎ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।২১ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“যে ব্যক্তি একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, সেই ব্যক্তি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা ও গুরুহত্যার পাপ সকল প্রাপ্ত হয় এবং বিষ্ণুলোকে কখনও গমন করতে পরে না, বা বৈষ্ণবধর্ম্মচ্যুত হওয়ায় বৈষ্ণব সঙ্গ পায় না ।”
ইত্যাদি শাস্ত্র প্রমাণ অনুসারে শ্রীএকাদশীতে উপবাস করা কর্ত্তব্য ।
প্রশ্ন: উপবাস কাহাকে বলে ?
উত্তর: নিকটে বাস—গৃহকার্য্য-বিষয়কার্য্যাদি পরিত্যাগ করে ভগবানের নিকটে বাস । যথা—
উপাবৃত্তস্য পাপেভ্যো যস্তু বাসো গুণৈঃ সহ ।
উপবাসঃ স বিজ্ঞেয়ঃ সর্ব্বভোগবিবর্জ্জিতঃ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১৩।৩৫ সংখ্যায় বৃহন্নারদীয়পূরণ-বাক্য)
“সকল পাপ হতে নিবৃত্ত হয়ে সদ্গুণ সমূহের সহিত যে মনুষ্যের বাস হয়, তাহাকে উপবাস বলে, এই উপবাসে সমস্ত ভোগ বর্জ্জিত জানতে হবে” ।
বৈষ্ণবো যদি ভুঞ্জীত একাদশ্যাং প্রমাদতঃ ।
বিষ্ণ্বর্চ্চনং বৃথা তস্য নরকং ঘোরমাপ্নুয়াৎ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।৩২ সংখ্যায় ব্রহ্মবৈবর্ত্তপূরণ-বাক্য)
“বৈষ্ণব যদি ভ্রম বশতঃ একাদশীতে অন্ন ভোজন করে, তবে তাহার বিষ্ণুপূজা বিফল হয় এবং তাহার ভয়ঙ্কর নরক প্রাপ্তি হয়” ।
প্রশ্ন: কিভাবে শ্রীহরিবাসর তিথি পালন করতে হবে ?
উত্তর: শ্রীহরিবাসরের মূলকৃত্য শ্রবণ, কীর্ত্তনাদি নববিধা-ভক্তি যজন । যেমন শ্রীমন্মহাপ্রভু বলেন (শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১০,২১)—
শ্রীহরিবাসর-দিনে কৃষ্ণনামরসপানে তৃপ্ত হয় বৈষ্ণব সুজন ।
অন্য রস নাহি লয় অন্য কথা নাহি কয় সর্ব্বভোগ করয়ে বর্জ্জন ॥
শ্রীনামভজন আর একাদশী ব্রত ।
এক-তত্ত্ব নিত্য জানি’ হও তাহে রত ॥
শ্রীহরি-বাসরে অধিক কীর্ত্তনদ্বয় করণীয়—সকালে শ্রীহরিবাসরে হরিকীর্ত্তন-বিধান ও রাত্রিতে শুদ্ধ ভকত-চরণ-রেনু ভজন-অনুকূল । শ্রীহরিবাসরে উপবাস এবং পারণ করা কর্ত্তব্য, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—
প্রসাদ ভোজন নিত্য শুদ্ধ বৈষ্ণবের কৃত্য অপ্রসাদ না করে ভক্ষণ ।
শুদ্ধা একাদশী যবে নিরাহার থাকে তবে পারণেতে প্রসাদ ভোজন ॥১১॥
পঞ্জিকায় উল্লিখিত পারণ সময়ের মধ্যে শ্রীএকাদশী ব্রত ভঙ্গের জন্য মহাপ্রসাদাদি গ্রহণ অবশ্য কর্ত্তব্য । শ্রীহরিবাসরে যেন সারাদিন সেবা-সাধনে থাকা যায় তার জন্য শাস্ত্র অনুমোদিত অনুকল্প গ্রহণীয়, যেমন (প্রেমবিবর্ত্ত: ১৮।১১)—
অনুকল্পস্থানমাত্র নিরন্ন প্রসাদপাত্র বৈষ্ণবকে জানিহ নিশ্চিত ।
শ্রীএকাদশীতে অনুকল্প আয়োজন এই রূপ—
অষ্টৈতান্যব্রতঘ্নানি আপো মূলং ফলং পয়ঃ ।
হরির্ব্রাহ্মণকাম্যা চ গুরোর্বচনমৌষধম্ ॥
(শ্রীহরিভক্তিবিলাস ১২।১০০ সংখ্যায় মহাভারত-বাক্য)
“জল, ফল, মূল, দুগ্ধ, ঘৃত ও ব্রাহ্মণ প্রার্থনীয়, গুরুবাক্য ও ঔষধ—এই আটটি ব্রতনাশক হয় না” । শ্রীমঠে ভক্তগণ এইভাবে অনুকল্প গ্রহণ করেন—
সকালে—পূর্ণ উপবাস ।
মধ্যাহ্নে—লবণ, গোল মরীচ, জীরা, আদা সহ আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বিভিন্ন ফল (কলা, শশা আদি), বাদাম, পেপে মিষ্টি আলু পায়েস বা সাগু ।
রাত্রিতে—আলু পেপে তরকারি, আলু ভাজা, বাদাম, দুধ ।
শুধু ঘি, বাদাম তেল, সূর্য্যমুখী তেল ব্যবহার করা যাবে । শস্যযুক্ত কোন দ্রব্য যেমন গুড়া মশলা, ময়দাযুক্ত সাগু ইত্যাদি গ্রহণ করা যাবে না । সেইজন্য ঘরের তৈরী ঘি, ছানা অথবা নারকেল মিষ্টি দ্রব্য গ্রহণ করা যাবে । এই সকল পঞ্চ রবিশস্য অবশ্যই বর্জ্জনীয়—(১) ধান্য অথবা ধান্যজাতীয় দ্রব্য—চাল, চিড়া, মুড়ি প্রভৃতি, (২) গোধূম—আটা, ময়দা প্রভৃতি, (৩) যব—যবের ছাতু, বার্লি প্রভৃতি, (৪) ডাল—মুগ, মসূর, ছোলা, মটর, অড়হর, কলাই, খেসারি প্রভৃতি, (৫) সরিষার তৈল ও তিল তৈল ।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন